- ফাহমিদুল হক
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানবীয় সামগ্রিক স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। কর্তৃত্ববাদী শাসন এই স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে শুধু সমাজকে নিশ্চলই করে না, তার বিমানবিকীকরণ ঘটায়। বাংলাদেশে জন্মলগ্ন থেকে প্রবাহমান শাসনপ্রণালীর গঠন কাঠামো ও চর্চা তাকে পরিণত করেছে সর্বস্বৈরতন্ত্রে। এই সর্বস্বৈরতন্ত্রের সাম্প্রতিক সংযোজন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অরাজ এই আইনকে সর্বস্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রবাদের অন্যতম নিয়ন্ত্রণমূলক শুঁড় মনে করে। প্রবাহমান প্রবন্ধে ফাহমিদুল হক মত প্রকাশের স্বাধীনতার বর্তমান শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতিকে খোলাসা করেছেন, শাসকতার নানা ধারা- প্রবণতা- চর্চাকে সমালোচনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোকপাত করে। প্রবন্ধটির বর্তমান সংস্করণটি শুদ্ধস্বর থেকে পুন:প্রকাশ করা হল। — সম্পাদক
ভূমিকা
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা একটি দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নির্মাণ ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অবকাশ রাখে না। বাংলাদেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ হয়েছে, নিশ্চয়ই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ধারণাকে বাদ দিয়ে নয়। “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়” – ভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত এই জনপ্রিয় গান কিংবা স্লোগানটি কেবল বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকারের বয়ান করে না, সার্বিকভাবে চিন্তার স্বাধীনতার কথাও বলে। বাংলাদেশের সংবিধানেও মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে কিছু ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা’ ব্যতিরেকে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই রচনায় স্বাধীন বাংলাদেশে, বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরিস্থিতির একটি চিত্র তুলে ধরা হবে। তাতে আমরা দেখতে পাবো, স্বাধীনতার পর নানান সরকারের সময়ে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমবেশি লঙ্ঘিত হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে পড়েছে।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিংবা জনপরিসরে বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ভাবনা প্রকাশের অধিকার হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (ড্যানেসি, ২০০৯: ১২৮)। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আমরা চিন্তার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে একত্রে মিলিয়ে আলোচনা করে থাকি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচক হিসেবে পাঠ করা হয়। একটি দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে কি নেই, এবং নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতার আছে কি নেই, তা দিয়ে সহজেই গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি পরিমাপ করা সম্ভব। সে হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে গত এক দশকে সরকারব্যবস্থা যেমন গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে ক্রমশ একদলীয় বা একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, তেমনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।
প্রেক্ষাপট
স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কখনোই আদর্শ পরিস্থিতিতে ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকেরা সরাসরি মত প্রকাশ করতে পারছেন। এর আগে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মধ্যেই সীমিত ছিল, কারণ ব্যক্তি নাগরিকের মত প্রকাশের তেমন কোনো মাধ্যম ছিল না। সেই বিবেচনায় বলা যায়, স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ১৯৭০-র দশকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে জিয়াউর রহমান সরকারের সময়ে ও ১৯৮০-র দশকে এরশাদ আমলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন চলাকালে সংবাদপত্রের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল না। সাংবাদিকরা একটি নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি সবসময়ই টের পেতেন, তবুও অনেকে নির্ভিকভাবে সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর নব্বই দশকে অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে দেশে মুক্তবাজার নীতি গৃহীত হলে বেসরকারি পর্যায়ে নতুন নতুন অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে এবং সাংবাদিকরা অনেকখানি স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ পান। আর নতুন শতকে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের বিস্ফোরণে অনেক টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলের আগমণ ঘটে। তবে এসব ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম চালু করবার লাইসেন্স কেবল সরকারঘনিষ্ঠ লোকজনই পেয়ে থাকেন। ফলে সরকার পরিবর্তনে বেশ কিছু চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায় অথবা মামলার মুখোমুখি হয়। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে যেহেতু একটি দলই ক্ষমতাসীন রয়েছে এবং লাইসেন্স প্রদানের নীতি যেহেতু একই থেকে গিয়েছে, তাতে দেশে বহু সংবাদপত্র, প্রায় চল্লিশটি টেলিভিশন, প্রায় ২০টি এফএম রেডিও থাকার পরও সরকারপসন্দ মতই ‘স্বাধীনভাবে’প্রকাশিত হচ্ছে, এবং সরকারবিরোধী মত প্রকাশিত হচ্ছে স্বনিয়ন্ত্রণের (সেলফ-সেন্সরশিপ) মধ্য দিয়ে ও সীমারেখা মধ্যে থেকে। সাম্প্রতিক সময়েই যুক্ত হয়েছে সাধারণ নাগরিকের সরাসরি মতপ্রকাশের মাধ্যম সামাজিক মাধ্যম (ফেসবুক ইউটিউব) ও ব্লগ। প্রাথমিকভাবে এই পাটাতনগুলোর ব্যবহারকারীরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারলেও, আইনী বেড়াজাল এবং হত্যা-হামলা-মামলা ইত্যাদির মুখে তারাও স্বনিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছেন। আবার স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে, মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের অংশ হিসেবে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহারের চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। আবার বেসরকারি সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণের ফলে, আধেয় নির্বাচন অনেকক্ষেত্রে সাংবাদিকদের পরিবর্তে মিডিয় প্রতিষ্ঠানের পুঁজিপতি মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছে। অর্থাৎ মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রভাবও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মতপ্রকাশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
প্যারিসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্ট্রিয়ার (আরএসএফ) প্রতিবছর সারাবিশ্বের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম ১। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ছিল ১৩৮তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৩৯তম। আরএসএফ যেসব সূচকের ভিত্তিতে এই র্যাংকিং করে সেগুলো হলো – বহুত্ববাদ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, পরিবেশ ও স্বনিয়ন্ত্রণ, আইনী কাঠামো, প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, অবকাঠামো, সহিংসতা২। আমি মনে করি, বাংলাদেশ যেকয়েকটি স্থানের পিছিয়ে পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো – স্বনিয়ন্ত্রণ, আইনী কাঠামো ও সহিংসতা। বহু মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি সত্ত্বেও, স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেল্ফ সেন্সরশিপ খুব স্পষ্ট, পূর্বেকার আইসিটি আইন ও হালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর এক আইন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং অনলাইন ব্যবহারকারী ও সাংবিাদকদের ওপর মামলা ও প্রত্যক্ষ হামলা অব্যাহত রয়েছে।
সর্বোপরি, দেশব্যাপী এক ভয়ের পরিবেশ রয়েছে যা মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম এক বাধা। গুম, ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধীদলের ও বিরোধীমতের ব্যক্তিদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার ও হয়রানি, ফোনে আড়িপাতা ও সুবিধামতো সেগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ, ২০১৮ সালের শিক্ষার্থীদের দুই আন্দোলন – শিক্ষা ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন – নিষ্ঠুরভাবে দমন এবং প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট শহিদুল আলমকে গ্রেফতার ও কারাগারে প্রেরণের মতো ঘটনা সার্বিকভাবে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে, যাতে মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। ২০১৮ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে একতরফাভাবে শতকরা ৯৬ ভাগ আসন বর্তমান সরকার নিজের করে নেবার মাধ্যমে দেশে একদলীয় কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী হয়েছে যা এক ভীতিকর, হতাশাজনক ও চরম অগণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। এই পরিবেশ প্রকারান্তরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিসরকে একেবারে সঙ্কুচিত করে ফেলেছে।
আইনী কাঠামো
বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা সংক্রান্ত বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে, নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এর কিছু খসড়া আকারে এখনও আছে, কিছু চূড়ান্ত হয়েছে। এসবকিছুর মধ্যে একমাত্র ‘তথ্য অধিকার আইন ২০০৯’ নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক হয় নি। নয়তো প্রায় সব আইন ও নীতিমালা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। এসব আইন ও নীতিমালাকে বিশ্লেষক-সাংবাদিক-অনলাইন ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ‘নিবর্তনমূলক’হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ‘সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪’ প্রচুর বিতর্কের জন্ম দেয়। তবে সবচেয়ে বেশি বির্তক হয় আইসিটি আইনকে (২০০৬ সালে প্রণীত, ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়) নিয়ে। বিশেষত এর ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনের ৫৭ ধারাটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। এটি বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানিকর কিছু বলা হলে তার বিরুদ্ধে যে শাস্তির বিধান রাখা হয় তা ছিল অত্যন্ত কঠোর এবং প্রচলিত আইন ও সাংবিধানিক পরিকাঠোমের বিরোধী। একই ধরনের মানহানিকর বক্তব্য মুদ্রণ মাধ্যমে দেয়া হলে, তার জন্য যদি ২ মাসের কারাদণ্ড বরাদ্দ হয়, তবে কেবল ডিজিটাল মাধ্যম বা অনলাইনে তা প্রকাশ করলে ৭ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এবং যেকোনো মামলা জামিন-অযোগ্য, যেকোনো কিছু পুলিশ আমলে নিতে পারবে এবং ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার করতে পারবে। অর্থাৎ অভিযুক্তের নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোনো ফাঁকই রাখা হয় নি। ফলে এটা ছিল প্রচলিত অর্থে এক ‘কালো আইন’এবং এর ভয়ঙ্কর দিকটির কথা সরকার স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং তারা বলতে থাকেন যে, নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারার মতো কিছু থাকবে না৩। কিন্তু নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হবার দেখা যায়, তা আইসিটি আইনের তুলনায় আরো ভয়ঙ্কর। আইসিটি আইন ছিল অনলাইনের ব্যবহারকারীদের জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার কারণে সাংবাদিকতাকে নিগড়ে বেঁধে ফেলা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে পুনরায় বিতর্ক শুরু হয় এবং এপর্যায়ে সাংবাদিকরা এবং বিশেষত ‘সম্পাদক পরিষদ’আইনের আপত্তিকর দিকগুলো নিয়ে বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করে সংবাদপত্রে পূর্ণপৃষ্ঠাব্যাপী প্রতিবেদন ছাপেন এবং স্পষ্টভাবে বলেন এই আইনের কয়েকটা ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। সম্পাদকরা এমনকি প্রেসক্লাবের সামনে এবিষয়ে প্রতিবাদী মানববন্ধনও করেন। কিন্তু সরকার যেহেতু কর্তৃত্ববাদী আচরণে পূর্বের তুলনায় আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী, তাই তারা কোনো আপত্তিই কর্ণপাত করেন নি। ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে সংসদে আইনটি পাশ হয়ে যায়। সারা দেশের মানুষের আপত্তি আমলে না আনা হলেও, পুলিশের আপত্তির মুখে একটি স্থানে পরিবর্তন আনা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন নেওয়ার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পুলিশের আপত্তির মুখে মাত্র এক দিনের মধ্যেই অনুমোদনের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। অর্থাৎ তারা কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই তল্লাশি বা গ্রেপ্তার করতে পারবে।
বস্তুত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পূর্বেকার ৫৭ ধারার ব্যাপারগুলো ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে নির্বাচিত দু’টি ধারা (৩২ ও ৪৩) আলোচিত হলো। ৩২ ধারায় বলা আছে:
(১) যদি কোনো ব্যক্তি Official Secrets Act, 1923 (Act No. XIX of 1923), এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করনে, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর কারাদণ্ডে অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডেদণ্ডিত হবেন।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এ উল্লেখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ সংঘটন করেন তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
৪৩ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো পুলিশ অফিসারের মনে করেন যে এই আইনের (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, বা হচ্ছে বা হবার সম্ভাবনা আছে তবে ওই স্থানে প্রবেশ করে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি করতে পারবে, ব্যবহৃত ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করতে পারবে, দেহ তল্লাশি করতে পারবে এবং সন্দেহ হলে গ্রেফতার করতে পারবে।
এটা বেশ কৌতুকপ্রদ ব্যাপার যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় ১৯২৩ সালের আইনকে সাক্ষী মানা হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত এই আইনটি তৎকালীন সরকারের জবাবদিহিতা এড়ানোর জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল যাতে নিঃসন্দেহে একটি অগণতান্ত্রিক আকাঙ্খা ছিল। অর্থাৎ সরকার যা প্রকাশ করবে না বা করতে চায় না, তাই ওই আইনের সুরক্ষায় অধরা থেকে যাবে। তাহলে সাংবাদিকরা করবেটা কী? বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থ লোপাট হয়ে গেলে, সেসংক্রান্ত কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে, সেই তথ্য যদি ডিজিটাল ফরম্যাটে থাকে, তবে তা সংগ্রহ করা অপরাধ হবে? শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হলে তদন্ত করা যাবে না, যেক্ষেত্রে আজকার অনেক তথ্যই ডিজিটাল ফরম্যাটে রক্ষিত থাকে? অর্থাৎ সরকারি পর্যায়ে যত অঘটন, অনিয়ম, কেলেঙ্কারি হোক, অনুসন্ধানের সুযোগ থাকবে না? অনুসন্ধানের চেষ্টা করলে বা তথ্য সংগ্রহ করলে ১৪ বছরের জেল হবে? একদিকে তথ্য অধিকার আইন বলবৎ আছে, অন্যদিকে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বরাত দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দূর্গ গড়ে তোলা হচ্ছে। আইনী তামাশা বলা যেতে পাওে একে।
অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক ধারা হলো ৪৩ ধারা। পুলিশকে কী অপরিসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে! পুলিশ যদি নেহায়েৎ মনে করে কোনো অপরাধ ‘সংঘটিত হতে পারে’তবেই তল্লাশি-জব্দ-গ্রেফতার করতে পারবে, কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই। পুলিশের ‘মনে হওয়া’ই যথেষ্ট কাউকে শাস্তি দেবার জন্য, হয়রানি করার জন্য! পুলিশি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে এরকম আইনই বোধহয় প্রয়োজন পড়ে, যেখানে নাগরিকের বা অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই রাখা হয়নি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৩টি ধারা জামিন-অযোগ্য। প্যারিসভিত্তিক আরএসফ, নিউ ইয়র্কভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম অব জার্নালিস্টস – মতপ্রকাশ ও সাংবাদিকতা পরিবীক্ষণকারী সব আন্তর্জাতিক সংস্থাই এই আইনটির বিরুদ্ধে উদ্বেগ জানিয়েছে।
সম্পাদক পরিষদ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ তারিখে কয়েকটি পত্রিকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে তাদের বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের শুরুতে তারা তাদের বিশ্লেষণের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।
জাতীয় সংসদে সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিচের মৌলিক ত্রুটিগুলো রয়েছে:
১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২. এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
৩. এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৫. এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করবে।
(প্রথম আলো, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)
কিন্তু সরকার কারো কোনে ওজর, কোনো প্রতিবাদ আমলে নেয় নি। একতরফা সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে কোনো তর্কবিতর্ক করতে হয় নি। বস্তুত কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার পেছনে আইসিটি আইন বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সরকার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। সফলভাবে এর প্রয়োগও আমরা দেখেছি। যেমন সরকারপ্রধান বা কোনো মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতার নামে অনলাইনে কেউ প্রতিবাদমূলক কিছু লিখলে দেখা গেছে ওই নেতার নির্দেশে বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ৫৭ ধারায় দ্রুত মামলা করছে কোনো ছাত্রনেতা বা চাটুকার কর্মী। এভাবে আইসিটি অ্যাক্টের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায়। ২৪ জুলাই, ২০১৮ তারিখে প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান জানান, ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে৪। বস্তুত আইসিটি আইন প্রবর্তনের পর সনাতনী মানহানিবিষয়ক আইন ব্যবহার হয়নি বললেই চলে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে:
বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের মামলা হু হু করে বাড়ছে। অঙ্কের হিসেবে ৩ বছরে মামলা বেড়েছে প্রায় ২০০০ গুণ। আর এসব মামলার প্রায় সবই করা হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায়। ধারাটি অজামিনযোগ্য (আসাদুজ্জামান, ২০১৬)৫।
এই হিসেব প্রতিবেদক সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুনালের মামলার সংখ্যা হিসেব করেই বলেছেন। এমন নয় যে, অনলাইনে ছদ্মনাম ব্যবহার করে সত্যি সত্যি অত্যন্ত মানহানিকর কেউ কিছু লেখে না। কিন্তু মামলার হারের এই বৃদ্ধি প্রমাণ করে, স্বাভাবিক সমালোচনা, যা গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার, সেটা হরণ করার জন্যই এই আইনের প্রবর্তন করা হয়েছে। শহিদুল আলমকেও আইসিটি আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আবার অরাজনৈতিক কারণেও, ব্যক্তিগত-পেশাগত দ্বেষ-বিদ্বেষ থেকেও অন্যকে হয়রানি করার জন্য এই আইনের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এই লেখকের বিরুদ্ধেও ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। সবমিলিয়ে দেশে একটা কর্তৃত্ববাদী, অসহিষ্ণু ও অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে এই আইন খুব অবদান রেখেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই প্রবণতার পরিধি আরও বিস্তৃত হয়ে গণমাধ্যমকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
মূলধারার গণমাধ্যম
আইসিটি আইন পরোক্ষভাবে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রত্যক্ষভাবে মূলধারার সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমনকি চলতি সংবাদ বা হার্ড নিউজ পরিবেশনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও আইনমন্ত্রী ডয়েচে ভেলে বাংলাকে বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকরা চিন্তা করবেন না, ৩২ ধারা আপনাদের বিরুদ্ধে নয়’৬, কিন্তু এই আশ্বাসসবাণী বলবৎ থাকে নি। সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের প্রেক্ষাপটে খুলনার দু’জন সাংবাদিক রিপোর্ট করেন যে খুলনা-১ আসনে ভোটারের সংখ্যার চাইতে ভোটপ্রদানের সংখ্যা বেশি হয়েছে। ওই দু’জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় এবং একজন গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত সাংবাদিককে শারীরিকভাবে হেনস্থা করার অভিযোগও পাওয়া যায় ৭। পরে অবশ্য তিনি জামিন পান। জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি ওই রিপোর্ট করেন এবং ভুলটা নির্বাচন কমিশনের লোকজনের।
কিন্তু এই আইনী বাধার বাইরেও একটা চিত্র আছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়াই মোটের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আগেই বলা হয়েছে লাইসেন্স প্রদানের নীতি অনুযায়ী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো খুব একটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। অনলাইন পোর্টালগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দক্ষিণপন্থী সংগ্রাম, দিনকাল, ইনকিলাব ইত্যাদি পত্রিকার প্রভাব তেমন নেই পাঠকমহলে। তবে প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, বণিকবার্তা বা নিউ এইজ পত্রিকা কিছুটা স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার শীর্ষস্থানীয় দু’টি পত্রিকা এবং সমাজে তাদের প্রভাব রয়েছে। এই দুটো পত্রিকা নিয়ে আমাদের পুরনো অভিযোগ রয়েছে – নব্বই দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রসারের জন্য জনমনে ভোক্তামনষ্কতা তৈরি করতে (দেখুন হক, ২০১১) এবং রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে সুশীল সমাজের মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনা করতে (দেখুন নিউটন, ২০১৩) পত্রিকা দু’টি ভূমিকা রাখতে চেয়েছে। প্রথমটিতে সফল হলেও তারা দ্বিতীয়টিতে ব্যর্থ হয়েছে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ বা রাজনীতিবিদরা পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণের পরে। তবে গত এক দশকে পরাক্রমশালী আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে অন্য সব পত্রিকা-মিডিয়া যেমন গাঁটছড়া বেঁধেছে, সেই প্রেক্ষাপটে এই দুই পত্রিকা স্বাধীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে। ফলে তাদের ওপরে চাপ এসেছে। ‘সরকারের ইমেজ ক্ষুণ করার চেষ্টা’র অভিযোগে ২০১৫ সালে শীর্ষস্থানীয় টেলিকম কোম্পানিগুলোকে বিজ্ঞাপন না দিতে সরকারের দিক থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে৮। বস্তুত, প্রচুর সংবাদপত্র, প্রচুর টেলিভিশন ও বেতার চ্যানেল থাকার পরেও সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারমাধ্যমগুলোতে কমই দেখা যায়। সংবাদপত্রের কলামে বা টেলিভিশন চ্যানেলে সরকারপন্থী সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিও প্রবল, যাদের দাপটে ভিন্নমত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কেবল বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলের রুটিন কর্মসূচি নয়, জনগণের স্বার্থে যে আন্দোলনগুলো হয়ে থাকে, সেগুলোর খবরাখবর এসব মিডিয়ায় সামান্যই পরিবেশিত হয়। পরিবেশবাদী ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার উদ্দেশে যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী আন্দোলন, তার সীমিত ও খণ্ডিত কাভারেজ হতে দেখি আমরা। উল্টো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষের মত সবলভাবে উপস্থিত হয়ে থাকে। এরকম পরিস্থিতি তৈরী হয় বলেই ড্যানি শেকটার (১৯৯৮) বলেছিলেন, “দ্যা মোর ইউ সি, দ্য লেস ইউ নো”। শেকটার অবশ্য কথা বলেছিলেন ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।
গণমাধ্যমের জন্য স্বাধীন মতপ্রকাশে যেমন বাধা আছে, বা ভয়ের পরিবেশ তৈরী হয়ে আছে এবং গণমাধ্যমগুলো স্বনিয়ন্ত্রণ করছে৯, কিন্তু সরকারকে বাড়তি সেবা দেবার জন্য বেশ কিছু গণমাধ্যম মাঠে সরব থাকে। যখন কোনো আন্দোলন দানা বাঁধে (ধরা যাক, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন), কিছু টেলিভিশন চ্যানেল চেষ্টা করে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে টক-শোতে ডেকে নিয়ে, সহযোগী সাংবাদিকদের সহায়তায়, আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কলঙ্ক আরোপ করতে, এভাবে পুরো আন্দোলনকে অপশক্তির আন্দোলন বলে প্রমাণ করতে। একদিকে রয়েছে সরকারের নিষ্ঠুর দমননীতি – গুম-নিখোঁজ, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার; অন্যদিকে রয়েছে পোষ্য মিডিয়া, যারা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কাজটি করে থাকে। তারই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে একাত্তর টিভি ও সময় টিভিতে নির্বাচনকালীন বিরোধী জোট নাগরিক ঐক্য ও বিএনপি নেতৃবৃন্দের বেশ কিছু ফোনালাপ ফাঁস করা হয়। এতে তাদের নির্বাচনকালীন পরিকল্পনা, যাতে কিছু সহিংস ঘটনার পরিকল্পনাও রয়েছে, সেগুলোকে বারবার প্রচার করা হয়। আমরা জানি, সূত্র ছাড়া কোনো সংবাদ হয় না, কিন্তু এগুলো প্রাইম টাইম নিউজ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। ফোনে আড়ি পাতা এমনিতেই নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী, সেই অনৈতিক কাজটিকে তারা সংবাদ উপাদান হিসেবে প্রচার করেছে। এসব ফোনালাপকে ‘নাশকতার পরিকল্পনা’র ট্রিটমেন্ট দিয়ে, অভিযুক্তদের কোনো বক্তব্য প্রচার ছাড়াই একতরফা প্রচারকে অনৈতিক ও দালালীর সাংবাদিকতা বলতে হবে। কারণ এই আলাপগুলো সবই একপাক্ষিক, এগুলোর সব সুবিধা সরকারই পেয়েছে। এসব ‘দালাল মিডিয়া’র ক্ষমতা ছিল না নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের নেতৃবৃন্দ কী পরিকল্পনা করছে, তা জানানোর – কীভাবে ভোট কারচুপি হবে, কীভাবে নির্বাচনের আগে বিরোধী কর্মীদের গ্রেফতার করা হবে বা হুমকি দিয়ে নিজ নিজ গৃহে অন্তরীণ থাকতে বাধ্য করা হবে?
হুমকি ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি স্বনিয়ন্ত্রণ ও দালালীর বাইরে অবশ্যই আরেকটি বিষয় হলো সাংবাদিকদের ওপর প্রত্যক্ষ বা শারীরিক হামলা। দেশীয় বেসরকার মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশে ১২২ জন সাংবাদিক শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা বা হুমকি-হয়রানির শিকার হয়েছেন।… আর ২০১৮ সালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা হয়েছে ২০৭টি। এর মধ্যে খুন হয়েছেন ৩ জন। ২০১৬ সালে নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১১৭টি (সুলতান, ২০১৯: ২)। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় কর্মরত আলোকচিত্রী ও সাংবাদিকদের সরাসরি আঘাত করে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যরা এবং এতে অন্তঃত ১০ জন সাংবাদিক আহত হন১০।
সামাজিক মাধ্যম
ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যম হলো এমন পাটাতন যাতে সাধারণ মানুষ যুক্ত এবং এখানে সরাসরি তারা তাদের মত প্রকাশ করে থাকেন। ম্যানুয়েল ক্যাস্টেলস (২০০৫) বর্ণিত ‘নেটওয়ার্ক সমাজ’-এর সার্থক উদাহরণ হলো এই সামাজিক মাধ্যম। এর সদস্যরা ‘আনুভূমিক যোগাযোগ’-এর মাধ্যমে একটি ‘প্রতি-ক্ষমতা’র (ক্যাস্টেলস, ২০০৭) জন্ম দেয় এবং এর মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে আর উত্তর আফ্রিকায় এরকম কয়েকটি সরকারের পতন হয়েছিল ২০১০-১১ সালে। এই ঘটনা সব দেশের সরকারকে সতর্ক করে তোলে এবং সরকারগুলোর প্রণোদনায় নজরদারির এমন যন্ত্র তৈরি করা হয়, যার মাধ্যমে অনলাইন ব্যবহারকারীদের নজরদারি করা যায়, অফিসে বসেই। কোনো সরকার এগুলো তৈরি করেছে, আর কোনো সরকার জনগণের করের টাকা দিয়ে বেশি দামে এগুলো কিনেছে এবং এরপর জনগণকেই নজরদারি করা শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকারও এর ব্যতিক্রম নয়১১। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইসিটি আইন বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। গত নির্বাচনের আগে এই নজরদারি আরও বৃদ্ধি পায়১২। বোঝাই যায়, সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের নজরদারিতে রেখে নির্বাচনে সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নজরদারি, কঠোর আইন প্রণয়ন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকারকে সরকার অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এধরনের নজরদারি ও শাস্তি প্রদানের পেছনে সরকারপক্ষ এবং তার পক্ষে সাফাই প্রদানকারী টকশোকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ও অনলাইন পণ্ডিতেরা যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন ভুয়া সংবাদ ও গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টাকে। একথা সত্যি ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম হলো ভুয়া সংবাদ ও গুজবের উর্বর ক্ষেত্র। ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা রংপুরে সাম্প্রদায়িক হামলাও করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় এক পর্যায়ে টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হলে, সেই সুযোগে হত্যা-ধর্ষণের গুজব ডালপালা মেলে। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে অভিনেত্রী নওশাবা গ্রেফতার হন। তখন আন্দোলনকারীরা গুজবনির্ভর আন্দোলন করছে এবং তারা ‘অপশক্তি’দের দ্বারা চালিত বলে নিন্দা জানায় সরকারের ঘনিষ্ঠ মিডিয়া এবং অনলাইন যোদ্ধারা। কিন্তু অচিরেই জানা যায়, গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়াতে সরকারপক্ষীয়রা কম যান না। নির্বাচনের ১০ দিন আগে, সরকারের বিভিন্ন পদে থাকা কিছু লোক দ্বারা পরিচালিত একাউন্ট ও পেজ ফেসবুক বন্ধ করে দেয়১৩। এছাড়া ব্লগ-জমানা (২০০৭ পরবর্তী সময়ে) থেকেই কিছু গ্রুপ (যেমন ‘এ-টিম’) অনলাইনে লড়াই-আক্রমণ-গালাগালিতে পরিচিত হয়ে ওঠে যার কিছু নিম্নমানের সংস্করণ (যেমন ‘সিপি গ্যাং’) ফেসবুকে সন্ত্রাস কায়েম করে এবং শেষপর্যন্ত এরা ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই তাদের ‘লাঠিয়ালগিরি’কে উৎসর্গ করে। এই অনলাইন যোদ্ধারাও অনলাইনে স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য বাধা। এদের আক্রমণের লক্ষ্য সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারী স্বাধীনতাবিরোধী দক্ষিণপন্থী জামাতগোষ্ঠী কেবল নয়, প্রগতিশীল, বাম, কিংবা স্বাধীনচিন্তার মানুষদেরও এরা অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করতে সক্ষম। উল্টো সমালোচনামুখর প্রগতিশীলদেরও তারা ছদ্ম জামাতি বা ‘বামাতি’ উপাধি দেয় এবং প্রয়োজনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এরা সরকারকে ক্রিটিক করছেন এরকম যেকোনো ব্যক্তি, তিনি যদি সম্মানীয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিও হন, তাদের বিরুদ্ধে এদের কেউ একজন মিথ্যা বা বানোয়াট কথা লেখে এবং বাকিরা তা শেয়ার করে করে প্রায় সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে১৪।
একটি কারচুপির নির্বাচনের পর ক্ষমতা গ্রহণ করে সরকার কিছু ‘কল্যাণমুখী’পদক্ষেপ নেয়। এর অংশ হিসেবে তারা বহু পর্নোগ্রাফির সাইট বন্ধ করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় অশ্লীলতা ও জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধ করতে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজিগুলোকে ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে একটি তালিকা পাঠায় বিটিআরসি। সেই তালিকায় সামহোয়ারইন… ব্লগের নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ফলে সামহোয়ারইন সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। এই লেখা পর্যন্ত সামহোয়ারইন সব নেটওয়ার্ক থেকে দেখা যাচ্ছে না, অর্থাৎ আংশিক নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান আছে। বাংলা ভাষার প্রথম কমিউনিটি ব্লগ, যেটা ২০০৬ সালের শেষে চালু হয়, যেখানে অনেক লেখকের জন্ম হয়েছে এবং অনলাইনে বাংলা ভাষায় লেখালেখি চর্চায় যে সাইটটির অবদান পথিকৃতের, সেই সাইটটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ অত্যন্ত আপত্তিজনক১৫।
মতপ্রকাশের অন্যান্য উপায়
এতদিন কেবল চলচ্চিত্র সেন্সরবিধির আওতায় ছিল। কিন্তু আজকাল সাহিত্যচর্চা বা বইপুস্তকের মাধ্যমে মতপ্রকাশের বিষয়টিও পরোক্ষ সেন্সরশিপের মধ্যে পড়ে গেছে। একসময় লেখালেখির কারণে তসলিমা নাসরীনকে দেশ ছাড়তে হয়েছে, কিন্তু এখন লেখালেখি করে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে মতপ্রকাশ দুই দিক থেকে আক্রান্ত – একদিকে রয়েছে রাষ্ট্রীয় আইন, আরেকদিকে জঙ্গির চাপাতির ঝিলিক। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড নিশ্চয়ই সবচেয়ে আলোচিত (অভিজিতের বই প্রকাশ করার জন্য তার প্রকাশক দীপনকেও হত্যা করা হয় এবং আরে প্রকাশক টুটুলকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমন করা হয়), কিন্তু একের পর এক যখন ব্লগার খুন হচ্ছিল, তখন খুনিদের গ্রেফতার করতে সরকার কোনো সক্রিয় উদ্যোগ নেয়নি। বরং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লিখলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে মধ্যে বেশ কয়েকবার ঘোষণা দেন১৬। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীও সেই ধারায় বক্তব্য দেন। নিজেকে জাহির করার জন্য ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষমূলক লেখালেখি নিশ্চয়ই দায়িত্ববোধের পরিচয় নয়, কিন্তু সেকারণে কাউকে হত্যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এবং সেই হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করে, ঘটনার শিকার নিহত ব্লগারদের দায়ী করা হলে মূলত হত্যাকারীদেরই উৎসাহিত করা হয়। আস্কারাপ্রাপ্ত বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠী ব্লগারদের পরে, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান পাদ্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রমুখকে একের পর এক হত্যা করতে থাকে। এই ধারাবাহিক জঙ্গি কার্যক্রম থামাতে সরকার লক্ষ্যযোগ্য কোনো পদক্ষেপই নিতে পারে নি, হোলি আর্টিজেনে মর্মান্তিক হামলার আগ পর্যন্ত। হোলি আর্টিজেনের হামলার পর সরকারের টনক নড়ে এবং তারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুরু করে। এক পর্যায়ে বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে সরকার জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত নেতা ও কর্মীদের হত্যার মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রমকে সাময়িকভাবে দমন করে।
কিন্তু এর মধ্যেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নেমে আসে নানান অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ। বইমেলা থেকে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে ২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনী বন্ধ করে দেয় বাংলা একাডেমি। ২০১৬ সালে ব-দ্বীপ প্রকাশনীকে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিককে গ্রেফতার করা হয়। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার, বইমেলার নতুন বই-পুস্তক পুলিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এর চেয়ে হানিকর আর কী হতে পারে! আর এও বড় খেদের বিষয় যে, যে শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে হেফাজতে ইসলামের উত্থান, যে হেফাজতে ইসলাম বলেছিল ‘নাস্তিকদের কতল করা ওয়াজিব হয়ে গেছে’১৭, সেই হেফাজতের তালিকা মোতাবেক সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকে রচনা সরিয়েছে, হাইকোর্টের সামনে থেকে থেমিসের ভাস্কর্য অপসারণ করেছে এবং তাদেরই দেয়া ‘কওমী জননী’১৮ উপাধি প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন। অথচ এই সরকারকেই ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম বলেছিল নাস্তিকদের সরকার১৯। ঢাকা দখল করলে এই সরকারই হেফাজতে ইসলামকে নির্মমভাবে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ই মে। যে দল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দল পরিচালিত বর্তমান সরকার একদিকে আচরণে অসহিষ্ণু-ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে ধর্মীয় শক্তির কাছে নতজানু হয়ে পড়েছে। মতপ্রকাশ স্বাধীনতা পরিস্থিতি শোচনীয় হবার জন্য গুরুতর কারণগুলো আমাদের সামনে এভাবে হাজির হয়ে পড়েছে। হোলি আর্টিজেনের ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত চলচ্চিত্র ‘শনিবার বিকেল’ যে সেন্সরবোর্ডে আটকা পড়বে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তেমনি বিস্ময়কর নয় ৫ই মার্চ, ২০১৯ তারিখে এশিয়ার বৃহত্তম আলোকচিত্র মেলা ‘ছবিমেলা’উপলক্ষ্যে শহিদুল আলমের সঞ্চালনায় বিশ্বখ্যাত প্রতিবাদী লেখক অরুন্ধতী রায়ের জনগণের জন্য উন্মুক্ত বক্তৃতাটি নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে২০।
উপসংহার
একটি বদ্ধ পরিস্থিতিতে সরাসরি বক্তব্যপ্রদান কঠিন হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি আসলেই অনেকখানি পাল্টে গেছে। নির্বাচনের পরে খুলনা-১ আসনসংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিবেদন দ্বারা যদি কেউ আক্রান্ত বোধ করেন, ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে পত্রিকায় একটি প্রতিবাদলিপি পাঠাতে পারেন, পত্রিকা সেটা ছাপবে প্রতিবেদকের ব্যাখ্যাসহ। কিন্তু সেসব চর্চার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি সাংবাদিককে গ্রেফতার করে রিমান্ডে পাঠানোর ঘটনায় বোঝা যায়, পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। সাংবাদিক-লেখক-অনলাইন ব্যবহারকারীর জন্য স্বাধীনতার পরিধি খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্যাটায়ার-সাহিত্য কিছুটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় সরকার টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে যদি আরেকটু সহনশীল হয়, ভিন্নমতের জন্য কিছুটা পরিসর ছেড়ে দেয়। সরকারের মনে রাখা উচিত যারা সারাক্ষণ তার প্রশংসা করছে, তাদের মধ্যেই স্তাবকের সংখ্যাই বেশি। আর যারা সমালোচনা করেন, তাদের মধ্যে কিছু বন্ধুও হয়তো আছে। তারা হয়তো সমালোচনার মধ্য দিয়ে তাকে সঠিক পথে থাকতে সাহায্য করছে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সরকারের যথেষ্ট দুর্নাম ইতোমধ্যে জুটেছে, তার অন্যতম একটি কারণ হলো মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা সবাই জানেন ও মানেন। কিন্তু জিডিপিভিত্তিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আজকাল আর কেউ উন্নয়ন বলে না, উন্নয়নের জন্য সঙ্গে চাই সামাজিক ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন এবং অবশ্যই নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতা।
অন্তঃটীকা
১ rsf.org/en/ranking_table| ০২ মার্চ ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
২ rsf.org/en/detailed-methodology| ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
৩ ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ২৬শে জুলাই ২০১৮ তারিখে গণমাধ্যমকে জানান, ৫৭ ধারা বস্তুতপক্ষে ডেড। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পরে ৫৭ ধারা নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকবে না। সুতরাং এটা নিয়ে টেনশনেরও কোনো কারণ নেই। দেখুন: :www.priyo.com/articles/201807261740|০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
৪www.dhakatimes24.com/2017/07/24/41575।০২ মার্চ ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
৫www.prothomalo.com/bangladesh/article/983584।০২ মার্চ ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
৬ www.dw.com/bn/সাংবাদকিরা-চন্তিা-করবনে-না-৩২-ধারা-আপনাদের বিরুদ্ধে নয়/a-42630246। ০২ মার্চ ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
৭ bonikbarta.net/bangla/news/2019-01-02/182318/২০১৯-০১-০২/১৮২৩১৮।০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
৮ www.dw.com/bn/বিজ্ঞাপন-বন্ধেরনির্দেশে-সরকাররে-ইমজে-ক্ষ্ণ্ণু-করার-চেষ্টা/a-18780505। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
৯ বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা, ডিজিটাল গণমাধ্যম ও টেলিভিশনের ৩২ জন সাংবাদিক ও সম্পাদকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে এক খবরে জানিয়েছে, এযাবৎকালের সবচেয়ে কঠোর গণমাধ্যম আইনের কারণে তাঁরা একটি ভয়ের পরিবেশের মধ্যে আছেন। এ জন্য অনেকে ‘স্ব–আরোপিত’নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কাজ করছেন। দেখুন, election.prothomalo.com/news/1570056?suggestion=। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১০ www.jugantor.com/national/77480/সাংবাদকিদরে-ওপর-ছাত্রলীগরে-র্ববর-হামলা-আহত-১০। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১১ বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার ৯ মে, ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং সিস্টেম (এসএমএমএস) নামের উন্নত প্রযুক্তি খুব শিগগিরই যুক্ত হচ্ছে এলিট ফোর্স র্যা বের বলয়ে। বিশেষায়িত এই প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নজরদারির মধ্যে রাখবে ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইনস্টগ্রামসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বাদ থাকছে না বিভিন্ন ওয়েবপোর্টালও। প্রযুক্তির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ২০ জন র্যাব সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র (কাওসার, ২০১৬)। দেখুন: www.bd-pratidin.com/first-page/2016/05/09/143555। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১২ ২৫ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে দৈনিক সমকাল-এ প্রকাশিত সংবাদে জানা যাচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক তথ্য প্রচার প্রতিরোধে উদ্যোগ নিয়েছে র্যাব। এ লক্ষ্যে আগামী চার মাসের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটির দুই হাজার ৫০ জন অভিজ্ঞ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ২৪ ঘণ্টা উল্লিখিত মাধ্যমগুলো নজরদারিতে রাখবেন। তারা রাষ্ট্রবিরোধী গুজব, বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তিমূলক পোস্টের জবাব দেবেন। একই সঙ্গে এসব কাজে যারা যুক্ত থাকবেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে র্যাবকে সহযোগিতা করবেন। এ ছাড়া এসব মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের সঠিক তথ্য প্রচারেও দায়িত্ব পালন করবেন প্রযুক্তিবিদরা (সাইফুদ্দিন, ২০১৮)। দেখুন: samakal.com/bangladesh/article/18101517।০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১৩ বিবিসি বাংলা ২০শে ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের এক প্রতিবেদনে বলছে, সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইট ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে ভুয়া খবর প্রচারের জন্য তারা বাংলাদেশে তাদের প্ল্যাটফর্মে ৬টি একাউন্ট এবং ৯টি পেজ বন্ধ করে দিয়েছে। ফেসবুক বলছে, এগুলোতে ‘বাংলাদেশের সরকারের সমর্থনে বিভিন্ন কনটেন্ট পোস্ট করা হচ্ছিল’, এবং ‘এর সাথে সরকার-সংশ্লিষ্ট কিছু লোকের সম্পর্ক আছে’। দেখুন: www.bbc.com/bengali/news-46636943। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১৪ এসংক্রান্ত আলোচনার জন্য দেখুন (সুলতানা, ২০১৫)।
১৫ দেখুন: www.prothomalo.com/bangladesh/article/1580737। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১৬ দেখুন: www.channelionline.com/ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত-দ-ি২/। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১৭www.prothomalo.com/bangladesh/article/196120/নাস্তিকদের-কতল-করা-ওয়াজিব হয়ে গেছে। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১৮www.banglatribune.com/national/news/382643/এবার-‘কওমি-জননী’-উপাধি পেলেন শেখ হাসিনা। ০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
১৯ www.youtube.com/watch?v=0HKZCkvGOlw।০২ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
২০ দশম ছবিমেলা উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিত অরুন্ধতী রায়ের বক্তৃতাটি ৫ই মার্চ ২০১৯ তারিখে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন কমপ্লেক্স মিলনায়তনে বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। কিন্তু আগের রাতে আয়োজকরা জানতে পারেন, ‘অনিবার্য কারণে’বক্তৃতাটির অনুমতি বাতিল করেছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। আয়োজকরা ওইদিনই বিকল্প ভেন্যু হিসেবে ধানম-ির মাইডাস সেন্টারে সন্ধ্যা ৬টায় আলোচনার ব্যবস্থা করে ফেলেন। কিন্তু শ্রোতা হিসেবে লেখক অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে জানতে পারেন এখানেও অনুষ্ঠানটি করতে নিষেধ করেছে পুলিশ। এক পর্যায়ে অনুমতি মেলে এবং সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় বক্তৃতা শুরু হয়। উল্লেখ্য অরুন্ধতি রায় শহিদুল আলমের মুক্তির জন্যও কলম ধরেছিলেন। দেখুন www.prothomalo.com/bangladesh/article/1581975। ০৭ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
তথ্যসূত্র
ড্যানেসি, মার্সেল (২০০৯)। ডিকশনারি অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স। নিউ ইয়র্ক: এম. ই. শার্প ইনক.।
ক্যাস্টেলস, ম্যানুয়েল (২০০৭)। কমিউনিকেশন, পাওয়ার অ্যান্ড কাউন্টার-পাওয়ার ইন দ্য নেটওয়ার্ক সোসাইটি। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কমিউনিকেশন ১।
ক্যাস্টেলস, ম্যানুয়েল (২০০৫)। দ্য নেটওয়ার্ক সোসাইটি: ফ্রম নলেজ টু পলিসি। ম্যানুয়েল ক্যাস্টেলস ও গুস্তাভো কারদোসো (সম্পা.), দ্য নেটওয়ার্ক সোসাইটি: ফ্রম নলেজ টু পলিসি। ওয়াশিংটন ডিসি: জন হপকিনস সেন্টার ফর ট্রানস্যাটল্যান্টিক রিলেশনস।
শেকটার, ড্যানি (১৯৯৮)। দ্য মোর ইউ সি দ্য লেস ইউ নো: নিউজ ওয়ারস। নিউ ইয়র্ক: সেভেন স্টোরিস প্রেস।
হক, ফাহমিদুল (২০১১)। অসম্মতি উৎপাদন: গণমাধ্যমবিষয়ক প্রতিভাবনা। ঢাকা: সংহতি।
নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৩)। বাজারের যুগে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আম্মু-আব্বু সমাচার অথবা বাংলাদেশে বিদ্যমান মহাজনি মুদ্রণের পলিটিাল ইকোনমি। ফাহমিদুল হক ও আ-আল মামুন (সম্পা.), মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি। ঢাকা: আগামী।
সুলতান, টিপু (২০১৯)। মতপ্রকাশে বাধা আইন, ভয় ও চাপ। প্রথম আলো। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯।
সুলতানা, আইরিন (২০১৫)। সাইবার সন্ত্রাস ও ‘সিপি গ্যাং’সমাচার। opinion.bdnews24.com/bangla/archives/28999|০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে সংগৃহীত।
আসাদুজ্জামান (২০১৬)। সাইবার অপরাধের মামলা হু হু করে বাড়ছে। | www.prothomalo.com/bangladesh/article/983584//
প্রথম প্রকাশ: অগ্রায়ন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রকাশনা), এপ্রিল ২০১৯, ঢাকা।