- আরিফ রেজা মাহমুদ
এক.
লাগাম ছাড়া লগ্নিপুঁজি এবং তার মুনাফার নেশা এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করে যার ভেতরে নিহিত থাকে প্রকৃতি এবং তার শৃঙ্খল বিনাসী তৎপরতা। ফলশ্রুতিতে এমনসব জৈব-জৈবনিক উপাদান তথা বীজানু উন্মুক্ত হয়ে পড়ে যা ছিল এতদিন সুপ্ত।
অতি উৎপাদন, কাঁচামালের যোগান, শিল্পোৎপাদনের জন্য বন উজাড়, জলাশয় বিনাস, কার্বন নিঃসরণে বায়ু দূষণ ও বায়ুমন্ডলে প্রভাব, ওজন স্তর ফুটো করে ফেলা এবং মহাকাশের নানা রশ্মির প্রভাব, সাগরের পানি উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততা সৃষ্টি ইত্যাদি পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাদনেরই ফল। মুনাফার লোভ প্রাণ-প্রকৃতিকে শুধু ধ্বংসই করে না, তৈরি করে এমন একটা ব্যবস্থা যার উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে পুরো সামাজিক জীবন।
পুঁজিবাদ আর এই সামাজিক জীবনের রক্ষণভাগই হল আধুনিক রাষ্ট্র– একটা সার্বভৌম ক্ষমতা যা পুরো সিস্টেমটাকে অভিভাবকের মতো দেখভাল করে আর কোথাও কোন বিচ্যুতি ঘটলে তাকে ঠিকঠাক করতে আরও দক্ষভাবে প্রয়োগ করে তার নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতা। বলাই বাহুল্য এই নিয়ন্ত্রণ শুধু বল প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তৈরি করা হয় তার শর্ত এবং প্রতিনিয়ত স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে বহাল থাকে জীবন্ত কর্তৃত্ব।
স্বাস্থ্য বলতে পুঁজিবাদ বোঝে না তার নাগরিকের জীবনের সুস্থতা। স্বাস্থ্য তার কাছে একটি মুনাফামুখিন খাত। বৈষম্য টিকিয়ে রেখে তার ভেতরেই রোগনিরাময়কে একটি অর্থনৈতিক চাহিদা হিসাবে গঠন করে পুঁজিবাদ। আর তাই মহামারি এবং আক্রান্ত তার কাছে নতুন ভোক্তার আবির্ভাব। এটা ততটুকুই বিপজ্জনক যতটুকু তা শ্রেণী সংহত একটা ব্যবস্থায় এলিট শাসক গোষ্ঠী ও তার দুর্ভেদ্য প্রাচীরকে আক্রান্ত করে।
তাই মহামারী হয়ে ওঠে রাষ্ট্রর ম্যানেজমেন্টের বিষয়। একদিকে যেমন মহামারী মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, অন্যদিকে মহামারি ম্যানেজমেন্ট রাষ্ট্রকে এনে দেয় নাগরিকের উপর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপের শর্ত। একটা কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং ক্ষমতা চর্চা।
দুই.
করোনা শুধু একটি সংক্রমণী ভাইরাস নয়। একই সঙ্গে ভয়– নিরেট ভয়ের সংস্কৃতি। একটি গণআতঙ্ক। এই আতঙ্ক বিস্তৃত হয় মন থেকে সমাজশরীরে। পুরো সমাজের সংবহনতন্ত্রকেই আক্রান্ত করে ভয়। এই ভয়ই দাবি করে শাসকীয় একশন। একেবারে বিদ্যুতবৎ একশন। ভয়কে ভিত্তি করেই সমাজের চিরায়ত এলাকায় ঢুকে পড়ে রাষ্ট্র কর্তৃত্বর শুঁড়।
ভয়ের সমানুভূতির উপরেই দণ্ডায়মান হয় রাষ্ট্র। ভীত জনগণের সামনে এবার নির্মিত হয় এক ‘জাতীয় শত্রু’– করোনা।
এই ‘জাতীয় শত্রু’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পার্টনার মিডিয়া। রাষ্ট্র- মিডিয়া মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে তোলে। মিথোজীবিতার ভিত্তি ‘জাতীয় শত্রু’ নিধন নয়– জাতীয় শত্রুর ভীতি এবং রাষ্ট্রর সর্বশক্তিমান রূপকে কাঙ্খিত করে তোলা। বল প্রয়োগ ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থাকে পাবলিক স্মৃতিতে সর্বাত্মক করে তোলা।
ভয় উৎপাদন, সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রকে স্বাভাবিক করে তোলে।
তিন.
রাষ্ট্র স্বয়ং প্রপাগান্ডা– কর্তৃত্ববাদেরই অমোঘ পরিণতি। রাষ্ট্র হয়ে ওঠে এক ও অদ্বিতীয় তথ্যকেন্দ্র। তথ্য তা-ই যা রাষ্ট্র সার্টিফাই করে। মিডিয়া আর সমগ্র প্রচার মাধ্যম তার বাহনমাত্র।
রাষ্ট্র শুধু ফরমান বা ঘোষণায় হাজির করে না। পটু হয়ে ওঠে মিথ্যাকে অবলীলায় কার্যকরী করে তুলতে। গুজবের জুজু রচনা করে রাষ্ট্র। আর একইসঙ্গে পরিণত হয় সকল ‘সত্য’র রচনাকারী নিউস্পিকে।
রাষ্ট্র হাজির করে সংখ্যা ব্যবস্থাপনার রাজনীতি। যেখানে অধিকাংশ সময় থাকে ধাঁধা। এই ধাঁধা তৈরি হয় সবসময় খারাপ কোন উদাহরণকে বেছে নিয়ে এবং তারপর মহান নেতা নেত্রীকে প্রতীক বানিয়ে তার সাফল্য ও স্তুতি রচনা করে রাষ্ট্র। প্রতীকস্বয়ং রাষ্ট্রপ্রসূত!!
শুধু প্রতীক পূজা নয়, প্রতিটি নিউস্পিকের
পক্ষ- বিপক্ষ দ্বিত্ব নির্মাণ করে রাষ্ট্র। আর বহুবর্ণিল মতের ঢেউকে নিয়ন্ত্রণ করে এই দ্বিত্বতে আটকে।
চার.
নতুন ধরনের সভেরিন পাওয়ার তৈরি হচ্ছে, যেটা ‘সচেতনতা’র উপর প্রতিষ্ঠিত।
‘সচেতনতা’ নিয়ন্ত্রণ কৃৎ-কৌশলের আরও আরও প্রকরণকে অবিসম্ভাবী করে তোলে। নজরদারি যা এতদিন ছিল একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য তা এখন নিপাট জীবন ও আচরণকে নতুন মূল্যবোধে আটক করছে আর এটাই হয়ে উঠছে নিয়মিত!
সচেতনতাকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করে পুরো পাবলিক পরিসরই, অ-সচেতনতাকে শুধু দোষারোপই করে না, অ-সচেতনতা হয়ে ওঠে সরাসরি সেনা- পুলিশ- রাষ্ট্রর চিরুনি অভিযানের লক্ষ্য।
প্রতিটি শরীর একদিকে যেমন সন্দেহভাজন, অন্যদিকে প্রতিটি আচরণই তৈরি করে একটি ‘সতর্ক’ অবস্থা।
প্রধানমন্ত্রী-সরকার ও বিরোধীদলসমূহ- আইন ও সুরক্ষা কাঠামো সমগ্র রাষ্ট্রপ্রণালীই কোয়ারেন্টাইনকে উপর্যুপরি ব্রিডিং করছে আর তার নতুন নতুন সংস্করণ হাজির হচ্ছে। শরীর থেকে ব্যক্তি, ব্যক্তি থেকে সমাজ সংবহনতন্ত্র কোয়ারেন্টাইনড। কোয়ারেন্টাইন এখন সামাজিক চুক্তি!
আমরা এখন এমন এক বিন্দুতে যেখান থেকে ক্ষমতাকে চিনে নেয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
কর্তৃত্ববাদী একটা ব্যবস্থায় সচেনতা অপরিহার্য করে তোলে যাবতীয় নিবর্তনমূলকপন্থাকে। সমাজ ও কমিউনিটির আত্ম উপলব্ধির উত্থান ছাড়া আত্মশক্তি গড়ে ওঠে না।
সচেতনতা মনে সমাজ অবরুদ্ধকরণ নয়। সচেতনতা মানে সামজিক উত্থানের পরিসরকে প্রশস্তকরণ। সমাজ ছাড়া শরীর বা ব্যক্তি বাঁচে না। পরিণত হয় অর্থহীন জিন্দা লাশে।