শহিদুল ইসলাম
রবীন্দ্র বিশ্বে ঢুকতে আমি ভয় পাই। তাই তাঁকে নিয়ে আমি কোন লেখা আজও লিখিনি। আগামি ২২ শ্রাবণ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা নিয়ে একটা কিছু লেখার তাগিদ এসেছে। লিখতে সাহস পেলাম এজন্য যে উপমহাদেশ ও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সামন্য চিন্তা-ভাবনা করেছি এবং কিছু লিখেওছি। তখন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শন আমার ওপর প্রবল প্রভাব ফেলে। তাঁর কেবল ‘শিক্ষা’ নামের বই-ই নয়; তাঁর অনেক লেখা, বক্তৃতা ও চিঠিপত্রে শিক্ষা নিয়ে অনেক চিন্তার কথা আমাদের জানিয়েছেন। আমার লেখায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অতি স্পষ্ট। তাঁর অনেক উদ্ধৃতি আমি ব্যবহার করেছি। ভাব প্রকাশ করতে যখন ভাষা খুঁজে পাই না, তখন তাঁর স্মরণাপন্ন হয়েছি। তিনি আমাকে পথ দেখিয়েছেন।
তবে শিশু শিক্ষার ওপর তাঁর গুরুত্ব দেবার বিষয়টি কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। তিনি এক থেকে পাঁচ বছর শিশুদের শিক্ষা নিয়ে বেশি ভেবেছেন। অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় আমাদের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিশুদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলেছেন এবং তিনি নিজেও শহরের ইট-পাথর-সুরকি ও যানবাহনের উৎকট আওয়াজ, মানুষের হইহুল্লোড় থেকে দূরে এক মনোরম ছায়াঘেরা গ্রামে তেমনি একটি আশ্রম গড়ে তুলে নিজের চিন্তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। চারধারে আদিবাসী সাঁওতাল গ্রাম। পায়ে চলা ধুলো ভর্তি রাস্তা। পাখির কিচির মিচির শব্দ। বিভিন্ন ঋতুতে রঙ বদলানো পরিবেশের মধ্য তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর আশ্রম। তিনি লিখেছেন ‘কেজো শিক্ষা’ দেয়াই তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতেন এবং তাদের হাতে-কলমে শিক্ষার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং তাদের মতই ‘কেজো শিক্ষা’ প্রচলনের চেষ্টা করেছেন। কেজো শিক্ষা বলতে তিনি শিশুদের দৈনন্দিন কাজ, যেমন নিজের জামাকাপড় নিজে পরা ও পরিস্কার রাখা, রুটি বানানো, ঘরদোর পরিস্কার রাখা, যেখানে-সেখানে কফ বা থুতু না ফেলা ইত্যাদি। কিন্তু তিনি তা পারেননি। কারণ ‘পুঁথিগত বিদ্যায় আমাদিগকে কেবল যে অকর্মণ্য করিয়া দিয়েছে তাহা পুঁথির বাহিরে যাহা-কিছু আছে তাঁহার প্রতি আমাদের ঔৎসুক্য চলিয়া গেছে।’ (উদ্যোগশিক্ষা, রবীন্দ্র-রচনাবলী, পঞ্চদশ খণ্ড: ক, বিবিধ, পৃষ্ঠা-৮৬৫)।
রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ প্রবর্তিত তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা কাঠামোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাঁহার মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নয়।… আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে।’ (শিক্ষার হেরফের, রবীন্দ্ররচনাবলী-চতুর্দশ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩১১)
এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মূল শিক্ষা দর্শন নিহিত আছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য ‘সুদক্ষ উৎসাহী চোখ-কান খোলা মানুষ পাওয়া।’ কিন্তু ‘মুখস্তবিদ্যার নীচে তাদের [ছাত্র] সব শিক্ষা সমাধিস্থ হয়ে যায়।’ ‘বিদ্যায়তনগুলি সংসারক্ষেত্রের বাইরে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে মানুষকে তার স্বস্থান থেকে উৎপাটিত করে এনে খাঁচার মধ্যে পাখিকে যেমন করে রাখা হয় তেমনি করে রেখে শিক্ষার বাঁধা খোরাক দেওয়া হয়। এই যে বাল্যকাল থেকেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হওয়া, এ দৈন্য আর কিছুতেই কখনো দূর হয় না।’ (পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৮৭৯)।
মুখস্তবিদ্যার পরিণতি সম্পর্কে তাঁর মজাদার উক্তি হল, ‘আমরা যতই বি.এ. এম.এ. পাশ করিতেছি, রাশি রাশি বই গিলিতেছি, বুদ্ধিবৃত্তিটা তেমন বেশ বলিষ্ঠ এবং পরিপক্ক হইতেছে না।… ইহার প্রধান কারণ, বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা-কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনোমতে কাজ চলে যায় মাত্র, কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে, কিন্তু আহারটি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়া দরকার। তেমনি একটা শিক্ষাপুস্তককে রীতিমত হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের সাহায্য আবশ্যক’ (শিক্ষার হেরফের, প্রাগুক্ত)।
নতুনের প্রতি আমাদের ভয়ের শেষ নাই। আমেরিকা প্রভৃতি উন্নত দেশে খাদ্যের অভাব না থাকলেও তারা নিত্য নতুন খাদ্য প্রস্তুত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ চির অভাবের আমাদের দেশে তা সম্ভব হয় না। কেন? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যাহা চলিয়া আসিতেছে, তাহা নিঃসন্দেহেই ভালো বলিয়াই চলিয়া আসিতেছে এই জড় বিশ্বাস আমাদের শিক্ষিত লোকদের মন হইতেও কিছুতেই তাড়ানো যায় না।… ইহা আমাদের অন্তরতম দাসত্বের লক্ষণ।’ (উদ্যোগশিক্ষা, পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৬৫)। দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ বরাবর কর্মমুখি শিক্ষার জন্য সারা জীবন লিখে গেছেন। ১৯৪০ সালের ২৩ জুলাই শান্তিনিকেতনে শিক্ষাভবনের ছাত্রাবাসে প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথ শেষ ভাষণে বলেন, ‘বন্ধ স্কুল গৃহের কঠোর শিক্ষাব্যবস্থা আমার মনকে দারুণভাবে পীড়িত করেছিল— আমি স্কুল পালাতে বাধ্য হয়েছিলাম।’ (পঞ্চদশ খণ্ড-পৃষ্ঠা-৮৯৬)।
আধুনিক শিক্ষা প্রসঙ্গে
শিল্প বিপ্লব সমাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। তা ক্রমশ সমস্ত পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। সম্পদের অতি দ্রুত বৃদ্ধি মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে প্রাচুর্য। সেই স্রোতে গা ঢেলে না দিয়ে কোন জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। সে কথাটি রবীন্দ্রনাথ ভাল ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু সেইসাথে মানুষের কাছ থেকে কী কেড়ে নিচ্ছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল তাঁর। সেকথা তিনি তাঁর বহু লেখায় লিখে রেখে গেছেন। আমরা যারা আধুনিক সভ্যতার তীব্র আলোকে চোখে কম দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিয়েছেন আধুনিক সভ্যতা আমাদের কি কেড়ে নিয়েছে। জীবনের শেষ বছরে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে অতি স্পষ্টভাবে তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বহুল আলোচিত সে প্রবন্ধ সম্পর্কে আজ আর কিছু লিখবো না। ১৩২৬ সনের অগ্রহায়ণ মাসে ‘কলাবিদ্যা’ নামের শান্তিনিকেতনের পত্রে সে সম্পর্কে আমাদের জানান যে ‘বর্তমান যুগ য়ুরোপীয় সভ্যতার যুগ। ইহাই হয়, গায়ের জোরে নয়, সম্মোহনের দ্বারা সমস্ত পৃথিবীকে বশ করিতেছে। এই সভ্যতা পৃথিবীর যে জাতিকে স্পর্শ করিতেছে তাঁহারই আকৃতি ও প্রকৃতি হইতে নিজের বিশেষত্ব ঘুচিয়া যাইতেছে।’ তিনি জাপানের কথা উল্লেখ করেন। আধুনিক সভ্যতা পৃথিবীর সকল দেশের মানুষের কি ক্ষতি করছে, সে সম্বন্ধে বলছেন, ‘যুদ্ধপ্রণালী ব্যবসায়প্রণালী আজ পৃথিবীতে সকল দেশেই একাকার হইতেছে, ইহাতে আশ্চর্য নাই কেননা ও দুটো যন্ত্রমাত্র এবং যন্ত্রের রূপ সকল দেশে একই রকম হইবে বৈকি? কিন্তু মানুষের মন তো যন্ত্র নহে; … সে সমস্তই আপনার করিয়া লয়— মোটের উপর কাঠামোটা ঠিক থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বাল্যকালের শিক্ষায় আমরা ভাষার সাথে ভাব পাই না। আবার বয়স হইলে ঠিক তাঁহার বিপরীত ঘটে; যখন ভাব জুটিতে থাকে, তখন ভাষা পাওয়া যায় না।’
‘কিন্তু আজ পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষের নিজের মনের সঙ্গে তার নিজের তৈরি কলের সাংঘাতিক লড়াই বাধিয়া গেছে। মানুষের ব্যবহার্য দ্রব্যে তাঁহার মনের স্বাক্ষর কোথাও আর দেখাবার জো নাই, সর্বত্রই কলের ছাপ। এই কলের সন্ততিগণের মধ্যে কোথাও আর রূপভেদ নাই। সুলভতা ও সুবিধার প্রলোভনে মানুষ ইহা স্বীকার করিয়া লইয়াছে— সেই প্রলোভনে মানুষ নিজের মনের কর্তৃত্বকে নিজের সৃষ্টিশক্তিকে অস্বীকার করিতেছে।’ ‘য়ুরোপের সভ্যতার সেই রুচিস্বাতন্ত্র্যনাশক মরু হাওয়া ভারতবর্ষীয় শিল্পগুলিকে সবই প্রায় নষ্ট করিয়াছে।’ (পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৭০)। উদাহরণ স্বরূপ তিনি আইরিশ শিক্ষা ব্যবস্থার উল্লেখ করেন। ‘য়ুরোপের যে যুগকে অন্ধকার যুগ বলে, যখন বর্বর-আক্রমণের ঝড়ে রোমের বাতি নিবিয়া গেল, সেই সময়ে য়ুরোপের সকল দেশের মধ্যে কেবলমাত্র আয়র্লন্ডেই বিদ্যার চর্চা জাগিয়া রইল। কিন্তু যখন ইংলন্ড আয়র্লন্ড দখল করিয়া উনবিংশ শতাব্দীতে ‘ন্যাশনাল স্কুল’ প্রণালীর সুত্রপাত করিল তখন আয়র্লন্ডের স্বদেশী উন্নত শিক্ষা কাঠামো ভাঙ্গিয়া পড়িল। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আইরিশদিগকে জোর করিয়া স্যাকসনের ছাঁচে ঢালা এবং ইংরেজ করিয়া তোলাই ন্যাশনাল স্কুল-প্রণালীর মতলব ছিল। ফলে এই চেষ্টার ব্যর্থতা প্রমাণ হল। ভালোই বল আর মন্দই বল, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে এমন ভিন্ন করিয়া গডিয়াছেন যে এক জাতকে ভিন্ন জাতের কাঠামোর মধ্যে পুরিতে গেলে সমস্ত খাঁপছাড়া হইয়া যায়।’ ফলে যা হবার তাই হল। ‘আইরিশভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল, আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া।’
জাতীয় শিক্ষাপরিষদের সদস্যরা তাঁকে স্কুল-বিভাগের একটি গঠনপত্রিকা তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছিল। ‘শিক্ষা সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি বলেন যে কাজটি সহজ নয়। ‘জাতীয়’ বলতে কী বোঝায়, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘আমরা চাই, কিন্তু কী চাই, তাহা বাহির করা যে সহজ তাহা মনে করি না। এই সম্বন্ধে সত্য-আবিষ্কারের ‘পরেই আমাদের উদ্ধার নির্ভর করে। যদি ভুল করি— যেটা হাতের কাছেই আছে, আমরা যেটাতে অভ্যস্ত, জড়ত্ববশত যদি সেইটাকেই সত্য মনে করি, তবে বড়ো বড়ো নাম আমাদিগকে বিফলতা থেকে রক্ষা করিতে পারিবে না।’ তারপরেই বলছেন, ‘যদি শিক্ষিত সমাজের প্রচলিত সংস্কারের সঙ্গে ইহার বিরোধ বাঁধে তবে ইহা গ্রাহ্য হইবে না, জানি।’ ইস্কুল বলতে তিনি মনে করেন ‘একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন; ছাত্ররা দুই-চার পাতা কলে-ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে।… কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে, ঠিক ফর্মাশ-দেওয়া জিনিষটা পাওয়া যায়; এক কলের সঙ্গে আর-এক কলের উৎপন্ন সামগ্রীর বড়ো একটা তফাত থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়।’
‘কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের অনেক তফাত। তবু মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায় কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না।’ কল ‘তেল দিতে পারে, কিন্তু আলো জ্বালাইবার সাধ্য তাঁহার নাই।’ স্কুলে আমরা যা শিখি, তার সঙ্গে জীবনের, আশেপাশের, বাড়ীঘরের ও মানুষের সঙ্গে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই স্কুল বলতে রবীন্দ্রনাথের চোখে ভেসে ওঠে যা মনোহর নয়, তা ‘বারিক, পাগলাগারদ, হাসপাতাল বা জেলেরই এক গোষ্ঠিভুক্ত।’ তাই তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকদিন হইল একটা বিজ্ঞানসভা স্থাপন করিয়াছি; তাঁহার পরে বৎসরে বৎসরে বিলাপ করিয়া আসিতেছি দেশের লোক বিজ্ঞানশিক্ষায় উদাসীন। কিন্তু একটা বিজ্ঞানসভা স্থাপন করা এক, আর দেশের লোকের চিত্তকে বিজ্ঞানশিক্ষায় নিবিষ্ট করা আর। সভা ফাঁদিলেই তাঁহার পরে দেশের লোক বিজ্ঞানী হইয়া উঠিবে, এরূপ মনে করা ঘোর কলিযুগের কল-নিষ্ঠার পরিচয়।’ (চতুর্দশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩২৫)।
শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ
তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিলেন। তিনি পাদ্রী এডাম সাহেবের তিনটি শিক্ষা রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেন। মেকলে যখন ইংরেজি ভাষার সিঁডিভাঙ্গা শিক্ষা কাঠামোর প্রস্তাব করছেন, তখন বড় লাট উইলিয়াম বেন্টিকের নির্দেশে এডাম সাহেব তিনটি বড় রিপোর্ট পেশ করেন ১৮৩৫-৩৮ সালের মধ্যে। সেখানে তিনি দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেছিলেন যে জনগণকে যদি শিক্ষিত করে তুলতে হয়, তাহলে তা কেবল জনগণের মুখের ভাষার মাধ্যমেই তা সম্ভব। ইংরেজ আসার আগে এদেশের প্রতিটি গ্রামে সাধারণ জ্ঞান দেবার জন্য একলক্ষ পাঠশালা ছিল। কিন্তু মেকলের চাপে পড়ে বেন্টিক এডামের রিপোর্টটি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে নিক্ষেপ করেন। শুরু হয় এদেশের শিল্প-কারখনার মত শিক্ষা ব্যাবস্থার ধ্বংসসাধন।
অনেকেই অবশ্য বাংলাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আশুতোষ মুখার্জি। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বাঙালির ছেলে ইংরেজিবিদ্যায় যতই পাকা হোক, তবু শিক্ষা পুরো করবার জন্যে বাংলা শিখতেই হবে, ঠেলা দিয়ে মুখুজ্জেমশাই বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়কে এতটা দূর পর্যন্ত বিচলিত করেছিলেন।’ (পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্টা, ৪২৩)। বাংলা ভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে তিনি বলেন, ‘একদা মধুসূদনের মতো ইংরেজি-বিদ্যায় অসামান্য পণ্ডিত এবং বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বিজাতীয় বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র এই মুখোশের ভিতর দিয়ে ভাব বাৎলাতে চেষ্টা করেছিলেন; শেষকালে হতাশ হয়ে সেটা টেনে ফেলে দিতে হল।’ (ত্বদেব, পৃ-৪২৭)। লেখাটা তিনি লিখেছিলেন ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
আজ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে মনে হয় আমাদের রাষ্ট্র যদি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শনের দিকে ফিরে তাকাতো, তাহলে হয়তো আমাদের শিক্ষার এই করুণ অবস্থা হত না। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের দেশে যতটা জনপ্রিয়, রবীন্দ্র-চর্চা ততটাই অবহেলিত। রবীন্দ্রনাথ যা চাননি, আমরা তাই করেছি। রবীন্দ্রনাথকে আমরা কেবল পাঠ্য পুস্তকভুক্ত করে জাতীয় জীবন থেকে তাঁকে বিসর্জন দিয়েছি।
এতে রবীন্দ্রনাথের কোন ক্ষতি হয়নি। হয়েছে আমাদের।
মোহম্মদপুর, ঢাকা
৫ আগস্ট, ২০২০