অরাজ
প্রচ্ছদ » সাক্ষাতকার।। লেবানন বিপর্যয় ও পারস্পরিক সহযোগিতা

সাক্ষাতকার।। লেবানন বিপর্যয় ও পারস্পরিক সহযোগিতা

  • অনুবাদ: খন্দকার তুর আজাদ

১০ আগস্ট, অবশেষে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পেরেছে লেবাননের জনতা৷ শাসকগোষ্ঠী ও এলিটদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনতার এই অর্জন বিজয়ের৷ তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রের সামনের পথ এখনও অনিশ্চিত৷ লেবাননের বর্তমান প্রতিরোধের সাথে এর অর্থনীতি, রাজনৈতিক ইতিহাস, উপনিবেশায়িত সময়কাল সবই জড়িত। তবে এই সাক্ষাতকারের মনযোগ মূলত বিস্ফোরণের পরের দুর্যোগ সামাল দিতে রাস্তায় নামা একজনের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধির উপর। ব্রিটেনের এনার্কিস্ট প্রকাশনা ফ্রিডমে সরকার পতনের আগের সপ্তাহের ঘটনার বিবরণের পর সাথে সাক্ষাতকারটি প্রকাশ করা হয়।

:রুত
গ্রাফিতি

সাক্ষাতকার

বৈরুতে বিস্ফোরণের পরে যখন দাঙ্গা-বিক্ষোভ, সরকারের নিয়ন্ত্রন ভেঙে ফেলার মত হুমকি হয়ে উঠতে পেরেছে; সেরকম সময়ে ‘ফ্রিডম’ কথা বলেছে একজন লেবানিজ র‍্যাডিক্যাল-এর সঙ্গে। যে কিনা এই ঘটনার আরেকটি দিকের সাক্ষী৷ সেদিকটি হল, সমাজ জুড়ে নিচ থেকে আসা সংহতি, যা তাদের এনার্কিস্ট হবার জন্য অনুপেরণা যোগাচ্ছে।

৪ আগস্টের যে বিস্ফোরণ বৈরুতের জাহাজঘাটগুলো ধ্বংস করেছে এবং পুরো শহরকে বিপর্যস্ত করেছে তা তাৎক্ষণিকভাবেই লেবাননের সমাজের চেহারা বদলে দিচ্ছে। আগে থেকেই থাকা একটি কঠিন পরিস্থিতিকে সরাসরি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে৷

অযোগ্যতা এবং বিস্ফোরণ পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে ব্যর্থতার জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয় লেবাননের দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারকে৷ এবং সরকারের প্রতি ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে সপ্তাহ শেষের বিশাল প্রতিবাদ এবং দাঙ্গাগুলোতে৷ মন্ত্রনালয়গুলো আক্রমণ করে দখল নেয়া হয়েছে, জনগণের কাছে ঘৃণিত ব্যাংকিং এসোসিয়েশনের প্রধান কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, সহস্র জনতা শহীদ চত্বরে সমবেত হয়ে ক্ষমতাবান শ্রেণীর উপর প্রতিশোধের শপথ নিয়েছে।

শহরের নিয়ন্ত্রন ফেরত নেবার জন্য দাঙ্গা পুলিশের আক্রমণে আহত হয়েছে শতাধিক। সরকার ও হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক নেতাদের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে৷ জনতাকে শান্ত করার চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব আগাম নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তবে তা জনতার ক্ষোভ থামাতে যথেষ্ট হবার কথা নয়।

একদিকে যখন বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারি ভবনের দখল নিচ্ছে, তখন একই সাথে আরেকটি বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে; যেটা স্বাভাবিকভাবেই তেমন একটা সামনে আসেনি৷ তা হলো: রাষ্ট্র যখন নিজেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত, তখন শহরের  মানুষেরাই একে অপরের প্রাণ বাঁচাচ্ছিল।

বিস্ফোরণের একদিন পর একজন লেবানিজ র‍্যাডিকাল শহরের বিদ্ধস্ত রাস্তায় সাহায্যের কাজে নেমে সেখানের দৃশ্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে। পরে সে লিখেছে:

আমি আজ একদল কমরেডের সাথে রাস্তায় মানুষকে এই ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কারের কাজে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম৷ সেখানে কী দেখতে পেলাম আমি? শুধুই খাঁটি সংহতি আর পারস্পরিক সহযোগিতা৷ মানুষজন একে অপরকে সাহায্য করছে। বিনামূল্যে খাবার এবং পানি দিচ্ছে। শ্রমিকেরা- মেরামতকারী, কাঠমিস্ত্রি সকলেই বিনামূল্যে শ্রম দিতে চাচ্ছে।

‘যদি কারো কোন আশ্রয় দরকার হয়, আমার জায়গা আছে, জানাতে দ্বিধা করবেন না ‘, বিস্ফোরণের পরপরই এমন সব পোস্টে ছেয়ে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া৷ কারণ ৩০ হাজার মানুষ তখন ঘর হারা ছিল৷

‘এসময় রাষ্ট্র কী করেছে? কিছুই না৷ পুলিশ আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার এক বন্ধু এক পুলিশকে বলেছিল আমাদের সাহায্য করতে। জবাবে সে বলেছিল ‘আমরা শুধুমাত্র আদেশ অনুসরণ করছি’। আচ্ছা,তোমারেও গুনি না তাইলে৷ একটা পুলিশ, সৈন্য বা রাজনৈতিক ব্যক্তি কোন সাহায্য করেনি,মানুষই নিজেদের সাহায্য করেছে৷ এটাই! আমি এনার্কিস্ট হয়ে উঠলাম।

ফ্রিডম’এর সাথে সাক্ষাতকারে সে এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানিয়েছে। সেই সাথে রাষ্ট্রের প্রতি ভেঙে যাওয়া আস্থা কীভাবে পারস্পরিক সহযগিতার আলোড়ন তৈরী করেছে তা নিয়েও কথা হয়।

আপনি কি লেবাননের /বৈরুতের? তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণ এবং এর পরের পরিস্থিতি আপনার জন্য কেমন ছিল? আপনার কমিউনিটি এটা দ্বারা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে?

আমি লেবাননের, কিন্তু আমি বৈরুতে থাকি না৷ আমি আলেহর পাশে থাকি, যেটা বিস্ফোরণ থেকে যথেষ্ট দূরে৷ এরপরেও সেসময় এখানের মাটি কাঁপছিল, এবং সেকেন্ড পরেই বিস্ফোরণটি ঘটলো – প্রায় ১৫ সেকেন্ড ধরে আমার আমার কানে তালা বাজছিল৷ বিস্ফোরণের পরপর সামাজিক গণমাধ্যম সাহায্য করতে চাওয়ার বার্তায় ভেসে গিয়েছিল। ”কারো আশ্রয় দরকার হলে আমার জায়গা আছে”, ”কারো খাবার লাগলে আমি সাহায্য করতে চাই ”, ” আপনি যদি এমন কাউকে চিনেন যার খোজ পাওয়া যায়নি, তাহলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন”৷ আমার চোখের সামনে যেন ক্রপোতকিনের ‘ Mutual Aid’  উন্মোচিত হয়ে উঠছিল।

সত্যি বলতে আমি হতাশ৷ আমি ভাবছি যে, এই বিস্ফোরণের আগে জীবন সুন্দর ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এটা জঘন্যর চেয়েও খারাপ ছিল আগের থেকেই৷ এরপর ত এটারও কোন দরকার ছিল না৷ পুরা কমিউনিটি শাসকদের প্রতি ক্ষুব্ধ, কেবলমাত্র কিছু অন্ধ ছাগল ছাড়া, যারা কিনা এখনও ওদের অনুসরণ করছে৷ তবে এই ট্র‍্যাজেডি আমাদের এটা বুঝিয়েছে যে, আমাদের চালানোর জন্য কোন সরকারের দরকার নেই : যদি আমাদের মধ্যকার সংহতি গত অক্টোবরে শক্তিশালী থাকে ( সেসময়ের প্রতিবাদের প্রসঙ্গে),  এটা আগস্ট ৪ এ আরো জোরালো হয়েছে।

বিস্ফোরণের একদম পরপরই আপনি লিখেছিলেন কীভাবে মানুষেরা তাৎক্ষণিকভাবে সংহতির সাথে কাজে নেমে পড়েছে যেখানে রাষ্ট্র কিছুই করেনি  প্রথম কিছুদিনে আপনি যা যা দেখেছিলেন সে ব্যাপারে একটু বিস্তারিতভাবে জানাবেন?

৫ তারিখে বিস্ফোরণের একদিন পরই, একজন সাবেক স্কুল শিক্ষক, এখন একজন বন্ধু, আমাদের হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে একটি বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন যে  বৈরুতের মার মিখায়েলে সহায়তা দরকার। আমি আমার কোদাল  নিয়ে তার এবং অন্য বন্ধুদের সাথে সেখানে হাজির হই।

প্রথমে যখন সেখানে আসি, কাঁচের কারণে পুরা জায়গা জুড়ে নাটি নীলচে হয়ে ছিল। আমরা কিছুটা হাঁটি, একটা স্ট্যান্ড এ আসি যেখান থেকে বিনামূল্যে খাবার, জুস, পানি দেয়া হচ্ছিল। যদি কারো দরকার হয় সেজন্য তারা তাদের ফোন নাম্বারও দিয়ে দিচ্ছিল৷  যাবার সাথে সাথেই একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো যে আমার কিছু লাগবে নাকি। আমি জানালাম যে আমি ঠিকই আছে৷ আগস্ট ৫ আর আগস্ট ৬, এই দুইদিন আমি সহায়তা কাজের সাথে ছিলাম।

আমি আমাদের সাহায্য করার জন্য সরকারের দিক  থেকে একটি উদ্যোগও দেখিনি৷ সেসময়ে রেডিট এ আমি অন্য একজনের তোলা একটি ছবি পোস্ট করেছিলাম৷ মানুষ যখন আবর্জনার স্তুপ সরাতে ব্যস্ত ছিল তখন এক পুলিশ সদস্য ধূমপান করতে করতে দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল, এমন ছিল ছবিটি৷ আমি ৩ জন পুলিশ অফিসারকে দেখেছিলাম: একজন তার মটরসাইকেলে গালিগালাজ করছিল, দ্বিতীয়জন কোন কাজ ছাড়া এমনিই বসেছিল, তৃতীয়জন একটি ব্যাংকের দরজা পাহাড়া দিচ্ছিল৷ রাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করতে একদম কিছুই করছে না। এমনকি তারা বিদেশি সাহায্যও ফিরিয়ে দিচ্ছি কারণ সেগুলা এই অবিশ্বাসযোগ্য সরকারের হাত হয়ে আসবে না৷

মানুষ নিজেরা নিজেদের সাহায্য করছিল। ১৫ মিনিট পরপর ই একজন নাগরিক বেরিয়ে এসে আমাকে পানি সাধছিলো৷ ৬ তারিখ, এক লোক তার গাড়ির জানালা থেকে চেঁচিয়ে বললো ‘ আমাদের সরকার অপদার্থ’।

আপনি বলেছিলেন যে আপনি আপনার কমরেডদের সাথে বের হয়েছিলেন৷ আসলে আপনাদের শহরে কী ধরনের র্যাডিকাল লেফট আছে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ভূমিকা কী?

এখানে একটি এনার্কিস্ট মুভমেন্ট আছে যেটির নাম কাফেহ৷ কাফেহ শব্দটির অর্থ অনেকটা সংগ্রামের কাছাকাছি। তারা একটি সামাজিক লঙরখানা খুলেছে। ইডিএলের সিড়ি বরাবর এই লঙরখানাটি রয়েছে যেটিকে তারা  ‘বোমা নয়, খাবার’ নাম দিয়েছে।

এখন রাষ্ট্র যখন তৎপর হয়ে উঠবার সুযোগ পেয়েছে, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসবে বলে মনে করেন?

 লেবানিজ আর্মড ফোর্সের প্রাথমিক লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে লেবানন এবং তার নাগরিকদের বাহিরের আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করা, অভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখা, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থবিরোধী হুমকি মোকাবেলা করা, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে জড়িত হওয়া, গণ এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলার সাথে সমন্বয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া৷ অথচ তারা উদ্ধারকারী কুকুরকে বন্দরের নিকট নিচ্ছে না৷ কোন একটা ভেজাল যে আছে, সেটা ত বুঝাই যাচ্ছে৷ আমার মতে সৈন্যদের এবং পুলিশদেরও এটা বুঝা উচিত যে সবার আগে তারা আমাদের মতই নাগরিক। আমরা এসব তাদের জন্যও করছি, এসব তাদের সাথেও সম্পর্কিত৷

শেষ কিছুদিন রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে জনসাধরণের প্রতিক্রিয়া কেমন

রাষ্ট্রের প্রতি চূড়ান্ত ঘৃণা  বিরাজ করছে৷ তারা আমাদের কথা মোটেও শুনছে না৷ আমরা দশ মাস ধরে তাদের পদত্যাগ করতে বলেছি, আমরা বলেছি যে আমরা সংস্কার চাই৷ তারা একটা কাজেও আসেনি। বরং তারা জনগণের বাধা উপেক্ষা করে বিস্রিতে একটি বাঁধ নির্মান করতে চাইছে। বিদেশী সাহায্য ফিরিয়ে দেবার বিষয়টি বাদ ই দিলাম। এই সরকার, নিকৃষ্টতম শাসনব্যবস্থার মূর্তিমান উদাহরণ৷

আর্টওয়ার্ক: বৈরুত
শিল্পী: খালিদ হোসেন
সুত্র : সাৎসি আর্ট

এই পর্যন্ত লেবানিজ সরকার যা যা ফিরিয়ে দিয়েছে:

  • ডক্টর উইথ আউট বর্ডারস ( দুর্যোগে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসাসেবা দেয়া একটি স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন) এর সহায়তা৷ যেহেতু তাদের মতে এর নাকি প্রয়োজন ছিল না৷
  • প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে হতাহতের খোজ করতে চাওয়া একটি ডাচ টিমের সাহায্য৷
  • আরব আমিরাতের সাহায্য৷ যারা তাদের এম্বাসির মাধ্যমে ত্রান বিতরণ করতে চেয়েছিল কারণ এর আগে কুয়েতি ত্রান বাজারে বিক্রি হবার মত স্ক্যান্ডাল ঘটেছিল।

কমিউনিটির স্বসংঘটিত কাজ চালাবার ক্ষেত্রে সামনে কী কী সুযোগ থাকতে পারে বলে মনে করেন?

আমি বিশ্বাস করি যে, মানুষ বুঝতে পারছে: রাষ্ট্র একটি বিভ্রম, এটি একটি অন্যায্য বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, যেটা খেয়ালখুশিমাফিক অযৌক্তিক ক্ষমতার চর্চা করে মানুষের উপর এবং মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হিসেবে কাজ করে। আমাদের নিজদের চালানোর জন্য এর প্রয়োজন নেই৷ এখন পর্যন্ত ৪ দিন হয়ে গেল (সাক্ষাতকার গ্রহণের সময়)  কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোন সাহায্য নেই।

আমি এটাও মনে করি যে এখন  রুশোর ‘সাধারণ সংকল্পের’ ধারণার প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে৷ সেই সাথে প্রখ্যাত অরাজবাদী চিন্তকদের দেয়া ধারণাগুলার সাথেও পরিচিত হওয়া দরকার, বিশেষত ক্রপতকিনের। বাকুনিন আর রুডল্ফ রকারও ভালো, কিন্তু এরকম সময়ে ক্রপতকিনের ‘ মিউচুয়াল এইড’ অবশ্যপাঠ্য।

খন্দকার তুর আজাদ