অরাজ
আর্টওয়ার্ক: কোভিড ১৯ শিল্পী: মেডিয়াক টুরে সূত্র: আর্টসি
প্রচ্ছদ » মাইকেল সাফি।। দুনিয়া বদলে দেয়া ১০০ দিন

মাইকেল সাফি।। দুনিয়া বদলে দেয়া ১০০ দিন

  • অনুবাদ: ইলোরা সুলতানা

শুরুটা হয়েছিল একটা সতর্কবার্তা দিয়ে। আর এখন আমরা জানি, এটা কিভাবে বিশ্বমহামারীতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের চেনা জীবনকে বদলে দিয়েছে।

একটা উথাল-পাথাল দশক তার চূড়ান্ত দিনে পৌঁছেছে। ২০১৯ এর শেষ দিনটাতে সারা দুনিয়া নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়নি, প্রস্তুতি চলছিল অন্যকিছুর।

২০১০ দশকের আগের বছরগুলোর স্মরণিকা ভরে আছে ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের নিজেকে প্রত্যাহার), সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, শরণার্থী সঙ্কট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তার এবং জন-জীবনে জাতীয়তাবাদের গর্জনের মত ঘটনার উদগীরণ আর তরঙ্গে যা এই দশকটির ঐতিহাসিক গড়ন ঠিক করে দিয়েছে। এসব কিছুই খুব আগাম লেখা হয়ে গিয়েছিল।

শেষ ঘণ্টা পর্যন্তও কিছু বোঝা যায়নি। এমনকি সবাই একসাথে পানাহার এবং কাউন্টডাউন শুরু করার আগেও বোঝা যায়নি যে, এই দশকের সবচেয়ে ভীত কাঁপিয়ে দেয়া ঘটনার মুখোমুখি হওয়া এখনো বাকি আছে আমাদের।

৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, রাত ১টা ৩৮ মিনিটে, চীনের একটি সরকারি ওয়েবসাইট থেকে জানা গেল যে, দক্ষিণ চীনের উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাদ্যের পাইকারি বাজারের আশেপাশের এলাকায় একধরনের ‘অপরিচিত নিউমোনিয়া’ শনাক্ত হয়েছে। এই শিল্প-শহরে ১১ মিলিয়ন মানুষের বসবাস।

সেই ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মহামারীতে ১২ জনের মধ্যে একজনকে সংক্রমিত হিসেবে চিহ্নিত করে। পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার মিজলস এবং আফগানিস্তানের ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবের ভীড়ে একটি শহরের এই আবিষ্কার চীনের বাইরের কারো বিশেষ নজরে আসে নাই।

এর পরের ১০০ দিনে, ভাইরাসটি মানুষের আন্তর্জাতিক ভ্রমন অচল করে দেয়, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ অচল করে দেয়, এমনকি অর্ধেকের বেশি মানুষকে ঘরে আবদ্ধ করে ফেলে। এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সংক্রমিত করে এবং তারপর করতেই থাকে। এদের মধ্যে ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, অভিনেতা ইদরিস এলবা এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীও সংক্রমণের তালিকায় আছেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যেতে পারে বলে পূর্বাভাস আসে।

যখন মধ্যরাত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ১১ টা ৫৯ বাজল, আতশবাজি ফুটিয়ে মানুষ বর্ষ-বরণের আনন্দে মেতে উঠল, তখনও এসব কল্পনাতীত ছিল।

আর্টওয়ার্ক: উহান ইন কোয়ারেন্টাইন
শিল্পী: আরর্কাডো এস্কুইভেল
সিূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

দিন : বুধবার, জানুয়ারি
উহানের সি-ফুড মার্কেট বন্ধ ঘোষণা

স্বাভাবিক সময়ে উহানের সি-ফুড মার্কেটটি খুব ব্যস্ত থাকে। কিন্ত সেদিন সকালে পুলিশ প্লাস্টিকের টেপ দিয়ে দোকানের ধাতব কাঠামোগুলো আটকে দেয় এবং দোকান মালিকদের তাড়া দেয় তাদের দোকানের নীল রোলারের দরজাগুলো দ্রুত লাগিয়ে দেয়ার জন্য। বিশেষ সুরক্ষা পোষাক পরা কর্মীরা খুব সাবধানে বিভিন্ন উপরিতল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নেয়।

চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেক দুশ্চিন্তামূলক বার্তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল রিপোর্ট শেয়ার করে সবাই সবাইকে সতর্কবার্তা পাঠানোর পাশাপাশি বলা হচ্ছিল যে, রোগীরা আশঙ্কাজনক উপসর্গ নিয়ে উহান হসপিটালে ভর্তি হচ্ছে।

একটি মেসেজে বলা হচ্ছে, ‘এটা নিশ্চিতভাবে সার্স, সেবিকা/নার্সদের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না’। আরেকটি মেসেজে বলা হচ্ছে: ‘আপনার হাত ধুতে হবে। মাস্ক। গ্লাভস’।

তাইওয়ান কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা নিয়ে সবকিছু নজরে রাখছে। এই দ্বীপটি ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করছে। উহান থেকে সরাসরি আসা ফ্লাইটগুলো থেকে তাইপে’র টারমাকে মানুষ নামার আগেই তাদের মধ্যে কোন ধরনের সর্দি কাশির লক্ষণ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। দুই দিনের মধ্যে সিঙ্গাপুর এবং হংকং এর বর্ডারগুলোতেও বিভিন্ন শহর থেকে আসা যাত্রীদের মনিটরিং শুরু করা হবে।

উহানে আটজনকে এই রোগের গুজব ছড়ানোর জন্য পাবলিক সিকিউরিটি ব্যুরোতে ডেকে পাঠানো হয়। লি ওয়েনলিয়াং নামে একজন চোখের ডাক্তারকে অপদস্থ করা হয় কারণ তিনি তার মেডিকেল স্কুলের একজন সাবেক সহপাঠীকে জানান যে, তার বিশ্বাস এটা সার্স ভাইরাস।

ওয়াই ওয়াই  নামের একটি জনপ্রিয় লাইভ স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ‘উহানের অজানা নিউমোনিয়া’ এবং ‘উহান সী-ফুড মার্কেট’ এই বাক্যাংশগুলো ইতোমধ্যে সেন্সর করে ফেলা হয়েছে।

দিন : বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি
অভূতপূর্বকরোনা ভাইরাসনাক্ত

রহস্যজনক রোগ চিহ্নিত: চীনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, উহানের অসুস্থ রোগীরা আগে অনাবিষ্কৃত করোনা ভাইরাসেরই শিকার।

সার্স এবং মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসতন্ত্রের উপসর্গ (মার্স) দুই ধরনের করোনা ভাইরাস ইতিমধ্যেই এই শতাব্দীতেই মহামারীর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছে। এই নতুন ভাইরাসটিও প্রাণঘাতী। গতরাতে ৬১ বছরের একজন উহান হাসপাতালে মারা যান, জানামতে কোভিডের সর্বপ্রথম শিকার।

এই পর্যায়ে রোগের অফিসিয়াল হার কমে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডাক্তাররা করোনা আক্রান্ত ভেবে সাধারণ নিউমোনিয়া রোগীদেরও চিকিৎসা দেয়া বন্ধ করতে শুরু করল। চারদিনে আর কোন নতুন করোনা আক্রান্তের খবর ঘোষণা করা হয়নি।

গতকাল তেহরানের সীমান্তে একটি উড়োজাহাজ দূর্ঘটনার খবরে নতুন এই ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার খবরটি ধামাচাপা পড়ে গেল। ইরান এটাকে যান্ত্রিক ত্রুটি হিসেবে অভিযোগ করলেও অনলাইন দুনিয়ায় প্রচারিত ছবি ও ভিডিও দেখে সন্দেহ জেগে উঠেছে যে এটাকে গুলি করা ভূপাতিত করা হয়েছে।

পরবর্তীতে, একটি গবেষণা থেকে জানা যাবে যে, এই পর্যায়ে এসে এই মহামারী প্রতি সপ্তাহে দ্বিগুন আকারে বাড়ছিল। আগামিকাল থেকে চক্ষু চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং এর শরীরে এই রোগের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করবে।

দিন ১৩: সোমবার, ১৩ জানুয়ারি
থাইল্যান্ডে প্রথম আক্রান্তের খবর প্রকাশ

এক সপ্তাহেরও বেশি হল উহানের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ নভেল করোনা ভাইরাসের শেষ কোন সংক্রমণের ঘটনা নিশ্চিত করেছে। শহরটিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক সভা শুরু হওয়ার পর থেকে রোগের আর কোন খবর নাই।

কিন্তু ভাইরাসটি জালের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে। থাইল্যান্ডে প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। ব্যাংকক এয়ারপোর্টে থারমাল সারভেইলেন্স স্ক্যানারের মাধ্যমে ৬১ বছর বয়ষ্ক একজন উহান বাসিন্দার শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা ধরা পড়ে।

ভাইরাসটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য ‘নার্ভট্যাগ’ আদ্যাক্ষরের সংক্রামিত রোগের বিশেষজ্ঞ দলের একটি কমিটি লন্ডনে বসেন। তারা একমত হন যে, যুক্তরাজ্যে এই সংক্রমনের আশঙ্কা খুব কম। তবে তারা অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

চীনের সরকার বলছে, মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোন পরিষ্কার প্রমাণ তারা এখনো খুঁজে পান নাই। এমনকি এখনো পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের অসুস্থ হওয়ার কোন খবরও পাওয়া যায়নি। এই সরকারি বার্তা ডাব্লিউএইচও’র ঘোষণাতেও প্রতিধ্বনিত হয়। যেখানে চীন সরকারের পদক্ষেপের মান বিষয়ে আবার আশ্বস্ত করা হয়।

মহামারী বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই খবরটি বেশ আশাব্যাঞ্জক। ‘যদি কয়েকদিনের মধ্যে নতুন কোন আক্রান্তের খবর না পাওয়া যায় তাহলে মহামারী শেষ ধরে নিতে হবে’। হংকং ইউনিভার্সিটির একজন সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ গুয়ান ই নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন একথা।

উহানের চিকিৎসকরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পান। পরবর্তীতে গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারব যে, পনের দিনের বেশি সময় ধরে শহরের হাসপাতালগুলোকে এমন পরিস্থিতি সামলাতে হয় যাকে সামুদ্রিক খাবারের দোকানগুলোর সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক নেই এমন রোগীদের ‘প্রণিধানযোগ্য বৃদ্ধি’ বলা যায়।

দিন ২০: সোমবার, ২০ জানুয়ারি
মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ নিশ্চিত হল

ঝং নানশান একজন নির্ভরযোগ্য শ্বাসতন্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং চীনা সরকারের মুখপাত্র হিসেবে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দুঃসংবাদটি প্রকাশ করলেন: গোয়াংডং প্রদেশে দুইজন নতুন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের সাথে উহানের সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই।

উপসংহার পরিষ্কার। ঝং বলেন, ‘আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এটা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ’

চীনে পনের দিন ধরে উধাও থাকার পর ভাইরাসটি দেশটির চারদিকে দেখা দিতে শুরু করল। শুক্রবার রাতে আরও নতুন চারজন আক্রান্তের খবর পাওয়া গেল। রবিবারের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩৯ এ। আগামিকাল শেষ হওয়ার আগেই বেইজিং ও সাংহাইতে কিছু নিশ্চিত আক্রান্ত শনাক্ত হবে।

এটা পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে পড়ছে: জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আমেরিকাতে। উহান থেকে আগত একজন ৩৫ বছরের ব্যক্তি গতকাল কাশি ও উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ে ওয়াশিংটনের ক্লিনিকে ভর্তি হন এবং এটাই এদেশের প্রথম কেস।

ঠিক দুইদিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ভাইরাসের উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হন। দি ওয়াশিংটন পোষ্ট এর একটি খবর অনুযায়ী একটি সেশনের মাঝে তিনি জানতে চান সুগন্ধী ভাপ নেয়ার পণ্যগুলো কখন বাজারে ফিরতে পারে।

উহানে দিন দিন আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। একজন কর্মী গার্ডিয়ান পত্রিকাকে জানিয়েছে, আজ সকাল ৬ টার সময় শহরের ঝিইহে হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের লক্ষণসহ একশোর বেশি রোগীকে ডাক্তারের সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

আর্টওয়ার্ক: য়ুরোপ
শিল্পী: আন্দ্রে পেসিয়া
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

দিন ২৪: শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি
ভাইরাসটির ইউরোপে আগমন

বন্ধু ও পরিবার-পরিজনদের সাথে নতুন চন্দ্রবর্ষ উদযাপনের জন্য ছুটিতে কয়েকশ মিলিয়ন চীনা নাগরিক ভ্রমন করছে। আক্রান্ত উহান শহরকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শহরের ভেতরের এবং বাইরের বেশিরভাগ যান চলাচল স্থগিত রাখা হয়েছে। আটশো’র বেশি সংক্রমণ সনাক্ত হয়েছে এবং ২৫ জন মৃত্যুবরণ করেছে।

শহরটি প্রথমবারের মত মহামারীর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে: খুব দ্রুত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, হাসপাতালগুলোর উপর চরম ধকল যাচ্ছে এবং পুরো জনগোষ্টি বিচ্ছিন্ন (quarantined) অবস্থায় আছে।

ভাইরাসটি ইউরোপে পৌঁছে গেছে। সম্প্রতি চীন থেকে আগত দুইজন এবং তার স্থানীয় একজন আত্মীয় শনাক্ত হয়। এই তিনজনের এক ডজনের উপরে মানুষের সাথে সম্পৃক্ততা হয়েছে এবং ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ জানালো, তারা সম্ভাব্য কেসগুলোকে দ্রুত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। ফ্রান্সের স্বাস্থ্য মন্ত্রী অ্যাগনেস বুজিন বলেন, ‘আগুন সামলানোর মত করে মহামারী সামলাতে হবে’।

দুইদিন আগে ডাভোসে অবস্থানকালে ট্রাম্প ভাইরাসটি সম্পর্কে প্রথমবারের মত গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। এক প্রশ্নে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি সম্ভাব্য এই বিশ্বমহামারী নিয়ে কতটুকু উদ্বিগ্ন? উত্তরে তিনি বলেন: ‘একদমই না। এবং এটা পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে’।

আগামিকাল চীনের লকডাউন বিস্তৃত করে আরো ৫৬ মিলিয়ন মানুষকে এর আওতায় নিয়ে আসা হবে। প্রেসিডেন্ট ঝি জিনপিং এই বলে সাবধান করবেন যে, দেশ এখন ‘কবর পরিস্থিতির’ মুখোমুখি। হুবেই শহরের ঝিনহুয়া হাসপাতালের চিকিৎসক লিয়াং উডং চিকিৎসা পেশাজীবী হিসেবে প্রথম মৃত্যু বরণ করবেন।

দিন ৩১: শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি
ব্রেক্সিট দিবসে মহামারীর মাইলফলক অতিক্রম

সংসদে প্রায় চার বছরের মানসিক পীড়াদায়ক বাদানুবাদের পর সকাল ১১ টায় যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসে। এই মাইলফলক অতিক্রমের জন্য ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে একটি ভার্চুয়াল বিগবেন একসুরে বেজে উঠল। কাছেই, পার্লামেন্ট স্কোয়ারে নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘ঈশ্বর রানীকে রক্ষা করুন’।

এই দিনটি করোনা ভাইরাসের জন্যেও একটি মাইলফলক: এই দিনের শেষে, এই মহামারী সার্সের চেয়েও বড় আকার ধারণ করবে। করোনা ভাইরাসটি যুক্তরাজ্যে পৌঁছে যাওয়া নিশ্চিত করবে। স্পেন এবং ইতালিতে প্রথম কেস দেখা দিবে।

ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রী রবার্তো স্পেরাঞ্জা বলবেন, ‘অবস্থা গুরুতর হলেও আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে’।

চীনের বাইরে এখনো পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি, কিন্তু চীনে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত ১১,০০০ সংক্রমিত এবং মৃতের সংখ্যা ২৫৮। চীন থেকে আগত সকল বিদেশির প্রবেশাধিকার আমেরিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

দিন ৩৫: মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি
চীনের বাইরে প্রথম মৃত্যু

চীনে আক্রান্তের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা ৪২৫ জনের মৃত্যুসহ ২০,০০০ অতিক্রম করছে। ফিলিপাইনের ম্যানিলা শহরের একটি হাসপাতালে উহানের একজন অধিবাসী তীব্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চীনের বাইরে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু। চীন থেকে নতুন করে আগমন ফিলিপাইন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মহাপরিচালক বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে এই রোগের ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ খুব কম এবং ধীর এবং যদিও আরো খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে, তবে বাণিজ্য ও চলাচলের উপরে অপ্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন নেই।

সাংহাই থেকে আসা লন্ডনের একজন নাগরিক গাটউইক এয়ারপোর্টে পৌঁছে গার্ডিয়ানকে বলেন, এখানকার শিথিল অবস্থা দেখে তিনি খুব আতঙ্কিত বোধ করছেন। তিনি একটি ফর্মে তার সাথে যোগাযোগের তথ্য পূরণ করেছেন এবং তার পরবর্তী ভ্রমনের পরিকল্পনা জানিয়েছেন কিন্তু তার মতে এগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে।

উহানের সেন্ট্রাল হাসপাতালে, লি ওয়েনলিয়াং এর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে ক্রোধ এবং শোকের আর্তনাদ এই লকড-ডাউন শহরসহ চীনের সব জায়গায় পৌঁছে যাবে।

২০১৮ সালে তুলে দেয়া হোয়াইট হাউজের বিশ্বমহামারী প্রস্তুতি শাখার কয়েকজন প্রাক্তন পরিচালক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তাদের মতামত একটি নিবন্ধে জানান। শিরোনামে বলা হচ্ছিল, ‘আমেরিকাতে করোনা ভাইরাসের মহামারী শুরু হওয়ার আগেই বন্ধ কর’।

আগামিকাল আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কনট্রোল এন্ড প্রিভেনশন প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট সরবরাহ শুরু করবে। কিন্তু এগুলো ত্রুটিযুক্ত ডিভাইস এবং পরের মাস জুড়ে আমেরিকা মাত্র ১২০০ নমুনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতে পারবে, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জার্মানি প্রতিদিন কমপক্ষে ১২,০০০ নমুনা পরীক্ষা চালাচ্ছে।

কয়েকদিনের মধ্যে, নিউ হ্যাম্পশায়ারের একটি র‌্যালিতে ট্রাম্প বলবেন যে, এই মহামারী তাড়াতাড়ি কমে যাবে। তিনি বলবেন, ‘এপ্রিল মাসের মধ্যে, আপনারা জানেন, তাত্ত্বিকভাবে, যখন আবহাওয়া একটু উষ্ণ হয়, তখন এটা অলৌকিকভাবে চলে যায়’।

দিন ৫০: বুধবার ফেব্রুয়ারি ১৯
দক্ষিণ কোরিয়ার চার্চ নিয়ে উদ্বেগ

দক্ষিণ কোরিয়ার কঠোর পরীক্ষা এবং নিরলস কন্টাক্ট ট্রেসিং বা সংস্পর্শ খুঁজে বের করার কাজগুলো তাদের সুফল দিতে শুরু করেছে। সেখানে গতকাল পর্যন্ত ভাইরাসটির মাত্র ৩০টি কেস নথিভূক্ত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও গতকালের ৩১তম আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ চিন্তায় পড়ে গেছে।

৬১ বছর বয়ষ্ক একজন নারী, যিনি একটি বড় চার্চের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, তিনি অসুস্থ অবস্থায় দুটি প্রার্থনা-সেবায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় তিনি করোনা পরীক্ষার করার জন্য ডাক্তারদের অনুরোধ উপেক্ষা করছিলেন। উপরন্তু দুপুরের খাবারের জন্য একটি হোটেলের বাফেতে যান। কর্মকর্তারা ধারণা করছেন তিনি কমপক্ষে ১১৬০ জনের সাথে ঝুঁকিপূর্ণ সংস্পর্শে গিয়েছেন। ‘এর ঠিক পরপরই, [ভাইরাসটি] বিস্ফোরণ ঘটাল’, কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ক্যাং কাইউং-হুয়া, পরবর্তীতে বলবেন।

ইরান তার দুটো নিশ্চিত কেস ঘোষণা করে, দুটোর অবস্থানই পবিত্র শহর কোম-এ।

মিলানের আটলান্টা তখনও তাদের চ্যাম্পিয়ন লীগে রূপকথার দৌড় চালিয়ে যাচ্ছে, স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়াকে ৪-১ গোলে হারানোর সময় স্টেডিয়াম উপচানো দর্শক প্রতিটি গোলে গর্বে ফুলে উঠছিল। একটি ম্যাচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ছোট শহর বারগেমোর প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠি সেদিন স্যান সাইরো স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিল’। এই খেলার জন্য স্পেনের আরো হাজার হাজার অধিবাসী লম্বার্ডিস্থ রাজধানীতে আসে।

লাস ভেগাসে, নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন গভর্নর মাইক ব্লুমবার্গকে প্রথমবারের মত নিজেদের সাথে যুক্ত করার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টি নবম রাষ্ট্রপতি বিতর্কের আয়োজন করে। যে বিতর্কের মূল সারাংশ দাঁড়ায় ব্লুমবার্গের সুখ্যাতির উপর ম্যাসাচুসেটসের সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের ভয়ঙ্কর আক্রমণ। ফলে এদিনও করোনা ভাইরাসের খবর উহ্য থাকে।

আর্টওয়ার্ক: ডেথ বাই ভাইরাস
শিল্পী: গ্রে ওয়াট
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

দিন ৫৬: মঙ্গলবার ২৫ ফেব্রুয়ারি
ভাইরাসটি দুনিয়া জুড়ে কায়েম হল

সারা বিশ্বে ৮০,০০০ হাজারের বেশি কেস ধরা পড়ে। মহামারী ঘোষণার পরে প্রথমবারের মত নিশ্চিত জানা যায় যে চীনের ভেতরের সংক্রমণের তুলনায় বাইরে সংক্রমণের সংখ্যা বেশি। আনুষ্ঠানিক সংখ্যার হিসেবে বেইজিং দুইদিন আগে এই মহামারীর চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় যেদিন ১৫০ জন মারা যায়।

অন্যরা মাত্র তাদের আরোহণ শুরু করেছে। চারদিন আগে ইতালিতে প্রথম একজন মারা যায়, আর এখন এগারো জনের মারাত্মক অবস্থা। গত চারদিন যাবৎ ইতালির উত্তরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ লকডাউনে আছে। ইউরোপের প্রথম অধিবাসী যারা কোয়ারেন্টাইনে গেছে।

চীনের বাইরে ইরানের মৃত্যু সংখ্যাই বেশি বলে মনে করা হচ্ছিল। একজন আইনজীবীর ভাষ্যমতে, সেখানে নিশ্চিতভাবে ১২ জনের অবস্থা মারাত্মক এবং মনে করা হচ্ছে শুধুমাত্র কোমে’ই পঞ্চাশ জনের মত মারা গেছে।

রোগটি এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অভিজাতদের আঘাত করছে: দেশটির স্বাস্থ্য-উপমন্ত্রী গতকাল টেলিভিশনে ‘এই ভাইরাসটি তাদের নিয়ন্ত্রনে আছে’ বলার সময় অবিরত ঘামছিলেন। আজ বিকেলে, ইরাজ হারিরচি নিশ্চিত করেছেন যে তার করোনা টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে।

যখন আমেরিকা তাদের ১৪তম সংক্রমণ ঘোষণা করে, ট্রাম্প তাঁর ভারত সফর থেকে টুইট করেন: ‘আমেরিকাতে করোনা ভাইরাস ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে আছে। স্টক মার্কেট তো আমার কাছে খুব ভালোর দিকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমার!’

দিন ৬৬: শুক্রবার, মার্চ
ইতালির অবস্থার অবনতি এবং আমেরিকাতে প্রথম মৃত্যু

ইতালিতে মৃত্যুর হার ছয়দিনে ছয়গুণ বেড়েছে: ২৩০ জনের বেশি অধিবাসীর মৃত্যু এবং প্রতিদিন ১২০০’র বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। রোম স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে, সেরিই’র একটি ফুটবল ম্যাচে দর্শকদের আগমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং লম্বার্ডি’কে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলার প্রস্তুতি শুরু হয়।

প্রধানমন্ত্রী গিসপে কনতে বলেন, ‘স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা অতিরিক্ত চাপের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে এবং আমরা নিবিড় পরিচর্যা গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ব যদি এই তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা বাড়তে থাকে’।

এই ভাইরাসে যুক্তরাজ্যে প্রথম একজন সত্তুর বছরের নারীর মৃত্যু হয়। ডাউনিং স্ট্রিট বলছে, ‘এই ভাইরাসটি এখন উল্লেখযোগ্য হারে ছড়িয়ে পড়ছে’।

তিনদিন আগে, একটি সংবাদ সম্মেলনে, বরিস জনসন ভ্রু উঁচিয়ে বলেন, ‘আমি আগের রাতে একটি হাসপাতালে ছিলাম যেখানে আমার মনে হয় অল্প কয়েকজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও ছিল এবং আমি সবার সাথেই হাত মিলিয়েছি’।

দিন ৭১: বুধবার, ১১ মার্চ
কোভিড১৯ কে বিশ্বমহামারী ঘোষণা

ওভাল অফিসের একটি দূর্লভ ঘোষণায় ট্রাম্প জানান, ‘একটি বিদেশি ভাইরাসকে মোকাবেলা করার জন্য তার প্রশাসন আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে আক্রমনাত্মক এবং ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে’।

আমেরিকায় সংক্রমণের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং সারাবিশ্বে ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষের মধ্যে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।

২০০৮ এর অর্থনৈতিক ধ্বসের পরে এই প্রথম যুক্তরাজ্য ও আমেরিকার স্টক মার্কেটে এত দ্রুত ধ্বস নেমে এসেছে। ভাইরাস আতঙ্কে সৌদি-রাশিয়ার তেলের মূল্য নিয়ে যুদ্ধ শুরুর যোগাড়।

ইতালিতে মৃত্যুর হার বেড়ে একদিনে ১৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, অন্য যে কোন জায়গার চেয়ে এটাই সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংবাদ। একজন ইতালীয় ক্লান্ত সেবিকার টেবিলের উপরে পড়ে থাকার ছবি ভাইরাল হয়। কনতে বলেন দেশটি ‘সবচেয়ে অন্ধকার সময় পার করছে’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা দেয়, যা ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট: কোভিড-১৯ একটি বিশ্ব মহামারী।

যুক্তরাজ্যে ৪৫৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু তারপরেও ইউরোপের অনেক জায়গার বাসিন্দারা এভাবে সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার বিরোধিতা করছিল। অসুস্থ এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়, কিন্তু সরকার এমন কিছু সিদ্ধান্তের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল যা পরে এই ভাইরাসকে মোকাবেলার জন্য উচ্চ মূল্য দিতে বাধ্য করবে। যুক্তরাজ্যের প্রধান বৈজ্ঞানিক পরামর্শক স্যার প্যাট্রিক ভ্যালেন্স বিবিসি’কে বলবেন, এই ভাইরাসটিকে ছড়ানোর সুযোগ দিলে যা হবে তা হচ্ছে ‘একধরনের হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে, ফলে অনেক বেমি মানুষের মধ্যে এই রোগের প্রতিরোধক তৈরি হবে’।

দিন ৭৭: মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ

আর্টওয়ার্ক: কোভিড -১৯
শিল্পী: গিলি নিকোলাস
সূত্র: ইয়ুথ ভয়েস

সারা পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন থমকে গেছে

ইউরোপের সব দেশ নিজেদের মধ্যে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এবং মহাদেশটি সারা বিশ্বের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইম্যানুয়েল ম্যাক্রন ঘোষণা করলেন, ‘আমরা এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছি’।

ইতালিতে প্রতিদিন ৪৫০ জনের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে যা চীনের মৃত্যু সংখ্যাকে দ্রুত ছাড়িয়ে যাবে। এই সপ্তাহের মধ্যে স্পেনে নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে ১৭ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। যারা এই রোগে মারা গেছেন তাদের এক-তৃতীয়াংশই ইউরোপের অধিবাসী।

প্রতিটি ঘন্টাই নতুন সংক্রমণের খবর নিয়ে আসছে: আরো বেশি শনাক্ত, আরো মৃত্যু এবং চলাচলে আরো নিষেধাজ্ঞা। বিদেশি অস্ট্রেলিয়ানদের একটি নজিরবিহীন অনুরোধ করা হয়, তারা যেন দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরে যায়। ফ্রান্সে বাইক চালানো নিষিদ্ধ করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার ৪০ লাখ মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়।

ডাউনিং স্ট্রিট হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলাসহ আগের সব কৌশল জরুরি ভিত্তিতে বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বরিস জনসনের টেবিলে দেয়া একটি হার্ড ইমিউনিটি মডেলে দেখানো হয় যে, এই কৌশলের মূল্য হিসেবে যুক্তরাজ্যকে আধা মিলিয়ন ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যু গুনতে হবে এবং এনএইচএস (জাতীয় স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা) বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।

বুরকিনা ফাসো’তে, পার্লামেন্টের একজন প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট করোনা ভাইরাসে মারা যায়, সাব-সাহারান আফ্রিকাতে কোভিড -১৯ এই প্রথম মৃত্যু। এই সপ্তাহের শেষে উপমহাদেশে ১০০০ আক্রান্তের খবর পাওয়া যাবে। সারা পৃথিবীতে আরো ১৬০,০০০ বেশী সংক্রমণের খবর নিশ্চিত করা হবে।

দিন ৮৩: সোমবার, ২৩ মার্চ
যুক্তরাজ্যে লকডাউনের আদেশ জারি

৬,৬০০ এর বেশি ব্রিটিশ নাগরিকসহ সারা পৃথিবীতে ৩৭০,০০০ এর বেশি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের টেলিভিশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দর্শকময় মূহূর্ত হিসেবে বর্ণিত ঘোষণায় এসে বরিস জনসন অত্যাবশ্যকীয় ছাড়া আর সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে জাতিকে আহবান জানান: ‘আপনাদের অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে’।

স্পেনে প্রায় ৪০০ জন মারা গেছে, যা এই পর্যন্ত সর্বোচ্চ মৃত্যুহার। পরের পনেরদিনের মধ্যেই এই মৃত্যুহার যে সর্বনিম্ন ছিল তা প্রমাণিত হতে থাকবে।

নিউইয়র্কে ৫০০০ এর বেশি নতুন আক্রান্ত শনাক্ত হবে এবং সব মিলিয়ে আমেরিকায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়াবে ২০,০০০। এই সপ্তাহের শেষেই আমেরিকাতে সংক্রমণের হার সারা পৃথিবীর সব দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হবে।

দেখা যাবে চীনে সংক্রমণের ঢেউ কমে আসছে, এই সপ্তাহেই প্রথম একটি দিন হবে যেদিন হুবেই সহ কোথাও কোন অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ ঘটবে না। হুবেই হলো সেই শহর যেখানে এই রোগের সংক্রমণ প্রথম চিহ্নিত হয়।

আগামীকাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদী, পরবর্তী তিন সপ্তাহের জন্য তার দেশবাসীকে ঘরে থাকার আহবান জানিয়ে বলবেন, ‘বাইরে যাওয়ার কথা ভুলে যান’। এই লকডাউনের আদেশ ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে এই প্রথম উপমহাদেশে মানুষের সবচেয়ে বড় জরুরি স্থানান্তরের সূচনা করবে, কারণ শহরবাসী শ্রমিকেরা দেশের বাড়িতে ফেরার প্রাণপণ চেষ্টা চালাবে। এসবকিছুর মানে হচ্ছে সারা পৃথিবীর ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ এখন কোন না কোন ধরনের কোয়ারেন্টাইনের আওতায় আছে।

আর্টওয়ার্ক: লেটস প্লে বোলিং বল
শিল্পী: মির সুহাইল
সিূত্র: র্কাুন মুভমেন্ট

দিন ৯৩: বৃহস্পতিবার, এপ্রিল
আরেকটি ভয়ানক মাইলফলক পার

গ্রিনউইচ মান সময় আনুমানিক রাত ৮.৪০ এর দিকে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি নিশ্চিত করে যে সারা পৃথিবীতে এখন এক মিলিয়ন মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত এবং এর মধ্যে ৫০,০০০ মানুষ মারা গেছে। অসুস্থ বরিস জনসন জানান তাঁর খুব সামান্য উপসর্গ দেখা গেছে এবং তিনি এখনও যুক্তরাজ্যের সরকারের পদক্ষেপের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য হুকুম বলে শাসন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

ভারতের ধারাভিতে দ্বিতীয় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়, এটি মুম্বাইয়ের একটি বস্তি যা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এর ফলে দেশটির মহামারী আক্রান্তের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা ২,০৬৯ জনের তুলনায় আরো বেশি খারাপ হতে পারে বলে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।

স্পেনে একদিনে ৯৫০ জন মারা যায় যা এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত এক সপ্তহে আমেরিকাতে ৬.৬ মিলিয়ন মানুষ বেকার হয়ে গেছে। তারও আগের সপ্তাহে ৩ মিলিয়ন মানুষ কাজ হারিয়েছে। আমেরিকাতে প্রায় ৬০০০ মানুষ মারা গেছে এবং প্রায় সোয়া মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে এবং মরদেহ সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজযুক্ত ট্রাক ব্যবহার করা হচ্ছে। ট্রাম্প সতর্ক করলেন, ‘সামনের দুই সপ্তাহ খুব যন্ত্রণাদায়ক হবে’।

দিন ৯৯: বুধবার, এপ্রিল
বিশ্বমহামারীর ভবিষ্যত এখনো অজানা

বরিস জনসন এখনও হাসপাতালে, সোমবারের পরে তাঁর উপসর্গের অবনতি হলে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

ইউরোপের কিছু কিছু দেশের অবস্থা ভয়াবহ, প্রতিনিয়ত নতুন সংক্রমণের সাথে সাথে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। চীনে কোন মৃত্যু ছাড়া একটি দিন নথিভূক্ত হল এবং শহরগুলো সাবধানতার সাথে খুলছে।

গত শনিবার ছিল এই পর্যন্ত হওয়া একটি ভয়াবহ দিন, সারা পৃথিবীতে ৬,৫০০ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু বেশ কিছু দরিদ্র এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এখনো এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় নাই, যদিও এত আগেই এটা অনুমান করা ঠিক হচ্ছে না।

সিংগাপুর, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দেয়া মাত্র তারা যথাযথ কোয়ারেন্টাইন পালন শুরু করে। দ্রুত টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। তারপরেও সবার জন্য এই টিকা বাজারে আসতে আরো ১৮ মাস লেগে যাবে।

পাকিস্তান তাদের নির্মাণ-খাতের কাজকর্ম আবারো শুরু করছে। দেশের এক-চতুর্থাংশ জনগণ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। ভাইরাস সংক্রমণ রোধের জন্য দেশটি সার্কাসের মত দড়ির উপর হাঁটছে,  প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, ‘মানুষ যেন অনাহারে না মরে এবং দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে না পড়ে সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে’।

ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে ৭৫০০০ মানুষ মারা গেছে এবং ১.৩ মিলিয়ন সংক্রমিত। এদের মধ্যে প্রায় ২৭০,০০০ সুস্থ্য হয়েছেন। মানুষ কীভাবে আগের মত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

এপ্রিল ৮, ২০২০।

মূল লেখাটি দেখা যাবে এখানে

ইলোরা সুলতানা

ইলোরা সুলতানা নৃবিজ্ঞান পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশাদার উন্নয়ন গবেষক এবং অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন। সম্প্রতি রাজশাহীর প্রজেক্ট হেডওয়ে গ্রামার স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন। যোগাযোগ: elu_11@hotmail.com