অনুবাদ: সেলিম রেজা নিউটন
বুর্জোয়া রাজনীতির সাথে– এমনকি সবচাইতে র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া রাজনীতির সাথেও– যেকোনো ধরনের মৈত্রী আমরা জোরের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছি। বোকার মতো এবং মানহানিকরভাবে অতিরঞ্জিত করে বলা হয়েছে, আমরা যে এই সমস্ত প্রকার রাজনৈতিক গুপ্ত ষড়যন্ত্র বর্জন করে আসছি সেটা নাকি এই জন্য যে, মুক্তির প্রশ্নে আসলে আমাদের কোনো আগ্রহই নাই– আমরা শুধু সমস্যার অর্থনৈতিক আর বস্তুগত দিক নিয়েই ভাবি। ঘোষণা করা হয়েছে যে, এর ফলস্বরূপ আমরা আমাদেরকে প্রতিক্রিয়ার কাতারে এনে বসিয়েছি। ব্রাসেল কংগ্রেসে একজন জার্মান প্রতিনিধি এই মনোভাবের ধ্রুপদী প্রকাশ ঘটিয়েছেন। একথা বলার স্পর্ধা তিনি দেখিয়েছেন যে, মানুষটা যে-ই হোন না কেন, জার্মান সোশাল-ডেমক্রেসির সুরে সুর মিলিয়ে যদি তিনি কবুল না করেন যে ‘রাজনৈতিক অধিকার (ক্ষমতা) জয় করে নেওয়াটা হচ্ছে সামাজিক মুক্তির প্রাথমিক শর্ত’,তাহলে–সচেতনভাবেই হোক আর অসচেতনভাবেই হোক–তিনি সিজারদের মিত্র!
এই সমালোচকেরা নিজেরাই নিজেদেরকে ব্যাপকভাবে প্রতারিত করেন এবং আমাদের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনকেও ঠকানোর চেষ্টা করেন– ‘সচেতনভাবেই হোক আর অসচেতনভাবেই হোক’। মুক্তি আমরা ভালোবাসি– তারা যতটা ভালোবাসেন তার চে অনেক বেশি। মুক্তি আমরা ভালোবাসি ততদূর পর্যন্ত, যতদূর পর্যন্ত গেলে তা পূর্ণাঙ্গ আর সামগ্রিক হয়ে উঠতে পারে। আজগুবি কল্পনা নয়, বাস্তবটাই আমরা চাই। এই জন্য আমরা সমস্ত বুর্জোয়া মৈত্রী প্রত্যাখ্যান করি, কেননা আমরা মানি যে, বুর্জোয়াদের সহযোগিতায়– তাদের রাজনৈতিক উপায়-উপকরণ-অস্ত্রপাতির সাহায্যে, অথবা যারা তাদের রাজনৈতিক ছলনার শিকার তাদের সাথে মৈত্রীবন্ধনের সাহায্যে– ছিনিয়ে নেওয়া মুক্তি জনাব বুর্জোয়া মহোদয়গণের জন্যই লাভজনক বলে প্রমাণিত হবে,কিন্তু শ্রমিকদের জন্য কখনোই সেটা অলীক কেচ্ছর চেয়ে বেশি কিছু হবে না।
সমস্ত পার্টির জনাব বুর্জোয়া মহোদয়গণ, এঁদের মধ্যে সবচাইতে অগ্রসরেরাও আছেন, যত বিশ্বজনীনই তাঁরা হোন না কেন, প্রশ্নটা যখন হয় জনগণের শ্রম আরও বেশি বেশি শোষণ করার মাধ্যমে টাকা কামাই করার প্রশ্ন, তখন তাঁরা সকলেই রাষ্ট্রের প্রতি দেশপ্রেমিক অনুরাগের ক্ষেত্রে একইরকম তীব্র আবেগে মথিত আর অতিশয় গোঁড়া হয়ে ওঠেন। বাস্তবে দেশপ্রেম হচ্ছে জাতীয় রাষ্ট্রের জন্য তীব্র আবেগ-অনুভূতি আর পূজা– এছাড়া অন্য কিছুই না। সম্প্রতি এমনটাই বলেছেন প্যারিসের প্রলেতারিয়েতদের অত্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক ঘাতক এবং ফ্রান্সের বর্তমান রক্ষাকর্তা জনাব থিয়ার্স। যে-কেউ যখন বলে ‘রাষ্ট্র’ তখন সে আধিপত্যের কথা বলে; যে-কেউ যখন বলে ‘আধিপত্য’ তখন যে শোষণের কথা বলে। এ থেকে প্রমাণিত হয়: যা এখন জার্মান সোশাল-ডেমক্রেসির বুলিতে পরিণত হয়েছে এবং দুঃখজনকভাবে আজও যা বজায় থাকছে সেই লোকসম্মত রাষ্ট্র বা ‘জনগণের’ রাষ্ট্র হচ্ছে একটা হাস্যকর অসঙ্গতি, একটা অলীক কাহিনী, একটা মিথ্যা। যারা এই ‘জনগণের’ রাষ্ট্রের উচ্চপ্রশংসা করে বেড়ায়, সন্দেহ নাই যে তারা এ-মিথ্যার ব্যাপারে অসচেতন– কিন্ত প্রলেতারিয়েতের জন্য এটা খুব বিপজ্জনক একটা ফাঁদ।
যত জনপ্রিয় চেহারাই ধারণ করুক না কেন, রাষ্ট্র সবসময়ই আধিপত্য আর শোষণের একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং সেই সূত্রে আমজনতার দারিদ্র্য আর দাসত্বের স্থায়ী একটা উৎস হিসেবে বিদ্যমান থাকবে। তার মানে হলো: জনগণকে অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিকভাবে মুক্ত করার এবং তাদেরকে একই সঙ্গে একই মুহূর্তে স্বাধীনতা আর ভালো-থাকা দুইটাই দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র, সকল রাষ্ট্র, বিলুপ্ত করে দেওয়া– এবং সেটা করার মাধ্যমে, যে-বস্তুকে এতকাল যাবত ‘রাজনীতি’ নামে ডাকা হয়ে আসছে, [খোদ] সেই বস্তুটাকেই চিরদিনের মতো খুন করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই। রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রকর্মের ভেতর আর বাহির–উভয় দিককার কার্যকলাপ এবং তার সুস্পষ্ট অভিপ্রকাশ। অর্থাৎ, বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণীসমূহের সপক্ষে আমজনতাকে শোষণ করার এবং তার উপর আধিপত্য চালানোর আচার-অনুষ্ঠান-অনুশীলন তথা আর্ট এবং বিজ্ঞানের নাম রাজনীতি।
এটা বলা তাহলে সঠিক নয় যে, রাজনীতিকে আমরা বিমূর্তভাবে বিবেচনা করি। রাজনীতির কোনো বিমূর্তায়ন আমরা ঘটাই না, কেননা অবশ্য-অবশ্যই আমরা একে হত্যা করতে চাই। আর এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা যার উপর ভিত্তি করে রাজনীতিবিদ এবং র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীদের থেকে আমরা আমাদেরকে পৃথক করে দেখি। (র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীরা এখন সামাজিক গণতন্ত্র বা র্যাডিক্যাল গণতন্ত্র আকারে কাজ চালাচ্ছে, যা আসলে পুঁজিবাদপন্থী গণতন্ত্রেরই উপরকার মিথ্যা চেহারা মাত্র।) বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীদের নীতি গড়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির রূপান্তর ঘটানো নিয়ে– এর ব্যবহার-প্রয়োগ-উপযোগিতা আর সংস্কার নিয়ে। আমাদের নীতি, [এক্ষেত্রে] একমাত্র যে-নীতি আমরা কবুল করি, সেটা গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের বিলোপ ঘটানো নিয়ে– এবং রাজনীতির বিলোপ ঘটানো নিয়ে, যা কিনা রাষ্ট্রেরই আবশ্যিক অভিপ্রকাশ।
এই যে খোলাখুলিভাবে আমরা রাষ্ট্রের বিলোপ চাই, শুধুমাত্র এই কারণেই আমরা বিশ্বাস করি যে, নিজেদেরকে আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী বলে ডাকার অধিকার আমাদের আছে; কেননা রাজনীতির সাথে সম্পর্ককে আমরা যেভাবে দেখি সেভাবে না-দেখে অন্যভাবে যিনি দেখেন, আমাদের মতো করে যিনি রাজনীতির সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন না– তিনি যে-ই হোন না কেন, দেশপ্রেমিক এবং বুর্জোয়া একটা রাষ্ট্রের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে তিনি বাধ্য। অন্য কথায় বললে, শুধুমাত্র এই ঘটনাটার মধ্য দিয়েই, তিনি তাঁর বিশাল বা ক্ষুদ্র জাতীয় রাষ্ট্রের নামে পরিত্যাগ করেন [সকল দেশের] সকল জনগণের মানবীয় সংহতি, সেই সাথে পরিত্যাগ করেন তাঁর নিজ দেশের গণমানুষের অর্থনৈতিক আর সামাজিক মুক্তির প্রশ্নটাকেও।
অনুবাদ: নভেম্বর ২০০৬