অনুবাদ: সারোয়ার তুষার
অনুবাদকের ভূমিকা
গত ১৭ই মার্চ, ২০২০ এ The Intercept অনলাইন পোর্টালে কানাডিয়ান লেখক, সামাজিক ও জলবায়ু আন্দোলনের তাত্ত্বিক-অ্যাক্টিভিস্ট নাওমি ক্লেইনের একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি করোনা মহামারির ফলে সৃষ্ট নজিরবিহীন সংকট ও সংকটকে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটরা যেসব প্রতিক্রিয়াশীল, গণবিরোধী নয়া-উদারতাবাদী নীতি গ্রহণ করতে পারে কিংবা ইতোমধ্যেই করেছে, সে সম্পর্কে বিশ্বের আপামর মানুষ ও অ্যাক্টিভিস্টদের সতর্ক করেন। করোনা মহামারির দিশেহারা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট পুঁজির লাগামহীন পুঞ্জিভবনকে ক্লেইন বলছেন ‘করোনা পুঁজিবাদ’। দুর্যোগ পুঁজিবাদ ও শক ডক্ট্রিন (এ সম্পর্কে নাওমি ক্লেইন একটি সাক্ষাতকারের অনুবাদ পড়া যাবে এই লিংকে: দুর্যোগ-পুঁজিবাদের জন্য মোক্ষম সুযোগ করেনা ভাইরাস ) তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি ‘করোনা পুঁজিবাদ’কে ব্যাখ্যা করেছেন।
The Intercept -এ প্রকাশিত ভিডিও বার্তাটি অত্যন্ত জরুরি মনে হওয়ায় বর্তমান অনুবাদক এটির শ্রুতিলিখন তৈরি করে অনুবাদ করেন। তবে এখানে প্রকাশিত পুরো অনুবাদটিই শ্রুতিলিখনের অনুবাদ নয়। The Intercept -এ প্রকাশিত ভিডিও বার্তার নিচেই নাওমি ক্লেইন বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা লিখেছেন। সেই ভূমিকাটির অনুবাদও এখানে হাজির করা হলো।
মূল আলোচনা
আমি দু’ দশক ধরে দুর্যোগের অন্তরালে সংঘটিত পরিবর্তনগুলো অধ্যয়ন করছি। আমি শিখেছি অন্তত যে একটা বিষয়ের উপর আমরা ভরসা করতে পারি তা হলো: বিপর্যয়কর পরিবর্তনের সময়গুলোতে, অকল্পনীয় বিষয়গুলো হঠাৎ করেই বাস্তবে পরিণত হতে থাকে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, মূলত নিকৃষ্ট পরিবর্তনগুলোই সাধিত হয়েছে। তবে বরাবরই এমনটা ঘটেছে তা নয়। এবং ভবিষ্যতেও একইভাবে চলতে হবে তাও নয়।
ক্রমবর্ধমান COVID-19 সংকট আমাদের সম্ভব-অসম্ভবের ধারণাকে যেভাবে পুনর্নির্মাণ করছে সে সম্পর্কে এই ভিডিওটি। ট্রাম্প প্রশাসন এবং পৃথিবীজুড়ে অন্যান্য সরকারগুলো ব্যস্ত এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিঃশর্ত আর্থিক ভর্তুকি প্রদান ও সরকারি তদারকি শিথিল করার কাজে। ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভেন ম্যানুচিন (Steven Manuchin) ২০১০-এর ডড-ফ্র্যাঙ্ক (Dodd frank Act) আইনের অংশ হিসাবে সর্বশেষ বড় অর্থনৈতিক মন্দার পর যে অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল তা বাতিল করতে চলেছেন। চীন তার দিক থেকে এরমধ্যেই ইঙ্গিত দেয়া শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য পরিবেশগত নীতিমালা শিথিল করবে তারা। যার ফলে এই দুর্যোগের মুখ্য যে ইতিবাচক দিক, অর্থাৎ দেশটির মারাত্মক বায়ুদূষণ যে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে সে অর্জনও পুরোপুরি বিনষ্ট হবে।
তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, আমরা শহর এবং রাজ্য স্তরের সংগঠনগুলোকে বৈশ্বিক মহামারি চলাকালীন সময়ে উচ্ছেদ রোধ করার ক্ষেত্রে বিশেষ সফলতা অর্জন করতে দেখেছি। সংকটের কারণে হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের, (এর মধ্যে মধ্যে স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত কর্মীরাও রয়েছে) ছয় সপ্তাহের বিনা কাজে বেতন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে আয়ারল্যাণ্ড। এবং এই বৈশ্বিক মহামারির সাথে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবার কোনো যোগসূত্র নেই, সম্প্রতি এক বিতর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জো বাইডেন এমন দাবি সত্ত্বেও, বহু আমেরিকান হঠাৎ করেই উপলব্ধি করছেন যে কার্যকরী সুরক্ষা নীতি না থাকার ফলে নানা দিক থেকেই বরং ভাইরাসের ঝুঁকি বাড়ছে।
পূর্বের সংকটগুলোর মতোই এই সংকটও— সমাজের উঁচুতলার ধনীদের স্বার্থ রক্ষার উপলক্ষ্য হয়ে উঠতে পারে, এমনকি এর সুফল ভোগ করবে আমাদের বর্তমান দুর্ভোগ ও নাজুক পরিস্থিতির জন্য যারা সবচাইতে বেশি দায়ী তারাও, অন্যদিকে সামান্য যা পারিবারিক সঞ্চয় সেগুলো নিঃশেষ করে দিয়ে আর ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো ধ্বংসের পর অধিকাংশ শ্রমজীবীদের ভাগে পড়বে না প্রায় কিছুই। কিন্তু এই ভিডিওতে যেমনটা দেখানো হয়েছে, অনেকেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন, সেই গল্পটা এখনো লেখা হয়নি।
এবারের স্ক্রিপ্ট আমাদের জানা… (নাওমি ক্লেইনের ভিডিও বার্তার শ্রুতিলিখনের অনুবাদ )
কেবল একটি প্রকৃত কিংবা উপলব্ধিজাত সংকটই আসল পরিবর্তন ঘটায়। যখন সেই সংকট ঘটে, তখন বিরাজমান ধারণাগুলোর উপর নির্ভর করেই পদক্ষেপ নেয়া হয়। -মিল্টন ফ্রিডম্যান
বিরাজমান ধারণাগুলো….স্মরণকালের অন্যতম কট্টরপন্থী মুক্ত-বাজার অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান অনেক কিছুতেই ভুল করেছেন। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে তিনি ঠিক।
সঙ্কটের সময়ে, আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ধারণাগুলোই হঠাৎ করেই সম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু কোন ধারণাগুলো? সংবেদনশীল, ন্যায্য ধারণাগুলো, যেগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যত বেশি সংখ্যক মানুষকে সম্ভব নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সুস্থ রাখতে? নাকি লুটপাটের ধারণাগুলো যা আদতে গৃহীত হয়েছে ইতোমধ্যেই অকল্পনীয় রকমের সম্পদশালীদের আরও ফুলেফেঁপে ওঠা নিশ্চিত করতে এবং সবচাইতে বিপদগ্রস্থকে আরও শোচনীয় অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে?
ক্রমাগত আঘাতে আঘাতে বিশ্ব-অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ছে। এই সর্ববিস্তারি আতঙ্কের মধ্যে, নিঃসন্দেহে যত প্রকারের করপোরেট লবিইস্ট আছে সবাই যার যার মতো সবরকমের ধারণা হাজির করছেন। ট্রাম্প বেতন-শুল্ক স্থগিতের দিকে ঝুঁকছেন যা সামাজিক সুরক্ষাকে দেউলিয়া করে দিতে পারে। মূলত এই খাতকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা বা বেসরকারিকরণের মোক্ষম অজুহাত দাঁড় করানোর আইডিয়া অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, এছাড়াও, আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বিত্তশালী ও সর্বাধিক দূষণমূলক খাতগুলোকে আর্থিক ভর্তুকি দেয়ার পাঁয়তারা তো আছেই। ফ্র্যাকিং কোম্পানি (তেল ও গ্যাস উৎপাদন কোম্পানিগুলো), এবং বলাই বাহুল্য সমুদ্র জাহাজ, এয়ারলাইনস এবং হোটেলশিল্পের জন্য আর্থিক ভর্তুকিপ্রদান ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান করতে পারে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা কারণ ভাইরাসই আমাদের একমাত্র বিপদ নয় যা আমরা মোকাবেলা করছি, জলবায়ু বিপর্যয়ও আছে এবং আমাদের টাকায় ‘উদ্ধারকৃত’ এসব শিল্পই জলবায়ু বিপর্যয়ের মূল চালিকাশক্তি।
ট্রাম্প বৈঠক করেছেন বেসরকারি স্বাস্থ্য বীমাদাতাদের সাথেও, সেইসব কোম্পানি যারা অসংখ্য আমেরিকানের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সামর্থ অর্জন করতে না পারে তা নিশ্চিত করেছে। এবং তারা যে একটা ভাগ পেতে যাচ্ছে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? দেখে মনে হচ্ছে পুরো মহামারির দায়িত্বই বাইরে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের প্রথম পদক্ষেপটিই ছিল অর্থনীতিতে আরও ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দেয়া, নিঃসন্দেহে যার পরিমাণ বাড়তে যাচ্ছে। তবে আপনি যদি একজন শ্রমজীবী মানুষ হয়ে থাকেন, বিশেষত যদি আপনি হয়ে থাকেন একজন ফ্রিল্যান্স শ্রমজীবী, সেক্ষেত্রে আপনার পোড়াকপালে হওয়া একটা বড় সম্ভাবনা আছে। আপনার যদি ডাক্তার দেখাতে হয়, তাহলে আপনার অবলম্বন না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই যা হতে পারে আপনার চিকিৎসার খরচ মেটাতে কেউ এগিয়ে আসবে না।
এছাড়া আপনি যদি জনস্বাস্থ্যজনিত সতর্কবার্তা আমলে নিয়ে কাজ বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন, সেক্ষেত্রে বেতন না পাওয়ারও একটা বড় সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও, সবকিছুর পরও বাড়িভাড়া সহ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রেডিট কার্ড, বন্ধকী ঋণগুলো আপনাকে পরিশোধ করতেই হবে।
ফলাফল খুব সহজেই অনুমান করা যায়: প্রচুর লোকের অসুস্থতা সত্ত্বেও কাজে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই, যার ফলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে ভাইরাস ছড়াবে। শ্রমজীবীদের ব্যাপক আর্থিক ভর্তুকি প্রদান না করা হলে, পথে পথে আরও বেশি সর্বস্বান্ত ও বাস্তুহারা মানুষ দেখতে পাব আমরা।
দেখুন, এই নাটক আমাদের পরিচিত। ২০০৮ সালে, সর্বশেষ বৈশ্বিক মহামন্দার সময়ে আমরা কর্পোরেশনগুলোকে কাছাছোলা নিঃশর্ত আর্থিক ভর্তুকি পেতে দেখেছি, যার কড়া মূল্য চুকাতে হয়েছিল সাধারণ মানুষকেই; যা এমনকি আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল।
তের বছর আগে আমি The Shock Doctrine: The Rise of Disaster Capitalism নামে একটি বই লিখেছিলাম। এতে [এমন পরিস্থিতিতে] ডানপন্থী সরকারগুলোর নৃশংস, গণবিরোধী কৌশলসমূহের পুনরাবৃত্তির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল।
যুদ্ধ, ক্যু, সন্ত্রাসী হামলা, বাজার ধ্বস কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কোনো প্রবল আঘাতের পর, জনগণের বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ নেয় তারা, গণতন্ত্রকে বাতিল করে দেয় এবং গোঁড়া ‘মুক্ত-বাজার’ নীতিমালাগুলো চাপিয়ে দেয়, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে শোষণ করে ১% কে বিত্তশালী করে তুলে।
তবে আমার গবেষণা আমাকে যা শিখিয়েছে তা হলো: এই আঘাত এবং সংকটগুলো সবসময়ই ‘শক ডক্ট্রিনের’ পথ অনুসরণ করে না। প্রকৃতপক্ষে, সংকটকে বিবর্তনের একটি ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ১৯৩০ এর দশকের কথাই ভাবুন, যখন আর্থিক মহামন্দা নতুন চুক্তির (New Deal) দিকে ধাবিত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্র, সরকারগুলো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করতে শুরু করেছিল যেন পরবর্তী ধ্বসের ক্ষেত্রে মানুষকে রক্ষা করার মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আগে থেকেই বিদ্যমান থাকে।
মূল কথা হচ্ছে ট্রাম্পের পরিকল্পনা কী তা আমরা জানি: যত প্রকার বিপজ্জনক ধারণা আছে তার সবগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি ‘মহামারী শক ডক্ট্রিন’ বাস্তবায়ন করা– সামাজিক সুরক্ষার বেসরকারিকরণ, সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া থেকে শুরু করে আরও ব্যাপক হারে অভিবাসীদের বন্দি করা। এমনকি নির্বাচন বাতিল করার পাঁয়তারাও তিনি করতে পারেন।
তবে এই কাহিনির শেষটি এখনো লেখা হয়নি। এটা নির্বাচনের বছর, সামাজিক আন্দোলন এবং ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিবিদরা ইতোমোধ্যেই সংঘবদ্ধ এবং সক্রিয়। এবং 1930 এর মতো, আমাদের কাছে গুচ্ছ গুচ্ছ বিকল্প ধারণা মজুদ রয়েছে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগেও এই বিকল্প ধারণাগুলোকে খুব বেশি ‘র্যাডিকাল’ বলে বাতিল করে দেয়া সম্ভব ছিল। এখন এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংকটকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে এই ধারণাগুলোকেই একমাত্র যৌক্তিক উপায় বলে মনে হচ্ছে।
এখন ওয়াশিংটন যখন হঠাৎই এই বিরাট তৎপরতায় মেতে উঠেছে, এটাই তাহলে সেই মোক্ষম সময় তৎপর হওয়ার, যেই তৎপরতার কথা আমরা অনেকেই বিগত কয়েক বছর যাবৎ বলে আসছি । যা ‘গ্রিন নিউ ডিল’ নামে পরিচিত। গত শতাব্দীর জীর্ন শিল্পগুলোকে উদ্ধারের পরিবর্তে আমাদের নতুন শিল্পকে উৎসাহিত করা উচিত যা আগামী শতাব্দীতে আমাদের সুরক্ষার দিকে নিয়ে যাবে।
ইতিহাস যদি আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে, তা হলো– আঘাতের মুহূর্তগুলো গভীরভাবে পরিবর্তনশীল। হয় আমরা জমিনের পুরোটাই হারাব, এলিটদের প্রবল পরাক্রমে বিলীন হয়ে যাব এবং দশকের পর দশক ধরে ভুগতে থাকব অথবা কয়েক সপ্তাহ আগেও অসম্ভব মনে হচ্ছিল এমন প্রগতিশীল বিজয় অর্জন করব। এটা সাহস হারানোর সময় নয়। যারা বিকল্প রূপকল্পকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে, তাদের সক্রিয়তা ও লড়াই করার একাগ্রতার উপরই ভবিষ্যত নির্ভর করছে।
ভিডিও লিংক: