অনুবাদ : সজীব সাখাওয়াত
অনুবাদকের ভূমিকা: গোটা বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস আমাদের অনেকগুলো ধাক্কা দিয়েছে। সেই ধাক্কাগুলো প্রশ্নের মুখে ফেলেছে আমাদের নাগরিক জীবন, সামাজিক জীবনকে। ‘যোগ্যতমর টিকে থাকার লড়াই’ না কি ‘পারস্পরিক সহযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই’ এ প্রশ্নের উত্থান হয়েছে আজকে আবার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেখানে ‘আমিত্ব’র প্রচার করে যাচ্ছে বারবার সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা বলে যাচ্ছি যৌথ জীবনের কথা। মানুষ সামাজিক জীব, এটি আমরা ছোটোবেলা থেকে মুখস্ত করে এসেছি। কিন্তু এই সমাজ, এই সামাজিক সংহতির কতটুকু আমরা দেখাতে পেরেছি– করোনা হাজির হয়েছে এ প্রশ্ন নিয়ে। করোনার এই ধাক্কাটা খুব গভীরভাবে আমাদের আঘাত করে।
কোয়ারেন্টাইন বা সামাজিক দূরত্বের শ্লোগান তুলে রাষ্ট্রগুলো যখন তার সমাজকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে তখন আমরা বলছি সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্ব এবং সামাজিক সংহতি করোনা মোকাবেলা করবে। মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতার কথা আমরা বলছি। এই পারস্পরিক সহযোগিতা মানুষের মধ্যকার আদিম এক প্রবৃত্তি। নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মীড সংস্কৃতিতে সভ্যতার প্রথম চিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন মানুষের উরুর ভাঙা হাড় যা আবার জোড়া লেগেছে। মীড বলেছেন সভ্যতার প্রথম চিহ্ন– পারস্পরিক সহযোগিতার কথা, যে সহযোগিতা ছাড়া উরুর হাড় জোড়া লাগত না। ইতিহাস বলে, পৃথিবীর যাবতীয় দুর্যোগ, মহামারিকে মানুষ মোকাবেলা করেছে একে অপরকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে, একে অন্যের দেখভাল করার মাধ্যমে।
করোনা আমাদের বারবার প্রকৃতির দ্বারস্থ করেছে। প্রকৃতির স্বাভাবিকতার দ্বারস্থ করেছে। আর সেই স্বাভাবিকতা হলো যৌথ জীবন। কোনো মানুষ একা বেঁচে থাকতে পারে না– এই চিরন্তন বাক্যটিকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। পিওতর ক্রপোতকিন তার মিচুয়াল এইড গ্রন্থে বলেছেন পূর্ববর্তী কয়েক শতকে রাষ্ট্রগুলো কর্তৃত্ববাদী আর শোষণবাদী রূপ ধারণ করার আগ পর্যন্ত মানুষ পারস্পরিক সাহায্য আর সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজকে পুনঃনির্মাণ করতে চেয়েছে। আর সেই সমাজের আদর্শ ছিল–মৈত্রীবোধ। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদ হবে সমাজকে এই পারস্পরিক সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে পুনঃনির্মাণ করতে চাওয়া। এই সমাজকে যদি আমরা পুনঃনির্মাণ করতে পারি তবেই ভালোবাসা-সৌহার্দ্য-পারস্পরিকতার এক যৌথ জীবন আমরা লাভ করতে পারব যেখানে আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে, থাকবে গান গাইবার স্বাধীনতা, চিৎকার করার স্বাধীনতা।
Sissy Doutsiou আর Tasos Sagris এর Cronavirus and Mutual aid রচনাটি আশা জাগানিয়া একটি রচনা। এই লিখা আমাদের সমানুভূূূতি-সমযোগিতার কথা বলে, বলে প্রেম-ভালোবাসা-যত্নের কথা। আমাদের নতুন সমাজ বিনির্মাণে এই ভাবনাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক সংহতির হাত ধরে গোটা বিশ্ব এই করোনা মহামারি মোকাবেলা করবে এটাই কামনা।
আজকের এই সময়ে আমরা সকলে সাধারণ এক ইতিহাসে বসবাস করছি
আমরা এমন এক সর্বনাশা ভাইরাসের মুখোমুখি যা গোটা দুনিয়ায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমাদের উদ্বেগকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আমরা বলছি, আমরা যদি সতর্কতামূলক আগাম ব্যবস্থা নিই, তবে আমরা বেঁচে যাব। এই সময়টাতেই আমরা টেলিভিশন দেখার সময়গুলো কমানোর চেষ্টা করি। আসলে, টেলিভিশনে খবর দেখাটা নিত্যদিনের গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন ভুল সংবাদ, গণমাধ্যমের প্রতি আমাদের অনাস্থার মানসিক আঘাত প্রতিস্থাপিত হয়েছে এক গভীর ক্ষত দ্বারা, মহামারির নিত্যদিনের ব্রিফিং আমাদের সকলকেই প্রভাবিত করছে।
আমরা প্রত্যেকেই, পুনর্বিবেচনার পরে নিজেদের ভয়গুলোকে মোকাবিলা করছি, নিজেদের সাথে কথোপকথনে জড়াচ্ছি এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে জীবনের অর্থকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছি। আমরা ভাবনার আদানপ্রদান করছি এবং কোনো একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছি। অনেক অনেক প্রবন্ধ, বিশ্লেষণ লিখা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে আমরা পুঁজিবাদের সীমার বিরুদ্ধে, বাণিজ্যিক-ভোগবাদী বিশ্বের বিরুদ্ধে।
কিভাবে আমরা আমাদের প্রাণ বাঁচাব, আমাদের সহ-মানবদের প্রাণ বাঁচাব? সমবেদনা আর সুখের আলোকে কোন পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করব? এই ভাইরাসের পাশাপাশি আমাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার এবং বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর ভালোবাসা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আন্তরিকতা, আর আরোগ্য দিতে না পারার ব্যর্থতাকে মেনে নিতে হচ্ছে। অথচ যখন কারো জীবন সংকটাপন্ন হয় এসবেরই সবচেয়ে বেশি দরকার হয়।
কিভাবে আমরা আমাদের ভয়কে নিরস্ত করতে পারব যখন এই পৃথিবীটা হঠাৎ করেই বদলে গেল? এর শেষ কখন হবে? কখন আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাব আমরা কি তখন দেখব শোষণ ও সামাজিক বৈষম্যের এই ব্যবস্থা পরবর্তী সংকট না আসা পর্যন্ত আবারও কাজ করা শুরু করেছে?
মূল হুমকি হলো আমাদের জীবন যাপনের ধরন বৈশ্বিক উদ্বেগ, বৈশ্বিক ভয় মানুষকে ভীত করে। সৌভাগ্যজনকভাবে, এখানে নির্মম রসবোধ আছে এবং অনেকেই আছে যারা এই ঘটনা অবলোকন এবং চিন্তা করছে, বিভিন্ন লেখা এবং বিশ্লেষণ, ভিডিও, স্বাধীন সংবাদ, সামাজিক যোগাযোগ এর মাধ্যমে তল থেকে উপরে তথ্য সরবরাহ করছে; প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে বাইরেও এ সকল যোগাযোগ মাধ্যম কাজ করছে।
যখন সমাজ আতঙ্কিত অবস্থায় থাকে, ব্যক্তিও আতঙ্কিত হয়। সমাজ যখন উন্নতির দিকে ধাবিত হয়, ব্যক্তি কেবল তার মৌলিক অধিকার পায়। সমাজ যখন ভাইরাসের মুখোমুখি হয়, ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কোনো গাছ কিংবা গাছের শাখায় বসে থাকা পাখির চোখে আমরা যদি অতীত আর ভবিষ্যত দেখি, আমাদের উচিত শুধু সুখ,আনন্দ আর স্বাস্থ্য খোঁজা। সংকটের সময় স্বাধীনতা কোথায়? সমাজ, প্রতিষ্ঠান, আইন, এবং ব্যক্তির আধুনিক জীবনব্যবস্থা সব চেতনে বা অবচেতনে পুনরাৎপাদিত হয়। এখন যখন আমরা কেবল বাঁচতে চাই এবং প্রিয়জনের সুস্থতা চাই তখন এই মুক্ত-বাজারে আসলে কি ঘটছে? জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি এবং মৃত্যুর উপলব্ধি আমাদের মনে সমভারেই থাকে।
যখন কোনো জীবনব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং জীব দুর্বল হয়ে পড়ে তখন নিরাপত্তার অভাব আর উদ্বেগ জন্মায়। আমাদের জীবনের প্রতি ভালোবাসা, চিন্তার সক্ষমতা আর ঘটনাকে বোঝার সক্ষমতা– এই চেতনার ঐকতানকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে: এখানেই আমরা বসবাস করছি এবং একত্রে এটাকেই আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। এটি অদ্ভুত নয়। পুঁজিবাদীরা শতাব্দী ধরে সকল জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে– বৈশ্বিক পুঁজিবাদ এই হুমকিকে বিশ্বব্যাপী আরো বৃদ্ধি করছে। শিল্পায়ন এবং প্রকৃতির ধ্বংস, যুদ্ধ শরণার্থীর বেদনা, দারিদ্র্য, প্রতিযোগিতা এবং বেঁচে থাকার দৈনন্দিন সংগ্রাম আমাদের জীবনে মহামারির মতোই। আমাদেরকে অবশেষে প্রতিরোধ ও একে অপরকে সমর্থন করার নতুন উপায় শিখতে হবে।
রোমান্টিকরা কল্পনা করেন শহরের গুপ্ত জায়গাগুলোতে বাজেয়াপ্তকরণ আর গোপন যুদ্ধের মাধ্যমে প্রলেতারিয়েতরা বা প্লেবিয়ানরা সামাজিক বিদ্রোহ সম্পন্ন করবে। র্যাডিকেলরা পুঁজিবাদের পতন চান, সামাজিক-ন্যায়বিচার বিশ্লেষকরা সামরিকায়িত সমাজ, একটা টোটালেটারিয়ান দুনিয়ার পূর্বাভাস দেন।
এবং আমরা সকলেই ভাবি: ‘কিন্তু, এ কেমন জীবন?’
আমাদের মধ্যে যারা সামাজিক ন্যায়বিচারের ব্যাপারে উৎসাহী এবং কেবল নিজেদের বেঁচে থাকা নিয়ে নয়– তারা প্রতিনিয়তই এই মেশিনের ভুল, ভাঙা দান্তটি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমরা বেঁচে থাকার অন্য উপায় খুঁজছি, একটা নতুন ভাষা, নতুন অর্থ, নতুন সম্পর্ক এবং অন্যায়ে বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একে অপরের সাথে যুক্ত হওয়ার উপায় খুঁজছি। আমরা আজ যে অভিজ্ঞতা অর্জন করছি নিঃসন্দেহে তা আমাদের বদলে দেবে। আমরা উৎকৃষ্টের জন্য বদলাই, আমাদের সাথী মানবজাতির প্রতি দয়াশীল হই, এবং তাদের প্রতি ভীত বা বর্ণবাদী যেন না হই। মহানুভবতা হোক আমাদের জীবনের যাপনের একটি উপায়। এই শ্বাসরোধী-বিশ্ব প্রাণকে হত্যা করে আর পৃথিবীকে করে শিল্পায়িত, আমাদের তাই দরকার বাস্তুতান্ত্রিক সচেতনতা যাতে আমরা এই শ্বাসরোধী-বিশ্বে দম নিতে পারি। নিজেদেরকে পুনঃআবিষ্কৃত করা রাজনৈতিক জগতের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা আমাদের অস্তিত্ব ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে কি বুঝেছি এবং কি বুঝতে যাচ্ছি? আমরা নিজেদের সম্পর্কে কি বুঝতে যাচ্ছি? ব্যক্তিগত জটিলতা, সমস্যা এবং চাপ সবকিছুই আমাদেরকে এটি বোঝার সুযোগ করে দিচ্ছে যে:
মুক্তির (emancipation) মাধ্যমেই আমরা সম্প্রীতি লাভ করব।
এবং ‘মুক্তি’ মানে কী? নিঃশর্ত আত্ম-নিয়ন্ত্রণ (self-determination) – নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারা এবং যে সিদ্ধান্তগুলো অন্যের জন্যও মঙ্গলজনক বটে। কেউ আসলে প্রকৃতপক্ষে নিজেরটুকু নিয়ে সুখী থাকতে পারে না। একে অপরকে সাহায্য করার মাধ্যমে চরম আনন্দ লাভ প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ন্যায়সঙ্গত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করে।
কিন্তু এই মুহুর্তে আমি কি ভাবছি? এই মুহুর্তে পৃথিবী গভীরভাবে আহত, এবং আমি ভাবছি আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা? হ্যাঁ, তাঁর কারণ আমার শরীর এবং মন এই ভয়কে কাটাতে চাচ্ছে। আমি জানি একটি সম্পর্ক আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো মানবতা আর প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ক। আমাদের শরীর হলো মানুষ আর প্রকৃতির মাঝের ছেদ। এখন যখন আমাদের শরীর অসুস্থ হয়ে হয়ে পড়ছে তখন সমাজও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমাদের অবশ্যই আমাদের মনকে একদম কোনো ডিসটোপিয়ান আর শ্বাসরোধী-চিন্তা দিয়ে বিরক্ত করা যাবে না। আমি আশা করি অসুস্থ ও ভাইরাস বাহকের জন্য এর মর্যাদা সুরক্ষিত ও মজবুত রয়েছে, এবং তাদের সাথে যেন কীটপতঙ্গের মতো আচরণ না করি। আমার আশা হলো, আমরা করোনাভাইরাস রোগীদের সাথে যুদ্ধের শরণার্থীদের মতো আচরণ যেন আচরণ না করি; করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের এ লড়াই অন্যান্য আক্রান্তদের বেদনা ও যন্ত্রণা বোঝার সুযোগ করে দিবে।
কর্মক্ষেত্র এবং ভোগের স্থানগুলো এখন মৃত্যু ফাঁদ
এমন একটা দুনিয়ায় কোয়ারেন্টাইন অর্জন করা কীভাবে সম্ভব যেখানে কিনা আমাদের মৌলিক চাহিদা নির্ভর করে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর যার ভিত্তি হচ্ছে শোষণ ও উৎপাদনের হাতিয়ারসমূহের মালিকানা, এবং যার পণ্যের বাজার সরবরাহ মুনাফামুখী বক্তিমালিকানায় রয়েছে? খাদ্য সংগ্রহের জন্য এখন চাকরি আর সুপারমার্কেট প্রয়োজন। এই করোনাভাইরাস যুগে আমরা যেসব জায়গায় যেতে সর্বদা বাধ্য সেগুলোই ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাব্য উৎস। কাজের জায়গাগুলো, সুপারমার্কেটগুলো কোনো কারণে যদি আমরা সেসবে ভিড় জমাই।
খাবার কেনার ক্ষেত্রে আপনাকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে গ্লাভস পরার জন্য, অন্যান্য ক্রেতাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য, সার্জিকাল মাস্ক পরিধান করার জন্য। কিন্তু যদি আমাদের বাড়িতেই বাগান থাকত, আমাদের ছাদে, কিংবা চত্বরে কিংবা আশেপাশে? আমাদের মধ্যে কজনের ছোট মাঠ আছে, একটা শস্যক্ষেত্র যেখানে সবজি, ফল আর মসলা আছে– এগুলোই কী প্রাচীন এথেন্সে গণতন্ত্রের উত্থানের কারণ ছিল না? সামন্ততন্ত্র পরবর্তী আধুনিক মানুষ একপাক্ষিক আজ্ঞা পালনে বাধ্য, এক ধরনের কাজকর্ম করতে বাধ্য এবং সেটা হলো ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য শ্রম ও ভোগ করা, এবং নিজেদের অসীম সম্ভাবনা এবং আমাদের সামষ্টিক শক্তিকে দাবিয়ে রাখা।
এখন আমরা মুনাফা আর নিয়ন্ত্রণের এক জলাভূমিতে বাস করি। এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় অভ্যস্ত হতে হবে আমাদের বেঁচে থাকার সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান হিসেবে। আমরা আমাদের নিদারুণ যন্ত্রণা ও তিক্ত কাজে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি, টাকা দুর্লভ এবং কখনোই পর্যাপ্ত হয় না, সময় পার করা কঠিন হয়ে পড়ে– আমাদের কর্মক্ষেত্র আজ আমাদের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। যেখানে কোনো ‘অপ্রয়োজনীয় হাঁটাচলা নেই’, বরং আছে অনেক অপ্রয়োজনীয় এবং ভিত্তিহীন চাকরি, যেগুলোকরতে বাধ্য হয়েছি কেবল মুনাফার ইঞ্জিন সচল রাখার জন্য, তা আমাদের জমিন আর জীবন ধ্বংস করে হলেও।
তাদের প্রশ্ন করতে হবে যারা আমাদের জীবন ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে
এই মুহুর্তে বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করা এবং মুক্তির পথ খোঁজা অযৌক্তিক নয় । রাষ্ট্রগুলো ভাইরাস প্রতিরোধের যে ব্যবস্থাগুলো নিচ্ছে সেগুলো নিষ্ঠুর এবং অনেক ক্ষেত্রে ক্যু এর মতো ভয়ানক, এবং ক্ষেত্রে আংশিকভাবে– যেহেতু তারা প্রথম শ্রেণির নাগরিক যারা নয় (যেমন ঘরহীন, মানসিক অসুস্থ, দরিদ্র, কয়েদি, শরণার্থী এবং সামাজিকভাবে বর্জিত) তাদের খাদ্যাদি সরবরাহের ব্যাপারে থোড়াই কেয়ার করে এবং দিনের পর দিন কারারোধ আর পাগলামোর সীমানার মধ্যে কাজগুলো পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চোখে কোন মানুষগুলো পরজীবী, এবং ফলস্বরূপ স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থার নাগাল পেতে ব্যর্থ? তাদের সকলের কি থাকার মতো ঘর আছে? তারা কি সকলে কাজকর্ম ফেলে ঘরে বসে থাকতে পারে অথবা দুরবর্তী অবস্থান থেকে কাজ করতে পারে?
এই ভাইরাস থেকে সকল গণ ও বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী, সকল ফ্রীল্যান্সার এবং কৃষকদের রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এটি সম্ভব কেবল যদি রাষ্ট্র সকল ‘অপ্রয়োজনীয়’ ব্যয় বন্ধ করে, ‘বুলশিট’ কাজকর্ম বন্ধ করে এবং অর্থের বন্টন করে (আমাদেরই অর্থ!)– এই বন্টন হবে তরুণ, গৃহিণী, ডাক্তার, শিক্ষক, দরিদ্র শিল্পী, এবং সেই সকল মানুষের দেখভাল আর সাহায্যের জন্য যাদের আয় নষ্ট হয়েছে। ইউরোপে এমন অনেক ‘সাংস্কৃতিক’ অনুষ্ঠান আছে যেখানে কোটি কোটি ইউরো দেয়া হয় সাংস্কৃতিক এন্টারপ্রাইজ ও এনজিওগুলোকে ‘ইউরোপীয় মান’ অথবা ‘সংহতি’ এবং ‘লিঙ্গ ও জাতি’ অভিগম্যতার জন্য। সকল ভন্ডামিপূর্ণ স্লোগানের জন্য কোটি কোটি ডলার পায় বিনিয়োগকারী প্রতারকরা যারা অনুদানে খেয়ে পরে বাঁচে। আমাদের কি দাবি তোলা উচিত না এসব তহবিলগুলোকে করোনাভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্তদের সহযোগিতায় বন্টন করার জন্য এবং সামাজিক কাঠামোগুলো ঠিক করার জন্য যাতে আমরা একে অপরের দেখভাল করতে পারি কার্যকরীভাবে? আমাদের সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য সাথী মানবজাতিকে সাহায্য এবং রক্ষা করা ব্যতীত আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
এই ভাইরাসের বিস্তৃতি এবং এর প্রতিকারের ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় নিয়ে এই প্রশ্নগুলো জাগে: কি ধরনের ব্যবস্থাপনা আমরা চাই? কি ধরনের ব্যবস্থাপনা আমরা পেতে পারি? সিদ্ধান্ত কারা গ্রহণ করবে? নিশ্চয়ই আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করতে চাই যেখানে ভালো অবস্থা আর সমৃদ্ধি আছে, যেখানে আমরা স্বাস্থ্যবান এবং ভালো থাকবো। রাষ্ট্র, শাসক, পুঁজিবাদ কি সর্বনাশা আপস ছাড়া এমন ভালো জীবন দিতে পেরেছে? এখন কি তারা জনগণকে রক্ষা করতে সক্ষম? তারা কি সক্ষম এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে একটা নিরাপদ আর কম যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি তৈরি করতে? এটা কি বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ব্যর্থতার নির্দেশক নয় যা ক্রমাগত মানবিক, বাস্তুতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক আর সামাজিক সংকট আর দুর্যোগ তৈরি করছে? কি পরিমাণ ‘সংযম আর ধৈর্য’ আমরা সহ্য করব? আর কি পরিমাণ আনুগত্য আমরা ঐসব রাজনীতিবিদদের দেখাব যারা মানবজাতিকে উত্তম জগতে প্রবেশ করতে বাধাগ্রস্ত করে?
আমাদের জীবন আমাদেরই অধীনে
বাস্তবতার আরো সামগ্রিক একটা দৃশ্য আমাদের প্রয়োজন। টোটালেটারিয়ান যুগের ক্রান্তিতে মানবজাতি একটি বিরাট স্বাস্থ্য সংকটে পড়েছে। যারা আমাদের পরিচালিত করে তারা এই সংকট সমাধানের রাস্তা হিসেবে কেবল বেছে নিয়েছে- আদেশ দেয়া এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এর মাধ্যমে এত বছর ধরে তারা যা করেছে এবং যা করেনি তার দায় আমাদের উপর চাপাতে চায়। পুঁজিবাদের প্রয়োজন আমাদের জীবন ধ্বংস করা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্র নির্মিত দমনযন্ত্র। আমাদের দরকার সামাজিক স্থাপনাগুলোর সংহতি আর পারস্পরিক সহযোগিতা; আমাদের রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদ কোনোটারই দরকার নেই।
শাসকগোষ্ঠী একমাত্র পরামর্শ নেয়ার সাহস করে যেটা হলো সমাজের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। বাধ্যতামূলক কারাবাস চাপিয়ে দেয়া আমাদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করে যা আমাদের ব্যক্তিক স্বাধীনতার সম্পূর্ণ বিপরীত। ভবিষ্যত আমাদের জন্য কি রেখেছে? বিদ্যমান আর অবিদ্যমান শত্রুদের কাছে সকল ধরনের দাসত্ব করা? কে প্রত্যেকবার এই সমাজের শত্রুদেরবেছে নেয়?
মেডিক্যাল কোয়ারেন্টাইন গুরুত্বপূর্ণ, যদিওবা একইসময়ে এটি এক অস্বস্তি তৈরি করছে এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে। আমরা এমন এক অবস্থায় আছি যা এই অনিশ্চয়তাকে চিরস্থায়ী করছে আর সরকারকে অধিকার দিচ্ছে আমাদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার।
আমরা এমন এক মানবিক মানবসভ্যতা চাই যা আমাদের আবেগকে শ্রদ্ধা করবে। পারস্পরিক সহযোগিতা আমাদের একাকীত্ব আর ভয় থেকে মুক্ত করতে পারে। এটা এখন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে আমরা সকলে একত্রে ইতিহাসের একই অধ্যায়ে আছি, একই নৌকায়, এই ঝোড়ো সমুদ্রে। আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে, কিছু সময়ের জন্য একে অন্যের থেকে দূরে থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত আরোগ্য আর সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। আসুন, এই দিনগুলোকে ব্যবহার করি আমাদের চিন্তাভাবনার কর্তৃত্ববাদী দিককে চ্যালেঞ্জ করার জন্য, চিন্তা করি কিভাবে একটা সমাজ প্রত্যেক শহর আর গ্রামে আইসিইউ সুবিধাসহ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা দিতে পারে, যাতে অ-রক্ষিত জনগণকে সাহায্য করা যায়, যাতে আমাদের বার্তা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়, আমরা নিজেদের সাথে কিছু সময় পার করতে পারি, আমাদের কোনো কর্মকান্ড দ্বারা আমাদের সাথী মানুষদের জীবন বা স্বাস্থ্য বিপন্ন না হয়, নতুন দক্ষতা (পড়া, লেখা, আঁকা, সেলাই করা) আবিষ্কার করি, প্রয়োজনে আমাদের প্রতিবেশির জন্য রান্না করি, প্রাচীন ভেষজ উদ্ভিদদের নাম শিখি, আমাদের সঙ্গীদের থেরাপি মাসাজ প্রদান করি, ভালোবাসতে শিখি এবং আমাদের প্রিয়জনদের সাথে কথা বলি। এবং আমি এমন গোপন রীতির সন্ধান করছি যা আমার পরিবার ও আমাদের সকলকে এই মহামারি থেকে বাঁচাতে পারবে। এবং আমি কেবল একটাই পেয়েছি:
পর্যালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (critical thinking) আমাদের সবার জন্য জরুরি।
মিচুয়াল এইড- আসুন একে অপরকে যত্ন ও শক্তি প্রদান করি
করোনাভাইরাস কি বৈশ্বিক পুঁজিবাদ ধ্বংস করতে পারবে? আমি জানি না, আমি তা মনেও করি না। কিন্তু অন্তত এর কাঠামো আর উপকরণকে প্রশ্ন করুক; ক্ষমতায় যারা আছে তাদের দিকে আমাদের কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া উচিৎ এবং দাবি করা উচিত তৎক্ষণাৎ উত্তরের। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে যে জিনিসটি আমাদেরকে গ্রাস করছে সেটা হলো: প্রতিদিন টিকে থাকার উদ্বেগ; এটি আমাদের অসুস্থ করে তোলে। এই আতঙ্ক আর উদ্বেগ আমাদের সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রকে অধীন করে যা প্রকাশ করে এই শোষণবাদী আর কর্তৃত্ববাদী যুগে আমাদের উপর ভর করা অশুভ এবং আমাদের বেঁচে থাকতে বাধ্য করার কার্যকরী ব্যবস্থাপনার অপর্যাপ্ততা!
আমরা নিজেদের আরো নিরাপদ মনে করতাম যদি আমাদের দেশ এবং অন্যান্য দেশগুলো বছরের পর বছর জনস্বাস্থ্য ধ্বংস না করত, যদি আমরা জানতাম যে আমাদের ঘরে বিনামূল্যের বিদ্যুৎ, পানি আর টেলিফোন ব্যবস্থা রয়েছে, যদি প্রতিমাসে আমাদের বেতনের ৮০% বিভিন্ন ভাড়া আর বিল দিতে চলে না যেত। আমরা নিজেদের নিরাপদ মনে করতাম যদি আমাদের পর্যাপ্ত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র থাকত। যদি আমরা জানতাম একটা বিরাট সংখ্যক ডাক্তার, শিক্ষক, নার্স, রাধুনি, শিল্পি, কবি এবং সুখী দাদা-দাদি বাচ্চাদের রূপকথার গল্প শোনাত। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন জাগে কীভাবে বিভিন্ন সমাজ আসলে স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংকট কাটিয়ে ওঠে-কোনটিকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি আর কোনটিকে অর্থহীন মনে করি। আমরা কিভাবে জনগণের স্বাস্থ্যগত আর জীবন ধারণের উপাদান সরবরাহ করি? কিভাবে আমরা ফটকাবাজ, সুবিধাবাদী, শোষণবাদীদের হাত থেকে দুর্বল, গরীব আর বৃদ্ধদের রক্ষা করি? আমরা কিভাবে সামাজিক অবিচার থেকে এই পৃথিবীকে সারিয়ে তুলি?
এই উত্থানরত করোনাভাইরাস মহামারির মুখোমুখি হওয়া কেবল নিষেধাজ্ঞার ব্যাপার নয়, বরং দরকার চিকিৎসা আর ভ্যাক্সিন যা বিনামূল্যে সকলের জন্য বন্টন করা হবে; এটা প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং নিরাপত্তা সামগ্রীসহ স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাইভেট সেক্টরের ক্লিনিক প্রস্তুত করার বিষয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মানবসম্পদ প্রদান করে এবং নতুন পাবলিক হাসপাতাল তৈরি করার মাধ্যমে। আমাদের প্রয়োজন সকলের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা-প্রত্যেকের অধিকার আছে সে সুস্থ কি অসুস্থ তা জানার। চলুন সাহসী হই আর ভাবি: আমাদের জীবন ধারণের শর্ত পরিবর্তিত হচ্ছে, আজকে আমাদের বেঁচে থাকার নতুন এক পরিকল্পনা চালু করতে হবে। সমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে দিই, শাসকদের নয়। অবশ্যই এখন থেকেই যারা ‘প্রাইভেট হাসপাতাল’ এর কথা বলবে তারা অপরাধী গণ্য হবে। যতক্ষণ না এই সংকট শেষ হয় ভাড়াটিয়ারা কোনো ভাড়া প্রদান করবে না এবং মহামারি শেষে ভাড়ার একটি অংশ কমানোর দাবি করবে। পুরো পৃথিবীজুড়ে বিশাল ভাড়া ধর্মঘট চলছে। আমাদের দায়িত্ব এটিকে সমর্থন করা।
আসুন আমরা আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা আর প্রশংসা প্রকাশ করি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের, মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের, কল্যাণের জন্য কাজ করা লোকজন, যারা নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করছে এবং যারা নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে রাখছে মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য, এবং আশপাশের লোকজনকে যারা অন্যের বেদনাকে কমানোর চেষ্টা করছে তাদের প্রতি। এফিনিটি গ্রুপ হিসেবে ভয়েড নেটওয়ার্ক শপথ নেয় যে আমরা সংগ্রাম করব তাদের জন্য যারা বিভিন্নভাবে সকলকে সাহায্য করছে, করবে।
এটাই আমাদের প্রয়োজন– যত্ন আর চিকিৎসা।দীর্ঘজীবী হোক মানব স্বাধীনতা, সমতা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ভালোবাসা।
আমরা প্রত্যেকেই এক একটা গল্প বহন করি, আমাদের বেদনার গল্প। এখন আমাদের সকলের একটি সাধারণ ইতিহাস আছে। আসুন এই সময়টাকে পৃথিবীকে ভালোভাবে বোঝার কাজে ব্যবহার করি। এই অভিযান শেষ হবে, আসুন আমরা নিজেদের উন্নত করার চেষ্টা করি, নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করি, সামাজিক কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করি যাতে একটি নৈতিক আর সহযোগিতামূলক পৃথিবী গড়ে তুলি, যে পৃথিবী সামাজিক অবিচার, অসাম্য আর স্বাধীনতা-দমনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
এতে ধৈর্য লাগবে, আমাদের জীবনকে নতুন এক উপায়ে দেখতে হবে। নিশ্চিত আমরা আবার মিলিত হবো। আসুন আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো কেবল ভালোবাসা আর উদারতার ভিত্তিতে তৈরি করি।
আমরা আবারো একে অপরকে আলিঙ্গন করব!