অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
ভূমিকা
সম্প্রতি ওপার বাংলা তথা ভারতের তরুণ নারী সাংসদ মহুয়া মৈত্র ভারতের জাতীয় লোকসভায় ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী সরকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ফ্যাসিবাদের কিছু চারিত্র্য লক্ষণ চিহ্নিত করে তার সাথে বর্তমান ভারতের শাসন ব্যবস্থার সাদৃশ্য নির্ণয় করে ওজস্বী বক্তব্য প্রদান করেন। খানিকটা হিন্দি ঢঙের উচ্চারণে বলা হলেও স্বচ্ছন্দ ইংরেজির সাথে মাঝে মাঝে দু/এক পংক্তি হিন্দি মেশানো এ বক্তব্য খুব দ্রুত ‘ভাইরাল’ হয়েছে, জয় করেছে লক্ষ জনতার হৃদয়। যদিও খুব দ্রুতই মহুয়ার বক্তব্য তাঁর ‘স্বকীয়’ চিন্তা নয় এবং হুবহু মিলে গেছে পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন্স ডব্লিউ ব্রিটের একটি প্রবন্ধের সাথে বলে দাবি আসছে বিরোধী মহল থেকে, গোটা উপমহাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষার স্তর দেখলে,মহুয়া যদি ব্রিটের প্রবন্ধ থেকে হুবহু বলেও থাকেন, তাতেও তাঁর কৃতিত্ব কমে না। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ব্রিটের আলোচনা শুধু ভারত নয়, উপমহাদেশ এমনকি তৃতীয় বিশ্বের অনেক শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কেই খাটে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লরেন্স ডব্লিউ ব্রিট ২০০৩ সালে ফ্যাসিবাদ বিষয়ে ফ্যাসিজম কেউ? (Anyone Fascism?) নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন যা মুক্ত অনুসন্ধান (Free Inquiry) এর বসন্ত ২০০৩ সংখ্যায় ২০ নম্বর পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়। জার্মানির হিটলারের শাসনামল, ইতালীর মুসোলিনি,স্পেনের ফ্রাঙ্কো, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো ও চিলির পিনোচেটের শাসনকাল সহ ইতিহাসের মোট পাঁচ কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট শাসনকাল পর্যবেক্ষণ করে ড. ব্রিট দেখেছেন যে, এই পাঁচ শাসনকালেই চোদ্দটি সমধর্মী উপাদান পাওয়া গেছে। ড. ব্রিট এই উপাদানসমূহকে ‘ফ্যাসিবাদের সনাক্তকারী ১৪ চারিত্র্য লক্ষণ’ নামে অভিহিত করেছেন। মুক্ত অনুসন্ধান পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসারে নিচে পুরো প্রবন্ধের অনুবাদ না ছেপে (যেহেতু পত্রিকাটি ইংরেজিতেও পুরো প্রবন্ধ নেটে দিচ্ছে না), তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশের তর্জমা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মূল প্রবন্ধ
১. ক্ষমতাশালী ও ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদ
ফ্যাসিবাদী শাসনপর্বে দেশপ্রেমিক মন্ত্র, শ্লোগান, প্রতীক, গান ও আরো নানা আলঙ্কারিক বিষয়ের ধারাবাহিক ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। জাতীয় পতাকা দেখা যায় সর্বত্র, পোশাকের উপর পতাকা প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং জনপরিসরে নানা প্রদর্শনীতেও জাতীয় পতাকার ব্যবহার বাড়ে।
২. মানবাধিকারের স্বীকৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা
শত্রুদের প্রতি ভীতিবোধ এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা থেকে, ফ্যাসিস্ট শাসনামলে বাস করা নাগরিকদের বোঝানে হয় যে বিশেষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকারকে রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে উপেক্ষা করলেও চলে। অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিকেরা এমন বক্তব্যে আস্থা রাখে অথবা এমনকি নির্যাতন, সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ড, হত্যা ও কারাবন্দিদের দীর্ঘ কারারোধও মেনে নেয়।
৩. শত্রু/বলির পাঁঠা সনাক্তকরণের মাধ্যমে একীকরণের পাটাতন তৈরি করা
জনতাকে কোন কাল্পনিক শত্রু বা হুমকির বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক উন্মাদনায় একই মঞ্চে আনা হয়: জাতিগত, নৃ-তাত্ত্বিক অথবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু; উদারনৈতিক; সাম্যবাদী বা কম্যুনিস্ট; সমাজতন্ত্রী বা স্যোশালিস্ট, সন্ত্রাসবাদী, প্রমুখ নানা কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে জনতাকে উত্তেজিত রাখা হয়।
৪. সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব
এমনকি যখন রাষ্ট্র বা দেশের ভেতরেই রয়েছে অসংখ্য অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সরকারি তহবিলের একটি বড় অংশই সামরিক বাহিনীকে দেয়া হয় এবং গার্হস্থ্য এজেন্ডাগুলো উপেক্ষিত হয়। সৈন্য ও সামরিক বাহিনীকে উজ্জ্বলতর করা হয়।
৫. প্রচন্ড পৌরুষবাদীতা
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রগুলোর সরকারসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরঙ্কুশভাবে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ফ্যাসিস্ট শাসনামলে সমাজের সনাতনী জেন্ডার রোল বা লৈঙ্গিক ভূমিকা কঠোর থেকে কঠোরতর হয়। গর্ভপাতের প্রতি বিরোধিতা প্রবলতর হয় এবং সমকামীতা বিরোধিতাও দেখা দেয়। সমকাম বিরোধী আইন ও জাতীয় নীতিমালা প্রণীত হয়।
৬.নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম
ফ্যাসিবাদী শাসনামলে গণমাধ্যম কখনো সরকার কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা সরাসরি ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার অনেক সময় গণমাধ্যম পরোক্ষভাবে সরকারী নানা প্রবিধান বা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল গণমাধ্যম মুখপাত্র ও কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ফ্যাসিবাদী শাসনে গণমাধ্যমে সেন্সরশীপ, বিশেষত যুদ্ধকালীন সময়ে, খুবই হয়ে থাকে।
৭.জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে ঘোর লাগা উন্মাদনা তৈরি
জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে জনগণের ভেতরে ভয়কে সরকার একটি ‘অনুপ্রেরণামূলক অস্ত্র’ হিসেবে তৈরি করেন।
৮. ধর্ম এবং সরকার পরষ্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রগুলোর সরকারসমূহ রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে নিপুণভাবে ব্যবহার করার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ধর্মীয় নানা বুলি-বচন, অলঙ্কার-উপমা বা পরিভাষা সরকারি নেতৃবৃন্দের মুখে অহরহ ব্যবহৃত হতে থাকে। এমনকি যখন ধর্মের প্রধান তত্ত্ব বা মৌল সুরগুলো সরকারের গৃহীত নানা নীতিমালা বা কার্যক্রমের সম্পূর্ণভাবে বিরোধী হয় তখনো।
৯.কর্পোরেট শক্তিকে সুরক্ষা প্রদান
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী অভিজাত শ্রেণিই মূলত সরকারি নেতাদের ক্ষমতায় বসায় আর এভাবেই একটি পারষ্পরিক ভাবে লাভজনক বাণিজ্যিক/সরকারি সম্পর্ক ও ক্ষমতাশালী অভিজাত শ্রেণির সৃষ্টি করে।
১০. শ্রমিক শক্তির দমন
যেহেতু শ্রমিকের সংগঠিত শক্তিই ফ্যাসিস্ট সরকারের একমাত্র শত্রু, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে হয় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয় অথবা তীব্রভাবে দমন করা হয়।
১১.বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এবং শিল্পকলার প্রতি অবজ্ঞা
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বা জাতিগুলো উচ্চতর শিক্ষা বা একাডেমিয়ার প্রতি খোলাখুলি শত্রুতাকে বাড়িয়ে তোলে বা বাড়তে দেয়। অনেক অধ্যাপক বা বুদ্ধিজীবীদের এসময় নিয়ন্ত্রিত বা এমনকি গ্রেপ্তার হতেও দেখা যায়। শিল্প-সাহিত্যে মুক্ত মতের প্রকাশ এসময় প্রকাশ্য আক্রমণের শিকার হয় এবং সরকারসমূহ প্রায়শই শিল্পকলায় বৃত্তি বা বরাদ্দ দিতে অস্বীকার করে।
১২. অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ে উন্মাদনা বা ঘোর তৈরি
ফ্যাসিস্ট শাসনামলে, পুলিশকে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বলতে গেলে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়। জনগণও পুলিশের নানা নির্যাতনকে উপেক্ষা করতে শেখে বা এমনকি দেশপ্রেমের স্বার্থে নাগরিক মুক্তি বা স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ছাড় দিতেও প্রস্তত হয়ে যায়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রগুলোয় একটি জাতীয় পুলিশ বাহিনীকে দেখতে পাওয়া যায় যারা বলতে গেলে নিসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে।
১৩. বিপুল স্বজনপ্রীতি ও দূর্নীতি
ফ্যাসিস্ট শাসনামল প্রায় সবক্ষেত্রেই কিছু নির্দিষ্ট বন্ধু এবং সহযোগী বৃত্ত কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে যারা একে অপরকে বড় নানা সরকারি পদে অধিষ্ঠিত করে এবং এভাবেই বন্ধুরা এ ওর সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে কাজে লাগিয়ে পরষ্পরকে জবাবদিহিতার হাত থেকে রক্ষা করে। ফ্যাসিস্ট শাসনামলে জাতীয় সম্পদ বা এমনকি কোষাগারের অর্থ পর্যন্ত সরকারি নেতাদের নিজেদের ভাগ-বণ্টিত হওয়া বা এমনকি চুরি হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
১৪. প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচন
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে নির্বাচন মাঝে মাঝে হয়ে দাঁড়ায় এক পরিপূর্ণ মিথ্যার আয়োজন। প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা থেকে শুরু করে তাদের হত্যা করা, ভোটারদের বা ভোট দাতাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বা রাজনৈতিক জেলার সীমারেখা নির্দ্ধারণে আইন প্রনয়ণ এবং গণমাধ্যমের অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রগুলো বিচারবিভাগকে অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে নির্বাচনকে ইচ্ছামাফিক ব্যবহার বা নিয়ন্ত্রণের কাজও করে থাকে।