- খন্দকার তূর আজাদ
সোমবার রাতে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের সদস্যরা। ভারত রাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পোস্ট দেয়ার পর শিবির ট্যাগ দিয়ে তার উপর ভয়ানক রকমের নির্যাতন চালানো হয়৷ এরপর থেকেই বুয়েট সহ সারাদেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলে৷ বুয়েটে ছাত্রলীগের নির্যাতনের আরো অসংখ্য ঘটনা বের হয়৷ সেসব ঘটনা প্রকাশ করা ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে, এদিকে আবরারের ভাইয়ের উপর চড়াও হয় পুলিশ।
অথচ সবকিছু পর শেষ পর্যন্ত আলাপ যেয়ে ঠেকলো সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করাতে। তাই আমাদের আবার প্রথম আলাপেই ফেরত যেতে হয় যে কেমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এরকম করে একটা ছেলেকে পিটায় মেরে ফেলা সম্ভব হল। কেন নিজের দেশের জনগণের স্বার্থ নিয়ে মতপ্রকাশ করায় ছাত্রলীগ টর্চার সেলে ডেকে এনে ঘন্টার পর ঘন্টা পিটিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলতে পারলো?
বিদ্যালয়ের হলগুলাতে ছাত্রলীগের প্রশ্নহীন দখলদারিত্বর কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। সেই ক্ষমতা তারা পেয়েছে সরকার থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাস চালানোর ফ্রি লাইসেন্স পেয়েছে প্রশাসন থেকে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নির্যাতন-হত্যাকান্ড এটাই প্রথম না৷ প্রশাসনের নাকের ডগায় ম্যানার শেখানোর নাম করে, শিবির নিধনের নাম করে প্রতিনিয়ত টর্চার সেলগুলাতে নির্যাতন চালানো হয় শিক্ষার্থীদের উপর৷ কিন্তু প্রশাসন ও ছাত্রলীগ পরস্পরের পোষা জানোয়ার হওয়ায়, শিক্ষার্থীরা কখনো প্রতিরোধ গড়তে চাইলেও তা থামিয়ে দেয়া হয়েছে৷ পুলিশের সাথেও এই দুই পক্ষেরই ভালো সম্পর্ক৷ বড় কারণ তো অবশ্যই সরকারের স্বার্থ রক্ষা, তবে তা ছাড়াও টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিতে এসব পক্ষ নিকটাত্মীয়। এরা প্রত্যাকেই এই স্বৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ।
আবরার হত্যার পর আরেকটা ব্যাপারে সবাই সোচ্চার ছিল যে, এখানে বাকস্বাধীনতা নাই৷ বাকস্বাধীনতা চর্চার কারণে নির্যাতন-হত্যা কিন্তু শুধু লীগ বা অন্য সন্ত্রাসী সংগঠনই করে না, সবচেয়ে বেশি মাত্রায় করে ‘আইন- শৃঙখলা রক্ষাকারী’ বাহিনীগুলাই। গুম-ক্রসফায়ারে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে? পুলিশি হেফাজতে কতটা ভয়ানক অত্যাচার চালানো হয়? সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার বৈধভাবেই নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। যেকোন প্রতিবাদকারীকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে জেলখানায় ঢুকানো সম্ভব। এবং ‘ অপরাধ সংঘটিত হইবার সম্ভাবনা’ দেখলেই পুলিশ যে কাউকে তল্লাশি, গ্রেফতার করতে পারে। এই বৈধ নিপীড়নের সুযোগেরই ভিন্নমাত্রার প্রতিফলন হচ্ছে ট্যাগ দিয়ে ছাত্রলীগের নির্যাতন চালানোটা।
আবরারের সর্বশেষ স্ট্যাটাস ছিল ভারত রাষ্ট্রের আগ্রাসন নিয়ে, জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি নিয়ে৷ ‘ বন্ধু রাষ্ট্রের ‘ স্বার্থরক্ষায় কিছুদিন আগেও কাশ্মীরে মোদি সরকারের নিপীড়ন নিয়ে উচ্চবাচ্য না করতে দেশীয় বৈধ নিপীড়ক বাহিনী হুঁশিয়ারি দিয়েছে। দেশের মানুষকে প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করে, নজরদারি বাড়িয়ে বিভিন্নভাবে ভারত রাষ্ট্রের নিপীড়ন জারি রাখার সুযোগ দিচ্ছে সরকার৷ কারণ কারচুপির নির্বাচন দিয়ে আসা এই সরকারের প্রধান রক্ষাকবচগুলির একটি ভারত রাষ্ট্র।
বুয়েটের বন্ধুরা তদের দৃষ্টিকোণ থেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করাকে সমাধান ভাবতে পারেন, কিন্তু আমাদের বুঝা দরকার যে সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের, শ্রেণীর, পেশার আবরারদের জন্য এটা বুমেরাং হয়ে উঠতেই পারে।
আপাতত, ছাত্রলীগের মত লাভজনক প্রকল্প থেকে সরকারের সরে আসার সম্ভাবনা দেখি না৷ কিন্তু নিওলিবেরাল নীতিতে চলা সরকার, প্রশাসনিক চরম স্বৈরতন্ত্রের এই সরকার ভবিষ্যতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেই ভায়োলেন্স আরো ভয়ানকভাবে জারি রাখতে পারবে৷আন্দোলন করা নারী শ্রমিকককে মেরে গর্ভপাত ঘটানোর ভায়োলেন্স, ফি বাড়ানো নিয়ে কথা বলায় ছাত্র বহিঃষ্কারের ভায়োলেন্স, কৃষককে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করার ভায়োলেন্স আরো বহুগুণে বাড়বে৷ সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে, কিন্তু ছাত্র অধিকারের রাজনীতি করতে দিবে, স্বৈরাচারের কাছে এমনটা আশা করা অমূলকই বটে৷
তাই নিজেদের অধিকার আদায়ের জায়গা নিষিদ্ধ না করে বরং স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের নিপীড়নের জায়গাগুলাতে আঘাত করার জন্য নিজস্বতা বজায় রেখেই নিপীড়িতদের ঐক্য দরকার যার লক্ষ্য হবে জনতার সার্বিক মুক্তি৷
তথ্যসূত্র
১. আবরার হত্যাকান্ড (https://www.bbc.com/bengali/news-49982663)
২. নির্যাতনের তথ্য প্রকাশের সাইট বন্ধ (https://www.bbc.com/bengali/news-50001035)
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (http://www.banglatribune.com/national/news/287899)
৫. বাংলাদেশ-ভারত সর্বশেষ চুক্তি্র বিশ্লেষণ (https://www.bbc.com/bengali/news-49953300)
৬. পুলিশের লাঠিচার্যে নারী শ্রমিকের গর্ভপাত (https://jogfal.com/2019/25620/?fbclid=IwAR0tnr1P4Avhf2F8IKLDz3dT88vdl9uMP6EgDn9sXg8ksbvFIX77cwZbWW0)