- সেলিম রেজা নিউটন
১.১ নৈরাজ্যের ব্যুৎপত্তি: রাজা ও রাষ্ট্র
মার্কসীয়-লিবারাল বিশ্ববীক্ষার কারণেই সম্ভবত ‘নৈরাজ্য’ শব্দটিকে গতানুগতিক ও বিভ্রান্তিপূর্ণভাবে ‘বিশৃংখলা’ এবং ‘কট্টরতা’ অর্থে নিন্দা করেন অনেকে। এঁরা আমাদের সেইসব বন্ধু যাঁদের সহজে কোনোকিছুতে খটকা লাগে না। পত্র-পত্রিকায়-প্রেসনোটে ‘নৈরাজ্য’ মানেই অশান্তি। পরিস্থিতি দেখে শব্দটার গভীর দার্শনিক তাৎপর্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান সুমন সম্প্রতি ফেসবুকে তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘এই মৌসুমে যে দুইটা শব্দ বিপুলভাবে অপব্যবহৃত হচ্ছে’ তার একটা হচ্ছে ‘নৈরাজ্য’ (অপরটা ‘গণহত্যা’; আজ তা আলোচ্য নয়)।
‘নৈরাজ্য’ শব্দটার ভেতরে আছে ‘রাজা’ বিষয়ক ধ্যানধারণা। আসলে রাজ, বিরাজ, রাজ্য, রাজা, রাজন, সম্রাট, রাষ্ট্র প্রভৃতি শব্দের আদিতে আছে ‘রাজ্’ নামের ধাতুটি (হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ১৯৯৬-খ: ১৯০৭)। এই ‘রাজ্’-এর অর্থ হচ্ছে ‘শোভা, দীপ্তি’ (হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ১৯৯৬-খ)। এই ধাতু থেকে উৎপত্তি লাভ করা ‘রাজ’ শব্দটির অর্থ ‘শোভা পাওয়া, দীপ্তি পাওয়া’; ‘প্রকাশ পাওয়া, বিদ্যমান থাকা’। এইভাবে ‘বিরাজ’ শব্দের অর্থ ‘শোভমান, শোভিত’, ‘দীপ্যমান, দীপ্ত’; কিংবা ‘শোভা পাওয়া, শোভিত হওয়া’; ‘শোভা করিয়া অবস্থান করা’, ‘বিদ্যমান থাকা, উপস্থিত থাকা’। ‘সম্রাট’ শব্দেরও অন্যতম অর্থ ‘রাজা’, এর গোড়ায় আছে ‘সম্+রাজ+কিপ’, অর্থাৎ ‘যিনি মণ্ডলেশ্বর ও রাজগণের শাসক, তিনি সম্রাট’। তার মানে: যিনি শোভা পান, যিনি দীপ্তি পান, যিনি প্রকাশ পান, যিনি বিদ্যমান থাকেন, তিনিই হন রাজা।
কিন্তু ‘রাজা’ ছাড়া বাকি সব মানুষ কি শোভা পান না? দীপ্তি পান না? প্রকাশ পান না? বিদ্যমান থাকেন না? নিশ্চয়ই পান, নিশ্চয়ই থাকেন। কিন্তু ‘রাজা’ ছাড়া অন্যসব লোকের শোভা, দীপ্তি, প্রকাশ, বিদ্যমানতা প্রভৃতির বিশেষ কোনো মূল্য ‘আইনত’ নাই (আইন এখানে রাজার আইন, রাষ্ট্রের আইন)। কেননা ‘রাজা’ ছাড়া অন্যসব ব্যক্তিও যদি শোভা পান, দীপ্তি পান, প্রকাশিত হন, বিদ্যমান থাকেন, তাহলে আর ‘রাজা’র সাথে সবার পার্থক্য কী থাকে?
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন ‘আমরা সবাই রাজা’, তখনই আসে নৈরাজ্যের প্রশ্ন। কেননা যে রাজ্যে বা যে রাষ্ট্রে এক ‘রাজা’ ছাড়া আর কারুর অস্তিত্বের, বিদ্যমানতার, বিরাজমানতার স্বীকৃতিই নাই, সেই রাজ্য দিয়ে কার লাভ? শুধু রাজাদের লাভ। এ কথা কে না জানে, রাজতন্ত্রের সর্বনিম্নপদস্থ দায়োয়ানটিও স্থান-কাল-পাত্রমতো নিজেই খোদ রাজা; আগা-পাছ-তলা এই রাজাদের সিস্টেম বা বন্দোবস্ত বা তন্ত্রের নামই তো দাঁড়িয়েছে রাজতন্ত্র। রাজতন্ত্রে দাসত্ব ছাড়া আমাদের জন্য কিছু বরাদ্দ নাই। রাজাকে দেশ লিখে দাও, তারপর দেশের মালিক রাজাকে খাজনা দাও, আর রাজপেয়াদার লাঠির বাড়ি খাও— এই আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। তাহলে তো নৈরাজ্যই ভালো। রাজতন্ত্রের বদলে অরাজতন্ত্রই ভালো।
‘রাষ্ট্র’ শব্দের উৎপত্তিও ঐ একই জায়গা থেকে— ‘রাজ্’ (হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ১৯৯৬)। ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির গোড়ায় আছে: ‘রাজ্+ত্র (স্ট্রন্)’, যার অর্থ ‘রাজ্য’। আর এই যে ‘স্ট্রন্’— এর অর্থ সব সময়ই কোনোকিছুর গঠন-পরিগঠনের সাথে যুক্ত। মানে রাজত্ব বা বিরাজত্ব জিনিসটার যে গাঠনিক কাঠামো, তারই নাম ‘রাষ্ট্র’।
আবার ‘রাষ্ট্র’ কথাটার আরও একটা অর্থ ‘প্রচার, প্রকাশ’ (হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ১৯৯৬)। রাজার বিরাজত্ব যখন প্রচারিত হয়, প্রকাশিত হয় এবং সবাই সে ব্যাপারে সম্মত হন, তখনই ‘রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যায়। এই গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার সাথেই ওপরের ঐ ‘ত্র’ কথাটার সম্পর্ক। ‘ত্র’ অর্থ ‘তরণ-রহন (এখনি তরিত হয়ে অন্য কোথাও চলে যাব, এই ভাব)’ (কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী, ২০০৯: ৪৮৮)। তার মানে হলো, ‘রাজা’র একক, অদ্বিতীয় ও প্রশ্নাতীত বিরাজত্ব যখন বাকি সবাইকে ‘তরিত’ হয়ে কোথাও ‘রহন’ করে বা রহে বা স্থিতি-কাঠামো লাভ করে, তখনই তার নাম হয় রাষ্ট্র।
‘রাষ্ট্র’ জিনিসটা তার মানে নিতান্তই ‘রাজা’র একক ও অদ্বিতীয় বিদ্যমানতার সংস্থা। এ জিনিস কখনো জনগণের হতে পারে না। অতএব, বিদ্যমান গঠন-কাঠামোয় ‘জনগণের রাষ্ট্র’ বলে কিছু হয় না। এইজন্যই রাষ্ট্র শব্দের আরো একটা অর্থ ‘উপদ্রব, মকরাদি, দুর্ভিক্ষ’ (হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ১৯৯৬)। তথাপি ‘সভ্যতা’ নামক গত পাঁচ হাজার বছরের রাজতন্ত্রে-শাসনতন্ত্রে ‘রাজা’ ‘রাষ্ট্র’ প্রভৃতিকে এতটাই স্বাভাবিকভাবে দেখানো হয়েছে যে, এগুলো সব ডালভাত তো বটেই আলো-পানি-হাওয়ার মতো প্রশ্নাতীত প্রাকৃতিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে যেন।
আজকের ‘রাজতন্ত্র’র মালিক-গোলাম-পেয়াদাবৃন্দ আর নবরত্নসভার রাজ-বুদ্ধিজীবীরা এতক্ষণে হয়ত বলেই ফেলেছেন: তো, জনাব, দেশটা চলবে কী করে, চালাবেটা কে? প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ-অজ্ঞ রাজাদের, তাঁদের বাচাকাচ্চাদের, বাচ্চা-রাজাদের বা রাজসন্তানদের এইরকম শিশুসুলভ প্রশ্নেরও সযত্ন উত্তর রচনা করতে হবে বৈকি। এবং সে উত্তর হতে হবে চিন্তারহিত সাবালকের উপযোগী। কেননা সে নিজে চিন্তা করবে না, খুঁজবে না, ভাববে না, শুধু মুখস্থ কথা বলবে এবং ‘উত্তম পশু’র মতো কুলগুরু পুরুৎঠাকুরের শেখানো ‘গায়ত্রী মন্ত্র’ জপে যাবে, আর এক প্রশ্ন হাজারো ভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যাবে: রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে তো, নইলে দেশটা চলবে কীভাবে?
তাকিয়ে দেখুন: খোদ এই মহাবিশ্বপ্রকৃতিকে পরিচালনা করার জন্য কী কোনো ব্যক্তি-রাজা লাগে? রাজতন্ত্র লাগে? থানা পুলিশ-পাইক-পেয়াদা-উজির নাজির-হাকিম-হুকুম-কারাগার-মন্ত্রী-মিনিস্টার লাগে? লাগে না। এগুলো লাগে পদার্থ-শক্তি-প্রাণের সর্বোচ্চ অভিপ্রকাশ মানুষের বেলায়ই শুধু। বাঘ-ভাল্লুক-শেয়াল-কুকুর-ইঁদুরের যা লাগে না, আশরাফুল মখলুকাত মানুষের তা লাগে। আশ্চর্য ঘটনা বটে। বনের রাজা সিংহ, অথবা মাছের রাজা ইলিশ থেকে শুরু করে বাতির রাজা ফিলিপস পর্যন্ত যত বানোয়াট কেচ্ছা যে নিছকই ‘রাজা’র দীপ্তি বাড়ানোর বুদ্ধিবৃত্তিক ছলনা, সে কথা বোঝা কী এতই কষ্ট? প্রয়োজনে স্মরণ করুন লোক-ছড়ার ইঙ্গিত: মাছের রাজা রুই, শাকের রাজা পুঁই, নারীর মধ্যে আমেনার মা, পুরুষের মধ্যে মুই।
হ্যাঁ, ‘রাজা’ একটি অভ্যাসের নামই বটে। আনুষ্ঠানিক রাজতন্ত্র তো এখন বিলুপ্ত-প্রায় পদার্থ। তার বদলে গণপতি গণেশের গণতন্ত্রের উত্থানের হাওয়া নতুন করে বইতে লেগেছে শ’ দুয়েক বছর ধরে— তথাপি তথাকথিত নিরক্ষর-অশিক্ষিতদের জন্য মাতব্বর-চেয়ারম্যান তো লাগেই, সর্বোচ্চ শিক্ষালয়ের জন্যও একজন বাদশাহী ভাইস-চ্যান্সেলর লাগে।
১.২ যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন: রাজাগিরির যুক্তি
এতসব দীক্ষায়ণ-প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও কিন্তু ‘রাজা’ এবং ‘রাজতন্ত্র’র বৈধতা ও যুক্তিসিদ্ধতা সম্পর্কে খটকা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় না; মনের মধ্যে কোথায় একটা খচখচানি থেকেই যায়। খটকাটা একেবারে আদি থেকেই ছিল বৈকি। মহাভারত তার প্রমাণ। মহাভারতের যুদ্ধের পরে তাঁর সর্বগ্রহণযোগ্যতার কারণে সকলেই যুধিষ্ঠিরকে ‘রাজা’ হওয়ার জন্য অন্তহীন কাকুতি-মিনতি করেই চলেছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির ছিলেন অনড়। ‘রাজা’ হতে চাননি তিনি মোটেও। তিনি বলছিলেন তিনি ধর্ম-জগতের লোক, রাজা তিনি হতে পারবেন না। মহাভারতের ‘শান্তিপর্ব্ব’র গোড়ায় অর্জুনকে তিনি বলছিলেন:
আমি রাজ্যলোলুপ হইয়াই পাপপঙ্কে লিপ্ত হইয়াছি। … অতএব আমি সমস্ত রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগপূর্ব্বক শোকদুঃখবিবর্জ্জিত হইয়া অরণ্যে গমন করিব। আমার রাজ্য বা উপভোগ্য দ্রব্যে কিছুমাত্র অভিলাশ নাই। অতঃপর তুমিই নির্ব্বিঘ্নে এই পৃথিবী শাসন করো। (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)
যুধিষ্ঠিরের এই একান্ত উপলব্ধির উত্তরে নিতান্তই রুষ্ট অর্জুনের বক্তব্য ছিল খুবই আক্রমণাত্মক ও সুস্পষ্ট এবং তাতে চিরন্তন ক্ষত্রিয়-ধর্ম তথা কর্তৃত্বধর্মের মহাসারকথাই ফুটে ওঠে:
যদি রাজধর্ম্মে দ্বেষ প্রকাশ করিয়া আলস্যে কালহরণ করিবেন, তবে কি নিমিত্ত ধৃতরাষ্ট্র-পক্ষীয় বীরগণকে বিনাশ করিলেন? ক্ষাত্র-ধর্ম্মাবলম্বী ব্যক্তিরা মিত্রের প্রতিও ক্ষমা, অনুকম্পা, কারুণ্য বা অনৃশংসতা প্রকাশ করেন না। … ক্ষত্রিয়গণ হিংসার্থই জন্মগ্রহণ করেন। হিংসাই তাঁহাদের একমাত্র অবলম্বন, সুতরাং সেই সহজ-হিংসাধর্ম্মের ও তাহার সৃষ্টিকর্ত্তার নিন্দা করা ক্ষত্রিয়ের নিতান্ত অকর্ত্তব্য। (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)
ক্ষত্রিয়-শাসক-রাজনীতিবিদ এবং তাদের শাসনযন্ত্র যে আজকের দিনেও এমনকি বন্ধুর প্রতিও ‘ক্ষমা, অনুকম্পা, কারুণ্য বা অনৃশংসতা’ প্রকাশ করে না, তা তো সমকালীন জাতীয়/আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে তাকালেই জলজ্যান্ত বোঝা যায়। ‘রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নাই’— এ জাতীয় কথা তো আর এমনিতেই রটে নাই। মহাক্ষত্রিয় অর্জুন থেকেই এইসব ধারণার উৎপত্তি। কিন্তু যুধিষ্ঠির তাঁর কথায় অনড়। রাজা হওয়ার যুক্তিপ্রণালী কিছুতেই তাঁর গ্রাহ্য হয় না— হওয়ার কথা না বলেই।
শেষ পর্যন্ত রাজ-রাজত্বের যুক্তিসিদ্ধতা কিসের ওপরে দাঁড়াচ্ছে সেইটাই আপাতত আমাদের দেখার বিষয়। তো, অর্জুনের যে নিজের ক্ষত্রিয়ধর্ম নিয়ে গর্ব, সেই গর্ব নিয়ে ‘দেবত্ব’ অর্জন করা যায় না, ‘দেবলোকে’ যাওয়া যায় না, সে কথাই তুলে ধরেন যুধিষ্ঠির। অনেক অনেক কথার পর অর্জুনকে এক পর্যায়ে তিনি বলেন:
যে ভূমিপতি এই অখিল ভূমণ্ডল মধ্যে একাধিপত্য বিস্তার করেন, তাঁহারও এক ভিন্ন দ্বিতীয় উদর নাই। তবে তুমি কি নিমিত্ত বিপুল রাজ্যভোগের প্রশংসা করিতেছ? … অতএব তুমি অগ্রে উদরকে পরাজিত কর, তাহা হইলেই তোমার সমুদয় পৃথিবী পরাজয় করা হইবে। … রাজ্যালাভ ও রাজ্যরক্ষা এই উভয়েই ধর্ম্ম ও অধর্ম্ম আছে; অতএব উহা পরিত্যাগ করিয়া মহদ্ভার হইতে বিমুক্ত হও। … যাহাদের বর্ণ ও আশ্রমাদির অভিমান থাকে, তাহারা পিতৃলোক, আর যাহারা অভিমানশূন্য, তাহারা দেবলোকে গমন করিয়া থাকে। (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)
কি সাংঘাতিক কথা। দেখা যাচ্ছে, বর্ণপ্রথার শ্রেয়ত্বের ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে রাজতন্ত্র, খোদ সেই ‘বর্ণ ও আশ্রমের অভিমান’ যুধিষ্ঠির আর বহন করতে প্রস্তুত নন। আর এই অভিমান না থাকলে যে ‘রাজত্ব’ই অর্জন করা যায় না, সেই গুরুতর সত্যের প্রতিও এভাবে তিনি ভাবীকালের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে বসে থাকেন। ‘রাজত্ব’ অর্জনের চেয়ে ‘দেবত্ব’ অর্জনের দিকেই তাঁর ঝোঁক। ফলত তাঁর শোক, আক্ষেপ, অনুতাপ ও পাপবোধ কিছুতেই প্রশমিত হয় না, বারংবার উথলে উঠতে থাকে। বেদব্যাসের কাছে তিনি অতঃপর এই ভয়াবহ সত্য উচ্চারণ করতে ছাড়েন না যে ‘রাজা’ এবং ‘ধর্ম’, ‘রাজত্ব’ ও ‘ধর্মবোধ’ আসলে পরস্পরের বিরোধী: ‘ধর্ম্মচর্য্যা ও রাজ্যরক্ষা এই উভয় পরস্পর বিরুদ্ধ, অতএব এক ব্যক্তি কিরূপে ধর্ম্মরক্ষা ও রাজ্যভার গ্রহণ করিতে পারে, নিরন্তর এই চিন্তা করিয়া আমি মোহে বারংবার অভিভূত হইতেছি।’
পরিশেষে, নকুল-সহদেব-দ্রৌপদী-ভীমের এবং ঋষি দেবস্থান ও মহর্ষি ব্যাসদেবের এবং সর্বোপরি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বহু বহু প্রকার, উপর্যুপরি, অনুরোধ-উপরোধ-যুক্তি-তর্ক-দৃষ্টান্ত ও উত্তেজনা-উক্তি এবং বিশেষত মহর্ষি বৈশম্পায়ন বেদব্যাস কর্তৃক প্রায়শ্চিত্ত পাওয়ার উপায় বর্ণনার পর যুধিষ্ঠির অবশ্য রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন; কিন্তু সংশয় ও শোক তাঁর পিছু ছাড়ে না কিছুতেই। তখন বহু কিছুর পর মহর্ষি বৈশম্পায়নের পরামর্শে সবাই মিলে তাঁকে নিয়ে যান ‘সর্বজ্ঞ ধর্ম্মবেত্তা’ ‘কুরুকুল-পিতামহ বৃদ্ধ ভীষ্মের নিকট’। যুধিষ্ঠিরের ‘ধর্ম্মগত সংশয় নিরাকরণ’ করার জন্য, সবিস্তারে রাজধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য। সেখানে ভীষ্ম কর্তৃক নানারকম রাজধর্ম-বন্দনা এবং রাজার কর্তব্য-অকর্তব্য প্রভৃতি শোনার পরও যুধিষ্ঠির সংশয়মুক্ত হন না; বরং তিনি এবার সেই মোক্ষম, একেবারে গোড়ার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন:
‘পিতামহ! ‘রাজা’ এই শব্দটি কিরূপে সমুত্পন্ন হইল? রাজার হস্ত, গ্রীবা, পৃষ্ঠ, মুখ, উদর, শুক্র, অস্থি, মজ্জা, মাংস, শোণিত, নিঃশ্বাস, উচ্ছ্বাস, প্রাণ, শরীর, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়, সুখ, দুঃখ, জন্ম ও মরণ যেরূপ, প্রজাগণেরও তদ্রূপ। তবে রাজা কিরূপে একাকী অসংখ্য বিশিষ্টবুদ্ধি মহাবলপরাক্রান্ত পুরুষের উপর আধিপত্য করিয়া সমুদয় পৃথিবী পালন করিতে সমর্থ হয়েন? সকল লোকে কি নিমিত্ত রাজার প্রসাদ-লাভের আকাঙ্ক্ষা করে … ?’ (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)
এ প্রশ্ন তো চিরন্তন স্বাধীনতাপরায়ণেরই বটে: ‘রাজা’র এবং ‘প্রজা’র মধ্যে কী এমন দৈহিক-প্রাকৃতিক পার্থক্য আছে যে, একজন মাত্র ব্যক্তি কোটি কোটি মানুষের ‘রাজা’ হয়ে বসে থাকেন? আর লোকে তাঁকে মানেইবা কী কারণে? গুরুতর এই প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্মদেব কিছুই লুকান না, ফাঁস করে দেন রাজতন্ত্রের গোড়ার গুমোর।
১.৩ আদি রাজা, আদি বুদ্ধিজীবী, আদিতম শাস্ত্র
এই পৃথিবীর আদিতে যে অরাজ ছিল, এবং সেই অরাজকে বলপ্রয়োগ ও শাস্ত্রপ্রয়োগের মাধ্যমে উচ্ছেদ করেই যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজতন্ত্রের, সেই আদি বৃত্তান্ত, সেই স্মৃতিকথা, বয়ান করেন মহাজ্ঞানী ভীষ্মদেব, একটু ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও, এমনকি ‘রাজা’দের দিক থেকে হলেও, যুধিষ্ঠিরের কাছে— কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ-পরবর্তী কলিযুগের আদিতম রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে।
ভীষ্মদেবের কথায় যা বোঝা গেল: আদি সেই অরাজকে ভেঙে ফেলে দেবতারা যে আদি দেবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন তা ছিল মনুষ্যশ্রমনির্ভর। মানুষের প্রদত্ত ‘হোমাদি’-স্বরূপ অন্নেই দেবতাদের গ্রাসাচ্ছাদ্দন হতো; এবং সেটাকেই দেবতারা বেদের নাম দিয়ে ‘ধর্ম’ বলে মেলা দিন চালিয়েছেন। কিন্তু মনুষ্যসমাজ এক পর্যায়ে যখন তা আর মানল না, তখন দেবকুলের মুখে এই মর্মে অন্নাভাবের হাহাকার শোনা গেল: নরলোকে আর বেদ নাই; নরলোকে আর ধর্ম নাই; সব বিনষ্ট হয়ে গেছে; “মানব-দিগের ক্রিয়াকলাপ উচ্ছিন্ন হওয়াতে আমাদিগের অন্নাভাব হইয়াছে”; শুধু তাই নয়, সেই অন্নাভাবের পরিণামে দেবতারা আর দেবত্বই বজায় রাখতে পারছেন না বলে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে আক্ষেপ করছেন: “অতঃপর আমরা মনুষ্যের ন্যায় অবস্থাপ্রাপ্ত হইলাম” (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)।
মাঝখানে একটু টুকে রাখি: ‘দেবত্ব’ বা বৈষম্য টিকিয়ে রাখার শর্তই হচ্ছে ‘প্রিভিলেজ’ বা বিশেষাধিকারতন্ত্র, অর্থাৎ অন্যের (মানুষের) শ্রমে বসে বসে খাওয়া। বসে খাওয়ার ‘বিশেষ অধিকার’ না থাকলে দেবতাও আর দেবতা থাকেন না, তাঁর অন্নাভাব ঘটে, তিনি মনুষ্যদশাপ্রাপ্ত হন।
তো, ব্রহ্মা যেন নরলোক থেকে বেদ ও ‘ধর্ম’ ধ্বংস হতে না দেন; একটা কিছু উপায় যেন তিনি ‘বুদ্ধি’ খাটিয়ে, ‘স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে’ বের করেন— দেবতাগণের এই সম্মিলিত নালিশ এবং আহাজারির মুখে ব্রহ্মা তাঁদের আশ্বস্ত করেন: নো টেনশন, মনুষ্যজাতিকে আবার বেদ ও ‘ধর্ম’ মানতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু কীভাবে? রাজা-প্রথার জোরে। রাজতন্ত্রের জোরে। কিন্তু রাজতন্ত্র চলবে কীসের জোরে? রাজতন্ত্র চলে কীসের জোরে? কেন?— শাস্ত্রের জোরে! স্বয়ং ব্রহ্মা সে উপায় বের করেন ‘বুদ্ধিবলে’। আদিতম ‘শাস্ত্র’ রচনা করে বসেন ‘প্রজাপতি’ ব্রহ্মা— এবং সৃষ্টি করেন তিনি ‘প্রকৃষ্টরূপে জাত’ বিশেষ ধরনের মানুষকে যারা অতঃপর ‘প্রজা’ হিসেবে পরিচিত হবে।
আদিতম ‘শাস্ত্র’ এবং আদিতম ‘বুদ্ধিজীবী’র সন্ধান তাহলে মহাভারতেই পাওয়া গেল! আদিতম সেই বুদ্ধিজীবীটি খোদ ব্রহ্মা। জানা গেল: তাঁর কাজ হচ্ছে শাসকদের অনুকূলে বৈষম্য ও বিশোধিকারতন্ত্র টিকিয়ে রাখা— প্রজাগণকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, এবং তাতে কাজ না হলে শাস্ত্রের জোর, শাস্তির জোর ও ভয়ের জোর খাটানোর ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়ে। এভাবে অবশেষে বুদ্ধির জোরে এবং গায়ের জোরে দুর্দান্ত ও দুর্দমনীয় মানুষকে শান্ত ও দমিত করার ব্যবস্থা হলো। তাঁদেরকে এই পৃথিবীতে রাজার রাজত্ব মানানো হলো, রাজবশীভূত করা হলো আদিতম শাস্ত্রের জোরে। এবং জানা গেল, এই ভূ-ভারতের আদিতম শাস্ত্রটি হলো ‘দণ্ডনীতি’শাস্ত্র। আরও জানা গেল, সেই শাস্ত্র চলে রাজা এবং রাজবুদ্ধিজীবীর যুগলবন্দিতে।
১.৪ আদিতম দণ্ডনীতির উৎপত্তি
এবার সেই চাঞ্চল্যকর ইতিহাসের সারবিবরণী হুবহু শোনা যাক কুরুকুলপিতামহ সর্বজ্ঞ বৃদ্ধ ভীষ্মের মুখে। বলছেন তিনি যুধিষ্ঠিরকে।
ভীষ্ম কহিলেন, ‘ধর্ম্মরাজ! সত্যযুগে প্রথমে যেরূপে রাজত্বের সৃষ্টি হয়, তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। সর্ব্বপ্রথমে পৃথিবীতে রাজ্য, রাজা, দণ্ড বা দণ্ডার্হ ব্যক্তি কিছুই ছিল না। মনুষ্যেরা একমাত্র ধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক পরস্পরকে রক্ষা করিত। মানবগণ এইরূপে কিছুদিন কালযাপন করিয়া পরিশেষে পরস্পরের রক্ষণাবেক্ষণ নিতান্ত কষ্টকর বোধ করিতে লাগিল। … নরলোক এইরূপে কুমার্গগামী হইলে বেদ বিনষ্ট ও ধর্ম্ম এককালে বিলুপ্ত হইয়া গেল।
তখন দেবগণ নিতান্ত শঙ্কিতচিত্তে লোকপিতামহ ভগবান ব্রহ্মার শরণাপন্ন হইয়া তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, ‘ভগবন্! … অতঃপর আমরা মনুষ্যের ন্যায় অবস্থাপ্রাপ্ত হইলাম। মানবগণ হোমাদি কার্য্যদ্বারা ঊর্দ্ধবর্ষী বলিয়া বিখ্যাত ছিল এবং আমরা বারিবর্ষণাদিদ্বারা অধোবর্ষী বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলাম; কিন্তু এক্ষণে মানবদিগের ক্রিয়াকলাপ উচ্ছিন্ন হওয়াতে আমাদিগের অন্নাভাব হইয়াছে। অতএব যাহাতে আপনার প্রভাবে সম্ভূত এই প্রাকৃতিক নিয়ম ধ্বংস না হয়, আপনি স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে তাহার সদুপায় উদ্ভাবন করুন।’
তখন ভগবান্ কমলযোনি … প্রজাপতি [ব্রহ্মা] … বুদ্ধিবলে একখানি লক্ষ অধ্যায়যুক্ত নীতিশাস্ত্র রচনা করিলেন। …
ভগবান্ পদ্মযোনি ঐ নীতিশাস্ত্র প্রণীত করিয়া ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণকে হৃষ্টমনে কহিলেন, ‘সুরগণ! আমি ত্রিবর্গ সংস্থাপন ও লোকের উপকার-সাধনের নিমিত্ত বাক্যের সারস্বরূপ এই নীতিশাস্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছি। ইহা পাঠ করিলে নিগ্রহ ও অনুগ্রহ দর্শনপূর্ব্বক লোকরক্ষা করিবার বুদ্ধি জন্মিবে। এই শাস্ত্রদ্বারা জগতের যাবতীয় লোক দণ্ডপ্রভাবে পুরুষার্থ-ফললাভে সমর্থ হইবে; অতএব ইহার নাম দণ্ডনীতি হইল। (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)
এতটা সুস্পষ্ট কথা আর কী হতে পারে! পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, ভূ-ভারতের আদিতম নীতিশাস্ত্রটি হলো ‘দণ্ডনীতি’ এবং যুধিষ্ঠিরকে পিতামহ ভীষ্মদেব বলেছিলেন, ‘দণ্ডপ্রভাবেই জনসমাজে নীতি ও ধর্ম্মের প্রচার হইয়াছে’। তার মানে, ‘দণ্ডনীতি’ই যে কর্তৃত্বতন্ত্রের আদিতম নীতিশাস্ত্র শুধু তা-ই নয়, এ জিনিস জনসমাজে প্রচলিত নীতিবোধের জনকও বটে। এবং এই তথাকথিত নীতিবোধের প্রধান দুই উপায় হচ্ছে ‘নিগ্রহ ও অনুগ্রহ’। এ-ই হলো সেই ‘নিমিত্ত’, যে নিমিত্তে ‘সকল লোকে … রাজার প্রসাদলাভের আকাঙ্ক্ষা করে’। নইলে যে মার খেতে হবে, নিগৃহীত হতে হবে! তারচেয়ে অনুগ্রহ-তাড়নাই বাস্তবোচিত।
দণ্ডনীতি কী বস্তু, সমাজ-সংসারে এর কাজ কী— তা যুধিষ্ঠিরকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলেছিলেন অর্জুন: ‘দণ্ড প্রজাদিগকে শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকে। সকলে নিদ্রায় অভিভূত হইলেও দণ্ড একাকী জাগরিত থাকে। পণ্ডিতেরা দণ্ডকে প্রধান ধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন।’ (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১) অর্থাৎ, অতঃপর, দণ্ডই ধর্ম।
এসব কথা আজকের সংসদীয় গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অত্যাধুনিক প্রবক্তাদের মুখে শোনাও যা, ‘সভ্যতা’র উষালগ্নের দণ্ড বা আইন প্রয়োগকারী সত্তা অর্জুনের মুখে শোনাও তা-ই। কেননা তথাকথিত “আইনের শাসন” তথা দণ্ডনীতি প্রতিষ্ঠার নামই ‘সভ্যতা’ এবং প্রচলিত সভ্যতার নামে এই জিনিসই চলছে গত পাঁচ হাজার বছরের ‘কর্তৃত্বতান্ত্রিক সভ্যতা’ জুড়ে। এই দণ্ডনির্ভর সভ্যতায় দণ্ডই ‘প্রধান ধর্ম’ বটে, তবে তা ‘মনুষ্যধর্ম’ নয় — ‘শাস্ত্রধর্ম’ তথা ‘রাজধর্ম’ — এবং সেই কারণেই বিপরীত দিক থেকে ‘প্রজাধর্ম’ও বটে। অন্য কথায়, এ বস্তুই আজকের ‘সভ্য’যুগের ‘রাষ্ট্রধর্ম, তথা রাষ্ট্রের ধর্ম। আইনের ধর্মই তো দণ্ড। শাসনের ধর্মই তো দণ্ড। এই আইনের শাসনকে কখনও সত্যিকারের মনুষ্যধর্মের নামে চালানো যায় না। একে চালাতে হয় শাস্ত্রধর্মের নামে। এবং পুনরাবৃত্তি করতেই হবে যে, আদিতম শাস্ত্রধর্মের নামই দণ্ডশাস্ত্র বা দণ্ডধর্ম বা কর্তৃত্বনীতি বা কর্তৃত্বধর্ম। এবং কর্তৃত্বতন্ত্র এই জিনিসটিকেই “মানুষের ধর্ম” এবং “প্রকৃতির ধর্ম” বলে চালাতে চায়। এবং এই পদার্থটির প্রাণভোমরার নাম ‘ভয়’। যুধিষ্ঠিরকে অর্জুন বলছেন, ভয়ের রাজত্বই হচ্ছে দণ্ডনীতির প্রাণ:
দণ্ডপ্রভাবে ধন ও ধান্য রক্ষিত হয়। … অনেকানেক পাপপরায়ণ পামরেরা রাজদণ্ডভয়ে, অনেকে যমদণ্ডভয়ে, অনেকে পরলোকভয়ে এবং অনেকে লোকভয়ে পাপানুষ্ঠান করিতে পারে না। অনেকে কেবল দণ্ডভয়েই পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে না। ফলতঃ সংসারে প্রায় সমুদয় কার্য্যই দণ্ডভয়ে নির্ব্বাহ হইতেছে। … ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও ভিক্ষুক ইহারা দণ্ডের ভয়ে স্ব স্ব পথে অবস্থান করিতেছেন। ভীত না হইলে কেহই যজ্ঞানুষ্ঠান, দান ও নিয়ম প্রতিপালন করিতে ইচ্ছা করে না। (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)
তৎকালীন প্রধান সেনাপতি অর্জুনের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। দণ্ডনীতি মানেই হচ্ছে দমননীতি এবং শাসন-ত্রাসনের নীতি: ‘দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে’। এবং কার জন্য কোন দণ্ড সমুচিত তার মোক্ষম বিধানও প্রস্তুত:
দণ্ড সংসার রক্ষা না করিলে সমুদয়ই গাঢ় অন্ধকারে নিমগ্ন হইত। দণ্ড দুর্দান্তদিগকে দমন ও দুর্ব্বিনীত ব্যক্তিদিগকে শাসন করিয়া থাকে। দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। ব্রাহ্মণের তিরস্কার, ক্ষত্রিয়ের বেতন প্রদান না করা, বৈশ্যের রাজসমীপে দ্রব্যজাত সমর্পণ এবং শূদ্রের সর্ব্বস্বাপহরণই সমুচিত দণ্ড। (কালীপ্রসন্ন সিংহ, ২০০১)
কি সুনির্দিষ্ট, কি তীব্রসূচিমুখ এই দণ্ডনীতি! সেই প্রাচীনকাল থেকেই। আর শাসনের প্রশ্নে সে কাউকেই ছাড়ে না। শাসনযন্ত্রের হাতে তথা শাসকের হাতে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ম্যানেজারদের হাতে ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত কারো কোনো নিস্তার নাই। পার্থক্য আছে বৈকি। ব্রাহ্মণের জন্য ‘তিরস্কার’ই যথেষ্ট; আর শূদ্রকে শায়েস্তা করার জন্য চাই তার ‘সর্বস্ব অপহরণ’ করা।
১.৫ উপসংহার
আজকের বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ইতিহাসগত বিচার স্রেফ দণ্ডনীতির মামলা নয়, বরং খোদ রাষ্ট্রের ধর্ম বদলানোর প্রশ্নও বটে। এই কথাটুকু মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এত কথা বলা।
হদিস
কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী (২০০৯)। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ: ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান । প্রথম খণ্ড। কলকাতা: ভাষাবিন্যাস।
কালীপ্রসন্ন সিংহ (২০০১)। মহাভারত । দ্বিতীয় খণ্ড নতুন মুদ্রণ, মার্চ ২০০১। কলকাতা: তুলি-কলম।
হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় (১৯৯৬)। বঙ্গীয় শব্দকোষ । চতুর্থ মুদ্রণ। দ্বিতীয় খণ্ড। কলকাতা: সাহিত্য অকাদেমি।
সম্পাদকীয় নোট: লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে, ২০১৩ সালে ১৪ই মার্চ। দৃষ্টিকোণ পাতায় ‘খর বায়ু বয় বেগে’ কলামে। পরে লেখকের অচেনা দাগ গ্রন্থে লেখাটি সংকলন করা হয়। বর্তমান সংস্করণটি সরণ-প্রতিসরণ https://salimrezanewton.info/ থেকে নেয়া হয়েছে।