অনুবাদ: তাসবির কিঞ্জল
আমার মত পরিসংখ্যান অ-বিশেষজ্ঞের সামনেও করোনা ভাইরাস মহামারি একটা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন হাজির করেছে । প্রশ্নটি হল: তথ্য কোথায় থেমে যায় আর কোথায় শুরু হয় ভাবাদর্শ?
এখানে একটা প্যারাডক্স আছে: দুনিয়া যত কাছাকাছি আসবে স্থানীয় দূর্যোগ তত বেশী বৈশ্বিক আতঙ্ককে উষ্কে দেবে এবং ধীরে ধীরে মহাপ্রলয়ের রূপ নেবে। ২০১০ এর বসন্তে আইসল্যান্ডে ছোটখাট একটা অগ্ন্যুৎপাতে তৈরি হওয়া ধুলোমেঘ; পৃথিবীতে জীবনের জটিল মেকানিজমে ছোট্ট একটা গোলমাল গোটা ইউরোপের আকাশে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। এই ঘটনাটি আরও একবার বেশ ধারালোভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিল কীভাবে প্রকৃতিকে বদলে দেবার বিপুল কর্মযজ্ঞ সত্ত্বেও মানুষজাতি এই পৃথিবী নামক গ্রহে আরেকটি প্রজাতি হিসেবেই থেকে গেছে। একটা ছোটখাটো বিষ্ফোরণের এমন প্রলঙ্কারী আর্থসামাজিক ধকলের কারণ হল আমাদের প্রযুক্তিক বিকাশের ভঙ্গুরতা। এক শতাব্দী আগে হলে এই ধরণের অগ্ন্যুৎপাত নিঃশব্দেই ঘটে যেত। প্রযুক্তিক বিকাশ আমাদের প্রকৃতি থেকে স্বাধীনতা দিয়েছে ঠিকই এবং একই সাথে ভিন্ন আরেক মাত্রায় আমাদের আরও প্রবলভাবে করেছে প্রকৃতির খামখেয়ালের অধীন। এবং করোনা ভাইরাসের বিস্তারের বেলাতেও ঐ একই কথা: দেং জিয়াওপিঙের সংস্কারকর্মের পূর্বে এই ঘটনা ঘটলে আমরা সম্ভবত তা শুনতেই পেতাম না।
একটা ব্যাপার নিশ্চিত: কেবল আইসোলেশন করে, নিত্যনতুন দেওয়াল বানিয়ে আর কোয়ারেন্টাইন বাড়িয়ে দিয়ে কোনও কাজ হবে না। প্রয়োজন হল নিঃশর্ত সংহতি আর সু-সমন্বিত বৈশ্বিক সাড়া। একসময় যাকে বলা হত কমিউনিজম, তারই এক নবরূপ। আমরা যদি আমাদের উদ্যোগগুলোকে এই দিকে ধাবিত না করি তাহলে আজকের উহান শহরই হবে আমাদের ভবিষ্যত।
অনেক ডিস্টোপিয়াই ইতিমধ্যে এমন ভবিষ্যৎ ভেবে ফেলেছে— আমরা বাড়িতে থাকব, নিজেদের কম্পিউটারে কাজ করব, ভিডিও-কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগাযোগ করব, আমাদের গৃহ-দপ্তরের এক কোনায় একটা যন্ত্রে শরীরচর্চা করব, মাঝে মাঝে মাস্টারবেট করব একটা স্ক্রিনের সামনে হার্ডকোর সেক্স দেখতে দেখতে এবং ডেলিভারির মাধ্যমে খাবার আসবে; মানুষের সাথে আর স্বশরীরে দেখা করা হবে না।
আসলে এই দুঃস্বপ্নের মধ্যেও একধরণের মুক্তির সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আমাকে স্বীকার করতেই হবে গত কয়েকদিনে উহান শহরে ঘুরে বেড়াবার স্বপ্ন আমাকে পেয়ে বসেছে। একটা মহানগরীর ধু ধু পড়ে থাকা রাস্তাগুলো— সাধারণের ভিড়ে উপচে পড়া নগরকেন্দ্রগুলোকে দেখাচ্ছে ভুতুড়ে পাড়ার মতন। দরজা খোলা সব দোকান এবং কোনও ক্রেতা নেই। কেবল একজন নিঃসঙ্গ পথিক বা এখানে সেখানে একটা গাড়ি। অ-ভোগবাদী দুনিয়া দেখতে কেমন হবে তারই একঝলক দেখিয়ে দিচ্ছে। সাংহাই বা হংকংয়ের ফাঁকা চত্ত্বরগুলোর বিষাদময় সৌন্দর্য আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে On the Beach সিনেমার পুরোনো কোনও কেয়ামত-পরবর্তী দৃশ্যের কথা; যেখানে একটা নগর তার প্রায় সকল নাগরিক সমেত শ্রেফ মুছে গিয়েছে। বড় কোনও দৃশ্যমান ধ্বংসযজ্ঞ নয়; কেবল দুনিয়া হারিয়ে ফেলেছে তার ‘চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিবার’ চরিত্রটি। আমাদের অপেক্ষায় আছে, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এবং আমাদের খুঁজছে। এমনকি সাদা মাস্ক পড়ে যে-কজন এদিক সেদিক হাঁটছেন তারা দেখাচ্ছেন একধরণের সম্ভাষিত নামহীনতার ছবি; যেন তারা মুক্তি পেয়েছেন ‘পরিচয়’-এর সামাজিক চাপ থেকে।
আমাদের অনেকেই মনে করতে পারবেন ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত সিচুয়েশনিস্ট ধারার শিক্ষার্থীদের ইস্তেহারের সেই বিখ্যাত উপসংহার: ‘Vivre sans temps mort, jouir sans entraves’ (মৃত-সময়কে ছেড়ে বাঁচো, অবাধে উপভোগ করো)। ফ্রয়েড এবং লাকাঁ যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকেন তা হল, বিবেকের হুকুম আসলে বিপর্যয়ের একটা রেসিপি (লাকাঁ যথাযথভাবে দেখিয়েছেন, বিবেক তার বুনিয়াদি স্তরে উপভোগের একটি ইতিবাচক হুকুম; কোনও কিছুতে বাঁধা দেবার নেতিবাচক কর্ম নয়)। আমাদের প্রাপ্ত সময়ের সবটুকুকে নিবিড় ব্যস্ততা দিয়ে ভরিয়ে তোলার তীব্র বাসনা অনিবার্যভাবে দমবন্ধ করা একঘেঁয়েমিতে পরিণত হয়। মৃত-সময়, প্রত্যাহারের মুহুর্ত, প্রাচীন সাধুরা যাকে বলতেন ‘ওম শান্তি’ [Gelassenheit], ছেড়ে দেওয়া— এসবই আমাদের জীবন অভিজ্ঞতাকে চনমনে করে তুলবার জন্য খুবই জরুরি। এবং সম্ভবত কেউ আশা করতেই পারেন বিশ্বজুড়ে শহরগুলোতে করোনা ভাইরাস কোয়ারেন্টাইনের অনিচ্ছাকৃত ফলাফল হিসেবে কিছু মানুষ যান্ত্রিক ব্যস্ততার বাহিরে এসে সময়কে অন্তত নিজের মত ব্যবহার করবার এবং নিজেদের (নন)সেন্স অবস্থাটা ভেবে দেখবার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন।
এইসকল ভাবনাকে গণপরিসরে আনার মধ্য দিয়ে আমি যে বিপদ টেনে আনলাম সে ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অবগত আছি। আমি কি আমার নিরাপদ বাহ্যিক অবস্থান থেকে ভুক্তভোগীদের উপরেই কিছু গভীর বিশুদ্ধ উপলব্ধি আরোপ করছি না এবং এভাবে তাচ্ছিল্যভরে তাদের দূর্ভোগকে ন্যায্যতা দিচ্ছি না? যখন উহানের একজন মাস্ক পরিহিত নাগরিক ঔষধ বা খাবারের খোঁজে হেঁটে বেড়ান তখন তার মনে অবশ্যই ভোগবাদবিরোধী চিন্তা থাকে না। থাকে আতঙ্ক, ক্ষোভ এবং ভয়। আমি কেবল বলতে চাচ্ছিলাম সাঙ্ঘাতিক কোনও ঘটনারও থাকতে পারে অনিশ্চিত ইতিবাচক পরিণাম।
কার্লো গিন্সবার্গ একটা ধারণা হাজির করেছিলেন, ‘ভালবাসা নয় বরং নিজ দেশ সম্পর্কে লজ্জিত হওয়াই সম্ভবত দেশকে ধারণ করবার বিশুদ্ধতম চিহ্ন’। সম্ভবত আইসোলেশন আর বাধ্যতামূলক নীরবতার এই কালে কিছু ইজরায়েলি লজ্জিত হবার মত সাহস সঞ্চয় করতে পারবেন। সেই রাজনীতির জন্য যা তাদের পক্ষ থেকে নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প করছে। ইহুদি হবার কারণে অবশ্যই লজ্জা নয় বরং একদম উল্টোটা। লজ্জা পাওয়া দরকার ইজরায়েলি রাজনীতি পশ্চিম তীরে খোদ ইহুদি ধর্মবাদের সবচাইতে মূল্যবান সিলসিলার সাথে যা করছে তার জন্য। সম্ভবত কিছু বিলেতী মানুষ লজ্জিত হবার মত সাহস সঞ্চয় করবেন সেই ভাবাদর্শিক স্বপ্নে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন বলে যা তাদের এনে দিয়েছে ব্রেক্সিট।
কিন্তু উহানে এবং বিশ্ব জুড়ে যারা আইসোলেশনে আছেন তাদের জন্য লজ্জিত বা কলঙ্কিত হবার সময় এটা নয়। বরং এখন সময় সাহস সঞ্চয় করবার এবং ধৈর্য ধরে নিজ নিজ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার। সত্যিকারের লজ্জা বরং পাচ্ছে চীনের সেই সকল মানুষ যারা জনসম্মুখে এই মহামারিকে পাত্তা দেয় নাই কিন্তু নিজেদেরকে ঠিকই নিরাপত্তার চাদরে মুড়েছে। চেরনোবিলের সেইসব সোভিয়েত কর্তাদের মত যারা জনসম্মুখে বিপদহীনতার দাবী করে যতদ্রুত সম্ভব নিজেদের পরিবারগুলোকে পাঠিয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়ে। অথবা সেইসব বড় ম্যানেজারেরা যারা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে জনসম্মুখে নাকচ করে দিয়ে ইতিমধ্যেই নিউজিল্যান্ডে বাড়ি কিনে ফেলেছেন বা কোনও পাথুরে পর্বতের গায়ে বানিয়ে নিচ্ছেন বাংকার। সম্ভবত এমন দ্বৈত নীতির (পড়ুন, ভিআইপি-গিরির) বিরুদ্ধে গণ-বিক্ষোভ এই সঙ্কটের অপ্রত্যাশিত ইতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াটির জন্ম দিয়ে দেবে।
[প্রবন্ধটি “The Virus of Ideology” শিরোনামে স্ল্যাভয় জিজেক-এর সাম্প্রতিক বই “প্যানডেমিক”-এর একটি অধ্যায় হিসেবে প্রকাশিত]