- জাহিদুল ইসলাম
প্রখ্যাত তাত্ত্বিক তালাল আসাদের মতে সেক্যুলারিজম শব্দটি উনিশ শতকের মধ্যভাগে পশ্চিমা মুক্তচিন্তরকরা ব্যবহার করেন। এ শব্দটি ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিলো তাদের যেন নাস্তিক হিসেবে উপস্থাপন করা না হয় এবং সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সমাজের সাথে একধরনের স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় থাকে। এ কৌশলটি তাঁরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার খাতিরে নয় বরং তাদের সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক করার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করেন।১ সেক্যুলার সমাজ বিভিন্ন সময় তার নিজস্ব ধর্ম থেকে বিভিন্ন উপাদান নিয়েছে। লকের প্রাকৃতিক আইনের ধারণাও ধর্মতত্ত্ব থেকে এসেছে। লক মনে করতেন জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি এই তিনটি প্রাকৃতিক অধিকার নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে আসে। যে অধিকার আদম পেয়েছিলেন ঈশ্বরের কাছ থেকে। আমেরিকার সংবিধানে লকের এ ধারণাটি গ্রহণ করা হয়। দার্শনিক জার্গেন হেবারমাসের মতে ‘মানবাধিকার’ ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ ‘গণতন্ত্রের’ মতো বিষয়গুলো সরাসরি ইহুদি ও খ্রিস্টান মূল্যবোধ থেকে নেওয়া হয়েছে।২ এক্ষেত্রে ধর্মের সাথে সেক্যুলারিজমের একদম বিপরীতধর্মী (বাইনারি অপজিশন) সম্পর্ক নেই। সেক্যুলারিজম যৌক্তিক, ধর্ম অযৌক্তক, সেক্যুলারিজম উদার, ধর্ম অনুদার এভাবে দুটি বাইনারিতে ভাগ করাই হচ্ছে বিপজ্জনক কাজ। যে কাজটি পশ্চিমা আলোকায়নের সময় হেগেল বা কান্টের মতো দার্শনিকরা করে গিয়েছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্পর্ক নির্মাণের ক্ষেত্রে। এবং এ নির্মাণের মাধ্যমে প্রাচ্যের উপর তাদের আধিপত্য যৌক্তিক করে তোলেন। পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ড ধর্মকে যেভাবে নির্মাণ করে তা হচ্ছে ধর্ম একটি প্রাচীন ধারণা। ধর্মের তুলনায় সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি অত্যন্ত প্রগতিশীল। ধর্মের সাথে সেক্যুলার সমাজের বাইনারি সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা আধিপত্যের বিস্তার ঘটে।
আধুনিক সার্বভৌমত্বের ধারণা খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব চর্চার মধ্য থেকে এসেছে। কার্ল স্মিট রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে দুই ধরনের রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের কথা বলেছেন: প্রাচীন ও আধুনিক ধর্মতত্ত্ব। প্রাচীন রাষ্ট্রতত্ত্বে ঈশ্বরের হাতে যে সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল, আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ধারণায় সেটি রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে। তিনি আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বকে ‘সেক্যুলারাইজড থিওলজিকাল কনসেপ্ট’ অভিহিত করেন।৩ পূর্বে যেখানে ঈশ্বর ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বর্তমানে রাষ্ট্র সে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এ সার্বভৌম ক্ষমতার বলে রাষ্ট্র তার নিজের জনগণের উপর ক্ষমতার চর্চার করে,আবার অন্য রাষ্ট্রর সার্বভৌমত্বও বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
সেক্যুলার সমাজ ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময় ভৌগলিকভাবে অপরের নির্মাণ করেছে। মধ্যযুগে আরব স্পেনকে ইউরোপের বাহিরে হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু আধুনিক স্পেনকে ইউরোপের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেহেতু এটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত সেক্যুলার রাষ্ট্র।৪ আধুনিক যুগে বসনিয়া এবং চেচনিয়া নামক দুটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা পশ্চিমা মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত। তারা আবার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গণহত্যার শিকার হয়েছেন। আজফার হোসেন তাঁর দর্শনাখ্যান বইতে গ্রিসকে প্রাচ্যের অংশ হিসেবে দাবি করেন। এটি পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের অংশ হিসেবেই তাদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সেক্যুলার সমাজ মিথকে বাতিল করতে চেয়েছিলো। বিপরীতে মিথকে ব্যবহার করে দীর্ঘ সময় ধরে যে জ্ঞান, বিশ্বাস ও চেতনার জন্ম দিয়েছে তালাল আসাদের মতে তাই হচ্ছে সেক্যুলার। সেক্যুলার যুগে মিথকে আধুনিক ফিকশনে টি এস ইলিয়ট, জেমস জয়েস, কোলরিজের মতো সাহিত্যিকরা ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে পার্সি বিশি শেলি একজন নাস্তিক হয়েও গ্রীক মিথের উপর ভিত্তি করে নাটক লিখেছেন। আধুনিক যুগে সেক্যুলার মানসিকতার সাথে মিথ মিশে আছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিক এডর্নো এবং হরখেইমার আধুনিকতার প্রকল্প হিসেবে এনলাইটেনমেন্টকে মিথ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ইউরোপীয় সমাজে সেক্যুলারিজম ধারণা বিকাশের পাশাপাশি এন্টি-সেমেটিজমের উপাদানসমূহকে লালন করে। যার ফলে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইহুদিদের উপর ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হয়। ঐতিহাসিকভাবেই ইহুদিরা ইউরোপে বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল। এনলাইটেনমেন্টের বিকাশও তাদের সেই অবস্থান থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি। বরং এনলাইটেনমেন্ট নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কিছু কল্পিত ধারণার নির্মাণ করে। এই নির্মাণই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা ঘটায়। এনলাইটেনমেন্ট তার যে যৌক্তিক বা সার্বভৌম চিন্তা চর্চা করত সেই যৌক্তিক চিন্তাই ইউরোপের কর্তৃত্ববাদী শাসন ও এন্টি-সেমেটিজমের জন্ম দেয়। এনলাইটেনমেন্ট তার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকে চাপা দেওয়ার জন্যেই গণহত্যায় মেতে উঠে। হিটলারের জার্মানি ইহুদিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনে তার মধ্যে ছিলো,ইহুদিরা সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্ররোচক। যারা একটি সমসত্ত্ব সমাজ ব্যবস্থায় চায়। এছাড়া হিটলার তাঁর বর্ণের ভিত্তিতে ইউরোপে আর্যদের অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান করতেন। ইহুদিদের তিনি ইউরোপীয়দের জন্য অস্তিত্বের হুমকিস্বরূপ মনে করতেন। এটি আত্নরক্ষার ধারণাকে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত করে।
এডর্নো ও হরখেইমারের মতে ইউরোপীয় বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় এন্টি-সেমেটিজমির অর্থনৈতিক কারণ ছিল উৎপাদন ব্যবস্থার উপর তাদের আধিপত্যকে ধামাচাপা দেওয়া।৫ ধামাচাপা দেওয়ার স্বার্থেই তারা ইহুদিদেরকে নিজেদের প্রধান শক্র হিসেবে উপস্থাপন করে। ইহুদিদের ভাবা হতো পুঁজিবাদের বিকাশ অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রগতির অন্তরায় হিসেবে।
সেক্যুলার রাষ্ট্রে সহিষ্ণুতার তত্ত্বটির ভিত গড়ে উঠেছে পরস্পর বিরোধী অবস্থানের মধ্য দিয়ে। উদারবাদী এলিটরা ধর্মীয় আবেগ অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সংখ্যালগিষ্ঠদের উপর আধিপত্যের বৈধতা দেয়। সেক্যুলারিজমের প্যারাডক্স হচ্ছে এটি ব্যক্তির ধর্মীয় আচরণকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসে, আবার রাষ্ট্র নিজেই সেই ব্যক্তিগত আচরণকে হস্তক্ষেপ করে। সুইজারল্যান্ডের কাছে হিজাব হচ্ছে বহিরাগত সংস্কৃতি ও লিঙ্গ বৈষম্যের প্রতীক।৬ এ প্রতীকগুলোকে দমিয়ে রাখার জন্য ফ্রান্সে আইন করে পাবলিক স্কুলগুলোতে হিজাব বা অন্যান্য ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধ করা হয়। সেক্যুলার সমাজে সংখ্যালঘুদের অবস্থান অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ হিসেবে বিবেচনা করা থেকেই তাদের উপর নির্যাতন বা প্রান্তিকীকরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটি কখনোই বহুত্ববাদী সমাজ তৈরিতে সহায়ক নয়। পশ্চিমা সেক্যুলার সমাজের নিকট একসময় ইহুদিদের হুমকিস্বরূপ মনে করা হতো, যার ফলে এন্টি সেমেটিজমের বিকাশ ঘটে। এখন ইহুদিদের ইউরোপীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে ইসলাম ও মুসলমানদের তাদের সাংস্কৃতিক হুমকিস্বরূপ মনে করা হয়।
ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মধ্যে মৌলবাদের বীজ নিহিত এ মতটিই বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত। পশ্চিমা বিশ্ব স্বাধীনতা ব্যবসার নামে এ মতটি ভালোভাবেই প্রচার করেছে। তালাল আসাদের মতে খ্রিস্টান ঐতিহ্য থেকে যেমন গণতন্ত্র, উদারতাবাদ ইত্যাদি ধারণা বিকাশ ঘটেছে ইসলাম বা অ-ইউরোপীয় অন্যান্য ধর্মতত্ত্বেও এসব উপাদান রয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ বা নব্য-সাম্রাজ্যবাদের মতাদর্শিক আধিপত্যের কারণে তার বিস্তার ঘটেনি।৭
কোন রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী যখন মানসিক, সাংস্কৃতিক বা আর্থ-রাজনৈতিকভাবে পরাধীন তখন সেসব লোকদের আত্মগ্লানি কাজ করে। তারা তখন তাদের অতীতে ফিরে যেতে যায়। অতীতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা থেকে ধর্মীয় উগ্রবাদের সৃষ্টি হয়। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী,ইজরাইলি জায়নবাদী,বিন লাদেন বা ওমর আল-বাগদাদীর উদ্দেশ্য ও একইরকম ছিল। লাদেনের উগ্রতার বিকাশ ঘটে সৌদি আরবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিকায়নের প্রেক্ষিতে। বাগগাদী প্রেরণা ছিলো নিজেকে মাসিহা হিসেবে নিজ সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থাপন করা এবং দুনিয়ার অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া। এজন্য তিনি সিরিয়া এবং ইরাকের কিছু অংশ দখল করে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলেন। একইসাথে ধর্মকে ব্যবহার করে সহিংসতার জন্ম দেন। তারা যে সত্তাকে নির্মাণ করে সেটি আত্মকেন্দ্রিক। এর বাইরে যারা আছে সবাইকে নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। অধীনতার গ্লানি ও সার্বভৌম ক্ষমতা দখলের পাশাপাশি তার নির্মিত ‘অপরের’বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সহিংসতা ঘটায়। অন্যদিকে সেক্যুলার রাষ্ট্রে ধর্মীয় সহিংসতার রুখতে ধর্মকেই ব্যবহার করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজেকে মনে করতেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ঈশ্বরের নির্দেশেই তিনি আফগানিস্তান এবং ইরাকে হামলা চালান।৮
অলিভার রয় সেক্যুলারিজম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পশ্চিমা সেক্যুলারিজম নিয়ে ভীষণভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। উদারপন্থী সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মকে রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষত ফ্রান্সে অভিবাসী মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রান্তিকীকরণ করা হচ্ছে। অলিভার রয়ের মতে যখন কোন সম্প্রদায়কে তাঁর ধর্ম এবং সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং তার মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে তখনই উগ্রবাদের জন্ম দেয়।৯ সেক্যুলার সমাজের সম্যাটি হচ্ছে এটি নিরপেক্ষতার কথা বলে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করে। একটি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে নিরপেক্ষতার মাত্রায় ফেলে এমনভাবে নির্মাণ করে যেন অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা এটিকে সচেতন বা অবচেতনভাবে গ্রহণ করে। এর ফলে ধর্মীয় চর্চার সমতা বা স্বাধীনতা সার্বজনীনভাবে কাজ করতে পারেনা।২
পাশ্চাত্য সমাজে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তারা তাদের ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে খ্রিস্টধর্মের প্রচার চালায়। ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনামলে খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা দখলের পর উইলিয়াম কেরি এবং টমাস নামে দুজন ব্যক্তি ধর্মপ্রচারের জন্য কলকাতায় আসেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বিরোধের ফলে তারা ১৮০০ সালে কলকাতা থেকে অদূরে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ জনগণকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা। ভারতবর্ষে বা আফ্রিকার উপনিবেশিত দেশগুলোর প্রতিটি অঞ্চলের ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করা হয়। ভারতবর্ষে শ্রীরামপুর মিশন থেকে উইলিয়াম কেরি,জন মার্শম্যান এদের নেতৃত্বে বাইবেল বাংলাসহ বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ১৮০৯ সালে শ্রীরামপুর মিশনের নেতৃত্বে সমগ্র বাইবেল ‘ধর্মপুস্তক’ নামে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়।
১৯৩০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের ব্যাপক জনসংখ্যার দুই শতাংশ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এসব ধর্মপ্রচারকরা ভারতীয় সমাজে ‘পশ্চিমায়ন’ ও ‘আধুনিকায়নে’ ভূমিকা রাখেন। প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা ভারতবর্ষের হিন্দুদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন। হেগেল মনে করতেন হিন্দুদের কোন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই,এবং তাঁদের ইতিহাস রচনার সামর্থ্য নেই। এক্ষেত্রে তাদের নিয়তি হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসনকে মেনে নেওয়া।১০
উপনিবেশিত কলকাতায় উনিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রাহ্মধর্মের প্রসার ঘটে। এ ধর্ম ছিল ভারতীয় ধর্মের সাথে খ্রিস্টান ধর্মের একপ্রকার সেতুবন্ধন।
তখনকার সময়ে বাঙালি রেনেসাঁসের বিকাশ যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তা হচ্ছে সতীদাহ প্রথা নিবারণ এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন। রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন এসব সংস্কারের জন্য তর্ক বির্তকে লিপ্ত হন, তখন তাঁরা হিন্দু ঐতিহ্যের ভিতর থেকেই এ কাজটি করেন। এ সংস্কারের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তারা ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকেই যুক্তি প্রদর্শন করেন। সতীদাহ নিয়ে কাজ করা লতা মনি তাঁর Contentious traditions বইতে দেখান যে সতীদাহ প্রথাটি যে হিন্দুদের ধর্মীয় প্রথা এটি ব্রিটিশ শাসনামলেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত এ প্রথাটির সাথে ব্রাহ্মণ সমাজের স্বার্থ জড়িত ছিল।
স্বপন বসু তাঁর ‘বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস’ বইতে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। কোন স্বামী মারা গেলে তার সাথে তার স্ত্রীকে যখন দাহ করা হতো তখন ধনীদের পরিবার থেকে দুইশত টাকা পর্যন্ত বখশিশ পাওয়া যেত। এই অর্থের লোভে ব্রাহ্মণরা মেয়েদেরকে সতী হতে উৎসাহ দিত। আর সতীদাহপ্রথা ভারতবর্ষের অন্যান্য এলাকার তুলনায় কলকাতায় বেশি প্রচলিত ছিলো। ব্রিটিশ শাসকরা যেহেতু ভারতবর্ষ সম্পর্কে পূর্বানুমান ছিলো যে তারা ধর্মান্ধ, তাই তারা এটিকে প্রথম দিকে ধর্মীয় প্রথা হিসেবে মেনে নেয়। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসকদের নারীমুক্তির চেয়ে স্থানীয় হিন্দুদের বিরাগভাজন হওয়া নিয়ে উদ্বেগ ছিলো। এর সাথে তাদের ভারতবর্ষকে পাকাপোক্তভাবে শাসন করার বিষয়টি জড়িত ছিলো। এজন্য তারা ধর্মগুরুদের কাছ থেকে সতীদাহ প্রথা সম্পর্কে মতামত নেয়। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির ক্ষেত্রে সতী বা নারীর বিষয়টি গুরুত্ব ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসকরা শাসনের বৈধতার জন্য সভ্যকরণ,মানবমুক্তি বিষয়টি উপস্থাপন করে, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত ছিল। অর্থাৎ এটি আধুনিকতা নামক ডিসকোর্সের সাথে সম্পর্কিত নয়।
উপনিবেশ স্থাপনের পরবর্তীতে ভারতবর্ষ শাসনের সুবিধার্তে ব্রিটিশরা বিভিন্ন আইন চালু করে। ভারববর্ষে ধর্মীয় আইনের বিধিবদ্ধকরণের কাজটি ব্রিটিশরাই প্রথমে করে। ১৭৭২ সালে হেস্টিংসের নেতৃত্বে কোরআন থেকে মোহামেডান আইন এবং ব্রাহ্মণ শাস্ত্র থেকে হিন্দু আইনের বিধিবদ্ধকরণ করা হয়।১১ ব্রিটিশ শাসকরা তাদের পূর্বানুমান থেকে এই কাজটি করে। তাদের ধারণা ছিলো ভারতবর্ষের লোকেরা অন্ধবিশ্বাসী,তাদের কাজকর্ম,চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ব্রিটিশদের নিকট ধর্ম বলতেই ছিলো ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এন্ডারসনের মতে মুঘল শাসনামলে বিচারব্যবস্থা ও আইনের ক্ষেত্রে কাজীর গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা ছিলো। কাজী তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন।১২
ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্বে মুসলমানদের জন্য ছিল মাদ্রাসা এবং হিন্দুদের জন্য ছিল টোল ও পাঠশালাভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব ধর্ম এবং সেক্যুলার উভয় বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিলো। মাদ্রাসায় যেসব প্রধান বিষয় পড়াশোনার অন্তর্ভুক্ত ছিলো এগুলো হলো ১.ব্যাকরণ ২. সাহিত্য, ৩. যুক্তিবিদ্যা, ৪.ইসলামিক আইন এবং এর মূলনীতিসমূহ ৫. কোরআনের ব্যাখ্যা ৬. হাদিস ৭. অতীন্দ্রিয়বাদ, ৮. স্কলাস্টিসিজম (ধর্মীয় দর্শন) ইত্যাদি । হিন্দুদের টোলে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল আর পাঠশালাতে ছিলো সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা। পাঠশালাতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো ছিলো ভাষা, মৌলিক গণিত, কৃষি ও নৌকা নির্মাণ দক্ষতা ইত্যাদি। মোঘল শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সম্রাট শাহজাহান তাঁর শাসনামলে দিল্লিতে ইম্পেরিয়াল কলেজ স্থাপন করেন।১৩ কিন্তু মোগল সাম্রাজ্যের শেষ পর্যায়ে এসে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার স্থলে ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে তা একদম স্থবির হয়ে যায়নি।
ঔপনিবেশিক শাসনামলের শুরুতে ব্রিটিশ শাসকরা শিক্ষাব্যবস্থাকে সরাসরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেনি। এসময় খ্রিস্টান মিশনারীরা বিভিন্ন মিশনারি বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতেন। ১৮১৩ সাল চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে শাসকদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। ব্রিটিশ শাসকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দুটিভাগে করেন। সেক্যুলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার ফলে মাদ্রাসা এবং টোল ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রান্তিকীকরণ ঘটে। অন্যদিকে মিশনারি বিদ্যালয়গুলো তখনও ব্রিটিশদের নিকট থেকে অনুদান পেত।১৪
বাংলায় যখন উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বাংলার মুসলমানরা বিভিন্ন কারণে এ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। মুসলমানদের প্রশাসনিক কাজের সংযুক্তের জন্য ব্রিটিশরা সরকার নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৮০ সালে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলে তখন সেখানে কোন বাঙ্গালী মুসলমান শিক্ষক ছিলেন না। অধিকাংশই ছিলেন বাংলার বাইরে থেকে আসা উর্দুভাষী।১৫
ব্রিটিশরা মুসলমানদের নিকট থেকে ভারতবর্ষে ক্ষমতা দখলের পর তাদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি চালু করে। মুসলমানদের নিকট থেকে ক্ষমতা দখলের বিষয়টিকে তারা একটি সাম্প্রদায়িক মাত্রায় রূপ দেয়। দার্শনিক জেমস মিল তাঁর ‘হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের সাম্প্রদায়িকতার সূচনা করেন। ইতিহাসবিদদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তিনটি যুগ বা সভ্যতায় ভাগ করেন। এ তিনটি যুগ হচ্ছে যথাক্রমে হিন্দু, মুসলিম এবং ব্রিটিশ যুগ৷ মিলের এ লেখাটি তৎকালীন সময়ে অসাধারণ স্বীকৃতি লাভ করে ও প্রভাব বিস্তার করে৷ মিলে পরবর্তী অনেক ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনায় তার যুগ বিভাজন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে অধ্যায়কে মিল হিন্দু যুগ হিসেবে চিহ্নিত করে তখন উপমহাদেশের সব শাসক-বংশগুলি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলো এমন নয়। রাজবংশের হিন্দু ধর্মের প্রাধান্যের ভিত্তিতে এ যুগকে হিন্দুযুগ মনে করা ভ্রান্ত,কারণ মৌর্য,ইন্দো-গ্রীক,শক,কুষাণ প্রভৃতি বহু প্রধান রাজবংশই অহিন্দু ছিলো। অনেক প্রভাবশালী বৌদ্ধ রাজারাও তখন শাসন করেন। লানন্দা, তক্ষশীলার মত বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বৌদ্ধ শাসনামলে সর্বাধিক প্রচার ঘটে। মিল তার যুগ বিভাজনের দ্বিতীয় পর্বে আরব, তুর্কি এবং পারসিক সকলকেই একসঙ্গে “মুসলমান” বলে অভিহিত করেন। মিল পূর্ব ঐতিহাসিকরা এদের ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসেবে চিহ্নিত করতেন। এককভাবে মুসলমান শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে এদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন শব্দের ব্যবহার করা হয় যা তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলে। তুর্কী, পার্সী এবং আরবরা ধর্মের দিক থেকে এক হলেও রাজনৈতিক ও জাতিগত অবস্থানের ক্ষেত্রে তৎকালীন সময় তারা ছিল ভিন্ন। এ ভিন্ন ভিন্ন জাতি দ্বারা ভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান হয়।
মিল তার তৃতীয় যুগবিভাজনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভিত্তিক যুগবিভাজন থেকে সরে আসেন। তিনি একে খ্রিস্টান যুগ না বলে ব্রিটিশ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। যেন এযুগের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষ সুশৃঙ্খল,সভ্য,ধর্মনিরপেক্ষ যুগে প্রবেশ করে। এ তিনটি যুগের দ্বারা মিল বুঝিয়েছেন প্রথম যুগ ছিলো হিন্দুদের জন্য গৌরবময় যুগ,দ্বিতীয় যুগ ছিল ‘মুসলিম স্বৈরশাসনের’, তৃতীয় যুগ হচ্ছে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার যুগ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আধুনিকায়নের পাশাপাশি মুসলমানদের অপর হিসেবে নির্মাণের কাজটিও একসাথে চলে। ঐতিহাসিকভাবেই ভারতবর্ষের ধর্ম ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল ছিলো। এটি শুধু হিন্দু মুসলিম বাইনারির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মুসলমান ধর্মের মধ্যে তখন বিভিন্ন বৈচিত্র্য ধারা (শিয়া, সুন্নি, হমেদিয়া)ছিলো। হিন্দুদের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ এবং এ বর্ণের বাইরেরও ছিলো প্রান্তিক দলিত জনগোষ্ঠী। বৌদ্ধ, জৈনসহ ভারতবর্ষে তখন বহুবিধ ধর্ম ও বর্ণের লোক বাস করত। ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারতবর্ষে মধ্যযুগ সম্পর্কে যে ইতিহাস নির্মাণ করে রোমেলা থাপার একে মিথ বলে অভিহিত করেন।১৬ আরসি মজুমদার থেকে যদুনাথ সরকার পর্যন্ত সকলেই এই মিথকে অনুসরণ করেছেন।
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে যে দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের নির্মাণ করে সে নির্মাণের ভিত্তিতেই ব্রিটিশরা তাদের সাম্রাজ্য হারায়। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে তখন দুটি সম্প্রদায় জন্য দুটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
ব্রিটিশ ভারতে যে সমস্যাটি সবচেয়ে গুরুতর ছিলো সেটি হচ্ছে হরিজন বা দলিত সমস্যা৷ ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত নেতারা এবং শাসক গোষ্ঠীরা নিজেদের স্বার্থে সম্যাটিকে ব্যাপকভাবে প্রান্তিকীকরণ করেছেন। যার ফলে এ সমস্যাটি এখনও ভারতে রয়ে গেছে। তাদেরকে এমনভাবে বিমানবীকরণ করা হয় যে তাঁরা ভারতবর্ষকে নিজেদের জন্মভূমি হিসেবে মনে করতেন না। ১৯৩১ সালে আম্বেদকরের সাথে মহাত্মা গান্ধীর যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনি বলেছিলেন ‘গান্ধীজি, আমার কোন মাতৃভূমি নেই। আপনি এমন কোন অস্পৃশ্যকে পাবেন না যে এই ভূখণ্ডের জন্য কোনরকম গর্ববোধ করে।’১৭ ১৯১৯ সালে আম্বেদকর ব্রিটিশদের নিকট দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি দলিত সম্প্রদায়কে পৃথক সামাজিক বর্গ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ব্রিটিশ শাসকরা কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণে এ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যায়।
১৯৩০ সালে ব্রিটিশদের ডাকা লন্ডন সম্মেলনে আম্বেদকর অংশগ্রহণ করেন। তিনি দলিতদের প্রধান হিসেবে এ সম্মেলন কমিটির নিকট তাঁর প্রস্তাব পেশ করেন। তাঁর প্রস্তাব ছিলো দলিতদের অন্যায়ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তাদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। ব্রিটিশরা তাঁর এ দাবি মেনে নেয়। কিন্তু গান্ধী নিজেকে অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বলে দাবী করেন এবং এর বিরোধিতা করেন। গান্ধীর আমরণ অনশনের প্রতিজ্ঞা ও জাতিয়তাবাদী নেতাদের চাপের ফলে আম্বেদকর তাঁর দাবী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। দলিতদের সমস্যাকে প্রান্তে রেখে ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের নিকট থেকে স্বাধীনতা লাভ করল। কিন্তু আম্বেদকর বা যোগেন মন্ডলের মতো দলিতদের প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ হলো না। হতাশার একপর্যায়ে স্বাধীন ভারতে আম্বেদকর তার অনুসারীদের নিয়ে স্বধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষও পরবর্তী সময় সেক্যুলার ভারতে সংখ্যালঘু প্রশ্নে দলিত সমস্যার মীমাংসা না করে বরং এটিকে আরো সমস্যা সংকুল করা হয়েছে।৩
বাঙালিরা একসময় ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করেছে আবার বাঙালি জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠন করেছে। এ দুটি রাষ্ট্র গঠনের মূলে যে প্রেরণাটি কাজ করে তা হল, দীর্ঘদিনের শোষণ ও বৈষম্যবোধ। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরির পিছনে যে কারণটির কথা বলতেন সেটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক বৈষম্যবোধ। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের উপস্থাপনের বিষয়টির কথা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যে তখন মুসলমান চরিত্র অর্থাৎ মুসলমানদের উপস্থানের অবস্থান ছিলো সীমিত। তাদের প্রান্তিকীকরণের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছিল। এ সাংস্কৃতিক বৈষম্যবোধ যোগেল মন্ডলের মতো দলিতদেরও ছিলো। তাই তিনি দলিতদের নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে এ বৈষম্যব্যবস্থা আরো জেঁকে বসে। সাংস্কৃতিক বৈষম্যের তুলনায় তখন অর্থনৈতিক বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তখন অধ্যাপক রেহমান সোবহান,অধ্যাপক আনিসুল হক,অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকরা দুই অর্থনীতি তত্ত্বকে তোলে ধরেন। যার উপর ভিত্তি করে ছয় দফা দাবি পেশ করেন।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে বৈষম্যের বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এ বৈষম্যের বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না করে অনেকে পাকিস্তান আন্দোলনকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রগতিশীল হিসেবে উপস্থাপন করেন৷ তাদের বক্তব্য হচ্ছে মাত্র পঁচিশ বছরের মধ্য বাঙালি নামক জাতি প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান থেকে প্রগতিশীল হয়ে উঠে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলে। শোষণ,বৈষম্যবোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়টি আড়াল রেখে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রগতিশীলতার বাইনারি হাজির করার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সে প্রক্রিয়া বহাল রাখা।
১৯৭১ হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। স্বাধীনতার পর সেই রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এ রাষ্ট্রের মধ্যে ন্যায়বিচারের অভাব। দীপন হত্যার পর তার পিতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাননি। কারণ তিনি নিশ্চিত আমাদের রা্ষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নেই। আরেকটি কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের জনগণ ফলস কনসাসনেসের মধ্যে বাস করছে। অপরের মুক্তির মধ্যেই যে তার নিজের মুক্তির এটি সে কল্পনাই করতে পারে না। যার ফলে বিভিন্ন সময় ধর্মীয় সহিংসতার জন্ম দেয়।
প্রাচ্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ সবসময়ই তার সমাজ কাঠামোর উপর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। এক্ষেত্রে ধর্ম অথবা সেক্যুলারিজম দু’টির একটিকেই চূড়ান্ত ভাবাদর্শ হিসেবে ব্যবহার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ধর্ম এবং সেক্যুলারিজমের মধ্যে পরস্পর বিরোধী অবস্থান নির্মাণের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তাদের শাসনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ বা ভারতের মতো বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে এধরনের কৌশল স্পষ্টভাবে কাজ করে। আমাদের দেশে ‘আস্তিক’ ‘নাস্তিক’ ‘প্রগতিশীল’ ‘প্রক্রিয়াশীল’ ‘হেফাজতি’ ‘শাহবাগী’ এরকম বর্গ রয়েছে। এ বর্গকরণের মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে শাসকগোষ্ঠী। তারা এসব দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে কৌশলে নিজেদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের দেশে প্রগতিশীল চিন্তকরা প্রগতিশীলতা চর্চার বিপরীতে সাম্প্রদায়িকতা নামক ডিসকোর্সটি তৈরি করেছেন তা অত্যন্ত কৌশলী। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামক ডিসকোর্সটি মূলত ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড থেকে পাওয়া। আমাদের দেশে সম্প্রদায়িকতা শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষকেই বোঝায়। আমাদের দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা এটিকে শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিম সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকেন। এর ফলে আমাদের দেশের আদিবাসীদের সমস্যা ব্যাপকভাবে প্রান্তিকীকরণ করা হয়;বিশেষত আদিবাসীদের ভাষা এবং জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা দিকটি।
বাংলাদেশের প্রগতিশীল চিন্তকদের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, যাদেরকে প্রগতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাদের অধিকাংশই সমাজে বিশেষ সুযোগ গ্রহণকারী জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন শ্রেণির লোকেদেকে তাদের সৃজনীশলতা বা জ্ঞানচর্চা দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে থাকে। বিভিন্ন ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে সত্য হলেও রাজনৈতিকীকরণের স্বার্থে তারা তাকে চেপে রাখেন। প্রগতিশীলতা চর্চার বিষয়টি পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বিস্তারের কৌশলে। রাষ্ট্র তার জনগণের উপর ক্ষমতা চর্চার সম্মতি উৎপাদানের কাজটিই তারা বিশেষভাবে করে থাকেন। এখানকার প্রগতিশীলরা চিন্তকরা সমাজ বিকাশের খাতিরে পশ্চিমা আলোকায়িত জ্ঞানের চর্বিতচর্বন দ্বারা আমাদেরকে আলোকিত করতে চান। কিন্তু একটি সমাজ প্রগতির জন্য শুধু ধার করা জ্ঞান দিয়ে চলে না। সমাজের ভিতর থেকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন জ্ঞান সৃষ্টি করতে হয়। যে সমাজ সৃষ্টিহীন সে সমাজ বন্ধ্যা এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়।
এদেশে হিন্দু মুসলমানরা নৃ-তাত্ত্বিকভাবে বাঙালি হলে আদিবাসীরা তা নয়। তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি আমাদের থেকে ভিন্ন। এ অর্থে তারাই প্রকৃত সংখ্যালঘু। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমরা হচ্ছি বাঙালি জাতি। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিতরে অন্যান্য জাতিও রয়েছে। ধর্মীয় রাষ্ট্র যদি সাম্প্রদায়িক হয় তাহলে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র কতটুকু অসাম্প্রদায়িক তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পর সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি হয়ে যায়। তখন থেকেই সমস্যার সূচনা। মানবেন্দ্র লারমা সংবিধান প্রণয়নের সময় তীব্রভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন। ১৯৭২ সালের ২৫ ও ৩১ অক্টোবর গণপরিষদের খসড়া সংবিধানের উপর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে তর্ক বিতর্কের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত দেওয়া হলো-
মানবেন্দ্র লারমা: আমরা করুণার পাত্র হিসেবে আসিনি। আমরা এসেছি মানুষ হিসেবে। তাই মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার আমাদের আছে।
মিসেস সাজেদা চৌধুরী: বৈধতার প্রশ্ন, জনাব স্পিকার, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলতে চেয়েছেন যে এই সংবিধানে তাঁদের উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আমি বলব, তাঁরাও আজকে স্বাধীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সঙ্গে তাঁদেরও একটা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
একটি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার চেয়ে একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কি অধিক মর্যাদাজনক নয়?মানবেন্দ্র লারমা: আমি একজন মানুষ, যেখানে জন্মগ্রহণ করেছি, যে জন্মভূমিতে আজন্ম লালিত-পালিত হয়েছি, সেই জন্মভূমির জন্য আমার যে কথা বলার রয়েছে, সে কথা যদি প্রকাশ করতে না পারি, যদি এই সংবিধানে তার কোনো ব্যবস্থাই দেখতে না পাই, তাহলে আমাকে বলতে হবে যে বঞ্চিত মানুষের জন্য সংবিধানে কিছুই রাখা হয়নি।
আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া: মাননীয় স্পিকার, আমি প্রস্তাব করছি যে সংবিধান বিলের ৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক।
‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’মানবেন্দ্র লারমা: আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়ার প্রস্তাবে আমার একটু আপত্তি আছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ—কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। আমি জানি না, এই সংবিধানে আমাদের কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়।
স্পিকার: আপনি কি বাঙালি হতে চান না?
মানবেন্দ্র লারমা: মাননীয় স্পিকার, আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয় না। আমরা কোনো দিনই নিজেদের বাঙালি মনে করি না। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদের বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: মাননীয় স্পিকার, মাননীয় সদস্য আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তির প্রতি, আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি অবৈধ ভাষায় বক্তৃতা করেন।… ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতির বদলে যে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তারই প্রতি ষড়যন্ত্রমূলক এ বক্তব্য।”১৮
পাকিস্তান শাসনামলে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা বাঙ্গালীদের উপর সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি বিষয় চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। বাঙ্গালী জাতি তার জাতিসত্ত্বার স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য তা মেনে নেয়নি। তাঁরা নিজেদের বাঙ্গালী পরিচয়কে রক্ষার খাতিরেই দেশকে স্বাধীন করে।সেই বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ হিসেবে ব্যবহার করে অন্যের উপর তা চাপিয়ে দেওয়ায় বাঙালি জাতিসত্তার চেতনা বিরোধী।
অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ তাঁর একটি লেখায় বলেছিলেন ‘পাহাড়িরা তাদের দাবীগুলোকে গৃহীত ও বাঙলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ক’রে নিতে চান,যা সংবিধানের মূল চেতনার বিরোধী।’১৯ অধ্যাপক আজাদ হয়ত এ বিষয়টি লক্ষ করেননি যে স্বয়ং বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার উপর গুরুত্বারোপ দেওয়া হয়নি। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে সংবিধানে প্রণয়নে গণপরিষদকে কিছু ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। বাংলাদেশের গণপরিষদ একত্রে নিষ্ক্রিয় ছিল,তাঁর হাতে কোন নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না। নির্বাহী ক্ষমতা ছিল রাষ্ট্রেপতি কার্যত প্রধানমন্ত্রীর নিকট। গণপরিষদ তার কার্যাবলীর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। এজন্য দেখা যায় গণপরিষদে সংবিধান বিল আকারে উত্তাপিত হওয়ার পর যেসব সংশোধনী প্রস্তাব আছে তার অধিকাংশই বাতিল হয়ে যায়। আর এই বিষয়টি পুরোপুরিভাবে মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাত আদিবাসীদের উপর কাজ করতে গিয়ে দেখিয়েছেন বাংলাদেশে কিভাবে আদিবাসীদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণের মাধ্যমে তাদেরকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদেরকে বিমানবিকীকরণ করা হয়। আদিবাসীদের ক্রমাগতভাবে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। গারো, হাজং, ওরাও, রাখাইন, খাসিয়া ও সাঁওতালদের মধ্যে গড়ে ৬৮.৮ ভাগ লোকের নিজস্ব জমি নেই।২০
অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ভাষায় ‘আদিবাসী মানুষের ভূমির অধিকার স্বীকৃত নয় অথবা যতটুকু আছে তাও সহজে হরণযোগ্য।…. সাঁওতালদের ৭২ শতাংশ এখন ভূমিহীন।….পঞ্চাশ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের আনুপাতিক হার ছিলো ৭৫ শতাংশ,আর এখন তা ৪৭ শতাংশ’।২১ আদিবাসীদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি, সমাধান আরো বহুদূরের বিষয়।
বাংলাদেশে আদিবাসীদের উপর বিভিন্ন সময় যে শারিরীক বা সাংস্কৃতিক সহিংসতা ঘটানো হয় এসব বিষয়কে মুছে ফেলার জন্য তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আমাদের দেশের শিল্প সাহিত্যে তাদের সমস্যা খুব একটা ফুটে উঠে না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘The Ugly Asian’ উপন্যাসে যেভাবে আদিবাসীদের জীবনের রাজনৈতিক জটিলতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন আমাদের দেশে তা খুবই বিরল। আলজেরিয়ায় জন্ম নেওয়া নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত ফরাসি উপন্যাসিক আলবেয়ার ক্যামু তাঁর সাহিত্যিক নীরবতার জন্য বিশেষভাবে সমালোচিত। তাঁর উপন্যাসের অধিকাংশ ঘটনা ঘটে আলেজেরিয়াকে কেন্দ্র করে। আর আলজেরিয়া তখন ফ্রান্সের উপনিবেশ। কিন্তু তাঁর গল্পে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলিত স্থানীয়দের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা অনুপস্থিত। অথচ ক্যামু একই সময়ে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা,লেখক ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সরব। ক্যামুর লেখায় স্থানীয়দের সমস্যার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। আমাদের দেশে শিল্প, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাও আদিবাসীদের উপর সহিংসতার ক্ষেত্রে একই কাজ করে থাকেন।
সত্যিকার অর্থকে বাংলাদেশেকে অসাম্প্রদায়িক ও সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল বাইনারি ডিসকোর্স থেকে বেরিয়ে এসে পারস্পরিক সহনশীলতার ভিত্তিতে একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলতে। যে সমাজে মুক্তি ঘটবে আপামর জনসাধারণের ।
তথ্যসূত্র
১)Talal Asad, Formation of The Secularism: Christianity Islam Modernity, California 2003, page 23
২) Saba Mahmood,Religious Difference in a Secular Age: A Minority Report,Princeton University Press, page 8
৩)Carl Schmitt, Political Theology, Four Chapter on The Sovereignty, Chicago 2005, page 36
৪)Talal Asad, Ibd, page 168
৫) Max Horkheimer and Theodor W. Adorno,Dialectic of Enlightenment,Philosophical Fragment, California, 2002 page 142
৬)Saba Mahmood, Ibd, page 170
৭)Talal Asad, Modern power and the reconfiguration of religious tradition interview with Saba Mahmood (1996)
৮) Ewen MacAskill,
George Bush: ‘God told me to end the tyranny in Iraq,The gurdian
৯)Olivier Roy, Secularism Confronts Islam,Colombia University Press, 2007
page 74-75
১০)Theshale Tibebu,Hegel and the Third World : The Making of Eurocentrism in World History, Syracuse University Press page 256-57
১১)Michael R Anderson,Islamic Law and the Colonial Encounter in British India WLUML occasional paper no.7 – June 1996 page 5
১২) Ibd page 11
১৩)আলী রিয়াজ, দক্ষিণ এশিয়ায় মাদ্রাসাশিক্ষা: প্রাক-ঔপনিবেশিক এবং ঔপনিবেশিক আমল,প্রতিচিন্তা, প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০১৭(ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)
১৪)প্রাগুক্ত
১৫)আহমদ শরীফ,বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব,১৯৯২, পৃষ্ঠা ১৭৪
১৬)Romila Thapar,What Secularism is and Where It Needs to Be Headed,The Wire,
Oct 18, 2015
১৭) Arundhati Roy,The Doctor and the Saint,2014 page 43
১৮)মহিউদ্দিন আহমদ, বাঙালি-আদিবাসী জাতীয়তাবাদ বিতর্ক,প্রথম আলো, ১৯-০৮-২০১১
১৯) উদ্ধৃতিটি হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘পাবর্ত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা’ বইয়ের ভূমিকা থেকে নেওয়া হয়েছে।
২০) Abul Barakat, Political Economy of Unpeopling of Indigenous Peoples: The Case of Bangladesh, page 27
https://bea-bd.org › site › pdfPDF
Political Economy of Unpeopling of Indigenous Peoples: The Case of Bangladesh/Abul Barkat
২১)আবুল বারাকাত, বাংলাদেশ কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭।