- অনুবাদ: শোয়েব আবদুল্লাহ
পুলিশের হাঁটুর নিচে আমাদের কারো গর্দান নেই, কিন্তু আমরাও দম নিতে পারছি না। আমরা দম নিতে পারছি না কারণ পুঁজিবাদ আমাদের খুন করে ফেলছে।
দরজাটা খুলে গেলো। চেহারাগুলি দেখার আগেই আপনি অনুভব করছেন দমিয়ে রাখা হিম্মত। লকডাউন ফুরিয়ে গেছে। বাঁধটা ভেঙ্গে গেছে। স্রোতের মত গড়িয়ে পড়ছে রাগ, ক্ষোভ, অস্বস্তি, হতাশা; স্বপ্ন, আশা আর আশঙ্কা। যেন এমন আমরা দমই নিতে পারছি না।
আমরা সবাই বন্দি দশায় আছি। শারীরিকভাবে পুরা দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করছি আসলে হচ্ছেটা কী। বিশেষজ্ঞরা বছর ধরে আমাদের এরকম একটা মহামারীর হুশিয়ারি দিচ্ছিলেন, যদিও তারা জানতেন না কত দ্রুত এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হালে একটা আজব ভাইরাস আমাদের জীবনই পালটে দিয়েছে। কিন্তু এটা এলো কোথা থেকে? এটা প্রথম দেখা যায় চীনের উহানে, কিন্তু আমরা যতই জানতে থাকলাম ততোই বুঝলাম, যেকোনো জায়গায় এর উৎপত্তি হতে পারতো । এটা এসেছে মূলত আমাদের জীবনের সাথে প্রাণ-প্রতিবেশের বোঝাপড়াকে ধ্বংস করে দেয়ার মধ্য দিয়ে। কৃষির শিল্পায়ন, দুনিয়া জুড়ে কৃষককে মুছে দেয়া, নগরায়নে উঠে-পড়ে লাগা, বন্য প্রাণীর আবাসভূমি বরবাদ করা এবং এই সকল প্রাণীকে বাণিজ্যিক পণ্য করে মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে।
আর আমরা যদি জীবনের অন্য ফর্মগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্কের তামাম একটা পরিবর্তন না আনি তাহলে সামনে এরকম আরো মহামারী আসতেই থাকবে। এটা একটা হুশিয়ারি: পুঁজিবাদের শেকল ছিন্ন করুন, নয়তো বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যান। “পুঁজিবাদ থেকে বের হয়ে আসুন” এটা একটা ফ্যান্টাসিই বটে। আমাদের মধ্যে ভয় এবং ক্ষোভ দানা বেঁধেছে, এমনকি জন্ম নিয়েছে আশাও। আর এজন্যই মনে হয়, আমরা কোনো না কোনো ভাবে পুঁজিবাদের শেকল ছিন্ন করতে পারবো।
লকডাউন যখন চলতে থাকলো তখন আমাদের মনোযোগ অন্য দিকে সরে গেলো। রোগ বালাই ছাপিয়ে অর্থনীতির হাল-হকিকতের দিকে নজর গেলো। ১৯৩০ সালের পরে প্রথম আমরা একটা বিরাট অর্থনৈতিক মন্দার দিকে যাচ্ছি। যা লোকে বলে ব্রিটেনের গত ৩০০ বছরের মধ্য সব থেকে খারাপ অবস্থা। বিশ্বব্যাংক আমাদের জানালো ১০০ মিলিয়ন মানুষ রাতারাতি গরিবি হালতে চলে যাবে।
দক্ষিণ আমেরিকার জন্য আরো একটা দশকের হারিয়ে যাওয়া। লাখ লাখ লোক দুনিয়ায় চাকরি হারিয়ে বেকার। মানুষ না খেয়ে আছে, ভিক্ষা করছে, অপরাধ বাড়ছে, আশাগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নগুলো যেন বরবাদ হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে কোনো আশু মুক্তি নেই, আর থাকলেও তা খুবই নাজুক ও দুর্বল।
আমরা ভাবি, আমরা কয়েক মাস যাবৎ ঘরের মধ্যে ছিলাম বলেই কি এমন হচ্ছে? তবে আমরা এখন জানি, আদতে তেমন নয়। অবশ্যই আমরা একটু গরিব হয়েছি। কয়েক মাস যাবৎ কাজ না করে ঘরে বসে থাকলে মানুষ একটু গরিব হবারই কথা। কিন্তু তাই বলে মিলিয়নের উপরে মানুষ বেকার হয়ে যাবে, মানুষ না খায়ে মরবে? একদম না। কয়েক মাসের বিরতির এই ফলাফল হতে পারে না। বরং উল্টোটা। করণীয়গুলো সম্পাদনের জন্য আমাদের আরো সতেজ ও পূর্ণ শক্তিতে ফেরা দরকারি ছিল।
আমরা অতঃপর আরেকটু ভাবলাম এবং তাতে বুঝতে পারলাম এই আর্থিক মন্দা অতিমারীর কোনো ফল না। যদিও রোগ বালাই এটাকে আনজাম দিয়েছে। যেভাবে এই মহামারীর ব্যাপারে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিলো মন্দার ব্যাপারেও এর চেয়ে পরিস্কার আভাস ছিলো। গত ত্রিশ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা সোজা কথায় ধার দেনা করে চলছিলো। এটার বাড়বাড়ন্তে ছিলো ধারের কর্যের পয়সা। তাসের ঘরটা যেন ভেঙ্গে পড়ার জন্যেই একবারে তৈরিই ছিল।
২০০৮ সালের দিকে তো এটা ভয়ানকভাবে ধসে পড়ে। কিন্তু একটা নয়া কাঠামোতে কর্যের টাকায় বিপুল খরচেতত্ত্বের প্রস্তাবনা একে আবার টেনে তোলে। অর্থনীতির ভাষ্যকাররা জানতো এটাই শেষ না। “খোদা নুহকে রঙধনু দেখিয়ে ইশারা দিয়েছিলেন, আর পানি না, সামনে আছে আগুন”। ২০০৮ সালের সংকটটা ছিলো বন্যা; কিন্তু সামনে ছিল আগুন, যেটা বেশি দূরে না।
পুঁজিবাদের উদাম চেহারা
এভাবেই আমরা পুঁজিবাদের আগুনের মধ্যে দিন গুজার করছি। বহু দুর্দশা, ক্ষুধা আর স্বপ্নের বরবাদি কেবল ভাইরাসের জন্য না, বরং এর কারণ হলো পুঁজিবাদের মুনাফামুখিতা। কি হতে পারে যদি আমরা এই মুনফা নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসি। কি হবে যদি আমরা আমাদের নয়া শক্তি নিয়ে বের হয়ে আসি এবং মুনাফার দিকে না তাকিয়ে যা করার দরকার সেটা করি, যেমন রাস্তা সাফ করা, হাসপাতাল বানানো, বাইসাইকেলে চড়া, বই লেখা, শাকসবজি চাষ করা, গান শোনা আরো কত কিছু। কোনো বেরোজগারি নাই, কেউ না খেয়ে থাকবে না, আর স্বপ্নগুলাও ভেঙেচুরে যাবে না।
আর পুঁজিবাদীরা? তাদের ঝুলিয়ে দেবো কাছের ল্যাম্পপোস্টের সাথে (এই শখটা তো আছেই) আর না হয় বেমালুম ভুলে যাবো তাদের ব্যাপারে। হ্যাঁ, ভুলে যাওয়াটাই বেশি ভালো হবে। এটা হয়তো আরেকটা কল্পনা; কিন্তু কল্পনাকে ছাপিয়েও এটা মূলত জরুরত। এবং আমাদের ভয়, ক্ষোভ আর আশা নিজেদের মধ্যে জন্ম নেয়া।
এইরম বহু বহুজিনিস লকডাউনের সময়ে আমাদের ক্রোধকে আনজাম দিয়েছে। এই করোনা ভাইরাস পুঁজিবাদের তামাম চেহারা উদাম করে ফেলেছে । চতুর্দিক দিক দিয়ে, পুঁজিবাদ এই রকম ন্যাংটো আগে কমই হয়েছে। লকডাউনের মধ্যে মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার বিশাল ফারাক ছিল। এটা শুরুই হয়েছিল কতক নতুন প্রশ্নকে সঙ্গী করে। আপনার কতটুকু জায়গা আছে, আপনার কোন বাগান আছে কিনা, আপনার কি আরেকটা বাড়ি আছে যেখানে আপনি ঠাঁই নিতে পারেন, ইত্যাদি।
পাশাপাশি রোগটা বিস্তারের সাথে সাথেই দেখা যায় গরিব আর ধনীদের উপরেও এই ভাইরাস একদম আলাদা প্রভাব ফেলেছে। এর সাথে আরো যুক্ত করা যায়, সাদা আর কালোদের আক্রান্তর হার আর মৃত্যুর বিশাল ফারাক।
গত ৩০ বছর চিকিৎসা সেবার ভয়ানক কমতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চোখ রাখা হয়নি বহু রাষ্ট্রের নিদারুণ অক্ষমতার দিকে। অথচ বেড়েই চলেছে প্রবল নজরদারি। আর পুলিশি ও সামরিক ক্ষমতাকে করে তোলা হয়েছে সর্বব্যাপী। যাদের ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার আছে এবং যাদের নাই, তাদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণে প্রবল অসমতা দেখা দিয়েছে। দুনিয়া জুড়ে যে পরিবর্তন এসেছে— যার ভেতরে শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত— তা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে এই সময়ে বহু নারী ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয়েছে ।
এই সব জিনিস যখন আরো তীব্র হয়ে উঠলো , তখন একই সঙ্গে অ্যামাজন ও জুমের মালিকসহ আরো যত টেক কোম্পানি এবং প্রকাণ্ড বহুজাতিকরা অভাবনীয় মুনাফা এবং শেয়ার দাম বাড়তে থাকলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আস্কারায় তারা বেহায়ার মত ক্রমাগত গরিবের টাকা ধনীদের পকেটে পাচার করতে লাগলো। আর আমাদের ক্রোধ বাড়তে থাকলো। আমাদের আশঙ্কা, আমাদের বেপরোয়া স্বভাব এবং আমাদের সংকল্পই আমাদের বলে দিল, এভাবে চলতে পারে না। কোনভাবেই এই দুঃস্বপ্নকে সত্যি হতে দেয়া যাবে না।
ক্ষোভের আগুন জ্বলছে আমাদের ভেতরে
এরপর দরজা খুলে গেল আর আমাদের বাঁধ ভেঙে গেল। আমাদের আশা আর ক্ষোভ বাঁধ ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে এসেছে। আমরা জর্জ ফ্লোয়েডের শেষ কথাটা শুনলাম “আমি দম নিতে পারছি না’। কথাটা আমাদের মাথার মধ্যে ভনভন করে ঘুরতে থাকলো। আমাদের গর্দানের উপরে খুনি পুলিশের হাঁটু নাই। কিন্তু, আমরাও তো দম নিতে পারছি না। আমরা দম নিতে পারছি না, কারণ পুঁজিবাদ আমাদের মেরে ফেলছে। আমরা হিংস্রতা অনুভব করছি এবং হিংস্রতা আমাদের ভেতর থেকে বিস্ফোরিত হতে চাচ্ছে। কিন্তু সহিংসতা তো আমাদের রাস্তা না, ওটা ওদেরই রাস্তা।
তারপরও আমাদের ক্ষোভ-আশা, আশা-ক্রোধের দম নেয়ার সময় হয়েছে, দম নিতে হবে। আর বুক ভরে প্রাণ বায়ু ভেতরে ঢুকছেও। পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়া জুড়ে বিক্ষোভের মাধ্যমে আমরা দম নিয়েছি। কুখ্যাত দাস কারবারি এডওয়ার্ড কোলস্টনের মুর্তি ব্রিস্টল নদীতে ফেলে দেয়ার সময় আমরা দম নিয়েছি। সিয়াটেলের ক্যাপিটল হিলকে স্বশাসিত অঞ্চল বানানোর সময়, মিনিয়াপলিসে, বেশুমার মুষ্টি আকাশে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আমরা দম নিয়েছি।
তাই ক্ষোভ-আশা- ভয়- ক্ষুধা- স্বপ্ন- হতাশার জলধারার সোপান এখনো বহমান আছে, একজন থেকে আরেকজনে, একে অপরের ক্রোধকে সম্মান করে গড়িয়ে যাচ্ছে অপরের দিকে। এই ক্ষোভ আমাদের ভেতরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে কেবল পুলিশি জুলমের বিরুদ্ধে না, কেবল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে না, কেবল দাসত্বের বিরুদ্ধেও না যেটা পুঁজিবাদের পয়দা । এটা একই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং সকল ধরনের যৌনবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ। তাই ৮ মিলিয়নের সেই প্রকাণ্ড মিছিলের তরঙ্গ এখনো গাইছে।
চিলির লোকেরা আবার রাস্তায় নেমে এসেছে, বিপ্লব চালিয়ে নিতে। কুর্দিস্তানের মানুষ সেই রাষ্ট্রকেই ধাক্কা দিচ্ছে, যে রাষ্ট্র তাদের রাষ্ট্রহীন সমাজকে সহ্য করতে পারছে না। হংকং এর লোকেরা সমাজতন্ত্রের মশকরা না করে চীনাদের অনুপ্রাণিত করছে। কারন তারা এটা বলেনি,”আমরা কমিউনিজম চাই না’’। বরং তারা বলছে, এসো, আমরা সত্যিকারের সমাজতান্ত্র বানাই।
জাপাতিস্তারা এক দুনিয়ার মধ্যেই বানিয়েছে বহু দুনিয়া। কৃষক তাদের বস্তি ছেড়ে জমিতে ফিরে গেছে যার সাথে নানা ভাবে তার নাড়ি পোঁতা। বাদুড় আর জন্তু-জানোয়ার জঙ্গলে তাদের আবাসে ফিরে গেছে। আর পুঁজিবাদ কাঁদতে কাঁদতে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে সিঁড়ির তলে।
আর শ্রম, পুঁজিবাদী শ্রম, সেই ভয়ানক যন্ত্রটা যা আমিরি আর গরিবি তৈরি করে এবং আমদের জীবনকে বরবাদ করে দেয়, তার খতম অনিবার্য। আমরা তাই করবো যা আমরা চাই। আমরা একটা দুনিয়া বানাবো যা হবে পারস্পারিক স্বীকৃতি আর সমতার মূর্তরূপ।
তারপর, কোনো দশক আর বেমালুম হারিয়ে যাবে না। কোনো বেরোজগারি থাকবে না এবং কোটি মানুষকে গরিবির দিকে ঠেলে দেয়া হবে না। কেউ না খেয়েও থাকবে না। কেবল তখনই আমরা প্রাণ ভরে দম নিতে পারব।
মূল লেখা দেখুন এখানে