- ইরফানুর রহমান রাফিন
১৯৪৮এ যখন ব্রিটিশ প্যালেস্টাইনে ইজরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এর ফলশ্রুতিতে প্রায় ৭০০,০০০ ফিলাস্তিনি রিফিউজিতে পরিণত হন। ফিলাস্তিনিদের কয়েকটি প্রজন্ম জর্দান আর লেবাননের রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে বেড়ে উঠেছেন, লেবাননের গৃহযুদ্ধে ইজরায়েলের যুক্ত হওয়ার উছিলাও তারাই। এটা দুনিয়ার সবচে দীর্ঘস্থায়ী রিফিউজি ক্রাইসিসগুলোর একটা।
এই ফিলাস্তিনিরা আজকে নিজ ভূমিতে ফিরতে চাইছেন, যেটাকে তারা বলছেন গ্রেট রিটার্ন মার্চ। কিন্তু ইজরায়েল দুনিয়ার যে-কোনো দেশে থাকা ইহুদিকে নাগরিকত্ব দিতে রাজি হলেও এই ফিলাস্তিনিদের নাগরিকত্ব দিতে আগ্রহী নয়। কেননা ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে হিস্টোরিকাল প্যালেস্টাইনকে ইহুদি-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখণ্ড বানানো হয়েছে, ফিলাস্তিনিরা ফিরে আসলে সে-সংখ্যাগরিষ্ঠতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এই ফিলাস্তিনিদের দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নাই। এরা আনুষ্ঠানিকভাবেই বেনাগরিক। বেনাগরিক হওয়ার কারণে তাঁদেরকে ক্যাম্পে থাকতে হয়েছে। মানুষের করুণার ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়েছে। এসবই নির্মম সত্য। কিন্তু তাঁদের আসল সংকট এরচে অনেক গভীর। সেটা হচ্ছে তাদের জৈবিক অধিকার হারিয়ে ফেলা।
জাতি-রাষ্ট্রের দুনিয়ায় মানুষের জৈবিক অধিকার নিঃশর্ত নয়। স্রেফ জীবিত বলে সে অধিকার পায় না। অধিকার পেতে কোনো-না-কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হয়।
অবশ্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকরাই পুরোপুরি সমান নয়; তাদের মধ্যে রয়েছে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণী, অঞ্চলভেদে বহু অসমতা। কিন্তু নাগরিক হিসেবে, অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে, তারা সমান। রাষ্ট্রের সব নাগরিকই, কমবেশি, জৈবিক অধিকারের অধিকারী।
এখন, কাউকে যখন বেনাগরিক করে ফেলা হয়, তখন তার কাছ থেকে এই জৈবিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়। শ্রেণী রাষ্ট্রের ভেতরের জিনিশ, এটা বাইরের জিনিশ। বর্ণ প্রথার পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, এরা এমনকি নিম্নতম বর্ণ শূদ্রও না, এরা হচ্ছে বর্ণবহির্ভূত দলিত।
বেনাগরিক করার রাজনীতি হচ্ছে এক্সক্লুড করার রাজনীতি। অনেকসময়ই এটা গণহত্যার একটা শুরুর দিকের ধাপ। এর সবচে ‘বিখ্যাত’ উদাহরণ হচ্ছে নাৎসি জার্মানি, যেখানে হলোকাস্টের ছয় বছর আগে, নুরেমবার্গে আইন করে ইহুদিদের নাগরিকত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছিলো।
আন্তর্জাতিক আইনে রিফিউজিদের ‘মানবাধিকারকে’ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে এই ‘মানবাধিকার’ এনফোর্স করা কঠিন, আসলে অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। কেননা রিফিউজিরা যেহেতু কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক নন, তাই তাদের ‘মানবাধিকার’ বিপন্ন হলে, নিন্দা জানানোর বেশি কিছু করার গরজ বোধ করে না কোনো রাষ্ট্র।
মিয়ানমার বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ জনসংখ্যাবহুল দেশ হওয়ায় রোহিঙ্গাদের কখনো নাগরিকত্ব দেবে, তেমন কোনো বাস্তব সম্ভাবনা নাই। ফলে এরা তাদের যাবতীয় জৈবিক অধিকার হারিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে মানুষের করুণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে।
ভারতে বিজেপি সরকার ‘ফরেনার’ তাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে। আসামের এনআরসি ১৯ লক্ষ মানুষকে বেনাগরিক করেছে, এদেরকে ‘বাংলাদেশি’ বলে এক্সক্লুড করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই কাজ করার পরিকল্পনা আছে।
এই বেনাগরিক করার দার্শনিক শেকড় কোথায় নিহিত? জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যেই। মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব অধিকারের জন্য যথেষ্ট নয়, তাকে অধিকার পেতে হলে নাগরিক হতে হবে, এই ধারণার মধ্যে।
এই ব্যবস্থায় ‘মানবাধিকার’ একটা সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক ধারণা। এবং সেটা বাস্তব নাগরিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। ‘মানবাধিকার’ কর্মীদের তৎপরতার কারণে একটা রাষ্ট্র যতোটা নিষ্ঠুর হতে চায়, হয়তো ততোটা হতে পারে না কখনো কখনো। কিছুটা আপোস করে। এখানে ওখানে দুই একটা ছোটোখাটো ছাড় দেয়। কিন্তু সেটা সে করে তার নিজের স্বার্থেই। ‘মানবিক’ কারণে না।
‘জাতি-রাষ্ট্র’ আর ‘নাগরিক অধিকারের’ ধারণাই দুনিয়ার দেশে দেশে রিফিউজি তৈরি করেছে ও করবে। তাই আমরা যদি রিফিউজি ক্রাইসিসের সমাধান চাই, সারা পৃথিবী জুড়েই, তাহলে জৈবিক অধিকারের ধারণা সামনে আনতে হবে। এবং সেই জৈবিক অধিকারের ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। এই কাজটা কঠিন। ‘জাতি-রাষ্ট্রের’ বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোটা ক্ষমতাবান ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণী, অঞ্চলের মানুষদের কাজে আসে। তাই তারা সহজে পরিবর্তনটা মেনে নেবে না। ফলে মানুষের জৈবিক অস্তিত্বকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়, এমন মানুষদের কাজ হলো ‘খাঁচাটাকে যথাসম্ভব বড়ো করা’, অর্থাৎ বিদ্যমান ‘জাতি-রাষ্ট্রের’ নানান ফাঁকফোকর ব্যবহার করে এর ভেতরে বাইরে মানুষের জৈবিক অধিকারের সীমানাটা ক্রমান্বয়ে প্রসারিত করতে থাকা।