- নুরে আলম দুর্জয়
আমরা সবাই কমবেশি বুঝি যে, আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা কোন না কোন ভ্রান্তিতে আটকে পড়েছে। কিন্তু সেটা কি? আমরা আমাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাই বাস্তব জগতের জন্য তৈরি হতে। কিন্তু এই বাস্তব জগতটার দ্রুত পরিবর্তন হলেও দশকের পর দশক ধরে আমাদের স্কুলগুলোর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আদি শিল্পযুগে কারখানার উৎপাদনের মতো করেই তৈয়িার করা হয়েছিল বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে দুনিয়াজুড়ে অগ্রচিন্তার মানুষজন একমত। আর আদি শিল্পযুগের গণ-উৎপাদন এবং গণ-নিয়ন্ত্রণের সেই মানসিকতা এখনো স্কুলগুলোতে প্রবাহমান।
আদি শিল্পযুগের মূল্যবোধ
আমরা শিশুদের শিক্ষা দেই থোকায় থোকায় বা ব্যাচে ব্যাচে এবং তাদের জীবনকে শাসন করি ঘণ্টা বাজিয়ে। সারাদিন ধরে শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা অনুসরণ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বসো। বইটা সামনে নাও। ৪০ নম্বর পৃষ্ঠা খোলো। তিন নম্বর সমস্যা সমাধান করো। কথা বলা বন্ধ করো। স্কুলে আপনাকে যা করতে বলা হয়েছে ঠিক তাই তাই করার জন্য আপনাকে পুরস্কৃত করা হয়। এসবই হল শিল্পযুগের মূল্যবোধ যা সত্যিকার অর্থে শ্রমিকদের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সফলতা নির্ভর করে, নির্দেশনা পালন করার উপর এবং ঠিক সেগুলোই করতে থাকা যা তাদের করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় আপনি কতদূর যেতে পারবেন শুধু কতকগুলো নির্দেশনা পালন করার মাধ্যমে? আধুনিক বিশ্বের মূল্যবোধ হল, মানুষ সৃজনশীল হতে পারে, নানা আইডিয়া নিয়ে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, পারস্পারিক সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু শিল্পযুগের এই মূল্যবোধের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি সিস্টেমে আমাদের শিশুরা এই অফুরন্তু সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পায় না।
স্বাধীনতার অভাব এবং নিয়ন্ত্রণ
স্কুলে আমাদের শিশুরা স্বাধীনতাহীন এবং সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ করে। একটি শিশুর জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত কঠোরভাবে সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় আপনি যেই গুরুত্বপূর্ণ কাজই করেন না কেন, আপনিই আপনার একান্ত সময়ের দেখভাল করে থাকেন। কি করবেন এবং কখন এটা করবেন সেসব বিষয়ে আপনি আপনার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিচ্ছেন। কিন্তু স্কুলে জীবনকে এর চেয়ে খুবই আলাদা দেখা যায়। এই সিস্টেম আমাদের শিশুকে একটি ভয়ঙ্কর বার্তা দিচ্ছে যে তাদের একান্ত জীবনের দায়িত্ব তাদের নিজেদের হাতে নেই। বরং নিজের দায়িত্ব নেয়ার থেকে এবং নিজের জীবনের পূর্ণতা অর্জন করার চেয়ে যা কিছুই করা হোক না কেন তাদের শুধু অণুকরণ করে যেতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে শিশুদের জন্য স্বাধীনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এটা কোন অবাক করা বিষয় নয় যে স্কুল দ্বারা আমাদের শিশুরা বিষণ্ন এবং নিরাশ হয়ে পড়ে। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ঠিক কী কী করবেন সেসব যদি আপনাকে বলে দেয়া হয় ! আপনি বি ভাবতে পারেন আপনার তখন কেমন লাগত?
মুখস্থ শিক্ষণ
স্কুলের শিক্ষণের বেশিরভাগটাই আত্মস্থ হয় না। কেননা মুখস্থ করা আর তা আওড়াতে থাকাই এর বৈশিষ্ট্য। এই সিস্টেম জ্ঞানের একটি জেনেরিক সেট সংজ্ঞায়িত করে, যা সব শিশুর জন্য আবার প্রযোজ্য। এরপর প্রতি কয়েক মাসের ব্যবধানে পরীক্ষার দ্বারা আমরা পরিমাপ করি যে, সে বিদ্যার কতটুকু অর্জিত হয়েছে। এমন শিক্ষা ভেতরে আলো জ্বালাতে পারে না। কেননা এর অধিকাংশটুকুই পরীক্ষার পরপরই শেষ হয়ে যায়। শিক্ষা মুখস্থকরণ এবং সংরক্ষণের চেয়ে বেশি কিছু হতে পারে। পরীক্ষা-নম্বর এবং তার মাপামাপি রীতিমত অসুখে পরিণত হয়েছে। এটা শিক্ষার্থী, মাতাপিতা এবং শিক্ষকের জন্য একটা চরম অস্বাস্থ্যকর সংস্কৃতি তৈরি করেছে। শিশুরা সীমাহীন টিউশন-ঘণ্টার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে আর সারারাত জেগে জেগে অথর্ব জিনিস মুখস্থ করছে যা তারা শিগগির ভুলে যাবে।
আবেগ এবং চাহিদার কোন স্থান নেই
আমাদের চরম স্টান্ডার্ড এক সিস্টেম রয়েছে, যেখানে প্রত্যেক শিশুকে একই জিনিস শেখা বাধ্যতামূলক। এটা মানুষ হওয়ার মূল সত্যর পরিপন্থী। কেননা আমাদের প্রত্যেকেই নিজস্ব উপায় আছে। এক জন আরেকজন থেকে ভ্ন্নি এবং এক একজন নিজেই নিজের স্টান্ডার্ড। আমাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন আবেগ এবং চাহিদা রয়েছে। জীবনের পূর্ণতা অর্জনের প্রধান বিষয় হল নিজের আবেগকে খুঁজে পাওয়া। কিন্তু আজকের স্কুলগুলো কি আমাদের শিশুদের তাদের আবেগ খুঁজে পেতে এবং বিকশিত হতে সাহায্য করছে? বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি শিশুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর কোন জায়গা নেই। কীসে আমি ভালো? জীবনে আমি কি করতে চাই? এই বিশ্বে নিজেকে কীভাবে খাপ খাইয়ে নিব?
সিস্টেম এসবের তোয়াক্কা করে না। অনেক প্রতিভাধর মানুষ আছেন যারা প্রচলিত স্কুল ব্যবস্থায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। হয়তো সৌভাগ্যক্রমে তারা এসব ব্যর্থতা জয় করতে সমর্থ্য হন। কিন্তু সবাই তা পারে না। আসলে প্রচলিত সিস্টেমে কতটা প্রতিভা কতটা সম্ভাবনা তা মাপার কোন উপায় আমাদের নেই।
আমরা শেখার ভিন্নতা
আমরা কীভাবে শিখি, কিছু শিখতে আমরা কতটা সময় নেই এবং কি ধরনের উপকরণ আমাদের কাজের জন্য সবচেয়ে ভালো তার উপর নির্ভর করেও প্রত্যেকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সিস্টেমে এই ভিন্নতার কোন জায়গা নেই।
সুতরাং আপনি যদি কোনকিছু শিখতে একটু ধীর হয়ে থাকেন তবে আপনি বিবেচিত হবেন ব্যর্থ হিসেবে। অথচ আপনার প্রয়োজন ছিল শুধু একটু বেশি সময়!
একঘেঁয়ে লেকচার
বর্তমান সিস্টেমে দিনপ্রতি শিশুদেরকে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লেকচার দেয়া হয়। আর এই পাঠদানে কয়েকটি বড় ধরনের সমস্যা আছে। খান একাডেমি লেকচারিংকে ‘একটি মৌলিকভাবে অ-মানবিকরণের অভিজ্ঞতা’ বলেছে। ‘ত্রিশজন শিক্ষার্থী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বসে আছে, অথচ একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া অনুমোদিত নয়।’ যে কোন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বোঝাপড়ার স্তরেও আছে ভিন্নতা। এখন শিক্ষক যা কিছুই করুন বা বলুন না কেন তা শিক্ষার্থীরা শুনতে বাধ্য এবং এই কারণেই সর্বজনীন লেকচার হয়ে ওঠে একঘৈয়েঁ।
ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল মিডিয়ার কারণে বিশ্বের সব ধরনের তথ্য আমাদের শিশুদের হাতে রয়েছে। প্রযুক্তি যে কারো জন্য যে কোন কিছু শিখতে সম্ভব করে তুলেছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে সিস্টেম এই অবিশ্বাস্য সম্পদের ব্যবহার করছে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, যা সেই আদি শিল্পযুগের মূল্যবোধ ধারণ করে আছে, তা অচল এবং অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
আমরা যদি আমাদের শিশুদের আধুনিক বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে চাই, আমরা যদি শিক্ষাকে কার্যকর এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে চাই তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।
সম্পাদকীয় নোট: লেখাটি সিক্স ট্রুথ এবাউট স্কুল ডকুমেন্টারি অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে।