অরাজ
প্রচ্ছদ » স্ল্যাভয় জিজেক ।। ভাইরাসের দুনিয়ায় পহেলা মে : নতুন শ্রমিক শ্রেণীর ছুটির দিন

স্ল্যাভয় জিজেক ।। ভাইরাসের দুনিয়ায় পহেলা মে : নতুন শ্রমিক শ্রেণীর ছুটির দিন

অনুবাদ: তাসবির কিঞ্জল

বৈশ্বিক মহামারি থেকে আমাদের নিবিড় দৃষ্টি একটুখানি সরিয়ে এই করোনা ভাইরাস ও এর বিধ্বংসী প্রভাব একটা সমাজ হিসেবে আমাদের সম্পর্কে কী উন্মোচিত করল তা বিবেচনা করে দেখার অনুমতি নিজেদেরকে প্রদান করবার সেই মূহুর্তটি মনে হয় এসে পড়েছে।

স্ল্যাভয় জিজেক

প্রথমেই যে জিনিসটি তীব্র ভাবে চোখে পড়ে তা হল, “আমরা সবাই একই নৌকায় আছি”- এই সস্তা কথাটির একদম বিপরীতে শ্রেণী বিভাজনগুলো বিষ্ফোরিত হয়েছে। আমাদের মোড়লতন্ত্রের একদম তলানিতে রয়েছেন শরণার্থীরা। তারা যুদ্ধ কবলিত অঞ্চলগুলোতে আটকা পড়েছেন । তাদের জীবন এমন ভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে যে, তাদের জন্য এই মহামারি প্রধান কোনও সমস্যা নয়। এই মানুষগুলোকে যখন মিডিয়া ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করছে, ঠিক তখন ভাইরাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ফ্রন্টলাইনে থাকা নার্সদের অতি আবেগপ্রবণ উদযাপনের তোড়ে আমরা ভেসে যাচ্ছি। অথচ নার্সেরা হলেন শোষিত হতে থাকা “সেবাপ্রদানকারী” শ্রেণীটির সবচাইতে দৃশ্যমান অংশ। এই শোষণ মোটেও মার্কসীয় চিত্রকল্পের পুরাতন শ্রমিক শ্রেণীর শোষণের মত নয়। এর বদলে ডেভিড হার্ভি যেমনটি বলে থাকেন, তারা গঠন করেছে এক “নতুন শ্রমিক শ্রেণী”।

তিনি বলেন: “সেই কর্মশক্তি যা ক্রমেই বাড়তে থাকা অসুস্থদের দেখাশোনা করবে অথবা দৈনন্দিন জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাবার মত নূন্যতম সেবা প্রদান করবে বলে আশা করা হয়েছিল তাকে উচ্চমাত্রার লৈঙ্গিক, বর্ণবাদী এবং জাতিবিদ্বেষ মূলক চরিত্র প্রদান করা হয়েছে। এটিই সেই “নতুন শ্রমিক শ্রেণী” যা সমকালীন পুঁজিবাদের পুরোভাগে রয়েছে। এই শ্রেণীর সদস্যদের দুইটি বোঝা বইতে হয়। প্রথমত, তারা হলেন সেই শ্রমিকের দল যারা পেশাগত কারণে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। দ্বিতীয়ত, ভাইরাস কর্তৃক আরোপিত অর্থনৈতিক সংকোচনের কারণে আর্থিক সংস্থান ছাড়াই লে-অফের শিকার হোন। যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন শ্রমিক শ্রেণীটিকে – যা প্রধানত আফ্রো-মার্কিন, লাতিন এবং বেতুনভুক্ত নারীদের নিয়ে গঠিত – এক নোংরা বাছাই প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়। একদিকে থাকে, মানুষের সেবা করতে গিয়ে এবং জরুরী পরিষেবাগুলো (যেমন, গ্রোসারি স্টোর) চালু রাখতে গিয়ে সংক্রমিত হবার দূর্ভোগকে বরণ করে নেওয়া। আর অপরদিকে বেকারত্ব; কোনও ধরণের সুযোগ-সুবিধা (যেমন, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা) ছাড়া”।

এই কারণেই ফ্রান্সে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল; প্যারিসের উত্তরে দরিদ্র শহরতলিগুলোতে যেখানে ধনীদের সেবকেরা থাকেন। এবং এই কারণেই, কয়েক সপ্তাহ আগে সিঙ্গাপুরে বিদেশী শ্রমিকদের ডরমেটরিগুলোতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। সিএনএন বলছে, “সিঙ্গাপুরে প্রায় ১৪ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিকের বাস। তাদের একটি বৃহৎ অংশ এসেছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। তারা গৃহপরিচালক, গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক এবং সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সিঙ্গাপুরকে সচল রাখতে এই অভিবাসীদের বিকল্প নেই। অথচ তারাই আবার এই শহরের সর্বনিম্ন মজুরীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তাহীন মানুষ। নতুন এই শ্রমিক শ্রেণীটি এখানে বরাবরই ছিল। মহামারি কেবল একে দৃষ্টিসীমার আওতায় নিয়ে এসেছে।

এই ক্ষেত্রটিকে যথার্থরূপে সংজ্ঞায়িত করার উদ্দেশ্যে ব্রুনো লাতুর এবং নিকোলায় সুলজ নতুন একটি পরিভাষা তৈরি করেছেন। তারা একে বলছেন “ভূ-সামাজিক শ্রেণী”। এই শ্রেণীর অনেকেই ধ্রুপদী মার্কসীয় পন্থায় উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকদের জন্য কাজ করতে গিয়ে শোষিত হোন না। বরং তারা শোষিত হোন তাদের জীবনের বস্তুগত শর্তাবলীর ভেতরেই। এর মধ্যে রয়েছে পরিস্কার পানি এবং বাতাস, তাদের স্বাস্থ্য, তাদের নিরাপত্তা। স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলো শোষিত হয় যখন তাদের জমিগুলোকে রপ্তানি বাজারের চাহিদা মাফিক বড় আকারের কৃষিকাজে অথবা বিস্তীর্ণ খনির খননকাজে ব্যবহার করা হয়। কোনও বিদেশি কোম্পানিতে কাজ না করেও শ্রেফ জীবনযাপনের প্রয়োজনে নিজেরই একখন্ড জমি পূর্ণাঙ্গরূপে ব্যবহার না করতে পেরে তারা শোষণের শিকার হচ্ছেন। সোমালিয়ার জলদস্যুদের কথাই ধরা যাক। তারা দস্যুপনা বেছে নিয়েছেন কারণ বিদেশী কোম্পানিগুলো বড় শিল্পের প্রয়োজনে মাছ শিকার করতে গিয়ে তাদের সমুদ্র উপকূলকে প্রায় ফাঁকা করে ফেলেছে। তাদের ভূখন্ডের একটা অংশ উন্নত দেশগুলোর অধিকারে চলে গেছে। ওদের জীবনকে শুকিয়ে মেরে আমাদের জীবনকে পরিপুষ্ট করবার কাজে তা ব্যবহার করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লাতুর প্রস্তাব করলেন, “উদ্বৃত্ত মূল্যের উপর অধিকার” ব্যাপারটিকে “উদ্বৃত্ত অস্তিত্বের উপর অধিকার” দিয়ে প্রতিস্থাপন করা উচিৎ। এখানে “অস্তিত্ব” মানে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত শর্তাবলি।

আর্টওয়ার্ক: কোভিড -১৯
শিল্পী: গিলি নিকোলাস
সূত্র: ইয়ুথ ভয়েস

মহামারি কালে আমরা আবিষ্কার করি যখন এমনকি কারখানাগুলোও থমকে যায় তখনও সেবা-প্রদানকারী এই ভূ-সামাজিক শ্রেণীটিকে কাজ করে যেতে হয়। তাই, ধ্রুপদী শিল্পশ্রমিক শ্রেণীর বদলে বরং তাদের উদ্দেশ্যেই এই পহেলা মে-কে উৎসর্গ করাটা যথার্থ হবে। তারাই সত্যিকার অর্থে মাত্রাতিরিক্ত শোষণের শিকার হচ্ছেন। যখন কাজ করছেন তখন শোষিত হচ্ছেন কারণ তাদের কাজটি মোটা দাগে অ-দৃশ্যমান এবং কাজ না করলেও তাদের বস্তুগত শর্তাবলির কারণে শোষিত হচ্ছেন। তারা যা করছেন তার মধ্যেই কেবল শোষিত হচ্ছেন না, তারা শোষিত হচ্ছেন খোদ তাদের অস্তিত্বের মধ্যেও।

গরীবের দূষিত চারপাশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন একটা ভূ-খন্ডে বাস করবার এক অনন্ত স্বপ্নে ধনী মানুষ বিভোর থাকে। সেই সমস্ত ব্লকবাস্টারগুলোর কথা চিন্তা করে দেখুন যেগুলোতে দেখানো হয় কেয়ামত-পরবর্তী কোনও দৃশ্য। নীল ব্লুমকাম্পের “Elysium” এমনই একটি সিনামা। ২১৫৪ সাল হল এর প্রেক্ষাপট। এখানে এলিটেরা বাস করেন মানব-নির্মিত এক প্রকান্ড মহাকাশ ঘাঁটিতে। আর বাকীদের বাস করতে হয় ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে। সেই পৃথিবীকে দেখলে আবার মনে পড়ে লাতিন আমেরিকার কোনও এক বিস্তীর্ণ ঘিঞ্জি বস্তির কথা। আজকের এই বাস্তব দুনিয়াতেও বৈশ্বিক দূর্যোগের আশঙ্কায় ইতিমধ্যে ধনীরা নিউজিল্যান্ডে বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয় করছেন অথবা ঠিকঠাক করে নিচ্ছেন কোনও পাথুরে পর্বতের গায়ে বানানো শীতল যুদ্ধের বাংকারগুলোকে। কিন্তু এই মহামারির সংকটটি হলো, কেউ কখনই নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারবে না। সন্তান মাতৃগর্ভে যেমন নাড়ির বাঁধনে বাঁধা থাকে, এটিও তেমনি। কী আপনার সামাজিক অবস্থান, কিচ্ছু আসে যায় না, দূষিত বাস্তবতার সাথে এক অনিবার্য বাঁধনে আপনি বাঁধা পড়ে গেছেন।

লেখার মিূল লিংক এখানে…

তাসবির কিঞ্জল