- সারোয়ার তুষার
স্বাধীনতা ছাড়া মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রিত। আর সমস্বর ছাড়া মত প্রকাশের স্বাধীনতা শ্রেণী- প্রপাগান্ডা।
– দেয়ালচিত্র
বাকস্বাধীনতা কিম্বা স্বাধীন মতপ্রকাশ স্রেফ রাজনৈতিক ইস্যু নয়। এর চেয়ে বেশি কিছু। বাকস্বাধীনতা মানুষের মানবীয়তার সাথে সম্পর্কিত একটি ব্যাপার । মানবীয়তা হলো মানুষের সেই সত্তা যা প্রকৃতিজগতে মানুষের অস্তিত্বকে সাংস্কৃতিক করেছে। মানুষকে একমাত্র কর্তাসত্তা সম্পন্ন জীবে পরিণত করেছে। মানবীয়তার কারণেই মানুষ তার ইচ্ছানুসারে প্রকৃতির রূপান্তর ঘটাতে পারে, নিজের কল্পনাপ্রতিভা, সৃজনশীলতা ও শ্রমের মাধ্যমে । খেয়াল করলে বোঝা যাবে প্রকৃতিজগতে মানুষ ব্যতিত অন্য কোন প্রাণীরই প্রকৃতির রূপান্তর ঘটানোর সামর্থ্য নেই, উদ্দেশ্যতাড়িতভাবে সাংস্কৃতিক জীবনযাপন করার সামর্থ্য নেই, চিন্তা ও কল্পনা করার সামর্থ্য নেই। সুতরাং একমাত্র মানুষই চিন্তাসম্পন্ন প্রাণী, একমাত্র মানুষেরই চিন্তা আছে। আর এই চিন্তা হয়েই ওঠে আসলে মানুষের ভাষার মাধ্যমে। ভাষাই চিন্তার আধার। মানুষের প্রাকৃতিক দশা থেকে সাংস্কৃতিক দশায় উত্তরণ প্রথমত ও প্রধানত সম্ভব হয়েছে ভাষার মাধ্যমে। ভাষা নেই মানে কিন্তু মানুষের মানবীয়তাও নেই। প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীর সাথে তাহলে মানুষের আর পার্থক্য থাকে না।
সুতরাং বাকস্বাধীনতা তথা ভাষার স্বাধীনতা ওতোপ্রোতভাবে মানুষের মানবীয়তা তথা প্রকৃতিজগতে একমাত্র চিন্তাশীল প্রাণী হিশেবে টিকে থাকার শর্ত। মানুষের সমস্ত সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার মূল সূত্র নিহিত ভাষা ও কল্পনাপ্রতিভার মধ্যে। মানুষ যেহেতু ভাষার মধ্যেই চিন্তা করে, ভাষা ছাড়া যেহেতু চিন্তা একেবারেই অসম্ভব; তাই কল্পনাপ্রতিভার আদিভিত্তিও এই চিন্তা তথা ভাষা। প্রকৃতির যেকোন উপাদানকে মানুষ নিজের ইচ্ছায় রূপান্তর ঘটাতে পারে এবং রূপান্তর ঘটাতে হলে সবার আগে মানুষকে প্রকৃতির উপাদানের মধ্যে নিজের ইচ্ছাকে কল্পনা করে নিতে হয়।
তারপর সেই কল্পনার সাথে শ্রম যুক্ত হয়ে প্রকৃতির উপাদানের মানবসৃষ্ট রূপান্তর ঘটে। চিন্তা ও শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতির এই উদ্দেশ্যতাড়িত রূপান্তরই মানুষের সংস্কৃতি। মানুষের সংস্কৃতি প্রকৃতিজগতে মানুষের অস্তিত্বকে উদ্দেশ্যতাড়িত করেছে। অন্যান্য প্রাণী, যাদের প্রকৃতিসত্তা থেকে উত্তরণ ঘটেনি, ঘটার সম্ভাবনাও নেই; তাদের সাথে মানুষের এই পার্থক্যকেই আমরা মানুষের মানবীয়তা বলছি । তার মানে চিন্তা ও শ্রম ছাড়া যেহেতু প্রকৃতি রূপান্তর ঘটানো সম্ভব না, সেহেতু চিন্তা ও শ্রম মানবীয়তার অংশ। উপরে আমরা দেখেছি ভাষা ছাড়া চিন্তা আদৌ সম্ভবপর হয় না। অর্থাৎ ভাষা মানবীয়তার আদি ও অবিচ্ছেদ্য উপাদান। ভাষা নিজেই মানবীয়তা।
ফলে বাকস্বাধীনতাকে স্রেফ রাজনৈতিক ইস্যু হিশেবে বোঝার মুশকিল হলো, যা (ভাষা) মানুষের মানবীয়তার অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা অন্যের, কোন ‘বৈধ’ কর্তৃপক্ষের বদান্যতা, উদারতার বিষয়ে পরিণত হয়। কোন ‘বৈধ’ অথরিটি যদি যথেষ্ট উদার হয়, তাহলে আমাদের কথা বলার অধিকার থাকবে, আর যদি অথরিটি কর্তৃত্বপরায়ণ হয় তাহলে আমাদের বাকস্বাধীনতা সে ‘হরণ’ করবে। গভীর ভাবে ভাবলে এটা স্পষ্ট হয়, এই ধরনের যুক্তিতর্কের মধ্যেই মানুষের সহজাত বাকস্বাধীনতা হরণের বীজ নিহিত থাকে। এক্ষেত্রে হরণকৃত বাকস্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার আকুতি, দেনদরবার জানাতে হয়। যা আমার মানবীয় সত্তার নিঃশর্ত উপাদান, তাকে প্রথমত রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার বিষয়ে পরিণত করে, সেই জিনিস খোয়ানোর পরে ফিরে পাওয়ার আবেদন জানাতে হয়। কোন সন্দেহ নেই এতে করে মানুষের কর্তাসত্তাও রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন হয়ে পড়ে।
এই কারণেই বাকস্বাধীনতা এবং মোটের উপর মানুষের মানবীয় সত্তা সম্পর্কিত কমনসেন্স বদলানো অত্যন্ত জরুরি। আমরা যদি আজকে থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করি যে, যা কিছু মানুষের মানবীয়তার অংশ, তা কোন পরিস্থিতিতেই এমনকি কোন ‘বৈধ’ কর্তৃপক্ষও হরণ করতে পারে না, তাহলে কিন্তু মানুষ হিশেবে আমাদের মৌলিক অধিকারসমূহও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকে না।
মানবীয়তা হলো মানুষের সেই জিনিস যা যেকোন প্রকারের রাজনৈতিক সংকটের শর্তাতীত। মানবীয়তা প্রাণী হিশেবে মানুষের বিকাশের সেই উত্তরণ যা কোন তথাকথিত ‘মহান’ রাজনৈতিক শাসনকে নিরঙ্কুশ করার স্বার্থে কম্প্রোমাইজ করা যায় না।
বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মানুষের মানবীয়তার সাথে সম্পর্কিত করে বোঝার কমনসেন্স তৈরি করতে হবে। তাহলে আমরা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে এই চ্যালেঞ্জ করতে পারবো যে কথা বলার অধিকারের জন্য আমরা রাজনীতির উপর নির্ভরশীল না। কথা বলা আমাদের মানবীয়তার অংশ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্মরণে রেখে কথাগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করা খুবই জরুরি।