- আরিফ রেজা মাহমুদ
পিপলস রিপাবলিক বাংলাদেশ গঠিত হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলা ভূখন্ডে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে। তবে তাকে কার্যকর করা হয়েছিল ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে। সেই ঘোষণায় বলা হয়েছে,
‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্দারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম…’
যেকোন দেশেই স্বাধীনতার ঘোষণা সেদেশের সর্বোচ্চ আইন। রিপাবলিকের প্রাণভোমরা হল : জনগণের সাধারণ সংকল্প। স্বাধীনতার ঘোষণায় রিপাবলিকের সংকল্প এবং ম্যান্ডেট পষ্ট করা হয়েছে। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’–এই হল আমাদের রিপাবলিকের প্রাণভোমরা। এই গণপরিষদের ঘোষণার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা ভূখন্ডে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকারও স্বাধীনতার ঘোষণায় ব্যক্ত হয়েছে।
৭২ সালের সংবিধানে খোদ রিপাবলিকের সংকল্পই পাল্টে ফেলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারও পাল্টে ফেলা হয়েছে। ‘জাতীয়তাবাদ-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ রাষ্ট্রের মূলনীতি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ৭২ এর সংবিধানের মূলনীতিকে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে প্রচার করেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সরব শক্তি সিপিবি। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর, এবং পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের পর আওয়ামী লীগ এ নিয়ে সরব। ৭২-এ এই সংবিধানের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন মেনন ভাই-ইনু ভাইরা। তারা আজ এই চারনীতিকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে করেন।
জেনারেল জিয়া ৭২ এর সংবিধানের মুলনীতিকে সামরিক ফরমান বলে পাল্টে – ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ; অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় বিচার– এই অর্থে সমাজতন্ত্রকে’ রাষ্ট্রের মুলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। পাকিস্তানিকরণের বীজ নিহিত ছিল জিয়ার এই রাষ্ট্রদর্শনে।
এর ক্রিটিক করতে গিয়ে, সিপিবির সভাপতি জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রায়শ তার লেখায় বলতেন, ‘জাতীয়তাবাদ-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর কোন নীতি যে মানবে না সে ফুল রাজাকার। দুই নীতি মানবেন, দুই নীতি মানবেন না হাফ রাজাকার।’ উল্লেখ্য যে, ৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির প্রশ্নে পুরোপুরি আপোসকামী হওয়া শুরু করে।
আদতে জাতীয়তাবাদ-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে প্রণয়ন এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারকে নির্বাসনে পাঠানোর মাধ্যমেই বাংলাদেশ রিপাবলিকের মৌলিক সংকল্প তথা অস্তিত্বকে মুছে ফেলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ভিশনকে তথা দৃষ্টিকল্পকে নস্যাত করে ফেলা হয়েছে।
Proclamation of independence শিরোনামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। বরেণ্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এর তর্জমা করেছেন ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ । এই অনুবাদটি যিনি করেছেন এবং যারা স্বীকৃতি দিয়েছেন তারা দেশের মানুষের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে ইনসাফ করেননি। Proclamation এর বাংলা তর্জমা ঘোষণা, ঘোষণাপত্র নয়। ৭২ এর সংবিধান গণভোটে পাশ হয়নি। গণভোটের দাবি উঠলেও তা গণভোটের জন্য পেশ হয়নি। গণপরিষদের ম্যান্ডেট সংবিধান প্রণয়ন করার, কিন্তু পাশ করার অধিকার তো জনগণের। যে সংবিধানে জনতার রায় আছে কি নাই তা জানার চেষ্টাই হয়নি, সে সংবিধানের বৈধতার ভিত্তি কি?
সংবিধানের উপর গণভোট একটা কন্ডিশনাল বিষয়। আমাদের দেশে কন্ডিশনটা একটু দেখা যাক। আসলে ৭০ সালে যে গণপরিষদ নির্বাচন হযেছিল তার উদ্দেশ্য ছিল সারা পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রস্তুত করা। আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট ছিল ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন। জনগণ তার নির্বাচনী ইশতেহারকে সমর্থন করেই ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার ম্যান্ডেট দিয়েছিল। কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে আলোচনার সময় যখন পাকিস্তানি সেনারা বাংলায় অবৈধ হামলা চালাল আমাদের জণপ্রতিনিধিরা গণপরিষদ গঠন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের দৃষ্টিকল্প ঠিক করলেন। দেশ শত্রুমুক্ত হল। এখন সংবিধান প্রণয়নের পালা।
প্রশ্নটা হল, যারা গণপরিষদে নির্বাচিত হযেছিলেন তারা ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়নের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত। তারা ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভূমিকা নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ে তো নতুন রাষ্ট্রে কোন জন ম্যান্ডেট নেন নাই, আর ৬ দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব না। কেননা ঐ কাঠামোটাই স্বাধীনতা ঘোষণার পর অকার্যকর। তারা যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিন্যাস কেমন হবে সে বিষয়ে নতুন করে দফা দিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসতেন এবং সংবিধান প্রণয়ন করতেন তাহলে গণভোট না হলেও মানা যেত। কিন্তু তারা যেহেতু সেটি করেননি বা করার প্রয়োজনবোধ করেননি, সেহেতু নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের পর তা গণভোটে দেয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। নইলে সংবিধানের সঙ্গে ‘জনগণের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা’র সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। অথচ এটি রিপাবলিক ধারণার প্রাণ ভোমরা।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সংকল্প রিক্লেইম করতে না পারলে, যাবতীয় প্রকার চেতনা আদতে রেটরিক। ভিশন একাত্তর আদতে ডি-ভিশন একাত্তরে পরিণত হয়। বাংলাদেশ পরিণত হয় একটি ব্রোকেন রিপাবলিকে ।