অরাজ
আর্টওয়ার্ক: করোনা শিল্পী: আলেসান্দ্রো সিভিগলিয়া সূত্র: সাচ্চি আর্ট
প্রচ্ছদ » আদিত্য নিগাম।। পুঁজিবাদের পরের জীবন এবং নয়া শাতিরীয়-কোপার্নিসীয় বিপ্লব

আদিত্য নিগাম।। পুঁজিবাদের পরের জীবন এবং নয়া শাতিরীয়-কোপার্নিসীয় বিপ্লব

অনুবাদ: সারোয়ার তুষার

অনুবাদকের ভূমিকা : আদিত্য নিগাম ইন্ডিয়ান চিন্তক এবং Centre for the Study of Developing Societies (CSDS)-এর ফেলো। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে পুঁজিবাদ পরবর্তী সম্ভাব্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিন্যাস নিয়ে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখছেন। গত ০৯ই এপ্রিলে দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে Kafila.Com ওয়েব পোর্টালে, শিরোনাম Life after capitalism and the new ‘al Shatir-Copernicus’ revolution-A Manifesto of Hope (পুঁজিবাদের পরের জীবন ও নয়া শাতিরীয়-কোপার্নিসীয় বিপ্লব: আশার ইশতেহার) । ভারত’সহ বাংলাদেশ ও অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর বাস্তবতায় আদিত্য নিগামের প্রবন্ধটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই সিরিজের প্রথম কিস্তির ( করোনা জৈব-রাজনীতি ও পুঁজিবাদের পরের জীবন: আশার ইশতেহার ) অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

আদিত্য নিগম

এই সিরিজ প্রবন্ধে আদিত্য নিগাম বিশ্বপরিসরে করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত আলাপ-আলোচনা-তর্ক উঠেছে, সেগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করার মাধ্যমে পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজের সম্ভাব্য রূপরেখার ইঙ্গিত করার চেষ্টা করছেন। করোনা মহামারীর ফলে একটা ভিন্ন সমাজের বিমূর্ত স্বপ্ন আরও প্রবলভাবে মূর্ত হয়ে উঠছে বলে মনে করেন তিনি। এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ইতিহাসচেতনা- চিন্তাচর্চা ও সক্রিয়তাই কেবল পারে পৃথিবীতে মানুষের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে।

আদিত্য নিগাম মূলত সামাজিক-রাজনৈতিক তত্ত্বের বিউপনিবেশায়নে বিশেষভাবে আগ্রহী। এই প্রবন্ধেও আমরা দেখব, তিনি পুঁজির ধারণার পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। পুঁজি বিশ্লেষণের সনাতনি ঐতিহাসিক ভ্রান্তিই যে বিগত শতকগুলোর সমস্ত সামাজিক বিপ্লবকে মহাদানবীয় সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রীয় গাড্ডায় নিক্ষেপ করেছে আদিত্য নিগাম তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। বিশেষত, এই কিস্তিতে তিনি ‘অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি’, ‘সংহতি অর্থনীতি’ ইত্যাদি ধারণাগুলোর তাত্ত্বিক ভিত্তি ও বিশ্বের নানা জায়গায় এ ধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতির বিরাজমান থাকা এবং রাষ্ট্র ও পুঁজির বাইরে বিদ্যমান সমাজের গর্ভেই অপেক্ষাকৃত নতুন এই ধারাগুলোর আরো বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনার দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। চতুর্দশ শতকের সিরীয় আরব জ্যোতির্বিদ আল শাতির ও ষোড়শ শতকের পোলিশ জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রীক সৌরজগত তত্ত্বের আলোকে সমাজবিজ্ঞান ও দার্শনিক বিবেচনায় প্রকৃতির সাথে মানুষের অন্টোলজিকাল বা অস্বিত্বসম্বন্ধীয় সম্পর্কের প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। একেই নিগাম বলছেন ‘নয়া শাতিরীয়-কোপার্নিসীয়’ বিপ্লব।

এই ধরনের ইতিহাস ও চিন্তাচর্চা পৃথিবীর উপর মানুষের সার্বভৌমত্ব /উপনিবেশ নাকচ করে দিয়ে মানুষকে ‘বায়োলজিকাল এজেন্ট’ হিসেবে প্রস্তাব করে। মানুষও আর দশটা প্রজাতির মত এক প্রজাতি, অধীশ্বর নয়। মানুষের ইতিহাস মানে মানুষের ‘নায়ক’ হবার ইতিহাস না, অন্তত ‘recorded history’ যেভাবে দেখাতে চায়; বরং ‘deep history’ অনুযায়ী মানুষের ইতিহাস আসলে ‘জীবনের ইতিহাস’-এর অংশ, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি পরস্পরের সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা— দুই সম্পর্কেই আবদ্ধ। (দীপেশ চক্রবর্তী , ‘আরেক টোয়েন্টি টোয়েন্টি: পৃথিবীর উষ্ণতা-বৃদ্ধি ও মানুষের ইতিহাস’; ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ ; আনন্দ পাবলিশার্স, তৃতীয় মুদ্রণ,২০১৬, কলকাতা)

এ রকম একটা সামাজিক রূপান্তর সম্ভব বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রূপান্তরের মাধ্যমেই।

আর্টওয়ার্ক: আয়রন রোলিং মিল
শিল্পী: এডলফ মেনজেল
সূত্র: ভাস্কো

পুঁজিবাদের পরের জীবন এবং নয়া শাতিরীয়কোপার্নিসীয় বিপ্লব: আশার ইশতেহার

এই নিবন্ধটির গত কিস্তিতে, আমি কোভিড-১৯ থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদ-পরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য বিশ্বব্যাপী লকডাউন এবং ‘ভোগের কোয়ারেন্টিন’-এর তাৎপর্য নিয়ে আলাপ করেছিলাম। এই কিস্তিতে, আমি দুটো বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই :

(ক) সেই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করব যা এই ধরনের ভবিষ্যতকে কেবল কল্পনাযোগ্যই নয়, বরং সম্ভব করে তোলে। এবং

(খ) এমন দিকের নির্দেশ করব যা এই সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করছে— এমন সব উপায়ের দিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি যা আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের দিকেই ধাবিত করে।

তত্ত্ব / ধারণা / ডিসকোর্স

যেহেতু পুঁজিবাদ-উত্তর ভবিষ্যতের সমস্ত আলোচনাই আমরা আমাদের বাইরের জগতটাকে ঠিক যতটা হ-য-ব-র-ল অবস্থায় দেখি ততটাই নিদারুণ আকাশকুসুম কল্পনা কিংবা সামঞ্জস্যহীন বলে মনে হয়, তাই প্রথমেই আমাদের চিন্তার জগত কিছুটা ঘষামাজা করে নেয়া দরকার। এবং খুব স্পষ্টভাবে বলা যাক যে এই ‘চিন্তার জগতে ঘষামাজা’র অর্থ কোনভাবেই অনুশীলনের জগতে ঘষামাজা নয়, বরং জ্ঞানকাণ্ড তত্ত্বের ঘষামাজা। এছাড়াও কোন গোঁড়া হিস্টেরিয়াগ্রস্ত বস্তবাদী—যার কাছে তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া কেবলই ‘ভাববাদ’ এবং ‘আসল’ ব্যাপার হচ্ছে বস্তুবাদিতা, সব ঘটে কেবল ‘রাজপথে’— তার খপ্পরে পড়ার আগে আমি অন্তত তিনটা বিষয় খোলাসা করতে চাই।

প্রথমত, অতিশাস্ত্রবাদীদের জন্য আমি লেনিনের দোহাই পাড়তে চাই। লেনিন ক্রমাগত বলে গেছেন ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন একটা কাঠালের আমসত্ত্ব।’ ( কী করিতে হইবে?) শুধু তাই নয়, কাউটস্কির পরে তিনিই জোর দিয়ে বলে গেছেন, নিজস্ব তত্ত্ব ছাড়া শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন কেবলমাত্র ‘ট্রেড ইউনিয়নের চেতনা’ উৎপাদন করতে পারে এবং শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে ‘সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব’ বাইরে থেকে  (মূলত বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে) আমদানি করতে হবে। এই চিন্তাভাবনাই বিপ্লবের ‘রাখাল বালক’ তত্ত্ব  (vangurdism) সহ যাবতীয় মুসিবত নিশ্চিত করেছিল, কিন্তু আপাতত আমরা এই বিষয়টা তুলে রেখে সামনে অগ্রসর হব।

দ্বিতীয়ত, (এবং এখানে বিষয়গুলো জটিলতর হয়) দুনিয়ার যে কোনও ‘আন্দোলন’-এর দিক নজর দিলে তত্ত্ব/ডিসকোর্স এবং অনুশীলনের মধ্যকার সম্পর্কের একই প্যাটার্ন উন্মোচিত হবে। লেনিন যা বলেছিলেন তা কেবল মার্কসবাদ কিংবা সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, বরং নারীবাদ, পরিবেশবাদ, ক্যুইয়ার রাজনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রেও সত্য। এমনকি, আদিকালের মহান ধর্মীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য— সবগুলো আন্দোলনই আগে নিজেদের ইশতেহার পেশ করেছে এবং পূর্ববর্তী প্রতাপশালী মতবাদ থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র হিশেবে জাহির করেছে। আমাদের সময়ের জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এটি কম সত্য নয়। আসলে, ‘আধুনিকতা’র ক্ষেত্রেও এই কথাই প্রযোজ্য, যা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই— বিভিন্ন ক্ষেত্রের আন্দোলনের ফলাফল ছিল এই ‘আধুনিকতা’। আধুনিকতার ডিসকোর্স কেবল কিছু ঘটনার পরম্পরা, অনুশীলন এবং প্রতিষ্ঠানকেই বিবৃত করেনি, বরং এগুলোকে আদর্শিকভাবে কাঙ্ক্ষিত এবং গঠন করেছিল। এর ডিসকোর্সই আধুনিক রাষ্ট্র ও আইন বলতে যা বিরাজমান তার ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং রাষ্ট্র কিভাবে কার্যকর থাকবে তা নিশ্চিত করেছিল।

‘তত্ত্ব’ বা ধারণাকে ‘সত্য’ হতেই হবে এমন কোন দিব্যি নেই ( উদাহরণস্বরূপ হিন্দুত্ববাদের কথা চিন্তা করুন), তবে দেল্যুজ ও গুয়াত্তারি যেমন বলতেন, ‘এটা অনুরণন সৃষ্টি করে’ এবং ক্ষেত্রটিকে একটি নির্দিষ্ট রূপে বিন্যস্ত করে দেয়।(দেল্যুজ এবং গুয়াত্তারি, দর্শন কী?) একটি ধারণার বিবৃতি আসলে সুনির্দিষ্ট অনুশীলনকে দৃশ্যমান (এবং বোধগম্য) করে যা ইতোমধ্যেই হয়তো বিরাজমান আছে অথবা অভিজ্ঞতার নির্দিষ্ট সেটগুলোকে এমনভাবে মূর্ত করে যার মর্ম বহুসংখ্যক মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে। সুতরাং, আমরা বলতেই পারি, যে ‘ক্যুইয়ার’ যৌন চর্চা সম্ভবত ইতিহাসে বরাবরই ছিল, কিন্তু যেই কিনা সংশ্লিষ্ট তত্ত্বসমূহ ভাষায় প্রকাশিত হতে শুরু করল, তখনই আমাদের দর্শনক্ষেত্রে এর আবির্ভাব ঘটল। এটা কেবল অতীতের এমন যৌনচর্চার অস্তিত্ব সম্পর্কেই আমাদের জ্ঞাত করেনা। বরং একটা পূর্বশর্ত হিসেবে যৌনতার ‘বিষমকামী ছাঁচ’কেও (heterosexual matrix) পরিস্কার করে (জুডিথ বাটলার), যেটি নারী-পুরুষ ভিন্ন সকল লিঙ্গীয় পরিচয়কে আড়াল করে ফেলেছে। এই ধারণার আত্মপ্রকাশ আমাদের তাৎক্ষণিকভাবেই দেখিয়েছে, যৌনতার বাইনারি বিভাজনের প্রমিতকরণে কী পরিমাণ প্রচেষ্টা, সময় ও বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং ‘অস্বাভাবিক’, মধ্যবর্তী (in-between) চর্চাগুলোকে চিকিৎসাব্যবস্থার অধীনস্থ করা হয়েছে।

জে. কে গিবসন-গ্রাহাম তাঁদের ‘পুঁজিবাদের পরিসমাপ্তি: রাজনৈতিক অর্থনীতির নারীবাদী পর্যালোচনা’ (১৯৯৬) বইতে ঠিক এরকমই কিছু একটা যে ‘অর্থনীতি’র ক্ষেত্রেও ঘটেছে তা অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখিয়েছেন । ক্যুইয়ার পুঁজিবাদে  গিবসন-গ্রাহাম মূলত এটাই দেখিয়েছেন যে, অর্থনীতি কেবল পুঁজি আর শ্রমের সমন্বয়েই গঠিত না (পুঁজিকেন্দ্রিক প্রবণতা, জেন্ডারের ফ্যালাসকেন্দ্রিকতার অনুরূপ)। বরং নানাবিধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপ এবং লেনদেনের সাথে বিজড়িত থাকে, যা আমাদের প্রচলিত তাত্ত্বিক কাঠামো/ছাঁচগুলো আড়াল করেছে। গিবসন ও গ্রাহাম তাঁদের নিজস্ব অবস্থান আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রকে ধরে তাদের এই অভিঘাত সৃষ্টি করলেও, এই কাজ পৃথিবীর অন্যত্র অবস্থিত সমাজগুলোর বিচিত্র ক্ষেত্রের বোঝাপড়া আমাদের জন্য সহজ করেছে। ইন্ডিয়ার মত ‘না-আদর্শনিষ্ঠ অর্থনীতি’র (non-normative economics) জয়জয়কারের দেশে তো বটেই। এগুলো অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির কৃষি উৎপাদন, সমবায়, ক্ষুদ্রঋণ এবং মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠী (উত্তরভারতে যাদের ‘কমিটি দালনা  নামে ডাকা হয়), পণ্য ফেরি করা, রিকশা চালানো, বেচাকেনা ইত্যাদির মতন বিভিন্ন খাতগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই খাতগুলোকে অতীতের ক্ষয়প্রাপ্ত চিহ্ন হিশেবে অন্তর্ভুক্ত করছে না যে এগুলোকে মুছে ফেলতে হবে কিংবা ‘আনুষ্ঠানিক’ (পড়ুন কর্পোরেট) খাতে বিলীন করে দিতে হবে। বরং এই খাতগুলোকে পুঁজিবাদ-উত্তর অর্থনীতির জন্য আরো সুগঠিত এবং শক্তিশালী করতে হবে। আমি পরে এই খাতগুলোর সম্ভাবনা নিয়ে আরো বিশদ আলোচনা করব, আপাতত শুধু এটুকু উল্লেখ করে রাখছি যে: গিবসন-গ্রাহামের বই লেখার প্রায় আড়াই দশক আগে কেনিয়ার ‘অনানুষ্ঠানিক’ খাতগুলো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান মিশন আশ্চর্যজনক তথ্যের মুখোমুখি হয় : প্রত্যাশা অনুযায়ী ‘গতানুগতিক’ খাতগুলো তো সংকুচিত হয়ইনি, বরং আরো বিস্তৃত হয়েছে। তারও কয়েক বছর আগে ঘানা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানী কেইথ হার্টও একই সিদ্ধান্তে আসেন এবং ‘গতানুগতিক খাতের’ বদলে ‘অনানুষ্ঠানিক খাতের’ ধারণার প্রস্তাব করেন। এই ধারণার সারবক্তব্য ছিল, এই খাতগুলোকে অতীতের অবশিষ্টাংশ হিশেবে না দেখে সমকালীন হিশেবে চিহ্নিত করা। আইএলও ‘অনানুষ্ঠানিকতা’ বিষয়ক হার্টের পরিভাষাটি গ্রহণ করে এবং একে ‘ধারণাগত আবিষ্কার’ হিশেবে আখ্যায়িত করে যা এ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার পাটাতনই বদলে দিয়েছে।

টিমোথি মিচেল (বিশেষজ্ঞদের বিধি) ও মিশেল কলনের মতো পণ্ডিতদের আরও একটি অভিঘাত এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল: ‘অর্থনীতি’ একটি কল্পিত নির্মাণ বলার পরিবর্তে, তাঁরা (বিশেষত মিচেল) দেখিয়েছেন যে বিশেষত বিশ শতকের শুরুর দশকগুলোতে অর্থনীতি/সামষ্টিক-অর্থনীতি’র মতো উদীয়মান শাস্ত্রের মাধ্যমে ‘অর্থনীতি’ বলতে কোন একটা বাঁধাধরা ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এর বস্তুগততাকে (materiality) কোথাও অস্বীকার করা হয়নি, বরং এর উপর জোর দেওয়া হয়। ধারণাগত অভিঘাত ও কলকব্জার এক ধারাবাহিক পম্পরায় ‘অর্থনীতি’কে এই গুরুত্বের জায়গায় বসানো হয়েছে।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তির প্রশ্ন, যেটা আমরা ইতর মার্ক্সবাদী ঐতিহ্যসূত্রে পেয়েছি: এটি “উৎপাদন শক্তির ইহজাগতিক বিকাশ”কে একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিশেবে ব্যাখ্যা করে যেটি ধারণার জগতের ঘটমান সমস্তকিছুরই একটি অবধারিত ‘বস্তুগত ভিত্তি’ আছে বলে মনে করে (এইসব বিকশিত উৎপাদিকা শক্তির দ্বারা এমনকি উৎপাদন সম্পর্ক পর্যন্ত নির্ধারিত হয় বলে মনে করে)। যদিও বহু মার্ক্সবাদীই অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর ‘ধারণা’র বিকাশ ঘটে এই মত ত্যাগ করেছেন, তারপরেও মার্ক্সবাদী শিবিরের অনেকেই এখনো ‘অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ’-এর ভূত দ্বারা তাড়িত। তারা এখনো মনে করেন এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া, ফলে অপরিবর্তনীয়। এখন, এই মুহুর্তে সামান্য আলোকপাত করেই দেখানো সম্ভব যে প্রযুক্তির বিকাশে এমনকি ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন না কোন উন্নতির ফলাফল; এটি আপনাআপনি নিজের মর্জিমাফিক ঘটেনা। যেকোন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বা যুগান্তকারী উদ্ভাবন (যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার [এআই] উদাহরণ দেয়া যেতে পারে) জ্ঞানজগতে তাত্ত্বিক ক্রমবিকাশের একটি যৌক্তিক পরিণতি। তবে, কোন প্রযুক্তি গ্রহণ করা হবে এবং প্রভাবশালী হবে তা কর্পোরেশনগুলোর সম্ভাব্য ভবিষ্যত মুনাফার হিসাবনিকাশের উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় এবং সেই অনুযায়ী সরকারি পলিসি ও বিনিয়োগের পরিমাণ ওঠানামা করে। কোনও প্রযুক্তিই ‘আপনাআপনি’ বিকশিত হয়না এবং যেহেতু মুনাফা ও রাষ্ট্রীয় নজরদারির কথা মাথায় রেখে সুনির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ( যেমন, শ্রম সাশ্রয়), পাশার দান সবসময়ই উল্টে দেয়া যায়।

হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই বিশ শতকে ফিরে যেতে পারি না এবং তখনকার দিনে নেয়া প্রযুক্তি সম্পর্কিত পশ্চাদমুখী সিদ্ধান্তগুলোকে ফিরিয়ে আনতে পারিনা, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের দর্শন অবশ্যই নতুন করে পরখ করা কিংবা পুনরায় কল্পনা করা যেতে পারে। তবে পুঁজির প্রয়োজনের সাথে খাপ খেলে এমন পরিবর্তন হতেই থাকে। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যখন বিশ শতকের শেষের দিকে পুঁজি যেই ‘নমনীয় পুঞ্জিভবন’(flexible accumulation) এর পথ খুঁজে পেয়েছিল, তৎক্ষণাৎ বৃহৎ বৃহৎ কলকারখানা ও প্ল্যাণ্টের বিশ শতকীয় ফোর্ডিস্ট উৎপাদনের যুগ স্রেফ বাতিল ও পরিত্যাগ করা হয়েছিল। পরিত্যক্ত কারখানাগুলোর ল্যান্ডস্কেপ এখনও ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের অনেক জায়গায় রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু কিছু ইতোমধ্যেই পার্ক বা যাদুঘর এমনকি শপিংমলে পরিণত হয়েছে। এমনকি প্রয়োজনে বড় বাঁধগুলো বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাও মানবজাতির কাছে অজানা কোন প্রক্রিয়া নয়। চীন বিশ্বের বর্তমান শিল্পকেন্দ্র (এবং কোভিড-১৯ বিতর্কের কেন্দ্রস্থল) কেবল কারখানাগুলোই পরিত্যাগ করেনি বরং বিভিন্ন প্রদেশের ভূতুরে নগরীগুলোকেও পরিত্যাক্ত করেছে।

সংক্ষেপে বললে, প্রযুক্তি বা উন্নয়ন, না এমন কোন ‘অধীশ্বর’ যার অমোচনীয় ক্ষমতার কাছে দুনিয়াকে মাথা নত করতে হবে, না এগুলোকে অপরিবর্তনীয় ভাবার কোন যুক্তি ধোপে টেকে।

কোপার্নিকাস

নয়াকোপার্নিসীয়বিপ্লব

মার্কিন পরিবেশ বিশ্লেষক লেস্টার আর. ব্রাউনের কাজ থেকে এই পরিভাষাটি আমি নিয়েছি, যিনি প্রায় দুই দশক আগে এ সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। ব্রাউন নয়া কোপার্নিসীয় বিপ্লবের জরুরতের কথা বলেন, কিন্তু আমার যুক্তি হলো যে এটি আসলে অনেকদিন ধরেই চলমান। আদি উৎসের বিবেচনায়, আমাদের সম্ভবত এটিকে ‘আল শাতিরকোপার্নিকাস বিপ্লব বলা উচিত, কারণ আজকের দিনে এসে আমরা জানি কোপার্নিকাস মূলত সিরিয়ান জ্যোতির্বিদ ইবনে আল-শাতিরের মডেল ধরেই কাজ করেছিলেন। এই তথ্যটা অবশ্য পোলিশ কোপার্নিকাস নিজে কখনো লুকান নি, কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস থেকে এটি সুকৌশলে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। শাতিরীয়—কোপার্নিসীয় বিপ্লব যদি পৃথিবী মহাবিশের কেন্দ্র এবং সূর্য এর চারপাশে ঘোরে এই ধারণাটিকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে বর্তমানে আমরাও দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। এর উপাদানগুলো বেশ কিছু কাল ধরে বিরাজ করছে এবং নতুন ‘সার্বভৌম’ অর্থাৎ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে প্রকৃতিকে শোষণ এবং এর উপর আধিপত্য কায়েম করতে হবে কিংবা একে পোষ মানাতে হবে—আঠারো উনিশ শতক থেকে আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের জগতের প্রাণভোমরায় পরিণত হওয়া এই ধারণার মধ্যে যে মারাত্মক মৌলিক গলদ আছে এই উপলব্ধি ক্রমবর্ধমানভাবে বিস্তার লাভ করছে। ‘প্রকৃতি’কে কেবল ‘অর্থনীতি’র জন্য ‘সম্পদ’ ও ‘কাঁচামাল’-এর যোগানদাতা হিশেবে বিবেচনা করা হতো। ‘অর্থনীতি’ ছিল বৃহত্তর সেট; ‘প্রকৃতি’ ছিল এর উপসেট। এই ধারণার গোড়া খুঁজতে গেলে সেই কার্তেসীয় মুহুর্তের মুখোমুখি হতে হয়, যাকে ব্রুনো লাতুর[v] ‘মহা বিভাজন’ হিশেবে আখ্যা দিয়েছেন; ‘আধুনিক’ দুনিয়ার সেই ‘আবির্ভাব’ যখন ‘সমাজ’কে ‘প্রকৃতি’ থেকে আলাদা করা হলো, ‘মানুষ’কে ‘না-মানুষ’(Non-humans) থেকে আলাদা করা হলো। ফলে মানুষ হয়ে উঠল মহাবিশ্বের ‘কেন্দ্র’ এবং একটা স্বতন্ত্র সত্তা হিশেবে নিজস্ব বিধি-বিধানসহ ‘অর্থনীতি’ হয়ে উঠল মানব অস্তিত্বের কেন্দ্র। এই নতুন সত্তা ‘প্রগতি’র চিহ্ন হিশেবে আরো বেশি বেশি সম্পদ পুঞ্জিভবনের দর্শনকে বাস্তবে পরিণত করেছিল। আমরা এই মুহুর্তটিকে পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্ব সংস্কৃতির (Episteme) উত্থান আধিপত্যের সূচনাবিন্দু হিশেবে চিহ্নিত করতে পারি।

নতুন বিপ্লবের রূপরেখা এখনো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে এবং এটাকে নামকরণ করতে হবে। কিন্তু একদিক থেকে এটা কোপার্নিকাসদের সেই বিপ্লবের কথাই আমাদেরকে বলছে যে-পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়(প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে)। একইভাবে মানুষও মহাবিশ্বের কেন্দ্র না(সামাজিক বিজ্ঞানে ও দার্শনিক অর্থে)। নয়া বিপ্লব আমাদের জানান দিচ্ছে যে, নিজেদের ‘সার্বভৌমত্ব’ ও এবং ‘অর্থনীতি’র বৃহত্তর সত্তাকে (সেটাকে প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র অথবা যে নামেই ডাকুন না কেন) ছাপিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাস করা মানুষের জন্য আত্মঘাতী ও শিশুসুলভ বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রকৃতপক্ষে, আমরা এখন ভীষণ প্রতাপশালী ও বিশ্বজয়ী পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের সাথে সর্বত্র বিরাজমান এক মোহমুক্তি প্রত্যক্ষ করছি। যেহেতু বিশ্বজুড়ে আরও বেশি বেশি অঞ্চল তাদের সংস্কৃতি, তাদের পরিবেশ, তাদের জীবনযাত্রা ও সত্তার ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে। তারা জীবনযাত্রার ঐতিহ্যগত ধারণাগুলোর সাথে নিজেদের সাপেক্ষিক অস্তিত্বের সম্পর্ক বিনির্মাণের চেষ্টা করছে। এর বেশ কিছু নজির আমরা দেখতে পাচ্ছি আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে উবুন্টু, দক্ষিণ আমেরিকায় বুয়েন ভিভির, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভূটানের ‘সুখ’-এর মত জীবনদর্শনে। এই প্রত্যেকটি দর্শনই যে ধারণা প্রকাশ করে, তা অন্তত দুটি প্রতাপশালী পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের সরাসরি বিপরীত :

(১) ‘হোমো ইকোনমিকাস (homo economicus) নামক আত্মসর্বস্ব ‘যুক্তিবাদী’ ব্যক্তির ধারণা ;

(২) প্রকৃতিকে শাসন করা মানুষের ‘সার্বভৌমত্ব’-এর ধারণা।

উল্লেখিত জীবনদর্শনসমূহ মানুষকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সাথে বিজড়িত এক সত্তা মনে করে, যা কিনা অন্যান্য প্রজাতির মতোই স্রেফ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশীদার। এই ধারণাগুলোকে আর ‘প্রান্তিক’ আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিলুপ্তির পথে হাঁটা ‘অতীতমুখী’ অনুশীলন বলে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না, এতদিন পশ্চিম যেটা করে এসেছে। এই ধারণাগুলো ইকুয়েডর এবং বলিভিয়ার মতো দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

অবশ্যই শক্তিশালী কর্পোরেট পুঁজিবাদী স্বার্থের তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং উত্থান-পতন এই ধারণাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সাংবিধানিক ধারা হিশেবে এগুলো গণপরিসরে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে গৃহীত হচ্ছে। ইকোয়েডরের ক্ষেত্রে তো রীতিমতো গণভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়েছে। এগুলো আসলে প্রমাণ করে খোদ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ‘প্রধান ধারা’য় ধারণাগুলো জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতির খোদ ‘মূলধারা’ নিজেই বদলে যাচ্ছে।

এবং কেবলমাত্র আদিবাসীদের মধ্যেই প্রকৃতির বৃহত্তর সত্তার সাথে নিজেদের সাপেক্ষিক অস্তিত্বগত সত্তার পুনর্নিমাণের চেষ্টা দেখা যায় না, বরং এমনকি চৈনিক ও ভারতীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রকৃতির সত্তা হিশেবে নিজেদের পুনরায় যুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা লক্ষণীয়। চীন ও ভারতের এলিট সম্প্রদায় নিওলিবারেল পুঁজিবাদের ফাঁপা বুদবুদ ও ফ্যান্টাসির জগতে যে এখনো বুঁদ হয়ে আছে সেটা ভিন্ন ব্যাপার, তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভোগবিলাসের বিকারের প্রতি মন্ত্রমুগ্ধ মনোভাব অনেকটাই কেটে যাচ্ছে।

এই প্রবন্ধের প্রথম কিস্তিতে, আমি কর্পোরেট জগতের লোকদের ভিন্ন জীবনযাত্রা বেছে নেয়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম , নগর-জীবনের রুদ্ধশ্বাস গতির বাইরে বেছে নেয়া এক ‘ধীরস্থির’ জীবন ; যা দরিদ্র বাচ্চাদের পড়ানো থেকে শুরু করে জৈবকৃষি এমনকি শিল্পকলার চর্চা পর্যন্ত বিস্তৃত। তারা অনুতাপহীন ‘আধুনিকতাবাদী’রা যেমনটা মনে করে, তেমন আদিমকালের গুহার জীবনে ফিরে যেতে চায়না, বরং রাষ্ট্র ও পুঁজির থাবার বাইরে একটা নির্ঝঞ্ঝাট অর্থবহ জীবন খুঁজে পেতে চায়।

বর্তমান প্রবন্ধের শেষ ভাগে এসে, আমি এখন সংক্ষিপ্তভাবে সম্ভাব্য এই নতুন জীবনের কিছু খসড়া চিত্র আঁকতে চাই। আমি মনে করি এটাই হতে হবে আমাদের ভবিষ্যত জীবনের গতিমুখ এবং ইতোমধ্যেই যা ঘটমান, সেসবের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমার এইসব চিন্তা।

পুঁজিবাদউত্তর ভবিষ্যত: একটি রূপরেখা

ভবিষ্যতের রূপরেখা প্রণয়ন করা যে কারোর জন্যই কঠিন, ভবিষ্যতের নীলনকশা তো বহু দূরের আলাপ! আবার, যেহেতু যেকোন প্রকারের পূর্বতসিদ্ধ ইশতেহার ঘোষণার বিরুদ্ধে আমার দার্শনিক অবস্থান, আমি এখানে একেবারেই সেই চেষ্টা করব না; বরং ইতোমধ্যেই বিরাজমান ধারণাগুলোই আমি আরও পরিষ্কার করার চেষ্টা করব। আমার ধারণা, পরিস্থিতিগত কারণেই, ব্যাপারগুলো আমাদের কাছে অধিকতর স্পষ্ট হবে এখন।

নিচে আমি এখন যে নজিরগুলো চিহ্নিত করব, তা বহুকাল ধরেই একটা পর্যায় পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল, কিন্তু আমরা এগুলোকে দেখতে পাইনি কিংবা ভেবেছি এগুলো ‘অতীতের ক্ষয়িষ্ণু স্মারক’।

তাহলে এটা বলে শুরু করা যেতে পারে : (একবার যদি আমরা বুঝে ফেলতে পারি যে শিল্পোদ্যোগ, ব্যবসাবাণিজ্য মাত্রই পুঁজিবাদী নয়) যে পুঁজিবাদ-উত্তর ভবিষ্যত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন রূপের সমন্বিত একটি রামধনু হবে। এর মানে হলো গণসম্পত্তি, সমবায়, বেসরকারি কুটির শিল্প, কৃষি, শহুরে বনাঞ্চলের খাস জমিতে সাধারণ অধিকার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় তথা গণমালিকানা পর্যন্ত নানা কিসিমের মালিকানার সহাবস্থান। জনস্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মতো বিষয়গুলো সম্ভবত রাষ্ট্রের হাতেই থাকবে, যেহেতু এখন এটি বেশ প্রতিষ্ঠিত ধারণায় পরিণত হয়েছে

পুঁজিবিহীন একটা দুনিয়া কল্পনা করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় কর্মসংস্থান তৈরিতে পুঁজির বিকল্প নেই এই ‘অর্থনৈতিক’ কল্পকাহিনী। ফলে কর ভর্তুকি, শ্রম আইন মেনে চলার স্বাধীনতা, ভর্তুকিযুক্ত বিদ্যুৎসুবিধা এবং বিনিয়োগের ‘নিরুপদ্রব পরিবেশ’ ইত্যাদির মতো চাহিদার গলায় আমাদের (পড়ুন সরকার) মালা পড়াতে হয়।

আর্টওয়ার্ক: ব্লাকডেথ
শিল্পী: পােকো বাসা
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

প্রথমেই মনে রাখবেন যে বেকারত্ব পুঁজিবাদের সৃষ্টি; সুতরাং পুঁজিবাদ বেকারত্বের সমাধান হতে পারে না। প্রথম বিশ্বে (‘উন্নত পুঁজিবাদী দেশসমূহ’) এই পুঁজিবাদ অন্য সকল ধরণের সম্পত্তির (সাধারণ সম্পত্তি) সম্ভাবনাকে ধ্বংস করেছে এবং বছরের পর বছর ধরে ‘কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি’ তথা ‘কর্মসংস্থান খোয়ানো প্রবৃদ্ধি’ নিশ্চিত করেছে। পশ্চিমকে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার(এআই) ভূতে পেয়েছে, যেটা কিনা নিকট ভবিষ্যতে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই চাকরির বাজারের চল্লিশ ভাগ খেয়ে ফেলবে। ইন্ডিয়ার মতো দেশগুলোতেও এর মারাত্মক বিপর্যয়কর প্রভাব তৈরি হতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে, এটা মহামারি আকারে সৃষ্ট বেকারত্ব ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার পটভূমিতে ইউরোপের নানা দেশে গৃহীত কিংবা গুঞ্জনরত সর্বজনীন ন্যূনতম আয় (ইউবিআই) ধারণার বিরুদ্ধ একটি ধারণা। এই ধারণার আদিসূত্র (একটা পর্যায় পর্যন্ত) থমাস মুরের ষোড়শ শতকীয় ইউটোপিয়া। কিন্তু গত শতকের সত্তুরের দশক থেকে একটা দারুণ সম্ভাবনা হিশেবে এটাকে বেশ গুরুত্বের সাথে আমলে নেয়া হয়েছে। আন্দ্রে গোর্জ ১৯৮০’র দিকেই এই ধারণার পক্ষে ওকালতি করেছেন এবং সম্প্রতি নীতিনির্ধারণী বিতর্কে জায়গা করে নেয়ায় এই ধারণাটির গুরুত্ব একটা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এমনকি জেমস ফার্গুসনের Give a Man a Fish গ্রন্থেও এটা স্বীকৃত হয়েছে যে সমসাময়িক পুঁজিবাদে জনসংখ্যার একটা বড় অংশই স্রেফ উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে এবং তারা কখনোই আর কাজ ফিরে পাবেনা।

কর্মসংস্থান দাবি করা স্রেফ মরুভূমিতে মরীচিকা ধরতে যাওয়ার মতো। ন্যূনতম সর্বজনীন আয়ও (ইউবিআই) তাই।পশ্চিমে, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দীর্ঘদিনের এই দাবি সম্প্রতি নীতিনির্ধারণী পরিসরেও প্রবেশ করাটা একটা বিরাট বাঁকবদলের নির্দেশক। তবে বাস্তবটা একটু মাথায় রাখুন, পশ্চিমে ক্ষুদ্র সম্পত্তি, সাধারণ কিংবা যৌথ সম্পত্তির এত নিদারুণ বেসরকারিকরণ /ধ্বংস ঘটানো হয়েছে যে সেখানে এখন ইউবিআইকেই একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প মনে হচ্ছে।

আমি সংক্ষেপে আলোচনা করেছিলাম যে, কোভিড-১৯ মহামারী সৃষ্ট পরিস্থিতি এমনকি যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একটি অস্থায়ী ইউবিআই নিয়ে গুরুতর আলোচনার দিকে পরিচালিত করেছে। স্পেনের সরকার এখন বলছে যে, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা স্থায়ী ইউবিআইয়ের পরিকল্পনাটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। স্মর্তব্য যে ভারতের সিকিম ইতোমধ্যে ইউবিআইর কিছু রূপ বাস্তবায়ন শুরু করেছে এবং গত সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণায় কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী রাহুল গান্ধী ‘নয়া প্রোগ্রাম’ (Nyunatam Aay Yojana) প্রস্তাব করেছিলেন— যেটা আসলে ইউবিআই এরই একটি ভারতীয় সংস্করণ। ইউবিআইয়ের এর মতো ‘বামপন্থী’ দাবি বর্তমানে বেশ গুরুত্ব সহকারে আলাপ-আলোচনা-নীতিনির্ধারণী পরিসরে জায়গা পাচ্ছে কারণ করোনা মহামারি প্রাদুর্ভাবেরও আগে সৃষ্ট নাজুক পরিস্থিতির বাস্তবতায় আমজনতার হাতে যেন কিছু ক্রয়ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে। এটি ইতোমধ্যে স্বীকৃতি যে খোদ বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় থেকে এটা একটা অনন্ত সংকটে পতিত হয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে সেই সংকট আরো প্রকট হচ্ছে।

এই মুহুর্তে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি প্রশ্নে ফিরে আসাটা কার্যকর হতে পারে, কারণ বেশিরভাগ ‘অ-পশ্চিমা’ অঞ্চলে এটা একেবারে প্রধান গুরুত্বের ব্যাপার। বিশ্বের ৬০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থানে নিযুক্ত মানুষ বর্তমানে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সাথে জড়িত। বস্তুত, এটা এখন আর ‘অ-পশ্চিমা উন্নয়নশীল অর্থনীতি’র একার বিষয় নয়। মার্থা চেনের মতে, অনানুষ্ঠানিকীকরণের বিতর্ক আশির দশক থেকেই ‘প্রথম বিশ্বে’ বিস্তৃত হচ্ছে, যদিও সম্পূর্ণ নেতিবাচক কারণে। ফোর্ডিস্ট-পরবর্তী ‘নমনীয় পুঞ্জিভবন’-এর উদ্দেশ্যে :

১৯৮০ এর দশকের মধ্যে, উন্নত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যে পরিবর্তনগুলো ঘটেছিল সেগুলোকে ধারণ করার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের বিতর্কের শর্তগুলোকে প্রসারিত করা হয়েছিল। উত্তর আমেরিকা ইউরোপে ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষুদ্র, বিকেন্দ্রীকৃত এবং অধিকতর নমনীয় অর্থনৈতিক ইউনিটগুলো দ্বারা উৎপাদনপ্রণালী পুনর্গঠিত হচ্ছে। ব্যাপক আকারের উৎপাদনের স্থলে নমনীয় বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলো জায়গা করে নিয়েছিল। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে, শ্রমঘন উৎপাদনও ফিরে আসছিল (পাইওর স্যাবেল, ১৯৮৪) এই পরিবর্তনগুলো কর্মসংস্থান সম্পর্কের অনানুষ্ঠানিকীকরণের সাথে যুক্ত ছিল (এবং এখনো আছে) স্ট্যান্ডার্ড চাকরীগুলো ঘন্টা হিশেবে বেতন বা অপ্রথাগত চাকরিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল তেমন কোন সুবিধাদি ছাড়াই, পণ্য এবং সেবার উৎপাদন হচ্ছিল সাবকন্ট্রাক্টের আওতায় ক্ষুদ্র অনানুষ্ঠানিক ইউনিট এবং শিল্পখাতের বাইরের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের দ্বারা। এই প্রক্রিয়ায় অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি পুঁজিবাদী বিকাশের স্থায়ী অথচ অধীন এবং পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। (আলেজান্দ্রো পোর্টেস, ম্যানুয়েল ক্যাসেলস লরেন . বেন্টন, ১৯৮৯)

অন্যত্র, আমি আলোচনা করেছি যে কীভাবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে, এটি এমন একটি খাত বলে মনে হয়েছিল যা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে চাকরি খোয়ানো লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। এই পুনর্মূল্যায়নটা জরুরী, কারণ দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই খাতকে কেবল ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া, ‘জবাবদিহিতাহীন’ খাত হিশেবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু দিনদিন এই খাতকে অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত হিশেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, কল্যাণ স্যানালের ভাষ্যে যেটি ‘পুঞ্জিভবনের অর্থনীতি’র যুক্তির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তিতে চলে। স্যানাল এই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে একটি ‘প্রয়োজনের অর্থনীতি’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এটিকে ‘পুঁজি বহির্ভূত’ (non-capital) ডোমেইন হিশেবে চিহ্নিত করেছেন। এখানে যেটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির বেশ কয়েকটি খাত অবিকশিত এবং অপর্যাপ্ত পর্যায়ে কেবল অস্তিত্বসমেত টিকে থাকে, কারণ এই খাতকে প্রায়ই চরম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়। এবার প্রতিকূলতাসহই এই খাত যেভাবে টিকে থাকে তার সাথে সরকারি প্রণোদনা, সহায়তা ও নিরাপত্তাসহ সদর্পে বিরাজ করা বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর সাথে বিবেচনা করুন। এতে একটা বিষয়ই পরিস্কার হবে যে এই অনানুষ্ঠানিক খাতগুলো যদি নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের আনুকূল্য ও সুনজর পেত, এগুলোর বিকাশ অন্য মাত্রায় গিয়ে পৌঁছাবে।

আমরা পুঁজিবাদ-উত্তর যে দৃশ্যকল্পের কথা বিবেচনা করছি, সেখানে বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর কী হবে? তারাও নিশ্চিতভাবেই অন্য সমস্ত খাতের সাথে সহাবস্থান করবে, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যসহ। কর্পোরেশনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে গৃহীত সিদ্ধান্ত যদি কোনভাবে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে, যদি বায়ু কিংবা পানি দূষণ করে, কিংবা যদি প্রকৃতি ধ্বংস করে, তাহলে তাদেরকে অতি অবশ্যই পর্যাক্রমিক সামাজিক নিরীক্ষণের মুখোমুখি হতে হবে। প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্তও এরকম নিরীক্ষণের মুখোমুখি হবে।

এবং সর্বোপরি, এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ রয়েছে যা অত্যন্ত সচেতনভাবে বিকল্প তৈরির চেষ্টা করেছে। যেমন ‘সংহতি অর্থনীতি’র ধারণা কিংবা গণসম্পত্তির ধারণা। এগুলো কী তা ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে আসুন আমরা এগুলোর প্রবক্তাদের কাছ থেকেই ধারণাগুলো সম্পর্কে শুনি এবং অবশ্যই যেন মনে রাখি যে বেশ বড় সংখ্যক মানুষ এখন এ ধরণের উদ্যোগের সাথে জড়িত। সুতরাং সংহতি অর্থনীতির ধারণার অন্যতম প্রবর্তক এমিলি কাওনো’র(Emily Kawano) এ সম্পর্কে বলছেন:

সংহতি অর্থনীতি একটি ন্যায়ত স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ার বিশ্বব্যাপী আন্দোলন। এটা আইভরি টাওয়ারের একাডেমিকদের দ্বারা তত্ত্বায়িত কোন নীলনকশা নয়। বরং এটি এমন একটি অনুশীলনের বাস্তুতন্ত্র যা ইতোমধ্যে বিদ্যমান এর মধ্যে কিছু পুরাতন, কিছু নতুন, কিছু এখনও উদীয়মান যা সংহতি অর্থনীতির মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই অর্থনীতিকে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। সংহতি অর্থনীতি এমন এক বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় যা বিস্তারিতভাবে সংজ্ঞায়িত এবং মানুষ এই গ্রহের জন্য টেকসই

বিগত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে নয়া উদারনীতিবাদ, বিশ্বায়ন প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায় সংহতি অর্থনীতির চর্চা বেড়েছে। এই প্রবণতাগুলো বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিশাপ, কর্মসংস্থানহীনতাঅনিশ্চিত কর্মসংস্থান, তীব্র অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সরকারি সামাজিক সুরক্ষা নিরাপত্তা কর্মসূচির সংকোচন সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সম্পদশালী এলিটরা রাজনৈতিক অগ্রাধিকার নির্ধারণে কর্পোরেট মুনাফাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সম্পদ ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে সামাজিক পরিবেশগত মঙ্গল কর্মসূচি উপেক্ষিতই থেকে গেছে

এই প্রেক্ষিতে, বধির কিংবা দুর্বল তহবিলযুক্ত সরকারের কাছে দাবি জানাতে জানাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বহু লোক সম্প্রদায়। সরকারের প্রতি হতাশা, প্রয়োজনের তাগিদ, বাস্তবতা, মরিয়াপনা এবং দূরদৃষ্টি দ্বারা তাড়িত হয়ে মানুষজন তাদের উদ্দীপনাকে যৌথ সমাধান নির্মাণে ব্যয় করছে। স্বকর্মসংস্থান, খাদ্য, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, পরিষেবা, ঋণ এবং অর্থ তৈরির বিপুল কর্মযজ্ঞে সোৎসাহে নেমে পড়েছে। এই অনুশীলনগুলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত অর্থনীতির ভিতরেবাইরে একযোগে কাজ করছে।

আর্ট্ওয়ার্ক: সলিডারিটি
শিল্পী: প্যাট্রিক হারজিগ
সূত্র: সাটসি আর্ট

এই ধরনের অনুশীলনের মধ্যে শ্রমিকদের সমবায় থেকে শুরু করে গোষ্ঠী উদ্যোগ, ক্রেডিট ইউনিয়ন, স্বনির্ভর অর্থনীতি, বিকল্প স্থানীয় মুদ্রা ইত্যাদি রয়েছে। অন্যদিকে, ‘কমনিং’ (commoning) এর আদি প্রেরণা গণসম্পদের ধারণা, তবে বিষয়গুলোকে সাধারণ করে তোলার অনুশীলনের দিকে জোর দেয়। এখানে ডেভিড বোলিয়ার (David Bollier) কমন্স( commons) এবং কমনিংয়ের (commoning) ধারণাটি ব্যাখ্যা করছেন:

আমি বিশ্বাস করি কমন্স (commons)- একইসাথে একটি প্যারাডাইম, একটি ডিসকোর্স, একটি নীতিশাস্ত্র এবং সামাজিক অনুশীলনের একটি সেটযা বর্তমান এই বিপর্যয়কে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি রাখে। রাজনৈতিক দর্শন বা নীতি এজেন্ডার চেয়েও কমন্স একটি সক্রিয় এবং জীবন্ত প্রক্রিয়া। এটি যতটা না একটা বিশেষ্যপদ, তার চেয়ে অনেক বেশি একটা ক্রিয়াপদ। কারণ এটি মূলত পারস্পরিক সহযোগিতা, দ্বন্দ্বসংঘাত, আলোচনা, যোগাযোগ এবং পরীক্ষানিরীক্ষার একটি সামাজিক সম্পর্কজাল, যেটা কিনা সীমিত সম্পদের বন্টন ব্যবস্থাপনার সুসংহত সিস্টেম গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয়। এই প্রক্রিয়াটি স্বউদ্যোগে পরিচালিত উৎপাদন, প্রশাসনিক পরিচালন, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের চমৎকার সংমিশ্রণে তৈরি এক সমন্বিত সিস্টেম

সাধারণ মানুষ, বস্তুগত এবং রাজনৈতিক দুই অর্থেই, তাদের সাধারণ সম্পদ পুনরুদ্ধারের প্রতি মনোনিবেশ করেছে। জমি, জল থেকে শুরু করে জ্ঞান এবং নাগরিক পরিসরগুলোর যে কাছাখোলা বেসররকারিকরণ বাজারিকরণ ঘটেছে, তারা সেগুলোর উপর তাদের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং এই সকল সম্পদ সম্প্রদায়গত জীবনের উপর নিজেদের সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ পুনরায় নিশ্চিত করতে চায়। তারা নির্দিষ্ট কিছু জিনিসকে তাদের জীবনের সাথে অবিচ্ছেদ্য মনে করে এবং সেগুলোকে বাজারে বিক্রির হাত থেকে রক্ষা করতে চায়, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে চায়। এই প্রকল্পটিবাজারকেই পাল্টা ঘেরাও করতে চায় এবং সর্বপ্রাণের স্বার্থকে রক্ষা করতে চায়। এমন কিছু অর্জন করতে চায় যা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সাধারণত অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেবিকারগ্রস্ত, অস্থিতিশীল, অনিশ্চিত বাজারের উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়….

তবে প্রচলিত রাজনৈতিক পরিসরে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে, যা কাঠামোগত পরিবর্তনের সুফলকে আত্মসাৎ করে, সর্বপ্রাণের দর্শনে উদ্বুদ্ধরা বাজার রাষ্ট্রের বাইরে নিজেদের স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রতি বেশি মনোযোগী। এমন না যে আত্মরক্ষা প্রগতিশীল পরিবর্তনের বাহন হিশেবে তারা প্রচলিত রাজনৈতিক পথ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিকে একেবারেই পরিত্যাগ করেছে; এটা স্রেফ এই পথপদ্ধতিগুলোর চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত কলুষিত হওয়ার বাস্তবতায় নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনীতি কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণ সংশ্লিষ্ট রাজনীতির অন্তর্গত সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধিজনিত অনীহা।

কর্পোরেশনের উপর সামাজিক নজরদারি’সহ এখানে উল্লেখিত প্রত্যেকটি অনুশীলনই এমন একটা ভবিষ্যতের দিকে যাওয়ার পাথেয় যা অধিকতর বৈচিত্রপূর্ণ, বহুত্ববাদী এবং সাম্য ও ন্যায্যতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাষ্ট্র এবং কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত বাজারের গণ্ডির বাইরে ‘প্রান্তিক’ মনে হওয়া বর্তমানকালের ক্রিয়াশীল বহু কর্মকাণ্ডই অদূর ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ খেলারাম হিশেবে আবির্ভূত হতে পারে। দশকের পর দশক ধরে প্রতিকূলতার মুখেও বিস্তার লাভ করা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি সেই ইশারাই দেয়। আসল বাস্তবতা হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলোর ফলে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়া বিরাট সংখ্যক মানুষ এই অনানুষ্ঠানিক খাতেই পারস্পরিক সহমর্মিতা’সহ তাদের জীবন ও জীবিকা ভাগ করে নিবে। এই ভবিষ্যৎ ভাবনা ‘বেকারত্ব’ ফ্রেমওয়ার্ক থেকে মুক্ত। পুঁজিকে ক্রমাগত অপ্রাসঙ্গিক করতে করতে এটা অগ্রসর হয়।

 

অনুবাদকের টীকা

[ অনুবাদকের টিকা তৈরি করার ক্ষেত্রে অলিউর সান , আব্দুল্লাহ আল মামুন, শাহিন খান সহায়তা করেছেন। তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই]

১. ইবনে আল শাতিরঃ একজন আরব জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে মুওয়াক্কিত (ধর্মীয় টাইমকিপার) হিসেবে কাজ করতেন এবং ১৩৭১-৭২ সালের দিকে মিনারের জন্য একটি সূর্যঘড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানমূলক গ্রন্থ কিতাব নিহাত আলসালফ তাসিহ আলউসুল (The Final Quest Concerning the Rectification of Principles)। এতে তিনি সূর্য, চাঁদ এবং গ্রহগুলির টলেমীয় মডেলকে ব্যাপকভাবে সংস্কার করেন। তাঁর কাজকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ-পূর্ববর্তী ‘বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ বলে বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য যে, আর্যভট্টের সৌরকেন্দ্রিক মডেল ইবনে বতুতার মারফতে আরবে পৌঁছায় এবং ইবনে হাইসাম আলশাতিরের হাতে বিকশিত হয় (সৈয়দ নিজার, জ্ঞানের বিকাশের তত্ত্ব ও বৈচিত্র্যময় ধারাসমূহ)। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীর জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাসের কাজে শাতিরের প্রভাব লক্ষণীয়।

কোপার্নিকাস : ষোড়শ শতকের পোলিশ জ্যোতির্বিদ। কোপার্নিকাসের সময়ে সৌরজগত সম্পর্কে প্রচলিত প্রভাবশালী ধারণা আজকের মতো ছিল না। তখন মনে করা হতো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহ আবর্তিত হয়। কিন্তু কোপার্নিকাস তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে বলেছেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহ আবর্তিত হয়। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, “পৃথিবী নয়, সূর্যই হলো সৌরজগতের কেন্দ্র। সূর্যই পুরো সৌরজগতকে আলোকিত করে।” পৃথিবী নয়, বরং সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্র; কোপার্নিকাসের এই ঘোষণা তৎকালীন ইউরোপের সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে পৃথিবীকে আর সৃষ্টির আদি বলে গণ্য করা সম্ভব ছিল না। ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে সকল পরিবর্তন ও বিনাশের উৎস হিসেবে পৃথিবী আর পরিগণিত হতে পারল না। প্রাচীন চার্চকেন্দ্রীক কর্তৃত্বের পুরো ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্যে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের দার্শনিক ধারণার পরিবর্তন দরকার ছিল। কোপার্নিকাসের তত্ত্বের ফলে তা সম্ভব হয়েছিল। একেই ‘কোপার্নিসীয় বিপ্লব’ বলে অভিহিত করা যায়।

২. দর্শন, বিজ্ঞান আর শিল্পের অ/ভিন্ন গাঁথুনিতে যে এক চমৎকার অট্টালিকা সম্ভব তা দেল্যুজ আর গুয়াত্তারির What is philosophy পড়লে বোঝা যায়। দুইজনের প্রথোমক্ত জন দার্শনিক, আরেকজন মনোবিশ্লেষক। তাঁদের প্রথম বই Capitalism and Schizophrenia প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। তার ২০ বছরের মাথায় এই বই; প্রধান আলোচ্য বিষয়: দর্শনের ধরন আর এর সাথে অন্যান্য বিষয়ের পার্থক্য। দর্শনকে পুরোপুরি যুক্তির ফসল বলতে নারাজ দুইজন। ব্যাপারটা ব্যাখা করতে গিয়ে concept এর আলোচনা আনা হয়েছে, আর বলা হচ্ছে, “দর্শন হলো এক ধরনের শিল্প যা concept গড়ে, আবিষ্কার করে আর এর অতিরঞ্জন করে।” আবার এই concept ব্যাপারটার পিছে দাড়িয়ে আছে শুধু দার্শনিক নয়, ঐতিহাসিক আর সামাজিক প্রেক্ষাপট। এইভাবে আলোচনা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সর্বেশ্বরবাদের দিকে। বোঝায় যাচ্ছে, transcendence নয় immanence বা সর্ব ভূ’তে ইশ্বর দেখার ঝামেলার দিকে নজর এদের। প্রচুর সমালোচনা সত্ত্বেও উত্তর-গড়নবাদী চিন্তা চেতনায় বিরাজ করার মতো যথেষ্ট উপাদান আছে এই বইয়ে।

৩. ক্যুইয়ার: ক্যুইয়ার শব্দটির অর্থ বিচিত্র/অদ্ভুত। নিপীড়িত বিভিন্ন যৌন ও লিঙ্গ পরিচয় বোঝাতে বৃহদার্থে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, সমকামিতা বোঝাতে ‘ক্যুইয়ার’ নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতো, যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে এলজিবিটির(LGBT) বদলে আরও অন্তর্ভূক্তিমূলক শব্দ হিসেবে ‘ক্যুইয়ারের’ নেতিবাচকতাকে পরাভূত করে আন্দোলনকারীরা রাজনৈতিকভাবে এর ব্যবহার শুরু করে।

জুডিথ বাটলারের তাত্ত্বিকভাবে বায়োলজিক্যাল সেক্সের ধারণা আর সামাজিক জেন্ডারের ধারণার ফারাক মোচন/সংকোচন, ক্যুইয়ার থিয়োরী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এটা তত্ত্ব হিসেবে দাঁড়িয়েছে বাটলারসহ অন্যান্য তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের কাজের ভিত্তিতে। বাটলারের শরীরের ধারণা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্যালাসকেন্দ্রিকতাঃ ফ্যালাসকেন্দ্রিকতা বলতে ফ্যালাস বা, লিঙ্গম বা, শিশ্নকে সামাজিক অর্থবোধকতার কেন্দ্রে ঠাহর করা বোঝায়। ১৯২৭ সালে আর্নেস্ট জোনস ফ্রয়েডের মনঃসমিক্ষণে নারীদের মন-যৌন বিকাশে শিশ্ন-ঈর্ষার ভূমিকার সমালোচনায় শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।

ফ্যালাসকেন্দ্রিকতাকে(phallocentric) পশ্চিমা দর্শনের বচনকেন্দ্রিকতার (Logocentrism) সাথে যুক্ত করে, দেরিদা ফ্যালোগোকেন্দ্রিকতা (বচশ্নকেন্দ্রিকতা?) শব্দটি ব্যবহার করেন, যা পাশ্চাত্য (ভাষা) দর্শনে নির্দেশিত/জ্ঞাপিতের(signified) এক আধ্যাত্মিক উপস্থিতিকে শিশ্নের মতোই ঠাহর করে। লুসি ইরিগারে জ্যাক লাকাঁর ফ্যালাসের সাথে পুরুষ শরীরের সম্পর্ক প্রত্যাখানের সমালোচনায় তাঁকে ফ্রয়েডীয় চিন্তার বাহক হিসেবেই সাব্যস্ত করে, ফ্যালাসকে প্রচলিত পুরুষালি কতৃত্বের স্মারক হিসেবে, অর্থবোধকতা ও দর্শনের ক্ষেত্রে ফ্লুইডের(তরল/নরম) তুলনায় সলিডের(কঠিন/শক্ত) প্রাধান্যের প্রবণতাকে খোলাসা করেন।

৪. ফোর্ডিস্ট উৎপাদন : বিশ শতকের শিল্পায়িত সমাজের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা। সাধারণত ব্যাপক উৎপাদন ও ব্যাপক ভোগ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমেরিকার শিল্পপতি ও ফোর্ড মোটর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতে হেনরি ফোর্ডের নামে নামকরণ করা হয়েছে

. ব্রুনো লাতুর : ফরাসি দার্শনিক। We have never been modern তাঁর বিখ্যাত বই। সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে এটা কি কোন পোশাকী মহড়া? শীর্ষক প্রবন্ধ লিখেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী তাফসিন প্রবন্ধটির অনুবাদ করেছেন। লাতুরের ‘সমাজ’ ধারণা, মানুষ ও না-মানুষের এজেন্সি, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির আধুনিকতাবাদী বিভাজনের অসাড়তা বোঝাতে গিয়ে অনুবাদকের টীকায় কাজী তাফসিন গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। বর্তমান প্রবন্ধের সাথে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দীর্ঘ উদ্ধৃতি হুবহু তুলে ধরছি :

নৃবিজ্ঞানী দার্শনিক ব্রুনো লাতুর মূলত আধুনিকতা বিষয়ক আলোচনায় আধুনিক অবস্থান নেন। অর্থাৎ, লাতুর একই সাথে আধুনিকতা এবং আধুনিকতাবিরোধীতা এই দুটোর কোনোটিতেই দাঁড়াতে চাইছেন না। লাতুর মনে করেন, আধুনিকতা হচ্ছে একধরনের চুক্তি যেটা প্রকৃতি সংস্কৃতির পরস্পরের মধ্যে একধরনের অধিবিদ্যক ফারাক তৈরি করে, যেটা একধরনের (সত্তাগত) ফারাক তৈরি করে রাখে মানুষ (human) আর নামানুষ (non-human) এর মধ্যে। চিন্তাজগতে আধুনিকেরা এই দুইজাতের ভাগ বাটোয়ারা করার ফলে, সকল মানবসত্তা থাকে তাদের হিসাবের একপাশে যারা কিনা সাংস্কৃতিক(Cultural), আর সকল মানবসত্ত্বা থাকে অন্যপাশে যাদেরকে প্রাকৃতিক(Natural) বলে ধরে নেয়া হয়। এই দুটো আলাদা শ্রেণীকরণের(বা ক্যাটাগরি তৈরি করবার) পর আধুনিকতা বিভিন্নভাবে এদের পরস্পরের শুদ্ধিকরণ(purification) করবার চেষ্টা করতে থাকেযেটা থেকে লাতুর বের হয়ে আসতে চেয়েছেন। এই প্রকৃতি/সংস্কৃতি কিংবা মানুষ/নামানুষের বৈপরীত্যের লীলাখেলা থেকে বের হয়ে আসার জন্য লাতুর সবকিছুকে একেকটা অ্যাক্টর (Actor) বলছেন তার অ্যাক্টরনেটওয়ার্ক থিওরিতে(Actor-Network Theory) অর্থাৎ, লাতুরের দৃষ্টিতে অস্থিত্বশীল কিংবা অনস্থিত্বশীল সবকিছুই একেকটা অ্যাক্টর। মানে, বরিস জনসন, জনসন এন্ড জনসন কোম্পানী, কেরু এন্ড কোম্পানী, স্যানিটাইজার, করোনা ভাইরাস, মরা বাঘ প্রত্যেকটা বিষয়ই একেকটি অ্যাক্টর। আর এই অ্যাক্টরগুলো যদি কোন একটা নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকে, তবে তারা পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করতে পারবে। লাতুর এভাবে সবকিছুকে একনাগাড়ে অ্যাক্টর বলার উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে মূলত একইসাথে আধুনিকতা এবং আধুনিকতাবিরোধীতা এই দুটোকেই মাড়িয়ে(bypass) আসা। নিয়ে বিস্তারিত জানতে লাতুরের The Pasteurization of France (১৯৮৪) বইটি দেখতে পারেন

এবং লাতুর আরও দেখান যে, আধুনিকতা কিভাবে সমাজকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে যেখানে সমাজ বলতে শুধুমাত্র মানুষের সমষ্টি তাদের পারস্পরিক এজেন্সীকেই বোঝানো হয়এবং সেই কল্পিত সমাজ এর সংজ্ঞা থেকে বাদ দেয়া হয় সকল নামানুষগুলোকে। অর্থাৎ আধুনিকতা হচ্ছে এক ধরনের চুক্তি (settlement) যেখানে রাজনৈতিক পরিসর(polity) থেকে নামানুষ যত অ্যাক্টর আছে সেগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ভাবা হয়। আধুনিকতার এই ক্যারিকেচার থেকে বের হয়ে লাতুর তাই রাজনৈতিক পরিসরে সকল নামানুষ অ্যাক্টরগুলিকে একে একে আমলে আনতে আগ্রহী। লাতুর আরও মনে করেন যে, শুধু মানুষ নয়, বরং একইসাথে নামানুষ অ্যাক্টরগুলোও মাঝে মাঝে দানবীয় রূপে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। না, তিনি এখানে কোনো লাফক্রাফটের ফিকশনের কথা বলছেন না। বরং মানব সমাজে এই নামানুষ অ্যাক্টরগুলো মাঝেমাঝে এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে যে সেটা মানুষের তৈরি করা মোটামুটি সবচেয়ে বিশাল আকারের প্রতিষ্ঠান(যেমনঃ রাষ্ট্র)-কেও শক্তিমাপে ছাড়িয়ে যেতে পারে, যেটা হয়তো আমরা এই করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখছি। সেজন্যই লাতুর এখানে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলছেন যে, মানবসমাজ আর আগের মতন শুধুমাত্র মানুষের পরস্পরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কারণ মানবসমাজে আমরা ক্রমাগত বিভিন্ন রকম নামানুষ অ্যাক্টরকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখছি, যেগুলো অনস্বীকার্য।

৬.  Give a Man a Fish (Reflections on the New Politics of Distribution) মার্কিন নৃবিজ্ঞানী জেমস ফার্গুসনের ২০১৫ সনে প্রকাশিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে, আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিকাশ পর্যবেক্ষণ করেছেন ফার্গুসন, যেখানে নিম্ন আয়ের নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিক প্রণোদনা পায়। এই ধরনের কর্মসূচি বেকারত্ব হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। ফার্গুসন মনে করেন পুঁজিবাদের পুনর্বিবেচনা সম্ভব। বন্টনের নতুন পরিকল্পনা ভিন্ন রকমের রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে বাজার, জীবিকা, শ্রম ও ভবিষ্যতের প্রগতিশীল রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল ঘটাতে পারে বলে মনে করেন ফার্গুসন।

সারোয়ার তুষার