অরাজ
আর্টওয়ার্ক ক্লাইমেট চেঞ্জ শিল্পী: ডাও থাকরাল সূত্র: পিন্টারেস্ট
প্রচ্ছদ » লাভলক, গাইয়া তত্ত্ব ও বায়োস্ফেয়ার

লাভলক, গাইয়া তত্ত্ব ও বায়োস্ফেয়ার

  • শহিদুল ইসলাম

বরেণ্য শিক্ষাগুরু, অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম এখনো লিখে চলেছেন। অষ্টতিতেও তরুণদের জন্য রীতিমত চ্যালেঞ্জ তিনি। প্রতিনিয়ত নতুন জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। উদ্রেক করছেন নতুন চিন্তার। ষাটের প্রজন্মের শিক্ষকগণ আর খুব বেশি আমাদের মাঝে নেই। আমরা সৌভাগ্যবান বিপুল প্রাণ স্ফূরণ নিয়ে অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম তাঁর রচনার মাধ্যমে আমাদের ‍ঋদ্ধ করছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো এখনো সহজলভ্য হলেও বেশিরভাগ রচনাই অনলাইনে নেই। অরাজ তাঁর গ্রন্থিত এবং অগ্রন্থিত রচনা অনলাইনে প্রকাশে আগ্রহী, তিনিও সম্মত। প্রবহমান রচনাটি তাঁর একটি ফেসবুক পোস্ট।  জেমস লাভলকের চিন্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই তাঁর এই প্রাত্যহিক চিন্তা তৎপরতা। লাভলকের কথা তিনি হাজির করেছেন অনেকটাই নিজ জবানীতে। মূল সাক্ষাতকারটি দীর্ঘ, এখানে কিয়দাংশ তিনি হাজির করেছেন।-সম্পাদক

জেমস লাভলক

মূল রচনা
বিখ্যাত ‘গাইয়া’ তত্ত্বের জনক জেমস লাভলক গত ২৬ জুলাই,২০২০ তারিখে ১০১ বছরে পা রাখলেন। সেই উপলক্ষে সাংবাদিক জোনাথান অটো তার এক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেটি গত ১৮ জুলাই,শনিবার,২০২০ গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখাটির শিরোনাম ছিল: The Biosphere and I are both in the last 1% of our life.’

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এই ‘গাইয়া’ তত্ত্ব সম্পর্কে হয়ত কিছু জানেন না। তত্ত্বটি বৈপ্লবিক। মূল কথা— পৃথিবীতে জীবন একটি আত্মপরিচালিত ( self-regulated) সত্তা। তাদের সুনির্দিষ্ট গঠন আছে, দেহ আছে, অবয়ব আছে। তারা জীব ও অবয়বী। তারা সব সময় পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকে। লাভলক সাধারণত ‘ধ্বংসের পয়গম্বর’ (prophet of doom) নামে পরিচিত। তিনি জলবায়ু সংক্রান্ত দার্শনিক। তিনি কোন মতাদর্শ পোষণ করেন না, কোন নিয়মের বশবর্তী হতে চান না। তিনি মালিকানাহীন পশু ও উদ্ভিদের বিকাশে বিশ্বাসী। তিনি মানুষের বাক স্বাধীনতা ও একাডেমিক স্বাধীনতার একজন বড় প্রবক্তা।

প্রথম প্রশ্ন ১৪ বছর আগে আপনি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে জলবায়ু চরম আকার ধারণ করবে এবং ২০২০ সালে পৃথিবী আরো সর্বনাশা দূর্ঘটনায় পড়তে পারে। এ বছরের প্রথমার্ধে পৃথিবী এক বৈশ্বিক মহামারীর (কোভিড-১৯) সম্মুখীন, মেরু প্রদেশের তাপমাত্রা এই প্রথম ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট অতিক্রম করলো, অস্ট্রেলিয়া ও সাইবেরিয়ায় দাবানলে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় পুনরায় প্লেগ দেখা দিয়েছে। এভাবে আপনার ভবিষ্যতবাণী প্রমাণ হওয়ায় আপনি আনন্দিত না হতাশাগ্রস্ত?

উত্তরে বলেন যে, আমি বিজ্ঞানী নই— একজন প্রযুক্তিবিদ। একটি ভবিষ্যতবাণী সত্য কি মিথ্যা তা বোঝার জন্য অনেক সময় দিতে হয়। আমি বলবো, এখন পর্যন্ত পৃথিবী তাপমাত্রা এমন জায়গায় রেখেছে, যে তাপমাত্রায় জীবন বাঁচতে পারে— এটাই গাইয়া  তত্ত্বের মূল কথা। আমি বলবো যে আমি ও বায়োস্ফেয়ার উভয়েই জীবনের শেষ ১% সময়ের মধ্যে বাস করছি।

তিনি মনে করেন ভাইরাসও আত্মপরিচালিত একটি প্রাণী। ডারউইনের ক্রমবিকাশতত্ত্বের অধীন। নতুন কোন প্রজাতির বংশবৃদ্ধি সম্ভব নয় যদি তার খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আজ যে ভাইরাসটির সম্প্রসারণ ঘটছে, তার অর্থ সে যথেষ্ট খাদ্য পাচ্ছে এবং সে খাদ্যটি হলাম আমরা, মানুষ। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে ভাইরাসের ছডিয়ে পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। আমরা প্রকৃতির পছন্দের প্রাণী নই যারা বাধাহীনভাবে বংশবৃদ্ধি করে পৃথিবীকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেবে। মালথুস এখানে সত্যি। তাঁর সময়ে মানুষের সংখ্যা এত কম ছিল যে ভাইরাস এত দ্রুতগতিতে ছডিয়ে পারত না।

আর্টওয়ার্ক: বার্নিং আর্থ
সূত্র: পিন্টারেস্ট

লকডাউনে কি কোন উপকার হবে?

অবশ্যই। মানুষের জীবনযাত্রায় এক পরিবর্তন আসবে। আমি বিশ্বাস করি মানুষ বুঝতে পারবে যে তারা আগে যে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল এখন তা করা যাবে না। অতিরিক্ত খেয়ে মোটা হওয়া মোটেই ভাল না।

আপনি কি বিশ্বাস করেন যে জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষ কিছু করবে?

কিছু করা উচিত। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বায়ু, সূর্যরশ্মি ও নিউক্লিয়ার শক্তির ওপর আমাদের আস্থা বৃদ্ধি করতে হবে। তা নাহলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।

লকডাউন কি আপনার ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার সৃষ্টি করেছে?

১০১ বছর বয়সে স্ত্রী স্যান্ডির সঙ্গে প্রায়ই ২/৩ মাইল হাঁটি। লকডাউনের ফলে রাস্তায় লোক চলাচল কম থাকায় হাঁটতে সুবিধা হয়।

 

শহিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী জীবননিষ্ঠ মননের সদনুশীলনে আত্মনিয়োজিত, শহিদুল ইসলাম নিরলস চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে সেই গোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছেন। গত পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখছেন। সমাজনীতি, রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অনবরত লিখে চলেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

তিনি স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন এক সমাজব্যবস্থার, অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার যেখানে মানুষ পাবে মানুষের অধিকার। বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে। তিনি বিজ্ঞানের দর্শন নিয়েও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন।

শহিদুল ইসলামের জন্ম ১৯৪০ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি, পাবনার ঈশ্বরদীতে। তিনি সাঁড়া মাড়োয়ারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা, পাবনা এওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি, রাজশাহী কলেজ থেকে বিএসসি (অনার্স) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেন।

তিনি ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকদের একজন ছিলেন। ২০০০-২০০৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ২০১৩-১৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন 'সমাজ ও প্রগতি জার্নাল'।

তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: শিক্ষাভাবনা, প্রসঙ্গ শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্তশাসন, আমরা কি ধরনের শিক্ষা চাই?, বিজ্ঞানের দর্শন, চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস, একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, দেশভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, জাতীয়তাবাদ: সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র ও রাজনীতি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ: মিথ ও বাস্তবতা, মৃত্যুহীন প্রাণ, শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ।

২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নিজকে নিয়োজিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নানা গবেষণায়।