অরাজ
আর্টওয়ার্ক: মাস্ক শিল্পী: এস. সুদজোজোনো সূত্র: লফটি
প্রচ্ছদ » জাস্টিন নেভিল কৌশাল ।। এডর্নো পুনর্পঠন : আর্ট কি ফ্যাশিজম রুখতে পারে?

জাস্টিন নেভিল কৌশাল ।। এডর্নো পুনর্পঠন : আর্ট কি ফ্যাশিজম রুখতে পারে?

অনুবাদ: শাহারিয়ার জিম

মূল প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিলো Philosophy Now নামক অনলাইন ম্যাগাজিনে, মূল লেখক Justin Neville Kaushall, University of Warwick এ নন্দনতত্ত্বে গবেষণারত।

র‍্যাডিকাল আর্ট আমাদের চিন্তা-চেতনাকে আমূল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম, থিওডোর এডর্নোর এই ধারনাটিকেই জাস্টিন কৌশাল বিবেচনা করে দেখতে চাচ্ছেন এইসময়ে এসে। এমন একটা সময়ে আমরা বাস করতেছি, যেখানে সারা-দুনিয়াব্যাপীই পপুলিস্ট মুভমেন্ট চাউড় হয়ে উঠেছে, এরকম সময়ে কি আর্টের দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত? এরকম একটা মন্দার কালে যখন সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সকল মৌলিক ভিত নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, এমতাবস্থায় শিল্প-সাহিত্য, মিউজিক এগুলা নিয়া ডুবে থাকাটা কি উটপাখির মতই মাটির নিচে মাথা ঢুকিয়ে রাখার মত কোনো ব্যাপার? নাকি শিল্পকর্ম নিজেই বাস্তবিকে আমাদেরকে কোনো পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করতে সক্ষম?

থিওডর এডর্নো
(১৯০৩–১৯৬৯)
উৎস: হোয়েন ইউ সি

আর্টের প্রতিবাদ

চলেন আগে দেখে নেই পলিটিক্সের ক্ষেত্রে আর্ট কী করতে আর কী করতে পারে না। একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি, রিচার্ড সেরা, সিন্ডি শেরমান, লুইস ল’লার, জোয়ান জোনাস, এবং জুলি মেহরেতু প্রমুখ আর্টিস্টরা ২০১৬ সালে ট্রাম্পের শপথপাঠের দিন পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বিভিন্ন আর্ট মিউজিয়াম এবং আর্ট গ্যালারি বন্ধ রাখেন একটি প্রতীকি প্রতিবাদ হিসেবে। তাদের ভাষ্যমতে, “এই প্রতিবাদ আসলে আর্ট, থিয়েটার অথবা অন্য যেকোনো সাংস্কৃতিক মাধ্যমের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নয়। বরং এটি আসলে এসব মাধ্যমকে নতুন করে ভাবার, চিন্তার, দেখার, অনুভব করার এবং কার্যসম্পাদনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি প্রক্রিয়া।” এই প্রস্তাব একধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০১৭ সালের ৯ই জানুয়ারী গার্ডিয়ান পত্রিকায় আর্ট ক্রিটিক জোনাথন জোন্স এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে “কিছু সাংস্কৃতিক ব্রাহ্মণের চটকদার র‍্যাডিকাল ঢঙ বা নাটক বলে আখ্যায়িত করেন”। অন্যকথায় বলতে গেলে, তিনি এরকমটা বলতে চাচ্ছেন: যেহেতু এসব আর্টিস্টরা কোনো ব্যক্তিগত রিস্ক নিচ্ছে না প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে, সুতরাং তাদের এই রাজনৈতিক প্রতিবাদ ব্যর্থ। তিনি আরও বলেন, “আমাদের এই বিষয়টার মুখোমুখি হওয়া উচিত যে, আর্ট এবং সিরিয়াস কালচার সম্পূর্ণভাবেই একটা প্রান্তিক বা মার্জিনাল পজিশনে অবস্থান করে আমেরিকান জীবনবোধে। আর্ট মিউজিয়াম বন্ধ করে দেয়াতে ট্রাম্পের সাপোর্টারদের কিছ্যুটি হবেনা”। “গোল্ডেন গ্লোবের আর্ট উৎসবে সুন্দর সুন্দর কথা বলা এবং এই ধরনের প্রতিবাদগুলো আসলে ব্যর্থ কারন আমরা যেই বিপদজনক বীভৎস দুনিয়াতে এখন বাস করতেছি, এইখানে জাস্টিস বা ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আর্ট তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না আসলে” এই বক্তব্যের মাধ্যমে জোন্স তার কথাগুলো শেষ করেন। জোন্সের মতে তাহলে, আমরা যেই ভয়ংকর দুনিয়াতে এখন বাস করতেছি, এই দুনিয়ার ভয়াবহতা এবং বীভৎস চেহারা যথেষ্টভাবে আর্টের মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব না। যেকোনো র‍্যাডিকাল আর্ট বা শিল্পমাধ্যমই আসলে বাস্তব যেকোন বিপদকে পাশ কাটায়া নিরাপদে থাকতে পারে। অর্থাৎ কোনো র‍্যাডিকাল দাবী নিয়া, যেমন ধরেন নিউক্লিয়ার যুদ্ধ, সামাজিক কুসংস্কার, পুলিশি জুলুম এসবের বিরুদ্ধে এক্টিভিস্টরা যেরকম গ্রেপ্তার, জেল, লাঞ্ছনা এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি থাকার পরেও সামনাসামনি রাস্তায় প্রতিবাদ করে, র‍্যাডিকাল আর্ট বা র‍্যাডিকাল আর্টিস্টদের সেই ঝক্কি না পোহাইলেও চলে, পাশ কাটায়া যাইতে পারে। বেশি হইলে তারা যেই বিপদের মুখোমুখি হয় সেইটা হইতেছে তাদের শিল্পকর্ম নিয়া নানাবিধ নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করা, নতুন নতুন কায়দা বের করা শিল্পকর্মের, যেগুলা দর্শককে একটা চিন্তাগত এবং অনুভবের জায়গায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, কিন্তু এই দর্শকের সংখ্যাটাওতো নেহাত কমই। এসব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনার পরে, আমরা তো এরকমটা স্বীকার করে নিলেই পারি যে, আর্ট আসলে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্ষমতাহীন? আর্টিস্টরা কেন এইটা স্বীকার করে নেয়না যে তারা সবসময় র‍্যাডিকাল পলিটিক্সের সাইডলাইনেই থাকে?

জার্মান ক্রিটিকাল থিওরিস্ট থিওডোর ডব্লিউ. এডর্নো, জোন্সের এই আর্গুমেন্টকে নাকচ করে দিতো। আর্টের সামর্থ্যকে এডর্নো (১৯০৩-১৯৬৯) দেখে ভায়োলেন্স (ক্যাপিটালিজম এবং ফ্যাশিজমে যেটার শিকার হই আমরা) সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন করে তোলার শক্তি হিসেবে, যেই বিষয়টা সবসময় ভাষার মাধ্যমে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। অন্যায়কে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে আর্টের নিজস্ব ঢঙ আছে, যেটা হয়তো সবসময় সরাসরিভাবে প্রাক্টিকাল পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব নয়, বরং দর্শককে তার সামাজিক এবং ঐতিহাসিক যে ভায়োলেন্সের ফাঁদ, সেই সম্পর্কে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর্টের এইরকম অনন্য পন্থায় প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা আসলে কোনো কার্যসম্পাদনের জন্য উস্কানি নয়, বরং চিন্তার উস্কানি হিসেবে কাজ করে আমাদের জন্য। এডর্নো’র মতে, জেমস জয়েস, আর্নল্ড শোয়েনবার্গ, স্যামুয়েল বেকেট, পল চিলান এবং পাবলো পিকাসোর মত মডার্নিস্ট শিল্প-সাহিত্যিকদের শিল্পকর্মে, ব্যক্তির অভিজ্ঞতাসমূহকে পুনঃসজ্জার মাধ্যমে সমাজের অনৈতিক চর্চার বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে এক ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এবং আমাদের র‍্যাশনাল চিন্তার শক্তিরে কীভাবে ধ্বংস করে ইর‍্যাশনালিটে পরিণত করে দেয় সমাজ, সেই বিষয়টাও চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখায়া দেয়। তার বিচারে, কমার্সিয়াল আর্ট (পপ মিউজিক, হলিউডের সিনেমা, টিভি শো, পপুলার উপন্যাস ইত্যাদি) এগুলা সামাজিক এবং ঐতিহাসিক নর্মগুলারে চ্যালেঞ্জের মুখে ফালাইতে ব্যর্থ, কারন এগুলা তৈরী হয় পাবলিকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে। এগুলা প্রায়শই বালখিল্যতা এবং বিভিন্ন গৎবাঁধা ফর্মুলা ব্যবহার করে তৈরী হয়। কমার্সিয়াল আর্ট যেহেতু সমাজের গৎবাঁধা নর্মসের বাইরে গিয়ে এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের বাইরে গিয়ে কোনো প্রকার আর্ট তৈরী করতে পারেনা, সুতরাং এসব আর্ট ব্যক্তির চেতনায় কোনো ধরনের র‍্যাডিকাল পরিবর্তন আনতেও অক্ষম। উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়, পপুলার ফোক মিউজিকের ক্ষেত্রে যেটা হয়, এই ধরনের গানবাজনা বেশিরভাগ সময়েই জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক যে গৎবাঁধা পরিচয়ের মধ্যে ব্যক্তি বাস করে, সেই ন্যারেটিভকেই বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শক্তিশালী করে তোলে (আমেরিকার ক্ষেত্রে যেমন মুক্তি, স্বাধীনতা, শক্তিমত্তা, স্বনির্ভরতা, এক কথায় বলতে গেলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকেন্দ্রিক কিছু ন্যারেটিভ)

আর্টওয়ার্ক: ডাই কাইন্ডস মর্ডারিন
শিল্পী: জিন মাম্মেন
সূত্র: পিনটারেস্ট

র‍্যাডিকাল আর্টের যেকোনো ধরনের স্ট্যাটাস ক্যো এর বিরুদ্ধে অবস্থান করা উচিত। এডর্নো’র মতে, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দর্শকের যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক গৎবাঁধা নর্মের একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সেখান থেকে বের করে এনে একধরনের “অপর” বা “বৈসাদৃশ্যের” সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারার অনুভূতি দেয়া। ১৯৪০এর দশকে নাৎসিদের দ্বারা নির্বাসিত অবস্থায় এডর্নো তার মিনিমা মোরালিয়া (১৯৫১, পৃষ্ঠা ২৫) বইতে জানান দিচ্ছেন: “ভয়ংকর বীভৎসতা তুলে ধরা, তার প্রতিরোধ করা, এবং উত্তম কোনোকিছুর বিভোর স্বপ্নের চেতনাকে পুষতে থাকার যে নেতিবাচক দিক সেটা তুলে ধরা ছাড়া বর্তমানে সৌন্দর্যের অন্য কোনো বোঝাপড়া নেই”। তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন, প্রচলিত যে সৌন্দর্যের ধারনা, সেটি দ্বারা তাড়িত হয়ে শিল্পকর্ম করাটা আর্টিস্টদের আর উচিত না। এই ধরনের প্রচলিত সৌন্দর্যের ধারনা দৈনন্দিন জীবনের বাইরে অতীন্দ্রীয় একপ্রকার সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের আরাম দিতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে, ভদ্রসমাজের ঘোমটার আড়ালে মূলত সহিংসতাই বসবাস করে। এক্ষেত্রে কেউ হয়তো বিলবোর্ডের সুন্দর সুন্দর বিজ্ঞাপনের কথা বলতে পারেন, যেগুলোর পেছনে আসলে প্রাতিষ্ঠানিক মিসোজিনি অথবা সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স লুকায়িত থাকে। পক্ষান্তরে, প্রকৃত আর্টের কাজ হচ্ছে সামাজিক সহিংসতার চিত্র শিল্পকর্মের মাধ্যমে (অহিংসভাবে) তুলে ধরার চেষ্টা করা। এরকম চেষ্টা আমরা শোয়েনবার্গের মিউজিকে দেখতে পাই। শোয়েনবার্গ ঐতিহাসিক সহিংসতাতে নন্দনতাত্ত্বিক ফর্মে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তার মিউজিকে, যার জন্য সে নতুন এক ধরনের ফর্মাল টেকনিকও উৎপন্ন করেছিলেন, যেটাকে এখন আমরা “Twelve-tone system” বলে জানি। এই সিস্টেম কাজ করে সুরের যে প্রচলিত ঐকতান সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে। এইরকম ঐকতান প্রত্যাখ্যাত কাজের উদ্দেশ্যই হচ্ছে একধরনের গুনগত অনন্য বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা, যার মাধ্যমে সামাজিক সহিংসতা বা ভায়োলেন্সের একপ্রকার নন্দনতাত্ত্বিক ফর্মে বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যায়। এডর্নোর মতে, প্রকৃত শিল্পকর্ম কখনোই আমাদের সাফারিংস বা পীড়নদায়ক অনুভূতিগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে পিছপা হবেনা, সেটা যতই বেখাপ্পা, হেঁয়ালিপূর্ণ এবং দুর্বোধ্য মাধ্যমেই হোকনা কেন। উদাহরণস্বরূপ স্যামুয়েল বেকেটের নাটকের কথাও এখানে বলা যায়, বেকেটের নাটকের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি ক্যাপিটালিস্ট সমাজে সাধারণভাবে যে বিষয়টাকে র‍্যাশনাল ভাবা হয়(স্বল্পশ্রম এবং স্বল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফা অর্জনের ব্যবহারিক বাসনা) সেটা প্রকৃত র‍্যাশনালিটির একটা বিকৃত সংস্করণ। এই ধরনের বিকৃত র‍্যাশনালিটি বাস্তব সহায়ক কোনো বিষয় না। তবে, এই ব্যাপারটি উপলব্ধির মাধ্যমে আমাদের সামনে একধরনের দার্শনিক উপলব্ধি এবং ‘অপরের’ সাথে ভিন্নতার ব্যাপারটিকে নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে দেখার একটি দ্বার উন্মোচিত হয়।

জর্জ ওরওয়েল
ছবি: উডরো কোহের
সূত্র: উডরো পিকচার্স
জর্জ অরওয়েল ১৯৮৪ ও এনিমেল ফার্ম লেখার আগে, আক্ষরিক অর্থেই স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে ফ্যাশিজমের বিরুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন।

যুদ্ধংদেহী আর্ট

তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আর্ট কীভাবে ফ্যাশিজমের বিরুদ্ধে ফাইট দিতে পারে?

প্রথমত, র‍্যাডিকাল বা চ্যালেঞ্জিং আর্ট পাশ্চাত্য জীবনধারায় মার্জিনাল বা প্রান্তিক হওয়া সত্ত্বেও, অস্থিতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য এর বিশাল পরিমাণে দর্শকের প্রয়োজন নেই। জোন্স তার প্রবন্ধে আর্টের রাজনৈতিক উপযোগীতা পরিমাপের ক্ষেত্রে, একটা আর্ট কতজন দর্শকের মনে ছাপ ফেলতে পারলো সেই বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু আসলে একটা আর্ট যদি একজন দর্শকের মনেও ছাপ ফেলতে পারে, যেমন একজন দর্শকও যদি পিকাসো’র গুয়ের্নিকা চিত্রকর্মটি দেখে সেটার শক এবং বীভৎসতা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলেও বলা যাবে ঐ চিত্রকর্মটি সার্থক।

এডর্নো’র নন্দনতত্ত্ব স্পষ্টভাবেই বাস্তবধর্মীতার বিরুদ্ধে। যার স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায় তার কথায়, “সত্য সেটাই যেটা এই দুনিয়ার সাথে মানানসই না” (Aesthetic Theory, 1970, p.76)। এডর্নো বলতে চাচ্ছেন, প্রকৃতপ্রস্তাবে সত্য এক ধরনের নৈতিক ক্যাটাগরি। যার ফলে প্রকৃত শিল্পকর্ম আসলে প্রথাগত চর্চাকে এড়িয়ে নিজস্বতা, ভিন্নতা এসবের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। যখন গৎবাঁধা সামাজিক প্রথানুযায়ী কোনোকিছু করা হয় তখন সেটা বিরাট আকারে জনপ্রিয়তা পায় বটে, কিন্তু কিছু অত্যাবশক জিনিস তার মধ্যে অনুপস্থিতও থাকে। এডর্নো’র বিচারে, নৈতিক কর্মসম্পাদনের জন্য মুক্ত বা স্বাধীন মন এবং ক্রিটিকাল চিন্তা অপরিহার্য, তার পাশাপাশি স্বাতন্ত্র্যের অভিজ্ঞতাও জরুরী (যেটা কোনো বস্তুর গুনগত অথবা উপাদানগত অনন্যতা বজায় রাখতে পারে)। আর্ট কীভাবে এই ধরনের নৈতিক সত্যে পৌঁছানোর লায়েক হয়ে ওঠে?

এই প্রশ্নের জের ধরেই আমরা দ্বিতীয় বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করতে পারি, অর্থাৎ যে কারনে আর্ট প্রতিরোধ গড়তে সক্ষ: কোনো শিল্পকর্ম তার অন্তর্নিহিত আইডিয়াগুলোকে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত ভাষা এবং কনসেপ্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেনা। বরং, শিল্পকর্ম তার সত্যকে ফুটিয়ে তোলে কাব্যিক এবং শৈল্পিক ভাষার মাধ্যমে, যেই ভাষা পারতপক্ষেই কোনো প্রকার প্রথাগত আইডিওলজি যা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া ছাড়াই গৃহীত হয়, সেটাকে এড়িয়ে চলে। সুতরাং, এডর্নো’র চিন্তানুযায়ী, মডার্ন শিল্পকর্মের মধ্যে যেগুলো উত্তম, সেগুলো আসলে একধরনের অসংগতিই তুলে ধরে বারবার, বীভৎসতা এবং তকলিফের উপস্থাপনা করে। চেলানের কবিতায় যেরকমটা সে পর্যবেক্ষন করেছেঃ “চেলানের কবিতা চরম পর্যায়ের বীভৎসতা প্রকাশ করে নৈঃশব্দের মাধ্যমে। স্বয়ং সত্যের বিষয়বস্তুই হয়ে ওঠে নঞর্থক।” (Aesthetic Theory p.405)। এই পন্থায়ই হয়তো আর্টের পক্ষে ধ্বংসযজ্ঞের বর্তমান দুনিয়ার প্রতি “ইনসাফ করা” সম্ভব।

আর্ট ওয়ার্ক: ড. রেস্টলেসস’ বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড
শিল্পী: ফেড্রিকো জুকারি

এডর্নোর আলাপ এখান থেকে আরও কিছুদূর এগিয়ে যায়, যেহেতু ক্যাপিটালিজম কোনো বস্তুর মূল্য নির্ধারণের সময় প্রবলভাবে জোর দেয় ওই বস্তুর মুদ্রামূল্যের ওপরে, স্বকীয় মূল্য বা ইন্ট্রিন্সিক ভ্যালুকে কম মূল্যায়ন করে, সেহেতু মডার্ন শিল্পকর্মের উচিত এমন কাজ তৈরী করা যা আসলে মুদ্রামূল্যের কাছে বেহুদা হিসেবে হাজির হয়, তবে এর পাশাপাশি যেন সেটার ইন্ট্রিন্সিক ভ্যালু (যা গোনা যায়না) সেটাও অক্ষত থাকে। এইজায়গা থেকে সে মনে করে যে, এমন শিল্পকর্ম করা থেকে বিরত থাকা উচিত যা নাঙ্গাভাবে কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডারে বাস্তবায়ন করতে চায়, শিল্পের নিজস্বতা হারায়ে রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদিও পার্সি বিশি শেলি একজন ওস্তাদ পর্যায়ের কবি, কিন্তু তার কিছু সেরা কাজ সরাসরিভাবে পলিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গিরে কায়েম করতে চায় এরকম প্রবণতাসম্পন্নও বটে (England in 1819, Masque of Anarchy…)। উল্টাদিকে, জন কিটসের কাজগুলা এমন কিছু থিম এবং সেট আপ ব্যবহার করে লেখা, যেগুলা প্রথাগত স্টাইলেই যোগাযোগ করতে চায় পাঠকের সাথে কিন্তু ওই প্রথাগত স্টাইল ব্যবহার করেই সে আবার প্রথা’র বিরোধীতা করতে থাকে, এবং শিল্পকর্মকে কোনো রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা থেকেও বিরত রাখে। (যেমনঃ To Autumn, Ode to a Grecian Urn). এই একই যুক্তিতে, বব ডিলান কম কার্যকরী বিঠোভেনের তুলনায়। কারন ডিলানের কাজ যতটা না স্পষ্টভাবে পলিটিকাল, বিঠোভেনের কাজ সে তুলনায় কম স্পষ্ট কিন্তু তার মধ্যে থেকেই আবার পলিটিকালও।

এই ধরনের কথাবার্তা বাহ্মণ্যবাদী বা এলিটিস্ট মনে হইতে পারে, কিন্তু এডর্নো’র আলাপে সেটা মুখ্য না। সমাজের বাইরে আর্টের নিজস্ব স্বকীয়তার কারনেই সে সমাজের ক্রিটিক হিসাবে আভির্ভূত হইতে পারে- বিশেষ করে, কোনো একটা সাবজেক্টকে সে এইটা বুঝায়া দিতে পারে যে, অবজেক্ট আসলে কোনো কোনো ‘ব্যবহারিক কারন’ (অথবা যেমনটা আমরা বুঝি হেজিমোনিক বিনিময় মূল্য)  দ্বারা নির্ণীত হয়না। একারনেই, যেকোনো শিল্পকর্ম যার স্বকীয়তা থাকেনা, যেমন কমার্সিয়াল টিভি শো, যেটা একেবারেই কর্পোরেট স্পন্সর এবং গৎবাঁধা স্টোরিলাইনের উপরে নির্মিত হয়, অথবা সবথেকে জনপ্রিয় গান, যার মেলোডিগুলো গৎবাঁধা এবং সহজে হজম করা যায় বেশি চিন্তাভাবনা না করেই, সেগুলা শিল্পকর্ম হিসেবে অবশ্যই ব্যর্থ। একই যুক্তিতে, নাঙ্গাভাবে রাজনৈতিক শিল্পকর্ম করলে, সেইটা আসলে সাবজেক্টকে বলেই দেয় যে কী ভাবতে হবে, একজন সাবজেক্টের অভিজ্ঞতার নকশা কীরকম হতে হবে সেদিকে একটা নিশ্চিত নির্দেশনা দেয়। পক্ষান্তরে, স্বায়ত্তশাসিত বা অটোনোমাস শিল্পকর্ম বরং সাবজেক্টের অভিজ্ঞতাকে যেকোনো “অপর” অথবা “বৈসাদৃশ্য” বিষয়াবলীকে অনুভব করার দিকে ধাবিত করে। এই ধরনের শিল্পকর্ম ক্রিটিকাল চিন্তাকে আটকে দেয়ার বদলে মুক্ত করতে সক্ষম।

মেরেট ওপেনহেটস অবজেক্ট ১৯৩৬

আর্টের মুক্তিকামিতা

যেকোনো কনসেপ্ট যা নিজেকে সার্বজনীন বলে দাবী করে, এরকম কনসেপ্টের পক্ষে কোনো বাস্তবিক বস্তুর সকল ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারার সক্ষমতা থাকেনা। এডর্নো এই বিষয়টিকে বলেন কনসেপ্ট এবং অবজেক্টের নন-আইডেন্টিটি (Minima Moralia p.127). আমাদের অভিজ্ঞতার কিছু বিশেষ কনসেপচুয়াল ব্লাইন্ড স্পট থাকে, এটা যখন আমরা উপলব্ধি করতে পারি, তখন আমরা এই ব্যাপারটির মুখোমুখি হই। যেমন কোনো অবজেক্টের উপাদানগত সকল বৈশিষ্ট্যকেই আমরা সবসময় যথেষ্টভাবে বর্ণনা করতে সক্ষম নই। একইভাবে, নিদির্ষ্ট কিছু শিল্পকর্মও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে কারন তাদের মাধ্যমে আমরা ওই অবর্ণনীয় বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারি, যা হয়তো কনসেপচুয়ালি কখনোই বর্ণনা করা যেতোনা। কনসেপ্টসের মাধ্যমে মূলত কোনো অবজেক্টের বিশেষত্বের সম্ভাবনা স্পষ্ট হওয়ার বদলে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অপরকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপলব্ধি করার নতুন দ্বারসমূহ আর্ট আমাদের সামনে উন্মোচন করতে পারে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাগুলোকেই বিশেষভাবে দমন এবং অস্বীকার করতে চায় ফ্যাশিজম। নন-আইডেন্টিটি কীভাবে নান্দনিক উপায়ে প্রতীয়মান হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই যখন আমরা কোনো আর্টগ্যালারিতে একটা শিল্পকর্মের সামনে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পর্যবেক্ষন করি যে এরকম অসম্ভব, অদ্ভুত এবং হতবুদ্ধিকর কাজ কীভাবে তৈরী হয়! – যেমন মেরেট ওপেনহেইমের “Object” কাজটি(১৯৩৬ সালে তৈরী)- একটি চায়ের কাপ, পিরিচ এবং চামচ, যেগুলো পশম দ্বারা আবৃত।

মডার্ন আর্ট আমাদের সাথে অপরের যে বৈসাদৃশ্য সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করে, যা প্রথাগত ক্যাটাগরিতে অসম্ভব বলেই মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে। আরেকটা উদাহরণ বলা যায় পল চেলানের কবিতা “Death Fugue”(সম্ভবত ১৯৪৫ সালে লেখা), এর প্রথম স্তবকের কিছু লাইন:

মৃত্যুর গীত

ভোরের কালো দুধ আমরা পান করি সন্ধ্যায়

পান করি দুপুরে পান করি সকালে

আর রাতেও

আমরা পান করি পান করতেই থাকি

আমরা কবর খুড়ি বাতাসে যেখানে চাপাচাপি নাই কোন

বাড়ির ভেতরে যে বুড়ো থাকে সে সাপ নিয়ে খেলে আর লেখে

সে লেখে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে জার্মানিতে

তোমার সোনালি চুল মার্গারিটা

সে লেখে আর দরজার বাইরে যায়

তারারা ঝকমকায়

শিষ দিয়ে হাউন্ডদের ডাকে সে

আর শিষ দিয়ে তার ইহুদিদের ডেকে কবর খোড়ায়

আমাদের নাচার আদেশ দেয়।

(অনুবাদ কৃতজ্ঞতা: তাসনিম রিফাত)

এই কবিতাটি কি সহজেই কোনো এস্থেটিক ক্যাটাগরি যেমন সুন্দর, মহৎ, কুৎসিত, অশ্লীল, মনোরম, উদ্ভট বা আকর্ষনীয় এসবের মধ্যে ফেলা সম্ভব? প্রথমত, একটা বিষয় আমি বলে রাখতে চাই যে, এই ধরনের ক্যাটাগরিগুলি সাধারণ প্রথাগত সংস্কৃতির বেঁধে দেয়া ক্যাটাগরি, এদেরকে অবশ্যই বারবার খতিয়ে দেখা উচিত যাতে করে এরা কোনো সাংস্কৃতিক ফ্যান্টাসির অঙ্গ না হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, এডর্নোর বিচারে, এস্থেটিক ক্যাটাগরি কখনোই কোনো সাবজেক্টের আবেগ-অনুভূতির  প্রতিক্রিয়ার হিসাব করে হওয়া উচিত নয়। বরং এই ক্যাটাগরি তৈরী হওয়া উচিত শিল্পকর্ম বা বস্তুটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিবেচনা করার মাধ্যমেই। শুধুমাত্র এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেই কোনো শিল্পকর্মের অন্তর্গত গঠনকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এছাড়াও এই দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, আমরা একটি শিল্পকর্মের সত্য উৎপাদন এবং তা বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে সেটি কতখানি সার্থক এবং ওই শিল্পকর্মের হেঁয়ালিপূর্ণ সারফেস কতটা সার্থক এই বিচার সঠিকভাবে করতে পারবো।

উদ্বুদ্ধকারী আর্ট

আর্ট কীভাবে ফ্যাশিজমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে সেটার চতুর্থ পয়েন্টে আমরা যাবো। যেকোনো শিল্পকর্মের মাধ্যমে আমরা আশা এবং সম্ভাবনার অভিজ্ঞতায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি যেখানে অনিবার্য ঘৃনা এবং হতাশা রাজ করে।

এডর্নো লেখায় ইতিবাচকতা বিরল, কিন্তু এখানে তিনি একটু সেরকম দৃষ্টিভঙ্গিরও ব্যবহার করেছেনঃ “হয়তো প্রকৃত সমাজ বিকশিত হতে হতে ক্লান্ত হয়ে যাবে, স্বাধীনতার শেষ দেখে ফেলবে, অন্য সম্ভাবনাগুলোকে গোনায় ধরবেনা, এবং চরম বিভ্রান্তির মুখে অজানা তারকামণ্ডলীকে জয়ের লক্ষ্যে রওনা হবে”(Minima Moraliap.156). ফ্যাশিজম এবং ক্যাপিটালিজম দুটোই প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন করতে চায়(অজানা তারকামণ্ডলীকে জয় করা)- বৈচিত্র্য, বৈসাদৃশ্য এবং অপরকে সে সহজেই চিনতে চায়, রুদ্ধ করতে চায়, নিয়ন্ত্রন করতে চায়। কিন্তু আর্ট তার র‍্যাডিকাল রূপের মাধ্যমে এই দুনিয়ার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য করতে চাওয়ার প্রবণতাটিকেই রুখে দিতে পারে।

যেমন, পল চিলানের কাজ প্রথাগত কবিতার বেশিরভাগ নিয়মই ভঙ্গ করে। তিনি অনেক সময়েই সরাসরি না বলে নতুন নতুন শব্দ উৎপাদন করে তার মাধ্যমে পাঠকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতেন। পাঠক যাতে কবিতা থেকে নতুন ধরনের কোনো মেসেজ উৎপাদন করতে পারে সেরকম এক চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিতেন তিনি। তার কবিতা এক প্রকার কোডের মত, ন্যারেটিভ নয়, এবং এটি এমন কোড যা আসলে ডিকোড করা যায়না। যেমনটা এডর্নোও তার Aesthetic Theory (অসমাপ্ত ১৯৬৯ এ মৃত্যুর সময় পর্যন্ত) উল্লেখ করেছে: “নতুন কোনোকিছুর ক্রিপ্টোগ্রাম(সাংকেতিক ভাষা) মানেই হচ্ছে একপ্রকার পতনের প্রতিবিম্ব; পতনের চরম নঞর্থক গুনের মাধ্যমেই অব্যক্ত ইউটোপিয়াকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে আর্ট”। কোনো এক ইউটোপিয়ার দিকেই হয়তো আর্ট বারবার ইঙ্গিত করে, ব্যক্তিকে সবসময় নতুন রূপে নতুন টেকনিকে তার অভিজ্ঞতাসমূহ সম্পর্কে সচেতন করে তুলে, এমন এক অল্টারনেটিভ দুনিয়ার সম্ভাবনা দেখানো যেখানে হয়তো সমাজের র‍্যাডিকাল সমালোচনার আর দরকার হবেনা। অস্তিত্বশীল ফর্মগুলোকে আর্টের মাধ্যমে নেগেট বা নেতি করে দেয়ার পরেই হয়তো ইউটোপিয়াকেও দৃষ্টিগোচর মনে হতে পারে।

আর্টওয়ার্ক: লেকরা
শিল্পী: লেম্বাগা কেবুদা
সূত্র: পিনটারেস্ট

এখন এখানে আপনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন: ইউটোপিয়া নিয়া আমার মাথা ঘামানোর দরকার কী? কিন্তু এডর্নোর ইউটোপিয়ার ধারনা একেবারেই নঞর্থকঃ এই ইউটোপিয়া একেবারেই একটা সীমিত ধারনা যেটা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিটা সমালোচনা বা ক্রিটিসিজমই যৌক্তিকভাবে আমাদের সামনে এমন এক নজির হাজির করে, যেটার মধ্যে পূর্বোক্ত বাতিল করে দেয়া কোনো উপাদানই অস্তিত্বশীল থাকেনা। সহজ কথায় বলতে গেলে, ক্রিটিসিজমের সম্ভাবনা মানেই প্রগতি বা প্রগ্রেসেরও সম্ভাবনা থাকা।

এই আলাপের জেরেই আমি এখন শেষ কারনটির দিকে আগাবো যেটার মাধ্যমে আর্ট ফ্যাশিজমকে রুখতে পারে। আর্ট যেহেতু সমাজ এবং ইতিহাসের গণ্ডি থেকে আংশিকভাবে মুক্ত সুতরাং তার পক্ষে সমাজের সমালোচনা করা, সমাজকে নিয়া ক্রিটিকালি চিন্তা করা এবং আরও উত্তম সমাজ যে সম্ভব সেসম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়ার একটা সামর্থ্য থাকে। মুক্তভাবে সমাজের সমালোচনা করার জন্য শিল্পকর্ম একটা উছিলা হিসেবে কাজ করতে পারে এবং নতুন নতুন মাধ্যমকে আশ্রয়ও দিতে পারে। এইধরনের সমালোচনা বা ক্রিটিক হয়তো প্রাক্টিকাল কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেনা- যেমন কোনো ফ্যাশিস্ট রাষ্ট্রপরিচালকের পতন ঘটানো বা তার দেয়া নির্দেশকে অমান্য করা। তবে ক্রিটিক করতে গেলে চিন্তা করতে হয়, আর এই চিন্তা করার প্রক্রিয়াই কোনোকিছুকে অন্ধভাবে মেনে নেয়ার প্রবণতা রোধ করতে পারে। সুতরাং, জনবল নিয়া রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ গড়ে তোলাটার সাথে তুলনা করলে হয়তোবা আর্টের প্রতিবাদের জায়গাটা নিষ্ফল মনে হইতেই পারে, কিন্তু আসলে র‍্যাডিকাল শিল্পকর্মগুলার গুরুত্ব ঠিক এইজায়গাতেই যে, সমাজে বিদ্যমান যে ক্ষমতা এবং বলপ্রয়োগের শক্তি সেটা ব্যবহার করেনা। শিল্পকর্ম সরাসরি কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনা তার নিজস্ব গুনগত কারনেই। কারন শিল্পকর্ম সমাজের গৎবাঁধা যুক্তির বাইরেই অবস্থান করে। অনেক শিল্পকর্ম বরং আমাদেরকে সমাজের যে উপযোগবাদী কাঠামো যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাকে ঘিরে থাকে, সেটাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। এডর্নো তার Minima Moralia বইয়ের ১১১পৃষ্ঠায় এরশাদ করেছেনঃ “প্রতিটা শিল্পকর্মই আসলে একটি অসংঘটিত অপরাধ”। সহজ কথায় বলতে গেলে, শিল্পকর্ম করাটা হচ্ছে সমাজের অসহনীয় নিয়মশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে একপ্রকার নাশকতা করার মত। তবে যেহেতু শিল্পকর্ম সবসময় সামাজিক শৃঙ্খলা এবং বিন্যাসের বেধে দেয়া যে নিয়ম এবং নর্মস সেগুলোর বাইরে গিয়ে স্বায়ত্তশাসিতভাবে থাকে বা থাকতে চায়, সেকারনে তার পক্ষে বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। একটা শিল্পকর্মের সত্যকে প্রকাশ করে নান্দনিক উপায়ে, প্রাক্টিকাল উপায়ে নয়।

এডর্নোর মতে, চিন্তা করাই এক প্রকারের পরোক্ষ প্রতিরোধ, এবং সব ধরনের কাজকর্মের জন্যই চিন্তা এবং জাজমেন্ট এই দুইটা বিষয়ের দরকার আছে যদি তারা আহাম্মকি পরিহার করতে চায়। তবে অবশ্যই সব শিল্পর্কমই যে প্রগ্রেসিভ বা আভাগার্ডের অংশ হয় সেরকমটা না। এডর্নোর যুক্তিতে, সোভিয়েতের অনেক রিয়ালিস্ট চিত্রকর্মই নিছক প্রোপাগান্ডা মাত্র, তারা কোনো ধরনের নতুন ফর্মাল টেকনিক বের করতে ব্যর্থ যা সমাজের বাইরে নিজের স্বকীয়তার জানান দিতে পারে। কিছু স্যুররিয়ালিস্ট চিত্রকর্ম এবং কবিতায়ও লিঙ্গবিদ্বেষ না নারীবিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায় কারন তা নারীদের দেহকে অবজেক্টিফাই করে, এছাড়াও তারা অনেক জায়গাতে নারী চিত্রকর, লেখিকা কিংবা নারী বুদ্ধিজীবীদেরকে হেয়প্রতিপন্ন ও দমন করতে উদ্যত হয়েছিলো। এবং আমাদেরকে এটা ভুলে গেলেও চলবেনা যে, জিনিয়াস রিচার্ড ওয়াগনার একজন কুখ্যাত এন্টি-সেমাইট ছিলেন এবং তার লিখিত অপেরাগুলোতে অলীক আর্য অতীতের দিকে ফিরে যাওয়ার এক ফ্যাশিস্ট বাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো।

আর্টের অবস্থান

শিল্পকর্মের মতই মানুষও একইসাথে দুইটা দুনিয়ার বাসি: একটা বাস্তব দুনিয়া আরেকটা সম্ভাবনার দুনিয়া। এরকম মন্দার কালে আমাদের পথনির্দেশক হিসেবে কোন দুনিয়ার কম্পাস ব্যবহার করা উচিত? স্যামুয়েল বেকেট অবশ্য একটা দিশেহারা দিশা’র ইঙ্গিত দিয়া গেছেন:

“You must say words, as long as there are any, until they find me, until they say me, strange pain, strange sin, you must go on, perhaps it’s done already, perhaps they have said me already, perhaps they have carried me to the threshold of my story, before the door that opens on my story, that would surprise me, if it opens, it will be I, it will be the silence, where I am, I don’t know, I’ll never know, in the silence you don’t know, you must go on, I can’t go on, I’ll go on.”

(Trilogy: Molloy, Malone Dies, The Unnamable, 1959, p.418)

ইংরেজীতে মূল প্রবন্ধের লিংকঃhttps://philosophynow.org/issues/129/Can_Art_Fight_Fascism?utm_term=Autofeed&utm_medium=Social&cpg=ebfb&utm_source=Facebook#Echobox=1561762950

শাহারিয়ার জিম