- তানভীর আকন্দ
পুলিশ সদস্য কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আমেরিকায় বর্তমানে চলমান বিক্ষোভ নিয়ে চমস্কির সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভ্যালেন্টিনা নিকোলাই। গত ২রা জুন, ইতালিয়ান দৈনিক ‘ইল মেনিফেস্তো’তে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। ৩রা জুন পত্রিকাটির আন্তর্জাতিক সংস্করণে ইংরেজিতে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। বর্তমান অনুবাদটি সেই ইংরেজি সংস্করণ থেকেই করা হয়েছে। এ সাক্ষাৎকারে চমস্কি যুক্তি দেখান যে এই বিক্ষোভ সাময়িক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয় বরং ৪০০ বছর ধরে চলতে থাকা আমেরিকান সমাজ ও রাষ্ট্রের বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদেই এই
বিক্ষোভ । – অনুবাদ
সাক্ষাতকার
যুক্তরাষ্ট্র জ্বলছে। কালো ও সাদারা একযোগে রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করছে, থামবার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। একাধিক শহরে জারি করা হয়েছে কারফিউ।
করোনা সংকট, বেকারত্ব এবং সামাজিক বৈষম্যের কারণে ইতোমধ্যেই ক্ষুব্ধ হয়ে থাকা জনগণের সাথে কোনোরকম আপোষে যাওয়ার তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না মার্কিন সরকার, বিশেষ করে ট্রাম্পের কথা ও কাজে ( “আইন ও শাসন“ নিয়ে তার সর্বশেষ বক্তব্য একটি টেলিভিশন নাটকের কথা মনে করিয়ে দেয়)।
দাঙ্গার ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ বোঝার জন্য আমরা প্রফেসর নোম চমস্কিকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। দুনিয়াজুড়ে আমেরিকার রাজনীতি ও সমাজ বিষয়ে প্রসিদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যে একজন তিনি।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ পরিণত হয়েছে দাঙ্গায়, যা মিনেপোলিশ শহর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে পেন্টাগন সামরিক পুলিশকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছে। প্রফেসর চমস্কি, যুক্তরাষ্ট্রে আসলে কী ঘটছে? বর্ণবাদ ও শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সদস্যের দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহারের বাইরে আরও গভীর কিছু কি রয়েছে এই বিক্ষোভের পেছনে?
গভীরে যা আছে তা হলো ৪০০ বছরের নির্মম অত্যাচারের ইতিহাস: প্রথমত, মানব ইতিহাসে দাসত্বের সবচেয়ে জঘন্যতম ব্যবস্থা, যা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (এবং যুক্তরাষ্ট্রেরও) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মূল ভিত্তি। এরপর ১০ বছরের জন্য আসে স্বাধীনতা, যেখানে কালোরা সমাজে প্রবেশ করার অধিকার পায়, অসাধারণ সাফল্যের সাথে তারা সেটা করেছিলও। তারপর উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে চুক্তি যার ফলে সাবেক দাস রাষ্ট্রগুলো নিজের মতো করে চলার অনুমতি পায়। কালো মানুষদের অপরাধী হিসেবে তুলে ধরতে তারা যা করেছিল তা হলো “ভিন্ন নামে দাসপ্রথা“ প্রতিষ্ঠা করা। এ বিষয়ে লেখা গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটির শিরোনাম এটি।১
প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত কার্যকর ছিল এটা, যখন দরকার ছিল শ্রমের। তারপর আপেক্ষিক স্বাধীনতার যুগ আসে। বর্ণবাদী আইনের দ্বারা এর পথ রুদ্ধ করা হয়। এতটাই চরমপন্থী আইন ছিল এটা যে নাৎসিরা পর্যন্ত একে খারিজ করে এবং ফেডারেল আইনের দ্বারা যুদ্ধের পর সরকারি অর্থায়নে তৈরি আবাসনে কালোদের পৃথকীকরণ২ করে দেয়া হয়। যুদ্ধফেরতদের বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষার কর্মসূচি থেকেও কালোদের (এবং নারীদের) বাদ দেয়া হয়। আর তারপর আসে কালোদের অপরাধীকরণের আরও একটা ধাপ।
এর ফলাফল সহজেই অনুমান করা যায়। বর্ণবাদ বহাল থাকে, যদিও আগের থেকে এর তীব্রতা কিছুটা কম। আর যখনই ফ্লয়েড হত্যার মাধ্যমে এই বর্ণবাদের প্রকাশ ঘটে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বিস্ফোরণ ঘটে। শ্বেতাঙ্গদের একটা বড় অংশ এতে অংশগ্রহণ করে, যা জনগণের অন্তত কিছু অংশ যে এই জঘন্য অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে তারই প্রতিফলন।
আপনার কি মনে হয় সাম্প্রতিক কালে ফুঁসে উঠা এ বিক্ষোভে বৈশ্বিক মহামারির কোনো ভূমিকা আছে? এটা কি দেশের বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের গভীর সংকটকেই সামনে তুলে আনছে? নাকি এটা কিছুদিন ধরে জমতে থাকা বারুদে আগুনের স্ফূলিঙ্গ ছুড়ে দিয়েছে মাত্র?
বৈশ্বিক মহামারি কিছু সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে। যেমন, করোনা সংক্রমণে কালোদের মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গদের তিনগুণ। ট্রাম্পের বদমায়েশিরতো কোনো শেষ নেই, মহামারির সুযোগ নিয়ে সে বায়ুদূষণ সংক্রান্ত নীতিমালাগুলো তুলে দিয়েছে, যার বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছে বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে। বিজনেস প্রেসের হিসাব অনুযায়ী দশ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হতে পারে এর ফলে। এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যাই বেশি, যারা মূলত সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বাস করে। এই তথ্য জনমতকে কীভাবে প্রভাবিত করবে সেটা নির্ভর করে তথ্যগুলো আসলে কতটুকু বর্ণবাদী যুক্তিতে আচ্ছন্ন।
কোনো পরিস্থিতিতেই কি ক্ষুব্ধ জনতার এরকম সহিংস হয়ে উঠা ন্যায়সঙ্গত হয়?
এর উত্তর বেশ সহজেই অনুধাবন করা যায়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্বাভাবিকভাবেই এটা আরও কঠোর নিপীড়নের প্রতি জনসমর্থন তৈরি করে দেয়।
বিক্ষোভের জবাবে ডোনাল্ট ট্রাম্প টুইট করেন “লুটপাট শুরুতো, গুলিও শুরু“। পরে তিনি সেটা সরিয়ে ফেলেন, কিন্তু ততক্ষণে আগুনে যথেষ্ট পরিমাণ ঘি ঢালা হয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উস্কানির কথা বাদ দিলে আর ঠিক কী কারণে এই উক্তি আমেরিকান সমাজকে এত প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে? সেটা যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন। আপনি কি মনে করেন সেই “আদি পাপ, আমাদের জাতিকে আজও যা কলঙ্কিত করে রেখেছে“ (জো বাইডেনের উক্তি) ট্রাম্পের উপস্থিতিতে তার ভার বেড়ে গেছে আরও অনেক বেশি? তার এই উত্তেজিত বাগাড়ম্বর কি তাকে পোলে এগিয়ে যেতেও সাহায্য করবে? এখন যেখানে বাইডেন এগিয়ে আছেন?
৫০ বছর আগে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জবাবে ফ্লোরিডার এক মেয়রের কথাকেই পুনরাবৃত্তি করেছে ট্রাম্প।৩ এর মানে বেশ স্পষ্ট, যদিও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লে ট্রাম্প এ নিয়ে মিথ্যা সাফাই গাওয়া শুরু করে। দাবি করে যে সে আসলে বুঝাতে চেয়েছে লুটপাটকারিরাই গুলি ছুঁড়বে। ট্রাম্প আসলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে, শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিগুলো টেনে এনে ট্রাম্প এই ‘কলঙ্গের দাগ’ আরও বড় করছে, এটা তার নির্বাচনের ভিত্তি। তবে জনমতে এর প্রভাব অনুমান করা আসলে কঠিন।
উদারনৈতিকদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আপনার কী মত? সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো থেকে উদারনৈতিক ও বাইডেনের শিক্ষা নেয়ার মতো কি কিছু আছে?
শিক্ষা নেয়া উচিত। তবে নেবে কি নেবে না সেটা দেখার বিষয়।
শেষ আরেকটি প্রশ্ন। আপনি “কালো মানুষদের অপরাধীকর’’-এর কথা বলেছেন, আপনার বইগুলোতে প্রায়ই এটা নিয়ে বলে থাকেন আপনি। সংক্ষেপে একটু ব্যাখ্যা করবেন কি, আমেরিকার সমাজ ও অর্থনীতিতে এটা কীভাবে কাজ করেছে এবং এখনো করছে?
এই বাক্যাংশের কৃতিত্ব আমার নয়। আমেরিকার সমাজ নিয়ে আলোচনাগুলোতে এটা বেশ পরিচিত। ঊনিশ শতকের শেষাংশে সাবেক দাস রাজ্যগুলোতে৪ এটি বেশ সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ ছিল। কোনো কালো মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে, ভবঘুরে অভিযোগে তাকে বন্দি করা হতো, এমন একটা জরিমানা ধরিয়ে দেয়া হতো যা তার পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। তাকে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হতো। যেখানে নানা কাজে তাকে শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো যাবে, এমন শ্রমিকের কোনো বিকল্প হয় না যে কিনা নিয়মনিষ্ঠ, কোনো প্রতিবাদ করবে না আর সস্তায় কাজ করানো যাবে। সে সময়ের বিপ্লব প্রতিষ্ঠা ও কৃষিব্যবসার পেছনে একটা বড় ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছিল এটা।
অপরাধীকরণের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে। ১৯৮০ সালে, তার দায়িত্বগ্রহণের সময় কারারোধের পরিমাণ ইউরোপের সমান ছিল। এরপরই বিস্ফোরণ ঘটে, ইউরোপকে ছাড়িয়ে সংখ্যাটা অনেকদূর এগিয়ে যায়। কারারুদ্ধদের মধ্যে কালোদের সংখ্যাটা ছিল আনুপাতিক হারে অনেক বেশি । এর পেছনে আংশিকভাবে দায়ী ছিল মাদকযুদ্ধের প্রভাব, বাকিটাকে কালোদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতার হার বেশি হওয়ার সাথে সম্পর্কিত করা যায়। দ্বিতীয় কারণটিকে প্রায়ই বর্ণবাদী যুক্তির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। কিন্তু কালোদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কেন বেশি এই প্রশ্নকে আড়াল করা হয়। এটাই নিপীড়িত সমাজের বৈশিষ্ট্য। আর কাৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে এটাতো আরও অনেক বেশি গুরুতর।
অনুবাদকের টীকা
১. ভিন্ন নামে দাসপ্রথা- ডগলাস এ. ব্ল্যাকমন এর লেখা বই Slavery by Another Name: The Re-Enslavement of Black Americans from the Civil War to World War II এর কথা বলছেন চমস্কি। ২০০৮ সালে এনকর বুকস থেকে প্রকাশিত হয় বইটি।
২. পৃথকীকরণ (segregation/Racial segregation) – বলতে পদ্ধতিগতভাবে কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোকেদের সামাজিকভাবে আলাদা করে দেয়াকে বুঝায়। আইনের দ্বারা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক স্থান যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পার্ক, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিতে স্বাভাবিকভাবে প্রবেশ ও চলাফেলার অগ্রাধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয় এর মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ফেডারেল হাউজিং এডমিনিস্ট্রেশান (FHA) ও ভেটারানস এডমিনিস্ট্রেশানের (VA) মাধ্যমে নাগরিকদের স্বল্প সুদে আবাসন ব্যবস্থা প্রদান করে। এই প্রকল্প থেকে লিখিতভাবে সরাসরি কৃষ্ণাঙ্গদের বাদ দেয়া না হলেও, উদ্যোক্তারা কৌশলে সারা দেশজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিতএলাকাগুলোকে এই প্রকল্পের আওতা থেকে বাদ দিতে থাকে। যার ফলে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে স্পষ্ট বিভেদের সৃষ্টি হয়। নিচের লিংকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা আছে-
৩. ১৯৬৭ সালে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মায়ামি পুলিশ প্রধানের বক্তব্য। সে সময় কিশোর বয়েসিদের উপর লুটপাটের অভিযোগ এনে পুলিশকে সহিংস উপায়ে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন তিনি।
৪. ১৮৬৫ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্রের যেসমস্ত রাজ্যগুলোতে দাস ব্যবসা বৈধ ছিল সেগুলোকে দাস রাজ্য বলা হতো। ১৮৬৫ সালে সংবিধানের তেরতম সংশোধনীর মাধ্যমে সমগ্র আমেরিকাজুড়ে দাসপ্রথার পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। এবং দাস রাজ্য ও স্বাধীন রাজ্য বলেও আলাদা কিছু আর থাকে না।