অরাজ
এক্সট্রাকশন
প্রচ্ছদ » এক্সট্রাকশন: জনপ্রিয় সিনেমার সংস্কৃতি পাঠের দৈন্যতা

এক্সট্রাকশন: জনপ্রিয় সিনেমার সংস্কৃতি পাঠের দৈন্যতা

  • রাকিবুল রাকিব

গোড়ার কথা

হলিউডের এক্সট্রাকশন সিনেমা নিয়ে আমার কতেক আলাপ আছে। এই আলাপ যতটা না নন্দনতত্ত্বের, তার চেয়ে বেশি সিনেমার উপস্থাপনের। এক্সট্রাকশন সিনেমাটির গল্প একটি কমিক বই থেকে নেয়া হয়েছে। কমিক বইটিতে প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিলের চিত্র আঁকা হয়েছিলো আর সিনেমাটিতে তা রূপান্তর করা হয়েছে ভারত ও ঢাকার চিত্র। এই স্থান বদলের কারনে সিনেমাটির চিত্র উপস্থাপনে একদিকে পার্থক্য তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে অর্থ পাল্টে গেছে; সাথে সংস্কৃতি উপস্থাপনে গলদ ধরা পড়েছে এবং এর গৎবাঁধা ছাপ বেশ নজর কেড়েছে।

সিনেমার গল্প, বাংলাদেশের এক মাদক ব্যবসায়ী ভারতের আরেক মাদক ব্যবসায়ীর ছেলেকে অপহরণ করে অর্থদাবী করে। ভারতের মাদক ব্যবসায়ীরা ছেলেকে উদ্ধারের জন্য তৃতীয় শক্তির শরনাপন্ন হয়। এই তৃতীয় শক্তি সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র টাইলর রেক। রেক একজন ভাড়াটে গুন্ডা, যে টাকার বিনিময়ে কাজ করে।

এক্সট্রাকশন

রেক যথারীতি ভারতের মাদক ব্যবসায়ীর ছেলেকে উদ্ধার করতে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশের মাদক ব্যবসায়ীর গুন্ডাদের মেরে সে ছেলেটিকে উদ্ধার করে। রেক ও ছেলেটিকে ধরতে মাদক ব্যবসায়ী তার গুন্ডা বাহিনী, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পিচ্চি বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। রেক তা দেখে আন্দাজ করে এখানে তাকে কঠিন মূল্য দিতে হবে। ছেলেটিকে উদ্ধারের যে অর্থচুক্তি হয়েছিল তা তার অ্যাকাউন্টে যথাসময়ে আসে না, ততক্ষণে তার পক্ষের কিছু লোককে জীবন খোয়াতে হয়েছে, ছেলেটির প্রতি তার মায়া কাজ করে; সে এক উভয়সংকটে পড়ে। শেষমেস সে ছেলেটিকে সাথে নিয়েই বিশাল এক বাহিনীর সাথে স্পার্টানের মতো লড়ে। এ লড়াই অ্যাডভেঞ্জারস ইনফিনিটি ওয়্যার, ব্লাক প্যানথার বা অ্যাকুয়াম্যানের মতো কমিক সিনেমা থেকে এ ঢের বাস্তব, আবার এর কতেক সাজানোও। এখানে বাংলাদেশের মাদক ব্যবসায়ী গুন্ডা আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যাপক ব্যবহার করে। মনে রাখতে হবে, এই রাষ্ট্রীয় বাহিনী ঘুষখোর, মাদক ব্যবসায়ীর টাকায় চলে। তাই তার কথামতো নায়ককে ধরতে এমনকি শহরে লকডাউন দিতেও এই রাষ্ট্রীয় বাহিনী পরোয়া করে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নানান সমস্যা আছে কিন্তু এই সিনেমায় পরিচালক যে চিত্র তুলে ধরেছেন তার সাথে মিল কিঞ্চিতই। এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে এমন খোলামেলা নয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এমন আকছার ব্যবহার কোনো ব্যক্তি এখানে করতে পারে না।

রেক ছেলেটিকে নিজের লোকদের সহায়তায় সহিসালামতে ভারতে পাঠাতে সমর্থ হয়। তার আগে ছেলেটির সাথে তার নিটোল আবেগের, আদরের আর  স্নেহের সম্পর্ক তৈরি হয়; রেক তার হারানো সন্তানের ছবি ওই ছেলেটির মধ্যে খুঁজে পায়। যে কারণে ছেলেটির জন্য তার বাড়তি আবেগ কাজ করে। ছেলেটির সাথে তার শরীরি বিচ্ছেদ হয় ঠিকই, কিন্তু মনের বিচ্ছেদ থেকে যায়। যেন সমরেশ মজুমদারের সেই কথার মতো, শরীর কিছু নয় মনটাই সব। ততক্ষণে রেক জীবনসায়াহ্নে, তার শরীরে ভিলেনের গুলি লেগে আছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে, এ শরীরে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার নিয়ন্ত্রণহীন শরীর বুড়িগঙ্গায় মুষড়ে পড়ে। নায়কের মৃত্যু অব্দী যে আবেগ এই সিনেমায় পরিচালক হাজির করেছেন, তার রেশ দর্শকের মন থেকে খুব সহজে উবে যাবার নয়।

সংস্কৃতি পাঠের দৈন্যতা

এক্সট্রাকশনের বাংলাদেশ আদতে আমাদের দেখা বাংলাদেশ নয়, পরিচালক আমাদের এক মিথ্যা বাংলাদেশের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। এখানে যে বাংলাদেশ উপস্থাপিত হয়েছে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর চালচিত্রের যে পরিচয় আমরা পেয়েছি তা কোনোভাবেই বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এ সিনেমায় বাংলাদেশের মাদক ব্যবসায়ীকে একজন ভয়ঙ্কর মানুষের চরিত্রে দেখা যায়, যার দয়ামায়া নাই, যে হিংস্র, যার লোভ আর ক্ষমতার সীমা বিস্তৃত। যার বাড়ির সাজগোজ বাদশাহী টাইপের; সেই বাদশাহী মধ্যযুগের নয়, আধুনিক যুগের। বাড়ির ভিতরে পরতে পরতে জৌলুস, এর ভিতরের রমণীদের আনাগোনা, বিদেশী মদ আর দ্রব্যের ছড়াছড়ি। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীর সাদামাটা কস্টিউম, অঙ্গভঙ্গি, তার রাগ আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশের স্থানীয় দুষ্কৃতিকারীদের কারও সাথে যায় না। গুন্ডাদের যে চিত্র পরিচালক এঁকেছেন, তাও বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। গায়ে ম্যাগি টাইপ গ্যাঞ্জি, গলায় তিন’চার প্রকারের বস্তু, কব্জিতে রিস্ট ব্যান্ডের কম্বিনেশন আর হাতে বন্দুকসহ যে কস্টিটিউম সিনেমায় দেখানে হয়েছে তার সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতির মিল নেই। ঢাকার অলিগলিতে কম বয়সী কিশোরদের বন্দুক হাতে ঘুরে বেড়ানোর যে দৃশ্য এক্সট্রাকশনে উঠে এসেছে তার সাথে বাংলাদেশের কিশোরদের উপস্থাপন লেজে গোবরে। এই সিনেমার বাংলা ভাষার ব্যবহার ও উচ্চারণ এদেশের মানুষের সাথে যায় না। ঢাকার মহল্লায় যে হিন্দিগান প্রতিবার বাজে তার সাথে হিসেব কষলে বুঝা যায় পরিচালক বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ ধরে নিয়েছেন। পুরান ঢাকায় বহুমাত্রিক সংস্কৃতির মানুষের বসবাসের কারণে এখানে যেমন ভারতীয় ডিজে বাজে, সাথে ইংলিশ ও বাংলা ফোক গানও সমানতালে বাজে। অথচ সংস্কৃতি পাঠের এমন দৈন্যতা বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে মানুষকে ভুল ধারণায় পর্যবসিত করবে। ডেসমন্ড মরিচ (১৯৮৮) জানাচ্ছেন ‘কান টেনে দেয়া’ ব্যাপারটার ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে পাঁচটি দেশে পাঁচ ধরনের অর্থ আছে। যেমন পর্তুগালে এর অর্থ কারও কাজে খুশি হয়ে প্রশংসা করা, ইতালিতে এর অর্থ কারও কাজে অখুশি হয়ে বকা দেয়া, গ্রিসে কারও কাজে অল্প সন্তুষ্ট হয়ে তাকে কাজটি ভালোভাবে সম্পাদনের জন্য উৎসাহিত করা। এভাবে সংস্কৃতি ভেদে একই অঙ্গভঙ্গির ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হাজির হয়। সেই ব্যাপারটা এক্সট্রাকশনের পরিচালক বুঝে উঠতে পারেননি, তাই এ সিনেমায় সংস্কৃতি পাঠের দৈন্যতা ফুটে উঠেছে।

সিনেমার যে দৃশ্যে রেক বাংলাদেশে আসে, সেই দৃশ্য খেয়াল করলে দেখা যাবে সাইনবোডে বাক্যের গঠন ভুল এবং যে সেট তৈরি করা হয়েছে তাতেও সমস্যা; একটা ঘিঞ্জি গলির সাইনবোডে কলেজের নাম, ডাক্তারের চেম্বারের নাম, বিউটি পার্লারের নাম যা কোনোভাবেই একসাথে ঘিঞ্জি গলিতে হতে পারেনা। এই সিনেমায় পহেলা বৈশাখের র‌্যালী রাতে করা হয়েছে। সংস্কৃতি বোঝাপড়ার ভুলের প্রভাব মানুষের জীবনে ব্যাপকভাবে পড়ে। এ প্রভাব আমাদের জীবনেও পড়বে, এরকম প্রভাব পড়ার কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক:

একবার আমেরিকার এক ব্যবসায়ী কাতারের এক ব্যবসায়ীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে কাতারে যান। কাতারে ব্যবসা সংক্রান্ত সব আলাপ শেষ হয়ে গেলে নিজ ব্যাগ থেকে দুই বোতল মদ বের করে দেন; তিনি ধরে নিয়েছিলেন মদ পেলে কাতারের ভদ্রলোক খুশী হবে। শেষে দেখা গেল কাতারের ব্যবসায়ী একসাথে ব্যবসা করাতো দূরে থাক বরং আর সম্পর্কই রাখেনি। গেরি ফেরাও (১৯৯২)

এখানে দেখা যাচ্ছে এক সমাজের মানুষের সাথে আরেক সমাজের মানুষের সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার ভুলের কারণে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে, এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে তাও স্বাভাবিক; সিনেমার বেলায়ও একই ঘটে। তাই সিনেমায় যেকোনো সংস্কৃতি উপস্থাপনের আগে সেই সংস্কৃতি পাঠ বহুল পরিমানে প্রয়োজন। কিছু বছর আগেও সিলেটের হোটেলগুলোতে গিয়ে কেউ পুরি খোঁজ করলে, স্থানীয়রা কিলঘুষি দিত, কিন্তু দীর্ঘ যোগাযোগের ফলে তারা বুঝে ফেলেছে; পুরি মানে শুধু মেয়েদের নির্দেশ করা হয় না, পুরির অন্য আরেক অর্থ আছে। মাদক ব্যবসায়ীর অবাধ পদচারণা আর রাষ্ট্রে তাদের প্রভাব সম্পর্কে যে ধারণা পরিচালক সৃষ্টি করেছেন; বাংলাদেশে বিদেশিরা যেকোনো কাজ সম্পাদন করতে উসখুস করবে। এমনও হতে পারে এসব উপস্থাপনের দরুণ বাংলাদেশে বিদেশি ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারাবে, টুরিস্ট আগমনের হার অনেক কমে যেতে পারে। সে কারণে এক্সট্রাকশন সিনেমার সেট নিমার্ণের আগে বাংলাদেশকে গভীরভাবে অধ্যয়নের প্রয়োজন ছিল। এখানে পরিচালক সংস্কৃতি অধ্যয়নের সাথে জড়িত কাউকে নিয়োগ দিতে পারতেন। কালচারাল অ্যানথ্রপোলজিস্ট বা কালচারাল স্ট্যাডিজের কারও কাছে তালিম নিতে পারতেন। পরিচালক হয়তো তা চাননি, তিনি ভারত দিয়ে বাংলাদেশকে বুঝতে চেয়েছিলেন; যে কারনে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম হননি। এই একই কারণে সিনেমার পুরো উপস্থাপন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে।

জনপ্রিয় সিনেমার রাজনীতি

এক্সট্রাকশন সিনেমায় উদ্ধার অভিযানের নায়ক রেকের সাথে ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীর ছেলের আচমকা এক সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্ক অদ্ভুত, চাপিয়ে দেয়া বা উড়ে এসে জুড়ে বসা নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর রিয়েকশনে এই সম্পর্ক তৈরি হয়। এর আগে অনেকক্ষণ ধরে গোলাগুলি চলে, উভয়ে কাছ থেকে মৃত্যুময় পরিস্থিতি অবলোকন করে। তারা একে অপরের কাছাকাছি থাকলেও নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করার সময় পায় না। যখনই একটু অবসর পেল, তখনই তারা এক নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেল। জীবনের কঠিন মুহুর্তের ফাঁকে এমন সম্পর্ক তৈরি হবে তাই বরং স্বাভাবিক। এই সম্পর্ক মানবিকতার আর আবেগের, মানুষে মানুষে মিলনের। মানুষ যে আর দশটা প্রাণী থেকে আলাদা এই তার বহিঃপ্রকাশ। মানুষের ভিতরে ভালো আর খারাপ সত্ত্বার যে সংমিশ্রণ থাকে এটা তার দৃশ্যভাষিক রূপ। দীর্ঘক্ষণ মার মার কাট কাট দৃশ্যের পর এমন একটি আবেগময় দৃশ্য মানুষকে নাড়িয়ে দেয়, মানুষের চেতনাজগতকে পুরো ঘুরিয়ে নেয়। চেতনাজগত ঘুরে যাওয়ার ফলে মানুষ এক দারুণ অনুভূতি উপভোগ করে। সিনেমা ও সিনেমার নায়ক সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এটা জনপ্রিয় সিনেমার রাজনীতি। মানুষের এই অনুভূতি ঘুরিয়ে দেয়ার খেলাই হচ্ছে আজকের জনপ্রিয় সিনেমার মূল কাজ, প্রোপাগান্ডা ছড়ায় যে সিনেমাগুলো তারও একই কাজ। ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করা যাক।

সল্ট

আঞ্জেলিনা জোলির সল্ট সিনেমার কথা এখানে বলা যেতে পারে। এই সিনেমার প্রধান চরিত্র সল্টের সঙ্গীকে রাশিয়ানরা মেরে ফেলে, সেই সঙ্গী ছিল সল্টের প্রিয় মানুষ। প্রেমের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যার সাথে তার বিয়ে হয়। পারতপক্ষে তারা সুখী দম্পতিও, অন্যান্য আমেরিকান দম্পতিদের মতো নয়। সঙ্গী হত্যার ক্ষোভ থেকে রাশিয়ানদের প্রতি সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে অথচ শুরুতে সে রাশিয়ান স্পাই ছিল। এখানে আমেরিকান দেশপ্রেমের দারুণ এক কাহিনী সাজানো হয়েছিলো কিন্তু ব্যাপারটা আদতে তেমন নয়, পুরোটাই মেকি। আমেরিকা-রাশিয়া বৈশ্বিক দুই শক্তি, এদের প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব চলে। নিজেদের উৎকৃষ্ট প্রমাণের যুদ্ধ চলে; এই যুদ্ধ ময়দানে বন্দুকে বন্দুকে নয়, বা পারমাণবিক বোমা মেরে নয়; এটা চলে সংস্কৃতি দিয়ে, সেটারই অংশ সল্ট সিনেমা। শুধু কি কাহিনী দিয়ে এই কাজ করা যায়? না, তা যায় না। সল্ট সিনেমায় কি মিউজিক, কি যৌন উত্তেজক কস্টিউম আর সিনেমাটোগ্রাফি সাথে জোলির দুর্দান্ত অভিনয়শৈলী এসবের মিশেলে প্রথমে দর্শককে বিনোদিত করে অর্থ কামানো হয়, এরপর রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডার কাজে জবরদস্ত ব্যবহার চলে। কখনো কখনো আবার শুধুমাত্র প্রোপাগান্ডার তাগিদেই সিনেমায় অর্থ ঢালা হয়, সেসবে ব্যবসার বালাই কম থাকে। সল্টের প্রথম ভূমিকার উদাহরণ হিসেবে আমরা এক্সট্রাকশনকে বেছে নিব, দ্বিতীয় ভূমিকার কারণেও আমরা একে বেছে নিতে পারবো। অন্যদিকে দর্শককে আবেগে নিমজ্জিত করার কাজটিও এই দুই সিনেমায় উপস্থিত আছে; সল্টের প্রেমিককে হারানোর বেদনা আর রেক ও ছেলেটির মানবিক এবং আবেগীয় সম্পর্ক মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতে একই ভূমিকা পালন করে। সেই তালিকায় ভারতীয় সিনেমা ‘রোমিও আকবর ওয়াল্টারকে’ও ফেলা যাবে।

গার্ডিয়ান অব দ্যা গ্যালাক্সি সিনেমায় এমন একটা মানবিকতা হাজির করা হয়েছিল, সিনেমাটি ভালো অর্থ বাগিয়েছে; অ্যাকুয়াম্যান ও ব্লাক প্যান্থার একই ফর্মূলা নিয়েছিলো। কিন্তু জোকার সিনেমার সাথে এগুলোর মিল নেই। জোকার সিনেমা আগাগোড়াই সিস্টেম বিরোধী, আগাগোড়াই জীবনের দুর্দান্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলে। সামাজিক বৈচিত্র্যকে অপর হিসেবে গ্রহণ করার মানুষের যে মানসিকতা, সেই জায়গায় কুঠারাঘাত করে। শুধু কি এতেই শেষ? তাও নয়। সমাজের ক্যান্সার যে পুঁজিবাদ, তার বিরুদ্ধেও একহাত নেয়। একদল চিকিৎসা পায় না, আরেকদলের চিকিৎসা হাতের নাগালে। একদল অভাবে হাহুতাশ করে, আরেকদলের জৌলুসের অভাব নেই। এই সিস্টেমে অসমতা ব্যাপক, এই সিস্টেমে বিচিত্র মানুষের স্থান অনুপস্থিত; যদি এখানে মানুষেরই স্থান না থাকে তাহলে এমন সিস্টেম নিষ্প্রয়োজন- জোকার সিনেমার তা কেন্দ্রীয় বক্তব্য। কিন্তু জোকার সিনেমার মতো এক্সট্রাকশন হতে পারেনি, বরং হয়েছে উল্টো। আজকের দিনে ভারত ও আমেরিকা জনপ্রিয় সিনেমা দিয়ে দুনিয়াব্যাপী নিজেদের অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় শক্তিমত্তা বারংবার জাহির করছে। রোজ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিচ্ছে। সেই কাজে এক্সট্রাকশন সিনেমা নিয়োজিত আছে বলে মনে হয়।

এক্সট্রাকশনে বাংলাদেশ গৎবাঁধা

গৎবাঁধা হচ্ছে এমন একটি প্রবণতা যেখানে কোনোকিছুর সম্পর্কে অল্প জেনে বাড়িয়ে বলা হয় এবং এই বাড়িয়ে বলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। মুসলিমরা ধর্মান্ধ, হিন্দুরা কৃপণ আর নিগ্রোরা অলস- আমরা প্রতিনিয়ত এমন অনেকগুলো গৎবাঁধা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। এক্সট্রাকশনে পরিচালক সেরকম কতগুলো গৎবাঁধা চিত্র উপস্থাপন করেছেন। তিনি ধরে নিয়েছেন বাংলাদেশ ভারতের উপনিবেশ যে কারণে এখানে সারাক্ষণ হিন্দি গান বাজে। এখানকার কিশোরেরা বিদ্যালয়ে যায় না, বন্দুক হাতে অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায়। তিনি ধরে নিয়েছেন দেশে মাদক ব্যবসায়ীর দাপট, এখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ঘুষলোভী মনোভাব, রাষ্ট্র মোটাদাগে বিকশিত নয় ফলে বাংলাদেশ একটি পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র। তার দেখানো বাংলাদেশের আকাশ উন্মুক্ত নয়, এখানে অবলীলায় বাইরের দেশের হেলিকপ্টার উড়তে পারে। অবলীলায় মাদক ব্যবসায়ী রাস্তায় লকডাউন বাস্তবায়ন করতে পারে। এরকম গৎবাঁধা নির্মাণের সাথে জড়িত থাকে বর্ণবিদ্বেষ, এর সাথে জড়িত উৎকৃষ্ট আর নিকৃষ্টের ধারণা, এখানে থাকে বৈষম্য। এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে কখনো কখনো জায়েজ করা হয়। পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সমাজে গৎবাঁধা নির্মাণ হাজির করে বিভেদ জিইয়ে রাখা, সাথে নানান মতলব হাসিল করা।

এক্সট্রাকশন

এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘কাভারিং ইসলাম’ (১৯৯৭, দ্বিতীয় সংস্করণ) বইয়ে বলেছেন, ট্রু লাইজ, ডেল্টা ফোর্স, ইন্ডিয়ানা জোনসের মতো সিনেমায় মুসলমান ধ্রুপদ খল চরিত্র নির্মাণ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করিয়ে তাদেরকে শয়তানরূপে হাজির করা হয় এবং শেষে আমেরিকান নায়ক দিয়ে তাদের পরাজিত করানো হয়। সাঈদ দেখিয়েছেন, এভাবে সিনেমায় মুসলমানদের ইচ্ছাকৃত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের পিছনে আমেরিকানদের মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদ দখলের রাজনীতি লুকিয়ে আছে। বঙ্গোপসাগর দখলের প্রতিযোগিতা আমেরিকা-চীন-ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এই দখলের সাংস্কৃতিক রাজনীতি এক্সট্রাকশন সিনেমায় থাকতে পারে- এমন আশঙ্কা অমূলক হবে না।

দুনিয়াব্যাপী প্রশংসা পাওয়া ও অস্কার জিতে নেয়া গডফাদার সিনেমাটির সিনেমাটোগ্রাফি, গল্প আর দুর্দান্ত সব ডায়লগের কারণে আলাদা বিশেষত্ব আছে। কিন্তু সিনেমাটি ইতালিয়ান-আমেরিকানদের এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যেন ইতালিয়ান-আমেরিকানরা ড্রাগ ব্যবসায়ী হয়, এই তাদের চিরাচরিত পেশা, এই কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। ‘আই বিলিভ ইন আমেরিকা, আমেরিকা হ্যাজ মেড মাই ফরচুন’ ডায়লগের মাধ্যমে সেই ব্যাপারটি পরিচালক আরও পরিষ্কার করেন। রবার্ট জেমেকিসও এর বাইরে ছিলেন না; রোমান্সিং দ্যা স্টোন সিনেমায় একই তিনি ভূমিকা সেরেছেন। তিনি সেখানে কলম্বিয়াকে মাফিয়া আর মাদক ব্যবসায়ীর রাষ্ট্র হিসেবে দেখিয়েছেন ঠিক এক্সট্রাকশনের মতো। এই একই পরিস্থিতি হিন্দি সিনেমায় ভিন্ন আঙ্গিকে আছে; হালের অমিতাভ বচ্চনের শোলে সিনেমাও এই ক্যাটাগরিতে পড়ে। এগুলো জনপ্রিয় ঘরানার সিনেমার বাস্তবতা; এই বাস্তবতা ইন্ডাস্ট্রি আর সময়ভেদে ভিন্ন হয়।

লিখতে হবে, বলতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে

এক্সট্রাকশন যা করেছে, তা ভুল; যা দেখিয়েছে, তা মিথ্যা আর গৎবাঁধায় ভরা। এমন কোনো উপস্থাপনা এক্সট্রাকশনে নাই যার কারনে এর পক্ষ নেয়া যাবে। আমরা এখানে যে বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছি, তা আমাদের বাস্তবের বাংলাদেশ নয়; কল্পনার বাংলাদেশতো নয়-ই। আমাদের কল্পনার বাংলাদেশ আরও সুন্দর, আরও মনোরম।

সিনেমার কাজ শুধু বিনোদন দেয়া আর অর্থ কামানো নয়, বিনোদন দেয়া যেকোনো সিনেমার প্রথম শর্ত হবে। কিন্তু এর বাইরেও সিনেমা নানান কাজ করে, বহু ফায়দা তুলে নেয়। আজকের দুনিয়ায় বৃহৎ অংশের মানুষের সম্মতি আদায়ের সবচে বড় টুল হিসেবে সিনেমা ব্যবহার হচ্ছে; এক্সট্রাকশন সেই কাজ করেছে। বাংলাদেশ এখানে উপস্থিত নাই, উপস্থিত আছে মাদক ব্যবসায়ী আর ঘুষখোর রাষ্ট্রীয় বাহিনী। আছে অলিগলিতে বন্দুক হাতে ঘুরে বেড়ানো কিশোরেরা। সারাবিশ্ব নিশ্চয় বাংলাদেশের এমন রূপ আন্দাজ করবে, বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। এ আশঙ্কা আমার যেমন আছে, অন্য আর দশজন সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষেরও আছে। এর মানে কি নেটফিলিক্স থেকে সিনেমাটি সরিয়ে নিতে বলবো? সিনেমাটিকে কি নিষিদ্ধ করার দাবি জানাবো? তা করা যাবে না, তা করা একজন সংস্কৃতি সচেতন মানুষের উচিত আর কর্তব্য কোনোটাই হবে না। বরং আমাদের আশু কর্তব্য হবে সিনেমাটির উপস্থাপনাকে যৌক্তিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এর নতুন নতুন পর্যালোচনা হাজির করা। এর আসল উদ্দেশ্য উদঘাটন করা, এর ভিতর কোন ধরনের রাজনীতি যুক্ত আছে তার হদিশ করা। আর এর বিপরীতে পাল্টা সিনেমা সৃষ্টি করে বিশ্ববাসীর কাছে হাজির করা।

রাকিবুল রাকিব

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করছেন। গল্প লেখেন। পাঠচক্র সংগঠন সংবিৎ-এর সঙ্গে যুক্ত।