অনুবাদ: সারোয়ার তুষার
‘সমাজতন্ত্র’ প্রত্যয়টির অর্থ নিয়ে যে কেউ চাইলেই তর্ক- বিতর্ক করতে পারে। কিন্তু এর সত্যিকারের অর্থ হল– উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ খোদ শ্রমজীবীদের নিজের হাতে থাকা।
শ্রমজীবীদের যারা শাসন করে, সেই মালিক-ব্যবস্থাপকদের হাতে উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ ও সমস্ত সিদ্ধান্ত কুক্ষিগত থাকা আর যাই হোক ‘সমাজতন্ত্র’ না; তা সেটা পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান হোক কিংবা একটা সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রই হোক।
সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ হিশেবে আখ্যায়িত করা মতাদর্শিক দ্বৈতচিন্তার এক চমকপ্রদ নজির। ১৯১৭ সালের অক্টোবরের বলশেভিক ক্যু লেনিন-ট্রটস্কিদের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করেছিল, যারা বিগত কয়েক মাসের গণ আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ফ্যাক্টরি কাউন্সিল, সোভিয়েত, গণ নিয়ন্ত্রণের অঙ্গসংগঠন সহ যেকোন প্রারম্ভিক পর্যায়ের সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন এবং শ্রমশক্তিকে পার্টি নেতাদের হুকুমের অধীনে নিয়ে এসেছিলেন, তারা যেটাকে বলতেন ‘শ্রমিক ফৌজ’।
‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটির যেকোন অর্থপূর্ণ ধারণার দিক থেকেই বলশেভিকরা এর যেকোন প্রকারের বিরাজমান উপাদানকে ধ্বংস করেছিল। এরপর থেকে আর কোন সমাজতান্ত্রিক উত্তরণ অনুমোদন পায়নি।
এই পরিণতি মার্ক্সবাদী চিন্তকদের তেমন একটা বিস্মিত করেনি, তারা বহু বছর ধরেই লেনিনের (যেমন ট্রটস্কি করেছিলেন) মতবাদকে সমালোচনা করে আসছিলেন, কারণ এই মতবাদ ভ্যানগার্ড পার্টির নেতাদের হাতে সমস্ত কর্তৃত্বকে কেন্দ্রীভূত করার পক্ষে।
প্রকৃতপক্ষে বেশ কয়েক দশক আগেই নৈরাজ্যবাদী চিন্তক বাকুনিন পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, [এমন ক্ষেত্রে] উদীয়মান বুদ্ধিজীবী শ্রেণী দুই পথের যেকোন একটি অনুসরণ করবে : হয় তারা নিজেরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে জনসংশ্লিষ্ট সংগ্রামগুলোর ফায়দা নিয়ে নির্মম ও নিষ্ঠুর ‘লাল আমলাতন্ত্রে’ পরিণত হবে অথবা গণসংগ্রাম ব্যর্থ হলে তারা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী সমাজের ব্যবস্থাপক ও মতাদর্শিক কর্তায় পরিণত হবে। উভয় বিবেচনাতেই এই পূর্বাভাস ছিল অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ।
বিশ্বের প্রধান দুই প্রপাগান্ডা সিস্টেম অনেক কিছুতেই একমত হয়নি। কিন্তু তারা বলশেভিকদের দ্বারা সমস্ত সমাজতান্ত্রিক উপাদান ধবংস করাকে ‘সমাজতন্ত্র’ হিশেবে অভিহিত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই একমত হয়েছিল। এটাও খুব বেশি বিস্ময়কর না। বলশেভিকরা সমাজতন্ত্রের সমস্ত নৈতিক খ্যাতি কাজে লাগিয়ে তাদের ব্যবস্থাকে ‘সমাজতন্ত্র’ হিশেবে অভিহিত করেছিল।
আর পশ্চিম সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে বলশেভিক অন্ধকূপের সাথে সমাজতন্ত্র শব্দটিকে জুড়ে দিয়ে এর বদনাম করতে চেয়েছিল যেন মুক্তিমুখিন আদর্শের প্রতি তাদের ভীতিকে আড়াল করা যায়। যেন অধিকতর ন্যায্য একটা সমাজের অন্তঃস্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের গণতান্ত্রিক কায়দায় নিয়ন্ত্রণ আর মানবাধিকার, গণচাহিদাগুলোকে অস্বীকার করা যায়।
সমাজতন্ত্রের মানে যদি হয় লেনিন-স্তালিনের স্বৈরশাসন, তাহলে যেকোন সুস্থ মানুষ বলবে -এটা আমার জন্য নয়। এটাই যদি হয় কর্পোরেট-রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের একমাত্র বিকল্প, তাহলে বহুজন আসলে এর কর্তৃত্বপরায়ণ কাঠামোর প্রতি বশ্যতা স্বীকার করবে একমাত্র ‘যৌক্তিক পছন্দ’ হিশেবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে প্রগতিশীল ও তেজস্বী ‘মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্র’ ধারণাটিকে পুনরায় জীবিত করার একটা সুযোগ হাজির হয়েছে; যেটি এর আগে প্রবল পরাক্রমশালী ক্ষমতা ব্যবস্থাপনাসমূহের মতাদর্শিক ও নিপীড়নমূলক আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেনি।
এটা কত বড় আশা আমরা জানি না, কিন্তু অন্তত একটি বড় বাধা অপসারিত হয়েছে। সেইদিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ফ্যাসিবাদী শক্তিসমূহের পরাজয়ের মতোই সমাজতন্ত্রের একটি ছোট্ট বিজয়।
রচনাটি অরাজ প্রচ্ছদ পাতায় প্রথম প্রকাশিত হয়: ২১ জুন, ২০১৯ সালে।