- নিসর্গ নিলয়
আচ্ছা ডাকসু কী?
– ডাকসু হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। মোটাদাগে বলতে গেলে, ডাকসুতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, একাডেমিক ও এক্সট্রা-একাডেমিক কার্যক্রমের উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নিয়ে কাজ করবে (কেন্দ্রীয় সংসদের ২(ক), ২(খ), ২(ঘ) ধারা)। ডাকসুর লক্ষ্য দেশের জন্য ‘সুনাগরিক’ তৈরি করা, নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা (২(গ) ধারা), অনেকটা মোটিভেশনাল স্পিকাররা যেভাবে বলে থাকে আরকি।
তাহলে ডাকসু কি রাজনৈতিক সংগঠন না?
– ডাকসুর ইতিহাসে দেখা যায়, ডাকসু বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হয়ে, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মতামত প্রকাশের প্লাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাকসুর নির্বাচনের নিয়মও গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রতিফলন। এজন্য এর গুরুত্ব ছিল অনেক। কিন্তু গঠনতন্ত্রে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘেঁটে যা দেখা গেল, সেখানে কোথাও সরাসরি উল্লেখ নেই যে, এটি রাজনৈতিক সংগঠন। সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও যদি বোঝা যেত যে এর রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে তাহলেও চলত। কিন্তু গঠনতন্ত্রে আসলে তেমন কোন ভাসাভাসা ইঙ্গিতও নেই। এই সুযোগে ডাকসুর যে রাজনৈতিক কার্যক্রম আছে, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে তা বানচাল করে দেওয়া সম্ভব।
আমি তো রাজনীতি করার ব্যাপারে আগ্রহী না, আমি কি ডাকসু নিয়ে ভাবব?
– অবশ্যই ভাববেন। আপনি রাজনীতি করার ব্যাপারে আগ্রহী না মানে তো এই না যে আপনি রাজনীতির বাইরের কেউ, বা রাজনীতির ব্যাপারে অজ্ঞ। আপনার অবশ্যই একটা রাজনৈতিক ধারণা, মতামত আছে। পাশাপাশি, ক্যাম্পাসে আপনার স্বাধীনভাবে চলাফেরা, পড়াশুনা করার অধিকারের সাথে ডাকসুর প্রশ্ন জড়িত। ডাকসুর রাজনীতি অবশ্যই এর উপর ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ডাকসু নির্বাচন যে হচ্ছে, এটা নিরপেক্ষ হবার সম্ভাবনা কতটুকু?
– নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সম্ভাবনা খুবই কম। জাতীয় নির্বাচনেই আমরা দেখলাম কী হল। সরকার ভোট ছিনতাইকে অস্বীকার করলেও আপনার আমার মত সাধারণ মানুষ তো জানে তারা কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে। সুতরাং, ছাত্রলীগ সমর্থিত প্যানেল ডাকসু নির্বাচনে একই কাজ করবে না, এ কথা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে? এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত ডাকসু সংক্রান্ত যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোনটাই সাধারণ শিক্ষার্থীবান্ধব না, বরং ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্রসংগঠনগুলোর পেশিশক্তির রাজনীতির পক্ষে যায়। যেমন- হলের ভিতরে ভোটকেন্দ্র রাখা। এছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও দেখলাম চোখ বুজে ছাত্রলীগের পক্ষে কথা বলতে।
ডাকসু হলে কি প্রশাসন আমাদের কথা শুনতে বাধ্য হবে?
– সেই ডাকসু যদি শিক্ষার্থীবান্ধব হয় তবে অবশ্যই হওয়ার কথা। এখানে একটা কিন্তু আছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসুর প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সংগঠনের অনেক ক্ষমতা ধারণ করেন। তিনি চাইলে ডাকসুর অনেক কার্যক্রম মুলতবি ঘোষণা করতে পারেন। যেমন- প্রেসিডেন্ট তার ক্ষমতাবলে কমিটির যে কোন সদস্য বা পুরো কমিটি বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারেন। তিনি গঠনতন্ত্রের কোন ধারা যেভাবে ব্যাখ্যা করবেন সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে (কেন্দ্রীয় সংসদের ৫(ক) ধারা)। তাই ডাকসু হলেই যে প্রশাসন ছাত্রদের কথা শুনতে বাধ্য হবে তা বাস্তবে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চিত। এই প্রশাসন যে শিক্ষার্থীবান্ধব না তা তো গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছিই।
ভিসি ডাকসুর প্রেসিডেন্ট কেন?
– গঠনতন্ত্র (কেন্দ্রীয় সংসদের ৫(ক) ধারা) অনুযায়ী ছাত্রসংসদের প্রেসিডেন্ট হন ভিসি। ঠিক যেমন সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির চ্যান্সেলরের দায়িত্ব অনেকটা আলংকারিক হলেও ডাকসুর ক্ষেত্রে তা নয়। ডাকসুর গঠনতন্ত্র ও বর্তমান প্রেক্ষিত অনুযায়ী ভিসির হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা থাকবে যা ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের মত হয়ে যেতে পারে। কারণ বর্তমান প্রশাসন বিগত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে এবং বিভিন্ন আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অত্যাচার-নিপীড়নে মদদ কিংবা মৌনসম্মতি দিয়েছে।
ডাকসু হলে নাকি গেস্টরুম বন্ধ হবে। সবাই হলে সিট পাবে। এটা কীভাবে? হলে হলে ক্ষমতা দখল, হল দখল নিয়ে যে মারামারি হয় সেটা বাড়বে না কমবে?
– গেস্টরুমের রাজনীতি তো মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর (বর্তমানে ছাত্রলীগের) ক্ষমতা অপব্যবহারের রাজনীতির টুকরো ছবি। কাগজে-কলমে ডাকসুতে যদি শিক্ষার্থীবান্ধব প্যানেল নির্বাচিত হয়, তবে তারা এ ধরনের রাজনীতি বন্ধ করবে (বলে প্রস্তাব করছে), বা শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি জানাতে পারবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। তবে দেখতেই পাচ্ছেন অনেকগুলো ‘যদি’ আছে: যদি শিক্ষার্থীবান্ধব প্যানেল নির্বাচিত হয়, যদি সেই প্যানেল শিক্ষার্থীদের দাবি তুলে ধরে… কিন্তু যদি ছাত্রলীগ সমর্থিত প্যানেলই নির্বাচিত হয় তবে কি ঘটবে সেটা সহজেই বোঝা যায়। এছাড়া হল সংসদেও গঠনতান্ত্রিকভাবে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ থাকে। হলের প্রভোস্ট থাকবেন হল সংসদের প্রেসিডেন্ট, সেখানে যে কোন বিষয়ে তিনি ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রাখেন (হল সংসদের ৩ ও ৪ নং ধারা)।সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া সেখানে কতটা জায়গা পাবে তাও ভাবনার বিষয়।
ডাকসুর নেতারা কেন আমার কথা শুনবে?
– কাগজে-কলমে ডাকসুর নেতারা হচ্ছেন শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত নেতা। সুতরাং নৈতিকভাবে তাঁরা আপনার কথা শুনতে দায়বদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা তো আমরা দেখছিই। এখানে নৈতিকতা বলতে কবে কী ছিল? বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হওয়ার কথা। সেখানে নির্বাচন নিয়ে যে ছেলেখেলা হল তা আমরা দেখেছি। এক্ষেত্রে শুধু নৈতিকতার উপর নির্ভরশীল না থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন ডাকসুর সাথে সবসময় যোগাযোগ এবং ডাকসুর সিদ্ধান্তে তার প্রতিফলনের ব্যবস্থা করতে পারে সেজন্য পরিষ্কার নীতিমালা এবং কার্যকরী অঙ্গসংগঠন, সাব-কমিটি, ফেডারেটিভ বডি ইত্যাদি তৈরির কথা ভাবতে হবে।
ডাকসু দিয়ে সরকারি দল আরও শক্তিশালী হয়ে যাবে না তো? ডাকসুর নেতারাই সব সুবিধা পাবে না তো? আমাকে কি আরও ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে?
– সেই ভয়টাই পাচ্ছি। ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের জন্য সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত হবে কিনা তা-ই সন্দেহের মধ্যে আছে। ছাত্রলীগের পূর্বের কাজকর্ম দিয়ে দেখলে ছাত্রলীগের ভোটের ফলাফল কারচুপি, ভোট ছিনতাই ইত্যাদি করার চেষ্টা খুবই প্রবল। ১৯৭০-এর দশকে ডাকসুর লেনিন-গামা পরিষদের নির্বাচনের সময় শেখ কামাল, শফিউল আলম প্রধান এদের বিরুদ্ধে ভোট ছিনতাই এবং অস্ত্রের রাজনীতির অভিযোগ পাওয়া যায় (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমেদ, জাসদের উত্থান ও পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি)। এই শফিউল আলম প্রধানই সূর্যসেন হলের কুখ্যাত সেভেন মার্ডার কেসের আসামি। এরা কিন্তু ছাত্রলীগেই ছিল। সুতরাং ছাত্রলীগ এবারে ভোট কারচুপি করবে না, তা কে বলতে পারে? এখন বরং তার জন্য এগুলো করা সহজ, কারণ সে ক্ষমতা অনেকখানি এককেন্দ্রিক করে ফেলেছে। ডাকসু নির্বাচনে তাদের জয় হলে সেটা ফলাও করে প্রচার হবে। তারা প্রচার করবে যে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে তারা জিতেছে। ফলে ক্যাম্পাসে যে কোন সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ, (কু)কর্মপন্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা আরও বৈধতা পাবে।
ডাকসু হলে কি ডিপার্টমেন্টের গবেষণাসহ পড়ালেখায় সুবিধা বাড়বে?
– যদি ডাকসুর নির্বাচিত নেতারা এ বিষয়ে একমত হন এবং পদক্ষেপ নেন, তবে তারা অবশ্যই কিছু করতে পারবেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে যে প্যানেলগুলো আমরা দেখেছি, তাদের কারও প্রস্তাবনাতেই স্পষ্ট করে এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেবার কথা বলা নেই। হয়তো “শিক্ষা খাতে সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে” জাতীয় এক লাইনের কথা দিয়ে দায় সারা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে কী করা হবে সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, হল লাইব্রেরি এসব জায়গায় গবেষণা তো দূরে থাক, সময় নিয়ে বসে একাডেমিক পড়াশুনা করবারই উপায় নেই। প্রতিদিনই সেখানে গেলে দেখা যায় চাকরি ও বিসিএসের পড়ার মহড়া চলছে। এত জোরেশোরে চলছে যে, ক্লাসের পড়া পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরও বসার জায়গা হয় না। অথচ লাইব্রেরির প্রয়োজন কিন্তু এই কাজেই ছিল। সেসব বিষয়ে বিভিন্ন প্যানেল আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ। গবেষণা কাজের উন্নয়ন, বাজেট বৃদ্ধি এসব নিয়েও তেমন কথা নেই। গঠনতন্ত্রে অবশ্য বলা আছে, শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিকাশ ঘটাতে ডাকসু কাজ করবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা কতটা সম্ভব? প্রচলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব কেমন? এসব বিষয়ও আলোচনায় আসছে না।
ডাকসু হলে কি আমি সব জায়গায় আমার দাবি-দাওয়া তুলতে পারব?
– ডাকসুর গঠন হচ্ছে হায়ারার্কিকাল, অর্থাৎ স্তরায়িত বা পিরামিডের মত। সবার উপরে প্রেসিডেন্ট, তার নিচে ভিপি-জিএস, তারপর এজিএস, সম্পাদকমণ্ডলী, সদস্য- এভাবে ক্ষমতার বণ্টন হয়েছে। ডাকসু ছাত্রসংসদ হলেও আসলে সাধারণ শিক্ষার্থীর অবস্থান পিরামিডের সবচেয়ে নিচে। আপনি ভোট দিয়েছেন, এরপরে আপনার তেমন কোন কাজ নেই। ভোটে যে প্যানেল নির্বাচিত হয়েছে, তার দাবিই অনেকটা আপনার দাবি হয়ে যাবে, সেখানে আপনার বক্তব্য-মন্তব্য থাকুক বা না থাকুক। কাগজে-কলমে হয়তো আপনি আপনার দাবি-দাওয়া জানাতে পারবেন, কিন্তু সে কথা নেতারা শুনলে বা না শুনলেও আপনার আসলে কিছু করার নেই। এর কাঠামোই এরকম।
তাহলে তো ভাই আমার এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোন লাভ নাই…
– না আছে। আপনি মাথা চাইলেও বা না চাইলেও ঘামাবেন। কারণ আপনি এমন একটা সমাজে বাস করেন যেখানে রাজনীতি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে উপায় নেই। যদি না ঘামান, তবে আপনি রাজনৈতিক শোষণের শিকার হবেন। পাশাপাশি প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ, ব্যক্তিক বিকাশের অধিকার আছে। সেজন্য আপনাকে মাথা ঘামাতেই হবে।
কিন্তু আমার মত প্রকাশের কোন উপায় তো বললেন না… সিজিপিএর ভয় দেখিয়ে শিক্ষকরা ছড়ি ঘোরায়, প্রশাসন সব বেতন-ফি নিজের ইচ্ছামত ঠিক করে, হলে থাকার ভয়াবহ কষ্ট অন্তত এসব নিয়েও যদি বলা যেত…
– বর্তমানে আমরা যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি দেখি তা নামেই গণতন্ত্র, আসলে তা অকার্যকর বলে প্রমাণিত। এজন্য আপনাকে নতুন বা বিকল্প পদ্ধতি খুঁজতে হবে। তেমন একটা উপায় হল ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি বা সরাসরি গণতন্ত্র। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাই রাজনৈতিক সচেতনতা আপনার না চাইলেও আছে। ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়ত আসলে বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আপনাকে যেতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনি শোষণের শিকার হন। শোষণ যে শুধুই অর্থনৈতিক তা নয়, মতাদর্শিক শোষণ, রাজনৈতিক শোষণ, প্রশাসনিক শোষণও ঘটে। এর থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে ভাবতে হবে। আপনি যদি নিজেকে সাধারণের থেকেও সাধারণ মনে করেন, তাহলেও আপনার ভাবতে হবে। এবং আপনার দাবি তুলতে হবে ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন প্লাটফর্মের।
ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি কী?
– ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি এমন একটা উপায় যেখানে শুধু ভোট দিয়েই আপনার কাজ শেষ নয়, আপনি সবসময় কেন্দ্রীয় সংসদের সাথে যুক্ত থাকবেন এবং সংসদ আপনার মতামতকে যে কোন অবস্থায় গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে। আপনাকে প্রচলিত কাঠামোর মধ্য দিয়ে যেভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, সেই সুযোগ আর আপনি দিবেন না।
এজন্য কী করতে হবে?
– অনেক রকম উপায় আছে। প্রথমত, ডাকসুর হায়ারার্কিকাল কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এজন্য প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টে একটি করে সমন্বয় সভা করা যেতে পারে। সভার সদস্যরা ডাকসু বিষয়ে নিজেদের জায়গা থেকে আলোচনা করবেন এবং নিজেদের মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য চর্চা করবেন। এসব সভার কাঠামো এমন হবে যেখানে সকলের মতামতকে আমলে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে, কোন স্তরায়িত ক্ষমতাবণ্টন থাকবে না। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট-জিএসের বালাই কম। এসব সংগঠন একটি-দুটি নয়, অনেকগুলো হতে হবে। এবং ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদ যাতে তাদের বক্তব্যকে আমলে নিতে বাধ্য হয় এমন অবস্থা ধীরে ধীরে তৈরি করতে হবে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করতে হবে, যারা স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের বক্তব্য, মতামত প্রকাশ করতে পারে।
কিন্তু এতেও আমার মতামত যদি কেন্দ্রীয় সংসদ না শোনে?
– কেন্দ্রীয় সংসদের কাছ থেকে যে সিদ্ধান্ত আসে তা উপর থেকে নিচের দিকে যায়। না শোনা খুবই সম্ভব। এজন্য সংবিধানে এমন পরিবর্তন আনবার প্রস্তাবনা বা দাবি তুলতে হবে যাতে এর উল্টোটা ঘটে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সংসদ যখন সিদ্ধান্ত নিবে, তখন সবার মতামত তাকে বিবেচনা করতে হবে। প্রচলিত কাঠামোর ভিতরে থাকা হল সংসদকেই এমন সমন্বয় সভা হিসেবে তৈরি করা যেতে পারে। অর্থাৎ হল সংসদগুলোতে সব সাধারণ ছাত্ররা মিলে যে আলোচনা করবে, তার প্রভাব পড়বে কেন্দ্রীয় সংসদের সিদ্ধান্তে। সেই সিদ্ধান্ত যদি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে যায় তবে তাদের সমন্বয় সভাগুলো একে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে বা অনাস্থা জানাতে পারবে।
কিন্তু এরপরেও ভিসি আর শিক্ষকদের ক্ষমতা কমবে কি?
– ডাকসুর গঠনতন্ত্রে এ নিয়ে সংশোধনের দাবি জানাতে হবে। ডাকসুর সংসদগুলোয় শিক্ষকরা সম্মানিত সদস্য হিসেবে থাকবেন। কিন্তু সরাসরি শিক্ষার্থীদের দাবিতে ভেটো দেওয়া বা সংসদ বাতিল করার ক্ষমতা তাঁদের থাকবে না।
যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রভাব খাটায়? স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক মতগুলো আরও শক্তিশালী হয়?
– সমন্বয় সভাগুলোর উপরে কোন রাজনৈতিক দল সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে যাতে না পারে, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, ইশতেহার তৈরি করতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী বা ধর্মভিত্তিক দলগুলির একটা ব্যাপার খেয়াল করলে দেখবেন, তাদের রাজনীতিতে সাধারণ মানুষেরই একটা অংশকে ‘অপর’ হিসেবে আলাদা করে দেওয়া হয় এবং ব্যক্তির স্বাধীনভাবে চলাফেরা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সুযোগ থাকে না। ইশতেহারে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, সকলের ব্যক্তি অধিকার চর্চার সুযোগ থাকবে এবং যে কোন আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ থাকবে। অধিকার খর্বকারী যে কোন মতামতের বিরুদ্ধে যৌক্তিক সমালোচনা করার সুযোগও সেখানে চলে আসবে। মনে রাখতে হবে, ২০১৯ সালের বাংলাদেশ এবং ১৯৭০-৮০ দশকের বাংলাদেশ এক না। ২৮ বছর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল, এই সময়ে ক্ষমতাধারী, প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত আরও শক্তিশালী হয়েছে। সুতরাং ক্রমাগত পরিবর্তন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মধ্য দিয়ে না গেলে ডাকসুর সফল বাস্তবায়ন, শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছাত্র আন্দোলনের কর্মী।