- অনুবাদ: পূজা রায়
গণআন্দোলনের সম্মুখে যে বিপত্তি উপস্থিত তা হচ্ছে প্রতিরোধের এনজিওকরণ। আমি যা বলতে যাচ্ছি তাকে সমস্ত এনজিওর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক একটা অভিযোগনামা হিসেবে পেঁচিয়ে ভিন্ন অর্থ করা সহজ হবে। আর তেমনটি করা হলে এটা মিথ্যাচার হবে। ভূয়া এনজিও স্থাপন বা অনুদানের অর্থ মেরে দেয়া বা কর ফাঁকি দেয়ার মতন ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্যই কিছু কিছু এনজিও মূল্যবান কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু, এনজিও প্রপঞ্চটিকে একটা বৃহৎ রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮০-১৯৯০ এর দশকের শেষদিকে ভারতে অনুদানপ্রাপ্ত এনজিও’র উত্থান হয়েছিল। একই সাথে ভারতের বাজারে নিওলিবারিজমও চালু হয়েছিলো। সেই সময়ে, কাঠামোগত সামঞ্জস্যতা (structural adjustment) বজায় রাখতে ভারত রাষ্ট্র গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি, জ্বালানি, পরিবহণ এবং জনস্বাস্থ্য খাত থেকে অনুদান প্রত্যাহার করা শুরু করেছিল। আর রাষ্ট্র যেহেতু চিরাচরিত ভূমিকা পরিত্যাগ করেছিল, এনজিও তখন সেই জায়গাগুলোতে কাজ করা শুরু করেছিল। তবে এখানে তফাৎ হল, জনসাধারণের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দের তুলনায় তাদের বরাদ্দকৃত তহবিলের পরিমাণ খুবই নগণ্য ছিল।
বেশিরভাগ বড় বড়ো এনজিও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে এমন কিছু সংস্থা যারা ঘুরেফিরে পশ্চিমা সরকারগুলো, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ এবং কয়েকটি বহুজাতিক কর্পোরেশন দ্বারা অর্থায়িত হয়। এগুলো হুবুহু একই ধরনের এজেন্সি নাও হতে পারে, তবে অবশ্যই এগুলো একই আলগা রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ যা কিনা নয়া-উদারবাদী প্রকল্পের তদারকি করে এবং শুরুতেই সরকারি ব্যয় কমানোর তাগদা দেয়।
এখন কথা হলো, এই সংস্থাগুলি কেন এনজিওগুলোকে অর্থায়ন দেয়? এটি কি কেবল পুরানো ধাঁচের মিশনারি উদ্দীপনা? নাকি অপরাধবোধ? এটি আসলে তার চেয়েও কিছুটা বেশি। এনজিওগুলো ধারণা দেয় যে, তারা পশ্চাদপসরণকারী রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করছে। তারা তা করছেও কিন্তু সেটি আদতে নিষ্ফল পদ্ধতিতে। তাদের আসল অবদান হলো তারা রাজনৈতিক ক্ষোভকে হ্রাস করছে এবং জনগণের প্রাপ্য অধিকারগুলোকে সহায়তা বা দানশীলতা হিসাবে বণ্টন করছে। তারা জনসাধারণের মানসিকতা পরিবর্তন করছে, যা কিনা জনগণকে নির্ভরশীল শিকারে পরিণত করে এবং রাজনৈতিক প্রতিরোধের তীব্রতাকে ভোঁতা করে দেয়। এনজিওগুলো সরকার এবং জনসাধারণের, সাম্রাজ্য এবং তার প্রজাদের মধ্যে নিরপেক্ষ একধরনের অবস্থান তৈরি করেছে। তারা হয়ে উঠেছে সালিশকারী, ব্যাখাদানকারী এবং সুবিধাদাতা।
শেষ পর্যন্ত এনজিওগুলি যাদের জন্য কাজ করে তাদের কাছে নয় বরং তাদের অনুদানকারীদের কাছে দায়বদ্ধ। উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের ভাষায় তাদেরকে “ইনডিকেটর স্পেসিস” বলা যায়। আসলে নিওলিবারেলিজম দ্বারা সৃষ্ট বিপর্যয় যত বেশি, এনজিওগুলির প্রাদুর্ভাব ততো বেশি। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দেশকে আক্রমণ করা এবং বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে সেই দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করার জন্য এনজিও তৈরি করার প্রস্তুতি একই সাথে চলে। এনজিওগুলোর অর্থায়ন যেন ঝুঁকিতে না পড়ে এবং যে দেশেগুলোতে তারা কাজ করতে চায় সেখানকার সরকার যেন তাদেরকে কাজ করার অনুমতি দেয়, সেজন্য এনজিওগুলোকে তাদের কাজকারবারকে সংকীর্ণ পরিসরে এবং কমবেশি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করেই উপস্থান করতে হয়।
দরিদ্র দেশ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলির অরাজনৈতিক (এবং, তাই চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক) প্রতিবেদনগুলো [অন্ধকারচ্ছন্ন] দেশগুলোর [অন্ধকারচ্ছন্ন] জনগণকে এমন অসহায় রূপে প্রকাশ করে যেন মনে হবে, আরো একজন অপুষ্ট ভারতীয়, আরো একজন অনাহারী ইথিওপিয়ান, আরো একজন আফগান শরণার্থী, আরো একজন হতাশ সুদানিয়ান… সকলেই শ্বেতাঙ্গ মানুষের সহায়তার জন্য বসে আছে। তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে বর্ণবাদী স্টেরিওটাইপগুলোকে শক্তিশালী করে এবং পশ্চিমা সভ্যতার কৃতিত্ব, স্বাচ্ছন্দ্য এবং মমত্ববোধ প্রচার করে। এদেরকে আসলে বলা যায় আধুনিক বিশ্বের সেকুলার মিশনারি।
অবশেষে, যেহেতু দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থনীতিতে ফটকা পুঁজি যুক্ত রয়েছে, এনজিও-র পুঁজি স্বল্প পরিসরে হলেও খুব সুদূরপ্রসারী সমান রাজনৈতিক ভূমিকা রাখছে। এটি এজেন্ডা নির্দেশ শুরু করে, লড়াইকে আপসে পরিণত করে, এবং প্রতিরোদের বি-রাজনীতিকরণ করে। এনজিওগুলো ঐতিহ্যগতভাবে স্ব-নির্ভর স্থানীয় জনগণের আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করে। তাদের তহবিল স্থানীয় লোকজনকে বিভিন্ন কাজ যোগাড় করে দেয় যারা কিনা প্রতিরোধ আন্দোলনের কর্মী হতে পারতো। কিন্তু এখন তারা অনুভব করেন যে, তারা তাৎক্ষণিক সৃজনশীল কিছু একটা করছেন (এবং, এটা করতে গিয়ে তারা কিছুটা উপার্জনও করছেন)।
বাস্তবিক রাজনৈতিক প্রতিরোধের এ জাতীয় কোনও সহজ পথ নেই। রাজনীতির এনজিওকরণ প্রতিরোধকে একটি ভদ্রস্থ, সুবিধাজনক, বেতনভুক্ত ৯টা-৫টা চাকরিতে পরিণত করার হুমকি দিচ্ছে। বোনাস হিসাবে রয়েছে কিছু সুযোগ-সুবিধা। প্রকৃত প্রতিরোধের কার্যকর পরিণতি থাকে, এবং কোনো বেতন থাকে না।
লেখার মূল লিঙ্ক: The NGO-ization of resistance, 2014