অরাজ
আর্টওয়ার্ক: দ্য রোলিং ডেথ সিরিজ শিল্পী: ফারহানা ইয়াসমিন সূত্র: ফেসবুক
প্রচ্ছদ » অরুণ কুন্দনানি।। ফানোঁ, ভেন্টিলেটর এবং আমাদের শ্বাস নেয়ার অধিকারের লড়াই

অরুণ কুন্দনানি।। ফানোঁ, ভেন্টিলেটর এবং আমাদের শ্বাস নেয়ার অধিকারের লড়াই

অনুবাদ: সারোয়ার তুষার

অনুবাদকের  ভূমিকা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাক আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশ খুন করার আগেই লিখিত হয় এই প্রবন্ধটি। কিন্তু জর্জ ফ্লয়েড নির্মম পুলিশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার বাস্তবতায় এই প্রবন্ধ যেন আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। গোটা পৃথিবীতেই আজকে মানুষ শ্বাস নেয়ার অধিকারের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে।

এই ‘শ্বাস নেয়া’র অধিকার যেমন জৈবিক তেমনি রাজনৈতিক। করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে দেখা যাচ্ছে নিওলিবারাল দুনিয়ার স্বাস্থ্যখাতের ভয়াবহ বিপর্যয়। চিকিৎসার অভাবে শ্বাস নিতে না পেরে মারা যাচ্ছে মানুষ।

বাংলাদেশেও আমরা দেখছি , হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সুবিধা না পেয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকছে হাসপাতালের সামনে। অর্থাৎ, এত এত উন্নয়ন, আধুনিকতা, প্রগতির দোহাই দেয়া হলেও মানুষকে জৈবিকভাবে শ্বাস নিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারছে না বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ। কারণ স্বাস্থ্যসেবার মত অত্যন্ত অপরিহার্য মৌলিক অধিকারকে অনেক আগেই বাজারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

ফলে স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্তির অধিকার চিকিৎসা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এই দায় সম্পূর্ণতই মুনাফাবাজ নিওলিবারাল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং তার সাথে সংগতিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ।

‘শ্বাস নেয়া’র অধিকারের রাজনৈতিক তাৎপর্যও ব্যাপক। কালো হওয়ার দরুণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অধিকারহীন জীবন যাপন করতেন জর্জ ফ্লয়েড।

আর্টওয়ার্ক: রেসিয়া ডেসক্রিমিনেশন
শিল্পী: এলান ম্যাকডোনাল্ড
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

রাজনৈতিকভাবে অধিকারহীন ‘ন-মানুষ’ উৎপাদন করাই আজকে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতার টিকে থাকার ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন না কোন বর্গে রাজনৈতিক অধিকারহীন ‘হোমো স্যাকের’ উৎপাদন করাটাই সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তি হিশেবে কাজ করে।

বাংলাদেশে আমরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। ‘নাস্তিক’, ‘শিবির’ নানা বর্গে এখানে বধযোগ্য প্রাণ উৎপাদন করা হয়। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা আজকে এতটাই বর্ণবাদী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছে যে তার পক্ষে বাংলাদেশের যেকোন মানুষকেই রাজনৈতিক অধিকারহীন বধযোগ্য ‘ন-মানুষ’ উৎপাদন করা সম্ভব। তার জন্য এমনকি জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুও হতে হয় না।

আবরার, বিশ্বজিৎ, তনু থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি পুলিশের হাতে নিহত কৃষক নিখিল কিংবা যশোরের কিশোর ইমরান সকলেই আজক এই শ্বাসরোধী ক্ষমতার নির্মম রোষের শিকার। এই দিক থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সারা বিশ্বেই নজিরবিহীন। অন্যান্য অঞ্চলে অন্তত ‘মূলধারা’র মানুষ কোনভাবেই বাংলাদেশের মানুষের মত সার্বভৌম ক্ষমতার রোষের সম্মুখে এতটা উন্মোচিত না। বাংলাদেশের জাতিগত-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুদের অবস্থা সেক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয়।

জৈবিক ও রাজনৈতিক শ্বাস নেয়ার অধিকারহীনতার বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকেই মানুষ সার্বভৌম ক্ষমতার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে গোটা বিশ্বে। বাংলাদেশেও, বিক্ষিপ্ত আকারে নানা রকম প্রতিরোধ-লড়াই এর নজির দেখতে পাই।

সেই প্রতিরোধ-লড়াইকে আরো বেগবান, আরো তীব্র করার নানামুখী প্রচেষ্টায় যারা নিয়োজিত, তাদের উদ্দেশ্যেই এই অনুবাদটি প্রণীত।

মূল প্রবন্ধ

কোভিড-১৯ মোকাবেলার প্রতিক্রিয়ায় শাসকগোষ্ঠীর এলিটেরা তাদের দুটি বাসনাকে চরিতার্থ করছে : রাষ্ট্রীয় বাসনা এবং বাজারের বাসনা। রাষ্ট্রীয় বাসনাটি হলো জনপরিসরকে গরীব, অভিবাসী শ্রমিক, জাতিগত সংখ্যালঘু, প্রতিবাদীর মতো ‘অবাধ্য’ জনতাশূন্য করা। আর বাজারের বাসনা হলো এমন একটি দুনিয়া কায়েম করা যা সম্পূর্ণতই মনুষ্য-সম্পর্ক বিবর্জিত এবং আগাগোড়া বাজারকেন্দ্রিক অ্যালগোরিদম দ্বারা পরিচালিত হবে। কোভিড-১৯ এই দুই উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার এক মোক্ষম অজুহাত হিশেবে হাজির হয়েছে। তীব্র সরকারী দমন-পীড়নের মুখে নিঃশর্ত আনুগত্যের যে বেসরকারি, ঘরকুনো , বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠার মতো জীবনযাপনের চাপে আমাদের পড়তে হয়; তার বাস্তবতায়  কেবলমাত্র স্বাস্থ্যসেবার অধিকারই নয়, পুরোদস্তুর মানুষের জীবনযাপন করার অধিকারকেই আমাদের আদায় করে নিতে হবে। আমাদের শ্বাস নেয়ার অধিকার আদায় করে নিতে হবে— জৈবিক ও রাজনৈতিক সকল অর্থেই।

‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অনন্ত যুদ্ধ আমাদের জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে কী ঘটে সে সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। ৯/১১-এর পরে অস্থায়ী জরুরি ব্যবস্থা হিশেব যে সব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল, তা পরবর্তীতে রাষ্ট্রের স্থায়ী ক্ষমতার স্তম্ভে পরিণত হয়েছিল। ৯/১১’র এর পরের দিনগুলিতে মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত সামরিক শক্তি ব্যবহারের অনুমোদন মার্কিন সেনাবাহিনীকে কার্যকরভাবে সমগ্র বিশ্বকে যুদ্ধক্ষেত্র হিশেবে বিবেচনা করতে সক্ষম করেছিল; এটি আজ পর্যন্ত একই মাত্রায় কার্যকর রয়েছে। গুয়ান্তানামোতে এখনও এমন বহু বন্দি আছে যারা কোনও অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হননি। এবং ৯/১১-এর পরের বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে প্রণীত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনটি একই কায়দায় পুরোপুরি বিধিবদ্ধ আছে। এছাড়াও, ‘সন্ত্রাসবিরোধী’  যুদ্ধ যে মুসলমানবিরোধী বর্ণবাদ উস্কে দিয়েছিল, তা এখনও এই সময়ে বিরাজমান। প্রকৃতপক্ষে, এটি চীন, মায়ানামার, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে মুসলমানরা এখন ভাইরাস সংক্রমণের বলির পাঁঠা।

আর্টওয়ার্ক: করোনা ভার্সেস ওয়ার্ল্ড ট্রেড
শিল্পী: কিয়ানৌরুশ রামজানি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অপ্রয়োজনীয় সামরিক সহিংসতায় ৮ লক্ষেরও অধিক মানুষ মৃত্যুর শিকার হয়েছে। এই ‘যুদ্ধের’  ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট পর্যাপ্ত জনস্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা যেত। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যারা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সমালোচনা করেছি, বহু আগে থেকেই যৌক্তিকভাবে বলে এসেছি যে, সুরক্ষা নীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মতো ফাঁপা ‘হুমকি’ অবসানে সময় আর অর্থ অপচয় না করে, সুস্থ সামাজিক ও পরিবেশগত সম্পর্কপ্রণালী গড়ে তোলার পথ গ্রহন।

‘নিরাপত্তা’ ধারণাটিকে স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত করে সংজ্ঞায়িত না করার খেসারত হিশেবে এই মহামারির কালে আমরা স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের তোড়জোড় দেখতে পাচ্ছি। নয়া উদারবাদী রাষ্ট্র দশকের পর দশক ধরে পদ্ধতিগতভাবে জনসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিজের সক্ষমতাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে, অন্যদিকে নানাবিধ পুলিশি ব্যবস্থা এবং যুদ্ধোন্মাদনা জারি রেখেছে। এখন আমাদের জনস্বাস্থ্য রক্ষার জরুরতকেও ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র বিস্তৃত বর্গে অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে।

জনপরিসরের নিয়ন্ত্রণ

কোভিড-১৯ এর প্রতিক্রিয়ায় লকডাউন এবং কোয়ারান্টাইনের প্রকৃত জরুরতকে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রসমূহ সহিংসতার তীব্রকরণে ব্যবহার করেছে, যে সহিংসতা ইতিমধ্যেই পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। ফ্রান্সে, শ্রমজীবীদের শহরতলিগুলোতে আবদ্ধ থাকার বিধি লঙ্ঘনের শাস্তি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি। গ্রীসে, অভিবাসী এবং রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাদের দিকে থুতু ছিটানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। কোভিড-১৯ বিধি প্রয়োগে ন্যস্ত পুলিশ তাদের চিরুনি তল্লাশির আওতায় নিয়ে এসেছে। বুলগেরিয়ায় বেশ কয়েকটি রোমা সেটেলম্যান্টকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন্ড করা হয়েছে, পৃথকীকরণ দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে, জোরপূর্বক টেস্টিং করানো হচ্ছে এবং বাসিন্দাদের শরীরের তাপমাত্রা দূর থেকে পরীক্ষা করার জন্য থার্মাল সেন্সর সম্বলিত ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।

ইজরায়েলে, জনস্বাস্থ্য সহায়তার খাতিরেও গাজা অবরোধ শিথিল করা হয়নি ; বরং মনে হচ্ছে ভাইরাস ‘দমনের’ অন্তরালে ইজরায়েল পশ্চিমতীরের অধিকাংশ অংশই দখলে নিয়ে নিবে। ভারতে সরকার কাশ্মীরে দমন-পীড়ন তীব্র করার কাজে মহামারি উদ্ভূত পরিস্থিতি কাজে লাগাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামারির বিশৃঙ্খলার মধ্যেও কেন্টাকি, দক্ষিণ ডাকোটা এবং পশ্চিম ভার্জিনিয়া রাজ্যগুলো তেল ও গ্যাসের পাইপলাইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দমনে নতুন ফৌজদারি দণ্ড আরোপের আইন পাস করেছে।

অভিবাসী এবং শরণার্থীরা বিশেষভাবে দুর্বল। কাতারে শত শত অভিবাসী শ্রমিককে টেস্টিং এর কথা বলে তুলে নিয়ে গিয়ে বন্দি করা হয়েছে কিংবা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে মাল্টিজ সেনারা একটি আটকে পড়া নৌকায় ভাঙচুর চালিয়ে কমপক্ষে পাঁচজন শরণার্থী যাত্রীর মৃত্যু ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রবার্ট আবেলা বলেছেন, কোভিড -১৯ এর কারণে এ জাতীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি ছিল। একইভাবে, মালয়েশিয়া তার দেশের দিকে ধাবমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহনকারী নৌকা ঘুরিয়ে দিয়েছে এবং ৫০০ জনেরও বেশি অভিবাসীকে আটক করেছে।

অঅর্টওয়ার্ক: হোস্টেজ মায়াগ্রান্ট
শিল্পী: শৌনাক সম্ভাতসার
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

মহামারির কালে জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে চলাফেরার স্বাধীনতার উপর যৌক্তিক বিধিনিষেধের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু যখন নৌকায় আগত গরীবদের ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং ব্যক্তিগত জেট বিমানে আগত ধনীদের অবাধে প্রবেশ করতে দেয়া হয়, তখন ব্যাপারটা আর ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ হিশেবে থাকে না, সর্বহারা নিধনে গিয়ে ঠেকে।

ইমিগ্রেশনের ডিটেনশন সেন্টারগুলো, যেগুলো মহামারি প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই জনাকীর্ণ অবস্থায় আছে, সেগুলোতে ভাইরাস সংক্রমণ রোধকল্পে কোন কার্যকর সুরক্ষা নেই— সম্ভবত সেখানে ৭৫ শতাংশের বেশি মানুষ সংক্রমিত হবে।

খাবার, পানি এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিবেচনা না করেই যখন গরীবদের উপর লকডাউন চাপিয়ে দেয়া হলো, তখন বিক্ষোভ-অসন্তোষ একপ্রকার অবশ্যসম্ভাবীই ছিল। এই বিক্ষোভ-অসন্তোষ রাষ্ট্রগুলোর একমাত্র জানা তরিকা  চরম পুলিশি সহিংসতার মাধ্যমেই মোকাবেলা করা হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকাতে, অনানুষ্ঠানিক জনবসতিগুলোর বাসিন্দারা বাড়ির ভিতরে থেকে অনাহারে ধুঁকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আনুমানিক ৫৫ লক্ষ অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে, যার প্রভাব এক কোটি পয়ষট্টি লক্ষ মানুষের জীবনে গিয়ে পড়েছে। শহুরে গরীবদের উপর লকডাউন চাপিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জলকামান এবং রবার বুলেট ব্যবহার করেছে। একইভাবে ভারতে, লকডাউনের বিরোধীতাকারী কর্মহীন, অভিবাসী শ্রমিকদের উপর পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেউপ।

অন্যত্র, সমালোচক সাংবাদিক, ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টদের গ্রেফতার করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায়, সরকারী কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। পাকিস্তানে, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদির অভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী কয়েক ডজন চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অ্যালগোরিদমিক বিধি

 ইন্টারনেটযুক্ত  ঘরে বন্দিদশায় (যদি সেই সুবিধা আমাদের থাকে), আমাদের জীবন ডিজিটাল মিডিয়া কর্পোরেশনগুলোর প্রতি স্থায়ীভাবে নির্ভর হয়ে পড়েছে। অ্যামাজন, জুম, নেটফ্লিক্স এবং এমনতর ডিজিটাল মাধ্যমগুলো বিচ্ছিন্নতার অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কপ্রণালী যতবেশি ডিজিটাল অ্যালগোরিদমের মধ্যস্থতার ফাঁদে পড়বে, তত বেশি নয়া উদারনীতিবাদের বাজারচালিত দুনিয়ার স্বপ্ন তরান্বিত হবে। যখনই মহামারিকালীন জরুরি সময়কাল শেষ হবে, আমরা সম্ভবত নিজেদের এমন এক সামাজিক কাঠামোতে আবিষ্কার করব যা আরও গভীরভাবে ডিজিটালাইজড, বাজারতাড়িত এবং গৃহায়িত এবং এই নয়া বাস্তবতা বাজারের মধ্যস্থতার বাইরে মানব সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাইরাসটির আশু প্রতিক্রিয়া হিশেবে অনলাইন পরিষেবা চালু করেছে। কিন্তু এই পরিষেবার জন্য অবকাঠামোগত সরবরাহকারী কর্পোরেশনগুলো এখন এমন এক স্ট্যান্ডার্ড তৈরির চেষ্টা করবে যেন অপেক্ষাকৃত কম সম্পদশালীরাও এই নিয়মে স্বাস্থ্যসেবা ও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য হয়।

আর্টওয়ার্ক: ক্লাপ সোসাইটি
শিল্পী: মারিয়ান খান
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

ইতিমধ্যেই, রাজনৈতিক নেতারা সংকটের মধ্যে নিজেদের বাজারীকরণের পুরোধা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। ৩ রা ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একটি ভাষণে বলেছিলেন, ‘করোনাভাইরাস জাতীয় নতুন রোগ আতঙ্ক এবং বাজার বিচ্ছিন্নকরণের আকাঙ্ক্ষাকে উদ্বুদ্ধ করার ঝুঁকিতে রয়েছে,’। যার অর্থ তিনি নব্য উদারতাবাদী বিশ্বায়নের উপর নিষেধাজ্ঞাকে বুঝিয়েছেন। পরিবর্তে, তিনি বলেছিলেন, ‘মানবতার কোথাও কোথাও এমন সরকার দরকার যা অন্তত শক্তিশালীভাবে ক্ষেত্রটি তৈরি করতে ইচ্ছুক… পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর একে অপরের মধ্যে অবাধে কেনা বেচা করার অধিকার  রয়েছে।’ সুতরাং বিশ্বব্যাপী যারাই ভাইরাসকে অন্য কোন মডেলের উপলক্ষ ভাবতে চায়, ব্রিটেন তাদের কাছ থেকে মুক্তবাজারকে রক্ষা করবে।

সুতরাং আমাদের নিজেদের এই প্রবোধ দিলে চলবে না যে, মহামারি বৈশ্বিক বামপন্থাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাঙ্গা করবে। এমনকি কেউ কেউ তো এই দাবিও করেন যে নয়া উদারতাবাদ ভেঙ্গে পড়ছে কারণ রাষ্ট্রগুলো ভাইরাসের চিকিৎসা এবং অর্থনৈতিক নিরাময়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এটি একটি সম্মোহনী মরীচিকা। এটি এই ভ্রান্ত ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে নব্য উদারতাবাদের মানে কম সরকার। নয়া উদারতাবাদকে বুঝতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য গৃহীত সমষ্টিগত পদক্ষেপকে ভন্ডুল করার বাজারি যুক্তিপ্রণালীর মাধ্যমে।  এই সংজ্ঞা অনুসারে, মহামারি নব্য উদারতাবাদী মওকা ততটাই বয়ে আনে, যতটা ঝুঁকি সাথে করে নিয়ে আসে। আর্থিক বাজারগুলি বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করে যে, ঝুঁকির চেয়ে সম্ভাবনাই বেশি। গত এপ্রিল ছিল বিগত কয়েক দশকের মধ্যে ওয়ালস্ট্রিটের সেরা মাস।  এবং, ইন্সটিটিউট ফর পলিসির গবেষণা অনুযায়ী, মার্চ ১৮ থেকে ১০ এপ্রিলের মধ্যে আমেরিকার কোটিপতিদের সম্মিলিত সম্পদ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমাদের শক্তি রাজপথে

মহামারির ধবংসযজ্ঞের উপর দাঁড়িয়ে, আমাদের অবশ্যই একটা নতুন সামাজিক বিন্যাস গড়ে তোলার লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া উচিত; এমন একটি সম্পর্কপ্রণালী যা মানুষের প্রয়োজনের নিমিত্তে গঠিত, কর্পোরেশনের লাভের নিমিত্তে নয়। তবে আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, আমরা এমন একটি অবস্থান থেকে এটি করছি যেখানে আমাদের নিজেদের মধ্যে যে পরিস্থিতি বিরাজমান তার কাঠামোর মধ্যে প্রগতির কোন গ্যারান্টি নেই। আমরা যেটা অবশ্যই জানি-যেসব ব্যবস্থাদি অনাগত , তা প্রতিরোধের কোন বিকল্প আমাদের সামনে নাই , কারণ আজকে যা কায়েম করা হয়ে গেছে, আগামীকাল তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা আরো কঠিন হবে।

অঅর্টওয়ার্ক: ডিফারেন্ট ইয়েট ইউনাইটেড
শিল্পী: সাবা
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

আমরা আরও জানি যে আমাদের শক্তি নিহিত আমাদের মানব সংহতিতে এবং আমাদের সামাজিক সংগ্রামের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকারের মধ্যে। আমাদের সংগঠিত করার, আন্দোলন গড়ে তোলার, একত্রিত হওয়ার তাগিদ-নতুনভাবে-আগের তুলনায় অনেক বেশি মূল্যবান। শিবানন্দন যেমন বলেছেন, আমাদের অবশ্যই ‘মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ বিশ্বাস এবং গভীর জ্ঞান ধরে রাখতে হবে যে, নিজের দ্বারা বা ব্যক্তি নিজেই কিছুই নয়, পারস্পরিকতার মধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব নিহিত। কেবলমাত্র সামস্টিক মঙ্গলের মাধ্যমেই আমরা প্রকাশিত এবং বেড়ে উঠতে পারি।’

ভাইরাসটি যেভাবে আমাদের সামাজিক জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পেরেছে, সেই পদ্ধতিই ভাইরাসটিকে এত বিধবংসী করে তুলেছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে গতিশীল থাকার অনেক অনেক উপায় এখনো রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, কল সেন্টার, ডেলিভারি এবং পণ্যগুদাম শ্রমিকদের জন্য ধর্মঘট ‘কাজ’ এর চেয়ে অধিক নিরাপদ। এবং অবশ্যই, আমরা রাস্তা ছেড়ে দিতে পারিনা। রাস্তাই আমাদের ক্ষমতার উৎস। সাংবাদিক সুসি ডে যেমনটি বলেন, ‘বিপ্লব কোয়ারেন্টাইন্ড হবে না!’

সারোয়ার তুষার