- সেলিম রেজা নিউটন
বাজার-চলতি মিডিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তি যাকে ‘নৈরাজ্য’ বলে অভিহিত করে, তা প্রকৃতপক্ষে ‘নৈরাজ্য’ নয়, ও জিনিসের নাম ‘মাৎসন্যায়’। নৈরাজ্য অন্য পদার্থ। নৈরাজ্য মানে নিয়ম, নৈরাজ্য মানে বেটার ম্যানেজমেন্ট, সেলফ ম্যানেজমেন্ট।
আসলে, “সমস্ত নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে যে-জিনিসটা সাধারণ, সেটা হলো সকল জবরদস্তিমূলক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত একটা সমাজের আকাঙ্ক্ষা” (হুডল্ফ হকার, ২০১১)। কিন্তু, এক দিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এক-দেড় দশকের অন্ধকার কাল-পর্বে সন্ত্রাসবাদ, এবং অন্য দিকে বিপুলতম নৈরাজ্যবিরোধী প্রচারণার কারণে সারা বিশ্বে এমন বিভ্রান্তি তৈরী হয়েছে যে, আজও লোকে ‘নৈরাজ্য’ বলতে বিশৃঙ্খলা বোঝে।
অন্ধকার ঐ কাল-পর্বে নৈরাজ্যবাদীদের সামান্যতম আইনী তৎপরতার সুযোগও রাখে নি ইউরোপের সরকারগুলো। ফলে, গভীর হতাশায়, নির্মম অত্যাচারে, বিগড়ে গিয়ে সন্ত্রাসের জনবিচ্ছিন্ন পথ বেছে নেন নৈরাজ্যবাদীদের একটা অংশ। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়াতেই শুধরে নিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন পথে। আর, আজকের একুশ শতকের নৈরাজ্যবাদীদের ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন’ তো প্রবলভাবে গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধের পথই বেছে নিয়েছে (ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-ক; ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-খ; ডেভিড গ্রেইবার, ২০১২)। নৈরাজ্যবাদকে বুঝতে গেলে বিশৃঙ্খলার বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার:
উঠতে-বসতে যাঁরা অনিয়ম, হৈ-হট্টগোল, গ্যাঞ্জাম, মারামারি-কাটাকটি, গন্ডগোল, এলোমেলো দশা, “জোর যার মল্লুক তার” নীতি (তথা মাৎসন্যায়) ইত্যাদিকে “নৈরাজ্য” বলে গালাগালি করেন তাঁরা তো আছেনই, ‘নৈরাজ্য’ শব্দ দিয়ে অনেকে এমনকি পুঁজিবাদকেও বুঝিয়ে থাকেন। আস্ত একটা ধারাই আছে ‘অ্যানার্কো-ক্যাপিটালিজম’ বা অরাজক-পুঁজিবাদ নামে। তার মানে, কর্তৃপক্ষীয় কমনসেন্স দিয়ে নৈরাজ্যকে বুঝে ফেলাটা অন্ধ হয়ে প্রলয় বন্ধ করারই শামিল। নৈরাজ্যকে আন্তরিকভাবে বুঝতে হলে তার সুদীর্ঘ ইতিহাসে ঢুকতে হবে। (সেলিম রেজা নিউটন, ২০১১-ঙ)
এখানে তার অবকাশ নাই, বলা বাহুল্য। তবু কতকগুলো কথা বলা নিতান্তই দরকার। আসলে,
মাৎস্যন্যায় আর নৈরাজ্যর পার্থক্য প্রণিধানযোগ্য, কেননা কথায়-লেখায়-মিডিয়ায় ডান-বাম নির্বিশেষে প্রায় সমস্ত মহল স্রেফ অজ্ঞতাজনিত কারণে আলোচ্য মাৎস্যন্যায়-পর্বকে [২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবরের আগে-পরের কালপর্বকে] নৈরাজ্য, অরাজকতা প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করেছে। নৈরাজ্য কিন্তু অতিশয় উন্নত নীতিবোধসমৃদ্ধ উন্নত মানবিক একটা সমাজ গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা বিষয়। সর্বজনগ্রাহ্য কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অভাবে পৃথক পৃথক রাজশক্তি বা রাজনৈতিক দলসমূহের “জোর যার মুল্লুক তার” নীতির সশস্ত্র অভিপ্রকাশজনিত ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা হলো মাৎস্যন্যায়। “রাজা নাই, অথচ সকলেই রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বের দাবিদার। বাহুবলই একমাত্র বল, সমস্ত দেশময় উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল শক্তির উন্মত্ততা; এমন যখন হয় দেশের অবস্থা, প্রাচীন অর্থশাস্ত্রে তাহাকেই বলে মাৎস্যন্যায়, অর্থাৎ বৃহৎ মৎস্য কর্তৃক ক্ষুদ্র মৎস্য গ্রাসের যে ন্যায় বা যুক্তি সেই ন্যায়ের অপ্রতিহত রাজত্ব!” (নীহাররঞ্জন রায়, ১৪০২: ৩৮০।)
২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবরকে ঘিরে ঠিক এরকম অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের দেশের ইতিহাসে আরও একবার, পাল আমলের আগে আগে, ৬৫০–৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এরকম মাৎস্যন্যায়-পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। সে-সময় সর্বসম্মতভাবে গণেশদেবকে রাজা নির্বাচনের মাধ্যমে সেই অবস্থার নিরসন ঘটে। অন্যদিকে, নৈরাজ্য তথা নৈরাজ্যবাদের নামে মেলা ভালোমন্দ-হাবিজাবি জিনিসের চল এখানে-সেখানে থাকলেও এর মূল সামাজিক আন্দোলনের ধারাটি ইউরোপে দীর্ঘকাল যাবৎ ‘মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র’ ‘মুক্তিমুখিন সাম্যবাদ’ প্রভৃতি নামে পরিচিত। আমাদের দেশের বলশেভিক-ঘরানার কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রীরা স্বাধীন সমাজতন্ত্রের ঐ দুর্দান্ত ধারাটির ইতিহাস ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত নয় বললেই চলে। কেননা, ১৯১৭ সালে রুশ জনগণের মহান অক্টোবর বিপ্লবের পর স্বৈরতন্ত্রী বলশেভিকরা জনগণের ওপর রক্তাক্ত দমনপীড়ন চালানোর মাধ্যমে নিরঙ্কুশ হুকুমদারির রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করার পর থেকে রুশ সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জগৎজোড়া প্রচারণা-ব্যবস্থা ‘সমাজতন্ত্রী’ অর্থে বলশেভিকদেরকেই তুলে ধরেছে।
যেমন ধরুন, ১৯৩৬ সালে স্পেনের সমাজতন্ত্রীদের অসাধারণ মুক্তিপরায়ণ বিপ্লবের কথা বলতে গেলে আমাদের কানেও আসে নি। খুব বেশি লোক জানেন না, ১৯৬৮ সালের ‘প্যারিস-বসন্তের’ ছাত্র-শ্রমিক-বিক্ষোভের পেছনেও ছিল মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রীদের নানান ধারার মুক্ত-স্বাধীন তৎপরতা। এটাও আমাদের জানা আছে কিনা সন্দেহ যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদী তৎপরতার সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও ধারালো বুদ্ধিবৃত্তিক কণ্ঠস্বর, অতুলনীয় ভাষাতত্ত্ববিদ নোম চমস্কি আজকের দুনিয়ায় মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রের প্রধানতম প্রচারকদের একজন।
তো, প্রকৃতপক্ষে নৈরাজ্যবাদ হচ্ছে স্বাধীন সমাজতন্ত্র: যাবতীয় রাজা-রাজড়া-রাজতন্ত্র—তথা সমস্ত প্রকার শাসকগোষ্ঠীকে—বিদায় করে দিয়ে সুসংগঠিত জনগণের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব কায়েমের পথে অত্যন্ত সুবিন্যস্ত পরিচালন-ব্যবস্থার মাধ্যমে গোটা দেশকে অবাধ-মুক্ত-সৃজনশীল আত্মকর্তৃত্বের সুসংগঠিত কাঠামোসমূহের অধীনে নিয়ে আসা। কিন্তু সেই শিল্প-বিপ্লবের সময়কাল থেকেই, যখন থেকে শ্রমিকদের স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো গড়ে উঠছে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত, নৈরাজ্যকে বিশৃঙ্খলা, গণ্ডগোল, মাৎস্যন্যায় প্রভৃতি অর্থে চালানোর লাগাতার প্রচারণা-প্রচেষ্টা শাসকশ্রেণীগুলোর তরফে চলে আসছে। এজন্যই নৈরাজ্যবাদের অন্যতম আদি প্রবক্তা প্রুঁধো বলতেন, “নৈরাজ্য মানে নিয়ম, আর শাসক-সরকার মানে গণ্ডগোল”। (সেলিম রেজা নিউটন, ২০০৮)
অর্থাৎ, অ্যানার্কিজমের প্রধান অর্থই হচ্ছে যে, রাষ্ট্র এবং অন্য যাবতীয় কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা। অথরিটি মানেই বলপ্রয়োগ। সকল অথরিটিই অবৈধ। সকল বলপ্রয়োগ অবৈধ। নিজেকে বৈধ প্রমাণ করার দায় অথরিটিরই, নইলে তা আপনাতেই অবৈধ (নোম চমস্কি, ২০০৫: ১৭৪, ১৭৮)। মানুষ নিজেই নিজের অথরিটি হয়ে উঠবে, ‘অর্থ’ হয়ে উঠবে, তার জন্য যাবতীয় কেন্দ্রীভূত অথরিটির বিলয় প্রয়োজন।
হদিস
ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-ক। David Graeber, Occupy Wall Street’s Anarchist Roots, Al Jazeera, ‘Opinion’ section, 30 Nov 2011.
ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-খ। Dabid Graeber, Situating Occupy, Adbusters, 2 December 2011.
ডেভিড গ্রেইবার, ২০১২। David Graeber, Concerning the Violent Peace-Police, n+1 magazine, February 9, 2012 [Originally published as “The ‘Cancer’ In Occupy? An Anarchist Reponds” in The Occupied Wall Street Journal on 3 June 2012, http://occupiedmedia.us/2012/03/the-cancer-in-occupy-an-anarchist-reponds/, accessed on 12 January 2012].
নীহাররঞ্জন রায়, ১৪০২ বঙ্গাব্দ। বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব । দ্বিতীয় দে’জ সংস্করণ। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং।
নোম চমস্কি, ২০০৫। Noam Chomsky. Chomsky on Anarchism. Selected and edited be Barry Pateman. Edinburgh, Oakland and West Virginia: AK Press, 2005.
সেলিম রেজা নিউটন, ২০০৮। সেলিম রেজা নিউটনের কলাম: সাত, অক্টোবর-মহাসংকট: মাৎস্যন্যায়-পর্ব, ইউকেবেঙ্গলি, লন্ডন, ১৩ই জুন ২০০৮।
সেলিম রেজা নিউটন, ২০১১। নৈরাজ্য, নীতিবোধ, রাজনীতি, ফেসবুক-নোট, মঙ্গলবার, ৮ই নভেম্বর, বেলা ১১:৪৯।
হুডল্ফ্ হকার, ২০১১। নৈরাজ্যবাদ: এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, হুডল্ফ্ হকারের অ্যানার্কোসিন্ডিক্যালিজম গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের অনুবাদ, তরজমা: সেলিম রেজা নিউটন, বাউণ্ডুলে (রাসেল মাহমুদ সম্পাদিত), খুলনা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃষ্ঠা ৪৭-৬৩। (এই অনুবাদ করার সময় পর্যন্ত ‘গুগল ট্রান্সলেট’ এর সাথে আমার দেখা হয় নি বলে Rudolf Rocker-এর নামের উচ্চারণ করেছিলাম “রুডল্ফ্ রকার”।)
সম্পাদকীয় নোট: রচনাটি লেখকের ২০১৩ সালের বই নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য: এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়ণতা প্রসঙ্গে একটি টুকরা। পৃষ্ঠা: ৪৭-৫০। প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী, ঢাকা। রচনার বর্তমান সংস্করণটি সরণ-প্রতিসরণ থেকে নেয়া হয়েছে।