অরাজ
আর্টওয়ার্ক: সেলফলেস হিরো শিল্পী: ডোডি সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » জর্জ মনবিয়ট।। করোনা: আত্মতুষ্টিতে ভোগা সভ্যতাকে প্রকৃতির সতর্কবার্তা

জর্জ মনবিয়ট।। করোনা: আত্মতুষ্টিতে ভোগা সভ্যতাকে প্রকৃতির সতর্কবার্তা

  • অনুবাদ: শুভম ঘোষ

আমরা একটি বুদবুদের ভেতর বসবাস করে আসছি, যে বুদবুদের বুনিয়াদ মিথ্যে আশ্বাস আর সত্যকে অস্বীকার করার মধ্যে নিহিত। সম্পদশালী দেশগুলোর বাসিন্দা হিসেবে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, আমরা বস্তু জগতের সীমাকে অতিক্রম করে ফেলেছি। যে সম্পদের পাহাড় (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা শোষণের মধ্য দিয়ে পুঞ্জিভূত হয়েছে ) আমরা গড়েছি তা আমাদেরকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। মূল দৃশ্যপটকে সরিয়ে রেখে গাড়ি, বাড়ি, আভিজাত্যে মোড়ানো বিলাসবহুল জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের বুঝ দিয়েছিলাম, যে কোনো ধরনের আকস্মিকতাকে পেছনে ফেলে এসেছি। ভেবেছিলাম, আমরা সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছি, যা কিনা প্রতিটা সভ্যতাই চায়।

আর্টওয়ার্ক: কোভিড- ১৯
শিল্পী: আন্দ্র পেসিয়া
সূত্র : কার্টুন মুভমেন্ট

কিন্তু এখন যখন মরীচিকার ধোয়া উবে গেলো তখন আমরা নিজেদের নগ্ন ও বিধ্বংসী বাস্তবতার স্বরূপ দেখতে পেলাম; যে বাস্তবকে আমরা আজীবন অস্বীকার করে এসেছি। এই মহামারীর ঝড় বয়ে যাওয়ার পর আরেকটা বুদবুদের আশায় আমাদের বুক বাঁধতে হবে। আমরা এখানেই আমাদের ইতি টানতে পারি না। ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আমাদের উচিত যন্ত্রণাদায়ক বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়া যা আমরা দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করে আসছি।

পৃথিবীতে অসংখ্য রোগের বিস্তার, যেগুলোর তুলনায় করোনা ভাইরাসের উপশম অনেক সহজ। কিন্তু সবকিছুর উপরে সম্প্রতি একটা চিন্তা আমাকে বিচলিত করে তুলছে: আমরা আমাদের খাদ্যের যোগান কীভাবে দিবো? টয়লেট পেপার নিয়ে সংঘাত বেঁধে যাওয়া বেশ বিচ্ছিরি ঘটনা, আশা করি খাদ্যের অভাবে কখনো সংঘাতে জড়াতে হবে না আমাদের। কিন্তু এই সংঘাত এড়ানোর রাস্তা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।

জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের খাদ্যাভাব প্রকট করে তুলতে পারে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা এই দুর্যোগের সম্ভাবনা প্রবল করে তুলেছে । ইতোমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বন্যা, খরা, দাবানল আর পঙ্গপালের প্রকোপে কৃষিখাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এসব দুর্যোগকে আমরা ‘biblical’ বলে আখ্যা দিই: আমরা বোঝাতে চাই এই ধরনের জিনিস বহু আগে ঘটেছিল, যাদের সাথে ঘটেছিল তাদের জীবন আমরা কল্পনাই করতে পারিনা। বর্তমানে এই ঘটনাগুলোই খুব ঘনঘন আমাদের সাথে ঘটছে।

আর্টওয়ার্ক: ডিপার্চর অব কালার
শিল্পী:
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি কীভাবে আমাদের খাদ্যের যোগানে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, মার্ক লিনাস তার আশু বই আওয়ার ফাইনাল ওয়ার্নিং এ তা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি প্রাক শিল্প স্তরের তাপমাত্রার চেয়ে তিন থেকে চার ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার বৃদ্ধিতে ভয়াবহ দুর্যোগের সূত্রপাত খুঁজে পেয়েছেন। উক্ত পরিস্থিতিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত দুর্যোগগুলোর প্রভাব খাদ্যোৎপাদন ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা মানুষের সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে যা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষিকাজ অসম্ভব করে তুলবে। প্রাণী বৈচিত্র্য অসহনীয় তাপমাত্রায় বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হবে। পৃথিবীর সিংহভাগ অঞ্চল জুড়ে তাপমাত্রা শস্য জাতীয় ফসলের ফলনের জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠবে এবং অধিকাংশ আবাদী জমি ধুলোর চাদরে ঢাকা পড়বে। বৈশ্বিক কৃষিখাত ধ্বংসের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠবে; আধুনিক দুনিয়ার এমন অভিজ্ঞতা কখনোই হয়নি।

সেচের পানির স্বল্পতা, অনুর্বর মাটি এবং পরাগবাহকের বিলুপ্তির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা জনসংখ্যা পৃথিবীকে একটি ‘স্ট্রাকচারাল ফ্যামিনে’র দিকে নিয়ে যাবে। এমনকি বর্তমানে খাদ্যের উদ্ধৃত যোগান থাকার পরও লক্ষ লক্ষ মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়ে অপুষ্টিতে ভুগছে। একটি ব্যাপার স্পষ্টত অনুমেয় যে, খাদ্যের ঘাটতি শত কোটি মানুষের অনাহারের কারণ হবে। সারা পৃথিবী জুড়ে সবসময়ের মত ক্ষমতাবান শ্রেণি দারিদ্রের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে অনৈতিকভাবে খাদ্যের মজুদ করবে। যদি সবগুলো দেশ প্যারিস চুক্তির প্রতি অনুগত থাকেও (যা প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছে), তাও বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন থেকে চার ডিগ্রী অনায়াসে বৃদ্ধি পাবে।

নিরাপত্তার এই বিভ্রমের কারণেই আমরা আসন্ন ভয়াবহ দুর্যোগের ব্যাপারে কোনো পূর্বানুমানই করতে পারছি না। এই অস্তিত্বের বিষয়টিকে আমরা আমাদের মনোজগতে খুব একটা জায়গা দিচ্ছি না। খাদ্যোৎপাদনের প্রতিটি সেক্টর নিজেদেরকে ভবিষ্যতের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবছে এবং পরিবর্তনের কোনো প্রকার তাড়না এদের নাই। আমি যখন তাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম তখন আমি এমন ঘৃণা, ক্ষোভ ও হুমকির মুখোমুখি হলাম যা ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করার পর থেকে নিকট অতীতে দেখিনি। পবিত্র গরু আর মেষশাবক সর্বত্রই আছে কিন্তু কোথাও কেউ গবেষণাগারে খাদ্য উৎপাদনের মত বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছে না।

এই দুর্যোগ আমাদের জন্য আসন্ন বিপদগুলোর একটি মাত্র। মানুষের শরীরে এন্টিবায়োটিকের কার্যকরিতা হারানোর ঘটনা অন্য যেকোনো নতুন ও অপরিচিত রোগের মতই ভয়ঙ্কর। পশুপাখির ফার্মে এনটিবায়োকের মত গুরুত্বপূর্ণ ঔষধের অনৈতিক এবং লাগামছাড়া ব্যবহারই এই সমস্যার অন্যতম কারণ। এসব ফার্মে বেশি সংখ্যক পশু গাদাগাদি করে একসাথে রাখা হচ্ছে এবং এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় এগুলো কেবল রোগ প্রতিরোধের জন্যই ব্যবহৃত হয় না, বরঞ্চ বৃদ্ধি বর্ধক (growth promoter) হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

আর্টওয়ার্ক: স্টে এট হোম
শিল্পী: সানাউনি ইমাদ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

আমেরিকার মত দেশে যেখানে ২৭ মিলিয়ন মানুষ চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় নেই, সেখানে কিছু মানুষ ভেটেরিনারি এন্টিবায়োটিকগুলো দিয়ে নিজেদের চিকিৎসা করছেন। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো নতুন ধরনের মেডিসিনের সন্ধান করতে এবং যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করত ব্যর্থ হচ্ছে। মানব শরীরে এন্টিবায়োটিক যদি পুরোপুরি কার্যকারিতা হারায় তবে পৃথিবীর বুকে সার্জারি অসম্ভব হয়ে পড়বে। নবজাতকের জন্ম পুনরায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। কেমোথেরাপির ব্যবহারও বিপদজনক হয়ে উঠবে। অতি পরিচিত সংক্রামক ব্যাধিগুলো মরণব্যাধি হয়ে উঠবে। এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত যেমনটা আমরা ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে করি, কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না।

এই দুটোর মতো আমাদের একাধিক সঙ্কটের গোড়া এক জায়গাতেই নিহিত। বাথ হাফ ম্যারাথন এর সংগঠকদের একটি সিদ্ধান্ত এর একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। ১৫ ই মার্চ একটি বিশাল ম্যারাথন দৌড় হওয়ার কথা ছিল, এবং এই পরিস্থিতিতে সবাই আয়োজনটি বাতিল করতে অনুরোধ করেছিলেন। সংগঠনটি তখন জানিয়েছে ‘এখন এই আয়োজন বাতিল করা অসম্ভব, ভেন্যু এবং যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে ফেলা হয়েছে। ঠিকাদারেরাও প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে।’ এর মানে দাঁড়াচ্ছে ইভেন্টটি বাতিল হলে যে আর্থিক ক্ষতি হবে, সে ক্ষতির কাছে ইভেন্টটি অদূর ভবিষ্যতে যে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি ও মৃত্যু ডেকে আনবে তা নস্যি, গুরুত্বহীন।

বিশ্ব অলিম্পিক কমিটি আয়োজন বাতিল করতে যে পরিমাণ সময় নিয়েছে তাও চোখে পড়ার মত যদিও তারা শেষপর্যন্ত পদক্ষেপ নিতে পেরেছে। জীবাশ্ম জ্বালানী শিল্প, কৃষিকাজ, ব্যাংকিং, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য খাতে ডুবে থাকা ব্যয়গুলো আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রুত রূপান্তরগুলোকে বাঁধা দিবে। জীবনের চেয়ে টাকাই বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতি দুই দিকে যেতে পারে। একটি হলো মিথ্যে আশ্বাসের বুদবুদে আরো বেশি করে ডুবে যাওয়া বা সত্যকে আরো বেশি করে অস্বীকার করা; যেমন করে আমাদের অনেকেই মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ অনায়াসেই মোকাবেলা করতে পারবো, এমনকি করোনা ভাইরাসও তেমন কোনো হুমকি না। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি বলসোনারোকেই দেখুন যিনি দাবি করেন করোনা ভাইরাস সাধারণ একটা ফ্লু ছাড়া আর কিছুই না। মিডিয়া এবং বিরোধীদলীয় রাজনীতিকসহ যারাই লকডাউনের কথা বলছেন তাদেরকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশীদার বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে।

আর্টওয়ার্ক: সেলফলেস হিরো
শিল্পী: ডোডি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

অথবা আমরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বসবাসযোগ্য পৃথিবীর দিকে ফিরাতে পারি। আমরা আর কখনোই মিথ্যুক এবং সত্য অস্বীকারকারীদের কথা শুনবো না। তেঁতো সত্যকে আড়াল করার জন্য আমরা আর কখনো মিথ্যে আশ্বাসের বুদবুদে ডুব দিবো না। যাদের কাছে জীবনের চেয়ে অর্থ বেশি মূল্যবার তাদের হেডমগিরি আমরা আর বরদাস্ত করতে পারিনা। করোনাভাইরাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা এই বস্তুজগতে (material world) বসবাস করি।

নোট: গার্ডিয়ান-এর মতামত পাতায় ২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে কলামিস্ট জর্জ মনবিয়ট ‘Covid-19 is nature’s wake-up call to complacent civilisation’ শিরোনামের এই নিবন্ধ লিখেন।

শুভম ঘোষ