- সেলিম রেজা নিউটন
সম্পাদকীয় নোট: আগস্ট বিদ্রোহের এক যুগ। ২০০৭ সালে সেনাকর্তৃত্বের জরুরি শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। যে অল্প ক‘জন শিক্ষক সেই জরুরি শাসনকে ক্রিটিক্যালি দেখতে পেরেছিলেন সেলিম রেজা নিউটন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ চলবে না’- এই উচ্চারণকে ধারণ করে প্ররতিবাদী মৌন মিছিল করার দায়ে তিনিসহ তাঁর সহকর্মিদের আটক করা হয়। জরুরি আইন ভঙ্গের দায়ে কারাদণ্ড দেয়া হয় তাঁদের। অতঃপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাঁদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকার। কারামুক্তির পর ক্ষমতা-কর্তৃত্ব- রাষ্ট্র-সমাজ-কারাগার-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি নিয়ে বিপুল পরিসরে রচনা শুরু করেন সেলিম রেজা নিউটন, যা এখনও চলমান। তাঁর অচেনা দাগ গ্রন্থের তৃতীয় দাগে জরুরি শাসন সংক্রান্ত রচনা সংকলিত হয়েছে। আগস্ট বিদ্রোহের যুগপূর্তিতে অরাজ ধারাবাহিতভাবে তা প্রকাশ করছে।
অবতরণিকা
এই লেখাটা তৈরি করা হয়েছিল ২১শে আগস্ট ২০০৭ তারিখে। সেদিন সকালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির বিশেষ জরুরি সভা বসেছিল বোমা হামলার হুমকি-সম্বলিত উড়োচিঠি প্রসঙ্গে করণীয় নির্ধারণ করার জন্য। কিন্তু ঐ উড়োচিঠির হুমকির চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাক্যাম্পের জওয়ানদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্র প্রহৃত হওয়াকে কেন্দ্র করে তপ্ত হয়ে উঠতে থাকা পরিস্থতিজনিত উৎকণ্ঠা আমাদের মনকে আরও বেশি আচ্ছন্ন করে তুলছিল। ঐ সভায় বসে, প্রথম আলো পড়তে পড়তেই ঘটনাটা জেনেছিলাম আমি। পত্রিকাটা বাকিদের দিকে ঠেলে দিয়ে সবাইকে বলেছিলাম, আমাদেরও উচিত প্রতিবাদ করা। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবতে ভাবতে ঠিক করা হলো একটা কলাম লেখা হবে, প্রথম আলো পত্রিকায় পাঠানো হবে, সবাই সেটায় স্বাক্ষর করবে। রচনার দায়িত্ব আমার ওপর। এ সেই রচনা।
রচনাটা শেষ করতে করতে সন্ধ্যা লেগে গেল প্রায়। সবার সই নিয়ে পাঠাতে পাঠাতে রাত আটটা পার। সম্পাদকীয় বিভাগের সাংবাদিক ফিরোজের সাথে কথা হলো, দেরির জন্যে ২২শে আর ছাপানো যাচ্ছে না, ২৩শে আগস্টে ছাপা হবে বললেন। ২৩শের পত্রিকায় লেখাটা না দেখতে পেয়ে ফিরোজকে ফোন করলাম। তিনি বললেন প্রথম পাতায় ‘লক্ষ্য করুন’ বিজ্ঞপ্তিটা দেখতে। দেখলাম: ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে ঢাবি এবং রাবি’র তরুণ শিক্ষকদের লেখা পড়ুন – ভেতরের পাতায়’ এ-জাতীয় একটা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া আছে। অথচ ভেতরের পাতায় লেখা দুটো নাই! ফিরোজ আরও জানালেন ঢাবি’র গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের রোবায়েত ফেরদৌস-সহ অন্যসব শিক্ষকদের একটা লেখা (‘ছাত্র-শিক্ষকের ক্যাম্পাসে সেনা পুলিশের ঠাঁই নাই’ ধরনের শিরোনামে) এবং আমাদের এই লেখাটা আগের দিন বিকালে তিনি নিজে হাজির থাকতেই পেস্টিং হয়ে গিয়েছিল, পরে তিনি চলে আসার পর রাতে তুলে ফেলা হয়েছে। সম্পাদকীয় বিভাগ ছাপার জন্য পেস্টিং করার পরও শেষ মুহূর্তে ‘কারা সেন্সর করল, কেন করল বুঝতেই পারছেন’ – ফিরোজের ব্যাখ্যা শুনে চুপ থাকতে হয়। জরুরি ক্ষমতার অধীনে সংবাদপত্রে সেন্সরশিপের সাক্ষাৎ প্রমাণ হয়ে রইল এই সামান্য রচনা।
বিভাগের সভাপতি খাদেমুল ইসলাম ছাড়া আর সকল শিক্ষক লেখাটার সাথে সম্মত হয়ে স্বাক্ষর করেছিলেন। আমারসহ মোট দশজনের নামে এটা পত্রিকায় গিয়েছিল। অন্য শিক্ষকরা ছিলেন: আকতার জাহান, ড. আবুল মনসুর আহাম্মদ, আ-আল মামুন, তানভীর আহমদ, দুলাল বিশ্বাস, মশিহুর রহমান, মুসতাক আহমেদ, মোছাঃ দিল আফরোজা খাতুন, এবং শাতিল সিরাজ। যৌথ রচনা হিসেবে এই রচনাটি যেহেতু এ-যাবৎ প্রকাশের মুখ দেখে নি, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের শ্বাসরুদ্ধকর চাপে আমার দুই কারাসঙ্গী ছাড়া বাকিরা যেহেতু এই রচনার চেতনার সাথে সংহতি বোধ করে প্রতিবাদের ধারা বজায় রাখেন নি এবং আদতে রচনাটা যেহেতু আমারই, সেহেতু এখানে এটা শুধু আমার নামেই পেশ করলাম।
বিভাগের সব শিক্ষক যেন সম্মত বোধ করতে পারেন, এবং যারা এমন সাংবাদিকতা করেন যে নিজেরা সেন্সর্ড্ হওয়ার দুঃখটা পর্যন্ত পাঠককে জানাতে পারেন না, সেই প্রথম আলো-র মতো একটা পত্রিকাও যেন লেখাটা ছাপাতে পারেন, তেমন সতর্কভাবে এটা রচনা করতে হয়েছিল, সে-কথা বলা হয়ত বাহুল্য নয়।
রাবি: ২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০০৮
আইন-শৃঙ্খলার ব্যথা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দের উপর পুলিশ এবং সেনাসদস্যদের তথা ‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’র হামলার ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দকে যেভাবে গণহারে পেটানো হয়েছে, এবং তাদেরকে রক্ষা করতে গিয়ে তাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যেভাবে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন তা খুবই উদ্বেগজনক। অনেক শিক্ষার্থীকে আটক করে রাখা হয়েছে এবং তাদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত আছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এই ঘটনাকে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর হামলা হিসেবে বিবেচনা না করার কোনো কারণ আছে বলে আমাদের মনে হয় না।
জনপরিসর নিয়ন্ত্রণ-প্রচেষ্টা
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বিধিবন্দোবস্তের মধ্যে কোথায় কোথায় সংস্কার করতে পারলে শিক্ষার উন্নততর পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় সেই সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা ও মতামত গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণের কাজে যখন আমরা মনোযোগী হয়ে উঠছি, তখনই লক্ষ করা যাচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যাম্পাসগুলোতে নবীনবরণ, বিতর্ক, শিক্ষার্থীদের সুস্থ-স্বাভাবিক আড্ডা-মেলামেশা-চলাচল, মতবিনিময়, নাটক-আবৃত্তি-গান, এমনকি ত্রাণ-তৎপরতা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত করার একটি অশুভ প্রচেষ্টা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই নিয়ন্ত্রণ-কর্মপ্রণালীর দৃশ্যমান উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক-প্রক্টরিয়াল কর্মকর্তাদেরকে দেখা গেলেও তাদের সাথে প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে পুলিশের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। তার সাথে যুক্ত হলো নতুন মাত্রা: সেনাসদস্য ও সেনাক্যাম্প প্রসঙ্গ। এনতুনত্ব সকলের জন্যই নাজুক, স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাক্যাম্প আপত্তিকর
জরুরি অবস্থার অজুহাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনা ক্যাম্প বসানোর সিদ্ধান্ত যদি হয়ে থাকে, তবে তা অত্যন্ত আপত্তিকর একটি কাজ। আমাদের অনুজপ্রতিম-সন্তানপ্রতিম শিক্ষার্থীরা যখন নিবিড় অধ্যয়নে এবং নানারকম শিক্ষামূলক, সেবামূলক, ব্যক্তিত্ব-বিকাশধর্মী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছেন, তখন তাদেরকে সার্বক্ষণিক নজরদারির অধীনে আনার চেষ্টা করা, তাঁদের আত্মমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং ক্যাম্পাসে তাদের চিন্তা ও চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করার পেছনে ইতিবাচক কী কারণ থাকতে পারে তা উপলব্ধি করতে পারা সহজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীগণ এবং শিক্ষকবৃন্দ ‘আইন-শৃঙ্খলা বিনষ্ট’ করার কাজে লিপ্ত আছেন এ রকম অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক ধরনের ঢালাও অনুমান প্রণয়ন করার কারণ বোঝা সত্যিই খুব কঠিন। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনা ক্যাম্প বা পুলিশ-ক্যাম্প বসানোর বা বহাল রাখার দরকার কী? এ কথা না বোঝার কোনো কারণ নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সংস্কৃতি-চিন্তা-ভাব ও স্বাধীনতার অবাধ চর্চার ওপর কোনো রকম বহিঃকর্তৃত্ব কায়েম, ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিপদগ্রস্ত করারই শামিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলে, স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তির প্রকৃত মুক্ত চর্চার বিকাশ পুরো সমাজকেই বিকশিত করে শত-সহস্র উপায়ে।
ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখলে এ-ও লক্ষ না করে উপায় নাই যে এরশাদের গণধিকৃত সামরিক শাসনের আমলেই কিন্তু আমাদের স্বাধীন দেশের পাবলিক বিশ্ব-বিদ্যালয়গুলোতে পুলিশ-ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। এবার ‘সেনা সমর্থিত’ সরকারের তরফে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ তারই ধারাবাহিকতা কিনা, এই প্রশ্ন না উঠে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়-পরিবার বরাবরই সরকারী বন্দুকধারী বাহিনীসমূহের এরকম ক্যাম্প স্থাপনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে এসেছে। ভুলে যাওয়া অসম্ভব যে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্র‘য়ারিতে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনীর হামলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, বেশ ক-জন ছাত্র নিহত হয়েছিলেন, অনেকে আহত এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই দিনটি একটি কালো দিন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। তদুপরি, এ কথা সত্য, এরশাদ-আমলে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন লঙ্ঘন করে যখনতখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়া এত সহজ ছিল না। সার্বক্ষণিক পুলিশি নজরদারি এবং প্রহরায় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সংস্কৃতি-চিন্তা ও ভাবচর্চার অবাধ, মুক্ত-স্বাধীন বিকাশ ঘটবে এ কথা অবিশ্বাস্য।
সেনাসমর্থিত সরকার এবং সুশীল সমাজের মিডিয়া
এবারের ১১ই জানুয়ারির ‘সেনা সমর্থিত’ শাসন যে সামরিক শাসন নয়, এটা যে অতীতের সামরিক সরকারগুলোর ধারাবাহিকতা নয়, সে-ব্যাপারে সেনাপ্রধানের নিজের তরফ থেকে এবং শাসকশ্রেণী ও শাসক-কর্তৃপক্ষীয় বুদ্ধিজীবী-মহল থেকে দেশবাসীকে আকারে-ইঙ্গিতে এবং সুস্পষ্টভাবে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। দেশবাসী প্রতিদিনই এই আশ্বাসের সত্যতার সুস্পষ্টতম প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতে চান। ভালোভাবে দেশ পরিচালনায় রাজনৈতিক দলগুলার চরম ব্যর্থতা এবং ভয়ঙ্কর কার্যকলাপে অতিষ্ঠ দেশবাসী এই সরকারকে শুরু থেকেই এক প্রকার নৈতিক সমর্থনই দিয়ে আসছে। গত দেড় দশক ধরে ‘সুশীল সমাজ’ ও মিডিয়ার লাগাতার প্রচার-প্রচারণাও এই নৈতিক সমর্থনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু নানান কারণে এই সরকার ও প্রধান ধারার মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে জনমনে সংশয়-প্রশ্ন-দ্বিধা-অনাস্থা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, এ-কথা অস্বীকার করা বা গোপন করে রাখা দেশ-জাতি-সরকারের জন্য কোনোক্রমেই মঙ্গলজনক নয়। সকলপ্রকার গণবিরোধী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থানরত মানুষের প্রধান অস্ত্রই কিন্তু অবাধ-মুক্ত প্রচার-মাধ্যম কর্তৃক পরিবেশিত নির্জলা সত্য। মোবাইল ফোন, ইমেইল এবং অন্য নানাভাবে প্রকৃত খবরের চলাচল রোধ করা আজকের যুগে সম্ভব বলে ভাবাটা কারো পক্ষে কি আদৌ সম্ভব? অকপট সত্যভাষণ সমাজের শুভ ও মঙ্গলকেই আরও শক্তিশালী করে তোলে বলেই আমাদের বিশ্বাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা ঘটার দিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় টিভি-সংবাদের আধেয় যে রকম ‘কোমলভাবে’ পরিবর্তিত-পরিমার্জিত-সংশোধিত হয়েছে এবং পরদিনের পত্রপত্রিকায় যে রকম ‘বিশেষভাবে’ ঘটনাটি পরিবেশিত হয়েছে, তা সচেতন পাঠক-দর্শক-মানুষের চোখ এড়ায় নি।
অপ্রকাশ্য আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন মহামান্য ভয় স্বয়ং
বিগত সরকারগুলোর শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ওপর নির্বিচারে সরকারী কর্তৃত্ব কায়েম করা হয়েছিল রাজনৈতিক দলের ছাত্র-সংগঠনসহ নানান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দলীয় প্রশাসন-যন্ত্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে। এই রাষ্ট্রীয়-সরকারী কর্তৃত্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, শিক্ষকদের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং শিক্ষার উদার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করেছিল। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তৈরি হয়েছিল নীতিহীন, সুবিধাবাদী এবং সরকারী ও বিরোধীদলীয় শাসক-কর্তৃপক্ষের ‘কর্মচারীসুলভ’ তল্পীবাহক শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী-দের একটি নির্লজ্জ গোষ্ঠী। শিক্ষকদের লাল-নীল রাজনীতি, ছাত্র-সংগঠনসমূহের হানাহানি-সন্ত্রাস এগুলো সবই কিন্তু সরকারী ‘হালুয়া-রুটি’ খাওয়ার অবাধ ও সরকারীভাবে উৎসাহিত প্রতিযোগিতা থেকে উৎসারিত হতো। আমরা চাই না বর্তমান সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কোনোরকম সরকারী প্রভাব খাটাক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজেদের মতো করে চলতে দিলে আমাদের সমস্যাগুলো আমরা নিজেরাই সমাধান করতে পারব। বিবেকের সামনে সততার সাথে দাঁড়ালে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে বিগত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বরের অচিন্ত্যনীয় প্রকাশ্য সন্ত্রাসের অবসান ঘটলেও ১১ই জানুয়ারি পরবর্তী বাংলাদেশে অপ্রকাশ্য আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন মহামান্য ভয় স্বয়ং। দুর্নীতিবাজ গডফাদাররা আতঙ্কে কাঁপুক, আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু সারা দেশের সকলের জন্য মহামান্য ভয়ের ঢালাও প্রসার আমরা – নেহায়েৎ ভীতু মানুষেরা – অত্যন্ত বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করি। মানুষ হিসেবে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য অন্য কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নাই।
রাবি: ২১শে আগস্ট ২০০৭। প্রকাশ: প্রবাসী বাঙালিদের অনলাইন পত্রিকা ইউকেবেঙ্গলি, লন্ডন, রাবি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছোটকাগজ বহতা, ৬ষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল ২০০৮।