- সারোয়ার তুষার
ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিসরে বহুল আলোচিত-সমালোচিত টার্মিনোলজি এবং এহেন রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষেও রয়েছে শক্তিশালী মতামত। ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানুষ খুন করার এখতিয়ার থাকা উচিত মর্মে যেসব যুক্তিপ্রণালী হাজির আছে, তার বেশিরভাগই রাষ্ট্র-আইন-সন্ত্রাস বিষয়ক অত্যন্ত উপরিতলের বোঝাপড়ার ফলাফল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রীয় পরিসরে ভায়োলেন্স-ক্রাইম নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছানোর নাগরিক অসহায়ত্ব থেকে উৎসারিত সমর্থন।
ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারকে রাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দ যেসব কারণে সমর্থন করে থাকেন, তার মধ্যে সবচেয়ে আপাত ‘যৌক্তিক’ কারণ ‘আইনের শাসন’ এর অনুপস্থিতি। যেহেতু ‘আইনের শাসন’ নাই, কোর্ট-কাচারি করতে করতে অপরাধী আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যাবে, সুতরাং নাগরিক পরিসরে ক্রসফায়ারকে ‘শর্টকাট জাস্টিস’ মনে করা হয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার আইনের শাসনের অ্যাবসেন্সে ঘটে না, বরং তা আইনের শাসনেরই রকমফের মাত্র। যেমন বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, হত্যাকারীদের একজন নয়ন বন্ডকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে খুন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; আবার অন্য আসামী রিফাত ফরাজি বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিশেবে রিম্যান্ডে আছে।
সবমিলে একই মামলার এক্সিকিউশন ভিন্ন ভিন্নভাবে হচ্ছে কেবল। রিফাত ফরাজির জিজ্ঞাসাবাদ চলতে চলতেই নয়ন বন্ডের ‘শাস্তি’ ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে, সেটা ‘ক্রসফায়ার’র মাধ্যমে। আইনের শাসনের একটা অংশ যদি হয় আদালত, বিচারবিভাগ ; অন্য অংশের এক্সিকিউটিভ ও জুডিশিয়ারি উভয়ের ভূমিকা পালন করে ফেলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সুতরাং, ক্রসফায়ার আইনের শাসনের অনুপস্থিতিতে ‘শর্টকাট’, ‘কার্যকর’ বিচারপ্রক্রিয়া ; এই যুক্তি ধোপে টেকে না। আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ২০১৩ সালে সংশোধিত ‘Anti Terrorism Act’ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্রেফ তাদের ‘সন্দেহ’ ও ‘মনে হওয়ার’ ভিত্তিতে যে কাউকেই চাইলে গ্রেফতার, আটক, রিমান্ড, এমনকি শাস্তি পর্যন্ত দিতে পারে। ক্রসফায়ার এই স্বেচ্ছাচারী, ব্ল্যাংকচেকপ্রাপ্ত ক্ষমতারই চূড়ান্ত রূপ। ‘আইনের শাসন’ এখানে পুরোদমে উপস্থিত। সুতরাং ক্রসফায়ারকে আইনের শাসনের বিকল্প ভাবার কোন ভিত্তি নাই।
এই আলোচনায় আমরা মূলত ক্রসফায়ার বিরোধী আলাপ-আলোচনা-যুক্তিপ্রণালীর কথকতার মধ্যে থেকে যাওয়া গলদ নিয়ে কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রগতিশীল-মানবাধিকারবাদী-বামপন্থি-উদারতাবাদী; এই রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তি-মহলসমূহ ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু এই বিরোধিতার ভাষিক কথকতার মধ্যেই আসলে কোথাও না কোথাও এহেন রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শর্ত তৈরি হওয়ার বীজ প্রোথিত রয়ে গেছে। যেমন, উল্লেখিত মহলসমূহ ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারকে ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করে থাকে। অন্তত কয়েকটি কারণে ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারকে ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা ভুল এবং বিপদজনক।
প্রথমত, ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা ‘বিচারিক’ হত্যাকাণ্ডের পাটাতনকে আরও নিরঙ্কুশ করতে পারে। আমরা যখন বলছি, ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে, তখন কি আমরা অবচেতনভাবেই ‘বিচারিক’ হত্যাকাণ্ডের প্রতি আমাদের অনাপত্তি জ্ঞাপন করছি না? হত্যাকাণ্ড যদি অবৈধ হয়, তাহলে আমাদের সকল প্রকার হত্যাকাণ্ডকে অবৈধ মনে করতে হবে। বাংলাদেশ এখনো ‘বৈধ’, ‘বিচারিক’ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার মত বস্তুগত ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি এই যুক্তি ভালগার বস্তুবাদী চিন্তার অনিবার্য পরিণতি। ‘বৈধ’, ‘অবৈধ’ সমস্ত প্রকারের রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা মূলত মানুষের শরীরকে একটা চরম সহিংস পলিটির অবজেক্টে পরিণত করার বিরোধিতারই নামান্তর, সেই অর্থে ‘বৈধ’ সহিংসতার মূলোৎপাটনের পক্ষে প্রথম পদক্ষেপ।
আমাদের উদ্দেশ্য যদি হয় সহিংসতামুক্ত সমাজ নির্মাণ, তাহলে এর উপায় খুঁজে বের করতে হবে এখন থেকেই। কোনও একসময়ে আমরা কোন ‘ভ্যানগার্ড’ তত্ত্বের মাধ্যমে বস্তুগত শর্ত অর্জন করবো ; তারপর ‘বৈধ’, ‘বিচারিক’, ‘রাষ্ট্রীয়’ সহিংসতা ‘শুকিয়ে মরবে’, ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়বে ; এহেন চিন্তাপ্রণালী ইতিহাসে বারবার ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ক্রসফায়ার ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড নয়, বরং ‘আইনি’ ‘বিচারিক’ হত্যাকাণ্ডেরই রূপভেদ- এই দাবির পক্ষে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য দোহাই দিতে আমরা বাংলাদেশের সংবিধানে টোকা দিতে পারি।
বাংলাদেশের সংবিধান এই রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ আইন। সেই সংবিধান অনুযায়ী শৃঙ্খলা রক্ষার দোহাই দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গৃহীত যেকোন পদক্ষেপই বৈধ, আইনি পদক্ষেপ। সুতরাং ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার-বন্দুকযুদ্ধ কিংবা জনদাবিতে গড়ে ওঠা কোনও আন্দোলনে দমনপীড়ন চালানোও বৈধ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আইনতই তার নাগরিককে খুন-জখম করার অধিকার সংরক্ষণ করে সাংবিধানিকভাবে। ক্রসফায়ার কিংবা এনকাউন্টারের মত ঘটনাগুলোকে ‘আইনবহির্ভূত’ ঘটনা মনে হলেও আসলে এগুলো আইনের বাইরের কোন ঘটনা না। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বিদ্যমান আইন অমান্য করে এইসব কিলিং ঘটাতে হয় না, বরং ‘জনশৃঙ্খলা’ রক্ষার্থে আইনসম্মতে উপায়েই তারা খুন খারাবি চালাতে পারে।
ক্ষমতার বয়ানেই, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের জরুরি ও বিদ্যমান চুক্তি হলো রাষ্ট্র কিভাবে নাগরিকের ‘জীবন ও স্বাধীনতার’ সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান বলছে, “আইনানুযায়ী ব্যতিত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। ” ( ৩২ অনুচ্ছেদ) তারমানে নাগরিকের জীবনের অধিকার নিঃশর্ত নয়, আইনের সাপেক্ষে রক্ষিত হবে। ‘আইনানুযায়ী ব্যতিত’ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না মানে হলো আইনানুযায়ী বঞ্চিত করা যাবে।
কিন্তু এই আইনি ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে যেটুকু অধিকার দেয়া হয়েছে নাগরিককে, সেটাও আবার কেড়ে নেয়া হয়েছে এভাবে : “এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলীতে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে কোন অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোন কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ঐ অঞ্চলে প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ,দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্য কোন কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন ” ( ৪৬ অনুচ্ছেদ)।অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো বটেই, এমনকি ‘অন্যকোন ব্যক্তি’ যদি ‘কোন কার্য’ করে থাকে ‘শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে’ তাহলে সেটাও চাইলে রাষ্ট্র ‘বৈধ’ মনে করতে পারে এবং ‘সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে’ পারে।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে চালিত অপারেশন ক্লিনহার্ট এবং বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চলাকালীন সমস্ত ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘এনকাউন্টার’ উল্লেখিত ৪৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে’ করেছে বলে ধরে নিতে হবে। সুতরাং এসবই আইনসিদ্ধ। ক্রসফায়ার কিংবা এনকাউন্টারের মত ঘটনার প্রেসনোটে অবধারিতভাবে দেখা যায় নিহত ব্যক্তির নামে ডজনখানেক মামলা ছিল। ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের মত রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ডগুলোর ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির নামে অসংখ্য মামলার দোহাই দেয়া হয় কারণ : “এই ধারার কোন কিছুই কোন মানুষকে হত্যার অধিকার দেয় না যদি না সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দণ্ডিত হতে পারে এমন কোন মামলায় অভিযুক্ত না হয়। ” ( ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারার ৩ উপধারা)। মানে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন হতে পারে এমন অপরাধে যুক্ত আসামীর গ্রেফতার নিশ্চিত করতে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে পুলিশ।
সুতরাং, আবারও, এমন আসামীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরার ক্ষেত্রে যেকোন পদক্ষেপ নিতে পারে। আসামীর মৃত্যুও এক্ষেত্রে ‘আইনের শাসন’। এমনকি কোন দুর্ধর্ষ আসামীও হতে হবে না। যেকোন জনসমাবেশে আইনানুগ নির্দেশে চাইলে গুলি চালাতে পারে রাষ্ট্রীয় বাহিনী : “একজন সৈন্য যদি তার ঊর্ধতন কর্মকর্তার আইনানুগ নির্দেশে একটি জনসমাবেশে গুলি চালায়, তবে তা সৈন্যটির অপরাধ হবে না। ” ( ১৮৬০ সালে প্রণিত পেনাল কোডের ৭৬ ধারা) । এক্ষেত্রে পূর্ণ ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির ব্যবস্থা আছে : “কেউ যদি এমন কিছু করে যা করার জন্য সে আইনত বাধ্য অথবা সে ভুলবশত সরলমনে বিশ্বাস করে যে এটা করা তার দায়িত্ব তবে তা কোন অপরাধ হবেনা। ” (প্রাগুক্ত) মানে সন্দেহের ভিত্তিতে বা ‘শৃঙ্খলা রক্ষার্থে’ যদি এমনকি যৌক্তিক নাগরিক আন্দোলনেও ‘সরল বিশ্বাসে’ গুলি চালায় পুলিশ, সেটা আইনত ‘বৈধ’।
সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা নাগরিককে হোমো স্যাকের বা ন-মানুষ/বধযোগ্য মানুষে পরিণত করে চাইলে আইনসম্মত উপায়েই জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। বেঁচে থাকার মতো নিঃশর্ত মৌলিক মানবীয় অধিকারকে আইনের সাপেক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, হরণ করতে পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ফলে, ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের মত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পিত হত্যাকান্ডকে ‘আইন বহির্ভূত’ কিংবা ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করা আসলে বাংলাদেশের সাংবিধানিক পর্যালোচনা সংক্রান্ত ঘাটতির ফসল।
মিডিয়া ম্যানুয়াল স্বীকৃত বুদ্ধিজীবীতার কারণে ‘আইনের শাসন’ কথাটি বেশ জনপ্রিয় বাংলাদেশে। কিছু হলেই শোনা যায়, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ যেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাবতীয় সহিংস প্রবণতা তার আইনি এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে ঘটছে। অথচ বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রবল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত আইনসম্মত উপায়েই সাধিত হয়। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কোন শাশ্বত ‘আইনের শাসন’ হয় না। সুতরাং ‘আইনের শাসন’ কায়েম করতে হবে বলার আগে, আইন কোন মাইন্ডসেটে প্রণীত হয়েছে সেটা বোঝার দরকার আছে। যে আইন নাগরিককে রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত করে, যে আইন ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত; সেইরকম গণবিরোধী, নিপীড়নমূলক আইন প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে ওকালতি করার মানে হলো নাগরিকের জীবন ও স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলা।
এজন্যই স্বাধীন দেশের উপযোগী আইন দরকার। যে আইনের কেন্দ্রে থাকবে ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রশ্ন। ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার রুখতে তাই সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক গণক্ষমতাতন্ত্র নির্মাণ অনিবার্য, যে গণক্ষমতাতন্ত্র হবে : ‘রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাণহীন যন্ত্রপাতিওয়ালা বর্তমান রাষ্ট্র-সংগঠনের জায়গায় স্বাধীন মানব-সম্প্রদায়সমূহের একটা সঙ্ঘ’। গঠনের দিকে থেকে হায়ারার্কিমুক্ত, আনুভুমিক ও ফেডারেটিভ। অার তা কেবল সম্ভব, ‘যাবতীয় অর্থনৈতিক একচেটিয়া এবং সমাজের মধ্যকার যাবতীয় জবরদস্তিমূলক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অবলুপ্তির মাধ্যমে’।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘বৈধতা’, ‘অবৈধতার’ নিরিখে বোঝার আরও একটি মুশকিল হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হওয়া। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে আমরা যতটা ভৌগলিক সংরক্ষণের অধিকারের জায়গা থেকে বুঝি, ততটা রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাস করতে পারার এক্সক্লুসিভিস্ট একচেটিয়া অধিকারের জায়গা থেকে বুঝি না। সভরেইন পাওয়ার সার্বভৌম ক্ষমতা হয়ে উঠতেই পারে না যদি এই ক্ষমতা কোন না কোন ক্যাটাগরিতে ফেলে মানুষকে ‘হোমো স্যাকের’ এ পরিণত না করে। সার্বভৌমত্ব ধারণাটাই এক্সক্লুসিভিস্ট। অন্যকে বাদ না দিয়ে, অন্যকে কর্তৃত্বহীন না করে সে নিজে কর্তৃত্বের মনোপলি ধরে রাখতে পারে না। সুতরাং, সার্বভৌম ক্ষমতার অনিবার্য কাজ হচ্ছে মানুষকে ‘বধযোগ্য’ হোমো স্যাকের তথা ন-মানুষে পরিণত করা।
রাষ্ট্র ও সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে এই সমাজতাত্ত্বিক ও নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘বিচারিক’, ‘বিচারবহির্ভূত’, এভাবে আর বুঝতে দেয় না। একচেটিয়া ‘বৈধ’ সন্ত্রাস করতে পারার অধিকার সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের হত্যাকাণ্ড, সহিংস আইনি তৎপরতা তার সন্ত্রাস কার্যকর করার রূপভেদ মাত্র।
আমরা যেহেতু ভাষার মধ্যেই চিন্তা করি এবং আমাদের চিন্তা যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-প্রতিরোধমূলক তৎপরতার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয় ; সুতরাং রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডকে স্রেফ রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডই বলতে হবে। ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড বলে ‘বিচারিক’ হত্যার প্রচ্ছন্ন বৈধতা তৈরি করে মোটের উপর ‘বৈধ’ সহিংসতার পাটাতনকে আরো সুদৃঢ় করলে আমরা কখনোই ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ নির্মাণ করতে পারব না। ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত সমাজের সাথে সংগতিপূর্ণ সামাজিক-সাংগঠনিক-ভাষিক চর্চা করতে হবে বর্তমানের মধ্যে থেকেই।
তথ্যপঞ্জি
১. বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা, গণতান্ত্রিক আইন ও সংবিধান আন্দোলন, ২০১৩
২. গুম-খুন-আতঙ্ক : শাসনপ্রণালী ও হত্যার কথকতা, বখতিয়ার আহমেদ, অরাজ
৩. বাকস্বাধীনতা : রাজনৈতিক নয়-মানবীয়তা, সারোয়ার তুষার, অরাজ
৪. নৈরাজ্যবাদ: লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, রুডলফ রকার, অনুবাদ: সেলিম রেজা নিউটন, অরাজ