অরাজ
আর্টওয়ার্ক: কংগ্রেস অব কমিনটার্ন শিল্পী: কুস্তদিয়েভ
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। আন্তর্জাতিকের সংগঠন

মিখাইল বাকুনিন।। আন্তর্জাতিকের সংগঠন

অনুবাদ : খোইরোম রুধির

জনগণই সামাজিক শক্তি, বা অন্তত সেই শক্তির সারসত্তা। কিন্তু সেই জঘন্য শর্তগুলো যা তাদের নিপীড়ন-নিগ্রহ করে তা থেকে মুক্তির জন্য তাদের দুটো জিনিসের কমতি আছে— শিক্ষা ও সংগঠন। এই দুটো জিনিসই বর্তমানে সকল সরকারের ক্ষমতার প্রকৃত ভিত্তি।

মিখাইল বাকুনিন

রাষ্ট্রের সামরিক ও শাসন ক্ষমতার বিলুপ্তি ঘটাতে প্রলেতারিয়েতদের অবশ্যই সংগঠিত হতে হবে। কিন্তু যেহেতু জ্ঞান ব্যতীত সংগঠনের অস্তিত্ব থাকে না সেহেতু জনসাধারণের মধ্যে প্রকৃত সামাজিক শিক্ষার বিস্তার জরুরি।

আন্তর্জাতিকের লক্ষ্যই হচ্ছে এই প্রকৃত সামাজিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো। যেদিন আন্তর্জাতিক ইউরোপের শ্রমীজীবী মানুষের অর্ধেক,এক চতুর্থাংশ কিংবা অন্তত এক দশমাংশকে একত্রিত করতে সক্ষম হবে সেদিন থেকেই রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রসমূহের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠবে। যেহেতু আন্তর্জাতিকের লক্ষ্য নতুন রাষ্ট্র গঠন নয় বরং বিদ্যমান সকল শাসনব্যবস্থার বিলোপ সাধন, সেহেতু আন্তর্জাতিকের সংগঠন সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের সংগঠন থেকে ভিন্ন ধাঁচের হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা যতই মেকি, বর্বর ও কর্তৃত্বপরায়নণ হবে ততই জনগণের স্বাভাবিক বিকাশ, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি উদাসীন ও বিরোধপূর্ণ হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিকের সংগঠন হতে হবে আরও বেশি স্বাধীন ও স্বাভাবিক। জনগণের সহজাত প্রবৃত্তি ও আদর্শগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।

কিন্তু জনসাধারণের স্বাভাবিক সংগঠন বলতে আমরা কী বুঝাচ্ছি? এর দ্বারা আমরা জনসাধারণের প্রাত্যহিক জীবনযাপন ও পেশাবৈচিত্রের অভিজ্ঞতা ও ফলাফলের ভিত্তিতে গড়ে উঠা সংগঠনকে বুঝাচ্ছি, যেমন জনগণের শিল্প-কারখানাভিত্তিক সংগঠন। জনসাধারণের সংগঠন তখনই পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করবে যখন উৎপাদন-শিল্পের সকল শাখার প্রতিনিধিত্ব তৈরি হবে তাদের আন্তর্জাতিকে।

কিন্তু এটা হয়তো বলা চলে যে, যেহেতু আমরা অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বিরাজমান রয়েছে, এবং জনসাধারণের উপর আমরা সুসংহত প্রভাব বিস্তার করছি: ফলে পুরাতন রাজনীতিবিদদের সমকক্ষ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠাই আসলে আমাদের লক্ষ্য। এমন ধারণা আসলে মস্ত বড় ভুল। জনগণের মাঝে ক্রিয়াশীল যেকোনো প্রকার সরকারি ক্ষমতার সাথে জনসাধারণের উপর আন্তর্জাতিকের প্রভাবের পার্থক্য রয়েছে। কোনোপ্রকার কর্তৃত্ব ছাড়াই, সাধারণ চিন্তাগুলোর স্বাভাবিক, অনানুষ্ঠানিক প্রভাব ছাড়া এটি আর কিছুই নয়।

রাষ্ট্র মানেই জনসাধারণের জীবন ও স্বাধীনতার উপর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণি ও বিশেষজ্ঞের ভান করা পণ্ডিতদের কর্তৃত্ব, শাসন ও সংগঠিত ক্ষমতার বিস্তার। রাষ্ট্র জনসাধারণের দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই চায় না, আবার একই সঙ্গে তাদের বশ্যতাও দাবি করে।

অন্যদিকে, জনসাধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ব্যতীত আন্তর্জাতিকের ভিন্ন কোনো লক্ষ্য নেই। যার ফলে এটি বিদ্রোহী সত্তাকে আহ্বান জানায়। রাষ্ট্র ও অগ্রাধিকারী শ্রেণির শাসনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বিদ্রোহী সত্তাকে যথেষ্ট শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে হবে এবং আর এজন্যই আন্তর্জাতিককে সংগঠিত হতে হবে।

এই লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে আন্তর্জাতিককে দুটো মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে-

১। আন্তর্জাতিকের চিন্তা-ভাবনাগুলোর প্রচার

২। জনগণের মাঝে এর সমর্থকদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এর ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকে স্বাভাবিকভাবে সংগঠিত করা।

প্রথম আন্তর্জাতিকে বাকুনিন

সংঘবদ্ধ কর্মপন্থাকে যে ব্যক্তি সর্বসাধারণের স্বাধীনতার উপর আঘাত কিংবা নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা বলে দাবি করে, সেই ব্যক্তি হয় কুতার্কিক নয় নির্বোধ। তাদের জন্য করুণা হয় যারা মানব সংহতির কার্যকারণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় এবং মনে করে যে, সমাজবিচ্ছিন্ন পূর্ণ ব্যক্তি-স্বাধীনতা সম্ভব কিংবা সেটাই কাম্য। এমন পরিস্থিতির মানে হলো সকল মানব সমাজের বিলুপ্তি ঘটা,  কেননা ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যেকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপরই মানুষের সমগ্র সামাজিক অস্তিত্ব নির্ভর করে। প্রতিটি ব্যক্তিই, এমনকি সবচাইতে চালাক ও শক্তিশালীরাও, অথবা বলে চলে সবচেয়ে চালাক ও শক্তিশালীরাই বিশেষ করে একই সাথে এই প্রভাবের সৃষ্টি ও স্রষ্টা। কোনো ব্যক্তি যে সমাজে বাস করে, বিকশিত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে সেই সমাজে তাকে ঘিরে থাকা সকল ব্যক্তির বস্তুগত, মানসিক ও নৈতিক সংস্পর্শের সরাসরি ফল হচ্ছে সেই ব্যক্তির ব্যক্তি-স্বাধীনতা। যে ব্যক্তি অধ্যাত্মিক, অতিমানবীয় ও পুরোপুরি স্বার্থপর “মুক্তি”র দোহাই দিয়ে এই সকল সংস্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চায়, সে মানব সত্তা হিসেবে নিজের অস্তিত্বের বিনাশ নিজেই ডেকে আনে। যারা অন্যের উপর এই প্রভাব বিস্তার থেকে বিরত থাকে, তারা আসলে সমস্ত সামাজিক জীবন থেকেই নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এবং নিজের চিন্তা ও অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়া থেকে বিরত থেকে সে বরং নিজের ধ্বংসের পথই সুগম করে। কাজেই, এই তথাকথিত “স্বাধীনতা” যা সচরাচর ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদীর দল প্রচার করে, এই তথাকথিত ব্যক্তি-স্বাধীনতাই অস্তিত্বের বিনাশ ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রকৃতিতে এবং মানব সমাজে যা আসলে এই প্রকৃতিরই অংশ, প্রত্যেক জীবই এই শর্তের উপর বেঁচে থাকে যে— সে ততটুকুই অন্যদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করবে যতটুকু তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তাকে অনুমোদন করে। পরোক্ষ এই প্রভাব বিস্তারের বিনাশ মানেই মৃত্যু। যখন আমরা সর্বসাধারণের মুক্তির কথা বলি তখন আসলে কোনো অর্থেই এটা বলি না যে, ব্যক্তি বা ব্যক্তির সমষ্টি তাদের নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে যেই স্বাভাবিক প্রভাব গড়ে তুলেছে তাকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।

আমরা যা চাই তা হলো এই মেকি, সুবিধাবাদী, আইনানুগ ও দাপ্তরিক প্রভাবের বিলুপ্তি। যদি চার্চ ও রাষ্ট্র ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান হতো তখনো আমরা অবশ্যই তাদের প্রতিপক্ষ হতাম বলে আমি মনে করি। তাদের টিকে থাকার অধিকারের বিরুদ্ধে হয়তো প্রতিবাদ করতাম না। এক অর্থে যদিও এটা সত্য যে বর্তমানে এগুলো ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানই কারণ এগুলো বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির স্বার্থের জন্য একচেটিয়াভাবে কাজ করে। তবুও, আমরা তাদের বিরোধিতা করি কারণ তারা জনগণের সকল শক্তিকে ব্যবহার করে জনগণের উপরই নিজের কর্তৃত্ববাদী, দাপ্তরিক ও বর্বরোচিত কায়দার শাসন কায়েম করে। আন্তর্জাতিক যদি কখনো নিজেকে রাষ্ট্রীয় কায়দায় সংগঠিত করত তবে আমরা যারা এটির সবচেয়ে উদ্যমী বন্ধু তারাই এটির ঘোর শত্রু হয়ে উঠতাম। কিন্তু সম্ভবত এটি এমন ছাঁচে নিজেকে তৈরি করতে সক্ষম হবে না। আন্তর্জাতিক মানুষের মৈত্রীবন্ধনের কোনো সীমা বেঁধে দেয় না, কিন্তু রাষ্ট্র এই মৈত্রীবন্ধন  ও সাম্যেকে ভৌগোলিক ধারণায় সীমাবদ্ধ করা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। ইতিহাস আমাদেরকে দেখিয়েছে যে, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি সংঘ গঠন, সকল স্বৈরশাসকদের যা স্বপ্নের বস্তু তা অসম্ভব। সুতরাং যারাই রাষ্ট্রের কথা প্রচার করে তারা অবধারিতভাবে নানাবিধ রাষ্ট্রে বিভক্ত একটি বিশ্বের কথা চিন্তা করে এবং প্রচার করে। যেই রাষ্ট্রগুলো অভ্যন্তরীণভাবে অত্যাচারী এবং বাহ্যিকভাবে লুণ্ঠনকারী, অর্থাৎ তারা একে অপরের শত্রু। রাষ্ট্র যেহেতু মনুষ্যত্বের বিভাজন, নিপীড়ন ও লুণ্ঠনে জড়িত সুতরাং এটি অবশ্যই মন্যুষত্বের অস্বীকৃতি এবং মানব সমাজের ধ্বংসকেই চিত্রিত করে।

প্রথম আন্তর্জাতিক

শ্রমজীবী মানুষদের সংগঠনের আদৌ কোনো মানে থাকত না, যদি রাষ্ট্রের উৎখাত তাদের লক্ষ্য না হতো। আন্তর্জাতিক এই লক্ষ্য সামনে রেখেই জনসাধারণকে সংগঠিত করেছে এবং শেষমুহূর্ত পর্যন্তও একে স্মরণ করে যেতে পারে। এবং এটি তাদেরকে কীভাবে সংগঠিত করে?

অবশ্যই উপর থেকে নিচ এই ক্রমে নয়, যেমনটা রাষ্ট্র পেশাভেদে উদ্ভূত আশা-আকাঙ্ক্ষার পার্থক্যের কথা আমলে না নিয়েই কোনো একপ্রকার বাহ্যিক একতা ও শৃঙ্খলা মানবসমাজের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা করে নিচ থেকে, জনগণের সামাজিক জীবনকে ধারণ করে, তাদের প্রকৃত আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই প্রারম্ভবিন্দু হিসেবে ধরে নিয়ে, সমাজে তাদের প্রকৃত স্বার্থের ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে সংগঠিত হওয়ার জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করে। আন্তর্জাতিক তাদের জীবন ও কর্মের স্বাভাবিক বৈচিত্র্যের ভিত্তিতেই উদ্দেশ্যের ঐক্য গড়ে তুলে, এবং  লক্ষ্যবস্তু ও কল্যাণের একটি সত্যিকারের সাম্যাবস্থা নির্মাণ করে।

শুধুমাত্র এই প্রক্রিয়ায় সংগঠিত হওয়ার কারণেই আন্তর্জাতিক প্রকৃত শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠেছে। সুতরাং প্রত্যেক গোষ্ঠীর সকল সদস্যের আন্তর্জাতিকের সকল মূলনীতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবগত থাকা অত্যাবশ্যক। শুধুমাত্র এই উপায়েই সে শান্তির সময় ভালো প্রচারক এবং যুদ্ধের সময় প্রকৃত বিপ্লবী হয়ে ওঠবে।

আমরা সবাই জানি যে আমাদের কর্মসূচি ন্যায়সঙ্গত। এটি কতিপয় সত্য উচ্চারণে প্রলেতারিয়েতদের ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক দাবিকে ব্যক্ত করে। শুধুমাত্র পুরোপুরিভাবে মানবিক কর্মসূচি হওয়ার কারণেই এটি সামাজিক বিপ্লবের সকল প্রকার লক্ষণ বহন করে। এটি পুরাতনের ধ্বংস এবং নতুন বিশ্ব নির্মাণের ঘোষণা দেয়।

এইটাই প্রধান আলোচ্য বিষয় যা আমাদেরকে আন্তর্জাতিকের সকল সদস্যদের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। এই কর্মসূচি পুরাতন ধর্মাচরণের প্রতিকল্প হিসেবে একটি নয়া বিজ্ঞান, নয়া দর্শন হাজির করে। এটি পুরাতন কূটনীতির বদৌলতে একটি নয়া আন্তর্জাতিক কর্মপন্থাকে সংজ্ঞায়িত করে। রাষ্ট্রের উৎখাত ব্যতীত এটির ভিন্ন কোনো লক্ষ্য নেই।

আন্তর্জাতিকের সদস্যদরা যাতে বিপ্লবী প্রচারক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব বৈজ্ঞানিকভাব পালন করে সে জন্য তাদের প্রত্যেকের এই নয়া বিজ্ঞান, দর্শন ও কর্মপন্থা দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া আবশ্যক; আন্তর্জাতিকের নতুন সঞ্জীবনী এগুলোই। এটা ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয় যে আমরা শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি চাই; চাই আমাদের শ্রমের পূর্ণ মূল্যায়ন, শ্রেণির বিলুপ্তি, রাজনৈতিক দাসত্বের সমাপ্তি, মানবাধিকারহীনতার উপলব্ধি, সকলের জন্য সমান দায়িত্ব ও ন্যায়বিচার; এক কথায় বললে, অখণ্ড মানবতা। নিঃসন্দেহে, এইসব দাবি বেশ ভালো ও ন্যায্য। কিন্তু আন্তর্জাতিকের কর্মীরা যখন এইসব দাবির যথার্থতা ও তাৎপর্য অনুধাবন না করেই শুধুমাত্র বারংবার এইসব বুলি আওড়াতে থাকে তখন তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া ফাঁপা বুলিতে পর্যবসিত হয়। আর বুঝতে না পারলে এই কথাগুলোর আদতে কোনো মূল্যই থাকে না।

আর্টওয়ার্ক: প্যারিস কমিউন
সংগ্রহ: গেটি ইমেজ

হয়তো বলা হবে যে, সকল শ্রমজীমী মানুষকে শিক্ষিত করা সম্ভব না, এমনকি যখন তারা আন্তর্জাতিকের সদস্যও হয়। সংগঠনের মধ্যেই একদল লোক যতদূর সম্ভব সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞান, দর্শন ও কর্মপন্থা সম্পর্কে পুনর্পাঠ নিচ্ছে, এইটাই কি যথেষ্ট নয়? সঠিক পথ থেকে সরে না আসার জন্য তাদের  যে ‘ভ্রাতৃবৎসল উপদেশ’ সেগুলো কি বিশাল জনতা অনুসরণ করতে পারে না, যা অবশেষে প্রলেতারিয়েতের মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে?

আন্তর্জাতিকের মধ্যেই কর্তৃত্ববাদী কমিউনিস্টরা প্রায়ই এইসব যুক্তি ব্যবহার করত, যদিও প্রকাশ্যে ও স্পষ্টভাবে বলার মতো সাহস তারা সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। সাধারণ জনতার বুদ্ধিমত্তা ও সর্বময় ক্ষমতার লোকভুলানো প্রশংসা অন্তরালে তাদের আসল অভিমত লুকানোর চেষ্টা করত। আমরা সর্বদা এসকল অভিমতের ঘোর বিরোধী ছিলাম। আমরা বিশ্বাস করি যে, আন্তর্জাতিক যদি বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও দশ, বিশ ও ততোধিক লোক নিয়ে গঠিত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী— এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং বৃহৎ অংশ যদি ক্ষুদ্র অংশের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে থাকে তাহলে এই আন্তর্জাতিক শেষমেশ অভিজাততন্ত্রের মধ্যেই বিনষ্ট হবে, যা আদতে রাষ্ট্রেরই চরম বিকৃত একটি রূপ। শিক্ষিত ও সক্ষম ক্ষুদ্র অংশ তাদের গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি একটি পরিচালনা পর্ষদের দাবি করে বসবে। এবং এই পরিচালনা পর্ষদ স্বীকৃত স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও অধিক স্বৈরাচারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। কারণ এর এই স্বৈরাচারী মনোভাব জনগণের ইচ্ছার প্রতি আনুগত্যশীল সম্মানপ্রদর্শনের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকবে। ক্ষুদ্রাংশটি জনগণের উপর সংকল্পের অস্ত্র চাপিয়ে দিয়ে তাদের শাসন করবে, এবং পরবর্তীতে একে ‘জনগণের ইচ্ছা’ নাম দিয়ে প্রচার করবে। আর এভাবেই শিক্ষিত ক্ষুদ্রাংশটি একটি শাসকবর্গে পরিণত হবে, এবং অপরাপর সকল শাসকবর্গের মতোই দিনে দিনে আরও বেশি স্বৈরাচারী ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠবে।

আন্তর্জাতিক তখনই জনসাধারণের মুক্তির হাতিয়ার হয়ে ওঠবে যখন এটি নিজে মুক্ত হয়ে উঠতে পারবে; যখন এটি আর নিজেকে দুটি দলে ভাগ হয়ে থাকতে দেবে না, যার বৃহৎ অংশটি ক্ষুদ্রাংশের অন্ধ অস্ত্রমাত্র। সেইজন্যেই এর প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে সদস্যদের মনে সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞান, দর্শন ও কর্মপন্থাকে আত্মস্থ করে তোলা।

 

 

 

খোইরোম রুধির