- সেলিম রেজা নিউটন
সম্পাদকীয় নোট: আগস্ট বিদ্রোহের এক যুগ। ২০০৭ সালে সেনাকর্তৃত্বের জরুরি শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। যে অল্প ক‘জন শিক্ষক সেই জরুরি শাসনকে ক্রিটিক্যালি দেখতে পেরেছিলেন সেলিম রেজা নিউটন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ চলবে না’- এই উচ্চারণকে ধারণ করে প্ররতিবাদী মৌন মিছিল করার দায়ে তিনিসহ তাঁর সহকর্মিদের আটক করা হয়। জরুরি আইন ভঙ্গের দায়ে কারাদণ্ড দেয়া হয় তাঁদের। অতঃপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাঁদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকার। কারামুক্তির পর ক্ষমতা-কর্তৃত্ব- রাষ্ট্র-সমাজ-কারাগার-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি নিয়ে বিপুল পরিসরে রচনা শুরু করেন সেলিম রেজা নিউটন, যা এখনও চলমান। তাঁর অচেনা দাগ গ্রন্থের তৃতীয় দাগে জরুরি শাসন সংক্রান্ত রচনা সংকলিত হয়েছে। আগস্ট বিদ্রোহের যুগপূর্তিতে অরাজ ধারাবাহিতভাবে তা প্রকাশ করছে।
মূল প্রবন্ধ
হাজার হাজার বছর ধরে কেন্দ্রীভূত সশস্ত্র কর্তৃত্ব জনসাধারণকে উৎপাদন-উপকরণের সহায়-সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে অস্ত্রের জোরে। ঐ একই সশস্ত্র শক্তির অপর ডানা বিদ্যাজীবীরা তাকে বিদ্যাবঞ্চিত করে রেখেছে অস্ত্রের সঙ্গে-সঙ্গে শাস্ত্রেরও জোরে। তার পরও, দুনিয়াজোড়া মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার অজস্র আত্মত্যাগী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে কর্তা-শাসকেরা এক পা এক পা করে পিছিয়েছে, বেড়েছে মানুষের স্বাধীনতার সীমানা। শাসকেরা আইন জারি করে একের পর এক অধিকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে মানুষের। দিতে হয়েছে মানুষের ভোটাধিকার, এমন-কি গরিব মানুষের, নারীর এবং কালো মানুষেরও সর্বজনীন ভোটাধিকার: এক ব্যক্তির এক ভোট। শুধু আইনে হলেও, স্রেফ মুখে হলেও, মেনে নিতে হয়েছে যে জনগণই দেশের মালিক, তাঁদেরই সম্মতিতে, তাঁদেরই প্রতিনিধিরা দেশ চালাবে। কিন্তু একদিকে অর্থনৈতিক-বৈষয়িক বৈষম্য, অন্যদিকে সুদীর্ঘকালের কর্তৃত্বপরায়ণ ধ্যানধারণা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো মানুষকে তাঁর প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচনের সক্ষমতা থেকে দূরে রেখেছে, এবং কোনো একটা উচ্চতর সংস্থায় তাঁর প্রতিনিধি তাঁর হয়ে ঠিকমতো কাজ না করলে সেই প্রতিনিধিকে ঘাড় ধরে ফেরত নিয়ে
এসে অন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করার অধিকার তাঁর এখনও অর্জিত হয় নি। নির্বাচন পরিণত হয়েছে কতিপয় নব্য রাজনৈতিক জমিদারদের ও মহা-
বড়লোকদের বাণিজ্য-সঙ্ঘগুলোর এবং এই উভয় তরফের ঔপনিবেশিক প্রভুদের টাকা-পেশি-মিডিয়ার কামড়াকামড়িতে। পার্লামেণ্ট সত্যি-সত্যি পরিণত হয়েছে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়ে’, যে ‘শুয়োরেরা’ সারাদেশকেই নিজেদের ‘খোঁয়াড়’ বানিয়ে ফেলার উপক্রম করেছিল। এরা বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে সারাদেশের সমস্তকিছুকে লুটের মাল ধরে নিয়ে তার ভাগাভাগির উপযুক্ত বিধি-বন্দোবস্ত দাঁড় করাতে না পেরে প্রকাশ্য রাজপথে খুনোখুনি শুরু করে দেয়, আর মিডিয়া তা ‘লাইভ’ সম্প্রচার করতে থাকে। এই জীবন্ত সংকটেরই অপর নাম ২০০৬ সালের অক্টোবর-মহাসংকট: মাৎস্যন্যায়-পর্ব।
এখানে মাৎস্যন্যায় আর নৈরাজ্যর পার্থক্য প্রণিধানযোগ্য, কেননা কথায়-লেখায়-মিডিয়ায় ডান-বাম নির্বিশেষে প্রায় সমস্ত মহল স্রেফ অজ্ঞতাজনিত কারণে আলোচ্য মাৎস্যন্যায়-পর্বকে নৈরাজ্য, অরাজকতা প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করেছে। নৈরাজ্য কিন্তু অতিশয় উন্নত নীতিবোধসমৃদ্ধ উন্নত মানবিক একটা সমাজ গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা বিষয়। সর্বজনগ্রাহ্য কেন্দ্রীয় রাজশক্তির অভাবে পৃথক পৃথক রাজশক্তি বা রাজনৈতিক দলসমূহের ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির সশস্ত্র অভিপ্রকাশ-জনিত ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা হলো মাৎস্যন্যায়। ‘রাজা নাই, অথচ সকলেই রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বের দাবিদার। বাহুবলই একমাত্র বল, সমস্ত দেশময় উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল শক্তির উন্মত্ততা; এমন যখন হয় দেশের অবস্থা, প্রাচীন অর্থশাস্ত্রে তাহাকেই বলে মাৎস্যন্যায়, অর্থাৎ বৃহৎ মৎস্য কর্তৃক ক্ষুদ্র মৎস্য গ্রাসের যে ন্যায় বা যুক্তি সেই ন্যায়ের অপ্রতিহত রাজত্ব!’ (নীহাররঞ্জন রায়, ১৪০২ বঙ্গাব্দ: ৩৮০) ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবরকে ঘিরে ঠিক এরকম অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের দেশের ইতিহাসে আরও একবার, পাল আমলের আগে আগে, ৬৫০–৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এরকম মাৎস্যন্যায়-পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। সে-সময় সর্বসম্মতভাবে গণেশদেবকে রাজা নির্বাচনের মাধ্যমে সেই অবস্থার নিরসন ঘটে। অন্যদিকে, নৈরাজ্য তথা নৈরাজ্যবাদের নামে মেলা ভালোমন্দ-হাবিজাবি জিনিসের চল এখানে-সেখানে থাকলেও এর মূল সামাজিক আন্দোলনের ধারাটি ইউরোপে দীর্ঘকাল যাবৎ ‘মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র’ ‘মুক্তিমুখিন সাম্যবাদ’ প্রভৃতি নামে পরিচিত। আমাদের দেশের বলশেভিক-ঘরানার কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রীরা স্বাধীন সমাজতন্ত্রের ঐ দুর্দান্ত ধারাটির ইতিহাস ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত নয় বললেই চলে। কেননা ১৯১৭ সালে রুশ জনগণের মহান অক্টোবর বিপ্লবের পর স্বৈরতন্ত্রী বলশেভিকরা জনগণের ওপর রক্তাক্ত দমনপীড়ণ চালানোর মাধ্যমে নিরঙ্কুশ হুকুমদারির রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করার পর থেকে রুশ সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জগৎজোড়া প্রচারণা ব্যবস্থা সমাজতন্ত্রী অর্থে বলশেভিকদেরকেই তুলে ধরেছে। যেমন ধরুন, ১৯৩৬ সালে স্পেনের সমাজতন্ত্রীদের অসাধারণ মুক্তিপরায়ণ বিপ্লবের কথা বলতে গেলে আমাদের কানেও আসে নি। খুব বেশি লোক জানেন না, ১৯৬৮ সালের ‘প্যারিস-বসন্তের’ ছাত্র-শ্রমিক-বিক্ষোভের পেছনেও ছিল মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রীদের নানান ধারার মুক্ত-স্বাধীন তৎপরতা। এটাও আমাদের জানা আছে কিনা সন্দেহ যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদী তৎপরতার সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও ধারালো বুদ্ধিবৃত্তিক কণ্ঠস্বর, অতুলনীয় ভাষাতত্ত্ববিদ নোম চমস্কি আজকের দুনিয়ায় মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রের প্রধানতম প্রচারকদের একজন।
তো প্রকৃতপক্ষে নৈরাজ্যবাদ হচ্ছে স্বাধীন সমাজতন্ত্র: যাবতীয় রাজা-রাজড়া-রাজতন্ত্র তথা সমস্ত প্রকার শাসকগোষ্ঠীকে বিদায় করে দিয়ে সুসংগঠিত জনগণের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব কায়েমের পথে অত্যন্ত সুবিন্যস্ত পরিচালন-ব্যবস্থার মাধ্যমে গোটা দেশকে অবাধ-মুক্ত-সৃজনশীল আত্মকর্তৃত্বের সুসংগঠিত কাঠামোসমূহের অধীনে নিয়ে আসা। কিন্তু সেই শিল্প-বিপ্লবের সময়কাল থেকেই, যখন থেকে শ্রমিকদের স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো গড়ে উঠছে তখন থেকে এখন পর্যন্ত, নৈরাজ্যকে বিশৃঙ্খল, গণ্ডগোল, মাৎস্যন্যায় প্রভৃতি অর্থে চালানোর লাগাতার প্রচারণা-প্রচেষ্টা শাসকশ্রেণীগুলোর তরফে চলে আসছে। এজন্যই নৈরাজ্যবাদের অন্যতম আদি প্রবক্তা প্রুঁধো বলতেন, ‘নৈরাজ্য মানে নিয়ম, আর শাসক-সরকার মানে গণ্ডগোল’।
যাক। সপ্তম-অষ্টম শতকের মতো চরম ভয়ঙ্করভাবে রাষ্ট্র ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার আগেই দেশের সেনাবাহিনী এগিয়ে এলো। কিন্তু উন্মুক্ত আলাপ-আলোচনা সংলাপের মাধ্যমে সর্বসম্মতভাবে ‘গণেশরাজা’ নির্বাচনের পথে না গিয়ে বস্তুত বন্দুকের মুখে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওরফে পুতুলের পুতুল-রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়েই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করালো, প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে তাঁকে আর তাঁর পারিষদ উপদেষ্টা-বর্গকে পদত্যাগে বাধ্য করল, নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করালো এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের নামে রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়া নেতাদের ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমন-অভিযান পরিচালনা করা শুরু করল। ‘আন্তর্জাতিক মহল’ তথা পরাশক্তিসমূহ এই পরিবর্তনকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো, তথাকথিত সুশীল সমাজ ও বহুজাতিক বাণিজ্য-সঙ্ঘগুলোর স্থানীয় কর্পোরেট-এজেন্টদের বাণিজ্যিক মিডিয়ার উল্লাসও গোপন থাকল না। ব্যাপকভাবে প্রচার করে বলা হতে লাগল, দেশের মানুষের ১০০ ভাগ সমর্থন এই সরকারের পক্ষে আছে। বাস্তবে সেই সমর্থনের প্রকাশস্বরূপ শত শত হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের রাস্তায় জমায়েত হওয়ার বিন্দুমাত্র কোনো নমুনাও দেখা যায় নি। আবার একথাও ঠিক, এই সরকারের বিরুদ্ধেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিবাদও তাঁরা প্রদর্শন করেন নি।
অক্টোবর-মহাসংকটের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই এইটা: জনগণের নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান। শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি চূড়ান্ততম পর্যায়ে নিয়ে গেছে, শাসকশ্রেণীরই নব্য ধনতান্ত্রিক প্রতিনিধি হিসেবে ‘সুশীল সমাজ’ নাম ধারণকারী এনজিও- আমলা- ব্যবসায়ী- মিডিয়া- আর আইনজীবী-এলিটরা তো কমপক্ষে ১৫-১৬ বছরের নিরলস, নিবিড় ও সাহসী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১১ই জানুয়ারি টাইপের পরিবর্তনে মানুষ যেন হোঁচট না খান সেরকম একটা মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি নির্মাণ করেছেন, শাসকশ্রেণীর প্রচ্ছন্ন অংশ হিসেবেই সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করেছে, আন্তর্জাতিক শাসকশ্রেণীর মুরুব্বিরাও তাতে আড়াল থেকে হলেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
এই দীর্ঘমেয়াদী সুবিস্তৃত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নিকট থেকে সতর্ক দূরত্ব রচনা করার কৌশলগত যে অবস্থান গণমানুষ গ্রহণ করেছে, সেটাই বিশেষ করে ২০০৬-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে ২০০৭-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কালের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আর এখানেই আমাদের দুর্বল গণতন্ত্রের যাবতীয় মুশকিলের বীজ নিহিত। শাসকশ্রেণী এবং তাদের রাজনীতি সম্পর্কে গণমানুষের এই নির্লিপ্ততা একদিকে যেমন সুচিন্তিত, অন্যদিকে তেমনি দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণের ফলও বটে। এর কারণ ও প্রেক্ষাপট আলোচনা করা এখানে সম্ভব হবে না। কিন্তু এটুকু এমনিতেই বোধগম্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারা করার যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকেই জনগণ নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, কিংবা পুরো প্রক্রিয়াটিকেই হয়ত তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার উদ্যোগ তাঁরা নেন নি। যদি নিতেন, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আগামী দিনে জনগণের সক্রিয়তার ওপরই।
রাবি: জানুয়ারি ২০০৮। প্রকাশ: প্রবাসী বাঙালিদের অনলাইন পত্রিকা ইউকেবেঙ্গলি, লন্ডন, ১৩ই জুন ২০০৮।