অরাজ
আর্টওয়ার্ক: নুড, গ্রীল লিভস অ্যান্ড বাস্ট শিল্পী: পাবলো পিকাসো সূত্র: পিকাসো আর্ট
প্রচ্ছদ » এমা গোল্ডম্যান।। বিয়ে

এমা গোল্ডম্যান।। বিয়ে

  • অনুবাদ: ফাতিন ইশরাক

বিবাহ। কত দুঃখ, দুর্দশা, অপমান; কত অশ্রু এবং অভিশাপ; কত যন্ত্রণা ও কষ্ট; এই শব্দটি মনুষ্য জাতিতে নিয়ে এসেছে। এর জন্ম থেকেই, আজ অবধি, আমাদের বিবাহ প্রতিষ্ঠানের লোহার জোয়ালের নিচে বেড়ে উঠেছে পুরুষ এবং নারী, এবং এ থেকে বেরোনোর ​​কোনও উপায় নেই বলে মনে হয়। সর্বকাল এবং সর্ব যুগে নিরুদ্ধ গোষ্ঠী মানসিক ও শারীরিক দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙার চেষ্টা করেছে। ঐসব সাহসী বীরদের চিন্তাচেতনা গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাজারো মূল্যবান জীবনের আত্মত্যাগ এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর মাধ্যমে এবং বাকিরা মৃত্যুবরণ করেছে কারাগারে অথবা আইনের নির্দয় হাতে। এভাবে ধর্মীয় দাসত্ব, সামন্তবাদ এবং কৃষ্ণাঙ্গ দাসত্ব বিলোপ হয়েছে, এবং নতুন মতাদর্শ, আরও প্রগতিশীল, বিস্তৃত এবং স্পষ্টতর, সামনে এসেছে, এবং আবারও আমরা দেখি নিষ্পিষ্ট মানবতা তার অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মৌলিক, সর্বাপেক্ষা স্বৈরাচারী প্রতিষ্ঠান- বিবাহ, চিরকালের মতই দৃঢ় এবং বিপদ নিয়ে আসে তাদের ওপর, যারা এর পবিত্রতা সন্দেহ করার ও স্পর্ধা করে। এমন কি আছে যা এদেরকে বিবাহ রক্ষা করতে প্রভাবিত করে? এমন কি আছে যা এদেরকে এই কুসংস্কার আঁকড়ে ধরায়? (এটা কুসংস্কার বৈকি কিছুই নয়) এর কারণ, বৈবাহিক সম্পর্ক ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তি, তথা, আমাদের নিষ্ঠুর এবং অমানবিক সিস্টেমের ভিত্তি। একদিকে সম্পত্তি এবং উদ্বৃত্ত, অপর দিকে অপরাধ; এজন্য বিবাহ প্রথার বিলোপ এর অর্থ উল্লেখ্য সবকিছুর বিলোপ।

এমা গোল্ডম্যান
(১৮৬৯-১৯৪০)
আর্টওয়ার্ক: এলিয়া-ইলাস্ট্রেশন
সূত্র: ডিভিয়ান্ট আর্ট

কিছু প্রগতিশীল মানুষ আমাদের বিবাহ সংক্রান্ত আইন গুলো উন্নত করার চেষ্টা করছে। তারা চার্চকে আর বৈবাহিক সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করতে দেয় না; অনেকে আরও অগ্রসর হয়, তারা মুক্ত বিবাহ করে, যেটা আইনের সম্মতি ব্যতিরেকে হয়; কিন্তু, তবুও বিবাহের ধারণা আত্মসমর্পণমূলক, ঠিক যেমনটা “পবিত্র”, আদি ধারণা হিসেবে, কারণ এটা আমাদের মধ্যে প্রচলিত বৈবাহিক সম্পর্কের মত নয়; কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, প্রথাটি আপত্তিকর, ক্ষতিকর এবং অবমাননাকর। এটা সর্বদা পুরুষকে তার স্ত্রীর ওপর অধিকার এবং ক্ষমতা দেয়, শুধুমাত্র তার শরীরের ওপর না, বরং তার কর্ম, তার ইচ্ছা; এমনকি তার সমগ্র জীবনের ওপর। এবং এছাড়া আর কিভাবে হতে পারে? স্বতন্ত্র পুরুষ এবং নারীর যেকোনো সম্পর্কের পেছনে কাজ করে সাধারণত ঐতিহাসিক ভাবে বিবর্তিত হয়ে আসা দুই লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের, যা বর্তমানে তাদের অবস্থান এবং সুযোগ সুবিধার মধ্যকার ফারাক তৈরি করেছে। দুইজন অল্পবয়সী মানুষ একত্রে আসে, কিন্তু তাদের সম্পর্ক বৃহত্তরভাবে এমনসব কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যার ওপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা নিজেদের সম্পর্কে অল্প জানে, সমাজ এই লিঙ্গদ্বয়কে আলাদা রেখেছে, ছেলে এবং মেয়ে বড় হয়েছে ভিন্ন পন্থায়। অলিভ স্ক্রাইনার তার আফ্রিকান ফার্মের গল্পে যেমনটা বলেছেন, “ ছেলেকে ছেলে হতে শেখানো হয়েছে, মেয়েকে মেয়ে মনে হতে।’’ ঠিক তেমনটাই, ছেলেকে শেখানো হয়েছে বুদ্ধিমান, উজ্জ্বল, চালাক, শক্তিশালী, পালোয়ান, স্বাধীন এবং আত্মনির্ভরশীল হতে; স্বীয় প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত দক্ষতা উন্নত করতে, স্বীয় আবেগ এবং ইচ্ছার অনুসরণ করতে। মেয়েকে শেখানো হয়েছে পোশাক পরতে, আয়নার সামনে দাড়িয়ে আত্মপ্রশংসা করতে, স্বীয় অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণে রাখতে, মানসিক ত্রুটি লুকাতে এবং স্বীয় ক্ষুদ্র বুদ্ধিমত্তা এবং যোগ্যতার সাথে সমন্বয় করতে একদিকে, এবং তাই হল স্বামী আকৃষ্ট করার, লাভজনকভাবে বিয়ে করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। এবং এজন্যই দুই লিঙ্গ একে অপরের প্রকৃতি বুঝে না, তাদের মানসিক চাহিদা এবং বৃত্তির ফারাক বুঝে না। জনমত তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব, তাদের সম্মান এবং অসম্মান খুব কঠোরভাবে একে অপর থেকে পৃথক করে। যৌন বিষয় নারীর কাছে নিষিদ্ধ, কারণ তাকে বোঝানো হয় যে, যৌন বিষয়ে প্রশ্ন করাও অপবিত্র, অনৈতিক এবং অশ্লীল। পুরুষের কাছে তা এমন এক বিষয়, যা অসুখ এবং কলঙ্ক নিয়ে আসবে, এবং কিছু ক্ষেত্রে ধ্বংস এবং মৃত্যু। বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে প্রেমে পড়া হালের চল না। সমাজের পুরুষেরা বিবাহ করে লাম্পট্য এবং কামের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করার পরে, তাদের নষ্ট গড়ন বিনির্মাণ করতে। বাকিরা জুয়া খেলা বা ফটকা ব্যবসায় নিজেদের পুঁজি হারিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে উত্তরাধিকারী একমাত্র বস্তু যা তাদের দরকার; তারা একথা ভালমতই জানে যে তাদের বিত্তশালী স্ত্রী দের উপার্জন আত্মসাৎ করতে তাদের বৈবাহিক বন্ধন কোন বাধার কারণ হবে না। যে বুর্জোয়া নারীকে শেখানো হয়েছে জীবনমুখী এবং বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হতে, এবং শেখানো হয়েছে বেঁচে থাকতে, শ্বাস নিতে, খেতে, হাসতে, হাঁটতে এবং পোশাক পরিধান করতে কেবলমাত্র হালের চল অনুযায়ী; সে তার প্রাচুর্যকে বিক্রি করে কোন পদবীর কাছে, বা সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন পুরুষের কাছে। তার একমাত্র সান্ত্বনা হল সমাজ বিবাহিত নারী কে অধিক স্বাধীনতা দেয় এবং বিবাহে অসন্তুষ্ট হলে তাকে অন্য উপায়ে তার ইচ্ছা পূরণ করতে হবে। আমরা জানি যে নারীর খাসকামরা এবং বৈঠক খানার দেয়াল মূক এবং বধির, এবং এই দেয়ালের আড়ালে ক্ষুদ্র সুখানুভূতি কোন অপরাধ না।

প্রলেতারিয়েত শ্রেণির নারী পুরুষে বিবাহ ভিন্ন জিনিস। উঁচু শ্রেণির মধ্যকার প্রেম অতটা বিরল না এবং বেশিরভাগ সময়েই উভয়কে সাহায্য করে জীবনের হতাশা এবং দুঃখ সহ্য করতে, কিন্তু এমনকি এখানেও বেশিরভাগ বিবাহ প্রত্যহ জীবনের একঘেয়েমি এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে স্বল্পকালীন সময়ে ভেঙে যায়। আবার, শ্রমিক শ্রেণির পুরুষ বিবাহ করে কারণ সে তার পেনসিত্তন জীবনে পরিশ্রান্ত এবং তার নিজের ঘর বানানোর মনবাসনা আছে, যেখানে সে স্বস্তি খুঁজে পাবে। তার মূল উদ্দেশ্য এমন নারী খোঁজা যে তার জন্য ভাল রাঁধুনি এবং গৃহিণী হবে; যাকে দিয়ে সে নিজের সুখ এবং কামের চাহিদা পূরণ করতে পারবে; যে তাকে নিজের ঈশ্বর, মালিক, রক্ষক এবং পৃষ্ঠ পোষক  প্রতিপন্ন করবে; একমাত্র উদ্দেশ্য যাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকা যায়। অন্য পুরুষ আশা করে সে যেই নারী কে বিয়ে করবে, সে কাজ করতে পারবে এবং বৃষ্টির দিনে কয়েক সেন্ট উপার্জনে সাহায্য করতে পারবে কিন্তু কয়েক মাসের তথাকথিত সুখের পরে সে তিক্ত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, সে জানতে পারে তার স্ত্রী মা হতে চলেছে এবং সে কাজ করতে পারবে না; এতে করে বুঝতে পারে সেই নারী এবং তার “দয়ালু” মালিক মিলেমিশে যে ক্ষুদ্র উপার্জন করেছে এযাবতকালে , তা পরিবার চালাতে যথেষ্ট না।

যেই মেয়ে তার শৈশব এবং যৌবনের একটা অংশ ফ্যাক্টরি তে কাটিয়েছে, সে অনুভব করে তার শক্তি কমে যাচ্ছে এবং সে নিজেকে আবিষ্কার করে এমন একটা ভয়ংকর অবস্থায়, যেখানে তার কর্মচারী হয়ে থাকার সময় ফুরিয়ে আসছে, কাজের ব্যাপারেও নিশ্চিত না এবং এজন্য সে বাধ্য হয় পুরুষ খুঁজতে, ভাল স্বামী খুঁজতে, যে তাকে সাহায্য করতে এবং তাকে ভাল বাসস্থান দিতে পারবে। নারী পুরুষ উভয়ই একই উদ্দেশ্যে বিয়ে করে, একমাত্র বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরুষ তার স্বাতন্ত্র্য, তার নাম, তার স্বাধীনতা ত্যাগ করবে এটা আশা করা না হলেও নারীকে তার নিজকে বিক্রি করতে হয়, নিজের শরীর ও আত্মা বিক্রি করতে হয় কারও স্ত্রী হওয়ার সুখের জন্য; অতএব তারা সমান অবস্থানে থাকে না, এবং যেখানে সমতা নেই, সেখানে কোন ঐকতান থাকতে পারে না। ফলাফল হল প্রথম কয়েক মাসের পরে বা সমস্ত ভাতা আত্মসাৎ করার জন্য এক বছর পরেই উভয় এই সিদ্ধান্তে আসে যে বিবাহ ব্যর্থ হয়েছে।

আর্টওয়ার্ক: দ্য রেসকিউ
শিল্পী: পাবলো পিকাসো
সূত্র: পিকাসো আর্ট

যেহেতু তাদের পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে, এবং সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে উক্ত নারী  নিরাশ, করুণ, অসন্তুষ্ট এবং দুর্বল হতে থাকে, তার সৌন্দর্য তাকে ছেড়ে যায়, এবং কঠোর পরিশ্রম, নির্ঘুম রাত, ছোটদের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা এবং স্বামীর সাথে মতানৈক্য এবং ঝগড়া বিবাদে, সে শারীরিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং যেই মুহূর্ত তাকে এই গরিব পুরুষের স্ত্রী বানিয়েছে, সেই মুহূর্তকে অভিশাপ দিতে থাকে। এরকম বিষণ্ণ এবং করুণ জীবন নিশ্চিতভাবে একে অপরের প্রতি ভালবাসা বা সম্মান টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। উক্ত পুরুষ নিজের দুর্দশা বন্ধুদের সঙ্গে ভুলতে পারে অন্তত; সে নিজেকে রাজনীতি তে ব্যস্ত রাখতে পারে, বা সে তার দুর্ভাগ্য কে মদের গ্লাসে ডুবাতে পারে।  নারীটি তার গৃহস্থের হাজারো দায়িত্ব এর দ্বারা গৃহের শেকলে আবদ্ধ; সে পারে না তার স্বামী কে পছন্দ করতে, বিনোদন উপভোগ করতে কারণ হয় তার কোন পুঁজি নেই এর জন্য, নতুবা জনমত তাকে তার স্বামীর সমান অধিকার দেয় না। এই ক্রুশ তাকে বহন করতে হয় মৃত্যু পর্যন্ত কারণ আমাদের বৈবাহিক আইনে কোন দয়া নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার বৈবাহিক জীবন মিসেস গ্রানডির সমালোচনা মুলক চোখ এর সামনে উলঙ্গ করতে চায়, এবং এমনকি তখনও সে শুধুমাত্র তখনই তার ঘৃণার পুরুষের সাথে শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে যদি সে সমস্ত দোষ নিজের কাঁধে নেয়, এবং যে পৃথিবী তার বাকি জীবন তাকে লাঞ্ছনা করবে, তার সামনে দাঁড়ানোর মত পর্যাপ্ত শক্তি যদি তার থাকে। এরূপ করার মত সাহস কয়জনের আছে? খুবই অল্প সংখ্যকের। এরকম বজ্রপাত কালে ভদ্রে দেখা যায়, যেমন, প্রিন্সেস ডি চিমেই এর স্পর্ধা ছিল প্রচলিত বাধা উপেক্ষা করার এবং হৃদয়ের ইচ্ছার অনুসরণ করার। কিন্তু এই ব্যতিক্রম হল পুঁজিপতি নারী, যে স্বনির্ভর। দরিদ্র নারীর তার সন্তানদের কথা চিন্তা করতে হয়; সে তার ধনী বোনের তুলনায় কম ভাগ্যবান, এবং তারপরও যে নারী দাসত্ব এর বন্ধনে থাকে, তাকে মর্যাদা সম্পন্ন বলা হয়ঃ যদিও বা তার সমগ্র জীবন বিভিন্ন মিথ্যা, প্রতারণা এবং বিশ্বাস ঘাতকতার লম্বা শিকল, সে তার বোন দের দিকে নিচু দৃষ্টি তে তাকায়, যারা সমাজের দ্বারা বাধ্য হয়ে নিজ মোহ এবং প্রণয় রাস্তায় বিক্রি করেছে। একজন বিবাহিত নারী যতই দরিদ্র, যতই করুণ হোক না কেন, সে অন্যদের থেকে নিজেকে উপরে ভাববে, যাদেরকে সে নিশিকন্যা ডাকে, যারা সকলের দ্বারা নির্বাসিত, ঘৃণিত এবং অপমানিত, এমনকি যারা তাদের পরিরম্ভ ক্রয় করতে দ্বিধা বোধ করে না, তারাও গরিব নরাধম কে প্রয়োজনীয় মন্দ হিসেবে দেখে, এবং তথাকথিত ভাল মানুষেরা পরামর্শ দেয় এই কু নারী দের নিউ ইয়র্কের একটা ডিসট্রিক্টে নির্বাসিত করতে, যাতে বাকি ডিসট্রিক্ট “পবিত্র” থাকে। কি এক প্রহসন! সংস্কারক রা এও দাবি করতে পারে যে নিউ ইয়র্কের বিবাহিত মানুষদের যাতে বের করে দেয়া হয় কারণ তারা রাস্তার নারীদের চেয়ে নৈতিক ভাবে উচ্চ না।  রাস্তার নারী এবং বিবাহিত নারীর একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে, একজন নিজেকে বাসস্থান বা পদবীর জন্য দাসী হিসেবে বিক্রি করে নাই,  এবং আরেকজন নিজেকে বিক্রি করেছে নিজের সাময়িক বাসনার জন্য; একজনের অধিকার আছে নিজের প্রেমের পুরুষকে বেছে নেয়ার, যেখানে বিবাহিত নারীর এরূপ কোন অধিকার নেই; উপরন্তু তাকে তার মালিকের কাম বাসনার কাছে আত্ম সমর্পণ করতে হবে, এই পরিরম্ভ তার কাছে যতই জঘন্য মনে হোক না কেন, তাকে তার মালিকের সকল আদেশ মান্য করতে হবে; মালিককে সন্তান উপহার দিতে হবে, নিজের শক্তি এবং স্বাস্থ্যের বিনিময়ে হলেও; এক কথায়, সে তার জীবনের প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি দিন বেশ্যাবৃত্তি করে। আমি আমার বিবাহিত বোনদের এরকম জঘন্য, আবমাননাকর এবং অধঃপতিত অবস্থার জন্য জঘন্য রকমের বেশ্যাবৃত্তি ব্যতিত আর কোন শব্দ পেলাম না, একমাত্র বিশেষত্ব হচ্ছে একটা বৈধ, আরেকটা অবৈধ।

শুধুমাত্র যেসব ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে বিবাহ প্রেম এবং সম্মানের ওপর দাড়িয়ে আছে, সেগুলো বিবাহকে যথার্থতা দেয়। কিন্তু বৈধ হোক বা অবৈধ, যেকোনো ধরণের পতিতাবৃত্তি অস্বাভাবিক, ক্ষতিকর এবং জঘন্য, এবং আমি এও ভালভাবে জানি যে এই পরিস্থিতি বদলাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এই নারকীয় প্রথা বিলোপ করা না হয়, কিন্তু আমি এও জানি যে শুধু মাত্র অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাই নারীর দাসত্ব এর জন্য দায়ী না, তার অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারও দায়ী, এবং আমি জানি আমার অনেক বোনকে এমনকি এখনই স্বাধীন করা যেত, যদি না বৈবাহিক প্রতিষ্ঠান সমূহ তাদেরকে অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে  রাখত। এজন্য বিবাহ প্রথা বিলোপ করা আমি দায়িত্ব বলে মনে করি, শুধু মাত্র আদি প্রথার নয়, এমনকি তথাকথিত আধুনিক বিবাহেরও, যার অর্থ হল একজন স্ত্রী এবং বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক অধিকৃত করা, যার অর্থ হল এক লিঙ্গকে অপর লিঙ্গ দ্বারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অধিকৃত করা। আমি নারীর স্বাধীনতা দাবি করছি; তার নিজেকে সাহায্য করার স্বাধীনতা, নিজের জন্য বাঁচার স্বাধীনতা, যাকে খুশি ভালবাসার স্বাধীনতা, বা যতজনকে খুশি ভালবাসার স্বাধীনতা। উভয় লিঙ্গের স্বাধীনতা দাবি করছি, ভালবাসার স্বাধীনতা এবং মাতৃত্ব এর স্বাধীনতাও।

আমাকে এ কথা বলবেন না যে শুধুমাত্র নৈরাজ্যের অধীনেই এসব সম্ভব; এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমরা যদি নৈরাজ্য অর্জন করতে চাই, আমাদের প্রথমে নারীদের মুক্ত করতে হবে, ওইসব নারীদের কে যারা তাদের ভাই দের মত স্বাধীন এবং যতক্ষণ না আমাদের স্বাধীন নারী আছে, আমরা স্বাধীন মা পেতে পারব না, এবং মা রা যদি স্বাধীন না হয়, আমরা তরুণ প্রজন্ম কে আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্যকারী হিসেবে পাব না, যেটা হচ্ছে নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা।

আর্টওয়ার্ক: লাভার্স
শিল্পী: আর্নেস্ট কার্নাশর
সূত্র: ফজ ওয়ার্ল্ড

আপনাদের যারা মুক্তমনা এবং উদার বাদী, যারা এক ঈশ্বর কে বিলোপ করেছেন এবং বহু তৈরি করেছেন, যাদের আপনারা পূজা করেন; আপনাদের যারা রক্ষণশীল এবং সমাজতন্ত্রী, যারা এখনও নিজেদের সন্তানদের সানডে স্কুলে পাঠান এবং যারা প্রত্যেকে নৈতিক মানদণ্ডের অনুমোদন দেন; তাদের প্রত্যেককে আমি বলব এটা আপনাদের সৎসাহসের অভাব যা আপনাদের বিবাহ কে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে, এবং যদিও আপনারা তাত্ত্বিকভাবে এর অর্থহীনতা কে স্বীকার করেন, আপনাদের জনমত খণ্ডানোর এবং নিজের জীবনে বাস্তবিক অর্থেই বেচে থাকার শক্তি নাই। আপনারা লিঙ্গের সমতা ভবিষ্যতের জন্য মনে করেন কিন্তু আপনারা নারীর ভোগান্তি কে প্রয়োজনীয় মন্দ মনে করেন। আপনারা বলেন নারীরা দুর্বল এবং অধীনস্থ, এবং তাদের কে শক্তিশালী হতে সাহায্য করার পরিবর্তে আপনারা তাদের কে নিচু অবস্থানে রাখতে সাহায্য করেন। আপনারা আমাদের জন্য স্বাতন্ত্র্য দাবি করেন কিন্তু নিজেরা বৈচিত্র্য ভালবাসেন এবং উপভোগ করেন যখনই সুযোগ পান।

বিবাহ, বহু শতাব্দীর অভিশাপ, ঈর্ষা, আত্মহত্যা এবং অপরাধের কারণ, বিলোপ করতে হবে যদি আমরা চাই তরুণ প্রজন্ম স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী এবং স্বাধীন পুরুষ ও নারী হিসেবে বড় হোক।

ফাতিন ইশরাক

ফাতিন ইশরাক ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করছেন উচ্চ মাধ্যমিকে। স্কুল জীবন থেকেই বিতার্কিক। পাশাপাশি কবিতা লেখেন ও অনুবাদ করছেন। ক্ষমতা, সমাজ, লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে তার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।