অরাজ
আর্টওয়ার্ক: মাদার আর্থ শিল্পী: সুমিত দত্ত সূত্র: পিকটোরেম
প্রচ্ছদ » বন্দনা শিবা ।। একটি ভাইরাস, মানবিকতা আর এই পৃথিবী

বন্দনা শিবা ।। একটি ভাইরাস, মানবিকতা আর এই পৃথিবী

  • অনুবাদ: সুস্মিতা চক্রবর্তী
বন্দনা শিবা

একটি ছোট্ট ভাইরাস সারা পৃথিবীকে লকডাউন করে দিয়েছে। এর কারণে বিশ অর্থনীতি থমকে গেছে। এটা কেড়ে নিয়েছে সহস্র মানুষের জীবন আর লক্ষ মানুষের জীবিকা।

করোনাভাইরাস মানব প্রজাতি হিসেবে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে আমাদেরকে, আমাদের আগ্রাসী অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দৃষ্টান্তগুলি, আর এই পৃথিবী সম্পর্কে কি বলছে?

আর্ট ওয়ার্ক: কোয়ারেন্টাইন ফিলিং
শিল্পী: মোহাম্মদ আফিফা
সূত্র কার্টুন মুভমেন্ট

প্রথমত, আমাদের লকডাউন মুহূর্তগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই পৃথিবী সকল প্রজাতির জন্য আর আমরা যখন সবকিছু থামিয়ে দিয়ে রাস্তাগুলোকে ‘গাড়িশূন্য’ ফাঁকা করে দিলাম, বায়ুদূষণ কমে গেল। হাতিগুলো দেরাদুন শহরের উপকন্ঠে হরিদ্বারের হারকি পৌরির গঙ্গায় এসে স্নান করতে লাগল। লা কর্বিউসারের (La Corbusier’s) চন্ডীগড়ে চিতাবাঘ এসে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ালো।

দ্বিতীয় শিক্ষাটি হলো যে, এই মহামারীটি কোনো ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ নয় ঠিক যেমন জলবায়ুর চরমভাবাপন্নতা কোনো ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই উদ্ভূত মহামারী রোগগুলো— ‘মনুষ্যজাত’ (Anthropogenic) যেগুলো মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণেই ঘটেছে।

বিজ্ঞান আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, যখনই আমরা বন-জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র দখল নিতে শুরু করি, বিভিন্ন প্রজাতির বাসস্থান ধ্বংস করি এবং লাভের জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করি— এসবের ফলে আমরা নতুন নতুন রোগের ক্ষেত্রগুলো তৈরি করি। গত পঞ্চাশ বছরে তিনশত নতুন রোগজীবাণু উদ্ভূত হয়েছে। এটা ভালোভাবেই নথিভুক্ত যে, এইচআইভি, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মার্স ও সার্সসহ মানুষের বিভিন্ন রোগের প্রায় সত্তর শতাংশের বিস্তার ঘটেছে তখনই যখন অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র দখল করা হয়েছে আর এর ফলে ভাইরাসগুলো বিভিন্ন প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। যখন বৃহৎ লাভের জন্য প্রাণীদের উৎপাদন বাড়াতে তাদেরকে কারখানায়-খামারে আটকে রাখা হয়েছে সোয়াইন ফ্লু এবং বার্ড ফ্লু-এর মতো নতুন রোগগুলো তখনই ছড়িয়ে পড়েছে।

বর্তমান মহামারী এবং ভবিষ্যতের আরো মহামারীর মূলে প্রোথিত মানুষের লোভ, সেই সাথে অন্য প্রজাতির প্রাণীর অধিকারের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা না থাকা এমনকি স্ব-প্রজাতির প্রতিও মানুষের কোনো শ্রদ্ধাবোধ না থাকা। অপরিমেয় সম্পদের মোহভিত্তিক একটা বিশ্বঅর্থনীতি যার ফলশ্রুতিতে তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সম্পদগুলোর প্রতি মানুষের সীমাহীন ক্ষুধা যার পরিপ্রেক্ষিতে সীমাহীনভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে আমাদের এই গ্রহভিত্তিক, বাস্তুতন্ত্রনির্ভর এবং প্রজাতিগত মূল্যবোধের সীমানাগুলো।

আর্টওয়ার্ক: ব্যাট বর্ন
শিল্পী: অলাফ হাজেক
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

তৃতীয় শিক্ষাটি হলো, এই ভাইরাসটি আমাদের উপলব্ধি করাচ্ছে এভাবে যে, আমাদের এই স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সঙ্কট প্রজাতি ধ্বংস এবং অবলুপ্ত হওয়ার মতো সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট। এটি জলবায়ু সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট। যখন আমরা কীটনাশক ও আগাছানাশক বিষ ঢেলে পোকামাকড় এবং আগাছা ধ্বংস করি তখন কোনো প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মতো সঙ্কট অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। যখন আমরা জীবাশ্ম কার্বন পোড়াই যা এই পৃথিবী ছয়শত মিলিয়ন বছর ধরে জীবাশ্মে পরিণত করেছে, তখন আমরা এই গ্রহবাসী হিসেবে গ্রহের সীমা লঙ্ঘন করি। এর পরিণতি হলো জলবায়ুর পরিবর্তন।

বিজ্ঞানভিত্তিক অনুমানগুলো এই আভাস দেয় যে, আমরা যদি পৃথিবী এবং তার প্রজাতিগুলোর বিরুদ্ধে এই মানবসৃষ্ট যুদ্ধ না থামাই তবে আগামী একশ বছরের মধ্যে আমরা মানুষের জীবনধারণ ও টিকে থাকার উপযোগী এই একমাত্র পরিবেশটি ধ্বংস করে ফেলবো। আমাদের প্রজাতি অবলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে আরও দুইশত রকমের অন্যান্য প্রজাতিও লুপ্ত হয়ে যাবে যারা আজও এই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অবলুপ্ততার হুমকির সম্মুখীন এক লক্ষ প্রজাতির সাথে আরো একটি প্রজাতি হিসেবে যুক্ত হবো আমরা— শুধুমাত্র মানুষের লোভ, ঔদ্ধত্য আর দায়িত্বহীনতার কারণে।

আমাদের এই সময়ের সকল জীবন বিপন্নতার সঙ্কটের মূলে রয়েছে মানুষের যান্ত্রিকতানির্ভর, যুদ্ধবাজ, এবং মানবস্বার্থ-কেন্দ্রিক বিশ্বভাবনা যা প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন— যেখানে মানুষ পৃথিবীর প্রভুত্ব দাবি করে, নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে আর অন্যান্য প্রজাতিদেরকে লাভের জন্য বস্তুর মত নিয়ন্ত্রণ করে। এই মনোভাব অবশ্য অর্থনৈতিক মডেলের মধ্যেও নিবদ্ধ যেখানে বাস্তুতান্ত্রিক এবং নৈতিক সীমানাবোধকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হয়। কর্পোরেট মুনাফার প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে এই সব প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই দূর করার মতো বিষয়। মা পৃথিবীর অধিকার, অন্যান্য প্রজাতিসমূহের অধিকার, মানুষের অধিকার, এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকারের জন্য এই মডেলে কোনো জায়গাই নেই ।

 

আর্টওয়ার্ক: কমবাটিং দ্য আর্থ
শিল্পী: মেটিওরাইট লান্ডালোউ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

এই দুর্যোগ পরিস্থিতি এবং লকডাউন পরবর্তী ক্ষতি পুষিয়ে নেবার পর্যায়ে, এই পৃথিবী, তার জলবায়ু ব্যবস্থাপনাগুলো, অধিকারসমূহ এবং বিচিত্র প্রজাতিসমূহের বাস্তুতান্ত্রিক জায়গা, আদিবাসী মানুষ, নারী, কৃষক ও শ্রমিকদের রক্ষা করতে পারাটা আমাদের শেখা জরুরি।

আমাদেরকে এই লোভের অর্থনীতি এবং সীমাহীন উন্নয়নের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যা আমাদেরকে এক ধরনের অস্তিত্ব সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।। আমাদের এই সত্যে জেগে ওঠা জরুরি যে, আমরা ‘পৃথিবী পরিবার-এর সদস্য’ এবং প্রকৃত অর্থনীতি হলো ‘পরিচর্যার অর্থনীতি’— এই পৃথিবী এবং আমাদের পরস্পরের পরিচর্যার জন্য।

আগামীতে মহামারী, দুর্ভিক্ষ এবং একটি নতুন মৃত্যুর সম্ভাবনা, মানুষ মানুষকে ফেলে রেখে যাওয়া এসব এড়াতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বায়িত, শিল্পোন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, এগুলোই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করছে এবং জীবননাশী রোগব্যাধি ছড়িয়ে দিচ্ছে। স্থানীয়করণ বৈচিত্রপূর্ণ প্রজাতি, বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতি আর বৈচিত্রপূর্ণ স্থানীয় জীবনযাত্রা-অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য স্থান ছেড়ে দেয়।

আমাদেরকে সচেতনভাবেই বাস্তুতান্ত্রিক পদচিহ্ন কমিয়ে ফেলতে হবে যেন আমরা অন্য প্রজাতি, সমগ্র মানবজাতি এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সম্পদের ন্যায়সঙ্গত অংশ এবং বাস্তুসংস্থানের জায়গা বরাদ্দ রাখতে পারি।

আর্টওয়ার্ক: মনসান্ত
শিল্পী: মার্টিন ওল্টে
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এই জরুরি অবস্থা এবং লকডাউন আমাদের দেখিয়েছে যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে আমরা বিশ্বায়ন রোধ করতে পারি। বিশ্বায়ন রুদ্ধ করার এই অর্থনীতিকে স্থায়ীভাবে আত্মীকরণ করা হোক, এবং উৎপাদন স্থানীয়করণের মাধ্যমে গান্ধীজি’র স্বদেশী দর্শনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে পণ্য বানানো হোক।

গত তিন দশক ধরে ‘নবধান্য’-এর অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, স্থানীয়, জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জৈবিক খাদ্যব্যবস্থা সকলের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার যোগান দিতে পারে এবং একই সাথে এটি মাটি, পানি এবং জীববৈচিত্র্যকে পুনর্জীবিত করে।

আমাদের অরণ্যে, খামারগুলোতে, খাদ্যে, আমাদের অন্ত্রনালীতে জীববৈচিত্র্যের যে ঐশ্বর্য তা এই গ্রহকে, তার বিচিত্র প্রজাতিগুলোকে সেই সাথে মানবপ্রজাতিকে রোগ নয় বরং সুস্বাস্থ্যের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত রাখে ।

একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস আমাদেরকে প্রকৃতির সাথে সমন্বয়ের ভিত্তিতে গ্রহনিবিষ্ট, বাস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার মতো একটা বড় পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করতে পারে ।
অথবা, আমরা প্রকৃতির উপর আধিপত্য করার এই বিভ্রম নিয়েই বেঁচে থাকতে পারি এবং দ্রুত পরবর্তী মহামারীর গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারি এবং চূড়ান্তভাবে প্রজাতির বিলুপ্তির দিকে।

এই পৃথিবী ঠিকই টিকে থাকবে তা আমাদের নিয়েই হোক অথবা না নিয়ে।

রাজশাহী: ৩ মে, ২০২০।

সূত্র: ডেক্কান হেরাল্ড থেকে লেখাটি নেয়া হয়েছে। ২০২০-এর এপ্রিলের ৫ তারিখে প্রকাশিত।

 

সুস্মিতা চক্রবর্তী

সুস্মিতা চক্রবর্তী কবি, শিক্ষক ও গবেষক। অধ্যাপনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে। সম্পাদনা করেছেন নারীবাদী পত্রিকা চন্দ্রাবতী। তাঁর জন্ম কিশোরগঞ্জে; ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪ সাল। প্রকাশিত গ্রন্থ: ফোকলোর ও জেন্ডার : লোক ঐতিহ্যে পিতৃতন্ত্র ও নারীর স্বতন্ত্র স্বর (প্রবন্ধ), খোঁয়াড়েরর মেয়ে (কবিতা), ও নীল বিচ্ছেদ বড় ভালোবাসিলাম (কবিতা), অরুন্ধতী রায়ের অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট (অনুবাদ)। যোগাযোগ: susmitac134@gmail.com