- বখতিয়ার আহমেদ
ভূমিকা: গুম-খুন-আতঙ্ক : শাসন প্রণালী ও হত্যার কথকতা প্রকাশিত হয় বাধন অধিকারী সম্পাদিত বাংলাদেশ পরিস্থিতি: নয়া উদারবাদী যুগে শাসনপ্রণালী ও কথকতা সংকলনে। এই রচনাটি একটি বক্তৃতার সম্পাদিত অনুলিপি। বক্তৃতাটি বখতিয়ার আহমেদের। তবে এর পেছনে আছে আরো কিছু কথা। সংকলন সম্পাদক বাধন রচনার শুরুতে ভূমিকায় জানান দেন:
বখতিয়ার আহমেদের কাছে প্রথমে লেখা চেয়েছিলাম এই সঙ্কলনের জন্য। পরে সময় বিবেচনায় নিয়ে এবং কাজের ব্যাপারে তার পারফেকশান আর ধীর গতির (দুটোই আমার কাছে ইতিবাচক। সেকারণেই তিনি যা বলেন/লেখেন তা জরুরি হয়ে ওঠে। হুটহাট বলেন না বলেই।) কথা মাথায় রেখে ফন্দি আঁটি কোনোভাবে একটি বক্তৃতা করিয়ে নেয়া যায় কিনা তাঁকে দিয়ে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনুজ সহযোদ্ধাদের মধ্যে আরিফুল ইসলাম শশী আর ইস্ক্রা এগিয়ে আসে বন্ধুর মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরা একটা মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে ‘মুক্তধারা’ নামে। শশী/ইস্ক্রাকে বলেছিলাম ওই আলোচনার ধরনটাই একটু পাল্টিয়ে যেন বখতিয়ার ভাইকে দিয়ে একটি আলোচনা করিয়ে নেয়। সেই আলোচনাই এখানে হাজির হলো আলোচকের নিজস্ব খানিক-সম্পাদনাসহ। আর আড়াই ঘণ্টার ধারণকৃত অডিও ক্লিপ থেকে এই বক্তব্যের অনুলিপি তৈরির দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন পিংকি ভৌমিক, খোরশেদ আলম আর মুজাহিদ আহসান, আমার তিন বন্ধু-সহযোদ্ধা-সহজন। তাদের আগাম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি।
বখতিয়ার আহমেদ আমাদের দেখিয়েছেন, আইনবহির্ভূত/বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলা হচ্ছে যাকে, তার শর্ত আদতে রাষ্ট্র আর আইনের অভ্যন্তরেই লুকিয়ে আছে। রাষ্ট্রীয়-আইনি জগতের অভ্যন্তরে ওইসব কথিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেসব কথকতা রচিত হয় তা বিশ্লেষণ করে বখতিয়ার আহমেদ দেখিয়েছেন, কী করে তা রাষ্ট্র নামের হত্যাযন্ত্রের প্রবহমানতা জারি রাখে। সবশেষে মানুষকে নিয়ে আশাবাদী এই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক তাগিদ দিয়েছেন পাল্টা কথকতা নির্মাণের।
সঙকলনেই জানানো হয়েছে, রচনাটি একটি বক্তৃতার সম্পাদিত অনুলিপি। বক্তৃতার শ্রুতিলিখিত অনুলিপির উপর লেখক সম্পাদনা চালিয়েছেন। অনেক বাক্য ও বাক্যাংশ পুনরাবৃত্তিজনিত কারণে বাদ দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু বা যুক্তি স্পষ্ট করবার জন্য নতুন বাক্য যোগ করা হয়েছে। অনেক বাক্য কাঠামোতে বক্তৃতাজনিত তোতলামি সারানো হয়েছে। কিন্তু পুরো আলোচনার ধারাবাহিকতা আর বাক-ভঙ্গিমা মূল বক্তৃতাটির কাছাকাছি থেকে গেল।
অরাজের পাঠকেদের জন্য রচনাটি প্রকাশ করা হল।
মুক্তধারার খোলা আলাপ
২৭ মে ২০১৪, মঙ্গলবার। কক্ষ নং ১০৪, নৃবিজ্ঞান গ্যালারি, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভবন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
শুরু করি মুক্তধারার আজকের আয়োজন। মুক্তধারার আয়োজন হিসেবে আজকেরটা একটু ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম দুইটা অর্থে, একটা হচ্ছে অনেক নতুন মুখ আজ এসেছেন এখানে, অনেকেই প্রথমবারের মতন। এটা বোধহয় মুক্তধারার সপ্তমবারের মত খোলা আলাপে বসা। আগের ছয়টা বৈঠকে আমরা যেভাবে আলাপ চর্চা করেছি তাতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা লেখাপড়ার চর্চাটা যেভাবে করি, ক্লাসরুমে, শিক্ষক উঁচুতে আর শিক্ষার্থীরা নিচুতে, একজন বলবেন বাকিরা শুনবেন, এরকম গৎ বাঁধা প্র্যাকটিস আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম। যতটুকু সম্ভব এগুলোর বাইরে এসে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিদ্যায়াতনে ক্ষমতার যে বিন্যাস, সেই বিন্যাসটাকে অস্বীকার করে জ্ঞানচর্চা সম্ভব করে তুলতে চেয়েছি। তো, তারপরেও আমরা জায়গা খুঁজতে গিয়ে দেখি ক্লাসরুম ছাড়া জায়গা নেই। আর ক্লাসরুম মানেই এই স্পেসের ব্যবহারিক সুবিধা যেমন আছে তেমন একটা রাজনৈতিক বিন্যাসও আছে। আমরা রাজনৈতিক সময়ে বাস করি, এখন রাজনীতি ক্রমবর্ধমাণ আর সর্বপ্লাবী হয়ে উঠছে। সমাজের অলি-গলি-সন্ধিতে, সমস্ত জায়গার, এমনকি ফিজিক্যাল স্পেস অর্থেও, রাজনীতিকরণ হচ্ছে। আজকের এই স্পেসও তাই, প্রত্যেকটা জায়গারই একটা কর্তৃপক্ষ থাকেন, উনি কর্তৃত্বের অধিকারী। উনি বললে আপনারা বসবেন, উনি বললে আপনারা দাঁড়াবেন, ফিজিক্যালি স্পেসটা এই উঠবস চর্চার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তো মুক্তধারা সেটা অস্বীকার করেই ছয়টা সেশন পার করে ফেলেছে।
আজকের আয়োজনের দ্বিতীয় ব্যতিক্রমটা এখানেই যে আমাকে আগেই আলাদা করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে কথা বলবার, আলাপের সূত্রপাত ঘটাবার। মুক্তধারার চর্চার কথা মাথায় রাখলে, কথা বলার দায়িত্ব যখন পাই তখন আসলে এক অর্থে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। আমরা শিক্ষকরা মাঝে মাঝে মজা করে বলি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বছরে একবার, আর আমাদের অলমোস্ট প্রতিদিন। প্রতিদিনই আমাদের ক্লাসে পরীক্ষা দিতে হয়। তো আজকেও ছোট একটা পরীক্ষা আমি দেব, খানিকটা নিরুপায় হয়েই, একটু ক্লাসের আদলে। তার আগে বলে নিই, আমি এই কাজটা করবার জন্য পুরোপুরি সুস্থ নই। একটু জ্বরাক্রান্ত হয়েছি দু’দিন ধরে এবং এসব কিছু মিলিয়ে প্রস্তুতি আমার ভালো না। প্রস্তুতি আধাআধি। একদম প্রস্তুতি না থাকলে ভালো হতো। কিন্তু আধাআধি প্রস্তুতি খারাপ জিনিস। তো এই আধাআধি প্রস্তুতি নিয়েই চেষ্টা করি।
একটু আগেই নিউটন ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল যে প্রস্তুতি নিয়েও কি খুব একটা লাভ আছে? সময়টাই এমন যে আমরা যা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি সেরকম স্পর্শকাতর বিষয় তো বটেই, স্রেফ চিন্তা করাটাই খুব কঠিন কাজ হয়ে গিয়েছে। গুছিয়ে চিন্তা করতে পারাটা খুব কঠিন, পরিস্থিতিগত কারণেই। আজকে হয়তো আমার চিন্তার ব্যর্থতাগুলো চোখে পড়বে আপনাদের। এটার দায় শুধুমাত্র যিনি চিন্তা করতে যাচ্ছেন তার না। সময়টাই এরকম যখন কোন একটা বিষয়কে আলাদা করে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে কোন একটা সূত্রে পৌঁছে যাওয়া খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও আমি চেষ্টা করেছি গুছিয়ে ভাবতে। আমার সাহসের কমতি নেই। কমতি নেই কারণ আমি আলোচ্য সমস্যার সার্বজনীন এবং সব জায়গায় প্রয়োগযোগ্য কোন সমাধানের রাস্তা দেখানোকে কাজ হিসেবে নিচ্ছি না। কাজ হিসেবে নিচ্ছি নিজের জায়গা থেকে আমার যে অগোছালো চিন্তা-ভাবনাগুলি আছে সেগুলি আপনাদের সাথে মিলিয়ে নেয়াটা। কাজেই আপনাদের হেল্প চাই, আলোচনায় অংশগ্রহণ চাই। এবং আশা করছি আমরা কোন একটা জায়গায় পৌঁছতে পারবো। তো আমি কাঠগড়ায় দাঁড়াই আর বোর্ডে একটু লেখালেখিও শুরু করি।
আমার আলোচনার শিরোনাম হিসেবে ধার্য করেছি ‘গুম-খুন-আতঙ্ক : শাসনপ্রণালী ও হত্যার কথকতা’। এইটাকে বিষয় করবার একটু ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সেটা হচ্ছে আজকের সেশনটার জন্য আর একজন দায়ী লোক এখানে নেই। এই লোকটির নাম বাধন অধিকারী। আমাদের এখানকার শিক্ষার্থী ছিলেন গণযোগাযোগের এবং আপনারা হয়তো তাঁর লেখালেখি এবং কার্যকলাপের সূত্রে অনেকেই তাঁকে চেনেন। বাধন বছর আট-নয়-দশ ধরে আমার পেছনে লেগে আছেন এই বিষয়টি নিয়ে। সেই ক্রসফায়ার যুগের শুরু থেকে। আমাকে ক্রমাগত বলে গেছেন ক্রসফায়ার নিয়ে আপনি কিছু করেন, আপনি কিছু লেখেন, আপনি কিছু বলেন এবং আমি বরাবরই করবো-লিখব-বলবো বলি এবং করি না। এটা আমার স্বভাবজাত সমস্যা এবং বাধন আমাকে লজ্জা দেওয়ার জন্য যা যা সম্ভব সবই করেছেন। ২০০৫ সালে বিশাল পরিমাণ নিউজ কাভারেজ কালেক্ট করে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু আমি কাজ করতে পারিনি এবং ২০০৭ সালে আমি বাইরে চলে যাই। বাইরে চলে যাওয়ার পরও সমাজবিদ হিসেবে ক্রসফায়ার দীর্ঘদিন আমার মাথায় থেকেছে। আমি অনেক ভেবেছি কিন্তু বাস্তব অর্থে কোনকিছুই করা হয়নি, না গবেষণা, না লেখালেখি। সেই হতাশা থেকেই বাধন হয়তো শশীসহ আরও কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করেছেন যে আমাকে দিয়ে কিছু বলিয়ে রেকর্ড করে নিয়ে হলেও কোন লেখা দাঁড় করানো যায় কিনা।
নিজের অকর্মণ্যতার জন্য লজ্জা পাচ্ছি আর বাধনকে মিস করছি আজকে। এই পুরো সময়টাতে আমার বোঝাপড়া, চিন্তা-ভাবনা এবং গবেষণার এজেন্ডা হিসেবে ক্রসফায়ার বা গুম-খুন বিষয়গুলিকে টিকিয়ে রাখবার জন্য বাধন সবকিছু করেছেন। আসলে বাধনের এই উসকানিতেই আমি খুব সচেতনভাবে এসব নিয়ে এই কয়টা বছর আমার সাধ্যমতো ভেবেছি। এবং সেই ভাবাভাবির একমাত্র বস্তুগত ফলাফল হচ্ছে বছর দু’য়েক আগে আমার ফেসবুকে একটা লেখা ‘গুম-খুন-আতঙ্ক : দরিদ্র বিশ্বের সাম্রাজ্যিক মাৎসন্যায়’ শিরোনামে। আজকের বিষয়ের ‘গুম-খুন-আতঙ্ক’ অংশটুকু সেখান থেকেই আসা। এটা আমি লিখেছিলাম, আপনাদের মনে থাকবে, যখন ইলিয়াস আলী গুম হয়ে যান, বিএনপির নেতা, এক সময়ের ছাত্রনেতা। সন্ত্রাসী ছাত্রনেতা হিসেবেই যার ইমেজটা বেশি বড় আকারে ছিল ছাত্র-রাজনীতিতে। তিনি যখন গুম হয়ে গেলেন, কাছাকাছি সময়ে গার্মেন্টস নেতা আমিনুলও গুম হয়ে যান। এই বড় এবং আলোচিত দুইটা গুমের ঘটনার পর আমি লেখাটি লেখি। সেই লেখাটির প্রসঙ্গে আমি আসব পরে। আপনারা হয়তো কেউ কেউ ফেসবুকে এই লেখাটা দেখেছেন।
একটু গোড়ার আলোচনা দিয়ে শুরু করি। আমি নিজে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে একজন অ্যানথ্রোপলজিস্টও। অ্যানথ্রোপলজি পড়াই, পড়ি এবং বয়সের অর্ধেক সময় ধরে ভাবনা-চিন্তার অংশ হয়ে আছে অ্যানথ্রোপলজি। ফলে, যখন চিন্তা-ভাবনা করি তখন অ্যানথ্রোপলজিকে এড়িয়ে যাওয়া খুব মুশকিল হয়। আমি বলেছি যে, আলোচ্য বিষয় নিয়ে কথা বলা, ভাবনা-চিন্তা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি একরকম বিপদজনকও হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে যারা এসব নিয়ে কার্যকর ভাবনা-চিন্তা করবেন, প্রকাশ্যে বলবেন, দেশ উদ্ধারের কথা ভাববেন, তাদেরও লাশ হিসেবে উদ্ধার হয়ে যাবার একটা আশঙ্কা আছে। পরিস্থিতিটা কাছাকাছি এরকমই।
এরকম পরিস্থিতিতে যখন চিন্তা করতে হয়, সেটা তখন একটা সাধারণ ক্রিয়ার চেয়েও বেশি কিছু হয়ে ওঠে। সিনসিয়ারলি চিন্তা করা, অনেস্টলি চিন্তা করা আসলে একটা অ্যাকশন, সামটাইমস একটা পিওরলি পলিটিক্যাল অ্যাকশন। তো সেই অ্যাকশনের শুরুতেই এতো কিছুর মধ্যে থেকে আমরা শুধু হত্যাকে বেছে নিই। নৃবিজ্ঞানের অনেক সংজ্ঞার মধ্যে একটি হচ্ছে মানুষের প্রজাতি ও প্রকৃতিজনিত কলাক্রিয়ার অংশ হিসেবে মানবীয়তার সংজ্ঞা বিনির্মাণের বিজ্ঞান এইটি। মার্ডার বা কিলিং বা হত্যা, এটা নিয়ে একজন অ্যানথ্রোপলজিস্ট সবচে আগে যে প্রশ্নটা তুলবেন সেটা হচ্ছে হত্যা মানবীয় বিষয় কিনা বা মানবীয়তার অংশ কিনা, মানুষের অংশ কিনা, মানুষের কার্যকলাপ কিনা? এটা কি প্রাকৃতিক নাকি একটা অর্জিত সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ব্যাপার? হত্যা কী প্রাকৃতিক একটা বিষয়? মানুষ মাত্রই কী সমাজে সব সময় শাশ্বতভাবে একই প্রজাতির এক সদস্য আরেক সদস্যকে খুন করে, মেরে ফেলে? আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ এবং শিশুসুলভ প্রশ্ন মনে হচ্ছে। কিন্তু এর উত্তর খুঁজবার জন্য নৃবিজ্ঞানী হয়তো প্রথমেই জানতে চাইবেন মানুষ যে মানুষকে খুন করে এটা অন্য কোন প্রজাতির মধ্যে দেখা যায় কিনা? অন্য কোন প্রজাতি কি এক প্রজাতির আরেক সদস্যকে হত্যা করে কিনা? এই অনুমানটার উপর নির্ভর করে আছে আজকে হত্যা সম্পর্কে প্রচলিত সব ধ্যান-ধারণার বিচার। হত্যার বৈধতা এবং অবৈধতা এই অনুমানটার উপর নির্ভর করে টিকে আছে যে মানুষের প্রকৃতিটা কী? এটা কি মানব প্রকৃতির অংশ? আমরা যে হত্যা করে ফেলি আমাদের প্রজাতিরই অন্য সদস্যকে এটা কি মানবিক? এটা কি প্রাকৃতিক কোন সত্য?
আপনারা একটু পার্টিসিপেট করলে মনে হয় ভালো হয় আলোচনাটায়। কী মনে হয় আপনাদের? মানে আমাদের হাতে কি আছে? ইতিহাস ঘেটে এটা দেখবার উপায় আমাদের হাতে খুব বেশি নেই। এটা ইতিহাসের এমন একটা স্তরের ব্যাপার যে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুব একটা পাওয়া যায় না। আমরা যদি ধরে নিই যে, প্রাকৃতিকভাবে ইতিহাসে সবসময় হত্যা জিনিসটা ছিল না, তাহলে কবে থেকে এটা শুরু হলো, সেটা জানতে আমাদের ইতিহাসে এতোদূর ট্রাভেল করতে হবে যেখানে আসলে ঐতিহাসিক প্রমাণ-টমান বলে স্বীকৃত কিছু নেই। তাহলে উপায় কী? ইতিহাস নিয়ে যেসব কথাবার্তা চালু আছে, তাতে এটুকু স্বীকৃত যে ইতিহাসের আগেও মানুষের ইতিহাস ছিল। অর্থাৎ ইতিহাসের আগেও ইতিহাস ছিল পৌরাণিকতায় আবদ্ধ হয়ে। সেই পৌরাণিক যুগে আমরা কীভাবে দেখছি হত্যার বিষয়টিকে? পূরাণ আমাদের কী জানায় এ নিয়ে?
আমরা যারা ইসলামিক মিথলোজি বা ইসলামিক পুরান অথবা কোরআনের সাথে, বা সেমেটিক ধর্মের ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত আমরা জানি যে সেখানেও মানুষের উৎস আর ইতিহাস সম্পর্কে একটা বয়ান আছে। সেখানে কোন প্রশ্নই সমাধানের বাইরে না। ওখানে হত্যা কীভাবে শুরু হলো তার একটা ব্যাখ্যাও আছে। আদি মানব আদম আদি অপরাধ অর্থাৎ অরিজিনাল সিন, জ্ঞানবৃক্ষের ফল গন্ধম খাওয়ার ফলে স্বর্গচ্যূত হলেন, হয়ে পৃথিবীতে আসলেন। পৃথিবীতে মানবজাতির শুরু হলো। আদম আর হাওয়ার প্রথম দুই পুত্রসন্তানের নাম ছিল-কাবিল আর হাবিল, বাইবেলে যাদের পাওয়া যায় কেইন এন্ড আবেল নামে। কাবিল ছিলেন মর্ত্যে মানুষের গর্ভে জন্ম নেয়া প্রথম মানুষ, আর হাবিল ছিলেন মর্ত্যে মানুষের হাতে খুন হওয়া প্রথম মানুষ। হিব্রু বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বে কাবিল ছিলেন কৃষক আর হাবিল ছিলেন মেষপালক। দুজনেই এক সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কোরবানি করলেন। কিন্তু হাবিলের ন্যায়নিষ্ঠার কারণে আল্লাহ শুধু তার কোরবানিই কবুল করলেন, কাবিলেরটা না। এতে কাবিল ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিহিংসার বশে খুন করে বসলেন হাবিলকে। এই হত্যাই মর্ত্যে সংগঠিত প্রথম পাপ, আদি পার্থিব অপরাধ। এই হত্যার পরেই আল্লাহ এক কাক পাঠিয়ে দেন, যা মাটি খুঁড়ে হাবিলের ‘মৃতদেহ’ কবর দেয়া দেখিয়ে দেয় কাবিলকে। অনুশোচনায় কাঁদতে থাকা কাবিল ছোটভাইকে কবর দেন। হত্যা মানুষের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠে।
‘মৃতদেহ’ কথাটার উপরে আমি জোর দিচ্ছি কারণ আমরা যে আলোচনায় এগোবো, সেখানে দেহ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে। মানুষ মৃত হয়ে যাবার পরে তার দেহটিকে কী করে আমরা কী করবো, এটা নিয়ে প্রত্যেকটা সংস্কৃতিতে, দুনিয়ার সব সমাজেই খুব গভীর কিছু আচার-অনুষ্ঠান আছে। এই আচারগুলোর মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, আমরা কীভাবে দার্শনিকভাবে মৃত্যু ঘটনাটার মুখোমুখি হই। আধুনিক সমাজে হত্যাকে কেন্দ্র করে নিহতের মৃতদেহ নিয়ে রাষ্ট্রীয় তথা আইনী তথা সেকুলার আচার-অনুষ্ঠান আছে। এই আচার-অনুষ্ঠানগুলোর নিবিষ্ট পাঠ আমরা হত্যা কীভাবে ম্যানেজ করি, হত্যার মোরাল, লিগাল এবং পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট তৈরি করি সেটা বোঝা যায়। সাহিত্য-শিল্পকলায় এজন্য শোনা যায় কাউকে লাশকাটা ঘরে নেয়ার গভীর সংবাদ কিংবা হাজার চুরাশির মায়ের নির্লিপ্ত বিষাদ বাঙময় হয়ে উঠে উপন্যাস বা সিনেমায়।
তাহলে হত্যা কী মানুষের সমাজে এতো প্রাচীন কোন বিষয়? এতো আদিম কোন প্রবৃত্তি? ভাবার মতোই বিষয়। আমার কাছে সব সময় কাবিলের কৃষক হওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। আজকে আমরা বিজ্ঞানের বরাতে জানি যে কৃষির আবির্ভাব দশ থেকে বারো হাজার বছর আগে। কাজেই মানুষের সমাজের অন্য অনেক আপাত শ্বাশ্বত প্রপঞ্চের মতন হত্যার সাথেও যদি কৃষির আবির্ভাবের কোন সম্পর্ক থাকে তো আমি অন্তত অবাক হব না। আজকে বিজ্ঞানের পথ ধরে আমরা যদি হত্যার উৎসমূল খুঁজতে রওনা দিই তো আমাদের হেঁটে আসতে হবে কৃষির আবির্ভাব থেকে শুরু করে ধাতুর ব্যবহার পর্যন্ত অনেক কিছুতেই। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমাদের যেতে হবে ত্রাস-রাষ্ট্র-আইন-কানুন ইত্যাদির আর্কিওলজিতে। তারপরেও সুনিশ্চিত কোন উত্তর বোধহয় পাওয়া যাবে না।
সো আমরা আজকে যখন নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার নিয়ে সোশিওলজিক্যালি বা অ্যানথ্রপলজিক্যালি ডিল করি, যখন সিস্টেমেটিক চিন্তা-ভাবনার চেষ্টা করি, তখন মানুষের ইতিহাসের এতো সুদূর পর্যন্ত আমাদেরকে দেখতে হয়। কারণ সমস্যাটার গোড়া এতো গভীরেই প্রোথিত। ফলে আমাদের মাথায় রাখতে হয় অনেকগুলো প্রশ্ন। হত্যা নামে যে একটা ঘটনা ঘটে মানুষে মানুষে, এটাকে সমাজগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে; ঐতিহাসিকভাবে কীভাবে এটাকে মীমাংসা করে; দার্শনিকভাবে এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করে? এবং ধীরে ধীরে কী করে হত্যা, খোদ হত্যারই একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে যায়? হত্যার চর্চা কীভাবে মানুষের জীবনযাপনেরই অংশ হয়ে ওঠে? তো, এতো গুরুতর একটা ব্যাপার নিয়ে আমরা একসাথে কথাবার্তা যখন বলতে চাইছি তখন আসলে আপনাদের সাথে আমার খানিকটা লিঙগুইস্টিক টিউন-আপ দরকার।
টিউন-আপ এই অর্থে যে, আলোচনায় আমি যে চাবিশব্দগুলো ব্যবহার করবো সেগুলোর অর্থ আমরা সবাই কাছাকাছি বুঝি কিনা। একই জিনিস বোঝা খুব জরুরি না, কিন্তু আলোচনার জন্য কিছু একদম প্রাথমিক বোঝাপড়ার জায়গা মিলিয়ে নেয়া দরকার যাতে কমিউনিকেট করতে পারা যায়। কারণ একই শব্দ দিয়ে এত বেশি ধরনের জ্ঞান প্রচলিত থাকে, যেগুলো আমরা সচরাচর খেয়াল করি না। ফলে ওই জায়গাটাতে আমাদের একটু বোঝাপড়া করে নিতে হবে। আলোচনার চাবিশব্দ আপনারাও প্রপোজ করতে পারেন। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু শব্দকে আমরা পরীক্ষা করে নিই। এই শব্দগুলো বলতে আমরা কে কি বুঝি। চাবিশব্দ মানে যে শব্দ আসলে চিন্তার তালা খুলবে। তো সেটা করতে গিয়ে প্রথমে বোর্ডে লিখি ‘রাষ্ট্র’।
রাষ্ট্র বলতে আমরা কে কী বুঝি? রাষ্ট্র বলতে আমাদের কমনসেন্স কি বোঝে? আমাদের আপামর সাধারণ মানুষ কি বোঝে? আমরা নিজেরা কী বুঝি? এই জায়গাটা খুবই অনড়, খুবই ইনএভিটেবল, অনিবার্য। মানে রাষ্ট্র এতোটাই স্বাভাবিক জিনিস যে আমরা এটা নিয়ে দ্বিতীয়বার খুব একটা ভাবি না। আজকে রাষ্ট্রের আমরা যা কিছু নিয়ে ভাবি, এমনকি আমরা ক্রসফায়ার নিয়েও যখন বলি, আমরা বলি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, অথবা রাষ্ট্রেরই আরেকটা রূপ হলো আইন, সেই আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
‘কথকতা’ আরেকটা চাবিশব্দ। কথকতা বলতে আমি কী বুঝছি, আপনারা কী বুঝছেন? আমার মনে হয়, রাষ্ট্রে যাওয়ার আগে ‘কথকতা’ নিয়ে কথা বললেই ভালো হয়। ইংরেজি ভাষায় যেটাকে বলে ডিসকোর্স, তার একটা মোটামোটি চলনসই বাংলা হিসেবে এই লেখায় আমি প্রস্তাব করছি ‘কথকতা’।
তো ডিসকোর্স বলতে নানা কিছু বোঝায়। মানে সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায়, ভাষাতত্ত্বের আলোচনায়, একেক সায়েন্সের আলোচনায় এর একেক অর্থ আছে। আমাদের আজকের আলোচনার জন্য আমি প্রস্তাব করবো, কথকতা হচ্ছে, খুব সহজ করে নিলে, আমরা ভাষার মধ্য দিয়ে যে চিন্তার প্রকাশ ঘটাই তার রাজনৈতিক বিন্যাস, অর্থ্যাৎ চিন্তার রাজনৈতিক সংগঠনের একটা উপায় হচ্ছে কথকতা। দেখা যায় যে আমরা ভাষা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ব্যাকরণের নিয়ম মানি না, তারও বাইরে আমরা কিছু নিয়ম মানি যেগুলো মোটাদাগে রাজনৈতিক বা পলিটিক্যাল। কাজেই কথকতা বলতে আমি বলবো যে টপিক অনুযায়ী, অর্থাৎ বিষয়বস্তু অনুযায়ী, প্রত্যেকটা বিষয়ে কথা বলবার জন্য গ্রামাটিক্যাল রুলসের বাইরেও কিছু রুলস আছে সেগুলোকে। এই নিয়মগুলো আমাদের কথাকে শাসন করে এবং অনেকেই মনে করেন, শুধুমাত্র আমাদের কথাকেই শাসন করে না, ভাষাকেই শাসন করে না, আমাদের চিন্তাকেও শাসন করে। কারণ ভাষা আর চিন্তা খুব আলাদা কিছু না। ডিসকোর্স কোন বিষয়ে কি ভাবতে হবে, কী বলতে হবে, এবং কী বুঝতে হবে সেটা রাজনৈতিকভাবে নির্ধারণ করে দেয়। তো প্রতিটা বিষয়েরই এরকম একটা ডিসকোর্স থাকে, একটা কথকতা থাকে। আজকে আমরা এই গুম-খুন-আতঙ্ক এবং এগুলো বিষয়ে যে কথকতা, সেই কথকতা নিয়ে আলোচনা করবো।
আমাদের আরেকটা চাবিশব্দ ‘রাষ্ট্র’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা সেটা আমি খুব বেশি জানি না। সংবিধান-সরকার, সার্বভৌমত্ব এবং জনগণ নিয়ে একটা রাষ্ট্র হয়, এটা আমাদের ছোট ক্লাসের বইতে লেখা থাকে। এতে করে, আমি আজকে এসে যেটা বুঝি, রাষ্ট্রের আসল উপাদানটাকে বাদ দিয়ে যাওয়া হয়। রাষ্ট্রের সবচে মৌলিক উপাদান হচ্ছে ত্রাস, সন্ত্রাস। এটা আমার কথা না। আপনারা ম্যাক্স বেভারের কথা জানেন, ফ্রেডরিখ নীৎশের কথা জানেন, তারা বহু আগেই বলেছিলেন যে, রাষ্ট্র জিনিসটা হচ্ছে ত্রাস, সন্ত্রাস ছাড়া রাষ্ট্র সম্ভব না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে সন্ত্রাস, ম্যাক্স বেভারের ভাষায় বৈধ সন্ত্রাসের একচেটিয়া অধিকার হচ্ছে রাষ্ট্রের ভিত্তি। কথাটা খেয়াল করেন। বৈধ সন্ত্রাসের মনোপলি অর্থাৎ একচেটিয়া অধিকার হচ্ছে রাষ্ট্রের ভিত্তি। এটা ছাড়া রাষ্ট্র সম্ভব না। ম্যাক্স বেভারেরও বহু আগে, আমাদের ভারতবর্ষে মনু সংহিতাতেও বলা আছে ‘রাষ্ট্রং বাহুবলাশ্রিতম’, মানে রাষ্ট্র হচ্ছে বাহুবলে আশ্রিত একটা কিছু। সেটা সাধারণত পুরুষ বা ক্লীববাচক কর্তৃবাচ্য পদ যার মানে হিসেবে অভিধানে একাধারে পাওয়া যায় রাজ্য, দেশ, বিষয়, জনপদ, তস্কর, উপদ্রব, মকরাদি, দূর্ভিক্ষ, প্রজাপীড়ন ইত্যাদি। খেয়াল করলেই দেখা যায় এর অর্থগুলো অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরোধী।
ইতিহাসেরও আগের ইতিহাসে যাওয়ার আরেকটা সম্ভাব্য পথ হচ্ছে ভাষার পথ। শব্দেরা ভাষায় কেন কী কারণে অর্থ বদলেছে সেটা বিশ্লেষণ আসলে আমাদের ইতিহাস কল্পনার একটা দারুণ কার্যকরী পথ হতে পারে। ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির অর্থও আসলে গোটা ইতিহাস জুড়ে একরকম ছিল না। যেমন ছিল না ইংরেজি স্টেইট শব্দটির অর্থও। এমনকি আজকেও একরকম নেই। এসব বিষয়ে আমরা আবার ফিরব। আমাদের ফিরতেই হবে। কারণ এই সব ভাষাগত দ্ব্যর্থকতা আসলে চিন্তাগত দ্ব্যর্থকতা। কারণ ভাষাই চিন্তা, চিন্তার ইতিহাস আমাদের ভাষাতেই খুঁজতে হয়।
কীভাবে রাষ্ট্র মানে সন্ত্রাস? আমি বলি রাষ্ট্র হচ্ছে ত্রাসের কানাগলি, রাষ্ট্র মানে সন্ত্রাসের মনোপলি। কীভাবে? গল্পটা বলা হয় এভাবে : সপ্তদশ শতকে একজন ইংরেজ দার্শনিক ছিলেন, থমাস হবস। তিনি বলেছিলেন, ঠিক আমরা যে চিন্তা নিয়ে আজকে শুরু করেছি, আদিতে মানব প্রকৃতি কেমন ছিল? মানুষের চরিত্র, মানে একদম প্রাকৃতিক স্বভাব-বৈশিষ্ট্য কী? মানুষ কি নিজেদের প্রজাতির ভেতরে মারামারি করে নাকি মিল-মহব্বত করে? কোনটা মানুষের মনুষত্ব? একে অপরের প্রতি মমত্ব-সহযোগিতা এগুলো মানুষের প্রকৃতি নাকি একে অপরের সাথে মারামারি আর প্রতিযোগিতাই মানব প্রকৃতি? মানুষ স্বার্থের দ্বারা তাড়িত নাকি মমত্বের দ্বারা তাড়িত? কোনটা মনুষ্যত্ব? এবং হবস মনে করতেন যে, মানুষ আসলে খুব খারাপ প্রাণী। মানুষে মানুষে দেখা হলেই দ্বন্দ্ব-সংহার-মারামারি শুরু হয়ে যেত এবং সেই আদিম সমাজ সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে হবস কিছু ‘বিখ্যাত’ বিশ্লেষণ ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর ভাষায় প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন ছিল ‘পুওর’, ‘সলিটারি’, ‘ন্যাস্টি’, ‘ব্রুটিশ’এবং ‘শর্ট’।
হবসের বিশেষণগুলো বিখ্যাত হয়ে গেছে। তখন ছিল সবার সাথে সবার যুদ্ধ, ওয়ার অল অ্যাগেইনস্ট অল, আর হবস মনে করতেন এটাই ছিল মানুষের প্রাকৃতিক দশা। এটাই হচ্ছে অর্ডার। অর্ডার মানে এটাই হচ্ছে আদর্শ স্থিত অবস্থা বা প্রাকৃতিক অবস্থা। এবং যেহেতু সবার সাথে সবার যুদ্ধ, তখন সব মানুষ মিলে ঠিক করলো কি, যেহেতু সবাই স্বাধীন, স্বাধীন মানে কী? স্বাধীনতা কথাটাকে হবসের অর্থে নিলে দাঁড়ায়, যেহেতু সবাই স্বাধীন, একজনের স্বাধীনতার সাথে আরেকজনের স্বাধীনতার সংঘাত অনিবার্য। এই সংঘাতের কারণেই সবার সাথে সবার প্রতিযোগিতা, সবার সাথে সবার মারামারি। ফলে মানুষ একটা সময় এসে, সবাই নিজের যে স্বাধীনতা, মানে সেই স্বাধীনতার একটা অংশ স্যারেন্ডার করলো। স্যারেন্ডার করলো মানে এক জায়গায় কোথাও রাখলো। সে জিনিসটার নাম হচ্ছে সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের আরেকটা উপাদান। রাষ্ট্র তখন একটা অর্ডার, নতুন একটা অর্ডার এস্টাবলিশড হচ্ছে যেখানে মারামারি-ধরাধরি-খুন এগুলো যা করা দরকার সেগুলো রাষ্ট্র একাই করবে। যেটা বললাম আমি, সন্ত্রাস করবার একচেটিয়া অধিকার কেবল রাষ্ট্রের। একচেটিয়া অধিকার মানে মারামারি-গোলাগুলি যা করার আমরা করবো, রাষ্ট্র করবে, আর কেউ করবে না। যদি আর কারও করার দরকার হয়, সে রাষ্ট্রের মাধ্যমে করবে। অর্থাৎ বিচারব্যবস্থা, আইন, আদালত এগুলোর মধ্য দিয়ে সেই ঘটনাটা ঘটবে। মানে একদম আমরা যেমন ওয়েস্টার্ন ছবিতে দেখি, যেভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, হয়। গোলাগুলি যা করা দরকার আইন বা পুলিশ নিজে করবে আর কেউ করবে না, এরকম একটা জায়গায় এসে, রাষ্ট্র যৌক্তিকতা পায়। সুতরাং এটাই আধুনিক জ্ঞান। আমাদের যে কাণ্ডজ্ঞান, কমনসেন্স, এর ভেতরে আছে যে, যদি আইন-রাষ্ট্র এগুলো না থাকে তাহলে কালকেই আমার সাথে আপনার মারামারি শুরু হয়ে যাবে। এবং কালকেই রাস্তায় দেখা হলেই আমরা আগে মারামারি করতে শুরু করবো। এরকম একটা অনুমান কিন্তু জন-মানসে কাজ করে বলে রাষ্ট্র জিনিসটা আমাদের কমনসেন্সে বৈধতা পেতে থাকে। বৈধতা পায়। এবং এই বৈধতাকে আমরা স্বীকার করে নিই। সো, রাষ্ট্র আমাদের আলোচনার চাবিশব্দ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটা চাবিশব্দ হওয়া উচিত ‘আইন’। আইন বলতেও আমরা সবাই আসলে একই জিনিস বুঝি কিনা। আইন কথাটার অর্থ আসলে রাষ্ট্রের এই ইতিহাসের সাথে ঘোট পাকিয়ে অনেকখানি বদলে গেছে, মিলেমিশে গেছে। মানুষের সমাজ, সমাজ পরিচালনা, সমাজের গতিশীলতা, সমাজ সংগঠন, এগুলোর সূত্র হিসেবে আইনকে আমরা দেখি। কিন্তু একটু ভালোমতো খেয়াল করলে দেখা যায় যে আজকে মানুষের সমাজ সংগঠনের সাথে আইনের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। এটা বরঞ্চ আরও বেশি প্রোথিত হচ্ছে যে বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ধীরে ধীরে সমাজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে থাকে সেখানে। সমাজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেয়ার যে উপায়, সেই উপায়টাই হচ্ছে আইন। এবং আধুনিক আইনের ভিত্তি রাষ্ট্রের মতোই। আইনের ভিত্তিও হচ্ছে সন্ত্রাস। যেকোন রাষ্ট্রের প্রথম সন্ত্রাসী জিনিসটার নাম হলো ‘আইন’। আইন হয়ে উঠেছে সেই সন্ত্রাসী ব্যবস্থা যা ন্যায়বিচারের নামে, শান্তি-শৃংখলার নামে বলপ্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু আইন জিনিসটাকে আমরা এতটাই মান্যতার নৈতিক দৃষ্টি দিয়ে দেখি যে এটাকে রাষ্ট্রের মতই অমোঘ, অনিবার্য এবং অবিকল্প দেখায়। কিন্তু আদতেই আজকের আধুনিক অর্থে আইন মানেই সন্ত্রাসের অনুমোদিত রূপ। আইনের উপস্থিতিই রাষ্ট্রকে এর রক্ষাকর্তা হিসেবে আরেকটু ভূমিকা তৈরি করে দেয় যার জোরে রাষ্ট্র স্বাভাবিকতা পায়। এর বলপ্রয়োগের দিকটি আমাদের নৈতিকতায় বৈধতা পায়। বৈধতা পেলেও আইন নিজে একটি সন্ত্রাস নির্ভর ব্যবস্থা সেটা অস্বীকার করা যায় না। কারণ হিসেবে অন্য অনেক যুক্তি দেয়া যায়। কিন্তু একটা সহজ যুক্তি হচ্ছে আইন প্রয়োগ করতে সবসময় বন্দুক লাগে। আইন হচ্ছে এমন একটা জিনিস যেটা বন্দুক দিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। আপনারা খবরের কাগজে দেখেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কারা? আমাদের দেশে বা দুনিয়ার সব জায়গাতেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মানে হচ্ছে বন্দুকধারী বাহিনী। তাই না? তার মানে আইনেরও ভিত্তি হচ্ছে কী? আইনেরও ভিত্তি হচ্ছে সন্ত্রাস। আরও সহজ করে বলি ত্রাস। সেটা কীভাবে?
আইন মোটাদাগে যেভাবে কাজ করে, সেটা হচ্ছে সে ভয় দেখিয়ে কাজ সারতে চায়, ত্রাস সৃষ্টি করে কাজ সারতে চায়। ভয় দেখিয়ে কাজ সারার অর্থ কী? ভয় দেখিয়ে কাজ সারার অর্থ হচ্ছে এই অপরাধ করলে আমি ফাঁসিতে ঝুলায় দেব, বলে আমি একজনকে ফাঁসিতে ঝুলায় দিলাম। তাতে সে যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি দেয়া হলো, আবার অন্যদের সামনে এই দৃষ্টান্ত ঝুলিয়ে রাখা হলো যে এই কাজ করলে এমন করে ফাঁসি দেয়া হবে। এইটাই ভয় দেখিয়ে কাজ সারা। এই জায়গায় একটু বলে রাখি, আমরা অনেক সময় বলি যে, সৌদিরা বর্বর। কারণ হচ্ছে ওরা রাস্তায় প্রকাশ্যে গলা কাটে। আর আমরা সভ্য। কারণ আমরা গোপনে জেলখানার আড়ালে রাত বারোটা এক মিনিটে ফাঁসি দেই। মানে যদি আইনের যৌক্তিকতার জায়গা থেকে দেখি, দুটোর কাজতো একই। বরঞ্চ দেখা যায় যে, এরশাদ শিকদারের যেদিন ফাঁসি হয়, পরদিন কিন্তু কোন পত্রিকার কপি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ ঐ যে রহস্যময়তার একটা চাদরে ঢাকা হলো ফাঁসিটাকে। এবং গলায় ফাঁস লাগার পরে ডাক্তার এসে ভেইন কেটে দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য। এবং জল্লাদের দড়ি যে ম্যানিলা থেকে আসে এবং পাকা কলা দিয়ে পাকানো হয় ফাঁসির দড়ি, এসমস্ত তো আমাদের নিউজ পেপারের মধ্য দিয়েই আমরা জানতে পারি। তার মানে হচ্ছে, এই রহস্যময়তা, এই রাতের অন্ধকারের ঘটনাগুলো আমাদের মনের আরো গভীরে দাগ কাটে। ফলে এই ধরনের আলোচনা, সৌদিরা যেহেতু প্রকাশ্যে গলা কাটে, আমরা যেহেতু গোপনে রাত বারোটা এক মিনিটে ফাঁসি দেই, আমরা ওদের চেয়ে বেশি সভ্য, এগুলো হচ্ছে একদমই অসার আলোচনা।
এই ত্রাস সৃষ্টির উপায়টাও যদি খেয়াল করেন তখন বোঝা যায় আইন ত্রাস সৃষ্টি করেই টিকে থাকে। এবং ত্রাস সৃষ্টি করার উপায়টা হচ্ছে নিজেকে এক ধরনের পরাবাস্তবতা দেয়া। এটা আমাদের দৈনন্দিন আটপৌরে বাস্তবতার অংশ না। আপনারা খেয়াল করেন, শুরু থেকেই র্যাবের কালো চশমা, কালো পোশাক, মাথায় পট্টি, যেভাবে মুভ করবে, এসবের মধ্যেই এই মেসেজগুলো দেয়াই আছে। আমাদের মিডিয়া কী করে? মিডিয়া আমাদের ক্রসফায়ারের খবর দেয় ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে ইনভার্টেড কমার মধ্যে শিরোনাম করে। এতে করে মিডিয়া নিজে আইন নিরপেক্ষ থাকে, অর্থাৎ আইনীভাষ্য বা প্রেস রিলিজের প্রতি তারা সরাসরি আঙুল তোলেন না, আবার ইনভার্টেড কমা দিয়ে এর পক্ষে অবস্থান নেয়াটাও তারা এড়িয়ে যান। অর্থাৎ ক্রসফায়ারের প্রেস স্টেটমেন্টের মধ্যে সংগুপ্ত যে আইনী ত্রাস পাবলিকের জন্য বরাদ্দ হয়, তার যে অ্যাম্বিগুইটি বা সংশয়ময়তা সেটা মিডিয়া ঠিক আইনের মত করেই ক্যারি করে। জনসাধারণ হিসেবে আমরা বুঝতেই পারি যে র্যাব প্রত্যেকটা ক্রসফায়ারের পরে একই গল্প বলছে। এটা আমি বুঝতে পারছি। এটা যে বানানো, মিথ্যা এটা আমি বুঝতে পারছি, কাজেই আমি বুদ্ধিমান বলে একটা আত্মপ্রসাদে ভুগি। আমরা বুদ্ধিমান, আমরা বুঝতে পারছি, র্যাব এটা ঠিক বলছে না। কিন্তু আমরা কি আসলেই বুদ্ধিমান? আসলে র্যাব তো প্রতিটা গল্প একই ছকে দিচ্ছে কারণ র্যাব চায় মানুষ জানুক যে দিস ইজ আস, এটা আমরা করছি। কিন্তু এটা যে র্যাব করছে এটা বুঝতে পেরেই আমরা নিজেদেরকে বুদ্ধিমান ভাবছি। ওই ভয়টা এবং তার সাথে যে প্রচারণা মিলিয়ে যে ভয়টা উৎপাদন এবং বিতরণ করা হয় একটা কথকতার মধ্য দিয়ে, ক্রসফায়ার নিয়ে সোশিওলজিক্যালি ভাবতে চাইলে আমাদের সেই কথকতাকেই গবেষণার উপাত্ত করতে হবে।
কি করে ভাবতে হবে? সেদিন ইস্ক্রার সাথে কথা হচ্ছিল যে ক্রসফায়ার নিয়ে ভাবতে গেলে আসলে একটু দিশেহারাই লাগে। এই নিয়ে গুছিয়ে চিন্তা করতে গেলে মনে হয় আসলে রাষ্ট্র, আইন, সমাজের সাথে এদের সম্পর্ক, নাগরিকত্ব এবং সবকিছুর সাথে এগুলো এমনভাবে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে যে, এগুলোকে আলাদা করে শুধুমাত্র ক্রসফায়ারকে দিয়ে, রাষ্ট্র, আইন এগুলোর যে ভাবমূর্তি, সেই ভাবমূর্তিতে আবদ্ধ থেকে ক্রসফায়ার নিয়ে ভেবে কোন সুরাহা করা যাবে না। এক ফাঁকে বলে রাখি যে আমি এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কথা বলছি এই হত্যা, ক্রসফায়ার এইগুলো নিয়ে। এর আগেরটা ছিলো একটা মানবাধিকার সংস্থা আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানে। ছয়মাস কি এক বছরের মধ্যেই; রাজশাহীতে। তো, সেখানে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন মূলতঃ হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস, মানবাধিকার কর্মী। ছিলেন হচ্ছে এ্যাডভোকেটরা, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধি সবাই। সাংবাদিক, অনেক সাংবাদিক ছিলেন। আমি আজকের মতই এরকমই নানা কথা বলি। তারপর আইন বিভাগ থেকে আরেকজন শিক্ষক ছিলেন। তিনিও তাঁর মতো করে বলেন এবং সবশেষে এক ধরনের মতামত নেয়া হয় যে, ক্রসফায়ারের দরকার আছে কি নাই। এবং সারাদিন সেশন শেষে হিইম্যান রাইটস ডিফেন্ডারেরা সবাই বললেন যে এটার দরকার আছে। এটা ছাড়া সম্ভব না আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি সামাল দেয়া। আসলে তখনই হচ্ছে আমাদের সমস্যাটা শুরু হয়ে যায়। আমাদের অবাক হয়ে যেতে হয়। দেখা যায় বৈধতা আর অবৈধতা দিয়ে আসলে ক্রসফায়ারকে ব্যাখ্যাই করা যায় না, নিরাময় তো দূরের ব্যাপার। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে, এইসব ঘটনা বা প্রতিষ্ঠানের পেছনে বিশাল একটা, গভীর একটা সামাজিক অনুমোদন আছে। এই অনুমোদনের কারণেই ক্রসফায়ার আপাতত আইনের বাইরের জিনিস মনে হলেও পুরা প্রক্রিয়াটা আইনের আদলেই কাজ করে। ভয় তৈরি করে, আমাদের অনুমোদন তৈরি করে। এইটা আইনেরই প্রতিকল্প। এটাকে ‘বিচার’ বা ‘আইন’ বহির্ভূত হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে ব্যাখ্যা করা যায় না। ক্রসফায়ার বেআইনী নয়, খোদ আইনেরই কাঠামোগত যমজ। কারণ খোদ আইন জিনিসটা সবসময়ই একটা গোলমেলে জিনিস। আইন নিজেকে নিজে রদ করে দিতে পারে। জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে। কাজেই সমাজবিদ্যার জায়গা থেকে আইনে কি আছে সেটা দিয়ে আইন বোঝা যায় না। আইনকে বুঝতে হয় তার কর্তৃত্ব দিয়ে, সন্ত্রাস দিয়ে, অনুমোদন আদায় দিয়ে এবং তার প্রয়োগ দিয়ে। এই অনুমোদনটা কীভাবে সম্ভব হয়ে উঠে? এটা আমার কথা বলবার পরের জায়গা।
এই যে আমরা সবাই মিলে এই রাষ্ট্র, আইন কিংবা ‘আইন’ বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতন বিষয়গুলোকে অনুমোদন করি, এই অনুমোদনের জায়গাটা কীভাবে তৈরি হয়? যেভাবে সরাসরি ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বা ‘আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ ইত্যাদি বিশেষণ এই ক্রসফায়ার গুম-খুন এগুলো বিষয়ে প্রচলিত আছে, এগুলোকে সন্দেহ করা, বা আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোন সুযোগ আছে কিনা? আমি কি এটুকু পরিষ্কার করতে পারলাম যে, আমি কী নিয়ে জোর দিতে চাচ্ছি? হত্যার কথকতা বলতে আমি কী বলতে চাচ্ছি? এই কথকতার ইতিহাস, আমি এর আগের লেখাটাতে লিখেছিলাম, হত্যার ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিশেল ফুকো বলতেন, আপনারা জানেন একজন দার্শনিক আছেন এই নামে, আশির দশকে মরে গেছেন কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাঁর চিন্তার প্রভাব খুব একটা কমেনি। সমাজ বাস্তবতা, রাষ্ট্র, ক্ষমতা এগুলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক হয়ে আছেন তিনি। তিনি একটা কথা বলেছিলেন যে, মার্ডার ইজ দ্য পয়েন্ট এ্যাট হুইচ হিস্টরি ইন্টারসেক্টস উইথ ক্রাইম। ইতিহাস আর অপরাধের সম্পর্ক নিয়ে এই বাক্যটা আমার খুবই প্রিয় একারণে যে, আমি এটা পুরো বুঝিনি এখনো। ফলে এটা আমাকে ভাবায় অনেক। মার্ডার ইজ দ্য পয়েন্ট যেখানে হিস্ট্রি ইন্টারসেক্টস উইথ ক্রাইম, মানে হত্যার বিন্দু থেকে অপরাধ এবং ইতিহাস অভিন্ন হয়ে যায়। অপরাধ আর ইতিহাসের সহযাত্রার মোহনা হচ্ছে মার্ডার। সে কারণেই আমি শুরুতেই ভাবতে চেয়েছি হত্যা আসলে ইতিহাসের ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু?
ইতিহাস নিয়ে অ্যানথ্রোপলজিস্টদের মধ্যে আরেকটা জনপ্রিয় পদ্ধতি আছে। সেটা হচ্ছে, ইতিহাসে ভ্রমণের জন্য বা ফিল্ডওয়ার্ক করবার জন্য যেহেতু আমাদের টাইম মেশিন নাই, ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার উপায় হিসেবে তারা ফিরে যান সো কলড ‘আদিম সমাজে’। যে সমাজগুলো এখনো আধুনিক হয়ে ওঠেনি, যাদেরকে আমরা ‘আদিবাসী’ ‘পশ্চাৎপদ’ ‘বর্বর’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলি। আরো সহজ করে বললে যে সমাজগুলো রাষ্ট্র ও আইন ব্যবস্থার ভিতরে আসেনি এখনো। এমন সমাজগুলোতে তারা ফিরে যান। তারা দেখতে পান যে এইসব সমাজে হত্যা বা হত্যার ঘটনাকে ম্যানেজ করবার অর্থাৎ হত্যাকে রেগুলেট করবার খুবই ভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুন আছে। এসব দিয়ে বোঝাই যায় যে ওই সমাজগুলোর হত্যা সম্পর্কিত যে দর্শন, সেই দর্শন একদমই ভিন্ন। যেমন, অনেক দূরে যাওয়ার দরকার নেই, পার্বত্য চট্টগ্রামের দু’একটি সমাজ এখানো আছে, অন্তত গত শতক পর্যন্ত ছিলো, যেখানে এমন কোন বিচার ব্যবস্থা নেই যেই ব্যবস্থা সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাস করবার ক্ষমতা রাখে। সন্ত্রাসী বিচার ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক বিচার ব্যবস্থা তাদের নেই। তাদের বিচার ব্যবস্থা কাউকে ফাঁসি দেয়ার ক্ষমতা রাখে না, গ্রেফতার করবার ক্ষমতা রাখে না, গুলি বা লাঠিপেটা তো নয়ই। আসলে কোন রকম রাজনৈতিক ক্ষমতাই তারা রাখে না। যাদেরকে আমরা গ্রাম-প্রধান বা কার্বারি বলে জানি, তারা মূলতঃ হচ্ছেন এক ধরনের মেডিয়েটর, যোজক, যৌথ মীমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিরসন ও বাইরের জগতের সাথে কাজ-কারবার ও দেন-দরবার করেন। তাঁদের কাউকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা নেই, ফাঁসি দেয়ার ক্ষমতা নেই। ওই সব সমাজে হত্যা এমনভাবেও মীমাংসা হতো যেখানে যে খুন হয়ে গেল তার পরিবারকে পাঁচটা ছয়টা শুকর দিয়ে বিষয়টা একভাবে মীমাংসা হয়ে যেতো। এবং দুই পক্ষই মনে করতো জাস্টিজ ইজ ডান। কাজেই ন্যায়ের ধারণার শ্বাশ্বত কোন রূপ নেই। আধুনিক বিচার ব্যবস্থার মধ্যে যে প্রতিশোধমূলক ন্যায়ের ধারণা সেটা পৃথিবীর সর্বকালের সব সমাজের বৈশিষ্ট্য না।
এমনকি আধুনিক সমাজেও ন্যায়ের ধারণা স্থির বা শীলাভূত কিছু না। ন্যায়ের ধারণা সমাজে বদলে যায়। যেমন আজকে অনেক মানুষ, এমনকি মানবাধিকার কর্মীরাও মনে করছেন ক্রসফায়ার হচ্ছে ন্যায় বা জাস্টিস, হোক না সেটা ডার্ক জাস্টিজ। ডার্ক জাস্টিজ তো একটা ফ্যান্টাসি, কিন্তু আমরা সবাই কম-বেশি বসবাস করি সেই ফ্যান্টাসিতে। বিমূর্ত বাস্তবতাকে বুঝতে ফ্যান্টাসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব সমাজে জাস্টিস নাই সেসব সমাজে ডার্ক জাস্টিস তো একটা পপুলার ধারণা হবেই। যেখানে ন্যায়বিচার নাই, যেখানে ন্যায়ানুবর্তিতা নাই, সেখানে ডার্ক জাস্টিস অর্থাৎ একটা কিছু শক্তি আসবে, জাস্টিসগুলো করবে, এই আকাঙ্ক্ষা তো থাকবেই। র্যাব শুরুতে জনমানসে এক অর্থে সেই ডার্ক জাস্টিসই ছিল, যে কারণে এটা আমাদের অনুমোদন পায়। এই অনুমোদনই তার কর্মকাণ্ডের আসল ভিত্তি। এই অনুমোদন মনে করে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে যে সন্ত্রাসীরা, সেসব সন্ত্রাসীদের ধরে রাতের অন্ধকারে মেরে ফেলছে র্যাব। কারণ এদেরকে কোর্টে তুলে লাভ নেই, আইনের কাছে নিয়ে লাভ নেই। এরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে। কাজেই আইন সবার জন্য নয়। শেষ বাক্যটি, আইন সবার জন্য নয়, এটা আমরা একটু মনে রাখব, ঠিক আছে?
তো আমি খুব বেশি মতভেদ পোষণ করবো না এই মনোভাবের সাথে। কারণ হচ্ছে, আমি যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করবো যে ক্রসফায়ার, যাকে অনেকে ‘আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলছেন, এগুলো আসলে আইনেরই অনুষঙ্গ। আইনের একদম মৌলিক উপাদান, এগুলো আইন বহির্ভূত না। খোদ আইন জিনিসটাই এরকম। একটা কথা তো অলরেডি আমি হয়তো বলেছি, আপনাদের কতোটুকু ধাক্কা লেগেছে জানি না। আমি যেদিন প্রথম ভাবতে পেরেছিলাম এটা, আমার খুব ধাক্কা লেগেছিলো। সেটা হচ্ছে যে কোন রাষ্ট্রের প্রথম ‘আইন বহির্ভূত’ জিনিস হচ্ছে রাষ্ট্র নিজেই। কেন? কীভাবে? কারণ হচ্ছে তার যে সার্বভৌমত্ব, তার যে একটা একচেটিয়া অধিকার সন্ত্রাস করবার, সেটার কারণে। এটা এমন একচেটিয়া ক্ষমতা যে চাইলেই সমস্ত আইন রদ করে দিতে পারে। মানে এটা হচ্ছে আইনের বাইরে। আইনের বাইরের একটা কিছু। যে কারণে সে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে। আবার একই সাথে সার্বভৌমত্ব আবার আইনের ভেতরেও কারণ এই ক্ষমতা বলেই রাষ্ট্র আইন প্রয়োগ করে। এই গোলমেলে ব্যাপারটাই আসলে ক্রসফায়ার বা গুম-খুন নিয়ে গোলযোগটা বোঝার জন্য জরুরি।
তো রাষ্ট্র, আইন, হত্যা, ত্রাস, সার্বভৌমত্ব এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি মোটা দাগে বলার চেষ্টা করলাম যে আসলে কী ঘটছে। সাথে আমি আরো একটা জিনিস যোগ করতে চাই, ক্ষমতাকে কখনোই যেন আমরা আমাদের শরীর বা জৈবিক অস্তিত্বের বাইরে না দেখি। মানে আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রকে ফুকো আমাদের জৈব ক্ষমতা বা বায়োপাওয়ার হিসেবে শিখিয়েছেন। উনি বলেন, জৈব ক্ষমতা বা বায়োপাওয়ার হচ্ছে ক্ষমতার কিছু টেকনোলজি যা দিয়ে পাবলিককে একটি গ্রুপ হিসেবে ম্যানেজ করা যায়, নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই জৈব-ক্ষমতাকে ফুকো মনে করেন আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নিজ কার্য-সাধনের একটা অন্যতম উপায়। বায়োপাওয়ার মানে শাসন-ব্যবস্থা আমাদের শরীরের উপর যে কর্তৃত্ব উপভোগ করে সেটা। মানুষের শরীর তখন রাজনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্র হয়ে উঠে। এই বায়োপাওয়ার প্রয়োগ হয় কিছু ডিসিপ্লিনারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে, যেমন পুলিশ, আইন-আদালত, কারাগার, ক্লিনিক থেকে শুরু করে আর সব বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। আধুনিক ক্ষমতা তার শাসিত মানুষদের শরীরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়। আমাদের শরীরের উপর আইনের যে ক্ষমতা, যেটা টিকা দেয়া থেকে শুরু করে গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাগার, হাজত কি হত্যা, সেটাই আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুতর বৈশিষ্ট্য মনে করেন ফুকো। আইন মানুষের শরীরের উপর, মানুষের জৈব জীবনের উপর যেটা প্রয়োগ করে সেটা আইনী ক্ষমতা নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা। আমি বিষয়টা আরো ব্যাখ্যা করতে চাই।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে যেসব কথা-বার্তা আমরা বলি ও শুনি, খেয়াল করলে দেখবেন সেই কথকতায় দেহের একটা ভূমিকা আছে। ক্রসফায়ারের পরে যেটা উদ্ধার হয় সেটা হচ্ছে দেহ, মৃতদেহ। ব্যক্তি মানুষ তখন একটা বডি হিসেবে উদ্ধার হয়। এইটাই ক্রসফায়ার নামক সংস্কৃতির, যদি আমরা এটাকে একটা এথনোগ্রাফিক ইভেন্ট হিসেবে দেখি, তার ‘রাইটস অফ প্যাসেজ’। ব্যক্তি বা নাগরিক থেকে কেউ কেউ ডিসকোর্সের মধ্য দিয়ে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা লাভ করেন। তারপর একটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’র মধ্য দিয়ে তারা ‘মৃতদেহ’ হিসেবে ‘উদ্ধার’ হয়ে যান। এটাই ক্রসফায়ারের জীবনাচার বা রাইটস অফ প্যাসেজ। ঠিক আইনের মতন। আইনে যেভাবে বিচারের মধ্য দিয়ে কেউ দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত হয়, তারপর খালাস বা শাস্তি পায়, বাকিদের জন্য বরাদ্দ হয় ভয়। ক্রসফায়ার বা গুম দেখেন ঠিক এই তিন ধাপেই কাজ করে। একারণে বললাম যে, দেহটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইদানিং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কাউকে তুলে নিয়ে গেলেই দেখা যাচ্ছে আত্মীয়স্বজন তাড়াহুড়া করে কোনভাবে ডিসি অফিসের সামনে হোক, সাংবাদিকদের সামনে হোক, সেখানে গিয়ে তারা একটা আপিল করছেন যে, আমার অমুককে ‘জীবিত’ ফেরত চাই। মানে ‘জীবিত’ উদ্ধার করা হোক, ‘মৃতদেহ’ হিসেবে নয়। কথাগুলো পেপারে আপনারা দেখছেন না? আবার একই সাথে আপনারা দেখেন ‘অজ্ঞাত’, ‘মৃতদেহ উদ্ধার’ জাতীয় শব্দবন্ধ… পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ধলেশ্বরী ক্রমাগত ‘অজ্ঞাত’ লাশের ‘ঠিকানা’ হযে উঠছে। তো ‘উদ্ধার’ মানে কী? মৃতদেহ কী করে ‘উদ্ধার’ হয়? কেন হয়? ব্যক্তি উদ্ধার পায় না কিন্তু তার দেহ তাহলে উদ্ধার হয়? তার মানে ব্যক্তিকে দেহ করে তোলাই কি র্যাবের কাজ, এটাই কি ক্ষমতাতন্ত্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা? এটাই কি আইনের চূড়ান্ত কাজ? এটাই কি বায়োপাওয়ার? ভাষার এই ফাঁকগুলো আমাদের খুব পরীক্ষা করে নিতে হবে। কারণ এগুলোর ফাঁকে ফাঁকেই কিন্তু এই সব ঘটনা যৌক্তিকতা পেয়ে যায়, আমাদের চিন্তা-চেতনার অংশ হয়ে ওঠে এবং আমরা ওভাবে ভাবতে বাধ্য হই। ঠিক আছে?
তো, আমি এসব নিয়ে আরেকটু ঘেটেছি। ফুকো যেটা মোটা দাগে বলেন সেটা হচ্ছে যে আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র এটা আসলে আমাদের শরীরে বসবাস করে। টেকনোলজিস অব পাওয়ার, মানে মেডিসিন, হাসপাতাল, পাগলাগারদ, শাস্তি, আইন-কানুন এ সমস্ত কিছুর লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিক শরীর এবং পপুলেশনকে একটা গ্রুপ হিসেবে, ব্যক্তিকে একটা সমষ্টি হিসেবে কন্ট্রোল করবার উপায় বের করা, ব্যক্তির শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, মানে তার জৈবিক অস্তিত্বের উপর দখলদারি করা, মানে জীবন-মরণের বিধাতা হয়ে উঠা। ফুকো এসবকে গভর্নমেন্ট বলেন না, বলেন গভর্নমেন্টালিটি। গভর্নমেন্টালিটি, এটা প্রতিষ্ঠান অর্থে গভর্নমেন্ট না, গভর্নমেন্টালিটি হচ্ছে জনসাধারণের মধ্যে শাসিত হওয়ার মেন্টালিটি তৈরি করবার প্রকৌশল, এর মধ্য দিয়েই গভর্নমেন্ট পাবলিককে স্বীয় শাসনের জন্য দীক্ষিত করে তোলে, স্বীয় নীতির যৌক্তিকতা তৈরি করে। ফুকো গভর্নমেন্টালিটির ধারণা দিয়ে ক্ষমতা নিয়ে আমাদের সব পূর্বানুমানই প্রায় বদলে দিয়েছেন। তিনি ক্ষমতাকে এর মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্রীয় আইন ও আমলাতন্ত্র নয়, ক্ষমতা প্রয়োগ বা শাসনকৌশলকে তিনি বিস্তৃত করেছেন সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সব প্রতিষ্ঠানের দিকে, স্কুল, হসপিটাল, পাগলাগারদ ইত্যাকার সবকিছুকেই তিনি এই শাসন প্রকৌশলের অংশ হিসেবেই দেখেন। এমনকি জ্ঞান উৎপাদন প্রক্রিয়াকেও। আমরা এখন তাহলে শাসনপ্রণালী বা গভর্নমেন্টালিটি হিসাবে ক্রসফায়ার বা গুম-খুন ঘাটতে গেলে দেখব ক্রসফায়ার বা গুম বা খুন, এগুলো আসলেই সবসময়ই আইনে ছিলো। দুনিয়ায় যুগে যুগে সমস্ত দেশে ছিলো। খোদ আইন জিনিসটাই দাঁড়িয়ে আছে এগুলোর উপর। এই নিয়ে আমি গত বছর দু’য়েক ধরে একজনের একটু জটিল দুই-তিনটা বই পড়ার চেষ্টা করছি। সেখান থেকে আমার কিছু বোঝা না বোঝা আপনাদেরকে একটু খুলে বলার চেষ্টা করি।
জর্জিও আগামবেন তাঁর নাম। আমি আসলে তার বইগুলোর বিজ্ঞাপনই করতে চাই। কারণ আমরা সবাই মিলে পড়লে যেটা হয় যে একেক জনের পড়া একেক রকম হবে, তাতে লাভ বই ক্ষতি নেই। আমি চাই যে সবাই আমরা পড়ি। আগামবেনের দুইটা বই আমাকে গত দুই-তিন বছর ধরে খুব ভাবিয়েছে। আমি মাঝেমধ্যেই নানা দিক থেকে পড়ার চেষ্টা করি। আগামবেন, ইতালির ভাবুক, দার্শনিক, অর হোয়াট এভার। তার দুইটা কাজ বিখ্যাত হয়েছে। একটা হচ্ছে ‘হোমো সাকের : সোভরেইন পাওয়ার এন্ড বেয়ার লাইফ’ (১৯৯৫)। হোমো সাকের কী সে প্রশ্নে আমি পরে আসছি। পরের বইটি হচ্ছে ‘স্টেইট অফ এক্সেপশন’ (২০০৫)। আগামবেনের কাজ মোটা দাগে বলা যায় ফুকোর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবার চেষ্টা। ক্ষমতা নিয়ে, জৈব ক্ষমতা নিয়ে ফুকো শেষ দিকে এসে যেখানে গভর্নমেন্টালিটি নিয়ে আলোচনা শেষ করে যেতে পারেননি অকালে মরে গিয়ে, আগামবেন সম্ভবত ফুকোর ওই কাজটাই ক্যারি আউট করছেন। তো ফুকোর বায়োপাওয়ারের কথা আমি বললাম, সেই বায়োপাওয়ারেরই আরেকটা এক্সটেনশন হচ্ছে আগামবেনের এই দুইটা কাজ।
‘স্টেইট অব এক্সসেপশন’ বলতে, স্টেইট কথাটা, ইংরেজিতে আপনারা জানেন, একটা অ্যামবিগুইটি আছে এটা নিয়ে, দ্ব্যর্থকতা আছে। স্টেইট বলতে কোনকিছুর অবস্থা বুঝায়, আবার স্টেইট বলতে রাষ্ট্র বুঝায়। ‘স্টেইট অফ দি নেশন’ বলতে জাতির অবস্থাও বোঝাতে পারে, আবার জাতির রাষ্ট্রও বোঝাতে পারে। ‘স্টেইট অব এক্সসেপশন’ এই জায়গাটাতে আপনাদের একটু মনোযোগ চাইব আমি। এই এক্সসেপশন মানে হচ্ছে, আমি যে বললাম যেকোন রাষ্ট্রের প্রথম বেআইনি জিনিসটা হচ্ছে রাষ্ট্র নিজে, সেটা। রাষ্ট্রই সেই আইনের আদিম ব্যতিক্রম বা এক্সসেপশন। কারণ রাষ্ট্রের আছে সার্বভৌম ক্ষমতা যেটা জনগণের শ্বাশ্বত সম্মতির আধার বলে কল্পিত হয়। কার্ল স্মিথ নামের একজন জার্মান রাষ্ট্রচিন্তক বলেন, সার্বভৌমত্ব আসলে রাষ্ট্রের আইনকে রদ করে দেয়ার ক্ষমতা। আবার এটার জোরেই রাষ্ট্র কিন্তু আইন প্রয়োগ করে। আবার জরুরি অবস্থা জারি করে সে সমস্ত আইন রদ করে দিতে পারে। ২০০৭ সালে আমাদের এখানে এটা ঘটেছিলো, যাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘ওয়ান-ইলেভেন’। তাই আগামবেন বলছেন স্টেইট অব এক্সসেপশন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সবচেয়ে তীব্রতম রূপ, সার্বভৌমত্বের সর্বোচ্চ প্রয়োগ। এখানে যুক্তি আর প্রায়োগিকতা মিলেমিশে গিয়ে একটা বিশুদ্ধ সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। কিন্তু স্টেইট অফ এক্সসেপশন কোন বিশেষ কালখণ্ড বা সময় হিসেবে ব্যতিক্রম নয়, ব্যতিক্রম হচ্ছে আইনের অবস্থার বিচারে। কারণ সময় হিসেবে জরুরি অবস্থা যেকোন মাপের হতে পারে। যেমন আগামবেন হিটলারের থার্ডরাইখের পুরা সময়টাকেই জার্মানির জন্য ‘স্টেইট অফ এক্সসেপশন’ মনে করেন। যখনই রাষ্ট্র তার শাসনতন্ত্র নিজেই মানতে পারে না, তার নিজের বানানো আইন নিজেরই ভাঙতে হয়, সেই সময়কেই আগামবেন বলছেন ‘স্টেইট অফ এক্সেপশন’। আধুনিক সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্র বা টোটালিটারিয়ানিজমকে এই ‘স্টেইট অফ এক্সেপশন’ হিসেবেও সংজ্ঞায়িত করা যায় যার মাধ্যমে ক্ষমতাতন্ত্র তার জনগোষ্ঠীর একটা ‘চিহ্নিত’ অংশের বিরুদ্ধে একটা বৈধ বা অবৈধ গৃহযুদ্ধ চালায়। এই যুদ্ধ শুধু যে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই নিকাশ করে তাই না, অনেক ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট বর্গের মানুষদেরই, যাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক বিন্যাসে আর জায়গা দেয়া যাচ্ছে না, তাদের খতম করে দেয়। কিভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা হত্যা করবার জন্য নিজ নাগরিকদের এই বর্গীকরণ করে, সেটার বিশদ ব্যাখ্যা আছে আগামবেনের আগের রচনা ‘হোমো সাকের’ এ। ‘জরুরি অবস্থা’য় না হয় পরে আবার ফিরে আসা যাবে।
‘হোমো সাকের’ কী? আপনারা জানেন যে হোমো স্যাপিয়ান্স, হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাভিলাস, হোমিনিড ইত্যাকারে মানুষের জৈবিক ইতিহাস আলোচনায় ‘হোমো’ প্রত্যয়টা সব সময় ব্যবহার হয়। বলা হয় যে হোমিনিড থেকে বিবর্তনের ধাপে ধাপে আমরা হোমোস্যাপিয়েন্স হয়ে উঠেছি। তো হোমো কথাটি গ্রিক এবং লাতিনে নানাভাবে ব্যবহার হয়। ‘সাকের’ কথাটার আক্ষরিক অর্থ ‘পবিত্র’, যেখান থেকে ইংরেজিতে ‘স্যাকরেড’ কথাটার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু শব্দার্থের ইতিহাসে এই কথাটার মানে সবসময় একরকম নয়। হোমো সাকের বলতে লাতিনে দুইটা বিপরীত অর্থ বোঝায়: ‘sacred’ বা পবিত্র। আবার একই সাথে ‘accursed’ বা অভিশপ্ত। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে এই দ্ব্যর্থকতাটা আসলে আইন বা সার্বভৌমত্বের মতই। আগেই আমরা যেমন বলছিলাম যে আইন বেআইনী কারণ সে নিজেকে নিজেই রদ করে দিতে পারে, বা সার্বভৌমত্ব একই সাথে আইনের বাইরে এবং ভেতরে অবস্থান করে। তেমনি হত্যার আইনি কথকতা হিসেবে ‘হোমো সাকের’ও দ্ব্যর্থক। আমরা দেখব যে কিভাবে আইনি কথকতার ইতিহাসে আইন নিজেই আইন বহির্ভূত হত্যার আয়োজন করে। এই কথকতার মাধ্যমে কীভাবে যে নিহত হয় আর যে হত্যা করে, দুজনকেই আইনের বাইরের কিছু হিসেবে দাঁড় করায়। একটু বাস্তব উদাহরণ দিয়ে রাখি, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে ক্রসফায়ার যারা হন এবং ক্রসফায়ার যারা করেন তারা উভয়েই আমাদের জন-মানসে ‘আইনের উর্ধ্বে’ হিসেবে বিবেচিত। এই সব খুন হওয়া ‘সন্ত্রাসী’রা বিচারের যোগ্য নয়, এরকম একটা ধারণা আমাদের মধ্যে কাজ করে। আবার যারা তাঁদের ক্রসফায়ার করেন তারাও ‘আইনের উর্ধ্বে’। আগামবেন আমাদের বলেন যে, আসলে তারা কেউই ঠিক ‘আইনের উর্ধ্বে’ নন, তারা আইনেরই প্রতিকল্প। সার্বভৌমত্বের কারণেই আইনের ভিত্তি আসলে আইন ভঙ্গের মধ্যেই নিহিত আছে। কাজেই আইনকে সব সময়ই ঠিক করে নিতে হয় সে কার জন্য প্রযোজ্য আর কার জন্য নয়। কার জন্য সে ‘প্রয়োগ’ হতে পারে, আর কার জন্য ‘ভঙ্গ’।
একটা ঐতিহাসিক বর্গ বা চরিত্র হিসেবে ‘হোমো সাকের’ এর সাক্ষাৎ আমরা পাই প্রাচীন রোমান আইনে। সেই আইনের সংজ্ঞায় হোমো সাকের হচ্ছেন নিষিদ্ধ মানুষ। তাকে মেরে ফেলা যায় কিন্তু ধর্মীয় আচার হিসেবে বলি দেয়া যায় না। কারণ সে পবিত্র না। প্রাচীন রোমান ধর্মে হোমো সাকের শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার হতো, খ্রীস্টধর্মের আবির্ভাব সেই অর্থটিকে বদলে দেয়। ইংরেজিতে এটা ‘পবিত্র’ অর্থ ধারণ করে। কিন্তু প্রাচীন রোম ধর্মাচারে হোমো সাকের মানে ছিল সমাজ থেকে ’বিচ্যূত’, যা একই সাথে ‘পবিত্রায়িত’ এবং ‘অভিশপ্ত’ অর্থ ধারণ করে। হিব্রু ভাষায় একই সত্তাটিকে পাওয়া যায় ‘কাদোস’ নামে। বাস্তব চর্চায় হোমো সাকের বলতে বোঝাতো সমাজ থেকে ‘বহিস্কৃত’/‘পরিত্যক্ত’ ব্যক্তি, যে সমাজধর্মের সকল অধিকার এবং আচার থেকে বঞ্চিত। এবং যাকে হত্যা করলেও হত্যাকারী খুনী হিসেবে পরিগণিত হবে না (আইনের বা নীতির দৃষ্টিতে)। কিন্তু তাকে ধর্মীয় আচারে উৎসর্গ করা যায় না।
আবার ‘পবিত্র’ অর্থে হোমো সাকের বলতে বোঝায় এমন একটা কিছু যা আইনের বাইরে, আইনের অতীত। ফলে পশ্চিমের রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যে অনেক ক্ষেত্রে হোমো সাকের কথাটি ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ বা রাজক্ষমতার সাথে গুলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। শপথ ভঙ্গের কারণেও কেউ হোমো সাকের হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে। শপথ প্রাচীন সমাজে একটা শর্ত সাপেক্ষিক আত্মাভিশাপ হিসেবে ছিল। যেমন অনেক সময় আমরাও বলি ‘আমি যদি এটা করে থাকি তো আমার মাথায় গজব পড়ুক’। ফলে শপথ ভঙ্গের কারণে কেউ যখন খুন হতেন তখন ধরে নেয়া হতো এটা ঈশ্বরের প্রতিশোধ। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের রোমান আইনে এর নিদর্শন পাওয়া যায় যেখানে বলা হয় কোন মহাজন যদি তার মক্কেলের সাথে প্রতারণা করেন তো তিনি ‘সাকের’ হিসেবে পরিগণিত হবেন।
একইভাবে ‘হোমো সাকের’ এর নির্মাণ আমরা দেখতে পাই প্রাচীন যুগে ‘বর্বর’ হিসেবে। গোটা মধ্যযুগ ধরে কিছু মানুষ ‘ডাইনি’ বা ‘নেকড়ে-মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে যাদের ‘দায়মুক্ত’ ভাবে হত্যা করা যায়। আধুনিক যুগের সূচনায় আমরা দেখেছি ‘আউটল’ নির্মাণ। এই ‘বধযোগ্য’ মানুষ নির্মাণ প্রথম যে আধুনিক আইন দিয়ে রোধ করবার চেষ্টা করা হয় সেটা হচ্ছে ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস আইন দিয়ে ব্রিটেনে। সেটা আমাদের ভিন্ন প্রসঙ্গ, পরে আসব। হত্যার ক্যাটাগরি হিসেবে ‘গণপিটুনি’ বা ‘গণহত্যা’র মধ্যেও এই হোমো সেকেরীয় উপাদান, অর্থাৎ কোন কোন বৈশিষ্ট্যের মানুষদেরকে বিধিবদ্ধ বা বিধির অতীত হিসেবে চিহ্নিত করে ‘বধযোগ্য’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করবার ব্যাপার ঘটে। যেমন আমরা ‘গণহত্যা’ বলি কাকে? প্রচলিত অর্থে গণহত্যা বলতে পরিকল্পিতভাবে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা বোঝায়। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায়, গণহত্যার সংজ্ঞা আসলে নিহতের সংখ্যা দিয়ে ঠিক করা যায় না। বরং নিহত মানুষদের নির্মিত পরিচয় এবং তাদের হত্যা করবার পেছনে যে কারণ সেটাই গণহত্যার প্রকৃতিকে তুলে ধরতে পারে অনেক মোক্ষমভাবে। ‘গণহত্যা’য় ‘গণ’ মানে সেই সব মানুষেরা যারা ‘ব্যক্তি’ নন। তাদেরকে হত্যা করা হয় ব্যক্তি পরিচয়ের কারণে না, সামষ্টিক কোন পরিচয়ের কারণে, কোন সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে। ফলে দেখা যায়, ব্যক্তি নয়, হোমো সাকের আসলে একটা রাজনৈতিক বর্গ যেটা আইনের প্রকৃতিকে নির্ধারণ করে দেয়। ‘গণপিটুনি’র ক্ষেত্রেও দেখবেন গণপিটুনির শিকারেরা যত না ব্যক্তি তার চেয়ে বেশি বর্গ : ছিনতাইকারী, পকেটমার, ডাকাত বা অন্যকিছু। ফলে হত্যার আইনী কথকতা বুঝতে গেলে এই বর্গ নির্মাণের প্রক্রিয়াটা বোঝা জরুরি।
আগামবেন প্রাচীন রোমান আইনের রহস্যময় বর্গ এই ‘হোমো সাকের’কেই ব্যবহার করে আইন ও ক্ষমতার সম্পর্কের বিষয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তোলেন। তার ১৯৯৫ সালের বই, ‘হোমো সাকের : সোভরেইন পাওয়ার এন্ড বেয়ার লাইফ’-এ তিনি দেখান কীভাবে যুগে যুগে রাষ্ট্র কিছু নির্দিষ্ট অপরাধের কারণে কিছু মানুষকে হোমো সাকের ঘোষণা করে, তাদের জন্য নাগরিক অধিকার রদ করে দেয়। এই অধিকারগুলোর প্রথমটি হচ্ছে বিচার পাওয়ার অধিকার। ফলে তারা ‘বধযোগ্য’ হয়ে যায় এবং তাদের হত্যাকারীরা ‘খুনি’ হিসেবে চিহ্নিত হয় না। আইন সব সময় নির্ভর করে এই আলোচনার উপরে যে কে আইনের আওতায়, অর্থাৎ আইন কার জন্য প্রযোজ্য এবং কার জন্য প্রযোজ্য নয়। এবং রোমান-গ্রিক সভ্যতা থেকে একদম প্যালেস্টাইন সভ্যতা পর্যন্ত বা এমনকি সর্বশেষ নাজি জার্মানিতে হিটলারের শাসন এ সমস্ত কিছুতেই তিনি দেখাচ্ছেন যে আইন কাকে এক্সক্লুড করে আর কাকে ইনক্লুড করে। এটা আইনের প্রকৃতি বোঝার জন্য জরুরি। কারণ আইন জিনিসটা সম্ভব হয়ে উঠে এর আওতাধীন জনগোষ্ঠীর এই ধরণের বিভাজনের উপর। গোটা ইতিহাস জুড়েই এই বিভাজন আইনের অনুষঙ্গ। আগামবেন বলছেন, হোমো সাকের হচ্ছে সেই মানব জীবন যা আইনী ব্যবস্থার সাথে পুরোপুরি যুক্ত হয় ‘আইন-বহির্ভূত’ একটা কিছু হিসেবে। ফলে হোমো সাকের আইন থেকে বিচ্যূত, আবার একই সাথে আইনের ভেতরেও বটে। এটা অনেকটা সার্বভৌমত্বের মতই যেটা একই সাথে আইনের ভিত্তি আবার একই সাথে আইনকেও রদ করতে পারে। আগামবেন সার্বভৌমত্বকে দেখেন জরুরি অবস্থার নির্ধারক হিসেবে। সার্বভৌমত্ব প্রসঙ্গে হবস আমাদের যে ধারণা দেন আগামবেন তার বিপরীতে সার্বভৌমত্বকে তার কার্যকলাপ দিয়ে বুঝতে চান। তিনি মনে করেন সার্বভৌমত্ব আইনের অতীত, কারণ সেটা আইনকে রদ করবার ক্ষমতা রাখে। এখানে বিষয়টা একটু দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে, এজন্যই আমি ক্রসফায়ারের উদাহারণ টানলাম শুরুতে এই বলে যে, যারা ক্রসফায়ার হন বা যারা করেন, উভয়েই আসলে আইনের উর্ধ্বে। আবার একই সাথে ক্রসফায়ার আইনেরই একটা প্রতিকল্প হিসেবে কাজ করছে। কাজেই এটা আইনেরই অনুষঙ্গ।
হোমো সাকের এর বাংলা আমি করেছি নমানুষ, মানে যে ঠিক মানুষ না, নমানুষ। রাজনৈতিক মানুষ তথা নাগরিকের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে এই নমানুষ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। যেভাবে সভ্য সমাজ সভ্য হতে পারে অসভ্যদের সামনে রেখে। অসভ্যরা না থাকলে সভ্যতার ধারণাও টিকে থাকে না। এমনি হাজারো উপমা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু আমাদের আপাতত বোঝার বিষয় হচ্ছে ঠিক কীভাবে আমরা আগামবেনের এই ‘নমানুষ’ বা জরুরি অবস্থার ব্যাখ্যাকে আমাদের সমাজ পরিস্থিতি বিশ্লেষণের কাজে লাগাতে পারি? হোমো সাকের বা নমানুষ আসলে শুধু পৌরাণিক চরিত্র নয়, রোমান মিথোলজির বিষয় নয়। আগামবেন বলছেন, এটা আরো স্পষ্টত দেখা যায় আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। জাতিরাষ্ট্র মাত্রই তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের নামে আইনকে একটা সিভিল রিলিজিওন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু নমানুষরা এই রাষ্ট্রধর্মের বাইরের লোক। এই কারণে সে বধযোগ্য, তাকে মেরে ফেলা যায়। তাকে মেরে ফেলা যায় এবং তাকে মেরে ফেললে আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটে না এবং যে মেরে ফেলবে সে আসলে ‘হোমিসাইড’ করে না। ‘হোমিসাইড’ হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের আইনি নাম। এই নমানুষদের স্থান ও কালভেদে এত জায়গায় এতরূপে এত অর্থে পাওয়া যাচ্ছে যে আগামবেন মনে করেন এটা আসলে আলাদা ধরনের হিউম্যান লাইফ। হোমো সাকের এর জায়গায় গ্রিকরা ব্যবহার করতো দুইটা শব্দ, জো আর বায়োস। বায়োস হচ্ছে বায়োলজিকাল মানুষ। আর জো’রা হচ্ছে ওই নমানুষ।
এই বিভাজনের প্রথম শিকার হন যারা ঠিক সিটিজেন না। সিটিজেন না বলতে, গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোতে যেটা দেখা যেতো যে, একদম প্রাচীর ঘেরা নগর রাষ্ট্রের ভেতরের মানুষেরাই, শুধুমাত্র নাগরিকরাই, নাগরিক অধিকারের অংশ। তার বাইরে যে বিশাল সমাজ, মানুষ, তারা সবাই বর্বর হিসেবে বিবেচিত। যেমন আজকের দিনের ‘ভিলেইন’ শব্দটিও পুরানা লাতিনে ব্যবহৃত হতো সাধারণত নগরের বাইরে বসবাসরত ভূমিদাস কৃষকদের ক্ষেত্রে যাদের নগরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। নগরের আইন, সেটা অধিকার হোক কী শাস্তি বিষয়ক, সেটা তাঁদের জন্য প্রযোজ্য নয়। ফলে ভিলেইন শব্দটি শব্দার্থের ইতিহাসে ঠিক কিভাবে আমাদের সিনেমার অর্থে ভিলেইন হয়ে গেল, কেন হলোভর্তি সিনেমার দর্শকেরা সবাই মিলে শেষে নায়কের হাতে বা অদৃষ্টের হাতে তাঁদের হত্যা কামনা করেন সেটা ভেবে দেখবার মতই বিষয়। একইভাবে দেখবেন ইতিহাসে রাজা আর সম্রাটদের বীরত্বগাঁথা রচিত হয় তারা কতো বেশি ‘বর্বর’ হত্যা করলেন তাঁর উপর নির্ভর করে। আমাদের রাম-লক্ষণরা যেমন একেকটি ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে হাজারে হাজারে রাক্ষস মারতেন। মধুসূদন তার ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে আমাদের প্রথম ইশারা দেন যে আসলে রাক্ষস বলতে কাদেরকে বোঝানো হতো। আর্য সভ্যতা কাদের রাক্ষস হিসেবে চিহ্নিত করে নিজেদের সভ্যতাকে সম্ভব করে তুলেছিল সেটা আর আমাদের অজানা নয়। সেই রামায়ণের যুদ্ধ কিন্তু এখনো থামেনি। নিওলিবারেল যুগে সেই যুদ্ধের একটি অংশের নাম অপারেশন গ্রীন হান্ট, আর এখানে রাক্ষস বা নমানুষ হচ্ছে মধ্য ভারতের আদিবাসীরা, যাদের হোমো সাকেরীয় নাম আজকে মাওবাদী। ইউরোপের মধ্যযুগে এদেরই আরেক অংশকে আমরা দেখেছি বা ডাইনি বা নেকড়ে মানব হিসেবে খুন হতে। আজকের দিনেও উদাহরণের কোন কমতি নেই। বৈশ্বিক পরিসরে আজকে আমরা তাঁদের বলি টেরোরিস্ট, আরো ভালভাবে বললে আজকের পৃথিবীর গ্লোবাল হোমো সাকের হচ্ছে ‘মুসলমান টেরোরিস্ট’। আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য না। ওসামা বিন লাদেন থেকে শুরু করে গুয়ানতানামো বে’র বন্দীরা, এরা সবাই নমানুষ।
হোমো সাকের নির্মাণের আরেকটা ইন্টারেস্টিং উদাহারণ হতে পারে বাংলাদেশের বিদ্যমান ‘উপজাতি’ ডিসকোর্সটা। আপনারা জানেন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাঙালি ছাড়া অন্য জাতিস্বত্তাগুলোকে কি নামে ডাকা হবে সেটা নিয়ে অনেকদিন ধরে একটা তর্ক চলছে। তারা বলছেন যে তারা উপজাতি নন, আদিবাসী; আর সরকার বলছেন তারা উপজাতি। এই তর্কের সূত্রে আমি উপজাতি কথাটার এটিমোলজি বা শব্দার্থের ইতিহাস খুঁজতে গেলাম। খোঁজ করতে গেলাম প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ‘উপজাতি’ কোন অর্থে ব্যবহার হতো। দেখা গেল ধর্মমঙ্গল কাব্যে এক বীর বলছেন, ‘কেমনে বধিব তারে নয় উপজাত’। মানে বীর এক সংশয়ে পড়েছেন এমন একজনকে বধ করতে গিয়ে যিনি উপজাত অর্থাৎ উপজাতি নন। তার এই নৈতিক সংকটটিকে ঘুরিয়ে নিলে কী দাঁড়ায়? ঘুরিয়ে নিলে কি দাঁড়ায় যে ব্যক্তিটি যদি উপজাতি হতো তাহলে তাঁকে বধ করবার ক্ষেত্রে কোন মোরাল ডিলেমা তৈরি হতো না বীরের? কারণ বীর ধর্মে সেটা সিদ্ধ। কাজেই উপজাতি হচ্ছে নমানুষ, হোমো সাকের। এই মেরে ফেলার মতো মানুষের বর্গ তৈরির ব্যাপারটা যেখানেই রাষ্ট্রের উপস্থিতি দেখবেন সেখানকারই সাহিত্যে এটার এক ধরণের প্রমাণ রয়ে গেছে। প্রমাণ রয়ে গেছে যে ইতিহাস জুড়েই রাষ্ট্র বা আইন সবসময় এক ধরনের মানুষ চিহ্নিত করতে থাকে এবং তাদেরকে নাগরিক অধিকার বা তথাকথিত আইনের অধিকারের বাইরে রেখে, আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ, মানে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ তাদের জন্য প্রযোজ্য হয়ে যায়।
ফলে ডিলেমাটা হচ্ছে তারা একই সাথে আইনের মধ্যে, আবার একই সাথে আইনের বাইরে। আইনের বাইরে যদি এই মানুষেরা না থাকে আইন নিজেই ভিত্তি পায় না। কারণ আইনের আরেকটা ফাংশন হচ্ছে, পতিত জীবন, যাকে আগামবেন বলছেন ‘বেয়ার লাইফ’, সেখান থেকে মানুষকে আস্তে আস্তে ‘গুড লাইফ’ এ নিয়ে আসতে হবে। এই প্রক্রিয়াটাকেই আপনারা ‘মূল স্রোতে নিয়ে আসা’, ‘উন্নয়ন’ করা, ‘স্বাক্ষরতা’ বা ‘সভ্য করা’ হিসেবে পত্র-পত্রিকায় জানতে পারেন। কুনাগরিকদের আইন, শাস্তি ও শিক্ষা দিয়ে দিয়ে সুনাগরিক করে তোলা রাষ্ট্রের নিয়মিত কর্তব্যের একটি। ফলে কিছু ‘কুনাগরিক’ না থাকলে রাষ্ট্রের বেকার হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে কুনাগরিক তৈরি করাও রাষ্ট্রের একটি নিয়মিত কাজ। সুনাগরিক তৈরির মতই। এই কুনাগরিক তৈরির অন্যতম প্রধান কারখানা হচ্ছে জেলখানা যেখানে, ক্রপোৎকিনের মতে, রাষ্ট্র পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধের উচ্চশিক্ষা দেয়া হয়। আমাদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশে নতুন নমানুষ হিসেবে প্রথমে চিহ্নিত হয় বাম চরমপন্থীরা। পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থা জারি করে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল ১৯৭০ এর দশকে, এখানে আমরা তার আরেক মিনি সংস্করণ দেখলাম ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে। র্যাব গঠনের পরেও তাঁদের প্রথম শিকার হয়েছেন বাম চরমপন্থীরা, পরে ডান চরমপন্থীরা। ‘সর্বহারা’, ‘চরমপন্থী’ বা ‘জেএমবি’, ‘জঙ্গী’ বা পত্রিকার ভাষায় এতটি ‘…মামলার আসামী’রাই হচ্ছে সেই সব বর্গ বা ক্যাটাগরি যাদের আমরা এতক্ষণ হোমো সাকের বললাম।
কাজেই আইন না মানার শর্তগুলো আইনের মধ্যেই উপস্থিত থাকে। ত্রাসই হচ্ছে তার ভিত্তি এবং এই ত্রাস না থাকলে আইন কার্যকর হয়ে উঠতে পারে না। ফলে তাকে সবসময় এই ত্রাসটা বজায় রাখবার জন্য হলেও আইন ভাঙতে হয়। আইনকে আইন ভাঙতে হয়। আধুনিক আইনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আয়রনি এইটাই। আইনের গোড়া থেকেই আইনের এই এখতিয়ার আছে ‘নমানুষ’কে সংজ্ঞায়িত করবার। একই সাথে ‘মানুষ’ সংজ্ঞায়িত করবার। প্রাচীন গ্রীসে শাসিত জনগোষ্ঠির এই বিভাজনকেই বলা হত ‘জো’ এবং ‘বায়োজ’। এই বিভাজনের মাধ্যমেই আইন মানুষের জীবনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয়। ফলে মানুষের ‘নিজের হাতে আইন তুলে নেয়া’ নিষিদ্ধ হয়। রাজনৈতিক মানুষ বা সিটিজেন এর বিপরীতে আমরা ইতিহাসে সবসময়ই এই ‘নমানুষ’ দেখতে পাই। এই বিভাজন শুধু আইন নয়, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের নিরীক্ষেও নির্ধারিত হয়। আরিস্ততল, আগামবেন বলেন, রাজনৈতিক জীবনকেও সংজ্ঞায়িত করেন এই ধরনের ইনক্লুশন এবং এক্সক্লুশনের মাধ্যমে। মনে করা যেতে পারে তাঁর সেই উক্তি, ‘দাসরা মানুষ নয়, জীবন্ত হাতিয়ার; তাঁদের প্রতি সদয় হওয়া উচিত’।
ফলে আমরা আজকের আলোচনায় সম্ভবত এ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছি যে ক্রসফায়ারকে আর যাই হোক, ‘আইন-বহির্ভূত’, ‘বিচার-বহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড বলে অন্তত ভাবনা-চিন্তার ক্ষেত্রে খুব বেশি সুবিধা করা যাবে না, সমস্যার গোড়ায় পৌঁছানো যাবে না। কারণ এর শর্তাদি আইন ও বিচারের মধ্যেই রয়ে গেছে। এটার শেকড় আরো অনেক অনেক ভিতরে। ক্রসফায়ারের ইতিহাস আসলে নতুন না। মিডিয়া এটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন র্যাব বলে একটা বাহিনী হওয়ার আগে এটার কোন অস্তিত্ব ছিল না। একই ধারণা আমরাও পোষণ করি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সিরাজ সিকদার থেকেই ক্রসফায়ার যুগের শুরু, তার আগেও এই ধরণের হোমো সাকেরীয় হত্যা ছিল। আসলে আমাদের বিস্মৃতি খুব প্রবল। আজকে আমরা নারায়ণগঞ্জের ঘটনাকে সেভেন মার্ডার বলছি, আমরা ভুলে যাই যে এই এপ্রিল মাসেই, ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল, আরেকটা সেভেন মার্ডার ঘটেছিলো এবং ওই লোকগুলোও ছিলো নারায়ণগঞ্জের লোক। ঘটেছিলো যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলো নারায়ণগঞ্জের কোহিনুর বলে একজন সন্ত্রাসী তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে। তাদেরকে মেরে ফেলা হয় মোহসিন হলে, অভিযোগ রয়েছে কাণ্ডটি ঘটেছিল সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতা শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে। এবং সে সময় সাথে সাথে পুলিশ তাঁদের অ্যারেস্ট করে। তারপরই আবার উচ্চতর নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার পর আবার তাদেরকে অ্যারেস্ট করা হয়, শফিউল আলম প্রধানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাকে আবার মুক্ত করেন। অবাক হওয়ার কারণ নেই যে তারপর থেকেই তিনি বিএনপির একনিষ্ঠ একজন মিত্র।
কাজেই রাষ্ট্র যেমন আইন তৈরি ও প্রয়োগ করে তেমনি তার বিরুদ্ধে ইনডেমনিটি বা ইমপিউনিটিও তৈরি করে। এই বিচারে রাষ্ট্র মানেই আইন ভাঙ্গা-গড়ার খেলা। এই আইন ভাঙ্গা-গড়ার খেলার নামই রাজনীতি। রাজনীতি মানে হচ্ছে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বিন্যাস। আমরা ভোট দিয়ে নিজেদের ব্যক্তি স্বাধীনতার একটা অংশ জমা দিয়ে ‘সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা’ করি বলেই রাজনীতি বলে কিছু একটা সম্ভব হয়ে উঠে। রাষ্ট্র বলে কিছু একটা সম্ভব হয়ে উঠে। যেমনটা বলেছিলেন হবস। ফলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ‘আইন ও বিচার ব্যবস্থা’ আসলে একটা বিশাল ইউটোপিয়া, এই জিনিস কোন যুগে কোথাও কস্মিনকালেও ছিল না। কারণ আইন ও রাজনীতির অভিন্ন ভিত্তি হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। ইনারা এক সাথেই রাষ্ট্রে বসত করেন। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক হত্যা মামলার আসামীদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের মধ্য দিয়ে সেই সার্বভৌমত্ব প্রসূত ইমপিউনিটির একটা বৈধ চর্চা আমরা দেখলাম। অবৈধ পথে ইমপিউনিটি তো আছেই। আসলে বৈধতা আর অবৈধতার ফারাকটা আমাদের নৈতিক মানসে যতোটা ক্রিয়াশীল থাকে ক্ষমতার চর্চায় ততটা থাকে না। এই ফারাক আসলে খুবই অস্পষ্ট এবং অনেক ক্ষেত্রে ফারাক আসলে নেই।
পরের সেভেন মার্ডার, অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের পরেও আমাদের কাছে এই সংক্রান্ত কথকতাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদি না ঠিকভাবে রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে, রাষ্ট্রের চরিত্রকে, রাষ্ট্রের ভিত্তিকে প্রশ্ন করা না যায়, বা রাষ্ট্রের খোদ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার যে প্রক্রিয়া, এর যা যা অনুষঙ্গ এগুলোকে যদি প্রশ্ন করা না যায় তাহলে সম্ভবত গুম-খুন নিয়ে মানবাধিকার টাইপের আহাজারি করে আমরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারবো না। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে এই রাষ্ট্রের সীমা কতোটুকু? কোন কোন হত্যাকাণ্ডকে আমরা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বলবো? আমি বলবো এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদলের ছাত্র যখন আরেকদলের ছাত্রকে মেরে ফেলে সেটাও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডই। এই সময় রাষ্ট্র আমাদের সমাজ জীবনের এত বেশি অলিগলিতে, এত বেশি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে যে এই বিভাজনটা করতে পারা একটু মুশকিল। তারপরও রাষ্ট্র বলতে এই মুহূর্তে শুধু আওয়ামী লীগ বুঝলে হবে না, রাষ্ট্র বলতে এই মুহূর্তে বিএনপিও। যে সমস্ত রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা আছে এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা কার্যকলাপ চালায় তারা প্রত্যেকে আসলে রাষ্ট্রেরই অংশ, ইনাদের মিলিয়েই রাজনীতি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে অনেক রাষ্ট্রই তো পৃথিবীতে রয়েছে যারা আইন মানে, নিজেদের নাগরিকদের উপর ত্রাস সৃষ্টি করে না। আমার যুক্তি হচ্ছে তারা এই সন্ত্রাসটাকে আউট সোর্স করতে পারে। এদেরই কিছু কিছু রাষ্ট্রকে আমি সুপার-স্টেইট বলি, সুপার-রাষ্ট্রও বলা যায়। এই সন্ত্রাসটা আউট সোর্সিং এর বিষয়টা আলোচনার শেষ অংশ। তৃতীয় বিশ্বের এই সব হত্যাকাণ্ডের যে একটা সাম্রাজ্যিক ছক আছে সেটা নিয়ে আমি আগে যেহেতু লিখেছি, সেটা আমি শেষে রাখছি। তার আগে কথকতার আরেকটু জায়গা আমি সেরে নিই। সেটা হচ্ছে আজকের এই আলোচনা থেকে আমরা সহজেই ফুকোর সেই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে আসলেই হত্যা হচ্ছে সেই বিন্দু যেখান থেকে অপরাধ আর ইতিহাস এক হয়ে যায়, অপরাধ আর আইনও এক হয়ে যায়। এমনকি হত্যাকারীকে বিচারের মাধ্যমে বৈধভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়েও আইন নিজেও হত্যাকারী হয়ে যায়। যে লোকটি হয়তো কাউকে হত্যা করবার কারণেই জেল খাটছে, সেই লোকটিই রাষ্ট্রের নির্দেশে জল্লাদ হিসেবে আরেকটি হত্যা ঘটায়। কী অদ্ভূত! পরের হত্যাটির জন্য তার কিন্তু আগের হত্যার সাজাও কমে যায়। কাজেই আইন নিজেই অদ্ভূত এক বৈপরীত্যে ঠাসা। আইনের প্রতি মান্যতার মনোভাব আমাদের এতই প্রবল যে এই বৈপরীত্যগুলোকে আমরা খুব কমই দেখতে পাই, প্রশ্ন তোলা তো অনেক পরের ব্যাপার।
একই সাথে আমি বারবার বলছি ইতিহাসে হত্যা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হত্যা নিয়ে কী বলা হলো, কী লেখা হলো, কী ভাবা হলো এই সবকিছুই। কারণ হত্যার কথকতাই আরেকটা নতুন হত্যার প্রেক্ষাপট সাজায়। একটা হত্যা নিয়ে আমরা কী বলছি, কী শুনছি, কী ভাবছি, কী লিখছি এগুলো পরের হত্যার জন্য মঞ্চ সাজায়। ইতিহাসের গতিপথটাই এরকম। একারণেই খোদ ইতিহাসের চর্চাই কখনো কখনো হয়ে উঠে হত্যার কথকতার অংশ। জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনাও প্রায়শই কোন না কোন নমানুষ তৈরি করে, হোমো সাকের তৈরি করে। আমরা মনে করতে পারি ১৯৭১ সালে কামরুল হাসানের আঁকা সেই বিখ্যাত পোস্টারটির কথা, ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীরা যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় গণহত্যা চালিয়েছে বাঙালিদের ‘ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও স্বাধীনতা উত্তরকালে হত্যার কথকতা দাঁড় করিয়েছে, যার সর্বশেষ চর্চাটি আমরা দেখলাম শাহবাগ আন্দোলনের সময়ও, সবকিছু ছাপিয়ে এই বিশাল সামাজিক আন্দোলনকে ফাঁসিতে আটকে থাকতে। কাজেই ইতিহাস চর্চা সবসময়ই হত্যার কথকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়। ফিলিস্তিনে ইহুদীদের পূণ্যভূমির দাবি তো আসলে একটা ঐতিহাসিক দাবি। বাবরি মসজিদ নিয়ে যে হিন্দু-মুলমান সংঘাত সেটাও তো একটা ঐতিহাসিক দাবির উপরেই দাঁড়িয়ে। এই ইতিহাস চর্চার ফলাফল হিসেবে আমরা গত এক শতাব্দীতে কম রক্তপাত তো দেখলাম না।
একজন ফরাসি অ্যানথ্রপলোজিস্ট আছেন, আমার খুব প্রিয় অ্যানথ্রপলোজিস্ট, পিয়েরে ক্লস্ত্রে, তিনি লিখেছেন যে, এযাবৎ কালে দেখা গেছে যেসব সমাজের লিখিত ইতিহাস আছে, ওইসব সমাজে সন্ত্রাসী রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে। যে সব সমাজের লিখিত ইতিহাস নাই, সেসব সমাজের সন্ত্রাসী রাজনৈতিক ক্ষমতা নাই। ঠিক পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ধরণের সমাজের কথা আমি আগে বললাম। অর্থাৎ লিখিত ইতিহাস থাকবার সাথে সন্ত্রাসী রাজনৈতিক ক্ষমতার উপস্থিতির একটা সম্পর্ক আছে। যেসব সমাজের লিখিত ইতিহাস নাই, সেগুলো হচ্ছে মৌখিক ইতিহাসের সমাজ। সেখানে অথেনটিসিটি অর্থাৎ কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, সেটা আধুনিক ইতিহাসের মতন এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতীত সেই ইতিহাস বা স্মৃতিচর্চার ক্ষেত্রে মৃত কোন জিনিস নয়। অতীতকে সেখানে বর্তমানের প্রয়োজনে ঢেলে সাজিয়ে নেয়া যায়। আধুনিক ইতিহাস সেটাকে বলে ‘ইতিহাস বিকৃতি’। বলে বটে, কিন্তু নিজেও রাজনৈতিক প্রয়োজনে সেটা করতে পিছু পা হয় না। আর ইতিহাসবিদ মাত্রই জানেন যে সহীহ ইতিহাস বলে আসলে কিছু নাই, সব ইতিহাসই আসলে ‘রচিত’, হতে পারে কোন জিনিয়াস সেটা রচনা করেছেন, কিন্তু সেটা রচিতই। লিখিত ইতিহাসের সাথে কথ্য ইতিহাসের পার্থক্য কী? পার্থক্য হচ্ছে লিখিত ইতিহাস নির্ভর করে হচ্ছে আইনী ভিত্তির ওপরে। অথেনটিসিটির ওপরে, যেমন স্বাধীনতার ঘোষণা যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন এইটা এখন আইনসিদ্ধ সত্য। কিন্তু কথ্য ইতিহাসে ওই সুযোগটা আছে যেখানে কোন আইনসিদ্ধ সত্য নাই। যারা সেই ইতিহাসে বাস করেন, তারা নিজেদের সুবিধা মতন ইতিহাস বা স্মৃতি বদলে নেন। তারপরও এটা আসলে ইতিহাসই। কারণ আগেই বললাম, অবিকৃত ইতিহাস বলে কোন কিছু সম্ভব নয়।
তো আমরা দেখতে পাচ্ছি ইতিহাস চর্চার সাথে হত্যার কথকতার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। যেমন বাংলাদেশে আজকে আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক হত্যাকে ঐতিহাসিক কথকতার সাথে যুক্ত করবার একটা চেষ্টা থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই গুম-খুনের প্রতিবাদ করলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী’ হয়ে যেতে পারে বিষয়টা, যেহেতু এই চেতনার ঐতিহাসিক দাবিদার দলটি এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে। নারায়ণগঞ্জে ত্বকি হত্যার পরে শামীম ওসমানও বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ত্বকী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিছুদিন আগে ফেসবুকে লিখেছিলাম আমরা সবাই আসলে কম-বেশি নারায়ণগঞ্জেই থাকি। আমি আসবো এসব বিষয়ে। তো এই এখান থেকে আর কী ছিলো বলার জন্য আমার পকেটে? হ্যাঁ, হত্যার কথকতা বা ডিসকোর্স হিসেবে ‘গুম’। গুমের সাথে হত্যার পার্থক্যটা কী? পার্থক্যটা হচ্ছে আইনী ব্যখ্যার পার্থক্য। গুম আরো বেশি করুণ, আরো বেশি মারাত্মক। মানে ক্ষমতার জায়গা থেকে দেখতে গেলে গুম অনেক বেশি কার্যকরী। ক্ষমতার নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। ক্ষমতা যখন অর্পিত হয় কারো হাতে, এই ধরনের খুন করবার ক্ষমতা; সেই ক্ষমতা তখন নিজেই ইতিহাসের চরিত্র ধারণ করে চালকের আসনে বসে যায়। যখন সেই ক্ষমতা টোটালিটারিয়ান হয়ে উঠে, যে মনে করে যে কোন ভিন্নমতকেই আমি একদম নাই করে দেব, তখন বিষয়টি কী দাঁড়ায়? আমরা জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘১৯৮৪’তে দেখি যে কল্পিত ওশেনিয়া নামের সেই দেশটিতে শুধুমাত্র একজন মানুষকে যে গুম করে দেয়া হত, তা না। মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ, মানে সত্য বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলো যাদেরকে গুম করে দেয়া হলো তাদের জন্ম থেকে শুরু করে সবকিছু ইরেজ করা। পরে খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে ওই নামে কখনো কেউ যে ছিলো এটাই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তো গুমের ক্ষেত্রে এরকমই ঘটে। প্রথমত এটা আইনকে কলা দেখানোর একটা কৌশল। কারণ আইনের দৃষ্টিতে ‘মৃতদেহ উদ্ধার’ না হওয়া পর্যন্ত কেউ মৃত নন। ফলে এক্ষেত্রে আইনীভাবে এটাকে হত্যা হিসেবে প্রমাণ করা যায় না। নির্মম ভূক্তভোগীরা জানেন যে এটা কতো বড় একটা নির্মমতা হতে পারে। ধরেন একটি লোককে গুম করে ফেলা হলো। ধরা যাক আমাকেই। এখন আমার ব্যাংকে কিছু টাকা আছে। আমার পরিবারের টাকাটা দরকার। আমি যাকে নমিনী করে গিয়েছি তিনি টাকাটা তুলতে পারবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মৃতদেহ উদ্ধার না হচ্ছে। কারণ আইনের দৃষ্টিতে আমি তখনও মৃত না। আর যেহেতু আমি মৃত না, সেহেতু ওই টাকা ক্লেইম করা যাবে না। ব্যাংক দেবে না সেই টাকা।
আইনের মধ্যেই যে ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা আছে সেটা ইংল্যান্ডের আইনজ্ঞরা টের পাচ্ছিলেন সেই সপ্তদশ শতকের দিকেই। ১৬৬৯ সালে একারণেই ইংল্যান্ড আরেকটি আইন তৈরি করে যার নাম হ্যাভিয়াস কর্পাস। এখানে কর্পাস বলতে আসলে শরীর বোঝায়। এই আইনটার মূল বক্তব্য হচ্ছে যখন কোন আইনী বাহিনী কাউকে নিজেদের হেফাজত বা কাস্টডিতে নেয়, সেটা গ্রেফতারই হোক বা আটকই হোক, তখন আইনের বা কোর্টের ক্ষমতা আছে সেই বাহিনীকে হুকুম দেয়ার যে সেই ব্যক্তিকে ‘সশরীরে’ আদালতে হাজির করবার। বাংলাদেশের আইনও যেহেতু ইংলিশ কমন ল’য়ের ভিত্তিতে তৈরি, এখানেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটককৃতদের আদালতের কাছে সমর্পন করবার বিধান রয়েছে। না করলে কেউ হ্যাভিয়াস কর্পাসের আবেদন করতে পারেন, বা আদালত নিজেই আদেশ দিতে পারেন। আমাদের দেশে ১৯৭০ এর দশকে কিছু হ্যাভিয়েস কর্পাস হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আইনের এই বিধানটি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় হয়ে দাঁড়ায় কারো কাস্টডি বা হেফাজত স্বীকার না করা। যেটা আমাদের বাহিনীগুলো এখন করে। প্রথমে স্বীকার করে না যে গ্রেফতার করেছে, পরে দেখা যায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সেই লোক মারা পড়েছে। আইনী বাহিনী যদি স্বীকার না করে যে কেউ তাদের হেফাজতে আছে তাহলে আদালত হেভিয়াস কর্পাস জারি করতে পারে না। এর ফলেই হ্যাভিয়াস কর্পাস খুব একটা কার্যকর হয়ে ওঠেনি কখনো।
হত্যার কথকতার মধ্য দিয়ে আরেকটা কাজ হয়, সেটা হচ্ছে গুম, হত্যা এগুলোর এক ধরনের স্বাভাবিকীকরণ হয়। এক ধরনের নরমালাইজেশন করা হয়। এতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠি। হত্যা আমাদের জীবনের আটপৌরে ব্যাপার হয়ে উঠে। আমরা এই আশা করতে করতে বাঁচি যে মরলে মরবে আর কেউ, আমি না। ভুলে যাই যে মরে গেছে সেও এমনটাই ভাবত। গত পরশুদিন আশির দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে এরকম একজন আমাকে বলছিলেন তারা সাত-আট বছরে অনার্স শেষ করেছেন, কথায় কথায় নাকি তখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হতো। এখন নাকি অনেক ভালো অবস্থা। আমি বললাম, আপনার কী মনে হয় যে ভালো অবস্থা কিছু না, যেটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে আমাদের সহ্য ক্ষমতা বেড়েছে? ঘটনা এখনো ঘটে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয় না। আগে একটা মার্ডার মানে তিন মাস চার মাস বিশ্ববিদ্যাল বন্ধ। এখন মার্ডার ঘটে যায় সকাল বেলা, আমাদের আজকের এই রুমেই সেদিন ক্লাশ হয়। এগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠছে। এই যে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়াগুলো, এই স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এবং তার মধ্যে আমরা কী নামে ডাকছি, কীভাবে ব্যাখ্যা করছি, কীভাবে ভাবছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন আমি দু’টা সাম্প্রতিক উদাহরণ দিবো এই কথকতা কীভাবে এই স্বাভাবিকীকরণের কাজটা করে সেটা নিয়ে। প্রেক্ষাপট আবারো নারায়ণগঞ্জ।
সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার। ২৭ এপ্রিল সাতটা লোক হারিয়ে গেল। কথিত আছে দু’টা গাড়িতে এসে র্যাব পরিচয়ে তাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। তুলে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে একটা ব্যাপক হইচই পড়ে গেল। আমি ওই সময় খবরের কাগজ খুব একটা পড়ছিলাম না। তো, পরদিন ইন্টারনেটে উঁকি মেরে খবরের কাগজে দেখলাম যে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম একজন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তিনি একটা কথা বলেছেন। ২৮ এপ্রিলের প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম ‘গুম-অপহরণ সীমা অতিক্রম করেছে : সুরঞ্জিত’। খবরের প্রথম বাক্য : ‘গুম ও অপহরণ সীমা অতিক্রম করেছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’। কথাগুলো খেয়াল করেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাতজন অপহরণ হওয়ার পরদিন বলছেন যে, ‘গুম ও অপহরণ সীমা অতিক্রম করেছে’। হোয়াট ইজ দিস ‘সীমা’? তারমানে গুম-খুন একটা সীমার মধ্যে ঘটলে ঠিক আছে, কিন্তু ‘সীমা অতিক্রম’ করলে ঠিক নাই?
আমি তখন এই সীমার পরিসীমা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই সীমাটা কি সেটা আপাতত বোঝা মুশকিল কিন্তু এটা বোঝা গেল জনাব সেনগুপ্ত নিশ্চয়ই সীমাটা বোঝেন। এমনকি তিনি নিজেও সেই সীমা নির্ধারণকারীদের একজন, ‘উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য’, ‘সংসদ সদস্য’, তিনি আইন বানান আর ‘সীমা নির্ধারণ’ করে সেই আইন ভাঙ্গেন। উনি তাদের একজন যারা গুম-অপহরণ কোন মাত্রা পর্যন্ত ঘটলে ঠিক আছে সেটা নির্ধারণ করেন। পরের বাক্যেই তিনি আবার বলছেন : ‘সরকারের বাইরে আরেক সরকার থাকলে তো চলবে না!’ আশ্চর্যবোধক চিহ্নসহ প্রথম আলো উনাকে কোট করছে, ‘এখানে দুর্বলতা দেখানো যাবে না। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। ক্রমাগত এ-জাতীয় অপহরণ ও গুম আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত নয়’।
মানে আমি যে এতক্ষণ বড় বড় তত্ত্ব কপচিয়ে যা বললাম, এটা যে শুধু তত্ত্বকথা নয়, সেটার সাক্ষী হিসেবে হাজির হয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই অর্থে যে তিনি বলছেন যে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ সীমার মধ্যে গুম-খুন-অপহরণ এগুলো করতে হবে। সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ সার্বভৌম ক্ষমতা কর্তৃক নির্ধারিত ‘হোমো সাকের’ বা নমানুষ ছাড়া কাউকে গুম-খুন করা যাবে না। পরের একটি বাক্যে তিনি এটা আরো স্পষ্ট করেন : ‘আর আইনজীবী, যিনি অফিসার অব দা কোর্ট, তিনি সরকারেরই লোক। তাকে অপহরণ করা হয়েছে। এখানে নমনীয় হওয়া যাবে না। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দোষীদের জনতার সামনে আনতে হবে’। এখান থেকে এবার অর্থ নিষ্কাশন করলে আমরা দেখতে পাই : জনাব সেনগুপ্তের বড় আপত্তি এই জায়গায় নয় যে এক বা একাধিক নাগরিককে অপহরণ করা হয়েছে। বড় আপত্তি এই জায়গায় যে খুন হওয়াদের একজন ‘অফিসার অব দা কোর্ট’ বা ‘সরকারেরই লোক’, মানে তিনি তো আর এমন কেউ নন যাকে আইন পরিত্যাগ করেছে। তিনি হোমো সাকের নন, সন্ত্রাসী নন, চরমপন্থী নন, জঙ্গী নন। কাজেই তাকে গুম করা ঠিক হয়নি। জনাব সেনগুপ্ত যোগ্য উপদেষ্টা। তিনি জানেন ‘ক্রমাগত এ-জাতীয় অপহরণ ও গুম আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত নয়’, মানে এসব করা যেতে পারে, তবে মাঝে-মধ্যে, সংজ্ঞা মোতাবেক, ঠিক মানুষেরা গুম হলে ঠিক আছে। কিন্তু এরকম ক্রমাগত হলে বা ভুল মানুষ হলে ঠিক নাই, আইনের শাসন থাকে না। তিনি ‘সীমার মধ্যে গুম-খুন’ হওয়ার প্রতি জনগণের অনুমোদনের বিষয়টাও জানেন। কারণ তিনি মনে করেন, ‘এই অপহরণের পর আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে’। মনে করা যেতে পারে যে এর আগের অপহরণগুলোর ক্ষেত্রে ‘আইনের শাসনে বিশ্বাসী’ মানুষদের গুম নিয়ে খুব বড় কোন আপত্তি ছিল না। আসলেই ছিল না, তেমন কোন আপত্তি আমরা আসলে দেখিও নাই আগে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আরেকটি বড় আপত্তি হচ্ছে ‘সরকারের বাইরে আরেক সরকার থাকা যাবে না’, কারণ সেটা ‘আইনের শাসনের দৃষ্টান্ত নয়’। তার মানে সীমা হচ্ছে সরকার, সীমা মানে হচ্ছে আইন, সীমা মানে হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। তারমানে আইনের প্রয়োজনে যেটুকুন করা দরকার সেটুকু গুম-খুন করা যেতে পারে। মানে আইনের সন্ত্রাসী ক্ষমতার প্রতি বেআইনী সন্ত্রাসীদের ভয় তৈরি করবার জন্য যেটুকু দরকার সেটুকু করা যেতে পারে। তার বাইরে গেলে আর আইনের শাসন থাকে না। সরকারের বাইরেও আর কেউ এই কাজ শুরু করলে বিষয়টা ‘ক্রমাগত’ হয়ে যায়, ম্যানেজিবল থাকে না, মানুষের কাছে আর গ্রহণযোগ্য থাকে না। আপনাদের কী মনে হচ্ছে না জনাব সেনগুপ্তের বক্তব্য পরিষ্কার আগামবেন বা ফুকোর বিশ্লেষণকেই সমর্থন করছে? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে উনার বক্তব্য ক্রসফায়ার বা গুম-খুনের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমার বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে গেলে দেখতে পাই তার বক্তব্য আসলে এসবকে স্বাভাবিকীকরণের কথকতারই অংশ। আমি নিজে যতবার এইসব কথকতায় এই সত্যগুলো আবিষ্কার করি, নিজেকে স্টুপিড মনে হয়। মনে হয় সবাই তো সবকিছু খোলামেলা বলছে, আমরা কেন বুঝতে পারছি না? আসলে এই প্রশ্নের তাগিদ থেকেই আজকের এই হত্যার কথকতার বিশ্লেষণে নামা।
সেকেন্ড কেস স্টাডি। ঘটনার প্রায় মাসখানেক পরে, ২৩ মে নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমান এই ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। ‘সেভেন মার্ডারে’র একজন কুশীলব হিসেবে উনার নামও আছে তখন আলোচনায়। এই হত্যার পলাতক সন্দেহভাজন অর্থ-যোগানদাতা নূর হোসেনের সাথে তাঁর ফোনালাপের রেকর্ড ফাঁস হয়ে গেল ২২ তারিখ। এবং উনি সাথে সাথে সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে’ স্বীকার করলেন যে ফোনালাপটি তাঁর এবং নূর হোসেনের সাথে উনার কথা হয়েছে। এবং এই ফোনালাপের সময় তিনি ছিলেন ‘গভর্মেন্ট অল দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে’র সাথে একটি ‘আইন-শৃংখলার মিটিংয়ে’। এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন প্রায় অবিকল সুরঞ্জিত বাবুর কথা, বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ২৪ মে অনুলিপি ছেপেছে উনার বক্তব্যের। ‘একজন আইনের ছাত্র হিসেবে, আইনবিদ হিসেবে, প্রণেতা হিসেবে’ তিনি ঘটনার জন্য কে দোষী সেটা বিচার চলাকালীন বলতে চাননি। কারণ বিচারের আগে কাউকে অপরাধী তিনি বলতে চান না, কারণ এটা বলা ‘উচিতও না সভ্য সমাজে’। তো, সংবাদ সম্মেলন ডেকে উনি বলছেন :
(র্যাবের সাথে কথা বলার পর) ‘আমি কিন্তু হান্ড্রেড পারসেন্ট কনফার্ম ছিলাম, যে নজরুল জীবিত থাকবে। বিকজ সাতটা মানুষ তো। একজন হলে আমি কোন আশাই করতাম না। কিন্তু সাতজন মানুষকে মেরে ফেলবে এটা আমার কল্পনা এমনকি চিন্তাতেও আসেনি। আপনাদেরও আসেনি। এমনকি কোন বিবেকবান, সভ্য মানুষের পক্ষেও এটা ভাবা সম্ভব নয়। ইভেনচুয়ালি প্রশ্নই আসে না’।
খেয়াল করেন, একজন হলে উনি কোন আশাই করতেন না যে বেঁচে ফিরবে। অর্থাৎ ‘বিবেকবান, সভ্য মানুষ’দের একজন হিসেবে শামীম ওসমানও তার মতো করে হিসাব করছেন যে সাতজন যেহেতু ধরেছে, সাতজনকেই যে মেরে ফেলবে এটা হতে পারে না। কিন্তু একজনকে ধরে নিয়ে গেলে ‘বিবেকবান, সভ্য’ মানুষদের আশংকা ছিল। কারণ একজনকে গুম করা বিবেকসম্মত, সভ্যতা সম্মত, এমনকি আগামবেনের যুক্তি দিয়ে আমরা বলতে পারি, ‘আইন সম্মত’। কাজেই নারায়ণগঞ্জের এই আইন প্রণেতাও আসলে আইনের কথাই ভাবছিলেন।
মানে কী দাঁড়াচ্ছে? যারা আইন বানাচ্ছেন, যারা আইন ভাঙছেন, যারা আইনের বাইরে আইন হয়ে উঠছেন, যারা সরকারের বাইরে সরকার হয়ে উঠছেন পুরো প্রক্রিয়াটার মধ্যেই এই গুম-খুনের শর্তগুলো রয়ে গেছে। শামীম ওসমান বা র্যাব হয়তো এখানে দ্বিতীয় অর্থে হোমো সাকের, সার্বভৌম ক্ষমতার সাথে যারা ‘পবিত্র’ সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার কারণে আইনের উর্ধ্বে। প্রচলিত আইন বা সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীদের তাঁর প্রতি স্নেহময় প্রশ্রয় তো আমাদের সেই ধারণাই দেয়। আইনের উর্ধ্বের এই আইনের মানুষেরা, বা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতন অভিজ্ঞ আইনপ্রণেতা তো আমাদের সরাসরি বলে দিচ্ছেন যে সরকার বা আইন এইগুলো করবে। স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন কিন্তু তারপরও এটা আমরা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি না, দেখতে পাচ্ছি না। মানে একজন আইন প্রণেতা, তিনি পত্রিকার সাংবাদিক ডেকে বলছেন আমরা এগুলো করবো। এগুলো করার দরকার আছে, এগুলো হবে। প্রকারান্তরে তাই বলছেন। সাথে শুধু বলছেন যে সীমা অতিক্রম করা যাবে না, গুম-খুন ক্রমাগত হলে সেটা আইনের শাসন থাকে না। এই সব যখন প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে তখন কিসের আইন-বহির্ভূত, কিসের বিচার-বহির্ভূত, কিসের রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড? আলাদা করে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে বুঝতে যাওয়া, রাষ্ট্রের মধ্যে যে এসবের শর্ত লুকিয়ে আছে, এসব যে রাষ্ট্রেরই অনুষঙ্গ এবং খোদ রাষ্ট্রকে নিয়েই মৌলিক প্রশ্নগুলো না তুলে আসলে এই প্রশ্নগুলোর ফয়সালা সম্ভব কিনা সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
আমি শেষ জায়গাটায় আসি। শেষ জায়গাটা হচ্ছে রাষ্ট্র বলতে রাষ্ট্র আর এখন একা না। রাষ্ট্র আর একটা নাই। মানে প্রত্যেকটা রাষ্ট্রই ভেতর থেকে দুই তিনটা রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ বিভাজিত হচ্ছে। আবার এটার একটা সাম্রাজ্যিক ছক আছে, অনেক রাষ্ট্র এক বা একাধিক রাষ্ট্রের জটিল সাম্রাজ্যিক ছকে আটকা পড়ছে ক্রমাগত। সাম্রাজ্যিক ছকটা কী? আমি আগেও বলেছি কিছু কিছু রাষ্ট্রের সুযোগ আছে, যারা অগাধ সম্পদের উপর ভর করে সামাজিক বৈষম্যকে সহনীয় রূপ দিয়ে, বলপ্রয়োগকে সীমিত করে একটা সিভিল অ্যাপিয়ারেন্স তুলে ধরে। যেমন লন্ডনের গর্বের বিষয় ছিল যে লন্ডনের পুলিশ বন্দুক ক্যারি করে না। অর্থাৎ ১৯৬০-৭০ দশক পর্যন্ত লিবারিজমের এরকম একটা বিষয় ছিলো যে রাষ্ট্র আইন এগুলোর ভিত্তি সন্ত্রাস কিন্তু সেটা সীমিত ও শুভ সন্ত্রাস, দশের ভালোর জন্য করা সন্ত্রাস। কিন্তু তারপরও ভালো আইন বা ভালো রাষ্ট্র হচ্ছে সেটা যেটা সন্ত্রাস কম করে। এরকম একটা মনোভাব ছিলো। ফলে ব্রিটিশদের গর্ব ছিলো যে তাদের পুলিশ অস্ত্র ক্যারি করে না, তাদের পুলিশ সভ্য হয়ে গেছে। যদিও সেপ্টেম্বর ইলেভেন এবং লন্ডনে টিউব রেলে হামলার পরে ব্রিটিশ পুলিশ কিন্তু এখন বন্দুক নিয়ে ঘোরে। এমনকি সর্বশেষ একটি ব্রাজিলিয়ান ছেলেকে গুলি করে রেল স্টেশনে মেরে ফেললো আরব বা টেরোরিস্ট মনে করে।
তো এই রাষ্ট্রগুলোর তারপরও অন্ততঃ নিজ ভূখণ্ডে নিজ নাগরিকদের প্রতি তুলনামূলকভাবে কম সন্ত্রাসী হওয়া সম্ভব হয় কীভাবে? তাদের সুযোগটা হচ্ছে যে এই সন্ত্রাস করবার ব্যাপারটা তারা, আগে যেমন বলেছি, আউটসোর্স করে দেয়। কারণ রাষ্ট্রের অন্য অনেক কিছুর সাথে প্রথম যে কারণে সন্ত্রাসটা দরকার পড়ে, আপনারা যদি ইতিহাস ঘেটে থাকেন, সেটা হচ্ছে নিজের শ্রমিক শ্রেণী নিয়ন্ত্রণের জন্য। ইংল্যান্ডে প্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয় শিল্প-বিপ্লবের পরে বিকশিত হওয়া শ্রমিক শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য। আমাদের এখানে যেটা হয়েছে সম্প্রতি, শিল্পাঞ্চল পুলিশ বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ। অলরেডি গুম খুনের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেও আছে। মধ্যবিত্ত ক্ষমতাধর বা নামকরা সন্ত্রাসীরা যখন গুম হন তখন সেটা আলোচনায় আসে। সবচেয়ে নীরব গুম-খুনের শিকার আসলে পৃথিবীর সমস্ত জায়গাতেই শ্রমিকেরা। যেহেতু তারা ব্যক্তি হিসেবে অতটা গুরুত্বপূর্ণ না, খুব সহজেই ‘বধযোগ্য বর্গ’ বা হোমো সাকের হয়ে পড়েন। এগুলো প্রত্রিকায় আসে না। বদরুদ্দিন উমর এক লেখায় দেখাচ্ছিলেন যে সাধারণত আলোচিত যেসব গুম-খুন সেই তুলনায় কতো গুন বেশি গুম-খুন ঘটেছে আমাদের শ্রমিক অঞ্চলগুলিতে।
আজকের পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রগুলো যেটা করছে সেটা হচ্ছে শ্রমনির্ভর বা লেবার ইনটেনসিভ শিল্পগুলো সব পাঠিয়ে দিচ্ছে অপর বিশ্বের গরিব দেশগুলোতে। নিজেদের শ্রমিক শ্রেণীকে একটা মান সম্পন্ন জীবন দিতে পারছেন, আমরা এখানে যেটাকে মোটাদাগে মধ্যবিত্ত মানের জীবন বলি। যেমন বাসায় রানিং ওয়াটার থাকবে, ট্যাপ খুললেই পানি আসবে, ইলেকট্রিসিটি থাকবে, আধুনিক জীবন-যাপনের সুবিধাগুলো থাকবে, এবং নগ্ন কোন সাংস্কৃতিক বৈষম্য থাকবে না। এগুলো নিশ্চিত করতে গিয়ে তাদেরকে এই শোষণ সবসময় আউটসোর্স করতে হয়। আউটসোর্স করতে হয় এই দরিদ্র দেশগুলোতে। ইনটেনসিভ লেবার ফোর্স কোন লিবারাল রাষ্ট্রের জন্যই আর নিরাপদ কোন জিনিস না। একটা বিশাল শ্রমিক জনগোষ্ঠি, যাদেরকে নগ্নভাবে শোষণ করতে হবে, এরকম একটা জনগোষ্ঠি নিজের দেশের মাটিতে বসিয়ে রেখে কোন সরকারের পক্ষে স্বস্তিতে থাকা সম্ভব না। ফলে এই শ্রমনির্ভর শিল্পগুলো তারা পাঠিয়ে দেয় আমাদের মত দেশে যেখানে তখন গড়ে উঠে ইপিজেড এর মতন বিশেষ রপ্তানি অঞ্চল, যেখানে শ্রমিকদের সাংবিধানিক অধিকারগুলোও আর খুব একটা স্বীকৃত নয়। ধনীদেশগুলোর মাপকাঠিতেই ইপিজেড এর ফ্যাক্টরিগুলোকে আসলে আর ফ্যাক্টরি বলা মুশকিল, এগুলো আসলে শ্রম শিবির, সোয়েট শপ।
তারপর এই গরিব দেশগুলোতে তখন দেখা যায় কৃষি থেকে সদ্য উচ্ছেদ হওয়া একটা জনগোষ্ঠি রাতারাতি একটা বিশাল শ্রমিক জনসংখ্যায় পরিণত হচ্ছে। নগ্ন শ্রমশোষণের ফলে এই শ্রমিকেরা আইন মানবে, ক্রমাগত বাড়তে থাকা শ্রম শোষণের চাপ নির্বিবাদে মেনে নেবে, বিপরীতে পুলিশও ভদ্র থাকবে, আইন মানবে, রাষ্ট্র নিয়ে এরকম কোন লিবারাল কল্পনা আসলে বাস্তবে অসার। বাস্তবতা কী সেটা আমরা সবাই জানি। আইন মেনে তো পুলিশের পক্ষে সারা মাস কাজ করে প্রতারণামূলক বেতনটাও না পেয়ে ক্ষেপে উঠা গার্মেন্টস শ্রমিকদের সামলানো সম্ভব না। ফলে বাংলাদেশে পুলিশ আইন মানবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইন মানবে, এমনটা আসলে আমরা কেউই আশা করি না। তখন দেখা যায় গরীব দেশগুলোতে গণতন্ত্র ভালো জিনিস না, তাদেরকে বোঝানো হয় যে তারা আসলে গণতন্ত্রের যোগ্য না। কারণ হচ্ছে কী? এখানে গণতন্ত্র থাকলেই মুশকিল। কারণ একটা মোটামুটি চলনসই গণতন্ত্র থাকলেও যে অবিশ্বাস্য ধরনের শ্রম শোষণগুলো হয় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আপনারা সুযোগ থাকলে উরুগুয়ের এ্যডুয়ার্ডো গ্যালিয়ানো বলে একজন লেখক আছেন, তাঁর দুইটা বই, ‘ওপেন ভেইন্স অফ লাতিন আমেরিকা’ এবং ‘মেমোরি অফ ফায়ার’, এই বই দুইটা পড়তে পারেন। আমি আগের লেখাটিতে খানিকটা লিখেছি এই নিয়ে।
সাম্রাজ্যের ছকটা হচ্ছে এরকম, যেটা চলছে দরিদ্র বিশ্বে। এখানে বিশাল শ্রমিক শ্রেণীর পাশাপাশি ছোট একটা ধনিকশ্রেণীও গড়ে তোলা হয়। এবং এই ধনীকশ্রেণীর ভোগ্যপণ্য কিনবার জন্য দেশগুলোকে রপ্তানি বাড়াতে হয়। তাদেরকে ভোগ্যপণ্য কেনা এবং ঋণ শোধ করবার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হয়। রপ্তানি বাড়াতে হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্যের দাম কম রাখতে হয়। পণ্যের দাম কমানোর প্রধান উপায় হয়ে উঠে শ্রমের দাম কমানো কারণ এই গ্লোবাল শিল্পে গরিবদেশগুলোর অবদানই হচ্ছে সস্তা শ্রম। এটা একটা চক্রের মতো কাজ করে। দরিদ্র দেশগুলোতে শ্রমিকশ্রেণী যেন ক্রমবর্ধমান হারে অনুগত থাকে এবং ক্রমবর্ধমান হারে সস্তা থাকে, এটা নিশ্চিত করবার জন্য দরকার পড়ে একদল পুলিশ, একদল গোয়েন্দা, জল্লাদ, নিপীড়ণকারী, টর্চারসেল এগুলোর। সেই সাথে দরকার পড়ে একটা অনুগত মিডিয়া। এবং এই বাহিনীকে খাওয়ানোর জন্য সরকারগুলোর দরকার পড়ে টাকা। ফলে সরকারগুলোকে আরো ঋণ নিতে হয় আইএমএফ’র কাছে, বিশ্ব ব্যাংকের কাছে। এই ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য দরকার পড়ে আরো ঋণ এবং আরো বেশি ডলার আয় করবার। এই আয় বাড়ানোর জন্য কী করতে হয়? রপ্তানি বাড়াতে হয়। যেহেতু ঋণটা শোধ করতে হবে ডলারে। ঋণের টাকা ডলারে আসে ডলারে যায়। ফলে রপ্তানি বাড়াতে হবে। রপ্তানি না করে উপায় নাই। রপ্তানি বাড়াতে হলে কী করতে হবে? দাম কমাতে হবে। দাম কমাতে হলে কি করতে হবে? শ্রমশক্তিকে আরো সস্তা করতে হবে। আরো সস্তা করতে হলে কী করতে হবে? তাদেরকে দমনের জন্য আরো বেশি শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী লাগবে। এবং আপনারা যদি আমার ফেসবুকে লেখাটা দেখেন, আমি যখন লিখছিলাম, একই সপ্তাহের নিউজ ছিলো শ্রমিক নেতা আমিনুল গুম খুন, তার আগের সপ্তাহে ইলিয়াস হারিয়ে গেছেন। ওই সপ্তাহেই আইএমএফ নতুন ঋণ ছাড় করছে বাংলাদেশে জন্য। একই সপ্তাহেই পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনা হয়েছে বিশাল অংকের ডলার খরচ করে। সবগুলো একই সপ্তাহের পত্রিকাতে আছে। আমরা শুধু এক খবরের সাথে আরেক খবরের যোগসূত্র স্থাপনে অক্ষম।
অস্বস্তিকর হলেও সত্য যে গুম-খুনের ইতিহাস আমাদের এখানকার রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মনে হলেও দুনিয়ার সবজায়গাতেই এই গুম-খুন বরাবরই রাষ্ট্রের একদম অঙ্গীভূত অংশ। কি সোসালিস্ট, কি কমুনিস্ট, কি ইসলামিস্ট, কি ক্যাপিটালিস্ট, কোন রাষ্ট্রের মধ্যেই এ প্রশ্নে তেমন কোন পার্থক্য নেই। সবচেয়ে ডিস্টার্বিং উদাহারণটাই দিই। ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে লেনিন বিপ্লব করে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। ঠিক দুই মাসের মাথায়, নভেম্বর মাসে তিনি গঠন করলেন আমাদের আজকের র্যাবের সোভিয়েত সংস্করণ, চেকা পুলিশ। এক মাসের মাথায় এই চেকা পুলিশ গুলি চালিয়েছিল ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপরে। এটা ব্যক্তি লেনিনের গলদ বা মার্ক্সিজমের গলদ হিসেবে আমি বিচার করছি না। আমি বলছি খোদ রাষ্ট্রের এই চরিত্রটা আছে। এইটা রাষ্ট্রের ধর্ম, রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, কারণ ‘রাষ্ট্রং বাহুবলাশ্রিতম’। পরে চেকা পুলিশের যে ইতিহাস আমরা দেখি সোভিয়েত ইউনিয়নে, সাথে যুক্ত হয় কেজিবি এবং সেখানে শুরু হয় গুম হয়ে যাওয়া, অথবা গুম হয়ে যাওয়ার ভয়ে নির্ঘুম দিন-রাত্রি-যাপন। প্রত্যেক রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বীদের হয় মেরে ফেলা অথবা শ্রমশিবিরে পাঠিয়ে দেয়া, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেয়া। এই যে একটা আতঙ্কের সমাজ সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিলো, সেটা আমরা দেখেছি। ফলে এখানে আসলে ক্ষমতায় কমুনিস্টরা নাকি ইসলামিস্টরা সেই প্রশ্ন খুব কাজের নয়। রাষ্ট্র জিনিসটাই এ রকম। রাষ্ট্র ইজ বাই ডিফল্ট এ কিলিং মেশিন, আইনী সংজ্ঞা মোতাবেক। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা হচ্ছে কারো জৈব অস্তিত্বেরই বিনাশ করবার ক্ষমতা। সেটার প্রয়োগ আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নেও দেখেছি, আরো বাজেভাবে দেখেছি অন্য অনেক জায়গায়। চেকা পুলিশ, পরবর্তিতে কেজিবি’র তুলে নিয়ে যাওয়াকে রুশরা বলত ‘মধ্য রাতের কড়া নাড়া’। রাতে মানুষ ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবতো যে মধ্যরাত্রে ‘ওরা’ আসবে। একই উদাহরণ আমরা দেখেছি লাতিন আমেরিকায়। সেখানে মার্কিন মদদপুষ্ট সামরিক শাসকেরা, চিলির পিনোসে থেকে শুরু করে ল্যাটিন আমেরিকাতে আর যেসব দেশে সিআইএ ব্যাকড গভর্নমেন্ট ছিলো, সেই গভর্নমেন্টরাও গুম-খুন চালিয়েছে পুরা শাসনকাল জুড়ে। এই মহাদেশে গুম হয়ে যাওয়ার নাম হয়েছিল ‘রুটিন ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’, নিয়মিত হারিয়ে যাওয়া, নাই হয়ে যাওয়া একেকটা মানুষ। ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকায় নৈরাজ্যপন্থীদের ওপর একই গুম-খুন চলেছে। এমন কোন রাষ্ট্র নাই যে এই চর্চা করে নাই। আমি বারবারই জোর দিয়ে বলছি। কী ইসলামিস্ট, কী ক্যাপিটালিস্ট, কী সোসালিস্ট… কোন পার্থক্য নাই। কারণ আইনী ও বেআইনী সন্ত্রাস ছাড়া রাষ্ট্রেরও টিকে থাকবার যে কোন উপায় নাই।
তো আমরা কী করতে পারি এরকম পরিস্থিতিতে? আমরা যে সন্যাস গ্রহণ করবো না সেই উপায়ও নাই। আগে ছিলো। আগে উপায় ছিলো যে রাষ্ট্র আমার পছন্দ হলো না, আমি রাষ্ট্রের বাইরে চলে যাব। এটলিস্ট বৈদিক সমাজে সেই সুযোগটা ছিলো। আমার বেদ পছন্দ না হলে আমি তান্ত্রিক হয়ে যেতে পারতাম, মানে ‘স্ব-তন্ত্র’ হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু এখন রাষ্ট্র পছন্দ না হওয়া মানেই যেন রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আজকের এই ক্লাশ যে রেকর্ড হচ্ছে, এটা দিয়েই আমার নামে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা সম্ভব। কারণ আমি পরিষ্কার বাক্যে বলছি রাষ্ট্র মানে হচ্ছে সন্ত্রাস, রাষ্ট্র ইজ এ কিলিং মেশিন। এগুলো আমি কয়েকবার বললাম। তাই না? এগুলো বলতে গিয়েও মনে মনে আমাকে আমার বিরুদ্ধে আনা সম্ভাব্য রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ খণ্ডন করতে হয়। আমি তো বলবো যে এটা আমি বলি নাই। এটা ম্যাক্স বেভার বলছেন। আমি তো বলি নাই, এসব ফুকো বলছেন, আগামবেন বলছেন। আমাকে আমার শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো পড়িয়েছেন। রাষ্ট্র আমাকে চাকরি দিয়েছে এগুলো পড়ানোর জন্য। কিন্তু এত যুক্তি শোনবার সময় আমাদের রাষ্ট্রের আছে বলে মনে হয় না। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত এই বিষয়ে আমাদের প্রায় ঐক্যমত আছে।
যখন রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র পরিবর্তনের জন্য আমাদের সমাজ একটা বিদ্রোহ করে, সেখানেও হত্যার একটা প্রভোকেটিং ডিসকোর্স দিয়ে সেই বিদ্রোহের চরিত্র নস্যাৎ করা যায়। যেমন আমরা দেখেছি যে শাহবাগ আন্দোলনে পরিকল্পিতভাবে এই তরুণদেরকে একটাই বুলি শেখানো হয়েছে ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি। সমাজের একটা সম্ভাবনাময় জাগরণকে একটা হত্যার ডিসকোর্সে আটকে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ গণজাগরণ মঞ্চ যেদিন তাঁদের বর্ষপূর্তি করছিল, ঘটনাক্রমে আমি ঠিক আগের বছরের মতন সেদিনও সেখানে ছিলাম। বইমেলায় যাব বলে। একবছর পূর্তিতে উনারা স্মৃতিচারণ করছিলেন। তো, কোনকিছুর ‘স্মৃতিচারণ’ কখন করতে হয় সেই প্রশ্ন আমার মনে না এসে পারেনি। কিন্তু তারচেয়ে মজার জিনিস দেখলাম যে গণজাগরণ মঞ্চের স্টলে রঙবেরঙের বাতি। একটা ফাঁসির দড়িতে বাতি জ্বলছে নিভছে, জ্বলছে নিভছে। পাশে লেখাও আছে ফাঁসি। ফাঁসি জ্বলছে নিভছে। জ্বলছে আর নিভছে। আর তেমন কোন বক্তব্য কোথাও নাই। একটি সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাটাকেও রাষ্ট্র হজম করলো ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি’ দিয়ে। সেলিম রেজা নিউটন তখনই লিখেছিলেন যে ‘রাষ্ট্র তো চাইবেই’, আমি যদি কোট ভুল না করি, ‘যে এই জমায়েত শুধু ফাঁসি ফাঁসি করে চিল্লাক’। এবং তাই ঘটলো। এবং এক বছর পরে যখন গণজাগরনের নিদর্শন যখন খুঁজতে যাওয়া হচ্ছে সেখানে শুধু একটা প্রত্নতাত্ত্বিক লাইট জ্বলছে। ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি। এইভাবেই কিন্তু হত্যার কথকতা আমাদের চিন্তাকে রিডিউস করে ফেলতে পারে।
আমাদের আসলে আজকে উপায় কী? উপায় হচ্ছে, উপায়টা অক্ষমের মতো মনে হতে পারে আপনাদের কাছে, কিন্তু ভেবে দেখবার মতন। উপায় হচ্ছে এই হত্যার কথকতার একটা পাল্টা কথকতা চালু করা। কোদালকে নির্মোহভাবে কোদাল বলা শুরু করা। সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রের যুগে সত্য বলাটাই একটা বড় বৈপ্লবিক কাজ। কিন্তু সেই সত্যকে আমাদের আগে দেখতে পেতে হবে রাষ্ট্রীয় কথকতার আড়াল সরিয়ে। তার জন্য প্রস্তুতি চাই। এই লড়াই রাষ্ট্রের বিপরীতে সব সমাজই করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ওই সময়ে মানুষ কী করেছে? রাষ্ট্র নিয়ে মানুষের রাজনৈতিক রসবোধ তখন সাংঘাতিক পর্যায়ে গিয়েছে। একটা জোক বলি, গুমের গুমোট ভাব কাটানোর জন্যই বলি, যেহেতু এখন শেষ করবো। কেজিবি অফিসে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে একদিন, বারবার একটা ফোন আসছিলো। ‘হ্যালো এটা কি কেজিবি?’, উত্তরে এখান থেকে বলা হলো যে না, কেজিবি বন্ধ হয়ে গেছে। একটু পরে আবার ফোন। ‘হ্যালো এটা কি কেজিবি?’ যথরীতি উত্তর : ‘না কেজিবি উঠে গেছে। আবার ‘হ্যালো এটা কি কেজিবি?’। এবার অপারেটর ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘আপনাকে কয়বার বললাম যে কেজিবি বন্ধ হয়ে গেছে’। উত্তরে ফোনের লোকটি বলে ‘ভাই কিছু মনে করবেন না, আমার শুনতে খুব ভাল লাগছে যে কেজিবি বন্ধ হয়ে গেছে।’
ফলে মানুষের চিন্তাতো। মানুষতো। আফটার অল মানুষ তো। একটা সমাজকে যখন সাপ্রেস করা হয়, প্রত্যেকটা ভিন্নমতকে যখন সাঁড়াসি দিয়ে চেপে ধরা হয় বা গুম করে দেয়া হয়, তখন ওই সমাজের ভিতরেই প্রতিচিন্তা জন্মাতে থাকে। কলম্বিয়ান একজন উপন্যাসিক। কয়েকদিন আগে মারা গেলেন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, তিনি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল’, কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না। উপন্যাসটা শুরুই করেছেন এভাবে যে ওই কর্নেলের গ্রামে একটা জানাযা হচ্ছে, একটা মানুষকে কবর দেয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। কর্নেলের জন্য আজকে অন্য রকম দিন। কেন অন্য রকম দিন? অনেকদির পরে এই গ্রামে একজন মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। এটা একটা বিশেষ দিন কর্নেলের জন্য। এবং গোটা উপন্যাসে কোন চরিত্রের কোন নাম নাই, ব্যক্তির নাম নাই। সে সময় কলাম্বিয়াতে সামরিক শাসনের দাপটে মানুষের ব্যক্তি সত্ত্বাই গুম হয়ে গিয়েছিলো। সেরকম একটা সময় আজকে প্রায়সই আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এখন ‘তোমার আমার ঠিকানা’ না হয়ে ক্রমশ বেওয়ারিশ লাশের ঠিকানা হয়ে উঠছে। কী অদ্ভূত! হিন্দি ছবিতেও দেখি খুন-খারাবির পরে ডনরাও সাঙ্গ-পাঙ্গদের ‘লাশের ঠিকানা লাগাতে’ বলেন। এখন আমাদের জাতিগত ঠিকানার নিশানা হয়ে উঠা এই নদীর মোহনাগুলোতে লাশগুলো কে পাঠাচ্ছেন?
আমার মনে পড়ে স্বাধীনতার আমরা যেদিন চল্লিশ বছর উদযাপন করি, তার আগের ক’দিন ধলেশ্বরিতে অজ্ঞাতনামা অনেক কয়টি লাশ পাওয়া যায়। এবং সেদিন আমরা কী করেছিলাম গোটা জাতি? আমরা পতাকা উড়িয়েছিলাম। আমরা ফ্লাগ উড়িয়েছিলাম। জাতীয় পতাকা। অরুন্ধতি সবচেয়ে ভালো বলেন, ফ্লাগ আর বিটস অফ কালার ক্লথস হুইচ দি গভরমেন্টস ইউজ টু শ্রিংক র্যাপ ইটস পিপলস মাইন্ড এন্ড এজ ও সেরেমোনিয়াল শ্রাউড টু বারি দ্য ডেড। জাতীয় পতাকা হচ্ছে কিছু রঙিন কাপড়ের টুকরা, যেটা সরকারগুলো ব্যবহার করে আমাদের চিন্তাশক্তিকে মুড়িয়ে দেয়ার জন্য, শ্রিংক র্যাপ মানে বস্তায় কোনকিছু যেভাবে ঠেসে র্যাপ করি। আবার একই সাথে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন মানে জাতীয় পতাকায় ঢেকে দাফন। বুদ্ধিবৃত্তিও একটা সময় এসে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নহীন সেবায় লেগে পড়ে। এবং যখন এগুলো খুব বাড়তে থাকে, ইতিহাস আমাদের বলে যে আমরা ফ্যাসিবাদ নামক স্টেশনের খুব কাছকাছি এসে গেছি। তখন আমাদের ডিসিপ্লিন আর প্যানিশমেন্ট নিয়ে এক ধরনের অবসেশন কাজ করে, আমরা সবাই বেশি করে পানিশমেন্ট চাই, আমরা সবাই বেশি করে ডিসিপ্লিন চাই। এমনকি, দেখবেন সামরিক শাসনের প্রতিও আমাদের জনমানসের একটা অংশের মোহ আছে। এগুলো হচ্ছে ফ্যাসিজমের আবির্ভাবের উপসর্গ। একটা টোটালেটেরিয়ান শাসনপ্রণালী যে আসছে, গুম-খুন থেকে শুরু করে এই সবকিছুই হচ্ছে তার আরলি সাইন।
এইসব নিয়ে সামগ্রিক কথকতা আমাদের অবসেসড করে রাখে, চিন্তাকে অবশ করে রাখে। অবসেশন উইথ ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট। টিভিতে সিআইডি চলতে থাকে, ক্রাইম শো চলতে থাকে, আমরা অবসেসড থাকি অপরাধ নিয়ে। যেদিন একটা বড় অপরাধ ঘটবে সেদিন পত্রিকা বেশি বিক্রি হবে। যেদিন একটা অপরাধ ঘটবে, যেদিন শামীম ওসমান কথা বলবেন, সেদিন টিভি চ্যানেলগুলোর টিআরপি বাড়বে। এতকিছুর পরেও ন্যাশনালিজম তুঙ্গে থাকবে। আমরা জাতীয় পতাকার রেকর্ড করবো, পরদিন পাকিস্তান সেটা ভাঙবে। আমরা আবার প্রস্তুত হবো জাতীয় পতাকার রেকর্ড ভাঙার জন্য। এবং মাঝখানে জাতীয় পতাকা অবমাননার দায়ে দু’চারজনকে উত্তম-মধ্যম দেয়া হবে। এই ধরনের কাণ্ড-কারখানা ঘটতে থাকবে। এই পুরো প্রক্রিয়াগুলো চলতে থাকে। ফলে ক্রসফায়ারের প্রেস স্টেটমেন্ট যে মিথ্যা এটা বুঝতে পেরেই নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে বসে থাকাটা আসলে সেই ফ্যাসিবাদকেই স্বাগত জানানো। এই জায়গাটায় সম্ভবত আমাদের কিছু করবার আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং সমাজে নতুন চিন্তার যোগান দেয়ার দায়িত্ব আছে বলে মনে করি। যদিও সেটা হয়তো খুব যথেষ্ট কিছু না। সেই কাজটাই শুরু হতে পারে আজকে প্রচলিত হত্যার কথকতার একটা পাল্টা অর্থ তৈরি করে। এই কথকতার শব্দগুলোর অর্থ উন্মোচন করে। কোন ক্ষেত্রে নতুন অর্থ দিয়ে, কোন ক্ষেত্রে পুরনো অর্থ উদ্ধার করে।
যেমন উদাহরণ হতে পারে আমাদের প্রথম চাবিশব্দ রাষ্ট্রই। রাষ্ট্র কথাটার মানে আসলে ক্ষমতার হাতে বেহাত হয়ে গেছে। সেই বেহাত হয়ে যাওয়ার প্রমাণ রয়ে গেছে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির ‘র-ফলা’তেই। আদিতে রাষ্ট্র শব্দটিতে ‘র-ফলা’ ছিল না, শব্দটি ছিল ‘রাষ্ট’। হরিচরণের শব্দকোষে এই রাষ্ট মানে লেখা আছে দেশব্যাপ্ত, প্রকাশ, বিদিত। অর্থাৎ রাষ্ট্র মানে সমাজের ‘দেশব্যাপ্ত’ বোঝাপড়া, মানুষের একজনের সাথে আরেকজনের বোঝাপড়া, যৌথ মিমাংসা, কনসেনসাস বা আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এটা এমন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং যেটা সবাই জানে, যেটা সর্বজন বিদিত। ‘রাষ্ট্র’ পদ হিসেবে পুরুষ কিংবা ক্লীব নামবাচ্য যার ব্যবহার সংস্কৃত সাহিত্যের আগে পাওয়া যায় না। কিন্তু ‘রাষ্ট’ বিশেষণ এবং প্রকৃত বাংলা শব্দ। কিভাবে সংস্কৃত ভাষায় এসে ‘রাষ্ট’ একটা ‘র-ফলা’ অর্জন করে ‘অপরূপ’ থেকে জটিল ‘পোড়াকাষ্ঠে’ রূপান্তরিত হলো সেই ভেদ করতে পারাটা আজকের সময়ে এসে জরুরি। যে শব্দের মানে ছিল আপনার সাথে আমার বোঝাপড়া, মানে সর্বজনবিদিত সোশাল কন্ট্রাক্ট, সেই শব্দ কিভাবে সর্বমান্য ‘বাহুবলাশ্রিত’ দানবে পরিণত হলো সেই ইতিহাস বোধকরি আমাদেরই লিখতে হবে। আমাদের পূর্বজনেরা তাঁদের মতন করে ইশারা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন আমাদের ভাষার আনাচে-কানাচে। আপাতত সেই বিচিত্র অর্থময়তার ভেতর থেকে কিভাবে ক্ষমতার ‘প্যাঁচা’ কোন এক ‘ছুতা’য় ‘সূর্যে’র সাথে নিজের ‘শত্রুতা’ ‘রাষ্ট’ করে দিয়ে মর্ত্যে আামাদের জীবন-মরণের বিধাতা হয়ে বসল সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। আমাদের দেখতে পেতে হবে যে আজকের সব আধুনিক জাতিরাষ্ট্রেরও সেই প্যাঁচার মতন একটা করে জাতীয় শত্রু থাকে। সেই শত্রুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র অকাতরে ঘৃণা রাষ্ট করতে থাকে। কিভাবে ‘রাষ্ট’ শব্দটিতে ‘র-ফলা’ লাগিয়ে সেটাকে সর্বজনবিদিত সর্বসম্মত বোঝাপড়া থেকে ত্রাস নির্ভর সার্বজনীন মান্যতা করে তুলল সেটা খুঁজে বের করা আমাদেরই দায়িত্ব।
এই প্যাঁচা যে নিজেকে শুধু যে সর্বমান্য করে তোলে তাই না, সে আসল সত্য গোপনও করে ফেলে। সেই গোপন করবার কাজটার জন্য নিয়োগ করা হয় শত শত সচিব। সচিব মানে কী? সচিব মানে, আক্ষরিক অর্থে সত্য সম্পাদনায় নিয়োজিত অমার্ত্যবর্গ। সচ+ইব(-ক)=সচিব, অমরকোষে রয়েছে সচতি সমবৈতি সচিবঃ। এখানে ইব প্রত্যয়টি ক্রিয়া সম্পাদন অর্থে বাংলায় সব পুরুষেই ব্যবহৃত হতো এককালে, আধুনিককালে এসে এটি শুধু উত্তম পুরুষে ব্যবহৃত হয়। সত্য সম্পাদনা মানে সত্য গোপন করা। ইংরেজিতেও সেক্রেটারি শব্দটির অর্থ তাই, সিক্রেট করেন যিনি, সিক্রেটকারী। ইংরেজি অভিধানেও সেক্রেটারি মানে ‘দ্য পার্সন এনট্রাস্টেড উইথ এ সিক্রেট’। একারণেই উনারা আমাদের সচিবালয় সত্য গোপনে নিয়োজিত থাকেন, ফলে এখানে প্রবেশ সহজ নয়, সবার জন্য নয়। এখানে সচিবেরা গোপনীয় সিল মারা সব কাগজপত্র গোপনে নাড়াচাড়া করেন। উনারাও ‘রাষ্ট’ অর্থে সর্বজনবিদিত বোঝাপড়াকে ‘রাষ্ট্র’ অর্থে ত্রাস-নির্ভর আনুগত্য বা আইনে পরিণত করবার অন্যতম কারিগর। কাজেই হত্যার কথকতা নিয়ে ভাবতে হলে এভাবেই শাসনপ্রণালির কথকতায় আমাদের ভাষার একটা লড়াই চালাতে হবে। আমাদের শব্দগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে হবে। সম্ভবত ভাষার আইন অমান্য করেই শুরু করতে হবে কাজটা, কি বলতে আমরা কি বুঝব সেটা অনেকখানি পাল্টে ফেলতে হবে। তাহলেই সম্ভবত হত্যার শাসনতান্ত্রিক কথকতা থেকে আমাদের চিন্তা মুক্তি পেতে পারে। আর আগেই বলেছি, মুক্তচিন্তা মাত্রই অ্যাকশন, আজকের সময়ে একটা পিওরলি পলিটিক্যাল অ্যাকশন।
আমি থামি এবার। সবাইকে ধন্যবাদ।