অনুবাদ: শাহারিয়ার জিম
ভূমিকা:
জঁ-লুক ন্যান্সি প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত La Communauté désœuvrée (The Inoperative Community) ন্যান্সির অন্যতম সুপরিচিত কাজ। গোষ্ঠী বা কম্যুনিটি’র প্রশ্ন তাঁর এই কাজের বিষয়বস্তু। করোনা মহামারি ও এর সাপেক্ষে জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে জর্জিও আগামবেন ও রবার্তো এসপজিতো’র সাথে বিতর্কে জড়িয়ে ইতোমধ্যেই Viral Exception ও A Much Too Human Virus শিরোনামের লেখা লিখেছেন। করোনা ভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে ন্যান্সি’র তৃতীয় রচনা Communovirus , ২৪শে মার্চ, ২০২০ তে প্রকাশিত হয়েছে Libération–এ। ২৭শে মার্চে ডেভিড ফেয়ার্নবাখকৃত ইংরেজি অনুবাদ verso-তে প্রকাশিত হয়েছে।করোনা ভাইরাস আমাদের কম্যুনাইজ বা গোষ্টীবদ্ধ করছে, কেননা আমাদেরকে এজমালি বা যৌথভাবে একে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এতে আমাদের কম্যুনিটি’র সত্যিকারের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ রয়েছে বলে ন্যান্সি মনে করেছেন। ন্যান্সি’র এই Communovirus রচনাটি অনুবাদ করেছেন শাহারিয়ার জিম। বোধিচিত্তের সৌজন্যে রচনাটি প্রকাশিত হল।
মূল রচনা
আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধুর মুখে শুনলাম তাদের ওইখানে ভাইরাসটাকে ‘কম্যুনোভাইরাস’ (Communovirus) নামে ডাকে। এই বিষয়টা কিভাবে ইতোমধ্যে আমাদের মাথায় নাড়া দেয়নাই? এটাতো বেশ সহজেই ধরা যায়! কী একটা অদ্ভুত এবং সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থব্যঞ্জক ঘটনাঃ কম্যুনিজম থেকে আবির্ভাব ঘটা এক ভাইরাসের, যে ভাইরাস আমাদেরকে কম্যুনাইজ (গোষ্ঠীবদ্ধ) করে। করোনা(Corona)‘র মত একটা বিদ্রুপাত্মক নাম যা ইতিহাসের পুরানা রাজতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদী গন্ধ ছড়ায়, সেটার তুলনায় কম্যুনো(Communo) নামটা বেশ ফলপ্রসূ। নিদেনপক্ষে এটা ভাল দিক যে, কম্যুনো নামটা করোনা‘র মুন্ডুপাত না করতে পারলেও এটিকে সিংহাসনচ্যুত করতে পারে বটে।
প্রথম নজরে বিষয়টির অর্থ অনেকটা এরকমই মনে হয়, যেহেতু এই ভাইরাসের আবির্ভাব এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ঘটেছে যারা নিজেদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্যুনিস্ট বলেই দাবী করে বর্তমান সময়ে। তবে শুধু প্রাতিষ্ঠানিকতাই নয়, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ভাষ্যমতেঃ এই ভাইরাল এপিডেমিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমাদের যে সাফল্য, সেটি মূলত “চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা”রই সাফল্য। যদিও ব্যক্তি মালিকানার উচ্ছেদ ঘটানো কম্যুনিজমের একটি মূল বৈশিষ্ট্য, তবে চীনা কম্যুনিজমের ক্ষেত্রে আমরা সামষ্টিক(বা রাষ্ট্রীয়) সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি(জমির মালিকানা বাদে)– এই দুইয়ের এক মিশ্রণ লক্ষ্য করছি অনেক বছর ধরেই।
এই বিকল্প ব্যবস্থা চীনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার কতটা উন্নতিসাধন ঘটিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী এর যে ভূমিকা সেটি আমাদের সবারই জানা আছে। এই বিকল্প ব্যবস্থার সমাজকে ঠিক কী নামে অভিহিত করা যায় সেটি এখনই বলা যাচ্ছে নাঃ কারণ ঠিক কোন অর্থে এটি কম্যুনিস্ট এবং একইসাথে আবার ব্যক্তি প্রতিযোগিতার বিষ ছড়াতেও সক্ষম, যা উদারনীতিবাদের চূড়ান্ত রূপ বা আলট্রালিবারেল এক্সট্রিম পর্যায় ধারণ করে এমন প্রশ্ন থেকে যায়। তবে আপাতত কোভিড-১৯ ভাইরাস ঠেকাতে চীনের যে সাফল্য সেটি তার সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। এই সাফল্য এতটাই প্রমাণিত যে, চীন এখন ইতালি এবং ফ্রান্সের জন্যও নতুন একটি সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বর্তমান সময়ে চীনা রাষ্ট্র যে কর্তৃত্বপরায়ণ প্রবল ক্ষমতা উপভোগ করছে সেটি নিয়েও বিতর্কের কমতি নেই অবশ্য। এমনকি এখন বিষয়টা এমন মনে হচ্ছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক চীনা কম্যুনিজমের ঝান্ডাকে উদীয়মান করতে একেবারে ঠিক সময়েই এই ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছে। তবে এর ফলে ‘কম্যুনিজম’ ধারনাটির অর্থ নিয়ে আরও যে ধোঁয়াটে পরিবেশ তৈরী হবে সেটি কপালে ভাঁজ ফেলার মত বিষয় বটে।
এবার কম্যুনোভাইরাস শব্দটির দ্বিতীয় অর্থটির দিকে একটু নজর দেয়া প্রয়োজন। ভাইরাসটি মূলত আমাদেরকে কম্যুনাইজ(গোষ্ঠীবদ্ধ) করে। ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা সর্বজনীনভাবে এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, যেখানে আমরা সবাই একত্রে সমানভাবে হুমকির মুখে। আমরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও আপাতবিরোধী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধতার এক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। শুধুমাত্র গোষ্ঠীবদ্ধতার মাধ্যমেই আমরা স্বতন্ত্র একক হয়ে উঠতে পারি। এই স্বাতন্ত্র্যবোধের অংশীদারীত্বই সর্বাধিক একতাবদ্ধ গোষ্ঠী তৈরীর প্রণালী।
একতা, পারস্পরিক নির্ভরতা এবং সংহতির কথা আজকে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রত্যেকভাবেই। এগুলোর যে প্রয়োজনীয়তা, তার প্রমাণ ও উদ্যোগ আমরা সবদিক থেকেই অনুভব করছি। এর সাথে যদি আমরা যানবাহন এবং কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বায়ু দূষণের হার কমে যাওয়ার ব্যাপারটিও যোগ করি, তাহলে এই ব্যাপারটির ফলে ইতোমধ্যে অনেকেই টেকনো-ক্যাপিটালিজমের পতনের কথা ভেবে খুশীতে গদগদ হচ্ছে। তবে এসব ব্যাপার নিয়ে এত গদগদ হওয়ার কিছু নেই আমাদের, বরং আমরা আমাদের গোষ্ঠী’র প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কীভাবে আরও ভালো বোঝাপড়া তৈরী করতে পারি, এই প্রশ্নটি করা উচিত নিজেদেরকে।
সংহতি’র সক্রিয়তা এবং আমন্ত্রণ দেখতে পাচ্ছি আমরা বহুলাংশেই, কিন্তু সামগ্রিক গণমাধ্যম মূলত রাষ্ট্রের নিজস্ব কল্যাণেই ব্যবহৃত হচ্ছে- যার সুবর্ণ সুযোগ এমানুয়েল ম্যাকরনকে ব্যবহার করতে দেখি আমরা। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে কোয়ারেন্টাইনে না রেখে বরং জোরজবরদস্তির মাধ্যমে বন্দী অবস্থায় রয়েছি, যদিওবা সেটা আমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই। বিচ্ছিন্নতার এই অভিজ্ঞতাটি আমরা বঞ্চনাবোধ হিসেবে অনুভব করছি, এমনকি যখন সেটি আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে তখনও।
একদিক থেকে এই সময়টি নিজেদেরকে আবিষ্কার করারও একটা সুযোগঃ এটা সত্য যে আমরা অসামাজিক জীব না। আমাদেরকে পরস্পরের সাথে মিশতে হয়, দেখা করতে হয়, একসাথে বসে আড্ডা মারতে হয় এবং ঘোরাঘুরি করতে হয় এসবও সত্য। এছাড়াও, ফোনে কথা বলা, ই-মেইল এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে আমাদের আকস্মাৎ এত সক্রিয়তা আরও একটি ব্যাপারের দিকে ইঙ্গিত করে, সেটি হচ্ছে যোগাযোগহীন হয়ে পড়ার ভীতি।
তার মানে কি এরকম যে, এই গোষ্ঠী নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার জন্য আমরা একটা উত্তম অবস্থানে আছি? সমস্যাটা হচ্ছে, ভাইরাসটি এখনও প্রধান প্রতিনিধি(representative) হিসেবে কাজ করছে; হোক সেটি নজরদারিমূলক কোনও ব্যবস্থা অথবা কল্যাণমূলক কোনও ব্যবস্থা, ভাইরাসটিই এখন একমাত্র সাধারণ বৈশিষ্ট্য উভয় ব্যবস্থাতেই।
যদি ব্যাপারটা এমনই হয়ে থাকে, তাহলে সামষ্টিক এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে অতিক্রম করে যাওয়া বলতে কী বুঝানো হয় সেই ব্যাপারটি নিয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে আমাদের কোনও অগ্রগতি ঘটবে না। সম্পত্তিকে অতিক্রম করে যাওয়া বলতে এখানে দুইটা অর্থ রয়েছে। একটি হচ্ছে সাধারণ অর্থে সম্পত্তিকে অতিক্রম করে যাওয়া, আরেকটা হচ্ছে সাবজেক্টের দ্বারা দখলকৃত যে অবজেক্ট, সেই দখলের ব্যাপারটিকে অতিক্রম করা (Transcending)। মার্ক্সের ভাষায় বলতে গেলে, ব্যক্তি’র প্রকৃত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে অতুলনীয়, অদ্বিতীয় এবং অকৃত্রিম হয়ে উঠবে এমনকি তার নিজের সাথেও। বস্তু বা সম্পত্তি অর্জন করা ব্যক্তি’র প্রকৃতি নয়। ব্যক্তি হবে স্বতন্ত্র। নিজেকে উপলব্ধি করার স্বতন্ত্র সম্ভাবনা থাকবে তার মধ্যে, এবং এই স্বাতন্ত্র্য আবার সামগ্রিকতার মধ্যেই ক্রিয়ারত থাকে সামগ্রিকতার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও। সামগ্রিকতা ও স্বাতন্ত্র্যের এই পরস্পর দ্বান্দিক ব্যবস্থাটি বজায় থাকে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক ও বিনিময় স্থাপিত হওয়ার মাধ্যমে(ন্যান্সির ভাষায়, যোগাযোগ)। এটা এমন এক ধরনের ‘মূল্য’ যা টাকাপয়সা কিংবা শোষণকৃত উদ্ধৃত্ত কোনওটা দিয়েই ক্রয়যোগ্য নয়, এমন ‘মূল্য’ যা কোনওভাবে পরিমাপও করা যায়না।