অরাজ
আর্টওয়ার্ক: কমবাটিং দ্য আর্থ শিল্পী: মেটিওরাইট লান্ডালোউ সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » অনি মৈত্র।। কোভিড-১৯ ও নয়া-উদারনীতিবাদী জরুরি অবস্থা

অনি মৈত্র।। কোভিড-১৯ ও নয়া-উদারনীতিবাদী জরুরি অবস্থা

অনুবাদ : সারোয়ার তুষার

আর্টওয়ার্ক: ডেনজারেস এপ্রোচ
শিল্পী: অ্যালেক্স ফ্যাল্ক চ্যাং

অনুবাদকের ভূমিকা: ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ এ “অকারণ জরুরতের ডেকে আনা জরুরি অবস্থা” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে ইতালিতে আরোপিত জরুরি অবস্থার সমালোচনা করে উক্ত আর্টিকেলটি লিখেছিলেন জর্জিও আগামবেন। আগামবেনের আর্টিকেলটি ইতালি এবং ইতালির বাইরে দার্শনিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তুমুল তর্কের সূচনা করে। পরেরদিনই, অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ফরাসি দার্শনিক জঁ-লুক ন্যান্সি  ‘ভাইরাসজনিত ব্যতিক্রম বা জরুরি অবস্থা‘ শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখে আগামবেনের সমালোচনা করেন। ন্যান্সির লেখা প্রকাশিত হবার পরের দিন, অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ এ এই বিতর্কে ঢুকে পড়েন আরেক ইতালীয় দার্শনিক রবার্তো এসপজিতো। তিনি ‘তিক্ত নিরাময়‘ শিরোনামে প্রবন্ধে ন্যান্সির সমালোচনা করেন।

বাংলা ভাষার সংশ্লিষ্ট পাঠকদের জন্য উল্লেখিত তিনটি প্রবন্ধের অনুবাদ হাজির করেছে বোধিচিত্ত। উপযুক্ত সময়ে জরুরি কাজটি করায় বোধিচিত্তকে ধন্যবাদ।

এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন আল জাজিরায় গত ২৯ মার্চ, ২০২০ এ প্রকাশিত “COVID-19 and the neoliberal state of exeception” আর্টিকেল। এটি লিখেছেন বাঙালি বংশোদ্ভূত ভারতীয় নাগরিক ও নিউইয়র্কের হ্যামিল্টনে অবস্থিত কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মৈত্র। তার এই প্রবন্ধটিকে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত আগামবেনীয় মতের সমালোচনা ও সংযুক্তি বলা যেতে পারে।

মহামারির বাস্তবতায় নিও লিবারেল তথা নয়া উদারনীতিবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বপরিসরে রাষ্ট্রকর্তৃক আরোপিত চিরাচরিত নিয়মের ‘ব্যতিক্রম’ জরুরি অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পুনর্বিবেচনা হাজির করেছেন অনিরুদ্ধ। এর মাধ্যমে ‘জরুরি অবস্থা’র এমন একটি বয়ান তুলে ধরেছেন অনিরুদ্ধ, যেখানে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক-একচেটিয়া-নিপীড়নমূলক-আরোপিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতাসম্পর্ক জিইয়ে রাখতে কেবল রাষ্ট্রই নয়, আপাত অর্থে রাষ্ট্র-বহির্ভূত ক্ষমতাধর বৈশ্বিক এলিটগোষ্ঠীর স্বার্থের ভূমিকাও টের পাওয়া যায়।

কার্ল স্মিট মনে করতেন সার্বভৌম হলো সেই, যে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে। অন্যভাবে বললে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারার মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব এক আইনি প্যারাডক্স (একইসাথে আইনের ভেতর ও ঊর্ধে বিরাজ করা) হাজির করে। এই প্যারাডক্সই সার্বভৌমত্ব তথা আইনের শাসনের ভিত্তি। ( আলম/ ২০২০: ২৪৬)

কিন্তু অনিরুদ্ধ মৈত্র কথিত নিওলিবারেল বিশ্বব্যবস্থা তথা পুঁজির সার্বভৌমত্বের কালে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে ট্র‍্যাডিশনাল কিংবা দৃশ্যমান সার্বভৌম ক্ষমতা কর্তৃক জরুরি অবস্থা জারির প্রাথমিক দ্বিধাকে আমরা কীভাবে পাঠ করব? পুঁজির সার্বভৌমত্বের যুগে জাতিরাষ্ট্র প্রবল বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও জরুরি অবস্থা জারির কার্যকর ক্ষমতা বা শর্ত কোথায় নিহিত ? এবং এর মাধ্যমে জরুরি অবস্থার কোন ডিসকোর্স হাজির হয়?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা বসবাস করছি বৈশ্বিক দুর্যোগ পুঁজিবাদ ও শক ডক্ট্রিনের কালে (Klein 2007) । বাংলাদেশ রাষ্ট্র বৈশ্বিক ‘শক ডক্ট্রিন’ এর স্থানীয় গ্রাহক। সদা সর্বদা জরুরি অবস্থা এখন আর ‘স্টেট অব এক্সসেপশন’ তথা নিয়মের ‘ব্যতিক্রম’ নয়, সদা সর্বদা জরুরি অবস্থাই এখন রুল বা নিয়ম। এই দুর্যোগ পুঁজিবাদ ও শক ডক্ট্রিনকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে সামাজিক সম্পর্কের জাল, মূল্যবোধ। এর ফলে এমন এক শাসনপ্রণালী অনিবার্য হয়ে উঠেছে যার লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় পরিসরে কাছাখোলা পুঁজির অবাধ প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা, পুঁজির প্রবাহে নূন্যতম হস্তক্ষেপ না করা। রাষ্ট্র যদি অর্থনীতিকে বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’ এর নিকট ছেড়ে দেয় তাহলে রাষ্ট্রের কাজ কী? রাষ্ট্র থেকে কী লাভ? কিন্তু রাষ্ট্রকে তো থাকতে হবে!

এই কারণেই আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা, নাগরিকের নিরাপত্তাহীনতা, ক্রমাগত সংকট উৎপাদন করা রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যুগে ‘সংকট’ শাসনপ্রণালীর অনিবার্য ডিসকোর্সে পরিণত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র-কর্পোরেশন আঁতাতে গৃহীত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে নাগরিকের মনোজগতে সংকটকে স্থায়ী করে তোলা হয়েছে। সমাজে নিরাপত্তাহীনতা, ত্রাস ইনজেক্ট করা হচ্ছে পদ্ধতিগতভাবে। এভাবে কায়েম হয়েছে এক অনন্ত জরুরি অবস্থা, যাকে আর কেবল ট্রেডিশনাল সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের ‘ব্যতিক্রমী’ অবস্থার মাধ্যমে বোঝা যায়না। এই অনন্ত জরুরি অবস্থাকে বুঝতে হয় রাষ্ট্র-কর্পোরেশন, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে গড়ে ওঠা মহাদৈত্যাকার কমপ্লেক্স এর সম্পর্ক ও সংঘাতের মাধ্যমে।

একদিকে আছে কাছাখোলা প্রতিক্রিয়াশীল বাজার মৌলবাদ। বাজারব্যবস্থাকেই মানুষের জীবন-জীবিকার চূড়ান্ত পরিণতি জ্ঞান করানোর মতো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনীতি মূল্যবোধ। বিশ্বের আপামর মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে শোচনীয়ভাবে অকার্যকর প্রমাণিত এই নয়া-উদারনীতিবাদ আবার শ্রেণী ক্ষমতাকে সুসংহত করতে ভীষণ কার্যকর। বহুজাতিক পুঁজির প্রবাহ ও অবাধ লুন্ঠন রোধ করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা শূন্য, বরং অনেকাংশেই শোষণ-লুন্ঠনের এই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয় রাষ্ট্র।

অন্যদিকে আছে এরকম একটা জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ, বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে কিংবা পুঁজির নির্বিঘ্ন বিচরণের বিরুদ্ধে সামান্যতম সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠলে তাকে দমন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রবল উপস্থিতি।

নিও লিবারেল দুনিয়ায় এটাই হলো একইসাথে রাষ্ট্রের অস্তিত্বশীল না থাকা ও থাকার প্যারাডক্স। (মুহাম্মদ/ ২০১৯)

নিওলিবারেল তথা নয়া-উদারনীতিবাদের যুগে রাষ্ট্র ও বৃহৎ বৃহৎ কর্পোরেশনের সমন্বয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটশ্রেণী, গোটা বিশ্বের ১ শতাংশ হলেও সম্পদ-ক্ষমতা-সিদ্ধান্তের একচেটিয়া দখলদার।

মহামারির কালে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই পলিটিকাল-ইকনমিক ক্লাস শক থেরাপির মাধ্যমে কিভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে, অনিরুদ্ধের এই প্রবন্ধে তা চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে জরুরি অবস্থা বহুল চর্চিত বিষয়। করোনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশেও জরুরি অবস্থা জারির গুঞ্জন এবং জারির পক্ষে হাইকোর্টে রিট করার মতো ঘটনা ঘটেছে বিগত দিনগুলোতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালে জরুরি অবস্থার বাংলাদেশী প্রেক্ষাপট-বাস্তবতা নিয়ে তুমুল মত-দ্বিমত লক্ষ্য করা গেছে।

মহামারির কালে রাষ্ট্র-কর্পোরেশন বলয় তাদের ক্ষমতাকে আরো নিরঙ্কুশ করতে চায়, পক্ষান্তরে যেসকল রূপান্তরকামী রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক পক্ষ সক্রিয় থাকে, তাদের জন্যও সংকটের কাল একটা সম্ভাবনা নিয়েও হাজির হয়। যে কথা, যে রূপকল্পকে আঁকড়ে ধরে তারা লড়াইরত, তা মানুষের কাছে আরো মূর্ত করে তুলবার সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত হয়। আপাত ‘বিকল্পহীনতা’ গণমানুষের মধ্যে যে নৈরাশ্য সৃষ্টি করে, সেখান থেকে ভিন্ন দুনিয়া, ভিন্ন ও অধিকতর ন্যায্য সমাজের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর পরিসর তৈরি হয়। সেই সম্ভাবনার উদ্দেশ্যেই এই অনুবাদটি প্রণীত।]

জরুরি পরিস্থিতিতে নয়া-উদারনীতিবাদী সরকারসমূহ বেসরকারি খাতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে কী ভূমিকা পালন করে ?

ফেব্রুয়ারি ২০২০ এর শেষেরদিকে, ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন দেশটির মিডিয়া ও সরকারের সমালোচনা করেছিলেন কারণ তারা অন্য যেকোন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের চেয়ে করোনা ভিন্ন কিছু তার যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই কোয়ারেন্টিন ও ‘সামাজিক দুরত্ব’ মেনে চলার বিধান দিয়েছিল।

আর্টওয়ার্ক: দ্য ব্যাটেল
শিল্পী: মোরো
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

আগামবেনের মতে, এই পদক্ষেপগুলো তিনি তাঁর কাজে যেমন “জরুরি অবস্থা”র উল্লেখ করেছেন তেমন প্রচণ্ড ‘ব্যতিক্রম’ সামারিকায়িত পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে যা নাগরিক ও তাদের স্বাধীনতার উপর সরকারের অস্বাভাবিক ক্ষমতা চর্চার পাটাতন তৈরি করে। এরকম ‘জরুরি অবস্থা’য় ‘সুরক্ষা’র নামে রাষ্ট্রীয় পুরোহিতরা স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে, যে ‘স্বাধীনতা’ আবার বাহ্যত তারাই নিশ্চিত করতে পারে।

বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সারা বিশ্ব জুড়ে কোয়ারানটাইন, লকডাউন এবং সরকারি মনিটরিং আমাদেরকে  ফরাসি দার্শনিক

মিশেল ফুকো কথিত অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে প্লেগ-প্রবর্তিত ব্যতিক্রমি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির স্মরণ করিয়ে দেয়। ফুকো লিখেছেন, “মহামারিই হলো সেই মুহুর্ত যখন কোন জনগোষ্ঠীর স্থানিক বিভাজন ও পুনর্বিভাজনকে (quadrillage) এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যেখান থেকে আর বিপজ্জনক বার্তা, বিশৃঙ্খল সম্প্রদায় ও নিষিদ্ধ যোগাযোগগুলো সম্ভব নয়।”

সংক্রামক রোগের বিস্তার রুখতে সরকার কর্তৃক জনগোষ্ঠীর বিভাজন হলো “নিরঙ্কুশ ক্ষমতার নির্মম প্রদর্শনি যা স্বীয় উদ্দেশ্যের প্রতি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগকৃত।” ফুকোর মতে সংক্রমণকালে (জনগোষ্ঠীকে) খুপরিবদ্ধ করে রাখা উদাম সরকারি ক্ষমতার উন্মোচন ঘটায়।

আগামবেন হয়তো কেবলমাত্র ইতালিতেই দশহাজারেরও বেশি মৃত্যুর পর করোনা ভাইরাসের তীব্রতা সম্পর্কে তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তবে “জরুরি অবস্থা” সম্পর্কে তার ফুকো-অনুপ্রাণিত যুক্তি আরও ঘনিষ্ঠ পর্যালোচনার দাবি রাখে। মোটের উপর নয়া-উদারনীতিবাদী একটা বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে সরকারি ‘ক্ষমতা’ বেসরকারি খাতের স্বার্থের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে, সেখানে “জরুরি অবস্থা”র তাৎপর্য কী আসলে?

নাগরিকদের বাড়িতে অবস্থানের নির্দেশনা দিতে বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষেত্রে সরকারগুলোর প্রাথমিক দ্বিধাকে আমরা কীভাবে পাঠ করব? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মার্কিন সরকার কেন তাৎক্ষণিকভাবে তার ‘নিরঙ্কুশ’ ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটালো না?

আর্টওয়ার্ক: স্টে এট হোম
শিল্পী: সানাউনি ইমাদ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

প্রথমে লকডাউন বা গণ কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা গ্রহণে বিভিন্ন সরকার কর্তৃক প্রদর্শিত নানামাত্রার অনিহার বিষয়টি বিবেচনা করুন। সর্বার্থেই চীনা শহর উহানে গৃহীত লকডাউন ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর ছিল। তবে লকডাউনটি এসেছিল করোনা প্রাদুর্ভাব একটা নির্দিষ্ট চূড়ায় পৌঁছানোর পর।

মহামারির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে চীন সরকারের নিজস্ব আশঙ্কা অবশ্যই এখানে একটি ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু এই ‘নির্দিষ্ট চূড়া’র আবির্ভাবের পেছনে দেশি-বিদেশি উভয়ক্ষেত্রের অ-রাষ্ট্রীয় প্রভাবকদের চাপও ভূমিকা পালন করেছে।

দ্য গার্ডিয়ান সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, চীন সরকার নভেম্বরের শুরু থেকেই প্রাথমিক কোভিড-১৯ কেস সম্পর্কে অবহিত ছিল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ অন্তত ৬০ টি নিশ্চিত কেস ছিল। তবে প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা তদন্তের পরিবর্তে, চীন সরকার গণমাধ্যম প্রতিবেদনগুলো সেন্সর করেছে। এমনকি নতুন সার্স (Severe Acute Respiratory Syndrome) এর মতো ভাইরাসের উহানে প্রাদুর্ভাব ঘটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হুইসেল ব্লোয়ারদের দমনও করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চীনা অধিদপ্তর ডিসেম্বরের পাঁচ আরিখেই “অজ্ঞাত উৎসের ৪৪ জন নিউমোনিয়া রোগীর” ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সতর্কতা জারি করলেও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কেন্দ্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল জানুয়ারির ৭ তারিখে নভেল করোনা ভাইরাসের কথা নিশ্চিত করেছে। জানুয়ারি ২০ এর আগে চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভাইরাসটির মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের তথ্য স্বীকার করেনি এবং শেষমেষ জানুয়ারির ২৩ তারিখে উহান লকডাউন শুরু হয়।

তারপর এই ধরণের একটি বৃহৎ আকারের লকডাউন বা কোয়ারানটাইন চীন সরকার তার জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চাপিয়ে দিয়েছে।

ভাইরাস সম্পর্কিত প্রতিবেদন দমন করে চীন সরকার যা আটকাতে চেয়েছিল, লকডাউন সেইদিকেই চীনকে ধাবিত করেছে-গত দুইমাসে দেশটির শিল্প উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে ঐতিহাসিক ধস।

আসলে সত্য হলো আজকের দুনিয়ার নয়া উদারনীতিবাদী বৈশ্বিক অর্থনীতিতে-যা অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, শেয়ারবাজার ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর আধিপত্য এবং অস্বীকৃত অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ – মূলধন, শ্রম ও পণ্যের অবাধ বিচরণকে বাধাগ্রস্ত করে এমন যে কোনও বৃহৎ প্রতিবন্ধকতাকে ‘প্রবৃদ্ধি-বিরোধি’ হিশেবে চিহ্নিত করা হয় এবং এই কারণেই সরকার ও কর্পোরেশনগুলোর কাছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত।

ইতালিও প্লেগসম ‘জরুরি অবস্থা’য় ধরাশায়ী হয়ে, মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে সুরক্ষিত নয়। স্থানীয় এবং রাজ্য সরকারগুলোকে অভূতপূর্ব ক্ষমতা দেয়ার পরেও, লকডাউন ইতালিতে মন্দার আশঙ্কাও তৈরি করেছে।

বিনিয়োগ সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকস-এর (Goldman Sachs) মতে, লকডাউনের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ খাতগুলো হলো- পর্যটন, ভ্রমণ, আতিথেয়তা এবং ক্ষুদ্রব্যবসায়। এই খাতগুলো ইতালির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৩ শতাংশ।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নয়া উদারনীতিবাদী কঠোর নীতিসমূহের বহু সমালোচকদের কাছে, ইতালি ও স্পেনের লকডাউন সৃষ্ট পরিস্থিতি আসলে মুক্ত বাজার অর্থনীতির দুর্বলতা, বেসরকারি খাতের উপর অতিনির্ভরশীলতা এবং নজিরবিহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ প্রদর্শনি।

মার্চের ১৬ তারিখ, ঠিক যেদিন স্পেনিশ সরকার সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ; সেইদিনই মাদ্রিদের একটি হাসপাতালের বাইরে অঝরো ক্রন্দনরত এক নারীর ভিডিও ফুটেজ দেখেছিল গোটা বিশ্ব। তার স্বামী সবেমাত্র করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং পরীক্ষায় তারও করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছিল। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা করার মতো ‘যথেষ্ট অসুস্থ নয়’ বলে এই নারীটিকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

জরুরি অবস্থাই সিদ্ধান্ত নেয় নাগরিকদের মধ্যে কাদের জীবন রক্ষাযোগ্য এবং কাদের জীবন নয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার এই সক্ষমতা আবার বিপরীত দিক থেকে বেশিরভাগ নাগরিককে রক্ষা করা ও সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে নয়া উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রের অক্ষমতার মুহুর্তও উন্মোচন করে।

তাহলে সম্ভবত একেবারেই বিস্ময়কর নয় যে, এই ভাইরাসকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই লকডাউন ব্যবস্থা আরোপে বেশ ‘ধীরে চলো’ নীতিতে ছিল। এখানে অনুচ্চারিত ভয়টি হলো এই যে, ‘জরুরি অবস্থা’ কেবলমাত্র মানুষ, পণ্য ও আর্থিক বাজারের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহের উপরই প্রভাব ফেলবে না, বরং জাতীয় সরকারগুলোর উপর অতিরিক্ত দায়িত্ব (বহু আগেই যা বাজারের হাতে ন্যস্ত) অর্পণ করবে।

অর্থাৎ, জরুরি অবস্থা জারির প্রতি এই অনিহা ‘স্বাভাবিক’ কারণ সকলের জন্য ভর্তুকিপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা হয় অপ্রতুল (যেমন যুক্তরাজ্যে), অথবা অস্তিত্বহীন (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে)। মহামারি মোকাবেলায় ধুঁকতে থাকা প্রত্যেকটি দেশই এখন, ভাইরাসটির ক্রমবর্ধমান বিস্তারের প্রেক্ষাপটে তার সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য এবং ‘উন্নত’ পুঁজিবাদী অর্থনীতি হিশেবে নিজের বৈশ্বিক খ্যাতির সাংঘর্ষিক বাস্তবতা স্মরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।

নয়া উদারনীতিবাদী আত্মশ্লাঘা এবং সংকটকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয়ার সাংঘর্ষিক বাস্তবতা সম্ভবত সবচেয়ে প্রকটভাবে দৃশ্যমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ায়। শেষাবধি মধ্যমার্চে জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং ‘সামাজিক দুরত্বের’ দিকনির্দেশনা দেয়ার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার টানা কয়েক সপ্তাহ ভাইরাসের ভয়াবহতার মাত্রাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে গেছে। তবে আমরা যেন ভুলে না যাই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কিংবা বাইরের মৃত্যুসংখ্যা নয়, বরং শেয়ারবাজারের ঐতিহাসিক ধসের মুখে এই সরকার ভাইরাসজনিত ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে নড়েচড়ে বসেছে।

প্রকৃতপক্ষে, জরুরি অবস্থার আগ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ফক্স নিউজের রক্ষণশীল হোস্টের দৃষ্টিভঙ্গি ও কথার ভঙ্গিতে চমকপ্রদ মিল ছিল, যিনি দাবি করেছিলেন যে “রাষ্ট্রপতির উপর অভিশংসন চাপিয়ে দেয়ার আরও একটি [ডেমক্রেট] কৌশল” হচ্ছে কোভিড-১৯।

আমরা যেন এও না ভুলে যাই যে, ‘সামাজিক দুরত্ব’ পালনের নির্দেশনা কিংবা এমনকি করোনা টেস্টিং অবকাঠামোর উন্নতির লক্ষ্যে প্রাইভেট-পাবলিক অংশীদারিত্বের ঢোল পিটানোর চাইতেও ফেডারেল সরকারের কাছে কী অগ্রাধিকার পেয়েছে : অর্থনৈতিক সংকট ঠেকাতে ১.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের পেছন পেছন ছুটছে।

যদিও কেউ কেউ তর্ক তুলতে পারে যে, অবশ্যসম্ভাবী ধসের হাত থেকে বাজারকে রক্ষায় এই ঋণ জরুরি প্রতিরক্ষা, আমাদের খেয়াল রাখা উচিত রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা ঘোষণার সাথে ৫০ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল সহায়তার প্রাথমিক ঘোষণাও এসেছিল যা ব্যাংকগুলোর জন্য বরাদ্দ অর্থের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণের কম।

পলিটিকো’র অনিতা কুমার যেমনটি উল্লেখ করেছেন, এমনকি জরুরি অবস্থায় ভাইরাস মোকাবেলায় ফেডারেল সহায়তার ঘোষণার মধ্যেও “একটি স্পষ্ট বাজারবান্ধব ঘ্রাণ”(market-first) বিদ্যমান ; কারণ সারাদেশে করোনার লক্ষণ পরীক্ষা বাড়াতে হোয়াইট হাউজ গুগল, টার্গেট, অ্যামাজন ও ওয়ালমার্টের মতো কর্পোরেশনগুলোর সাথে নজিরবিহীন মধ্যস্থতা করেছে।

যদিও সরকারের নিষ্ক্রিয়তার চাইতে এইসব অংশীদারিত্বই বরং বেশি কাঙ্ক্ষিত মনে হতে পারে, তারপরেও এর ফলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এই জরুরি অবস্থার মূল কারিগর আসলে বেসরকারি খাত। বিশেষত দৈত্যাকার বহুজাতিক সংস্থাসমূহ যাদের কপাল খুললে ওয়ালস্ট্রিটের কপাল খুলে যায়। জরুরি অবস্থার ‘ব্যতিক্রমি’ নয়া উদারনীতিবাদী রাষ্ট্র এই ‘অংশিদারিত্ব’ ছাড়া এই মুহুর্তে সম্পূর্ণ অকার্যকর।

একই সাথে, ক্ষয়ক্ষতি মেরামতে জনগণের মধ্যে ‘দেশপ্রেম’ চাগিয়ে দেয়া এবং নিজেকে ‘যুদ্ধকালীন’ অবতার হিশেবে পুনঃপুন ব্র্যান্ডিং এর ডোনাল্ড ট্রাম্প্রীয় কূটকৌশলের পরেও, ফেডারেল সরকার ও স্থানীয় রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে ক্রমাগত সংযোগহীনতার নিহিতার্থও আমাদের উপেক্ষা করলে চলবে না।

এখানেও, আগামবেন কথিত ‘জরুরি অবস্থা’ কিংবা ফুকো কথিত অদম্য সরকারি ক্ষমতার ধারণার পুনর্মূল্যায়ন দরকার। ফেডারেল সরকার জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণার বহু আগেই, স্কুল বন্ধ এবং ‘সামাজিক দূরত্ব’ পালনের নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে রাজ্য গভর্নর ও নগরপ্রধানরা নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছেন। এবং অবশ্যই স্মর্তব্য, রাষ্ট্রপতি যেখানে এখন ইস্টার ( যিশুর পুনরুত্থান দিবস) এর আগে সামাজিক দূরত্বের নির্দেশিকা শিথিল করে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন, জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং রাজ্য গভর্নররা আক্রান্তের হার শুন্যে নামিয়ে আনতে এখনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়ে যাচ্ছেন।

আর্টওয়ার্ক: হেলথ সিস্টেম
শিল্পী: ভাস্কো গারগ্যালো
সিূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

কোভিড -১৯, তাই এমন এক মার্কিনী ‘জরুরি অবস্থা’ হাজির করেছে, যা ভেতর থেকেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। যেখানে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সম্পূর্ণ ধসে পড়া ওয়েলফেয়ার কাঠামোর বাস্তবতায় কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার মাধ্যমে জীবন বাঁচানোর

আশুকর্তব্যের উপলব্ধি এবং আর্থিক বাজারকে পুনরুজ্জীবিত করতে যেকোন নতি স্বীকার করতে উন্মুখ নব্য উদারনীতিবাদী নীতি পরস্পর দ্বন্দ্বমুখর।

যদি এই ফাটল এবং বিভাজনগুলোর সাথে এই নির্বাচনের বছরের হিসাবনিকাশকে রাঙ্গানো যায় ; তাহলে আসন্ন মাসগুলোতে ধাবমান যে গভীর সামাজিক-অর্থনৈতিক জরুরি পরিস্থিতির আলামত পাওয়া যাচ্ছে, তাকে না রাষ্ট্রপতির  বাগাড়ম্বর, না ‘স্বাধীনতা, ‘গণতন্ত্র, ‘বাজার’ এর মতো নয়া উদারনীতিবাদী ফাঁপা বুলি ঠিক করতে সক্ষম হবে।

সদ্য পাস হওয়া ২ ট্রিলিয়ন ডলারের উদ্দীপক বিলের ‘দুর্যোগ সমাজতন্ত্র’ পুনর্নিবাচনের কৌশল (re-election strategy) কিনা তা বলার সময় এখনো হয়নি। একদিকে, এটি রাজ্য সরকার, হাসপাতাল এবং শিল্পগুলোকে  অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যদিকে, বিলের অগ্রাধিকারের খাতগুলো বলছে: ব্যবসায়ের জন্য ৫০০ বিলিয়ন ডলার, স্বাস্থ্যসেবার জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার, রাজ্য ও স্থানীয় সরকারগুলোর জন্য ১৫০ বিলিয়ন ডলার এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য প্রায় শূন্য ভর্তুকি।

চিকিৎসাখাতের মারাত্মক অবকাঠামোগত সঙ্কট এবং বেকারবীমার আকাশছোঁয়া দাবির মুখোমুখি হয়ে নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো ইতিমধ্যে তার রাজ্যে বরাদ্দকৃত অর্থকে “বিশাল বালতিতে এক ফোঁটা” হিশেবে সমালোচনা করেছেন। কুমো এবং অন্যান্য ডেমোক্র্যাটরাও ফেডারেল সরকারের প্রতিরক্ষা উৎপাদন আইন প্রণয়নের তোরজোড়ের পরেও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি উৎপাদনকে জাতীয়করণে ট্রাম্পের অস্বীকৃতিকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এখানে আবারও আমরা নিজেদেরকে এক উদ্ভট জরুরি অবস্থায় আবিষ্কার করছি যেখানে ফেডারেল সরকার পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এটা কেবল প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছে।

আগামবেন ও ফুকো বর্ণিত জরুরি অবস্থায় সরকারি ক্ষমতা মানে শুদ্ধ শৃঙ্খলা। বিপরীত দিক থেকে মার্কিন জরুরি অবস্থাকে শুদ্ধ বিশৃঙ্খলা বলেই মনে হচ্ছে।

ভাইরাসের প্রকোপ কমে আসতে আসতে এবং প্রতিষেধক সহজলভ্য হতে হতে, লক্ষ লক্ষ আমেরিকান, যাদের জীবন  ও জীবিকার মারাত্মক অধঃপতন ঘটবে, তাদের জন্য এই বিশৃঙ্খল জরুরি অবস্থা একটা আগাগোড়া ব্যক্তি ও বেসরকারি মালিকানাধীন অর্থনীতির অনিশ্চয়তার উপর নির্ভরশীল কোন দেশে বসবাসের ঝুঁকি উপলব্ধি করার ঘুম ভাঙ্গানিয়া মুহুর্তও বটে। বিশেষত এমন এক রাজনৈতিক অর্থনীতি যার ওঠানামায় সাধারণ আমেরিকানদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।

রাজনীতিবিদ এবং টেলিভিশনের উপস্থাপকেরা ‘মার্কিন জনগণ’কে মুক্তবাজার প্রদত্ত ‘স্বাধীনতা’র প্রতি অনুরক্ত হিশেবে প্রচার করতে পছন্দ করে। প্রহেলিকাপূর্ণ এই জরুরি অবস্থার ভুক্তভোগী মার্কিনীরা এবার এই ধারণা পরিবর্তনে সক্রিয় হতে পারে।

নাওমি ক্লেইন যেমন সম্প্রতি তাঁর “করোনা-পুঁজিবাদ” ভিডিওতে যুক্তি দেখিয়েছেন, সঙ্কটের সময়ে অসম্ভব ধারণাগুলোই সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে। তবে কাদের ধারণাগুলো সম্ভবপর বলে বিবেচিত হবে সেটাই মুখ্য : বাস্তুহারা এবং লাঞ্ছিত-বঞ্চিতদের নাকি ইতিমধ্যেই সম্পদশালী ও সুবিধাপ্রাপ্তদের।

এই জরুরি অবস্থাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্রও পরিবর্তনের একটা মওকা হয়ে উঠতে পারে। তবে এটা কেবলমাত্র তখনই হবে, যখন আমরা জনগণ কেন্দ্রীক সুরক্ষা প্রকল্পগুলোর সমাবেশ ঘটাতে পারব এবং ‘চুইয়ে পড়া’ নীতি ও বাজারপন্থী কর্পোরেট প্রণোদনায় সন্তুষ্ট হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করতে পারব।

আলম, পারভেজ,(২০২০) ‘আসল জরুরি অবস্থা’, মদিনা; আদর্শ প্রকাশনি, ২০২০, ঢাকা।

Klein, Naomi, (2007) THE SHOCK DOCTRINE : THE RISE OF DISASTER CAPITALISM , Metropolitan Books , 2007 , New York.

মুহাম্মদ ,আনু, (২০১৯) রাষ্ট্র আছে রাষ্ট্র নাই ; সংহতি প্রকাশন , ২০১৯ , ঢাকা ।

সারোয়ার তুষার