- অনুবাদ: মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার
অনুবাদকের ভূমিকা: মানব শিশু কিভাবে বড় হয়ে উঠবে? এই প্রশ্নের উপরে হয়তো আজকে এই ২০১৯ সালেই হাজার হাজার লেখা পাওয়া যাবে, হাজার হাজার মতামত পাওয়া যাবে। বিশেষত আজকের পুঁজিবাদী সমাজের ইঁদুর দৌড়ের মাঝে শিশুকে বড় করে তোলা যেনো একটা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগে ২০১৫ সালে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, তাঁর প্রবন্ধে ফার্স্ট বয়’দের দেশ হিসাবে ভারত কে উল্লেখ করেছেন যেখানে একদিকে কোটি কোটি শিশু শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবে শারীরিক ভাবে বৃদ্ধিরহিত বামন হয়ে থাকে সারা জীবন আর অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ পিতা-মাতা নিজের ছেলে-মেয়েকে ‘ফার্স্ট বয়’ বা ‘ফার্স্ট গার্ল’ বানানোর জন্যে দিনরাত দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশেও শিশুর বড় হয়ে ওঠা নিয়ে চলছে নানান সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আধুনিক পিতা-মাতা নিজের শিশুকে ‘শ্রেষ্ঠ’ হিসাবে গড়ে তুলতে তার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছেন পিতা-মাতার সকল আকাঙ্ক্ষার বোঝা। শিশু বড় হয়ে উঠছে পিতা-মাতার আকাঙ্ক্ষার আদলে, তার নিজের মতো করে নয়। এটা কি স্বাভাবিক? আজ থেকে প্রায় একশো তেরো বছর আগে এমা গোল্ডম্যান এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন এবং শুধু প্রশ্ন তুলেছিলেন তা নয়, তিনি প্রশ্নটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। শিশু কিভাবে বড় হয়ে উঠবে, এই প্রসঙ্গে তাঁর একটা সহজ সরল কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত, সৃজনশীল ব্যাখ্যা হাজির করেছেন এমা তাঁর এই প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধটির আগ্রহী পাঠ আমাদেরকে আমাদের বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে। অনুবাদটিতে মূল প্রবন্ধের অনুগামী থাকার চেষ্টা করা হয়েছে প্রায় একশোভাগ, কেবল কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাঠযোগ্যতার কথা স্মরণ করে কিছু বাংলা প্রবাদ-প্রবচন ও বাংলা কথ্য ঢংকে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রবন্ধটির মতামত এমা গোল্ডম্যানের, সে বিষয়ে অনুবাদকের দায় নেই, কিন্তু অনুবাদ সংক্রান্ত যেকোনো মতামত সাদরে গৃহীত হবে।
মূল প্রবন্ধ
শিশুকে কি আমরা একজন আলাদা ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য করবো? নাকি তাকে কেবলই কোনো একটা নরম বস্তু হিসাবে গণ্য করবো যাকে ইচ্ছেমতো দলাই-মলাই করা যায়, ইচ্ছেমতো ভাঙ্গা ও গড়া যায়? শিশু প্রসঙ্গে এটাই আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে হয় শিশুর মাতা-পিতা ও শিক্ষকদের কাছে। এবং আরও যে প্রশ্নগুলো জরুরি তা হচ্ছে – শিশুর বেড়ে ওঠাটা কি তার নিজের ভেতর থেকে হয়ে উঠবে, তার যাবতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশকে কি দিনের আলো দেখতে দেয়া হবে? নাকি আটার খামিরের দলার মতো তাকে বাইরের শক্তি দিয়ে নিজেদের ইচ্ছা মতো নানান দিক থেকে দলে মথে তৈরি করা হবে, এই সকল প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে শিশুকে আমরা আসলে কি মনে করি তার উপরে।
আমাদের সময়ের সেরা ও মহৎ আকাঙ্ক্ষা গুলো গড়ে ওঠে কেবল শক্তিমান ব্যক্তিত্বদের জন্যে। যেকোনো সংবেদনশীল মানুষই নিজেকে একটা মেশিন কিংবা একটা তোতাপাখির মতো প্রথাগত ভাবতে ঘৃণা করে। প্রত্যেকটি মানুষই তার নিজস্বতার স্বীকৃতি দাবী করে, তার নিজের স্বকীয়তাকে ভালোবাসে।
আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার যে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকেই তার বড় হয়ে ওঠার পরিক্রমায় তার সন্তানের মতো শৈশবের মধ্যে দিয়েই যেতে হয়েছে, এবং শিশুকে স্কুল ও পরিবারের পরিবেশের মধ্যে দিয়ে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে আমরা এই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরাই, এমন কি উদারনৈতিক ও বিপ্লবী পরিবারেও প্রায়শই তার প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বিকাশের গতিরোধ করে দাঁড়াই কিংবা তার বিকাশকে গলা টিপে ধরি।
আমাদের সময়ের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, পরিবার, রাষ্ট্র কিংবা আমাদের নৈতিক বিধিবিধানের কাছে যেকোনো শক্তিমান, সুন্দর ও আপসহীন ব্যক্তিত্ব হচ্ছে এক রকমের ভয়ঙ্কর শত্রুর মতন, ফলে এই সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শিশুর নবজাতক অবস্থা থেকেই তাকে একটা গড়পড়তা জামা পরিয়ে দেয়ার চেষ্টার শুরু হয়, তার মানবিক আবেগ কিংবা চিন্তার মৌলিকতাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়ে থাকে একেবারে গোড়া থেকেই, তার সকল মৌলিকত্বকে ধ্বংস করে দিয়ে তাকে আর দশজন আটপৌরে মানুষের মতো একই কাঠামোতে গড়ে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টার শুরু হয়, খুব অনুগত দাসের মতন, খুব পেশাদার যান্ত্রিক মানুষের মতো, সুবোধ করদাতা নাগরিক এবং প্রথাগত নীতিনৈতিকতার পুজারি হিসাবে তাকে গড়ে তোলার সকল আয়োজন করা হয়ে থাকে। এতো সব আয়োজনের মধ্যে দিয়ে যদি কোনও একজন খানিকটা আলাদা হয়ে, খানিকটা মৌলিকত্ব নিয়ে, স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে বড় হয়ে ওঠে (যদিও এটা একটা বিরল ঘটনা আমাদের চারপাশে) সেটা আসলে আমাদের সন্তান প্রতিপালনের পদ্ধতি বা অনুশীলনের কারণে নয়, আমাদের শিশু শিক্ষার পদ্ধতির কারণে নয়, বরং এই ধরনের ব্যক্তিত্ব প্রায়শই পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধাকে অতিক্রম করেই গড়ে ওঠে। কোনো শিশুর এই ধরনের ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে ওঠাকে বরং একটা অস্বাভাবিক অর্জন হিসাবে উদযাপন করা দরকার, অভিনন্দিত করা দরকার, কেননা শিশুর বড় হয়ে ওঠার পথে এতো এতোসব পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক বাধা বিছিয়ে দেয়া থাকে যে এসব অতিক্রম করে যদি কেউ তার শক্তি, সামর্থ্য, ব্যক্তিত্ব আর সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে পারে এবং এসব নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে, তাহলে এই ঘটনাকে বরং একটা ‘মিরাকল’ বা অলৌকিক ঘটনা হিসাবেই দেখা দরকার।
প্রকৃতপক্ষে, সমাজের প্রথাগত অংশের চিন্তাহীনতা আর নির্বুদ্ধিতা থেকে যে নিজেকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে পেরেছে তার দাঁড়ানোর জন্যে সমাজের নীতি-নৈতিকতার স্তম্ভের উপরে ভর করতে হয় না, আম-জনতার মতামতের উপরে ভরসা করতে হয় না, ফ্রেড্রিখ নিটশে যাকে তুলনা করেছিলেন দারুণ উচ্চস্বরে বেজে চলা স্বাধীনতা আর মুক্তির এক অবিরাম সঙ্গীতের সাথে, এই স্বাধীনতা আর মুক্তির গান গাইবার অধিকার শুধু তাদেরই প্রাপ্য যারা তা অর্জনের তুমুল সংগ্রাম ও যুদ্ধটা করে। আমাদের সমাজে এই যুদ্ধটা শুরু হয় শিশুর একেবারে কাঁচা বয়স থেকেই।
যেকোনো শিশু সাধারণত তার ব্যক্তিগত প্রবণতা গুলোর প্রকাশ শুরু করে তার খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে, চারপাশের মানুষের কাছে করা তার নানান প্রশ্নের মধ্য দিয়ে, চারপাশের মানুষের সাথে ও বিভিন্ন বস্তু, উপাদানের সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু শিশুকে তার নিজের এই প্রকাশের পরিক্রমায় সারাজীবন ধরে মোকাবিলা করতে হয় নানান ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে, তার চলাচলের বিরুদ্ধে, চিন্তার বিরুদ্ধে কিংবা তার আবেগের বিরুদ্ধে এই সকল হস্তক্ষেপ। শিশু যেনো কখনই তার নিজের চারপাশের প্রকৃতির সাথে নিজের বেড়ে ওঠাকে প্রকাশ না করে, তার নিজের ব্যক্তিত্ব আর তার বড় হয়ে ওঠার মাঝে যেনো কোনো ঐকতান না থাকে, শিশুকে যেনো কেবল একটা বস্তু, একখন্ড মাংসের দলা হয়ে বড় হতে হবে। শিশুর হাজারটা প্রশ্নের উত্তর গুলো হয় খুবই সংকীর্ণ, প্রথাগত আর হাস্যকর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব তাড়াহুড়ো করে ভুলভাল উত্তর দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয় তার। সহজ সরল বড় বড় চোখ করে অবাক হয়ে সারা দুনিয়ার সকল বিস্ময়কে যখন সে বুঝে নিতে চায়, জেনে নিতে চায় তখন তার মুখের উপরে জানালাটা বন্ধ করে দেয়া হয়, দরোজাটা ছিটিকিনি দিয়ে আটকে দেয়া হয় আর তাকে বন্দি করা হয় বাসার ভেতরে নিরাপদ এক উষ্ণ ‘গ্রীন হাউজে’ যেনো সে একটা বনসাই এর মতো যার স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার নেই, স্বাধীন ভাবে বড় হয়ে ওঠার অধিকার নেই।
এমিল জোলা তার উপন্যাস Fecundity তে দেখিয়েছেন, একটা বিরাট অংশের মানুষ আসলে ইতিমধ্যেই মানব সন্তানের মৃত্যু ঘোষণা করেছে, মানব সন্তান ভুমিষ্ট হবার বিরুদ্ধে সকল ধরনের ষড়যন্ত্রের আয়োজন ইতিমধ্যে শেষ করেছে, সন্দেহাতীত ভাবেই খুবই ভয়ঙ্কর চিত্র এটি, এই ধরনের নানান ষড়যন্ত্র আমাদের জীবনে প্রবেশ করছে সভ্যতার নামে আর কাজ করছে মানুষের বিকাশের বিরুদ্ধে, মানব সন্তানের বড় হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে, এটা বরং আমার মতে আরও ভয়ংকর ও ধংসাত্মক মনে হয়, কেননা এই সকল ষড়যন্ত্র আমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হয় খুব ধীরে ধীরে আর মানব শিশুর উপরে এর ধ্বংসাত্মক ভূমিকাটি কাজ করে একটু একটু করে, সামাজিক প্রাণী হিসাবে তাকে ক্রমশ নির্বোধ আর বেকুব করে গড়ে তোলে, তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে করে তোলে খোড়া মানুষ হিসাবে।
যেহেতু আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই আমাদের শিশুকে গড়ে তোলে একজন আত্মঅসচেতন মানুষ হিসাবে, সে নিজের কাছেই একজন অচেনা মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে তাই অবশ্যম্ভাবী ভাবেই সে তার চারপাশের মানুষের কাছেও একজন অচেনা মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে, অর্থাৎ আমরা আমাদের বড় হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে আসলে একেকজন অচেনা মানুষে পরিণত হই আর এই অচেনা মানুষেরা তাই বড় হয়ে ওঠেন একে অপরের বিরোধী হিসাবে।
আমাদের সমাজের একজন সাধারণ গড়পড়তা শিক্ষক আসলে একজন সম্পূর্ণ মানুষ নন, তিনি তার চিন্তাভাবনায় একজন মৌলিক মানুষ নন, বরং শিক্ষক হিসাবে তাঁর সকল কলা ও শৈলী নিয়ে তাঁর প্রাণান্ত চেষ্টা থাকে কিভাবে সমাজের ইতিমধ্যেই বানানো কাঠামোর মধ্যে নিজেকে একজন একনিষ্ঠ যন্ত্রমানব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, কিভাবে আমাদের ফাঁপা সমাজের সকল নির্বুদ্ধিতা আর মূল্যবোধের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলা যায়। প্রতিটি বাড়ি, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল পরিমাণে শুষ্ক, শীতল উপযোগবাদী ধারণাগুলো দিয়ে, বিগত প্রজন্মের উপচে পড়া এই সকল ধারণা, চর্চা আর অনুশীলন দিয়ে ভরে তোলা হয় ছাত্রদের মাথাগুলো। ‘ফ্যাক্টস এবং ডেটা’ অর্থাৎ তথ্য ও উপাত্ত, যেভাবে বলা হয় এখনকার সময়ে, এই ‘ফ্যাক্টস এবং ডেটা’র মাঝে আসলে বিপুল পরিমাণে তথ্য ও পরিসংখ্যান থাকে যা দিয়ে অনায়াসেই একটা কর্তৃত্ববাদকে বজায় রাখা যায়, জায়েজ করা যায়, দখলদারিত্ব সম্পর্কে এক ধরনের সম্মতি উৎপাদন করা যায়, এবং সেই সাথে এটা আসলে মানব আত্মার এবং পৃথিবীতে এর অবস্থান সম্পর্কে সত্যিকারের বোঝাপড়া তৈরি করার জন্য একটা বিরাট প্রতিবন্ধকতাও।
আমাদের জগতে সত্য অনেক আগেই বিস্মৃত হয়েছে, এর মৃত্যু হয়েছে আর তাই দুনিয়া ও মানুষ সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো এখনো ছাঁচে বাঁধা, এমন কি আমাদের দাদিমা’র আমলের ধারণাগুলোকেও আমাদের তরুণ সমাজের মাথায় হাতুড়িপেটা করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। নিয়ত পরিবর্তন, হাজার রকমের বৈচিত্রময়তা আর নিরন্তর সৃজনশীলতা হচ্ছে আমাদের জীবনের প্রাণ। আমাদের কালের পেশাদার শিক্ষকতা এসবের কিছুই জানে না, পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটিকেই সাজানো হয়েছে নথি, শ্রেণী আর সংখ্যার ভিত্তিতে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই উর্বর সম্ভাবনাময় বীজ নেই যা এক সমৃদ্ধ মাটিতে রোপিত হয়ে একদিন হয়ে উঠবে এক বিশালদেহী মহীরুহ, এরা নিঃশেষ, অক্ষম অসমর্থ, মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততকে জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা এঁদের নেই। শিক্ষক, উপদেশক, অধ্যাপক এঁদের আত্মা মরে গেছে, এঁরা তাই মৃত আত্মা আর মৃত মূল্যবোধ নিয়ে চলছেন। গুণগত মানের যায়গা দখল করেছে সংখ্যার হিসাবনিকাশ। এর পরিণতি তাই অনিবার্য।
যেদিকেই তাকাই না কেনো, অধীর আগ্রহ নিয়ে অনুসন্ধান করি, একজন মানুষ খুঁজে পাওয়ার জন্যে যিনি মানুষের চিন্তাকে, আবেগকে, অনুসন্ধিৎসাকে যুক্তিতর্কের গজ ফিতা দিয়ে মাপজোখ করবেননা, খুঁজি এমন মানুষ যিনি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের সাথে বিরোধ বোধ করবেন না, স্বাধীন মানুষের বৈশিষ্ট্যের সাথে বিরোধ বোধ করবেন না, বরং বিরোধ বোধ করবেন ‘ঝাঁকের কৈ’ এর কসরতের সঙ্গে।
কোথাও কোনো অবশেষ আর দেখি না যাকিছু প্রাণের অবয়ব সব যেনো শুধু কসরত আর কিছুই নয়
ফাউস্ট এর এই কথাগুলো যেনো আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিকেই চিত্রায়িত করছে একেবারে নিখুঁত ভাবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যেভাবে ইতিহাস পড়ানো হয় তার কথাই ধরুন। দেখবেন ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা সেখানে এমন ভাবে দেয়া আছে যে মনে হবে পৃথিবীটা যেনো কোনো একটা সস্তা পুতুল নাচের প্রদর্শনী। যেনো কয়েকজন বাজিগরের হাতে দায়িত্ব পড়েছে সারাদুনিয়াকে আর মনুষ্য প্রজাতিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার, তাদের ভবিষ্যত গড়ে দেবার।
আর আছে আরেক বুলি – ‘আমাদের নিজেদের জাতির ইতিহাস’ ! আমাদের দূরদর্শিতা কি আমাদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেনি? আর এটা কি আমাদেরকে অন্য জাতিসমূহের উচ্চতার চাইতে পাহাড়সম তফাৎ গড়ে দেয়নি? জাতিগত ভাবে আমরা কি সাগরের মুক্তর মতো নয়? আমার জাতি কি অতুলনীয় নয়? তুলনাহীন সৌভাগ্যবান, আদর্শ আর সাহসী জাতি নয়? এই সকল হাস্যকর শিক্ষার ফলাফল হচ্ছে নির্বোধ অগভীর দেশপ্রেম, যা এর সীমাবদ্ধতার কাছেই দারুন ভাবে অন্ধ আর ষাঁড়ের মতো জেদী, গোঁয়ার, ফলে অন্য জাতিসমূহের শক্তি, ক্ষমতা ও মেধার বিচার করতে সম্পূর্ণ অসমর্থ, ব্যর্থ। আর এভাবেই কিছু মানুষের নিজেদের মূল্যবোধের বাড়াবাড়ি হিসাবনিকাশ দিয়ে আমাদের তরুন সমাজকে করে তোলা হচ্ছে বীর্যহীন মৃতপ্রাণ সত্ত্বা। আর এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই যে এসব বিষয়ে আমজনতার সম্মতি উৎপাদন খুব কঠিন কোনো কাজ নয়।
‘প্রাকহজমকৃত খাবার’ এর মতোই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সবাইকে সাবধান করে দেয়া দরকার, যারা বিরাট সব ফাঁপা, উপরভাসা অর্জনে সন্তুষ্ট হয় তাদেরকে হয়তো নয়, বরং যারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব আর মৌলিক বিচার-বুদ্ধিকে হারাতে চায়বনা তাঁদেরকে সাবধান করে দেয়া দরকার জীবনে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে। জীবনের প্রতিটি স্তরে থরে থরে যে সকল বাধা সাজানো থাকে মানব শিশুর স্বাধীন বিকাশের পথে, সেসবের কথা মনে করিয়ে দেয়াটাই হয়তো যথেষ্ট হতে পারে এক্ষেত্রে।
একই রকমের এবং গুরুত্বের দিক থেকে মোটেও খাটো নয় এমন অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা সাজানো থাকে কৈশোর আর তারুণ্যে আবেগঘন দিনগুলোতে। এই সময় বাবা-মায়ের কি উচিৎ নয় তাদের সন্তানের সবচাইতে সূক্ষ্ম সংবেদনশীল আবেগপ্রবণ বিষয়গুলোর সাথে নিজেদেরকে একতারে বাঁধা? সবাই একমত হবেন, হ্যাঁ সেটাই তো করা উচিৎ, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাবা-মা’ই হচ্ছেন দুনিয়ার প্রথম ব্যক্তি যারা খুব শক্ত হাতে তাদের সন্তানের আবেগগুলোকে, সংবেদনশীল ভাবনাগুলোকে ধ্বংস করে থাকেন, দমন করে থাকেন।
ধর্মগ্রন্থগুলো আমাদেরকে বলেছে যে ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার নিজের অবয়বের মতো করে, যদিও সেটা কোনো ভাবেই একটা সফলতা হিসাবে প্রমাণিত হয়নি। মাতা-পিতারা তাঁদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছেন তাঁদের স্বর্গীয় স্রষ্টাকে অনুসরণ করতে, তাঁরা সকল ভাবেই চেষ্টা করেছেন তাঁদের সন্তানদের নিজেদের মতো করে, নিজেদের ছাঁচে ও আকৃতিতে বড় করে তোলার জন্যে। মা-বাবা প্রায় এক রকমের নাছোড়বান্দার মতো তাঁদের ধারণাকে আকড়ে ধরে রাখেন যে সন্তান আসলে তাঁদেরই একটা বর্ধিত অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়, এটা শুধু একটা ভুল ধারনাই নয় বরং একটা ভয়ংকর ক্ষতিকর ধারণা এবং এই ধারণা শিশুর মনস্তত্ত্ব, শিশুর প্রাণকে না বোঝার বা ভুল বোঝার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুনে আর এর ফলে যা হয় তা হচ্ছে শিশু হয়ে ওঠে বাবা-মায়ের অধীন দাসের মতন।
শিশুর মন যখনই প্রথমবারের মতো সচেতনতার, তার নিজের বিবেচনাবোধের আলোয় আলোকিত হয়, সহজাত ভাবেই সে তার নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে চারপাশের মানুষের তুলনা করতে শুরু করে। কত হাজার শক্ত শীতল পাথুরে খাঁজের ভেতরে দিয়ে সে তাকিয়ে থাকে তার বিস্ময়াভিভূত বড় বড় চোখ গুলো দিয়ে, তার কোনো হিসেব আছে? কিন্তু খুব শিগগিরই সে টের পায় এই স্বাধীনতা তার জন্যে নয়, সে এখানে এসেছে কেবল একটা বস্তু হিসাবে, তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকের হাতের পুতুল হয়ে, যারা তাকে আকৃতি দেবার মালিক, গড়ে তুলবার কর্তৃপক্ষ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক প্রথার বিরুদ্ধে চিন্তক মানুষের যে ভয়াবহ সংগ্রাম তার শুরুটা হয় পরিবার থেকেই, সেখানে শিশুকেও শুরু করতে হয় তার নিজের সংগ্রাম, ভেতরের এবং বাইরের শক্তির বিরুদ্ধে। খুব সরাসরি উপদেশগুলো হচ্ছে এরকমের – ‘তুমি এটা করবে’, ‘তুমি অবশ্যই…’, ‘এটা সঠিক’, ‘এটা ভুল’, ‘এটা সত্য’, ‘এটা মিথ্যা’ এহেন আরও হাজারটা বাণী, যেনো এক নরম অপরিণত মাথায় বুনো ফোঁটার বৃষ্টির মত করে ঝরে পড়া উপদেশের বোঝা আর নিজের সংবেদনশীলতাকে বোঝার আগেই, তার প্রভাব অনুভব করার আগেই তাকে মাথা নত করতে হয় বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস আর আবেগের কাছে। এতসব কিছুর পরেও শিশুর সুপ্ত গুণাবলী, তার সহজাত প্রবৃত্তি আর এসব মিলিয়ে গড়ে ওঠা তার এক অদ্ভুত পদ্ধতি দিয়ে সে বুঝে নিতে চায় চারপাশের সবকিছুকে, সবকিছুর পেছনের কারণ, ভিত্তিকে, সে বুঝে নিতে চায় সাধারণ ভাবে যাকে বলা হয় ভুল কিংবা সত্য বা মিথ্যা ইত্যাদিকে। সে তার চলার পথে নতজানু হয় বটে, কেননা সেতো তার পিতা-মাতা বা অভিভাবকের মতোই একই রক্ত – মাংশ আর স্নায়ু দিয়ে গড়া, যারা তার ভবিষ্যত নিয়তি ঠিক করে দেয়। আমি সত্যিই বুঝি না পিতা-মাতা কি করে আশা করেন যে তাঁদের সন্তানেরা স্বাধীন সত্ত্বা আর আত্মমর্যাদা নিয়ে বড় হয়ে উঠবে যখন তাঁরা নিজেরাই পদে পদে তাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেন, তাঁদের সন্তানদের নানান ধরনের কার্যক্রম আর সক্রিয়তাকে সীমাবদ্ধ করেন আর এর সাথে যখন যুক্ত হয় সন্তানদের গুণাবলী আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা আসলে তাদের সাথে তাদের পিতা-মাতা’দের তফাৎ গড়ে দেয় আর এই গুণাবলীর উপরে ভর করে সন্তানেরা হয়ে ওঠে দুর্দান্ত চিন্তা-ভাবনার বাহক। ভেবে দেখুন, দারুণ সম্ভাবনাময় সতেজ কোনো একটা ছোট্ট গাছকে স্বাধীনভাবে, প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠতে দেয়ার বদলে যখন বাগানের মালি নিজের পছন্দ মতো আকৃতিতে বেঁধে রাখার জন্যে নিয়মিত কেটে ছেঁটে রাখেন, একটা কৃত্রিম আকৃতিতে বা অঙ্গ সৌষ্ঠবে ধরে রাখার জন্যে, এই কাটা-ছাঁটার জন্যে সেই গাছটি কখনই তার মহীরুহ হবার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারে না, অর্জন করতে পারে না তার নিজের কাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্যকে।
শিশু যখন তার শৈশব পেরিয়ে কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছায়, তখন তার উপরে আরও বিশাল আকৃতির বোঝা যুক্ত হয়, পরিবার আর স্কুলের নানান সব বিধিনিষেধের সাথে যুক্ত হয় কঠিন কঠিন সব সামাজিক নৈতিক প্রথা আর বিধিনিষেধ। বয়ঃসন্ধিকালে প্রেম আর যৌনতার জন্যে যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে দমন করা হয় সটান অজ্ঞানতা দিয়ে আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অজ্ঞানতাকে নিশ্চিত করেন স্বয়ং পিতা-মাতা, যারা মনে করেন বয়সের এই চাওয়া হচ্ছে অযথাযথ, অসভ্যতা, লজ্জাজনক, এমন কি এক ধরনের অপরাধের মতোই, তাই একে চেপে রাখতে হবে, এই আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে এক রকমের যুদ্ধ করতে হবে, যেমনটা যুদ্ধ করতে হয় ভয়ঙ্কর কোনো রোগবালাইয়ের বিরুদ্ধে। পিতা-মাতা আর এই সকল অভিভাবকদের স্থুলতা আর নির্বুদ্ধিতার জন্যেই ভালোবাসার মতো কোমল অনুভূতিও পরিণত হয় স্থুল কুরুচিতে, ভালগার অমার্জিত বোধে, ফলে যা কিছু সুন্দর, সুকুমার তার সবকিছুকেই হয় একসাথে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় নয়তো লুকিয়ে রাখতে হয় গভীর সঙ্গোপনে, যেনো এক বিরাট পাপকে লুকিয়ে রাখা, দিনের আলো দেখার অধিকার যার নেই।
সবচাইতে বিস্ময়কর যে ব্যাপারটি তা হলো, সন্তানের জন্যে মা-বাবার ব্যক্তিগত ত্যাগের দিকটি, মা-বাবা তাদের সন্তানের জন্যে নিজের জীবনপণ করেন প্রায়শই, সন্তানের যেকোনো শারীরিক অসুস্থতার সময় নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেন, দুশ্চিন্তা আর বেদনা নিয়ে রাতের পর রাত জেগে থাকেন সন্তানের জন্য, কিন্তু এই মা-বাবাই আবার দারুণ শীতল আর পাথুরে শক্ত হয়ে যান সন্তানের প্রাণের চাওয়াগুলোর ব্যাপারে, তার আবেগের আকুলতা ও আকাঙ্ক্ষা গুলোর ব্যাপারে, যখন তরুণ মন সত্যিই ব্যাকুল হয়ে প্রত্যাশা করে পিতা-মাতার স্বীকৃতি।
আর এসবের পরেও অনেক পিতা-মাতা মনে করেন তাঁরাই মনে হয় সন্তানের সবচাইতে ভালোটা চান, আমি বিশ্বাস করি, কেউ কেউ হয়তো সত্যিই তাই চান, কিন্তু মোটের উপরে তাদের এই ভালো চাওয়া হচ্ছে সন্তানটিকে একটা কচি চারাগাছের অবস্থানে মেরে ফেলা, কিংবা কুঁড়িতেই ধ্বংস করে দেয়া। কেননা তারা তাদের সারাজীবন ধরে কেবল তাদের পথ প্রদর্শকদের অনুকরণই করে যায়, রাষ্ট্র, সমাজ, নৈতিক ব্যাপার-স্যাপার, বাণিজ্য ইত্যাদি সকল বিষয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেদের স্বাধীন মতামত কে দমিয়ে রাখে, চেপে রাখে, সমাজের যাবতীয় দূর্বৃত্তায়নকে সম্পর্কে নিজের মতামত কে চেপে রাখে, এই সকল দুর্নীতি – দুর্বৃত্তায়নকে বিশ্লেষণ ও তার অবসানের জন্যে সকল রকমের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাকে চেপে রাখে, এই অন্তর্গত সত্যকে তারা কখনও বুঝতেই পারে না যে তাদের প্রতিটি প্রচেষ্টা, প্রতিটি পদক্ষেপ, এক বিপুল উদ্দীপনা তৈরী করতে পারে যা আসলে মানুষকে তার কাংখিত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত করে, এগিয়ে দেয় এই স্বাধীনতা অর্জনের বৃহত্তর সংগ্রামের দিকে।
পিতা-মাতা এবং প্রতিটি শিক্ষকেরই জানা থাকা দরকার যে, এই ধরনের বাধ্যবাধকতা প্রতিরোধকেই জাগিয়ে তোলে। আমাদের বাস্তবতায় এটাও দারুণ একটা বিস্ময়ের ব্যাপার যে বেশিরভাগ বিপ্লবী ও প্রগতিশীল পিতা-মাতার সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ের মতামতের একেবারে বিপরীত মতামত ধারন করে, এঁদের কেউ কেউ হয়তো একেবারেই মান্ধাতার আমলের মতামত পোষণ করে থাকে কিংবা অনেকেই সমাজ বদলের এই নতুন ধারণাগুলো সম্পর্কে একেবারেই নিরাসক্ত থাকে। এবং এটা এমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিপ্লবী বা প্রগতিশীল পিতামাতারা যদিও নিজেরা মানুষের উপরে মানুষের দখলদারিত্বের ধারণা থেকে মুক্ত হয়েছেন, তারপরেও তারা অনেকটাই একগুঁয়ের মতো নিজের সন্তানের উপরে অধিকারবোধ ফলাতে কসুর করেন না, তার উপরে কর্তৃত্ব ফলানোকে অনেকটাই অধিকার মনে করেন। ফলে সন্তানকে বড়ো করে তোলার জন্যে তাঁরাও এক ধরনের ছাঁচ তৈরি করে নেন তাদের মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে, তাদের চিন্তাচেতনার উপর ভর করে, তাদের ভালো-মন্দ বোধের উপরে ভর করে গড়ে তোলেন এই ছাঁচ। আর তারপর এই ছাঁচ আরোপ করেন সন্তানের উপরে ঠিক একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান বা ধার্মিক পিতা-মাতা যেভাবে তাদের মূল্যবোধ চাপিয়ে দেন সন্তানের উপর। ঠিক যেভাবে ধার্মিক পিতা-মাতারা বলেন, ‘আমি যেভাবে বলি সেভাবে কর, আমি যেভাবে করি সেভাবে নয়’। কিন্তু অনুভূতিপ্রবণ শিশুর মন ঠিকই বুঝতে পারে যে তার পিতামাতার জীবন নানান স্ববিরোধীতায় পূর্ণ, যে চিন্তা তাঁরা ধারণ করেন তার সাথে তাদের যাপিত জীবনের রয়েছে নানান তফাৎ। তারা দেখে, তাদের পিতা-মাতা, রবিবারে খুব ভালো খ্রিষ্টানের ভুমিকা পালন করলেও সপ্তাহের অন্যান্য দিন সবসময় খুব উৎকৃষ্ট খ্রিস্টান হিসাবে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারেন না, সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে তাই ঈশ্বরের নানান বিধিবিধান লঙ্ঘন করতে দেখা যায় তাঁদের। তেমনি বিপ্লবী ও প্রগতিশীল পিতা-মাতারা ঈশ্বরকে অস্বীকার করেন, অভিযুক্ত করেন, মোল্লাতান্ত্রিকতাকে সমালোচনা করেন, চার্চ বা মসজিদ– মন্দির কেন্দ্রিকতার বিরোধিতা করেন, সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসন সহ আরও অনেকের সমালোচনা করেন তাঁরা, কিন্তু তারপরেও তাঁদেরকে দেখা যায় এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নানান রকমের আপোস করতে, নানান ভাবে মানিয়ে চলতে। এসবের পরেও কোনো মুক্তচিন্তার পিতা-মাতা হয়তো বেশ গর্বের সাথে বলতে পারেন যে তাঁদের সন্তান থোমাস পাইন এর ছবি দেখে চিনতে পারে, কিংবা সে বিখ্যাত ঘড়ি ‘ইনগ্রেসল’ এর ছবি দেখে চিনতে পারে, কিংবা সে জানে যে ঈশ্বর ধারণা একটা ফালতু ব্যাপার-স্যাপার ইত্যাদি। কিংবা কোনো বামপন্থী সমাজতন্ত্রী পিতা হয়তো তার ছয় বছুরে কন্যাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন – ‘খুকি, বলোতো, দাস ক্যাপিটাল কে লিখেছেন?’ কন্যা হয়তো চটপট উত্তর দেবে – ‘কার্ল মার্কস, বাবা’ ! কিংবা এনার্কিস্ট মা হয়তো বেশ বুক ফুলিয়ে বলতে পারে যে তার কন্যাদের নাম লুইস মিশেল কিংবা সোফিয়া পেরোভস্কায়া, কিংবা তাঁর গর্বের কারণ হয়তো হতে পারে যে তাঁর কন্যা অনেক গুলো বিপ্লবী কবিতা গড় গড় করে মুখস্থ আবৃত্তি করতে পারে, হেরওয়েই, ফ্রেলিংগ্রাথ কিংবা শেলির কবিতা, অথবা সে হয়তো দেখা মাত্রই আঙ্গুল দিয়ে চিনিয়ে দিতে পারে বিখ্যাত সব এনার্কিস্ট চিন্তকদের, স্পেন্সার, বাকুনিন বা মোসেস হারমন’দের মতো মানুষদের।
এসব আমি একদমই বাড়িয়ে বলছিনা; বরং এটা দুঃখজনক যে, আমি এই রকমের প্রগতিশীল, মুক্ত চিন্তক পিতা-মাতাকে দেখেছি, আমার পরিচিত চত্বরেই দেখেছি। কিন্তু এভাবে শিশুর মনকে, চিন্তাকে পক্ষপাতদুষ্ট করার কি ফল হতে পারে? ফলাফল যা ঘটে, তা যে খুব বিরল, তা কিন্তু নয়। এর ফলে শিশু ক্রমাগত একপাক্ষিক জ্ঞান নিয়ে বড় হয়, এক ধরনের জড় ও বদ্ধ ধারণা নিয়ে বড় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পিতামাতার দেয়া তার প্রতিদিনের এই সকল চিন্তার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়ে ওঠে, আর এর পরে বরং নতুন কিছু জানার জন্যে, শোনার জন্যে নিজের চৈতন্যকে নিবেদিত করে, তা সেই নতুন জ্ঞান নতুন জানাশোনা যতই স্থুল হোকবনা কেনো, মনুষ্য মস্তিস্ক কখনই একই রকমের চিন্তায় অভ্যস্ত হতে চায়না, সে একঘেয়েমিকে মেনে নেয় না বেশিদিন। ফলে সেই কিশোর বা কিশোরী, যাকে থোমাস পাইন কিংবা এই রকমের দার্শনিকদের তত্ত্ব দিয়ে অতিভোজন করানো হয়েছে, তারা খুব শিগগির চার্চ বা মসজিদ-মন্দিরের উঠোনে গিয়ে হাজির হয়। অথবা তাঁরা ভোট দেয় সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ কিংবা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে, কিংবা হয়তো কোনো একটা কারখানা খুলে বসে, নিজেদের ধনী হওয়ার অধিকারবোধ থেকে, শুধুমাত্র তাদের পিতা-মাতার সনাতনী কমিউনিস্ট ধারণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে। অথবা মেয়েটা হয়তো কোনো একজন ধনকূবেরের সাথে গাঁটছড়া বাধে কেবল একটা স্বচ্ছন্দ জীবন পাওয়ার আশায়।
এই ধরনের পরিণতি নিশ্চিত ভাবেই খুব বেদনাদায়ক ও করুণ যেকোনো পিতা-মাতার জন্যেই, যারা সত্যিই চান তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পথ অনুসরণ করুক। কিন্তু এর পরেও আমি এই সকল ছেলে মেয়েদেরকে দারুণ সতেজ উদ্দীপক মানসিক শক্তি মনে করি। এরাই প্রমাণ করে যে স্বাধীনচেতা মন চিরকালই গতানুগতিক ধারণা কে চ্যালেঞ্জ করবে, এরা সবসময়ই মানুষের মন ও চিন্তার উপরে কর্তৃত্ব করতে আসা সকল ভেতরের ও বাহিরের শক্তিকে এরা চ্যালেঞ্জ করবে।
কেউ কেউ হয়তো আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তাহলে দুর্বল প্রকৃতির কি হবে? তাকে কি সুরক্ষা দেয়া দরকার নয়? হ্যাঁ, তা দিতে হবে, কিন্তু সেটা দেয়ার জন্যে অন্তত আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে যে শিশুর শিক্ষার মানে এটা নয় যে অন্ধ অনুকরন, ঝাকেই কৈ এর মতো করে কসরত করা। শিশুর জন্যে শিক্ষা বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ শিশুর স্বাধীন ভাবে বেড়ে ওঠাকে নিশ্চিত করা, তার নিজের ভেতরের সকল সুকুমার বৃত্তি ও প্রবণতাসহ তাকে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়া। কেবল এভাবেই আমরা সমাজে স্বাধীন মানুষের প্রত্যাশা করতে পারি, আর স্বাধীন মানুষই পারে স্বাধীন সমাজ গড়তে, স্বাধীন জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে, যা মানুষের বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ ও জবরদস্তিকে অসম্ভব করে তুলবে।