- সহুল আহমদ
২০১৮ সালে আমরা অদ্ভুত দুইটা আন্দোলন প্রত্যক্ষ করলাম; এক কোটা সংস্কার আন্দোলন, দুই নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। দুইটার ধরণ দুই রকম, অংশগ্রহণকারীদের বয়সও দুইরকম, তবে, একটা বিষয়ে মিল হচ্ছে তারা সকলেই শিক্ষার্থী। কোটা সংস্কার নিয়ে আলাপ আলোচনা অনেকদিন যাবত বিভিন্ন মহলে, ছাত্রসমাজ এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ, দুই মহলেই চলছিল। তাই এ আন্দোলন যতটা না আকস্মিক ছিল তাঁর চেয়ে বেশি আকস্মিক ও অভূতপূর্ব ছিল নিরাপদ সড়কের জন্যে আন্দোলন। ২৯ জুলাই ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন শুরু হয়। ঐদিনই মৃতদের নিয়ে নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খানের হাসি ঠাট্টা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলে। ঢাকা থেকে শুরু হলেও এই আন্দোলন কিশোরদের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আন্দোলনকে ‘অভূতপূর্ব’ বলার যথেষ্ঠ কারণ আছে, বিশেষ করে কোন ধরণের নেতা বা নেতৃত্ব ছাড়াই এই কিশোররা রাস্তা সামলাতে এবং আন্দোলন সামলাতে যে ‘চরিত্র’ দেখিয়েছে সেটা রীতিমত ভড়কে যাওয়ার মতো।
চরিত্রে অভিনব এই আন্দোলন গড়ে ওঠার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে কিছু সড়ক সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যানে। ২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৮৬০টি দূর্ঘটনা ঘটেছে, এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ২৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৫২০ জন। ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১৮ এর জুন পর্যন্ত, এই সাড়ে তিন বছরে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২৫ হাজারের অধিক মানুষ। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ জন। এই সময়ে আহতের সংখ্যা ৬২ হাজারের অধিক। এদের ৯০ শতাংশ ঘটেছে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব এবং অতিরিক্ত গতির কারণে। আবার, যারা লাইসেন্স নিয়েছেন বা নেয়ার অভিজ্ঞতা আছে তারা বলতে পারবেন লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটা আপাদমস্তক দুর্নীতির সাগরে নিমজ্জিত। তাই, আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কোন ‘দুর্ঘটনা’ না, বরং এটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। দুই বন্ধুকে হারানোর পর শিক্ষার্থীদের পরিবহণ মন্ত্রী যখন কোন সান্তনার বাণী না শুনিয়ে উলটো শুনিয়ে দিলেন, ভারতের মহারাষ্ট্রে ৩৩জন সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে, তাতে তারা কি কোন হট্টগোল করেছে! সেটা বললেনও হাসিমুখে। করিম এবং মীমের বন্ধুরা তাদের এই দুই বন্ধুর এমন অপমান সহ্য করতে পারে নি। রাস্তায় নামে। তাদের দেখানো পথেই, প্রথমবারের মতো, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সরাসরি এই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। ধীরে ধীরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন কিছু নতুন দিকে আমাদেরকে চোখ তুলে তাকানোর সুযোগ দিয়েছে। আমরা যেমন লক্ষ্য করেছি শিক্ষার্থীদের বিদ্রোহী চেতনার বিস্ফোরণ, তেমনি দেখেছি সরকারী প্রোপ্যাগান্ডার ব্যপকতা। সেই সাথে এতদিন ধরে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেভাবে ‘ফার্মের মুরগী’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল বা হচ্ছিল সেটা একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে এই দুইটা আন্দোলনই। কোটা আন্দোলনের সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর যখন হামলা করা হলো, তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়ার পায়তারা চললো, তখন এর হাল ধরল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তারা রাস্তায় নেমে আসলো। শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরাই বেসরকারিতে পড়ে, এই ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। বেসরকারিতে এখন মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এটা যত বাড়তে থাকবে, দাবি-দাওয়ার জন্যে রাস্তায় নামার হারও বাড়বে। নো ভ্যাট আন্দোলন দিয়েই এর শুরু হয়েছিল বলা যায়। এইজন্যে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ক্ষোভও বাড়বে, সেটা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রের নগ্ন আক্রমণ প্রমাণও দেয়।
আন্দোলন দেখা এবং আন্দোলন শেখা
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে পাশে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, আন্দোলনকারীদের মুখ থেকেই তাদের আন্দোলন সম্পর্কে জানার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। এই আন্দোলনের চরিত্র কেমন ছিল সেটা বুঝতে এই অভিজ্ঞতা যে কাউকেই সাহায্য করবে বলে আশা করতে পারি। তাদের শ্লোগানের মধ্য দিয়ে অনেক কথা আগুনের ফুল্কি হয়ে বেরোচ্ছিল, রাস্তাঘাট প্রকম্পিত করে তুলেছিল। সেই সাথে নতুন কিছুর আভাসও দিচ্ছিল। রামপূরা এলাকায় আমি যে শ্লোগানগুলো শুনেছিলামঃ ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িচাপা পড়ে সে‘/ ‘নেতা হতে আসি নাই, ভাই হত্যার বিচার চাই‘/ ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে‘/ ‘We Want Justice’ ইত্যাদি। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘টনক তুমি নড়বে কবে?’/ ‘রাষ্ট্রের মেরামত করতে নেমেছি’/ ‘আমার মা কাঁদছে, নৌমন্ত্রী হাসছে’/ ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’/’আমাদের জীবন পুতুলের মতো নয় যে জীবন নিয়ে খেলা করবে’ ইত্যাদি। এমন শ্লোগানের পাশাপাশি একটা গ্রুপ হঠাৎ করে স্লোগান ধরলো, শাহজাহান ভাইর গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে। দুই তিনবার স্লোগান দেয়ার পর আরেকজন প্রতিবাদ জানালো, ঐ বেটা শাহজাহান কি তোর ‘ভাই‘ লাগে যে হেরে ভাই ডাকতাছস! সে তো খুন করছে তোর ভাইকে। পরে স্লোগানও পরিবর্তন হয়ে গেল, স্লোগান থেকে ‘ভাই‘ শব্দ উধাও, হয়ে গেল, ‘শাহজাহানের গালে গালে …‘। প্রতিটা শ্লোগানে মিশে ছিল যে কোন ধরণের নেতৃত্বকে অস্বীকারের প্রবণতা, সর্বোচ্চ কর্তত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস এবং প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা।
আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলতাম, তাদের কথা শুনার চেষ্টা করতাম মনোযোগ দিয়ে। ক্লান্ত শ্রান্ত এই কিশোররা কিন্তু কোন অবস্থাতেই রাজপথ ছেড়ে যেতে রাজী ছিল না। আন্দোলনের অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করতেই তিন চারজন দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বললো যে, দাবি আদায় না হলে আমরা রাজপথ ছাড়ব না। আগের আন্দোলন থেকে শিক্ষা পাইছি কেউ কথা দিয়ে কথা রাখে না। আগের আন্দোলন বলতে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং শাহবাগ আন্দোলনের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটা কিছুক্ষন পরে এরাই উল্লেখ করে দিল। সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে কি না যখন জানতে চাইলাম তখন ঘর্মাক্ত দেহের এক স্কুল বালকই বললো, ভাই, কারো যদি মিনিমাম বিবেক থাকে তাইলে বুঝবে এইটা তাঁদের জন্যে, আমরা তো তাদেরই বাচ্চাকাচ্চা। আমি করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, জেগে থাকা মানুষরে ঘুম থেকে তুলবা ক্যামনে? এবার আমার চারপাশে থাকা সবাই মিলে আরো দৃঢ় স্বরে বললো, আমরা জাগাবোই। সবাইকে। তাদের এই দৃঢ় স্বর অন্য জিনিস দিয়ে তৈরি, সামনা-সামনি যিনি শুনবেন তার দ্বারাই বোঝা সম্ভব। এই স্বরে ভেঙে গড়ার প্রত্যয় আছে। এখানেই শেষ না। রাষ্ট্র জোর করে আন্দোলনকারীদের তুলে দিতে পারে এই আশংকা যখন আমি প্রকাশ করলাম তারা আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে আমাকে শোনাল, ভাই আমাদের কোন নেতাও নাই, কমিটিও নাই। সহজে তুলে দিতে পারবে না। দাবি আদায় হইলেই রাজপথ ছাড়ব। এরা গাড়ি আটকিয়েছে। লাইসেন্স চেক করার দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছে, রাষ্ট্রকে মেরামতের দায়িত্ব দু দিনের জন্যে হলেও এরা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। কোন গাড়ি আটকালে যতটা নরমসুরে কথা বলা যায় ততটাই নরম সুরে কথা বলার চেষ্টা করতো তারা। অসুস্থ কেউ থাকলে রিকশা দেখেও দিত। সি এন জি ঠিক করে দিত। সারাদিন রাস্তায় কখনো রঙ দিয়ে তাদের দাবির কথা বলতো, আবার কখনো ইট দিয়েও লিখে রাখত। সারাদিনের আন্দোলনে পর সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরতো তখন নিজ দায়িত্বে এরা রাস্তা পরিষ্কার করেছে। ঢাকা শহরে রিকশাকে যেভাবে এক লাইনের মধ্যে নিয়ে এসেছিল এই ছাত্ররা সেটা রীতিমতো অবাক করার বিষয়।
পূর্বেই বলেছিলাম এই আন্দোলনে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা, যাদের আমরা কিশোর বলে থাকি, তারা অভাবনীয় পরিপক্কতা দেখিয়েছে। এরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অভিবাবকদের সাথে তর্ক করতে পারে। এরা বলতে পারে, আন্দোলন তো সালাম-জব্বার-রফিক-বীরশ্রেষ্ঠ-শেখ মুজিবের কাছে থেকেই শিখেছি। এরা উঁচু গলায় বলতে পারে, ‘নেতা হতে আসি নাই…‘। আপনি এদের ছবি তুলবেন পরে অনলাইনে দুই দিন পর ডিহিউমানাইজ করবেন- এ বিষয়ে এরা বেশ সচেতন। এরা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ক্যামেরা/মোবাইলে ছবি তুলতে গেলে এরা বলে ভাই কারো মুখের ছবি তুইলেন না, স্লোগানের ছবি তুলেন। পুরো আন্দোলনের ছবি তুলেন। যখনই কোন বিদেশযাত্রী কিংবা রোগী এসেছেন এরা যেভাবে দৌড়াদৌড়ি করে তাদেরকে রাস্তা পার করে দিয়েছে সেটা দেখে মনে হয় এই অসুস্থ মানুষগুলো বোধহয় তাদেরই আত্মীয়! এই কিশোররা যেমন আপসহীন, এরা তেমনি ভালো-মন্দও বুঝে। এরা অন্ধ না। এরা এও বুঝে আপনি যতবড় সেলিব্রেটি-মন্ত্রী- মিনিষ্টার হোন না কেন এরা আপনাকে পাত্তা দিবে না। তাঁদের স্লোগানও তাই – ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, আমরা বাড়ি যাব না‘।
স্কুল-কলেজের এই কিশোররা অনেক বেশি বাস্তব-বুদ্ধি সম্পন্ন। ওরা যখন বলছিল নেতা না থাকায় আন্দোলন জমছে ও টিকে আছে, মানে ওরা যখন এই ‘নেতৃত্ব‘ বিষয়টাকে অস্বীকার করছে তখন আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে। এরা যেভাবে পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মাঠে কাজ করেছে, মাইক-মঞ্চ-মুরুব্বি, এই তিন ‘ম’কে অস্বীকার করছে সেটা রীতিমত বিস্ময়কর। তাদের পরিপক্কতার আরেকটা জায়গা হচ্ছে, এরা সবাইকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছে। সি এন জি ড্রাইভারকে আটকালে বলছে, ভাই আপনারও তো ছেলে আছে, আমরা তো আপনার ছেলের মতোই। পুলিশ/আর্মির লোকদের আটকালেও একই কথা বলছে, আমরা আপনাদেরই ছেলেপেলে। মানে, ওরা কাউকে বাদ দিয়ে আন্দোলন করছে না, বরং, সম্পর্কের অলিগলি ধরে এরা সবার অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করে তুলছে।
যে কিশোররা একটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল তাদের প্রতি এই রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার কেমন ছিল সেটাও একবার আমাদের দেখা উচিৎ। অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে, এই আন্দোলনেও রাষ্ট্র (সরকারও পড়তে পারেন) তাঁর পুলিশ ও বেসামরিক পেটুয়া বাহিনীকে ব্যবহার করার কথা। সেটাই হয়েছে। সরকারের উপর মহল থেকে বলা শুরু হলো ‘তৃতীয় পক্ষে’র উপস্থিতির কথা। যে কোন আন্দোলন দমানোর জন্যে ‘তৃতীয় পক্ষ’ নামের এক কল্পিত শত্রুকে হাজির করা খুবই কার্যকর পন্থা। ধীরে ধীরে হুমকি দেয়াও শুরু হলো এই বলে যে, রাস্তায় কিছু হলে সরকার দায়ী থাকবে না। আগস্টের ২ তারিখ মিরপুরে পুলিশ ও হেলমেট পরিহিত লীগের কর্মীরা ছাত্রদের উপর হামলা করে। পরের দিনও হামলা করা হয়। আগস্টের ৪ ও ৫ তারিখ যা হয় এর চেয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতি আর কিছু হতে পারে না। শতাধিক শিক্ষার্থী পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়। ধর্ষণ ও নিহত হওয়ার গুজবও রটে তখন। অনেক ছাত্রকে গ্রেফতারও করা হয়। গুজব রটানোর অজুহাতে শহিদুল আলম সহ আরো অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই আচরণের সামনে স্কুলের কিশোর-কিশোরীরা আর দাঁড়াতে পারে নাই। স্কুলের ছোট ভাই বোনদের উপর আক্রমণের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৬ তারিখ রাস্তায় নামতে চেয়েছিল। এইদিন আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, আইইউবিও, এবং ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরো নৃশংস আক্রমণ করা হয়। এদের মধ্যে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আফতাবনগর এলাকায় ঢুকতেই একজন (শ্রমিক লীগেরই হবে) ডাক দিল, ভাই কই যাচ্ছেন, ছাত্রদের কাছে? আমি কইলাম না, আত্মীয়ের বাসায়। বললো, ওকে যান, কিন্তু ছাত্রদের সাথে কথা বলেবন না। আমি ভদ্র ছেলের মতো আচ্ছা বলে চলে গেলাম। একটু সামনে গিয়ে দেখলাম মূল গেইটে সদলবলে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ইস্টওয়েস্ট এর সামনে যে অবস্থা হয়েছে তা দেখার জন্যে আসলে প্রস্তুত ছিলাম না। পুরো যুদ্ধক্ষেত্র। মসজিদের ভেতর থেকে দেখলাম। কিছুক্ষণ পর পর লীগের সদস্যরা (ছাত্রলীগ/শ্রমিক লীগ) ইট-পাথর ছুঁড়ে মারছে ভার্সিটির গেইটে, ভার্সিটির ভেতরে ছুঁড়ে মারছে। পুলিশের সামনেই এগুলো হচ্ছে। আর পুলিশ কিছুক্ষণ পর পর টিয়ার-শেল মারছে ক্যাম্পাসের ভেতরে। মসজিদের ভেতরেই টিয়ার-শেলের যন্ত্রণায় বসা যাচ্ছিল না। আর ভার্সিটির ভেতরে ইস্টওয়েস্টের শিক্ষার্থীরা দাঁত কিড়িমিড়ি দিয়ে যে প্রতিরোধ দেখাচ্ছে সেটা ছিল অভূতপূর্ব। যতবার পুলিশ ভেতরে টিয়ার-শেল ছুঁড়েছে তাঁরা যেন ততটা উঁচু স্বরে বলছে, ‘পুলিশ কোন চ্যাটের বাল‘! লীগরা যে পাথর ছুড়ছে, সেই পাথর ছাত্ররা একটু পর কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারছে পুলিশের উপরে। একটা রাষ্ট্র তাঁর হাতে থাকা সকল যন্ত্র নিয়ে নেমেছে, আর এই শিক্ষার্থীরা শুধু পাথর আর গলার আওয়াজ দিয়ে এর প্রতিরোধ করেছে। কিছু কিছু পত্রিকা তখন ‘কারা করছে ইস্টওয়েস্ট এ আক্রমণ‘ টাইপের শিরোনামে রিপোর্ট করেছে। টাকার বিনিময়ে যারা ভাঙচুর করে – এমন দু একজন গরীব মানুষের ছবি যুক্ত করে এমন শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করা প্রোপ্যাগান্ডা বৈ আর কিছু না। রিপোর্টকারীরা মনে হয় জানতেন না যে, কারা এই আক্রমণ করতে পারে! পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে? কাদের নির্দেশে এইগুলো হচ্ছে?
‘তৃতীয় পক্ষ’ বনাম দুই পক্ষের রাজনীতি
বলেছি যে, দুই শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে স্কুলের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল সেটা একদিকে যেমন ঢাকা থেকে শুরু করে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকেও শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে শরিক করতে পেরেছিলেন। সরকার প্রথমে এই আন্দোলনকে আমলে না আনলেও দু একদিনের মাথায় এই আন্দোলনকে আমলে নিতে বাধ্য হয়েছিল, এবং ধীরে ধীরে হুমকি-ধামকি দেয়াও শুরু করেছিল। রাস্তায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কিছু হলে সরকার দায়ী থাকবে না এমনও হুশিয়ার বাণী উপরের মহল থেকে আসা শুরু হয়। এমন ‘আদুরে’ হুমকি এবং পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি ও দলীয় ‘কঠোর’ আক্রমণ প্রমাণ করেছিল যে সরকার শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ‘সরকারবিরোধী আন্দোলন’ হিসেবেই নিয়েছিল এবং রীতিমতো ভয়ও পেয়েছিল।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন বেগবান হয়, ঢাকা শহরের রাস্তাকে তারা ‘আক্ষরিক অর্থেই’ নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে তখন ক্ষমতাসীন দল তাদের ‘তৃতীয় পক্ষ’ নামক হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয়। দলের অন্ধ ভক্ত, মোসাহেব, সমর্থক থেকে শুরু করে এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এই ‘তৃতীয় শক্তি’র কথা আওড়াতে থাকেন। ৫ আগস্ট গণভবনে এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, “কিন্তু আমরা এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা আরও ভয়ানক। এর ভেতরে তৃতীয় পক্ষ চলে এসেছে।’ এই ‘তৃতীয় পক্ষে’র কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তৃতীয় শক্তি এরা মানুষ না। এরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। অগ্নি-সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীরা যে কোনো অঘটন ঘটাতে পার। … ঢাকার বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসছে এখানে। তাদের কাজটা কি হবে? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা। যখনই আমি এটা দেখলাম তখনই আমি আতঙ্কিত এই শিশুদের নিয়ে।’ এর ঠিক একদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবও একই ধরণের আশংকার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্বেগটা হচ্ছে, যৌক্তিক ইনোসেন্ট আন্দোলনের মধ্যে যখন রাজনৈতিক অপশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে। এই আন্দোলনে এই পর্যন্ত আমরা বার বার খবর পাচ্ছি রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ঘটছে।’ তিনি আরো বলেন, “সন্ধ্যার পরে এই কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা যখন বেশি থাকে না, তখন এদের মধ্যে এই অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে যায়। তখন তাদেরকে বাস ভাংচুরের উসকানি দেওয়া হয় … দেশকে অস্থিতিশীল করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে। যারা অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক আন্দোলনে রাজনৈতিক রং চড়াতে চায়, তাদের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকার জন্য আমরা অনুরোধ করছি।” নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান উষ্কানিদাতা এই তৃতীয় পক্ষের নাম সরাসরি বলেই ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত হওয়া অন্যদের আন্দোলনে বিএনপি প্রবেশ করে শুধু উসকানি দেয়। … হেফাজতের আন্দোলন থেকে শুরু করে, কোঠা আন্দোলন, এমনকি বাসচাপায় দুই ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পতনের চেষ্টা চালাচ্ছিল বিএনপি, যা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না।‘
প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নৌপরিবহনমন্ত্রী তাদের কথাকে আমরা বেশ গুরুত্ব সহকারেই গ্রহণ করি, কেননা তারা যা বলেন সমর্থক ও মোসাহেবরা তাই জপতে থাকেন দিনে রাতে। তিনজনের বক্তব্যেই আন্দোলনকারী ছাত্রদের ‘কিশোর’ বা ‘ইনোসেন্ট’ ইত্যাদি আদুরে শব্দ ব্যবহার করে সম্বোধন করা হয়েছে। এই শব্দগুলো দিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রতি তাদের সমর্থনের কথাটা প্রকাশ করার একটা চেষ্টাও আছে। দাবি-দাওয়া মানা হবে কি হবে না এই বিষয়ে কোন আলোকপাত না করে বরং ‘আমাদের শিশু’ ইত্যাকার আদুরে নামে ডাকার দিকেই তাদের আগ্রহও লক্ষণীয়। সেই সাথে তারা আশংকা প্রকাশ করেছেন তৃতীয় পক্ষ নিয়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ হাজির করার খুব একটা দরকার পড়ে নাই, বরং আন্দোলনকারীদের দেদারছে রাজকার বলা হয়েছে, ‘স্বার্থপর আন্দোলন’ বলা হয়েছে। কিন্তু নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে ‘তৃতীয় পক্ষ’র উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়!
সরকারদলীয় নেতৃত্ব ও সমর্থকদের কারণে ‘তৃতীয় পক্ষ’ শব্দটা বাজারে বেশ চাউরও হয়েছে। ছাত্ররা আন্দোলনে নামলেই আসমান-জমিন ফুঁড়ে ‘তৃতীয় পক্ষ‘ এসে হাজির হয়। যে কোন আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই একদল আশংকা করতে থাকেন এই বুঝি তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়লো! এবং কেউ কেউ এই আশংকা থেকে প্রথম থেকেই আন্দোলনেরই বিরুদ্ধে থাকেন! এতেই বুঝা যায় ‘তৃতীয় পক্ষে’র শক্তির জোর কতটা! কিন্তু তারা ‘তৃতীয় পক্ষ’ আসলে কি বুঝান সেটার একটু সন্ধান করা দরকার। যেহেতু তৃতীয় পক্ষ আছে, তাঁর মনে আরো দুই পক্ষের অস্তিত্বও আছে। এখানে অবধারিত ভাবে প্রথমপক্ষ হচ্ছে সরকার/রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যারা আসীন, আর দ্বিতীয় পক্ষ হচ্ছে সাধারণ জনগণ কিংবা যারা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামে। আমাদের রাষ্ট্র যে তার জনগণকে নিজের বলে মনে করে না, এর একটা বড় নমুনা হচ্ছে এই দুই পক্ষের সৃষ্টি হওয়া। অবশ্য রাষ্ট্র ও সমাজ সর্বদাই দুই পক্ষ! এখন আসে তৃতীয় পক্ষের প্রশ্ন, এরা কারা? বারেবারে এসে এরা হাজির হয়। এই তিন নম্বর পক্ষ হচ্ছে আরেকদল যারা ‘ক্ষমতার স্বাধ‘ থেকে বঞ্চিত, কিন্তু তারাও ক্ষমতা চায়। প্রচলিত রাজনীতিতে লীগের কাছে জামায়াত-বি এন পি ‘তৃতীয় পক্ষ’, জামায়াত-বিএনপির কাছে লীগ ‘তৃতীয় পক্ষ’। তাই প্রথম ও তৃতীয় পক্ষ যেমন একে অপরের শত্রু, তেমনি আবার বন্ধুও বটে। এই দুই পক্ষই তাদের বাহিনী ও পুলিশকে ব্যবহার করে দ্বিতীয় পক্ষের দাবি দাওয়া দমন করতে। এই দাবি-দাওয়া দমন করতে প্রথম পক্ষের যেমন তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি দরকার, তেমনি তৃতীয় পক্ষেরও দরকার প্রথম পক্ষের। তাদের মধ্যে একধরণের মিথোজীবী সম্পর্ক তৈরি হয়, যা দিয়ে আসলে জনগণকে ধোঁকা দেয়, মারধর করে, তারপর বলে, তোমাদের জন্যই এইসব করলাম। উপনিবেশকরা যেমন করে বলত, আমি তো তোমাদের সভ্য বানানোর জন্য শাসন করছি, তেমনি আমাদের এই দুই পক্ষ কিংবা আমাদের এই রাষ্ট্রও বলে, আমি তোমাদের ভালোর জন্য, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য তোমাদেরকে জেলে পুরছি, মারধর করছি। সবই তোমাদের ভালোর জন্যে। তাই দেখা যায় আন্দোলন দমানোর সময় স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত এরশাদ যা বলেন তার সাথে গণতন্ত্রীদের কথার খুব একটা তফাৎ পাওয়া যায় না। এরশাদ যেমন করে বলতেন সন্ত্রাসে ছাত্রদের উস্কানি দেয়া হচ্ছে, এখনকার গণতন্ত্রী নেতারাও একই কথা বলেন। ছাত্র আন্দোলন দমনে সকলের মুখের ভাষা এক হয়ে যায়।
ছাত্রদের এই আন্দোলন কেন দমে গেল, এর উত্তরে সরকারদলীয় সমর্থকেরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ‘তৃতীয় পক্ষে’র কাহিনী নিয়ে এসেছেন। তারা বলা শুরু করেছেন যে, অভিভাবকরা নাকি ‘তৃতীয় পক্ষে‘র উপস্থিতি লক্ষ্য করে তাদের ছেলেপেলেকে ঘরে নিয়ে গেছেন। আন্দোলনের বিপক্ষে তাদের অবস্থানের কারণ ছিল এই ‘তৃতীয় পক্ষ’, আবার আন্দোলন দমে যাওয়ার কারণও তাদের কাছে ‘তৃতীয় পক্ষ’। সবই নন্দ ঘোষের দোষ। তাদের এই তত্ত্বের তলে চাপা পড়ে যায় রাষ্ট্রের সকল যন্ত্র, পুলিশ, আদালত, বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কাহিনী। আপনারা যাবতীয় যন্ত্র – সেটা বন্দুক হোক, ইট হোক আর মিডিয়া হোক – সব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, হুমকি দিবেন রাস্তার কিছুর জন্য সরকার দায়ী থাকবে না, টানা দুই/তিন দিন আক্রমণ করবেন এই বাচ্চাদের, জেলে পুরবেন – তারপর গবেষণা করে বের করবেন, কিভাবে ‘তৃতীয় পক্ষে‘র ভয়ে ছেলেরা ঘরে ফিরে গেল। এর চেয়ে বড় হিপোক্রেট তত্ত্ব আর হতে পারে না।
২
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাজউদ্দীন আহমদ পরিবার বেশ সুপরিচিত। সেখানে তাঁর পুত্র সোহেল তাজও, শুধু পিতার কারণে নয়, তার নিজের কারণেও সুপরিচিত। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি তার ফেসবুকে স্বৈরাচারী শাসক কেমনে চেনা যায় তার একটা চেকলিস্ট দেন। তার পুরো লেখাটা ছিল এরকম-
বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদের হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ তার জন্ম লগ্ন থেকে গণ মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলন করেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে এই দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। পরবর্তীতে একই ধারায় আওয়ামী লীগ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে।
ইদানীংকালে আমরা অনেকেই স্বৈরাচারী শাসন কি তা হয়তো ভুলে গিয়েছি। নতুন প্রজন্মের জন্য ছোট্ট করে নিম্নে কিছু নমুনা দিলাম, যাতে করে আমরা ভবিষ্যতে স্বৈরাচার কি তা চিহ্নিত করতে পারি।
স্বৈরাচারী শাসন চেকলিস্ট:
১. যখন সাধারণ মানুষ তার মুক্তচিন্তা ব্যক্ত করতে ভয় পায়।
২. যখন দল, সরকার এবং রাষ্ট্র একাকার হয়ে যায় আর সরকারকে সমালোচনা করলে সেটাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
৩. যখন দেশের প্রচলিত নানা আইন এবং নতুন নতুন আইন সৃষ্টি/তৈরি করে তার অপব্যবহার করে রিমান্ডে নেয়া এবং নির্যাতন করা হয়
৪. বিনা বিচারে হত্যা ও গুম করে ফেলা হয়।
৫. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়।
৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনী পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৭. যখন সাধারণ নাগরিকসহ সকলের কথাবার্তা, ফোন আলাপ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট মনিটর ও রেকর্ড করা হয়।
৮. যখন এই সমস্ত বিষয় রিপোর্ট না করার জন্য সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকদের গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে হুমকি দেয়া হয়।
উপরের প্রতিটি পয়েন্ট পড়ে যে কেউ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে মেলাতে পারবেন, সোহেল তাজ সরাসরি বর্তমান পরিস্থিতির কথা না বললেও আকলমন্দের জন্যে ইশারাই যথেষ্ট। এ নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। গুম, বিনা বিচারে হত্যা, ৫৭ ধারার অজুহাতে গ্রেফতার, পুলিশের সাথে অন্যান্য পেটোয়া বাহিনীকে ব্যবহার করা, সবকিছু রেকর্ড করা, হুমকি ধমকি দেয়া এই সবকিছু গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করেছে। তাই সকলেই যা বুঝার তা বুঝেনও। সোহেল তাজ যা বলেছেন তা কতটা ঠিক, মানে এই চেকলিস্ট কতটা সঠিক, আর কি কি বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, এইগুলাই সব কি না – এসব নিয়ে সমালোচনা হতেই পারত, কিন্তু সোহেল তাজের বিরুদ্ধে সমালোচনা হলো পুরো অন্য খাতে। সেই সমালোচকরা বলতে লাগলেন সোহেল তাজের এই বক্তব্যের কারণে তিনি তৃতীয় পক্ষের সুবিধা করে দিয়েছেন, আওয়ামীবিরোধীদের হাতে সুযোগ তুলে দিয়েছেন। এই সমালোচনার চাপ কত বেশি ছিল তা তিনি না বললেও আমরা বুঝতে পারি, ফেসবুকে তার সেই লেখাটির যোগ-বিয়োগ আমাদেরকেও অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করে।
উল্লেখ করতে হয়, এখানে এক পক্ষের সমালোচনাকে আরেক পক্ষের প্রশংসা হিসেবে ধরা হয়। মানে, আপনি যদি আওয়ামীলীগের সমালোচনা করেন, তাইলে আপনি ‘বিএনপি-জামায়াত‘ মার্কা গায়ে মাখবেন, আর যদি আপনি ‘বিএনপি-জামায়াত‘ এর সমালোচনা করেন তাইলে ‘আওয়ামীলীগ‘ মার্কা গায়ে মাখবেন।
দুই বাক্সের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া – চিন্তা পদ্ধতির মধ্যে এই প্রবণতা আমাদের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। যেমন, শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলন করে আওয়ামীলীগ/সরকার দলীয় মনোভাব কেমন ছিল সেটা পূর্বেই বলা হয়েছে, অন্যদিকে বি এন পি-জামায়াতওয়ালারা বেজায় খুশি হয়ে ওঠে যে ছাত্ররা আন্দোলন করছে। সে খুশির কারণ আবার ছাত্রদের বিদ্রোহী মনোভাব নয়, বরং অন্য। একজন বেজার মুখে বলছিলেন যে, পোলাপান আমগো লগে আন্দোলনে নামলেই পারত! কিন্তু তারা বারেবারে ভুলে যাচ্ছিলেন এই শিক্ষার্থীর, যারা রাষ্ট্রেরই লাইসেন্স চাইছে এরা দুই দলকেই ভালো করে জানে ও চিনে। এরা এই রেজিমের বিরুদ্ধে মানে আপনার পক্ষে না। এরা জানে আপনারা পেট্রোল বোমায় কতটা গরীব মানুষ মেরেছেন, এরা জানে আপনাদের গ্রেনেড হামলার কথা। এরা মনে প্রাণে দুই দলীয় ‘মাইর’ থেকে বাঁচতে চায়।
দুই দলীয় এই ‘মাইরে’র ইতিহাস ও শিকড় অনেক গভীরে। এখানে যে রাজনীতিচর্চা চলছে তার সূচনা হয়েছিল উপনিবেশ আমলে, উপনিবেশিকদের প্রত্যক্ষ মদদে ও সুপ্ত বাসনায়। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে ব্রিটিশরা তাদের শাসনকে দীর্ঘায়ত করার জন্যে যে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি হাতে নেয় তার কোলেই জন্ম নিয়েছিল এই ‘দ্বি দলীয় রাজনীতি‘, এরই নাম এরা দিয়েছিল ‘গণতন্ত্র‘! কংগ্রেস যেমন উনারা গঠন করছেন তেমনি মুসলিম লীগ গঠনেও উনারা সাহায্য করছেন। এবার বরং দেশীয়রা নিজেদের মধ্যেই মারামারি করুক, তবু মূল শাসকের বিরুদ্ধে না নামুক। যত শক্তি সব নিজেদের মধ্যেই ব্যয় করুক, মূল শাসকের বিরুদ্ধে না। উপনিবেশিকরা যখন চলে গেলেন তখন ক্ষমতা দিয়ে গেলেন নিজেদের বানানো মানুষদের হাতেই। তৈরিকৃত এই মানুষদের যারাই ক্ষমতায় আসেন তারা জনগণকে ভয় দেখান অপর পক্ষ নিয়ে। জনগণ হাবুডুবু খাচ্ছে দুই পুকুরের মধ্যে, আর পুকুরের চিকন পার দিয়ে ক্ষমতা-লোভী দুই দলই হেঁটে বেড়ায় নিশ্চিন্তে। জনগণ খানিক মাথা তুলতে গেলেই এক পারের শাসক ভয় দেখায় আরেক পারের শাসককে দেখিয়ে। দেখা গেলো উপনিবেশিকরা চলে গেলেও আমরা সেই মানসিক দাসত্ব বহন করে চলছি এখনো। এর একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে আমাদের চিন্তাভাবনায় দুই দল-কেন্দ্রিক ভাবনার আধিপত্য। তাই কেউ কোন কথা বললে তার কথার যৌক্তিকতা নিরূপণ করি আমরা দুই দলের বাক্সকে বিবেচনা করে। তার কথা কোন বাক্সে যাচ্ছে এইটাই হয়ে উঠে আমাদের মূল বিবেচনা। সোহেল তাজ একটা কথা বলেছেন। তার কথায় যুক্তির উপস্থিতি আছে কি নাই, বাস্তবতা আছে কি নাই – এর চেয়েও বড় বিবেচ্য হয়ে উঠছে তার কথা বিএনপি-জামায়াত এর জন্যে লাভবান হলো কি না! এর চেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়া-পনা আর কি হতে পারে?
মুক্তবাজারের যুগে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলন
আমরা যে যুগে বাস করছি সেটাকে বলা হয় ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র যুগ। এই মুক্তবাজার ব্যবস্থাকে কার্যকর রাখার দর্শন হলো ‘নিওলিবারেজম’। বাংলা-ইংরেজি দুই শব্দের মধ্যেই ‘মুক্ত’ ও ‘লিবারেল’ আছে, তাই শুনতেও শ্রুতিমধুর। এখন আপনি পুরোপুরি মুক্ত, তবে সেটা শুধু ‘পণ্যে’র নির্মাণে। আপনার আবেগ-অনুভূতি সবই ‘পণ্য’। আপনার বাজার দর নির্মাণ করা হবে ‘প্রতিযোগিতা’র উপর ভিত্তি করে। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারলে আপনি সফল, আর না হলে আপনি লুজার। আপনি কিভাবে বিশেষ সুবিধা পেলেন, আপনি কোন শ্রেণিতে অবস্থান করেন এসব বিবেচনায় না আনলেও হবে, আপনি টাকা কামাইতে পেরেছেন এইটাই আপনার কৃতিত্ব! আপনি structural unemployment এর শিকার সেটা বড় কথা না, আপনি চাকরি যেহেতু পান নাই তাইলে সেটা শতভাগ আপনারই ব্যর্থতা! আপনার বাচ্চার স্কুলের সামনে মাঠ নাই এইটা কোন বিবেচনার বিষয় না, কিন্তু বাচ্চা মোটা হয়ে গেলে বা অবেসিটিতে আক্রান্ত হলে সেটা আপনার ব্যর্থতা। সহজ কথা হচ্ছে, সফল/অসফলের মানদণ্ড হচ্ছে ‘প্রতিযোগিতা’। তাই, দেখা যাচ্ছে যখনই শিক্ষার্থীরা কোন ‘structure’ এর সংস্কারের আন্দোলনে নামছে তখন সমাজের কথিত মোটিভেশনাল স্পিকারদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। গত দুইটা আন্দোলনে তাদের অবস্থান দেখলেই বিষয়টা পরিষ্কার বুঝা যাবে। এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন আমাদের মধ্যে মোটিভেশনাল স্পিকারদের আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছে! তারা সবচেয়ে বড় যে কাজটা সফলভাবে করে থাকে সেটা হচ্ছে, সিস্টেমের ভুলের দায়ভার ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোন ভুলের কারণে যখন কর্মসংস্থান কমে যেতে থাকে একদিকে যেমন বেকারত্বের হার বাড়তে থাকে, অন্যদিকে তেমনি মোটিভেশনাল স্পিকারদের হারও বাড়তে থাকে। আমাদের এখানে দেখতে পাচ্ছি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমেছে, তাই স্বাভাবিকভাবে এই স্পিকারদের সংখ্যাও বাড়ছে। তারা, প্রথমেই বলেন, চেষ্টা করো পারবে। চেষ্টা করলেই পারবে। যদি না পারো তার মানে এনাফ চেষ্টা করো নাই। অর্থাৎ, তুমি চাকরি পাচ্ছো কি পাচ্ছো না সেটা নির্ভর করছে পুরোপুরি তোমার যোগ্যতার উপর। দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কতটুকু আছে কি নাই সেটা কোন মুখ্য ব্যাপার না। ফলাফল এই দাঁড়াচ্ছে যে, চাকরি না পাওয়াটা ব্যবস্থা-গত ভুল নয়, নিজের অক্ষমতাই আসল কথা।
তাই শিক্ষার্থীরা যখন কোন ব্যবস্থা-গত ভুলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে তখন এই স্পিকাররা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। স্কুলের কিশোরদের বিচারের যে আন্দোলন সেটাও আমাদের ‘ব্যবস্থা-গত ভুলে’র বিরুদ্ধে আন্দোলনই। কিন্তু, আন্দোলনের সময় এবং পরে একদল বের হয়েছেন যারা উপদেশ দেয়া শুরু করেছেন ছাত্রছাত্রীদের। তাদের কথা হচ্ছে, ‘আমাদের রাস্তা আমরাই ঠিক রাখবো’! মানে, ব্যবস্থা ঠিক না করলেও চলবে, আমরা ঠিক হলেই চলবে। মানে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী সাধারণ জনগণই, ভাঙাচুরা লাইসেন্স বিহীন গাড়ীও না, লাইসেন্স বিহীন চালকও না। ত্রুটি সিস্টেমের না, ত্রুটি আপনারই। তাই এই ক্ষেত্রেও এই মোটিভেশনাল স্পিকাররা আন্দোলনের বিরুদ্ধে রইলেন!
মুক্তবাজার অর্থনীতির যে ‘প্রতিযোগিতা’ সেটারই আরেক অবধারিত ফলাফল হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। আমরা সকলেই বিচ্ছিন্ন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটা লেখায় বলেছিলেন, এই যুগে ভিড় জমে, কিন্তু ঐক্য গড়ে ওঠে না। এইটাই বিচ্ছিন্নতা। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে করেছে ঠিকই, তাদের ঘনঘন দাঁড়িয়ে যাওয়াটা যেমন চোখে পড়ার মতো ছিল, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। যেমন, শাবিপ্রবির একটা নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্ট দেখা যাচ্ছে ক্লাস বর্জন করছে, পুরো ভার্সিটি কিন্তু এক হতে পারছে না, নিজেদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সকলে এরা বিচ্ছিন্ন থেকে যাচ্ছে। আর যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে তারাও সবসময় এই ‘বিচ্ছিন্নতা’কেই কামনা করেন। মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আনতে পারলেই আন্দোলন দমানো সহজ হয়ে ওঠে।
আমেরিকায় শ্রমিকরা তখন ঘনঘন আন্দোলন করতেন, লাঠিপেটা করেও তাদের দমন করা যাচ্ছিল না, তাই মালিক পক্ষ মিডিয়াকে হাতিয়ার বানিয়ে সামনে নিয়ে আসে। বলা হলো, এই শ্রমিকরা আসলে আন্দোলনের নামে আমেরিকার জিনিসই নষ্ট করছে, তাই আন্দোলনকারীরা আমাদের শত্রু। এবং, এই প্রচারের ফলও হয়েছিল দারুণ, আন্দোলনকারীদেরকে সাধারণ জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় কোন লাটি-বৈঠা ছাড়াই আন্দোলন দমন করা যেত। গত দুই আন্দোলন যেমন ছিল চমক জাগানো, তেমনি একে দমন করাও হয়েছিল চমকিয়ে। শুধু লাঠি-পেটা দিয়ে কিন্তু কাজ হচ্ছিল না। খেয়াল করে দেখেন, দুই আন্দোলনেই যেদিন পুলিশ-লীগ আক্রমণ করেছিল তাঁর পরেরদিন আন্দোলন আরও বড় আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু দমে যায় তখনই যখন মিডিয়া এসে আন্দোলনে হাজির হয়। কি সুন্দর করে দুইটা আন্দোলনকে দমন করা হয়ে গেলো, একটাতে হাজির হইলো ‘রাজাকার তত্ত্ব’, আরেকটাতে আসলো ‘গুজব তত্ত্ব’! সাথে ছিল ‘তৃতীয় পক্ষে’র উপস্থিতি সংক্রান্ত খবর!
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখজনক অধ্যায় হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে শ্রমিকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া। এই দুই পক্ষকে কি এর পূর্বে কখনো মুখোমুখি অবস্থায় দেখা গিয়েছিল? বরং বাসে উঠলে কোন শিক্ষার্থী হাফ পাস দিতে চাইলে এই হেলপাররা কখনো কখনো বলতেন, মামা আপনারা না দিলে আমরা খাব কি? এই শ্রমিকরা হচ্ছেন প্রথমত শিক্ষা হতে বঞ্চিত, দ্বিতীয়ত এরা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। শাসকগোষ্ঠী সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করছে। তাদেরকে যে মালিক অবৈধভাবে লাইসেন্স এনে দিবেন, সে সারাজীবন কিন্তু সেই মালিকের ‘মাসলম্যান’ হিসেবে কাজ করবে। অন্যভাবে বলা যায়, এই শ্রমিকদের যতদিন দারিদ্র্যের পুকুরে রাখা যাবে ততদিন তাদেরকে ‘মাসলম্যান’ হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।
ঘুরেফিরে দুই আন্দোলনেই একটা বিষয় কমন হচ্ছে এরা কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে না, বরং ‘ব্যবস্থা’র বিরুদ্ধে নেমেছিল। ব্যক্তির চেয়ে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়া কঠিন, তাই দমন করা হয়েছে কঠিন ভাবে। আবার দেখা যাচ্ছে দুই ক্ষেত্রে ‘বৈষম্যে’রও একটা ভূমিকা আছে। সেই বৈষম্যকে স্বাধীনভাবে টিকিয়ে রাখার কাজটাই করে যাচ্ছে ‘মুক্তবাজার’!
নথিপত্র
১) বিডিনিইউজ, ৫ আগস্ট, ২০১৮, তৃতীয় পক্ষ নেমেছে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফের: প্রধানমন্ত্রী,https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1526300.bdnews
২) বিডিনিইউজ, ৪ আগস্ট, ২০১৮, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ঘটেছে: কাদের https://bangla.bdnews24.com/politics/article1526142.bdnews
৩) প্রথম আলো, ০৯ আগস্ট ২০১৮, অন্যের আন্দোলনে উসকানি দেয় বিএনপি: শাজাহান খান
৪) মানবজমিন, ০৮ আগস্ট ২০১৮, সোহেল তাজের চেকলিস্ট http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=129668