অনুবাদ: জাকির হোসেন
প্রথম কিস্তি
আদতে ১৮৫০ এর পর থেকেই সমাজে পুঞ্জিভূত হতে থাকে বিপুল সম্পদ। উত্থান ঘটে তুলনামূলক স্বতন্ত্র ও বিকশিত শ্রমিক শ্রেণির। এমন প্রেক্ষাপটেই ধনী ও ক্ষমতাবানদের জন্য ‘গণতন্ত্রের সমস্যা’ খুব জরুরি হিসেবে দেখা দেয়। সাধারণভাবে পুরো সমাজ জুড়েই সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং একইসাথে বৃদ্ধি পাচ্ছিল নতুন কারখানা, খনি এবং জমির মালিকদের লোভ। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের সময় থেকে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ মানুষের বিরামহীন বিক্ষোভ প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। প্রশ্নটি হলো, এমন পরিস্থিতিতে কী করা যায়?
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে ‘ধনী ও সুবিধাভোগী’ শ্রেণির প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল তাদের সুবিধা এবং সম্পদ অব্যাহত রেখে সাধারণভাবে গণতন্ত্রের এক ধরনের আভাসকে স্বীকার করে নেওয়া। আইনসভা হলো গণতন্ত্রকে বানচাল করা এবং সত্যিকারের সংগ্রামগুলোকে একটি নিরাপদ অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার একটি মাধ্যম। প্রত্যেকবারেই এটি শ্রমিক আন্দোলনের গোরস্থান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
গণতন্ত্রের সমস্যা
১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে কিছু মানুষ যে শাসন করার জন্যই জন্মায় এমনতর ধারণাটির বিলোপ সাধিত হয়। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন এবং শক্তিশালী রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। তার জায়গা দখল করে ‘মানুষ এবং নাগরিকের অধিকারসমূহের ঘোষণা’য় বর্ণিত আইনগত সাম্য এবং ব্যক্তি মানুষের কতিপয় অধিকার।
নতুন এই অধিকারগুলোর ভিত্তি রচিত হয়েছিল একটি বৃহৎ সামাজিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে। গ্রহণযোগ্যতা পাবার পর এই অধিকারগুলোই ছিল ফরাসি বিপ্লবের সত্যিকারের ছাপ। সে সময় থেকে উক্ত আইনসমূহ এবং আইন তৈরির প্রক্রিয়ার পুরোটাই ছিল সেই ‘সাধারণ ইচ্ছা’র বহিঃপ্রকাশ। বিষয়টি এমন যেন, কথিত ‘সাধারণ ইচ্ছা’ মাফিক সেই আইনগুলো অনুমোদিত বা বাতিল হয়ে যেতে পারে। সে সময়ের এই বৈশিষ্ট্যটিই তাকে অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আলাদা করে ফেলে।
ফরাসি বিপ্লবের সময়েও ‘সাধারণ ইচ্ছার’ ধারণাটি রাজনীতিতে নতুন ধারণা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তারপরেও ভবিষ্যতের জন্য এর প্রভাব নির্ণয় করা মোটেই কঠিন কোনো বিষয় ছিল না। ষাট বছর পূর্বের ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও ঠিক এই বিতর্কগুলোই সামনে এসেছিল। রাজতন্ত্রকে যদি বিদায় দেওয়া হয়, তবে কোন ধরণের সমাজ এর জায়গা দখল করবে? ঠিক কোন উপাদানগুলো নিয়ে ‘সাধারণ ইচ্ছা’ গঠিত হয়? এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কে বা কারা ‘সাধারণ ইচ্ছা’র আইন প্রয়োগ করবে?
পুৎনি বিতর্কের সময় রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে সিংহাসনচ্যুত করতে লড়াই করা শক্তিগুলোর মধ্যে ঠিক এই বিষয়গুলো নিয়েই তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা অলিভার ক্রমওয়েল এবং অন্যান্যরা একটি বিষয়ে একমত হয়েছিলেন যে, রাজাদের স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসান ঘটানো উচিত। কিন্তু তারা একইসাথে এটিও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, সমাজ পরিচালনার ভার কোনো একজন ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। একজন রাজার ক্ষমতা তার জন্মগত অধিকার বলে মনে করা হতো। কিন্তু রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় তারা একটি নতুন কাঠামোগত উপাধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন; পাছে সমাজের শাসমক্ষমতা সাধারণ মানুষের হস্তগত হয়ে যায়। সম্পদকেই হতে হতো সেই নতুন কাঠামোগত উপাধির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ক্রমওয়েলের সেনাপ্রধান (হেনরি আইরিটন – অনুবাদক) যেমনটা লিখেছেন:
আমার মতে, সাম্রাজ্যের স্থায়ী কোনো স্বার্থ জড়িত নেই এমন বিষয়গুলোতে কোনো ব্যক্তির সাম্রাজ্যের কোনো স্বার্থ ও সুবিধাদির ব্যাপারে মীমাংসা করার কোনো অধিকার নেই। ১
তবে রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করা অন্যান্য দলগুলো এই চিন্তাকে সমর্থন করে নি। গৃহযুদ্ধের ফলে অনেকগুলো দল-উপদলের সৃষ্টি হয়। লেভেলারদের মতো কিছু দল সে সময়ের বিদ্যমান সামাজিক শর্তসমূহ সম্পর্কে সচেতন ছিল। ডিগারদের মতো অন্য কিছু দল পতিত জমিগুলো দখল করে নেয় এবং সেগুলোতে গাছ রোপন করার পর সেই গাছগুলোর জন্য এবং সেখানে তাদের নিয়োগকৃত শ্রমশক্তির জন্য সেগুলোকে নিজেদের বলে দাবি করে। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিরুদ্ধে সংঘটিত সংগ্রাম এই দলাদলিকে ভেতর থেকে উসকিয়ে দেয়। সে দলগুলো ছিল কর্তৃত্ববাদবিরোধী এবং তারা বেশ কিছু বিষয়ে ক্রমওয়েল এবং তার অনুগামীদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করত। প্রখ্যাত লেভেলার থমাস রেইনসবোরঘ আইরিটনের বক্তব্য খন্ডন করেন এভাবে:
আমার মতে, ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দরিদ্রতম ব্যক্তিরটিরও সবচেয়ে বিত্তবান ব্যক্তির মতো যাপনযোগ্য একটি জীবন রয়েছে। এবং সে কারণে কোনো একটি সরকারের অধীনে বসবাস করতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তির সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো নিজেকেই সে সরকারের অধীনে পেশ করা। ২
কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত দেওয়ার অধিকার থাকবে, এমন একটি ধারণার কিছু বিপজ্জনক প্রভাব ছিল। এর ফলে ‘সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ’ এবং ধনীদের স্বার্থ সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল। আইরিটন আবারো বলেন:
কোনো একজন ব্যক্তির নিজস্ব সরকার নিজেই নির্ধারণ করার যে প্রাকৃতিক অধিকার রয়েছে বলে আপনি উল্লেখ করেছেন, সে অধিকার বলেই তার চোখের সামনে দৃশ্যমান যে-কোনো দ্রব্যসামগ্রীর উপর তার অধিকার বর্তায়। ৩
কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে ছিল ‘দ্রব্যসামগ্রী’। গৃহযুদ্ধকালীন ইংরেজ সমাজ ছিল বর্তমান সমাজের তুলনায় অনেক বেশি দরিদ্র। তবে সে সময়ের জনসংখ্যার অনুপাতে সেখানে তারপরেও প্রচুর পরিমাণে সম্পদ মজুত ছিল। সম্পদগুলো সমানভাবে বন্টিত হয় নি। কে কোন সম্পদের মালিকানা ভোগ করছে সে বিষয়ে বিরাট অসমতা বিরাজ করছিল। উইন্সট্যানলির মতো ডিগারদের জন্য এটিই ছিল বিক্ষোভের সবচেয়ে বড় কারণ। তিনি লিখেন:
… এবং গরীব মানুষেরা এই দাসত্ববন্ধনের ব্যাপারটিতেই অভিযোগ করে থাকে। তাদের ধনী ভ্রাতৃবৃন্দেরা সে সব জমি নিয়ে তাদেরকে দরিদ্র করে রেখেছে যেখানে সকলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত রয়েছে। ৪
সুতরাং, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধে রাজার শাসন বাতিল হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই অপর একটি অধিকতর একগুঁয়ে সমস্যার উৎপত্তি ঘটে। পুরোপুরি সমানাধিকার-কে স্বীকার করে নেওয়া হলে কি বিত্তবানদের সুবিধাভোগের অবসান ঘটবে না? যাইহোক, হাজার বছর আগে অ্যারিষ্টটল একটি জাজ্বল্যমান সত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, “বিত্তবানেরা সংখ্যালঘু এবং দরিদ্ররা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ।” যে-কোনো সরাসরি গণনা কিংবা গণভোটে অসংখ্য দরিদ্রের অগ্রাধিকারের সামনে কতিপয় বিত্তবানের স্বার্থ খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। ঠিক এভাবেই জন্ম নেয় ‘গণতন্ত্রের সমস্যা’।
এই সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে বিত্তবানেরা স্বাভাবিকভাবেই পেশিশক্তির ব্যবহার করেছিল। ডিগার এবং লেভেলারদের মতো গণতন্ত্রবাদীরা এই নিয়তি বরণ করেছিল যখন তাদেরকে সামরিক কায়দায় বিক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়েছিল। ক্রমওয়েল এবং আইরিটনের মতো ‘বিত্তায়িত’ ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল। তারা একটি নতুন আইনসভার মাধ্যমে শাসনকাজ পরিচালনা করেছিল এবং বিপুল পরিমাণে ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল। একই সময়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছিল দরিদ্ররা। ১৬৬০ সালে ইংল্যান্ডে ভ্রমণকালে একজন পর্যবেক্ষক লিখেছেন:
এই দ্বীপটি শাসিত হয় এমন সকল ব্যক্তির প্রভাবের ছায়ায়, যারা বাস করে প্রাচুর্যের মধ্যে। তাদের ভাড়াটিয়া এবং পরিচারকদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিশোধ করা ভাড়ার উপর তারা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করে। প্রত্যেকেই নিজেদের ভূ-সম্পদের সীমানার মধ্যে রাজপুত্রের মতো আচরণ করে। তারা সকলেই সেখানে পুরোপুরি সার্বভৌম। তাদের সেবায় নিয়োজিত পরিচারক এবং শ্রমিকেরা ছিল ক্রীতদাসের সমজাতীয়। তাদের ভাড়াটিয়ারা মূলত স্বাধীন হলেও তারা প্রজা শ্রেণির মধ্যে পড়ে। ৫
ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের মতো ফরাসি বিপ্লবও স্বল্প মেয়াদে সামাজিক গঠন প্রক্রিয়ার উপর সীমিত আকারের প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফরাসি রাজতন্ত্র মারাত্মকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছিল এবং ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এই বিপ্লবের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিল উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণি। বণিক এবং ব্যাংকারেরা ছিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। তারা বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় বেশকিছু ধারণা এবং বুদ্ধিবৃত্তির যোগান দিয়েছিল। বহুদিন ধরে তারা দুর্নীতিবাজ রাজার চাপিয়ে দেওয়া অন্যায্য করের বোঝা বহন করে যাচ্ছিল। ফরাসি বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে তাদের হাতে ক্ষমতার লাগাম চলে আসে। তারা আইনকে ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থানুযায়ী পরিবর্তিত করে ফেলে।
তবে ফরাসি বিপ্লব চূড়ান্তভাবে অন্যান্য বিপ্লব হতে আলাদাও ছিল। একটি দিক দিয়ে এর সামগ্রিক কিছু ফলাফল রয়েছে। প্রথমত, ‘এটিই হলো একমাত্র বিপ্লব যার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে একটি করে সামাজিক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল।’ ৬ জনগণই ছিল এই বিপ্লবের সফলতার প্রাথমিক চালিকাশক্তি। ক্ষমতার লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উপস্থিত থেকে তারা একে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এটি সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিপীড়িতদেরকে একসূত্রে বেঁধে ফেলেছিল। তবে এই বিপ্লব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাও দিয়েছিল। সেটি হলো, যখন উপরমহল থেকে সংস্কারকার্য ব্যর্থ হয়, তখন নিচে থেকে বিপ্লব উপকারী বলে বিবেচিত হতে পারে। অংশত এই বিপ্লবের ফল হিসেবে পুরো ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
ফরাসি বিপ্লব নির্দিষ্টভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় আরেকটি কারণে। এটি সংঘটিত হয়েছিল শিল্প বিপ্লবের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে। সার্বিকভাবে সমাজে সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আঠারো শতকের ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে আনুমানিকভাবে সম্পদের পরিমাণ পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। যন্ত্রপাতি এবং শ্রমশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে সম্পদের বৃদ্ধি খুব দ্রুতগতিতে ত্বরান্বিত হয়।
ইংল্যান্ডের উপযুক্ত পরিবেশে শিল্পবিপ্লব সূচিত হয়ে ইউরোপের অ-ইংরেজভাষী অঞ্চলগুলোতে তুলনামূলক দ্রুততার সাথে তা ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ‘ইউরোপের অ-ইংরেজভাষী অঞ্চলগুলোতে প্রকৃতঅর্থে শিল্প-কারখানার রূপান্তরের পরিমাণ ছিল অল্প। স্পেন, পর্তুগাল, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং পুরো বলকান উপদ্বীপজুড়ে একশ মাইলের কিছু বেশি রেললাইন দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল…।৭ কিন্তু ‘তারপরেও প্রকৃত উৎপাদন ও রপ্তানি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।’৮
এর অর্থ দাঁড়ায় ‘বিত্তবান এবং সুবিধাভোগীদের’ সম্পদ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বৃদ্ধির পরিমাণ কেমন ছিল তা প্রায়ই সঠিকভাবে বোঝা যায় না। ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম সেই সময়ের ব্রিটেনে রেলপথ নির্মাণের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমাদের সে সংক্রান্ত একটি ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। দুই দশকের ব্যবধানে কয়েক মাইল হতে (১৮২০ সালে) ৪,৫০০ মাইল (১৮৪০ সালে) এবং পরবর্তী সময়ে ২৩,৫৫০ মাইল (১৮৫০ সালে) রেলপথ নির্মিত হয়। তিনি এই বিশালাকার উদ্যোগের পেছনে লগ্নি করা অর্থের উৎসের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ’‘ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব চলাকালীন প্রথম কয়েকটি প্রজন্ম সম্পর্কে সবচেয়ে মৌলিক সত্যটি হলো তারা খুব দ্রুততার সাথে এতো বিপুল পরিমাণে অর্থ উপার্জন করেছিল যে সেগুলো ব্যয় এবং লগ্নি করার ক্ষেত্রে তা সম্ভাব্য সবধরণের অনুমানকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।৯ তারপর যখন ১৮৩৫-৩৭ সালে এবং ১৮৪৪-৪৭ সালে দুই দফায় কথিত ‘উন্মক্ত রেলশিল্প’ ইংল্যান্ডে আঘাত হানে, তখন ‘কল্পনাবিলাসী উন্মাদেরা’ রেলশিল্পের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগে মনোনিবেশ করে ।
উক্ত বাঞ্চনীয় পরিস্থিতি অসংখ্য শ্রমিক জনতার অবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। তাদের কাজ ছিল মূলত এই ধরণের উদ্যোগের পেছনে শ্রম ব্যয় করা। তাদের জন্য ‘অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নতুন রূপান্তর দুর্ভোগ এবং অসন্তোষের সৃষ্টি করে।’১০ বিত্তহীনেরা তাদের অবস্থার কারণে প্রলেতারিয়েত হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রলেতারিয়েতরা তাৎক্ষণিকভাবে নতুন ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে নি। ‘শ্রমিকদেরকে কারখানার উপযোগী পন্থায় কাজ করা শিখতে হয়েছিল। তাদেরকে অর্থনৈতিক প্ররোচনার প্রতি সংবেদনশীল হতেও শিখতে হয়েছিল।১১ শুরুর কয়েকটি প্রজন্মের শ্রমিকদেরকে নতুন ব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তারা এই ব্যবস্থা পছন্দও করে নি। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রতিরোধের খবর পাওয়া যায়।
হবসবম উল্লেখ করেন, ‘এই পরিস্থিতির সমাধান খোঁজা হয় শ্রমিকদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালনের মধ্যে। সর্বোপরি এমন একটি চর্চা শুরু হয় যেখানে শ্রমিকদের এতোই স্বল্প পরিমাণে মজুরি দেওয়া হয় যে তাদের কোনোমতে টিকে থাকার জন্য ন্যূনতম উপার্জন নিশ্চিত করতে ক্রমান্বয়ে পুরো সপ্তাহজুড়ে পরিশ্রম করতে হয়।’১২ তাতে করে কোনো একজন শ্রমিকের পুরো পরিবারকেই কাজ করতে হয়। ১৮৩৪-৩৯ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডের তুলা কারখানাগুলোতে সবগুলো শ্রমিকের মধ্যে ‘চারভাগের একভাগ ছিল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, অর্ধেকই ছিল নারী, বালিকা এবং আঠারো বছরের নীচে থাকা বালকেরা’১৩ ১৮৪০ সালের পশ্চিম ইউরোপে‘শিল্পায়নের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত সামাজিক সমস্যাসমূহ এবং বিপদজনক নগরায়নের দুঃস্বপ্নগুলো উপস্থিত ছিল ভয়াবহ মাত্রায়। সেগুলো মামুলি ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।’ ১৪
একটু আশ্চর্যের বিষয় হলো সে সময়ের ইউরোপ ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের দ্বারা প্রকম্পিত হয়েছিল। ইতালি, ফ্রান্স এবং হাঙ্গেরিতে উদারনীতিবাদীরা নিজেদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজপরিবারগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। ‘প্যারিস ও অন্যান্য ইউরোপীয় শহরের শ্রমিক’দের পক্ষ থেকে গুরুতর প্রকৃতির স্বাধীন দাবি-দাওয়া উঠতে থাকে। ‘সামাজিক বিপ্লব’ এবং ‘লাল প্রজাতন্ত্র’ এর জন্য তীব্র দাবি উঠতে থাকে। ‘তাদের এ জাতীয় দাবিগুলো সম্পত্তি এবং বাজারের নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে
থাকে।’ ১৫
একটি উপযুক্ত সমাধান
আদতে ১৮৫০ এর পর থেকেই সমাজে পুঞ্জিভূত হতে থাকে বিপুল সম্পদ। উত্থান ঘটে তুলনামূলক স্বাধীন ও বিকশিত শ্রমিক শ্রেণির। এমন প্রেক্ষাপটেই ধনী ও ক্ষমতাবানদের জন্য ‘গণতন্ত্রের সমস্যা’ খুব জরুরি হিসেবে দেখা দেয়। সাধারণভাবে পুরো সমাজ জুড়েই সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং একইসাথে বৃদ্ধি পাচ্ছিল নতুন কারখানা, খনি এবং জমির মালিকদের লোভ। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের সময় থেকে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ মানুষের বিরামহীন বিক্ষোভ প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। প্রশ্নটি হলো, এমন পরিস্থিতিতে কী করা যায়?
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে ‘ধনী ও সুবিধাভোগী’ শ্রেণির প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল তাদের সুবিধা এবং সম্পদ অব্যাহত রেখে সাধারণভাবে গণতন্ত্রের এক ধরনের আভাসকে স্বীকার করে নেওয়া। আইনসভা হলো গণতন্ত্রকে বানচাল করা এবং সত্যিকারের সংগ্রামগুলোকে একটি নিরাপদ অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার একটি মাধ্যম। প্রত্যেকবারেই এটি শ্রমিক আন্দোলনের গোরস্থান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
উক্ত বিষয়টি নিয়ে সে সময় থেকেই ‘ধনী ও সুবিধাভোগীদের’ কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি হয়। একদিকে ওজোন সম্প্রদায়, যাদের মুখপাত্র থমাস বেবিংটন ম্যাকৌলি বিশ্বাস করতেন, ‘মানবসম্প্রদায়ের মধ্যে উঁচু ও মধ্যম সারির লোকেরা প্রাকৃতিকভাবেই পুরো মানবজাতির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।১৬ তিনি দরিদ্র ও বিত্তহীনদেরকে ভোটাধিকার প্রদানের বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। ১৮৩০ এর দশকে চার্টিস্ট আন্দোলনের উত্থানের সাথে সাথে ব্রিটেনে এই বিতর্কটি ইতিমধ্যেই সামনে চলে আসে। এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কোবেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তার মতে, মানুষ ভোটাধিকার চেয়েছিল ‘যাতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়, যাতে কিছুটা সুফল পাওয়া যায়। এবং তা কোনো বিমূর্ত খেয়ালের পরিতৃপ্তি সাধনের জন্য নয়।১৭ ম্যাকৌলি এই প্রসঙ্গে বৈশ্বিক ভোটাধিকারের ধারণাকে আক্রমণ করেছেন। তার মতে, এর ফলস্বরূপ ‘বিত্তবানেরা ‘লুন্ঠিত’ হতে পারে… তাতে করে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এবং মানুষ বর্বরতার দিকে ফিরে যেতে পারে।’১৮
অন্যেরা অবশ্য এতোটা অনুভূতিহীন ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত দার্শনিক জে. এস. মিল ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সময় যে পাল্টে গেছে, তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। তিনি লিখেন, ‘অশিক্ষিতেরা শিক্ষিতদের উপর আস্থা রাখে।১৯ এমন একটি সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। তার পরিবর্তে এমন একটি সময় এসেছে যখন ‘জনগণ দিশাহীন অবস্থায় রয়েছে এবং সমাজ সবরকমের ভূল-ত্রুটি এবং সমূহ বিপদের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।২০ আলোচ্য বিপদসমূহের মধ্যে একটি ছিল সামাজিক বিপ্লব। মিল ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে কিছু একটা করার দরকার। তবে তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘুরে যাবে না।
তিনি নিজে কোনো বিভ্রমের মধ্যেও ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণের অজ্ঞতা বিশেষত তাদের স্বার্থপরতা এবং বর্বরতার ব্যাপারে আতঙ্কিত।২১ তার চোখে নিম্নবর্গ ছিল ‘নির্বোধ অজ্ঞ জনসমষ্টি’, ‘গড়পড়তা জনতার পাল’ অথবা ‘অসভ্যের দল’।২২ বিপরীতে তিনি নিজেকে এবং তার অনুসারীদেরকে ভাবতেন ‘বুদ্ধিমান শ্রেণি যারা শিক্ষার চর্চা করবে এবং তার সুফল ছড়িয়ে দেবে পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে।২৩ এই ধরণের সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল পরিষ্কার। তিনি বলেন: ‘তুলনামূলক উচ্চশিক্ষিত একজন বা কতিপয় ব্যক্তির প্রভাব এবং পরামর্শ সভা ব্যতীত গড়পড়তাদের মধ্যে থেকে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হতে পারে না।২৪ বিকল্প হিসেবে তিনি ‘গড়পড়তা জনতার পাল’ সম্পর্কে যে অর্থপূর্ণ বয়ান দেন তা বোধগম্য ছিল না। তার মতে: ‘দেশের সংবিধান যদি অজ্ঞতাকে সচেতনতার মতো রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে তা উপকারী নয় বরং ক্ষতিকর।২৫ মিলের মতে এমনতর সমস্যার একটি উপযুক্ত সমাধান হলো: ‘বুদ্ধিজীবী শ্রেণিগুলোর উচিত সরকারকে পরিচালিত করা এবং সরকারের উচিত বেকুব শ্রেণিগুলোকে পরিচালিত করা।২৬
সময়ের সাথে সাথে সবখানেই যা সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কার্যপ্রণালিতে পরিণত হবে, ১৮৫০ এর দশকে তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকরী ছিল না। ‘উঁচু এবং মধ্যম সারির লোকেরা’ প্রাকৃতিকভাবেই সংখ্যার লড়াইয়ে (“বিত্তবানেরা সংখ্যালঘু এবং দরিদ্ররা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ”) ‘বর্বর জনতার’ তুলনায় অসুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। উক্ত পরিস্থিতি আলোচ্য সমস্যার একটি অংশ ছিল। সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাটি ছিল ভোটাধিকার এবং এ সংক্রান্ত আরো বেশ কিছু বিষয়ে ধনী এবং দরিদ্রদের মধ্যে বিদ্যমান প্রত্যাশার ভিন্নতা।
এ সংক্রান্ত আলাপে মিল আরো একবার পরিষ্কার ছিলেন। তার মতে, গণতন্ত্র এমন নয় যে ‘জনগণ নিজেরাই নিজেদের শাসন করে। বরং তারা একটি ভাল সরকারের নিশ্চয়তা পায়।’ তার চোখে সেই ‘ভাল সরকার’ ইতিমধ্যেই বিদ্যমান ছিল। আইনসভা ছিল সেই ‘ভাল সরকার’ এর নমুনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইউরোপের অবস্থা কেমন ছিল সে সম্পর্কে হবসবম লিপিবদ্ধ করেছেন:
রাশিয়া ব্যতীত গুণগতভাবে ইউরোপের সবগুলো দেশেই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঐতিহ্য কায়েম হয়ে গিয়েছিল। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঐতিহ্যগতভাবে সম্ভ্রান্ত শ্রেণির ক্ষমতা পুরোপুরি অবিতর্কিত না হলেও নিরাপদেই ছিল। কারণ নির্বাহী বিভাগের উপর আইনসভার ক্ষমতা ছিল নামেমাত্র। তাতে করে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে আইনসভার দূর্বল প্রভাব বিদ্যমান ছিল।’২৭
আইনসভা সম্পর্কে এসব খোলাখুলি সত্য ঘটনা এবং তার অসঙ্গতি সে সময়ের মানুষজনের নিকট পরিষ্কার ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আইনসভায় যারা যোগ দিতেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ছিলেন ইউরোপজুড়ে ক্ষমতাসীন সম্ভ্রান্ত শ্রেণির নিয়োগপ্রাপ্ত লোকজন। তারা ছিলেন বিত্তবান শ্রেণিগুলোর বিভিন্ন কিসিমের ওয়ারিশ, ব্যবসায়ী, আইনজীবী এবং আরো বিভিন্ন পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন। এমনতর গণতন্ত্রের চিন্তা অন্তত ‘বেকুব শ্রেণির’ মানুষদের মাথায় ছিল না। বিপরীতে ‘জনগণের দ্বারা শাসন’ বলতে উপরোক্ত পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা-ই বুঝতে হবে, এমন চিন্তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ঠিক সে কারণেই ইতিহাসের সে নির্দিষ্ট সময়জুড়ে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির এমনতর বিপজ্জনক সংজ্ঞায়ন চালু ছিল।
মিল এবং অন্যান্যরা ধনী ও গরীবদের মাঝে গণতন্ত্র সম্পর্কে ‘বোঝাপড়ার’ যে পার্থক্য রয়েছে, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। এটি ছিল একটি প্রধান সমস্যা। এক অর্থে ‘শাসনের ঐতিহ্য’ বা ‘শাসক এবং শাসিতের বোঝাপড়ার সাধারণ ক্ষেত্র’ বলে কিছু ছিল না যেখানে দুই পক্ষই তাদের নিজেদের অবস্থান এবং নিয়তি সম্পর্কে অবগত থাকবে। এই ধরণের ঐতিহ্য চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ভোটাভুটির প্রক্রিয়াটি ঠেকিয়ে রাখা বা তাকে অকার্যকর করে ফেলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
‘গুণসম্পন্ন ভোটের’ মাধ্যমে উক্ত উদ্দেশ্য সাধন করা হয়েছিল। যদিও তার পূর্বেই ‘ভরযুক্ত ভোটের’ ধারণা দিয়ে তারা হাত মশকো করেছিল। মিলের উদ্ভাবিত এই ধারণাটি ছিল অভিনব।
যদি কোনো সাধারণ অদক্ষ শ্রমিক একটি ভোট দিতে পায়, তাহলে একজন দক্ষ শ্রমিকের দুইটি ভোট থাকা উচিত। স্থানীয় কোনো মোড়ল-মাতবরের থাকা উচিত তিনটি ভোট। কারণ হিসেবে বলা যায়, তার পেশা তার কাছে থেকে সাধারণ সংস্কৃতির চেয়ে বেশি কিছু দাবি করে। এছাড়াও তার কিছু নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুণ থাকার প্রয়োজন হয়। একজন কৃষক, নির্মাণকর্মী অথবা ব্যবসায়ীর তিনটি বা চারটি করে ভোট থাকা উচিত। নিয়মতান্ত্রিক মানসিক সংস্কৃতির প্রয়োজন হয় এমন যে-কোনো পেশার ব্যক্তির জন্য পাঁচটি বা ছয়টি করে ভোট বরাদ্দ থাকা উচিত। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের জন্যেও কমপক্ষে একই পরিমাণে ভোট বরাদ্দ থাকতে
হবে। ২৮
উক্ত উপায়ে বিত্তবানদের সংখ্যাবাচক অসুবিধার নিরসন করা যায়; অন্তত যতদিন পর্যন্ত না দরিদ্রেরা তাদের নিয়তিকে স্বীকার করে নিচ্ছে।
কিন্তু এমনটা হওয়ার ছিল না। ‘গুণসম্পন্ন ভোট’ ছিল অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। শিক্ষাগত যোগ্যতা, সম্পদের পরিমাণ, ধর্ম, জাতি, চামড়ার রঙ, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদি মনগড়া পার্থক্যের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকারকে সংকুচিত করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া চলেছিল যতদিন পর্যন্ত না জনগণ যথাযথভাবে ‘পরিপক্বতা’ অর্জন করেছিল। ১৮৬৪ সালে ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪% ভোটাধিকার ভোগ করত। সে সময়ে ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকের হার ৪% থেকে ৮% এ নিয়ে যাওয়া যায় কিনা এমন একটি বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। এই বিতর্কের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন ‘পরিপক্কতা’ বলতে কী বোঝানো হয় তার বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। গ্ল্যাডস্টোনের মতে, ভোটারকে হতে হবে এমন একজন ব্যক্তি যার থাকবে ‘আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, সংযম, শৃঙ্খলার প্রতি সম্মান, দুর্ভোগের মধ্যে সহনশীলতা, আইনের প্রতি আত্মবিশ্বাস এবং ঊর্দ্ধতনের প্রতি সমীহ।’২৯
১৮৫০ থেকে ১৯৫০ সালের এক শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে মূলধারার আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। পূর্বে এইসব দেশগুলোতে মোট জনসংখ্যার ১-৫% পূর্ণবয়ষ্ক ব্যক্তির ভোটে নির্বাচিত সংসদ বা আইনসভা থেকে পরবর্তী সময়ে প্রায় ১০০% পূর্ণবয়ষ্ক জনগণের অংশগ্রহণের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা এবং চলমান তীব্র অসাম্যকে আমলে নিয়েও পরিবর্তনের এই ধীর গতি মূলত শাসকশ্রেণি (‘ধনী ও সুবিধাভোগী’ শ্রেণি) এবং শাসিতশ্রেণির (শ্রমিকশ্রেণি) মধ্যে ‘শাসনের ঐতিহ্য’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সার্বিক সমস্যাগুলোকেই তুলে ধরে। দমন-পীড়নের গতানুগতিক তরিকা বাদ দিয়েও এবং ধীরগতিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ব্যাপকভাবে সফল এই প্রক্রিয়াটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভর করেছিল:
১) একটি অনুবর্তী সংসদীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্থান।
২) শুরু থেকেই ‘ধনী ও সুবিধাভোগী’ শ্রেণির সুযোগ-সুবিধা ও স্বার্থের সেবক হিসেবে গণমাধ্যমের বিকাশ ও প্রভাব।
(চলবে)
তথ্যপঞ্জি
১ S. Bowles and H. Gintis, Democracy and Capitalism (Routledge Keegan Paul, 1986), p28.
২ ibid., p28.
৩ibid., p28.
৪ A. Arblaster, The Rise And Decline Of Western Liberalism (Basil Blackwell, 1984), p160.
৫ ibid., p160.
৬ E. Hobsbawm, The Age Of Revolution (Mentor, 1962), p54.
৭ ibid., p168.
৮ ibid., p42.
৯ ibid., p45.
১০ ibid., p38.
১১ ibid., p49.
১২ ibid., p49.
১৩ ibid., p49.
১৪ ibid., p173
১৫ A. Arblaster, op. cit., p267.
১৬ ibid., p265.
১৭ ibid., p264.
১৮ ibid., p265.
১৯ ibid., p278.
২০ ibid., p278.
২১ ibid., p279.
২২ ibid., p280.
২৩ ibid., p279.
২৪ ibid., p279.
২৫ ibid., p280.
২৬ ibid., p278.
২৭ E. Hobsbawm, The Age of Capital (Mentor, 1975), p102.
২৮ Norman Wintrop ed., Liberal Democratic Theory and Its Critics, (Croom Helm, 1983) p33.
২৯ A. Arblaster, op. cit., p273.