রোকন রকি
মৃত্যুপুরীতে দুঃসময়
আমারে তালা বদ্ধ রেখে
আমারে আগুনে পুড়িয়ে মেরে
প্রেসনোট, শুধু প্রেসনোট আমি চাই না
–কফিল আহমেদ
একটা পরিকল্পিত মৃত্যুকূপ তৈরি করা হয়েছে। একটা কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ভেতর আটকে রেখে খুন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে কোটি কোটি মানুষকে। তারপর হিসেব করা হচ্ছে লাশের সংখ্যা। দৃশ্যমান ভাইরাস নিজের অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করে প্রতিদিন প্রেসনোট দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে অদৃশ্যমান ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা গেছে, কতজনকে ঘরবন্দী করেছে, মানুষকে ঘরবন্দী করতে কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে। এক নিশ্চিত মৃত্যু উপত্যকায় বসে মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছে। আর এই আতঙ্কগ্রস্থ মানুষের মাঝে ক্রমাগত ভয়ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে ক্রমাগত অসহায়ত্বের বোধ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে।
তারপর রক্ষকের ভূমিকায় থেকে অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধবাজ দৃশ্যমান ভাইরাস ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করে মানুষের সামগ্রিক চিন্তার ফোকাসকে একমুখি করে তুলছে।১ যেন এর পেছনে আর কারো কোন দায় নাই। পৃথিবীর মেইন্টেনেন্সের দায়িত্ব নিয়ে রাখা ঠিকাদাররা যেন পৃথিবীটাকে স্বর্গে রূপান্তর করেছিল, করোনা ভাইরাস হঠাৎ এসে তা নষ্ট করেছে। মানুষের চৈতন্যকে এই পথে চালোনা করার ফলে প্রাণ-প্রকৃতি বিরুদ্ধ যে অবকাঠামো এই ভাইরাসের বিস্তৃতিতে সহায়ক হয়েছে তা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
কিন্তু এই তাৎক্ষণিক ভয়াবহতা কেটে গেলে আমাদের এই প্রশ্নে ফিরে আসতেই হবে যে কোন অবস্থায় এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং কোন অবস্থায় তা এতো ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয়? সুন্দর এক নতুন পৃথিবী নির্মাণের প্রয়োজনে এই ভয়াবহাতার মাঝেই আমাদের জেনে নিতে হবে এই সভ্যতার সঙ্কটগুলো। যেহেতু পরিবেশবাদীরা হুশিয়ার করে বলছেন, এটাই শেষ মহামারী নয়। যদি আমরা আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি বিরুদ্ধ মানুফাকেন্দ্রিক কার্যক্রম জারি রাখি তাহলে অতিশীঘ্রই এরকম আরো বেশ কিছু মহামারির কবলে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
বিশ্বব্যাপি কোভিড-১৯ এর প্রতাপ ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। আমরা দেখছি বড় পুঁজির ওয়েল ইকুয়িপড রাষ্ট্রগুলো তুলনামূলক উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। আমাদের এখানে এখনো পরিস্থিতির ভয়াবহতা অতোটা দৃশ্যমান হয়ে না উঠলেও শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় পাওয়ার পরও একদম শুরু থেকে আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অব্যবস্থাপনা দেখেছি। দেখেছি নাজুক চিকিৎসা ব্যবস্থা, পলকা অর্থনীতি, শ্রমনির্ভর শিল্প কারখানায় মালিক পক্ষের মাস্তানি, জনমানুষের হক মেরে খাওয়া ক্ষমতার শোষণ। করোনার আগমন সামগ্রিক অব্যবস্থাপনাকে স্পষ্ট করে চোখের সামনে তুলে ধরছে। সম্ভাব্য ভয়াবহতা মোকাবেলায় বড় ধরনের খেসারত দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
অথচ ইতালি, আমেরিকা, স্পেইন, ফ্রান্সের ভয়াবহ মহামারি পরিস্থিতি দেখে আমরা বাংলাদেশিরা হয়তো কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলছি। কারণ আমাদের রাষ্ট্রনেতারা বার বার সেসব দেশের পরিস্থিতিকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন আমাদের পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো। কিন্তু একটু চোখ কান খোলা রাখলেই এদেশের প্রকৃত পরিস্থিতির ভয়াবহতা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা ট্রিবিউন এক রিপোর্টে জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশে প্রথম ২০০০ জন আক্রান্ত হতে সময় লেগেছে মাত্র ৪০ দিন। যা ইতালি বাদে উপরে উল্লেখিত অধিক সংক্রমিত দেশ গুলোর চেয়ে দ্রুততম সময়ে ঘটেছে। একই রিপোর্টে আরো জানাচ্ছে বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার হার দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর সর্বনিম্ন এবং সমগ্র পৃথিবীর ভেতর নিম্ন হারের দিক থেকে ১৪তম। অর্থাৎ এই উন্নয়নের দেশ সমগ্র পৃথিবীর মাত্র ১৩টা দেশের চেয়ে বেশি করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করতে পেরেছে। তারপরেও এই অল্প সংখ্যক পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা ২০০০ জন আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অধিক সংক্রমিত দেশ গুলোর চেয়ে দ্রুততম সময়ে ঘটেছে। তার উপর এখানে আজ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুস্থ হওয়ার হারের চাইতে মৃত্যু হার বেশি।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে প্রতিদিনের বাগাড়ম্বর প্রেস ব্রিফিংয়ের বাইরে প্রকৃত পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। এবং তা সামাল দেওয়ার ব্যবস্থাদির বেহাল দশা এই সামগ্রিক ভয়াবহতার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।
এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সঙ্কটই প্রধান চিন্তার বিষয়। কিন্তু সম্ভাব্য বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির পরের পৃথিবীটাকে গড়তে আরো কিছু বিষয়ের বোঝাপড়াটাও জরুরি। রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বকে তদরকি করা, প্রশ্ন করা, সমালোচনা করা, সমাধান বাতলে দেওয়া এবং সমাধান করতে বাধ্য করা যেমন এই সময়ের একটা জরুরি কাজ, ঠিক তেমনই রাষ্ট্রের কোন অব্যবস্থাপনা এই বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির সম্ভাবনা তৈরি করেছে তা খুঁজে বের করা, চ্যালেঞ্জ করা, সমাধানের পথ খোজার চেষ্টা করা এবং সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়াও এই সময়ের দাবি।
মৃত্যুপুরীর অবকাঠামো
ঘরে থাকো, ঘরে থাকো, ঘরটা যে কই?
এখনো সে পথে পথে করে টই টই!
-সমগীত
আমরা সকলেই জানি যে, সংক্রামক ব্যাধির বিস্তারে জনঘনত্ব অত্যাধিক সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অতুলনীয় অবস্থানে আছে। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১১১৬ জন, যা সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ।২ এটাকে অনগ্রসর সামাজিক পরিস্থিতির ফল হিসেবে দেখা যেতেই পারে, যদিও এর সাথে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির গভীর সংযোগ আছে। কিন্তু তার বাইরে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো এই জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণ এবং জীবন মানকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। এই অবকাঠামো কতটা জনবান্ধব আর কতটা মৃত্যুবান্ধব তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ দরকার।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ভিড় করে গড়ে উঠেছে দেশের সার্বিক কর্মতৎপরতা। এই অঞ্চলগুলোকে কেন্দ্র করে শিল্প কারখানা, অফিস আদালত, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে শতশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সব অবকাঠামোর গড়ে উঠেছে। পুঁজির বিকাশের সাথে সাথে বিকশিত হচ্ছে এই মুনাফামুখিন অবকাঠামো। যা মানুষজনকে বাধ্য করছে তার দ্বারস্থ হতে। প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব জীবিকা ধ্বংস হচ্ছে মুনাফামুখি বিধ্বংসী শিল্পায়নের বিকাশে। বন-জঙ্গল, নদী-নালা, আবাদি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। বেকার হয়ে পড়ছে এর উপর নির্ভরশীল বিপুল সংখ্যক লোকজন। যারা এখনো টিকে আছে তারাও অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ফলে কর্মহীন গরিব থেকে গরিব হতে থাকা মানুষজন, অনিশ্চয়তা থেকে গোলামির শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া মানুষজন, অর্থবিত্তর মরীচিকায় মোহগ্রস্ত মানুষজন দলে দলে ভিড় করছে এই শহরগুলোতে। কেউ দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তা পেতে, কেউ গোলামি করতে বা অধিকতর ভালো গোলাম হয়ে জীবিকার নিশ্চয়তা পেতে, আবার কেউ উদ্দেশ্যহীন মোহগ্রস্ত হয়ে। সমগ্র দেশ থেকে, অধিকাংশটা বাধ্য হয়ে এবং কিছুটা ভ্রমে পড়ে, দলে দলে ছুটে যাচ্ছে এই কেন্দ্রীভূত শহরে।
বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড সিটিস রিপোট থেকে জানা যায় এই অতিকায় মহানগরী ও রাজধানী শহরে প্রায় ১ কোটি ৯৫ লক্ষ মানুষের বসবাস। এ রিপোর্টে আরো বলেছে, এ শহরে মানুষের সংখ্যা এতো দ্রুত এবং ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে ২০৩০ সাল নাগাদ তা আরো ১ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২ কোটি ৮০ লক্ষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আয়তন অনুপাতে এতো বিপুল সংখ্যক লোকসংখ্যার ফলে দেখা গেছে এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যাধিক বেশি। উপরে উল্লেখিত জনসংখ্যার হিসাবে এখানে প্রায় প্রতি বর্গমাইলে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার লোকের বসবাস। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা এই শহরকে এই ভাবে কেন্দ্রীভূত করেছে যে প্রায় সব ধরনের সুবিধা এবং সেবা একটু ভালো ভাবে পেতে অনেকটা বাধ্য হয়ে এখানে পাড়ি জমাতে হয়। অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে ভালো চিকিৎসা সেবা নেই, এই শহরকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে সব মন্ত্রনালয়, সরকারি বেসরকারি শতশত প্রতিষ্ঠান এবং তাদের প্রধান কার্যালয় এখানে, প্রায় সবগুলো বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাস এই শহরে এবং এই শহরেই গড়ে উঠেছে শতশত শিল্প কারখানা।
ঢাকার গা ঘেসে নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চল। স্থানীয় সরকারের হিসাব মতে বর্তমানে এখানে লোকসংখ্যা ৫০ লক্ষেরও অধিক। আয়তনের দিক থেকে ছোট এই জেলায় ৫০ লক্ষ জনসংখ্যা ধরে নিলে জনসংখ্যার ঘনত্ব দাঁড়ায় প্রতি বর্গ মাইলে প্রায় ১৯ হাজার। এছাড়াও ছোট বড় সব মিলিয়ে কয়েকশ শিল্প কারখানা এই জেলায় গড়ে ওঠায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে ভিড় করেছে আরো প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিক।
প্রায় একই রকম চিত্র দেখা যায় রাজধানী ঢাকার স্পর্শে গড়ে ওঠা শহর গাজীপুরেও। এর বর্তমান জনসংখ্যা সঠিক ভাবে জানা যায়নি। তবে রাইসিং বিডি অনলাইন পোর্টালে গত ২৮ অক্টোবর ২০১৯এ এক রিপোর্টে জানাচ্ছে যে গাজীপুর প্রায় ৮০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি অঞ্চল। ভারি ও মাঝারি শিল্প কারখানা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দুই বড় বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে এক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে গাজীপুর। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, শিক্ষার্থী সহ নানা রকম কর্মজীবী মানুষ নিয়ে একটা কেন্দ্রীভূত ঘিনঘিনে অস্বাস্থ্যকর স্থান হয়ে উঠেছে।
মৃত্যুপুরীর আর্তনাদ
আমিও পেতেছি কান,
শুনি বৃক্ষের ক্রন্দন
ধূসর রাজপথের প্রান্তরে।
–মেঘদল
এই কেন্দ্রীকরণ নানা রকম সমস্যা সহ আজকের সম্ভাব্য করোনা মহামারীর ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যতসামান্য টেস্টের মাধ্যমে দেওয়া সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের হারের দিকে নজর দিলে দেখতে পাওয়া যাবে দেশের ভেতর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কেন্দ্রীভূত অবকাঠামোর এই তিনটা শহরে। আইইডিসিআর এর দেওয়া তথ্যমতে ২১ এপ্রিল সকাল ৮টা পর্যন্ত সব চাইতে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকাতে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ১২২৯ জন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল নারায়ণগঞ্জে ৪৬৯ জন এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল গাজীপুরে ২৬৯ জন। এই দেশে কোভিড-১৯ এর অতিমাত্রায় বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরির হওয়ার পেছনে এই অবকাঠামোর কেন্দ্রীকরন বিশেষ ভাবে দায়ি।
এরকম পরিস্থিতিতে ঘন হয়ে বসবাস করায় একে অপরের সাথে অধিক ছোঁয়াছুঁয়ি, ঘেঁসাঘেঁসি এবং স্পর্শের ঘটনা ঘটে শুধুমাত্র এই কারণেই এই ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় ব্যাপারটা তেমন না। বরং এই অবকাঠামোর আরো নানাবিধ পার্শপ্রতিক্রিয়া এর পেছনে কাজ করে।
এই অবকাঠামো মূলত পুঁজিবাদী অবকাঠামো। ফলে এখানে মানুষের চাইতে গুরুত্ব বেশি মুনাফার। এটা কেবলই মুনাফার প্রত্যাশায় এর কর্মতৎপরতা চালায়। মানুষ, মানুষের জীবন, প্রাণ-প্রকৃতি এই মুনাফার চাহিদার কাছে সব সময় উপেক্ষিত। সারাদেশ থেকে আশা এই বিপুল সংখ্যক মানুষজন, বিশেষ ভাবে নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা, এখানে অমানসিক পরিশ্রমের পর যে কয়টাকা পায় তা দিয়ে প্রতিটা মাস পার করতে হিমসিম খেতে হয়। মাস শেষে টাকা কয়টা হাতে পাওয়ার পরে তা থেকে প্রথমে একটা বড় অংশ দিয়ে দিতে হয় স্যাঁতসেতে, অন্ধকার, গাদাগাদি করে থাকা ঘরটার ভাড়া হিসেবে। তারপর মুদি দোকানে গতমাসের শেষের দিন গুলোর বকেয়া পরিশোধ করে এবং গ্রামে পরিবার পরিজনের জন্য সামান্য কিছু পাঠিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে মাস পার করতে হয় এদের অধিকাংশকে। এই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তাদের সাংসারিক বাজেটে ঘাটতি বাজেট পুরণ করতে যে কায়দা-কানুনের আশ্রয় নেয় তা রীতিমত অর্থনীতির গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হতে পারে। যেখানে তিন বেলা খাবার জোগাড় করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে সেখানে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রেশনের ব্যবস্থা করার কথা চিন্তাতেও আসে না। ফলে বরাবরই তারা শারীরিক ভাবে অপুষ্টিতে ভোগে।
একই সাথে দেখা যায় এই প্রকৃতি বিরুদ্ধ শিল্পায়ন ও কেন্দ্রীভূত অবকাঠামো মানুষ সহ জীববৈচিত্র্যের জন্য অসম্ভব ক্ষতিকর পরিবেশ তৈরি করে। আজকের এই লকডাউনের দিনেও সারা পৃথিবীর ভেতর ঢাকা দূষিত শহরের র্যাংকিং–এ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে।৩ এনভায়রনমেন্টাল পরফরম্যান্স ইনডেক্স এর একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে পরিবেশ সুরক্ষার র্যাংকিং-এ সারা বিশ্বের ১৮০টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯ অর্থাৎ শেষের দিক থেকে দ্বিতীয়। উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ের গবেষক মাহা মির্জা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখাচ্ছেন যে, ‘ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম আর সিসার দূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে৪। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় সিসাদূষণের শিকার ছয় লাখ মানুষ (বেশির ভাগই শিশু)৫ এবং দেশের ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের দেহে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটছে৬। এ ছাড়া পরপর কয়েক বছর ধরেই ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস-অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যেও অন্যতম শীর্ষে৭।’
আন্তাজাতিক সংবাদ মাধ্যম দি গার্ডিয়ান ২০ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, গবেষণা মতে সম্ভবত অত্যাধিক বায়ুদূষণ কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুতে অধিক ভূমিকা রাখছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতালি, স্পেইন, ফ্রান্স ও জার্মানির ৬৬টি প্রদেশের করোনায় মৃত্যুর হারকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ৭৮ শতাংশ মৃত্যুই ঘটেছে এই প্রদেশ গুলোর ভেতর মাত্র ৫টি প্রদেশে, যেগুলো অতিমাত্রায় দূষিত। এই প্রতিবেদনের সাথে বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হারকে মিলিয়ে দেখলে দূষণে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের অবস্থা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।
এছাড়াও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ফলে সংক্রামক ব্যাধি সহ নানা রকম রোগ ব্যাধি আমাদের অপুষ্টিতে ভোগা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন শরীর গুলোকে আক্রান্ত করে এবং আমাদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়; আমাদের মৃত্যুর সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। উপরে উল্লেখিত কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের হার যেমন এই পরিস্থিতির সত্যতা নিশ্চিত করে তেমনই আক্রান্তদের মাঝে সেরে উঠা এবং মারা যাওয়ার আনুপাতিক হার দেখেও তা বোঝা যায়। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে দেখানো মোট আক্রান্তের মাঝ থেকে সেরে উঠেছে ৮৭ জন এবং মারা গেছে ১১০ জন। অর্থাৎ ক্লোসড কেসের ভেতর ৪৪.১৬ শতাংশ সুস্থ হয়েছে এবং ৫৫.৮৪ শতাংশ মানুষ মারা গেছে। তার মানে আক্রান্ত হলে আমাদের প্রত্যেকের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৪৪.১৬% এবং মারা যায়ার সম্ভাবনা ৫৫.৮৪%।
চায় সোনার কাঠির অনুসন্ধান
জল, জমি, জঙ্গল, পশুর আর ইরাবতি
সুন্দরী ও দুখু হারালে দেশের ক্ষতি।
-স্বরব্যাঞ্জো
কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে এই অবকাঠামোগত মৃত্যুপুরী শুধুমাত্র সংক্রামক রোগের মাধ্যমেই আমাদের মারে না। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগেও এই কেন্দ্রীভূত পুঁজিবাদী অবকাঠামোতে স্লো পয়জনিং-এর মাধ্যমে আমরা তিলে তিলে মারা যাচ্ছিলাম। এটা করোনার পূর্বেরও যে কোন মুহুর্তের জন্য সত্য। আজ করোনা নতুন যা করেছে তা হচ্ছে এই পরিস্থিতিটাকে বুঝতে সাহায্য করেছে। একই রোগে একই সময়ে এতো বিপুল সংখ্যক আক্রন্ত হওয়ায় এই অবকাঠামোর গলদটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে।
এই অবকাঠামো যেমন গণহারে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার জন্য, আক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়ার জন্য বড় ভূমিকা রেখেছে, একই সাথে এটা সংক্রামক ব্যাধি ছাড়াও গণহারে মৃত্যুর নিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এখানে আগুন লেগে হাজারে হাজারে মানুষ মরে, বিল্ডিং ধসে হাজার হাজার মানুষ মরে, যানজটপূর্ণ রাস্তাঘাটে প্রতিদিন গাড়ির তলায় পিষ্ট হয়ে মানুষ মরে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয়ে শয়ে মানুষ মরে, এই অবকাঠামোতে স্রেফ না খেতে পেয়েও, কেড়ে খেতে যেও মানুষ মরে। রানা প্লাজার, তাজরিন গার্মেন্টসের, পুরান ঢাকার আগুন বা ভদ্র পাড়ার এফ আর টাওয়ারের বীভৎস স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে। হর হামেশা ছোটলোক শ্রমিকের বস্তি পোড়ার খবরে তো আমরা প্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এই বিধ্বংসী অবকাঠামো করোনার মতো প্রাণঘাতী ব্যাধির মাধ্যমে লাখে লাখে মানুষকে এক ধাক্কায় মেরে ফেলছে আবার এই একই অবকাঠামো স্লো পয়জনিং –এর মাধ্যমে তিলে তিলে লাখ লাখ মানুষকে মেরে ফেলেছে, মেরে ফেলছে।
অপরদিকে মানুষ ও প্রকৃতির লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গড়ে ওঠা অবকাঠামোতে উপকৃত হচ্ছে অল্প কিছু সুবিধাভোগী। চিকিৎসা ক্ষেত্রে, বসবাসের ক্ষেত্রে, শিক্ষা ক্ষেত্রে এরকম জীবন ধারণের প্রতিটি বিষয়ে কিছু সংখ্যালঘু মুনাফাভোগী বিশেষ সুবিধা ভোগ করছে। এই করোনা কালেও তা স্পষ্ট ভাবেই বুঝতে পারা যায় যখন দেখি স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাসচিব বলছেন, ভিআইপিদের করোনা চিকিৎসার জন্য থাকবে আলাদা আইসিউ এবং আলাদা হাসপাতাল, যখন দেখি যোদ্ধা ঘোষণা করা ডাক্তারদের জোর জবরদস্তির মাধ্যমে অনিরাপদ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়ে আইইডিসিয়ার এর দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক কোন কারন ছাড়া অধিক নিরাপাত্তার জন্য কোয়ারেন্টাইনে গেছেন, যখন দেখি প্রণোদনার নামে সরকারি ঋণ সুবিধায় বড় পুঁজির ব্যবসায়ী এবং প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষেত্রে প্রায় একই হারে সুদ ধার্য করা হয় এবং কোন কোন ব্যবসায় খাতের চাইতে কৃষিখাতের ধার্যকৃত সুদের হার বেশি থাকে।
অতএব বাঁচতে হলে আমাদের এখনই ভাবেত হবে আমরা কোন সভ্যতা চাই। কোন অবকাঠামোগত পরিবর্তন মানুষবান্ধব হবে, পরিবেশ বান্ধব হবে। যুথবদ্ধ বসবাসের অর্থ দম বন্ধ হওয়া ঘনবসতির জীবন না, নয়া উদারবাদের নয়া দাসত্বের জীবন না। আমাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে কিন্তু থাকতে হবে সামাজিক ভাবে সংযুক্ত। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও কর্পোরেশনের বিপরীতে হয়ে উঠতে হবে স্বনির্ভর এবং সমাজনির্ভর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিকে স্বীকার করে এবং প্রয়োজনমত সাথে নিয়েই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব জীবন যাত্রায়। এই অবকাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন ভাবে ঢেলে সাজাতে হবে এমন ভাবে যেন আমাদের জীবন যাত্রা হয়ে উঠে প্রকৃতি নির্ভর এবং প্রকৃতিবান্ধব। যেন আমাদের কারণে আজকের মতো প্রকৃতিকে ভুগতে না হয় এবং প্রকৃতির কোন উপাদানের কারণেও যেন আমাদের আজকের মতো ভোগান্তির পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়।
তথ্যপঞ্জি
১. যুদ্ধ পরিস্থিতি মঞ্চায়ন করে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়েছে জনমানসকে। এই যুদ্ধে ভাইরাসকে শত্রু নির্ধারন করা হয়েছে, ডাক্তার, পুলিশ, আর্মি, র্যাবকে যোদ্ধা ঘোষণা করা হয়েছে, কোরেন্টাইনের নির্দেশনা অমান্য করা মানুষকে নির্ধারণ করা হয়েছে বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে।
২. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো; বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০১৮; ২০১৯
৩. আইকিউ এয়ার; ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি; ২১ এপ্রিল, ২০২০; বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪:৩৫।
৪. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ, ২০১৮
৫. বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭, বিশ্বব্যাংক
৬ ক্যানসার কন্ট্রোল ইন বাংলাদেশ, জাপানিজ জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি (জেজেসিও), ২০১৫
৭. গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স, ২০১৭