অরাজ
পেইন্টিং: লির্বাটি লিডিং দ্য পিপল শিল্পী : ইউজিন ডিলাক্রইক্স সূত্র: উইকিপিডিয়া
প্রচ্ছদ » কর্তৃত্ব-বিরোধী ইশতেহার : মূল প্রস্তাব

কর্তৃত্ব-বিরোধী ইশতেহার : মূল প্রস্তাব

  • আরিফ রেজা মাহমুদ
পেইন্টিং: গুয়ের্নিকা ?
শিল্পী: লুকা গারোনজি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

মানবপ্রকৃতি: অস্তিত্বের শেকড় ও অখণ্ডতার সূত্র

স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের আত্মশক্তির বীজ। স্বাধীনতাই মানবীয় সৃজনশীলতার ধাত্রী। সংহতি এই স্বাধীনতার অস্তিত্বের শর্ত—স্বাধীনতার ধারক। স্বাধীনতা-সংহতি-সৃজনশীলতা হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবণতা। মানবপ্রকৃতির জ্ঞানধারা নির্মিত হয়েছে মূলত এই উপলব্ধিকে আধার করে।

একজন মানুষ যখন তার স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেয়, তখন সে তার অনিবার্য  মনুষ্যত্বকেই বিসর্জন দেয়। সে বিসর্জন দেয় তার সকল অধিকারকে। সে বিসর্জন দেয় নিজের মানুষ হওয়ার দায়িত্বকে। একটা মনুষ্যত্বহীন প্রাণীতেই তখন সে পর্যবসিত হয়। এমন সর্বস্বত্ব ত্যাগের আর কোনো খেসারত হতে পারে না। অপর কিছুতেই এর কোনো পূরণ ঘটে না। মানুষের মনুষ্যপ্রকৃতির সঙ্গে এ সঙ্গতিহীন। আর একজন মানুষকে যখন তুমি তার ইচ্ছা বিবর্জিত প্রাণীতে পর্যবসিত কর, তখন তুমি তার ক্রিয়াকর্মকেই নৈতিকতাশূন্য কর্মে পর্যবসিত কর।

স্বাধীনতার বিধি হচ্ছে: আত্ম অস্তিত্ব সংরক্ষণ। এর প্রধান বিবেচ্য নিজের স্বার্থকে রক্ষা করা। যে মুহূর্তে ব্যক্তি যুক্তির বয়স অর্জন করে, সে মুহূর্তে সে নিজের প্রভুতে পরিণত হয়। কারণ তার অস্তিত্বের সর্বোত্তম নিশ্চয়তা কিসে, এখন সে নিজেই তার নির্ধারক। নিজ অস্তিত্ব সংরক্ষণে নিজেই নিজের নির্ধারক হওয়ার অধিকারই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচার নয়। নিজকে দিয়ে অন্যের বিষয়ে যা ইচ্ছে তাই করানোর অধিকার নয়। বরং স্বাধীনতা হচ্ছে নিজ বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেবার তথা নিজ দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেবার অধিকার। সুতরাং স্বাধীনতা যেন স্বেচ্ছাচার না হয় তার জন্য পরস্পরের স্বাধীনতার প্রতি পরস্পরের সম্মতি প্রয়োজন।

প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ব্যক্তির স্বাধীনতার নিশ্চয়তাই হচ্ছে সামগ্রিক সমাজের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা তখনই নিশ্চিত হয় যখন মানুষ অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে না। সংহতি মানুষের এই স্বাধীনতাকে রক্ষণ করে। সংহতি হচ্ছে মানুষের সেই প্রবৃত্তি যা মানুষকে শুধু যুথবদ্ধই করে না বরং পরস্পরের স্বাধীনতার প্রতি পরস্পরের সম্মতি ও দায়কে ধারণ করে। সংহতি হচ্ছে স্বাধীনতার ঐক্যতান।

সৃজনীশক্তি মানুষকে জীবজগতে অনন্য করে তোলে। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর এই বিশেষত্ব নেই। ভাষাতত্ত্বে বিপ্লব সৃষ্টিকারী জেনারেটিভ গ্রামারের উদ্ভাবক নোম চমস্কি তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় যে লক্ষ্যণীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা হলো: মানুষ সহজাত ভাবসম্পন্ন। চমস্কি যুক্তি দেখান যে, ভাষার ব্যাকরণ কাঠামোর অন্তর্নিবিষ্ট রূপগত বিধান বুঝতে পারার ক্ষমতা মানুষের সহজাত। প্রজাতিগতভাবেই মানুষ এই বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে। খুব অল্প বয়সেই শিশুরা বড়দের কথাবার্তা শুনে ব্যকরণের জটিল বিধানগুলো আয়ত্ত করে ফেলে। একজন শিশু পরবর্তীতে এই বিধানগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে খুব নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দ দিয়েই অসংখ্য বাক্য সে প্রণয়ন করতে থাকে। এই বাক্যগুলো অশ্রুত অর্থাৎ নতুন। তাই ব্যকরণের অন্তর্নিহিত বিধান চিনতে পারার সক্ষমতা এবং অসংখ্য বাক্য উৎপাদনের এই সহজাত ক্ষমতাকে সৃজনশীলতা বলে আখ্যায়িত করা যায়। চমস্কি এ প্রসঙ্গে বলেন,

যে কেউ ভাষা অধ্যয়নে আগ্রহী হলে অনিবার্যভাবে একটা বাস্তব সঙ্কটের মুখোমুখি হন। তিনি একটা পূর্ণবিকশিত প্রাণীসত্তা, কিংবা বলা যায় পরিণত বক্তার মুখোমুখি হন, যে-বক্তা কোনো-না-কোনোভাবে বিস্ময়কর মাত্রার সক্ষমতা অর্জন করেছেন। এই সক্ষমতা তাকে, বিশেষত, যেটা বুঝাতে চান, ঠিকঠাক সেটা বলতে এবং অন্য মানুষজন কী বলছে সেটা বুঝতে সক্ষম করে তোলে। তাছাড়াও, তিনি এগুলো এমন পারঙ্গমতায় সম্পাদন করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন যাকে আমার মতে অন্তত সৃজনশীল বলাই শ্রেয়… বলা চলে, অন্য যে কারো সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতায় একজন ব্যক্তি যা কিছু বলেন তার বেশিরভাগটাই অভিনব; আপনি যা শোনেন তার বেশিরভাগটাই নতুন, আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতার কোনোকিছুর সাথে এগুলোর নিবিড় সাদৃশ্য থাকে না। এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো অভিনব আচরণ নয়, এগুলো এমন ধরণের আচরণ যা যথাযথরূপে পরিস্থিতিমাফিক। কিছুদিক বিবেচনায় এধরণের আচরণ সংজ্ঞায়িত করা অত্যন্ত দুরূহ এবং সত্যিকারার্থে এসব আচরণের ভিতর এমন অনেক বৈশিষ্ট্য জাহের থাকে যাকে সৃজনশীলতা বলাই যায়।

মানববিদ্যার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও মানুষের সহজাত সৃজনশীলতার প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে চমস্কি অনুমান করেন।

সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা। বাস্তব ক্ষেত্রে মানুষ কোনো কর্ম করে যে-প্রক্রিয়ায় সফল হয় তা তার অভিজ্ঞতা তথা জ্ঞান হিসেবে সঞ্চিত থাকে। আগে যেভাবে সফল হওয়া গিয়েছিল পরবর্তীতে ঠিক একই কায়দায় সফল হতে হবে —এমন রীতি, জ্ঞান উৎপাদনে শৃঙ্খল সূচনা করে। একই কর্মের পুনঃ পুনঃ আবর্তন জ্ঞানকে রুদ্ধ করে ফেলে। কেননা জ্ঞান উৎপাদনে শৃঙ্খল-সূচনা পরীক্ষণকে নিষিদ্ধ করে ফেলে। ফলে নতুনের সৃষ্টি হয় না। সৃজনশীলতাও রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই সৃজনশীলতার জন্য স্বাধীনতা অনিবার্য।

আবার সংহতির মধ্যেই সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। সংহতিপরায়ণ মানবগোষ্ঠীতে শৃঙ্খল বা পরস্পরিক হানাহানি থাকে না বলে মানুষ স্বাধীনচেতা ও স্বকীয় হতে পারে।  সংহতির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার চর্চা মানুষকে শিষ্ঠতা ও শান্তি দেয়। ফলে এই প্রতিবেশের মধ্যে মানুষের সৃজনশীলতার বিকাশ অনুকূল হয়ে দাঁড়ায়।

মানুষের এই সংহতি চর্চা প্রাকৃতিকও বটে। প্রকৃতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার নানান ধরনের উপাদানের মধ্যে সংহতি তথা পারস্পরিক সহযোগিতা। প্রকৃতির এই সংহতি তার বিবর্তনের একটা বিশিষ্ট কারণ। জৈব সম্পর্কের সংহতি চর্চার মধ্য দিয়েই প্রকৃতিতে উৎপাদন-পুনরুৎপাদন সংগঠিত হয়। এই উৎপাদন-পুনরুৎপাদন সৃজনশীলতাকেই প্রতীকায়িত করে। এই সৃজনশীলতার কারণেই প্রকৃতি তার জৈব সম্পর্কের বিন্যাসের বিবর্তন ঘটায় এবং মানুষসহ অন্যান্য জীব জীবনের উচ্চতর বিকাশের পথে ধাবিত হয়।

স্বাধীনতা-সংহতি-সৃজনশীলতা অখণ্ডতার সূত্রে বাঁধা, মনুষ্যপ্রকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। মানুষের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত এই বৈশিষ্ট্যই স্বয়ম্ভর ও বিশুদ্ধ। মানুষের স্বাধীনতা-সংহতি-সৃজনশীলতার এই স্বয়ম্ভর ও বিশুদ্ধ বিকাশের মধ্যেই মনুষ্যত্বের নিয়ম তথা বিধি-বন্দোবস্ত নিহিত থাকে।

কিন্তু কর্তৃত্ব মানুষের সহজাত প্রবণতাকে রুদ্ধ করে। মানবপ্রকৃতির স্বাভাবিক বিশুদ্ধিকে বিকশিত হতে বাধা প্রদান করে। মানুষের স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করার মাধ্যমে মানুষকে দাস বানায়। মানুষের মধ্যে উঁচ-নিচ ভেদাভেদ তৈরি করে মানুষের সমতাকে নষ্ট করে। মানুষের সংহতিপরায়ণতাকে ভেঙ্গে ফেলে মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।

মিখাইল বাকুনিন
(১৮১৪-১৮৭৬)
সূত্র: উইকিপিডিয়া

কর্তৃত্ব: অস্তিত্বের বুকে ছুরি, মনুষ্যগহনে রক্তক্ষরণ 

কর্তৃত্ব কী? এটা কি প্রকৃতির নিয়মের কোনো অবিসম্ভাবী ক্ষমতা? যা নিজকে প্রাকৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের প্রপঞ্চগুলোর প্রয়োজনীয় সংযোগ ও পরম্পরাগুলোকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে? এই নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুধু নিষিদ্ধই নয়, অসম্ভবও বটে। আমরা এগুলোকে ভুল বুঝতে পারি, এগুলো সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না হতে পারি কিন্তু আমরা এগুলোকে অস্বীকার করতে পারি না। কারণ এগুলো আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি ও মৌলিক শর্ত নির্মাণ করে। এগুলো আমাদেরকে আবৃত করে, পূর্ণ করে তোলে এবং আমাদের সকল চিন্তা ও কাজের গতিবিধি পরিচালনা করে। এমনকি আমরা যখন মনে করি আমরা এগুলোকে অস্বীকার করছি তখন আমরা এগুলোকে শুধু রোষই দেখাই।

হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই এই নিয়মগুলোর দাস। কিন্তু এ ধরনের দাসত্বের মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। কিংবা এটা আদতে দাসত্বই নয়। দাসত্বের ক্ষেত্রে যেখানে ব্যক্তির বাইরের একজন প্রভু বা আইন বিধায়ক ব্যক্তিকে হুকুম দেয়, সেখানে এই নিয়মগুলো আমাদের বাইরে নয়। এগুলো আমাদের মধ্যেই নিহিত থাকে এবং আমাদেরকে নির্মাণ করে। আমাদের সামগ্রিক নির্মিতি– শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক এগুলো সবই এর মাধ্যমে সংগঠিত হয়। আমাদের বাঁচা, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা, আমাদের আকাঙ্ক্ষা সবকিছুই এই নিয়ম অনুসারে সংগঠিত হয়। এগুলো ছাড়া আমরা কিছুই না– আমাদের কোনো অস্তিত্বই নেই।

প্রকৃতির নিয়মগুলো আমাদের অস্তিত্ব। এগুলোকে কোনোভাবেই কর্তৃত্ব বলে চিহ্নিত করা যায় না। কর্তৃত্ব মানে কর্তাগিরি। কর্তৃত্ব হচ্ছে সহজ কথায় শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র ‌‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ সাধিত হওয়া। অর্থাৎ যখন কর্তার খেয়াল খুশি মোতাবেক কাজ করা হয়, যাতে অন্য কারো কিছু বলার বা করার থাকে না, তখন তাকে কর্তৃত্ব বলা হয়। সুতরাং কর্তা হওয়া এবং অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর বা সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা দেয়াই হচ্ছে কর্তৃত্ব। কিন্তু এই মাফিক কর্তা কে? আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী, ‘যে করে’ সে? ‘কারক’? না… আসলে কর্তা হচ্ছে:  কোনো ব্যক্তির বাইরের শক্তি যা ঐ ব্যক্তির ইচ্ছার তোয়াক্কা না করেই ব্যক্তির উপর বল বা শক্তি প্রয়োগ করে। সুতরাং কর্তৃত্ব হচ্ছে একটা সম্পর্ক যেখানে কর্তা ও উদ্দিষ্ট থাকে এবং কর্তা উদ্দিষ্টের উপর বল বা শক্তি প্রয়োগ করে। কর্তৃত্ব বলতে আমি শক্তিমানের বলপ্রয়োগকেই বুঝি।

আবার কর্তৃত্বের সাথে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক আছে। কর্তৃত্ব যদি ‘শর্ত’ বা ‘সূত্র’ সাপেক্ষ হয় অর্থাৎ চুক্তির বাঁধনে বাধা পড়ে এবং চুক্তির উপর ছদ্ম-সম্মতি প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই আমরা তাকে ক্ষমতা বলতে পারি। সুতরাং ক্ষমতা নিজেও হচ্ছে এক ধরণের সম্পর্ক। ক্ষমতা সম্পর্ক হচ্ছে বল প্রয়োগের ‘স্বীকৃত’ ‘শর্ত’ বা ‘সূত্র’ যা ছদ্ম-সম্মতির দ্বারা বৈধ বলে বিবেচিত হয় এবং সামাজিক সম্পর্কের যুথবদ্ধতার সূত্রকে ভেঙ্গে কর্তৃত্ব কায়েম করে। এই কর্তৃত্ব আরোপণ যখন একমুখী হয়ে পড়ে তখন তাকে বলা হয় অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক। এই অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক মূর্ত হয়ে ওঠে প্রধানত চারটি বিষয়ের মাধ্যমে। এই চারটি বিষয় হচ্ছে:

১. ভূমির অসম মালিকানা
২. শ্রমের উদ্বৃত্ত শোষণ
৩. দেহগত ও লৈঙ্গিক আধিপত্য
৪. ভাষা-সংস্কৃতি-জ্ঞানগত আধিপত্য

রাষ্ট্র এই অসম ক্ষমতা সম্পর্কের রক্ষক।

রাষ্ট্র: জল্লাদের দরবার, জুলুমের কসাইখানা

বলাবাহুল্য রাষ্ট্র নিজেই একটা ক্ষমতাকাঠামো কর্তৃত্বের চরম সংস্থা। জনগণের প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র। কাজেই রাষ্ট্র মানেই সকল বিষয়ে মাতবরি– সকল বিষয়ে কর্তাগিরি-হুকুমদারি।

‘আধুনিক’ রাষ্ট্র হচ্ছে এলিটদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ম্যানেজারিয়েল সিস্টেম। এলিটদের স্বার্থ রক্ষাকারী সাধারণ কাজকর্ম ব্যবস্থাপনার কমিটি হচ্ছে এই রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নামক এই কমিটির কাজ এলিটদের নিজেদের মধ্যেকার বিরোধ মীমাংসা করা, ছোট লোকদের শোষণ করে বড় লোকদের ধন-সম্পত্তি পাহারা দেয়া, মৌলিক অর্থে ‘প্রতিপক্ষ’ শ্রেণী-গোষ্ঠী-দল-শক্তিকে ধ্বংস করা ইত্যাদি। এলিটদের শাসকশোষকদের তৈরি করা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ‘সমন্বয়’ সাধন করা এই কমিটির আর একটা কাজ। এইসব ‘ফরজ’ কর্মসম্পাদনের জন্য এই কমিটির হাতে থাকে আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিচার বিভাগ বা আইনগত প্রতিষ্ঠানসমূহ, উর্দি বিভাগ বা পুলিশ-সেনা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া বা মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।

কর্তৃত্ব যে চারটি বিষয়ের মধ্য দিয়ে প্রধানত মূর্ত হয়ে ওঠে তার নিরাপত্তাদাতা হচ্ছে রাষ্ট্র। প্রকৃতির প্রতিকুলতার সামনে উৎপাদনের উপায়ের সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের চাহিদার বিপরীতে সম্পদ সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে এই সীমিত সম্পদের উপর প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। এই প্রতিযোগিতাই জৈব-সংহতির সূত্রকে ভেঙ্গে  যুথবদ্ধতাকে বিপন্ন করে বলপ্রয়োগকেই নীতি হিসেবে বেছে নিতে ‘বাধ্য’ করে। বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই কিছু লোক ভূমির মালিক হয়ে ওঠে এবং সেই ভূমির মালিকানাকে সংরক্ষণ করতে পাহারাদারির তথা বলপ্রয়োগের সংস্থা গড়ে তোলে। রাষ্ট্র সেই সংস্থারই বিকশিত রূপ। রাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবেই ভূমির অসম মালিকানাকে আইনগতভাবে রক্ষণ করে।

শ্রম হচ্ছে উৎপাদনের প্রধান উপায়। উৎপাদনের কাঁচামালে শ্রম প্রযুক্ত হলেই কেবল তা পণ্য হয়ে ওঠে। পণ্য উৎপাদনের জন্য শ্রমের যে মূল্য নির্ধারিত হয় এবং পণ্যের যে মূল্য নির্ধারিত হয় তার ব্যবধানই শ্রমের উদ্বৃত্ত শোষণ। শ্রমের উদ্বৃত্ত শোষণের মধ্য দিয়েই পুঁজি বৃহৎ থেকে বৃহত্তর আকার ধারণ করে। অপরদিকে শ্রমের যোগানদাতা শ্রমিক শুধুমাত্র ততটুকুই পায় যতোটুকু পরবর্তীতে শ্রম প্রদানের জন্য তার জৈবিক শক্তির যোগান হিসেবে প্রয়োজন। শ্রমের উদ্বৃত্ত শোষণের মধ্য দিয়েই, যে-পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে রাষ্ট্র তার আইনগত ম্যানেজারিয়াল কমিটি হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে।

মানুষের জৈব-বিবর্তনের সূত্রে সংহতি থেকে ছেদ এবং জৈব-বলপ্রয়োগের সূচনার মধ্য দিয়েই দেহ ও লৈঙ্গিক আধিপত্যের সৃষ্টি। জৈব-বলপ্রয়োগে শক্তিমান সত্তা হিসেবে পুরুষের উত্থান নারীকে করে অবদমিত। সম্পদ-উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য পুরুষের বীজ-বিশুদ্ধতার নিশ্চিতির উপর ভিত্তি করেই সমাজে ক্রমাগতভাবে পুরুষের লৈঙ্গিক আধিপত্য কায়েম হতে থাকে। সম্পদ-উত্তরাধিকার-বীজ বিশুদ্ধির রক্ষাকর্তা-বিধানদাতা হিসেবে রাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবেই সর্বদা হাজির থেকেছে। বর্তমানে ভুঁইফোঁড় আইনের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সমতার প্রশ্নটিকে রাষ্ট্র মীমাংসা করতে চাইলেও নারী পুরুষের মধ্যে  সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যেকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সেই সবচেয়ে বড় ক্ষত্রশক্তি।

রাষ্ট্রের ক্ষমতা শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে টিকে থাকে না। এই ক্ষমতা টিকে থাকার জন্য জনগণের সম্মতি উৎপাদনের প্রয়োজন হয়। এই সম্মতি উৎপাদনের জন্য রাষ্ট্র ও অপরাপর ক্ষমতাশক্তি মতাদর্শিক প্রচার-প্রচারণার সিস্টেম তৈরি করে। এর মাধ্যমে ক্ষমতার আকাম-কুকামকে বৈধ করে তোলা হয়। মিডিয়া হচ্ছে প্রচার-প্রচারণা সিস্টেমের প্রধান ক্ষত্রশক্তি। একটি যুগের ভাষিক অর্থ চর্চা এবং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি নির্মাণ করে মিডিয়া। ক্ষমতা-তাড়িত মিডিয়ার এই ভাষিক অর্থ চর্চা এবং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি নির্মিত হয় ক্ষমতারই অনুগামী হয়ে। ক্ষমতা-সম্পর্কের শক্তিধর প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র এর প্রধান সুবিধাভোগী এবং এই কারণে রক্ষকও বটে।

সামাজিক চুক্তি-রাষ্ট্র-রাজনৈতিক দল: ‘জনশক্তি’র মিথ ও আত্মাহীন ক্ষমতার রক্ত-পিপাসা

আমাদের এমন একটা সংস্থা তৈরি করতে হবে যার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্ব ও সম্পদকে রক্ষার জন্য সমগ্র সংস্থার শক্তিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে পারি যাতে আমরা যখন সমগ্রর সাথে মিলিত হই তখন আমার নিজেদের সম্মতিতে নিজেদের ইচ্ছারই মাত্র অনুগত হই এবং স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এবং শক্তি পূর্বের মতোই অক্ষত থাকে। … সম্মতির ভিত্তিতে সমাজ সংস্থা যখনই বাস্তব রূপ লাভ করে তখনই এই সংস্থা প্রত্যেকটি সদস্যের জন্য সমগ্র সংস্থার নৈতিক এবং যৌথ শক্তি সহকারে প্রতিটি সদস্যের পাশে এসে বিত্রস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে উপস্থিত হয়। এবং এরই পরিণামে সমাজসংস্থার নবতর অস্তিত্ব এবং ইচ্ছার শক্তিপ্রাপ্ত হয়। নাগরিকদের সমবায়ে গঠিত এমন সমাজ সংস্থাকে প্রাচীনকালে একটা নগর বা নগররাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হতো। পুরাতন সেই অভিধার স্থলে আজ আমরা তাকে একটা রিপাবলিক বা রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে অভিহিত করে থাকি। এবং এই সংস্থাকে মানুষ তার নিস্ক্রিয় অবস্থায় ‘রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করে; ক্রিয়াশীল অবস্থায় এই সংস্থাই সার্বভৌম জনশক্তিতে পরিণত হয়।

রাষ্ট্রের সামাজিক চুক্তির ধারণায় রাষ্ট্রকে দেখা হয়েছে ‘জনগণের সার্বভৌম শক্তি’ হিসেবে। ‘জনগণের সার্বভৌম শক্তি’ হিসেবে রাষ্ট্র সমগ্রর উপর কর্তৃত্বের অধিকারী হয় জনগণের অধিকার সাপেক্ষে। জনগণের এই অধিকার মানে ‘নিজেদের সম্মতিতে নিজেদের ইচ্ছারই মাত্র অনুগত’ হওয়া। ফলে সামাজিক চুক্তির ধারণামাফিক রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের মাধ্যমে সম্মিলিত কর্তৃত্ব তথা নিজেদের ইচ্ছার আনুগত্য নিশ্চিত হয়। কিন্তু এটা অসম্ভব। কেননা রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বদায় ন্যাস্ত থাকে সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিন্যাস ক্রমকর্তৃত্বতান্ত্রিক। ফলে সমাজ সংস্থা হিসেবে ‘ক্রিয়াশীল অবস্থাতেই’ রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত হয়, জনশক্তিতে নয়। তাই রাষ্ট্র জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু জনগণের উপর দণ্ডায়মান একটা ক্ষমতাকাঠামো হিসেবে টিকে থাকে।

জি জ্যাক রুশো
(১৭১২-১৭৭৮)
পেইন্টিং: মরিস কুয়েন্টিন ডিলা ট্যুর
সূত্র: উইকিপিডিয়া

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর ক্ষমতা বিন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমলাতন্ত্র। এই আমলাতন্ত্র  যান্ত্রিক এবং যান্ত্রিক সুর-তাল-লয়-ছন্দে তা ক্রিয়াশীল থাকে, সেই সাথে সবকিছুকেই যান্ত্রিকতার নিগড়েই গড়ে তুলতে চায়। এরকম নিস্প্রাণ একটি সংস্থা যেমন চরম মূলানুগ তেমনি চরমভাবে তা সৃষ্টিশীলতা বিরোধী। উনিশ শতকের সিন্ডিক্যালিস্ট আন্দোলনের বিশিষ্ঠ চিন্তক ও সংগঠক রুডলফ রকার বলেন,

মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্মতি আর সমর্থনের ভিত্তিতে সংহতিপূর্ণ সহযোগিতার পথে এ-যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় বাধাটা সৃষ্টি করেছে আত্মাহীন রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের সদা বর্ধমান ক্ষমতা, এবং তা গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে নবতর বিকাশের সমস্ত সম্ভাবনা। অথচ এই রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রই দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষের জীবন রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভাল করে থাকে। যে-সিস্টেম তার জীবদ্দশার প্রত্যেকটা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জনগণের বৃহৎ অংশগুলোর আজ্ঞে হ্যাঁ, পুরো জাতির মঙ্গল ও কল্যাণ জবাই করে দেয় ক্ষুদ্র সংখ্যা-অল্পের ক্ষমতা আর অর্থনৈতির স্বার্থের কামনা-বাসনা পূরণ করার জন্য, সেই সিস্টেমটাকে তো সমস্ত সামাজিক বন্ধন ছিন্নভিন্ন করে ফেলতেই হবে, আর লিপ্ত হতে হবে এমন এক সার্বক্ষণিক যুদ্ধে, যে যুদ্ধ সবার বিরুদ্ধে সবার।

কিন্তু আমলাতন্ত্রের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ রাষ্ট্রের ‘গণমুখী’ মুখোশকে উন্মোচন করে ফেলে। তাই রাষ্ট্রকে সর্বদাই জনগণের দোহাই পাড়তে হয়। জনগণের দোহাই পাড়ার একটা বিশেষ রূপ হচ্ছে রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিত্ব। নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্ব-ব্যবস্থার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনাকে গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করার চল খুবই প্রবল। কিন্তু সামগ্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র তার উপর শোষণ-শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার কর্তাকেই বেছে নিতে পারে। শোষণ-শাসন ব্যবস্থার উচ্ছেদ কখনোই নির্বাচনের মাধ্যমে সম্ভব হয় না।

রুডল্‌ফ্‌ রকার
(১৮৭৩-১৯৫৮)
সূত্র: উইকিপিডিয়া

রাষ্ট্রে ‘জনপ্রতিনিধিত্ব’ কায়েমের জন্য রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি। রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই জনগণ কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন করে এবং রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক বানায়। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় রাজনৈতিক দল হচ্ছে মুখ্য কর্তা এবং জনগণ গৌণ। তাই রাজনৈতিক দল হচ্ছে এই ক্ষমতার বিন্যাসে নির্বাচিত শোষক-শাসক। রাজনৈতিক দলের কাঠামোও নির্মিত হয় রাষ্ট্রের কাঠামোর ছাঁচে। কী ‘গণতান্ত্রিক’ কী ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র উভয় জায়গাতেই রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা। এই রাষ্ট্রক্ষমতার ঝোঁক-প্রবণতা-মাত্রাগুলোর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান থাকলেও রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বব্যাপিতা এবং নিরঙ্কুশ স্বৈরচরিত্রের কোনো পার্থক্য নেই।

মার্ক্সবাদ, রাষ্ট্র ও মুক্তি: ঠুলি-আাঁটা চোখে দুনিয়াপাঠের বোধন-উদ্বোধন

রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজতন্ত্র মার্ক্সীয় ধ্যানধারণা থেকে উদ্ভুত। মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সূত্র অনুযায়ী, উৎপাদন শক্তির সাথে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ‘নতুন সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই মোতাবেক সামন্তসমাজ ভাঙ্গার ক্ষেত্রে কৃষি উদ্বৃত্তের মাধ্যমে পুঁজি গঠন এবং সেই পুঁজির মুনাফামুখিনতা, সৃষ্টি করে পুঁজিবাদী সমাজ। এই সমাজে উৎপাদনের উপায়গুলো বুর্জোয়া শ্রেণী তথা পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত থাকায় সামগ্রিক উৎপাদনে পুঁজির দৌরাত্ম চলতে থাকে। উৎপাদক শ্রেণী– শ্রমিক শ্রেণী থাকে উপেক্ষিত, শোষিত। এই শ্রমিক শ্রেণী (যা মূলত বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার ফলেই সৃষ্ট) হচ্ছে মার্ক্সের মতে সর্বহারা শ্রেণী বা শিল্প প্রলেতারিয়েত। পুঁজিবাদী বৈষম্য ভেঙ্গে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠায় এই শিল্প প্রলেতারিয়েতই (যা পুঁজির ক্রমাগত সঞ্জীভবনের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু শ্রেণীতে পরিণত হয়) হচ্ছে মুখ্য শক্তি। পুঁজিবাদী শ্রেণী- সমাজ থেকে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার মাঝখানে উৎক্রমনমূলক স্তর সমাজতন্ত্র -সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব। অর্থাৎ শিল্প প্রলেতারিয়েতের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এই ক্ষমতা কায়েম হয় রাষ্ট্রের মাধ্যমে। কেননা মার্ক্সীয় মতধারায় রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণী আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যম-শ্রেণীদ্বন্দ্বের অমিমাংসেয় ফল এবং সমাজতন্ত্র হচ্ছে উৎপাদনের উপায়গুলোর উপর প্রলেতারিয়েতের কর্তৃত্বশীল মালিকানা আরোপের রাজনৈতিক ক্ষমতা।

কার্ল মার্কস
(১৮১৮-১৮৮৩)
সূত্র: উইকিপিডিয়া

মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের সহজ অর্থ হচ্ছে তা দরবারী সমাজতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের উপায়সমূহের সামগ্রিক মালিকানা সামাজিক নয় বরং রাষ্ট্রীয়। ফলে সামগ্রিক উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে ন্যাস্ত। আর এক্ষেত্রে রাষ্ট্রক্ষমতা মানেই সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাই তো সামগ্রিক সর্বহারা শ্রেণী আসীন থাকতে পারে না। বরং সর্বহারা শ্রেণীর ‘অগ্রসর অংশ’ নামক গুটিকতেক শিল্প প্রলেতারিয়েতের হাতে ন্যাস্ত হয় এই ক্ষমতা। এই গুটিকতক শিল্প প্রলেতারিয়েতের বাস্তব অর্থ হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি। ফলে সর্বহারার একনায়কত্ব দাঁড়ায় কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কত্ব। আর পার্টির গঠনকাঠামো যখন ক্রমকর্তৃত্বতান্ত্রিক তখন পার্টির সর্বোচ্চ কর্তাটি একনায়ক হিসেবে আবির্ভাবের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করতে গিয়ে রুডলফ রকার সেন্ট সাইমনের অভিমত: ‍‍‌’এ‍‍‌‌‌‌মন দিন আসবে যখন মানুষজনকে শাসন-পরিচালনের কলাকৌশল লোপ পাবে। তার স্থলে জায়গা নেবে নতুন একটা কলাকৌশল। সেটা হলো বস্তু সামগ্রী-বিষয়াদি ব্যবস্থাপনার কলাকৌশল।’ এর সাথে সহমত পোষণ করেন এবং এ সম্পর্কে বলেন,

 … এটা [সাইমনের অভিমত] মার্ক্স ও তার অনুসারীদের লালন পালন করা এই তত্ত্ব ছুঁড়ে ফেলে দেয় যে, শ্রেণীহীন সমাজে যাওয়ার পথে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব হিসেবে গঠিত রাষ্ট্র একটা আবশ্যিক উত্তরণকালীন স্তর; আর এই স্তরে সকল শ্রেণী-সংঘাত এবং তারপর খোদ শ্রেণীগুলোই দূরীভূত হওয়ার পরে রাষ্ট্র নিজেই নিজেকে বিলোপ করে দেবে এবং দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যাবে। এই ধ্যানধারণা রাষ্ট্রের আসল স্বভাব চরিত্রকে এবং ইতিহাসে রাজনৈতিক ক্ষমতা নামক ঘটনাটার তাৎপর্যকে একদমই ভুলভাবে বোঝে, আর ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। এই ধ্যানধারণা আসলে তথাকথিত অর্থনৈতিক বস্তুবাদের যৌক্তিক পরিণত মাত্র। অর্থনৈতিক বস্তুবাদ ইতিহাসের সমস্ত ঘটনা-লক্ষণ-প্রপঞ্চের মধ্যেই কোনো একটা সময়পর্বের স্রেফ উৎপাদন পদ্ধতিসমূহের অপরিহার্য ফলাফলই শুধু দেখতে পায়। এই তত্ত্বের প্রভাবে লোকজন বিভিন্ন আকার-প্রকারের রাষ্ট্র এবং অন্য সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে সমাজের ‘অর্থনৈতিক অট্টালিকা-কাঠামোর’ ওপরে দাঁড়ানো ‘আইন-বিষয়ক ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো’ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল; এবং লোকজন ভেবেছিল এই তত্ত্বের মধ্যে তারা প্রত্যেকটা ঐতিহাসিক ঘটনামালার চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছে। বাস্তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য পরিচালিত বিশেষ বিশেষ লড়াই সংগ্রাম কিভাবে একটা দেশের অর্থনৈতিক বিকাশধারাকে শত শত বছরের জন্য রুদ্ধ করে দিয়েছে বা ব্যহত করেছে ইতিহাসের প্রত্যেকটা পর্বই আমাদেরকে তার হাজার হাজার দৃষ্টান্ত সরবরাহ করে।

রকার রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন,

… সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন যে রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়েছে সেই রাষ্ট্র পুরাতন শাসকশ্রেণীসমূহের বিশেষ অধিকারগুলোর ইতি টানতে পারে বটে, কিন্তু এটা সে করতে পারে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন আরেকটা বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণী খাড়া করার মাধ্যমেই, যে শ্রেণীটাকে তার প্রয়োজন পড়বে নিজের শাসকগিরি বজায় রাখার জন্য।১০

সমাজতন্ত্র,স্বাধীনতা ছাড়া অর্থহীন। রাষ্ট্রবিহিত সমাজতন্ত্রে সেই স্বাধীনতা তো  নে-ই, উপরন্তু তা এক নতুন ধরনের বৈষম্য-শৃঙ্খলে মানুষকে শৃঙ্খলিত করে। কাজেই মুক্তির প্রশ্নে মার্ক্সবাদ খুবই বিবেচ্য বিষয় কিন্তু হুবহু অনুসরণীয় নয়।

মুক্তির পথ: কর্তৃত্ব-বধ ও সহজাত আকাক্সক্ষার নির্মিতি…

কর্তৃত্বের কবল থেকে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সহজাত। কর্তৃত্ব এবং সর্বপ্রকার কর্তৃত্বের উচ্ছেদের মাধ্যমেই কেবল মানুষের মুক্তি সম্ভব। মানুষের এই মুক্তি শুধুমাত্র গণতন্ত্র নয়, সাথে সাথে সমাজতন্ত্রকেও দাবি করে। মিশেল ফুকো বলেন,

গণতন্ত্র বলতে কেউ যদি, শ্রেণীবিভক্ত নয় কিংবা ক্রমতান্ত্রিকভাবে শ্রেণীবিন্যস্ত নয় এমন একটা জনসমষ্ঠির দ্বারা, ফলপ্রসু ক্ষমতার চর্চা বলে মনে করেন তাহলে সুস্পষ্টভাবেই আমরা গণতন্ত্র থেকে বহুদূরে অবস্থান করছি। সেই সাথে এটাও সুস্পষ্ট যে, আমরা বাস করছি একটা শ্রেণী-একনায়কতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর অধীনে ও শ্রেণীক্ষমতার অধীনে, যে শ্রেণীটি সহিংসতার মাধ্যমে নিজেকে চাপিয়ে দেয়, যদিও হতে পারে যে তাদের এই সহিংসতার হাতিয়ারগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও সংবিধান সম্মত।১১

কর্তৃত্ব তথা অসম ক্ষমতা সম্পর্কের উচ্ছেদ এবং কেবলমাত্র উচ্ছেদের মাধ্যমেই গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ফলপ্রসু চর্চা সম্ভব। আর এই ক্ষমতা সম্পর্কের উচ্ছেদ মানেই ভূমির অসম মালিকানার স্থলে যৌথ-পঞ্চায়েতী সামাজিক মালিকানা, শ্রমের উদ্বৃত্ত শোষণের স্থলে উৎপাদন যন্ত্রে শ্রমের প্রতিষ্ঠা, দেহগত ও লৈঙ্গিক আধিপত্যের স্থলে জৈব সংহতি এবং ভাষিক-সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত আধিপত্যের স্থলে সমতা ও ভাষা-সংস্কৃতি-জ্ঞানের সামাজিক পরম্পরাগত প্রসার। আর এইজন্য জরুরী হচ্ছে সমাজের প্রবাহমান নানান ধরণের সম্পর্ক ও প্রপঞ্চগুলোকে বোঝাপড়া করা, এগুলোর মধ্য থেকে কর্তৃত্বপরায়ণ উপাদানগুলোকে চিহ্নিত করা এবং তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা চ্যালেঞ্জ করা। মানুষই ইতিহাসের নির্মাতা। ফলে কোনো শাস্ত্রবাদী সূত্র মেনে সমাজ পরিবর্তিত হয় না। সমাজ পরিবর্তিত হয় শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র মানুষের জাগরণের মাধ্যমে তার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ-আন্দোলোনের মাধ্যমে।এই প্রতিরোধ-আন্দোলনকে হতে হবে মানুষের সহজাত-স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু সংগঠিত প্রচেষ্টার প্রতিকৃতি।

প্রতিরোধ-সংগঠন: চিন্তা-সৃজন-সংগ্রামের সংহতি-প্রচেষ্টা

সংগঠন হচ্ছে একটি বিশেষ লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তা বাস্তবায়নের জন্য কিছু মানুষের মধ্যে চিন্তা, সৃজন ও তৎপরতার সংহতি। পারস্পারিক যোগাযোগ ও দায়বদ্ধতাই এই সংহতির প্রধান ভিত্তি। সুতরাং সত্যিকারের প্রতিরোধ-সংগঠন হতে হবে ক্রমকর্তৃত্বতন্ত্রমুক্ত একটা জিনিস। ক্রমকর্তৃত্বতন্ত্র বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। সাধারণত পলিটিক্যাল পার্টি কিংবা অনান্য প্রতিষ্ঠানে কাজের দায়িত্ব ভাগ করার নামে নানান ধরণের পদ তৈরি করা হয়। এই পদগুলোকে সুনির্দিষ্ট ক্ষমতাও দেয়া হয়। ফলে ক্ষমতার নির্দিষ্টতা অনুসারে উপরতলা-নিচতলা তৈরি হয়। সাধারণত উপরতলার প্রধান ব্যক্তিটি হন সভাপতি আর তারপর ক্রমঅনুসারে সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক প্রভৃতি পদ বিন্যস্ত থাকে। এখানকার সাধারণ সংস্কৃতি হচ্ছে: উপরতলার লোক নিচতলার লোককে হুকুম বা নির্দেশ দেবেন এবং নিচতলার লোক বিনা বাক্যব্যায়ে তা পালন করবেন। আর এটা করতে পারলেই নিচতলার লোক একদিন উপরতলায় যেতে পারবেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে মূলত ক্ষমতা, প্রতিষ্ঠানের গুটিকয়েক লোকের হাতে ন্যাস্ত হয়ে পড়ে। এবং এই গুটিকয়েক লোক সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠেন। ফলে ক্রমকর্তৃত্ব্তন্ত্র ক্ষমতার কেন্দ্রানুগতাকেই ধারণ করে। প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্র-কর্তৃত্বকে জায়েজ করার জন্য নানান ধরণের পলিটিক্যাল পার্টি ঘরানা থেকে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র আওয়াজ শোনা যায়। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’ জিনিসটি একটি মিথ। গণতন্ত্র বলতে প্রতিটি ব্যক্তির স্বাধীনতা-সাম্য-সংহতি’র নিশ্চয়তাকে বোঝায়। কিন্তু কেন্দ্র মানেই অসম ক্ষমতা- অপরের উপর কর্তৃত্ব। আর সম্পর্ক যখন কর্তৃত্বমূলক তখন সেখানে সংহতি থাকতে পারে না। সংহতির নামে খুবই নি¯প্রাণ যান্ত্রিক একটা সম্পর্ক টিকে থাকে। ফলে গণতন্ত্র ও কেন্দ্র সমার্থক হতে পারে না।

পেইন্টিং: প্যারিস কমিউন
সূত্র: রবার্ট গ্রাহামের অ্যানার্কিজম ওয়েবলগ

প্রতিরোধ-সংগঠনের প্রধান কাজ হচ্ছে কর্তৃত্ব-ক্ষমতা-আধিপত্যের সম্পর্কগুলোকে পাঠ করা, সমাজের মধ্যে বিদ্যমান এই সম্পর্কগুলোকে প্রশ্ন করা এবং তা সমূলে উৎপাটনের জন্য কর্মতৎপরতা সংগঠিত করা। এই কর্মতৎপরতার প্রধান শক্তি হচ্ছে গণমানুষ। একমাত্র এবং একমাত্র গণমানুষের সম্মিলিত মুক্তিমুখীন প্রতিরোধ আন্দোলনই পারে তাকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির সমাজ নির্মাণ করতে।

সূত্র:

১.  রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট: সরদার ফজলুল করিম অনুদিত; পৃ:২৯
২.  রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট: সরদার ফজলুল করিম অনুদিত; পৃ:২৯
৩.  মুখোমুখি নোম চমস্কি এবং মিশেল ফুকো/ মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা: আ আল মামুন অনুদিত, পৃ-৪৪
৪.  মুখোমুখি নোম চমস্কি এবং মিশেল ফুকো/ মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা: আ আল মামুন অনুদিত, পৃ-৪৪
৫.  বাকুনিন: কর্তৃত্ব কী? অনুবাদ: লেখক
৬.  সেলিম রেজা নিউটন, (২০০৩) বাজারের যুগে সাহিত্য সাঙবাদিকতার আব্বু আম্মু সমাচার কিংবা মহাজনী প্রিন্ট মিডিয়ার পলিটিক্যাল ইকোনমি, যোগাযোগ ৪র্থ সংখ্যা, সম্পা: ফাহমিদুল হক, রাজশাহী
৭.   সরদার ফজলুল করিম, (২০০৩) রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট, পৃ:৩৬, ৩৭, ৩৮
৮.  রুডলফ রকার (২০০৬)  নৈরাজ্যবাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, অনুবাদ: সেলিম রেজা নিউটন, সরণ-প্রতিসরণ
৯.  রুডলফ রকার (২০০৬)  নৈরাজ্যবাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, অনুবাদ: সেলিম রেজা নিউটন, সরণ-প্রতিসরণ
১০. রুডলফ রকার (২০০৬)  নৈরাজ্যবাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, অনুবাদ: সেলিম রেজা নিউটন, সরণ-প্রতিসরণ
১১. মুখোমুখি নোম চমস্কি এবং মিশেল ফুকো/ মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা: আ আল মামুন অনুদিত

রচনাকাল: ০৪ এপ্রিল, ২০০৮ রা.বি

সম্পাদকীয় নোট:  প্রথম প্রকাশ : ওঙ্কার, প্রথম সংখ্যা, ২০০৮, রাবি থেকে প্রকাশিত। লেখার বর্তমান সংস্করণটি টিটুমের বাঙলা ব্লগ থেকে নেয়া হয়েছে। লেখাটি ২০০৭ সালে আগস্ট বিক্ষোভের পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা কর্তৃত্ব বিরোধী আন্দোলনের জন্য একটা ইশতেহার রচনা প্রচেষ্টা। এর আদি নাম ছিল : আন্দোলনের কর্তৃত্ব বিরোধী ধারা: মূল প্রস্তাবনা।

আরিফ রেজা মাহমুদ

লেখক