অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ওরেগন লাইভ শিল্পী: আলেন ব্রেটম্যান সূত্র: পিনটারেস্ট
প্রচ্ছদ » ‘সুপার কপ’ কিংবা ‘ডার্ক জাস্টিস’: রাষ্ট্রীয় খুন ও জনমনের রাজনৈতিক বাসনা

‘সুপার কপ’ কিংবা ‘ডার্ক জাস্টিস’: রাষ্ট্রীয় খুন ও জনমনের রাজনৈতিক বাসনা

  • বখতিয়ার আহমেদ

নানা পাটেকারের ‘আব তাক ছাপ্পান’ (২০০৪) আমার দেখা প্রথম বলিউডি ‘সুপার কপ’ মুভি। বেশ কয়েকবার দেখছি। প্রায়ই কানে ভাসে ৫৬ এনকাউন্টার করা পুলিশ অফিসার সাধু আগাশের অমোঘ ডায়লগ: ‘সোসাইটিকে জামাদার হ্যায় হাম’। গ্লোবাল সাউথের এই ‘সুপার কপ’ সমাজের সুইপার, খুনে-অপরাধীদের সাফ করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজেও খুন করেন। কিন্তু তার খুন আইনেরই স্বার্থে, সমাজেরই বৃহত্তর স্বার্থে। ফলে চাকরিসূত্রে তিনি ঠিক মানুষ নন, কিলিং মেশিন। বড়কর্তার গোপন অলিখিত নির্দেশে সকালের ফ্লাইটে শাদা পোশাকে ভারতের আরেক শহরে গিয়ে অচেনা কোন লোককে অবলীলায় গুলি করেন। বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে বাজার থেকে সব্জী কিনে নিয়ে মমতাময়ী স্ত্রী আর আদরের সন্তানের সাথে আটপৌরে জীবন কাটান। মানুষ আর মিডিয়া তাকে নিয়ে ভাবে কিন্তু ঠিক বোঝে না। তিনি নিজের কাজ নিয়ে খুব বিচলিত নন, কারণ ‘যো কারনা হ্যায়, ও কারনা হ্যায়, ঠোক না হ্যায় তো ঠোকনা হ্যায়… সোচনে কা এলাউ নেহি হ্যায়’। খুনাখুনি করা ছাড়া রাষ্ট্র চালানো যায় না, এবং খুনাখুনি নিয়ে ভাবার অনুমতি নাই, এই হচ্ছে ‘আব তাক ছাপ্পান’ খুনের মোরাল অব দি স্টোরি।

আবতক ছাপ্পান পোস্টার

বলিউড ছবি আমি পারতপক্ষে মিস করি না। ‘কোম্পানি’ বা ‘দাবাং’ থেকে শুরু করে ‘সিংঘম’ পর্যন্ত সব ‘সুপার কপ’ বা গ্যাংস্টার মুভিই মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। কোন চ্যানেলে ‘সিংঘম’ দেখালে আমার ‘বলিউড প্রীতি’তে বিরক্ত ছেলে পর্যন্ত টিটকারি দেয় ‘তোমার ফেভারিট মুভি’ হচ্ছে বলে। শুধু বলিউড না, আমি শার্লক হোমস থেকে শুরু করে জেমস বন্ড টাইপ সব মুভিই দেখার চেষ্টা করি, ‘ডার্ক-জাস্টিস’ বোঝার জন্য ‘সুপার হিরো’ মুভিও। ঢালিউড মৃভিও দেখি যথাসম্ভব। এসব প্রায় পেশাগত দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কারণ অ্যাকশন বা থ্রিলার মুভি আমার জন্য মিথ বা ভাষার মতই মানুষের মন বোঝার উপাত্ত। রাষ্ট্র ব্যবস্থার দৈনন্দিন চেহারা ও চর্চা বিশ্লেষণ যেমন নৃবিজ্ঞানের ধ্রুপদী কাজ, প্রতীকি ব্যবস্থায় সামাজিক সত্য আবিষ্কার তেমনি তার ধ্রুপদী বিশ্লেষণ পদ্ধতিগুলোর মূল একটি।

নৃবিজ্ঞানের চোখ দিয়ে বুঝতে গেলে, বাংলাদেশসহ বহু আধুনিক রাষ্ট্রে চলমান খুনাখুনি শাসিত জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের সম্মতি, ‘সহমত’ অথবা সংশয়ী অবস্থান ছাড়া ‘স্বাভাবিক’ বা ‘সিস্টেমিক ম্যানেজমেন্ট প্রাকটিসে’ পরিণত হতে পারে না। কেন? সেটা আমি ২০১৪ সালের এক আলাপে যতদূর সম্ভব বলার চেষ্টা করছি (আহমেদ ২০১৪-ক)। কিন্তু এই সম্মতি আর সংশয় কিভাবে তৈয়ার হয় সেটা ব্যাখ্যা করতে গেলে ‘হাইপার রিয়েল’ সমাজ বাস্তবতায় ‘ফ্যাক্ট’ আর ‘ফিকশন’ দুটাকেই বিশ্লেষণের আওতায় আনতে হয়। ফলে ‘আইনী’ বাহিনীর ‘বেআইনী’ হত্যা প্রবৃত্তির ‘স্বাভাবিকায়ন’ বোঝার জন্য গণমানসে ‘সুপার কপ’ আর ‘ডার্ক-জাস্টিস’ ধারণার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রডাকশন আর রিপ্রোডাকশন প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ খুব জরুরী হয়ে পড়ে।

লিবারেল রাষ্ট্র-কল্পনায় বিভোর আধুনিক নাগরিক মনের কল্পনায় ‘পুলিশ’ আসলে দুইটা জোড়-বিপ্রতীপ বা বা্ইনারি চরিত্রের সংমিশ্রণ; আধুনিক অ্যাংলো-স্যাক্সন সাংস্কৃতিক বলয়ে যার মোক্ষম উদাহারণ হবেন শার্লক হোমস আর জেমস বন্ড, বলছেন নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্রেয়বার (২০১৫)। এই দুই চরিত্রই আসলে অভিন্ন সত্তা এই অর্থে যে দুজনের মধ্য দিয়েই ‘অপরাধ’, ‘পুলিশ’ বা আইন-প্রয়োগ নিয়ে পাবলিকের রাজনৈতিক চেতনা বা বাসনার স্ববিরোধিতাই প্রতীকায়িত হয়। বেশি জটিল শোনালে বিশ্লেষণ পদ্ধতিটাই একটু খুলে বলি।

লেভি-স্ত্রস প্রতিষ্ঠিত স্ট্রাকচারাল নৃবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ পদ্ধতি মোতাবেক, কোন প্রতীকের অর্থই স্বতঃসিদ্ধ নয়, অন্য প্রতীকের সাথে সম্পর্কসূত্রেই তার অর্থ নির্ধারিত হতে থাকে। নৃবিজ্ঞানী মাত্রই সংস্কৃতির জটিল জালে ক্রিয়াশীল প্রতীকগুলোর অর্থময়তার আন্তঃসম্পর্কের কাঠামো বা বিন্যাস চিহ্নিত করেই মানুষের মনকে বোঝার চেষ্টা করেন। নৃবিজ্ঞানের এই ‘কাঠামো-প্রত্যাশী’ (মজহার ১৯৭৭) পদ্ধতির প্রথম ধাপ হচ্ছে ভাষায়, কাব্যে, প্রতীকে, মিথে, টোটেমে, বিশ্বাসে, বয়ানে বা জনমানুষের মনের আর সব অলি-গলি-সন্ধিতে থাকা প্রতীকগুলোর জোড়-বিপরীত সম্পর্কগুলো আবিষ্কার করা।

এই বিশ্লেষণ খুব কঠিন কোন কাজ না, কোন থিওরি তো না-ই। এই সম্পর্কের প্রথম সূত্রই হচ্ছে জোড়-বৈপরীত্য বা বাইনারি। সহজ অর্থে এর মূল সূত্র হচ্ছে কোন প্রতীকি ব্যবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে, কোন প্রতীককে তার জন্য সাংস্কৃতিক অভিধানে নির্দিষ্ট করা অর্থ দিয়ে না বুঝে আর সব প্রতীকের সাথে সম্পর্কসূত্রে বুঝতে হবে। একটা বাক্যে যেমন কোন পদের অর্থ অন্য পদের সাথে তার সম্পর্কের নিরীক্ষে নির্ধারিত হয়। এজন্য প্রথমে একটা নির্দিষ্ট পরিসর লাগবে, সেখানে ক্রিয়াশীল উপাদানগুলো চিহ্নিত করতে হবে, তারপর একটার সাথে অন্যটার বিপ্রতীপ আন্তঃসম্পর্ক আবিষ্কার করতে হবে। যেমন জনমানসের ভয় যদি পরিসর হয়, হরর মুভির ক্ষেত্রে ড্রাকুলা বা কোন ভ্যাম্পায়ার চরিত্রকে বুঝতে হবে তার প্রতি-চরিত্র ওয়্যার-উলফ দিয়ে। কারণ একজনকে ছাড়া অন্যজনের কল্পকথা পূর্ণ হয় না।

লেভিস্ত্রস

ফেভারিট কোন ‘সুপার কপ’ বা ‘সুপার হিরো’ থাকার বয়স পেরিয়ে গেলেও লেভি-স্ত্রস এখনো আমার ইন্টেলেকচুয়াল হিরোদের একজন। কারণ উনার আগের সমাজবিদ্যার কাছে ব্যাখ্যাতীত বিমূর্ত বাস্তবতাকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের আওতায় নিয়ে আসবার, উপাত্তে পরিণত করবার, এবং তার অন্তর্লীন আদল ‘আবিষ্কার’ (খান ২০১১) করবার একটা সহজ ও সাহসী পদ্ধতি তিনি আধুনিক নৃবিদ্যাকে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতির সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের জন্যও আমি তাঁর এই ‘অন্তর্লীন-কাঠামো-সন্ধানী’ পদ্ধতি (আহমেদ ২০১৪-খ) অকাতরে ব্যবহার করি।

যা হোক, গ্লোবাল নর্থের লিবারেল ও পপুলার রাষ্ট্র কল্পনায় হোমস আর বন্ড এমনই জোড়-বিপরীত সম্পর্কে আবদ্ধ দুই প্রতীক। ইনাদের একজনকে ছাড়া আরেকজনকে বোঝা যাবে না। কারণ উনারা জনমনে মিশে থাকা দুই বিপরীত বাসনার প্রতীক যা দিয়ে তারা বাস্তবের ‘পুলিশ’ নিয়ে ভাবে। এই বৈপরীত্যেরই হাজারো প্রকাশ আছে আমাদের রাজনৈতিক জীবন আর কথকতার দৈনন্দিন চর্চায়, ‘সুপার কপে’র বিপরীতে ‘মনস্টার কপে’র মত বাইনারি আছে আরো অসংখ্য। আমার ধারণা বাংলাভাষী সাংস্কৃতিক বলয়ে ‘হোমস-বন্ড’ জুটির লোকাল বা পোস্টকলোনিয়াল উত্তরাধিকার হচ্ছেন ফেলুদা (বা মিসির আলী) আর ‘অবসরপ্রাপ্ত মেজর’ মাসুদ রানা। যাই হোক, আপাতত ‘হোমস-বন্ড’ বাইনারি দিয়েই আরেকটু বোঝা যাক ‘পুলিশ’ নিয়ে লিবারেল নাগরিক কল্পনার কায়-কারবার।

জেমস বন্ড পোস্টার

হোমস আর বন্ড, দু’জনেই লন্ডননিবাসী ‘অপরাধ-নিরোধকারী’ হলেও স্বভাব ও কাজেকর্মে পুরাই বিপরীত। প্রথম জন অ্যামেচার, পরের জন পেশাদার। প্রথম জন একটু নেশা-ভাঙ করলেও যৌনতা উদযাপনে তেমন আগ্রহী নন, দ্বিতীয় জনের মদিরা ও যৌনতা, দুইয়েই আগ্রহ আছে। অ্যামেচার আর খেয়ালি হলেও হোমস নিজের কাজে সাংঘাতিক দক্ষ ও দায়িত্বশীল। ওদিকে পেশাদার হলেও বন্ড মৌজ করতে গিয়ে প্রায়ই নিয়ম, দায়িত্ব বা ছদ্মবেশ ভুলে বিপদে পড়েন। হোমস পুলিশের লোক না হলেও অপরাধ তদন্তে পুলিশের চেয়ে দক্ষ, প্রধানত আইনের সীমার মধ্যেই কাজ করেন। বন্ড রাষ্ট্রীয় সিক্রেট এজেন্ট হলেও শুধু ‘লাইসেন্সড টু চিল’ই না, ‘লাইসেন্সড টু কিল’ও বটেন। তিনি প্রায় সব কাজই করেন আইনের সীমার বাইরে। এমনকি প্রায়শই নিজ দেশের ‘পুলিশ’ই তাকে ধাওয়া করে, নিজের বসই তাকে গ্রেপ্তার বা গুলির নির্দেশ দেয়। প্রায়শই ‘হি ইজ আউট অন হিজ ওউন’।  একটু খেয়াল করলে দেখবেন স্পাই থ্রিলার ‘মিশন ইম্পসিবলে’র ইথান চরিত্রটিও তাই।

কিন্তু এতসব বিপরীত-বৈশিষ্ট্য ছাপিয়েও দুইজনের সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হচ্ছে হোমস অতীতে ঘটে যাওয়া অপরাধ সম্পর্কে ‘সত্য’ উদঘাটন করে আইনের হাতে তুলে দেন, অন্যদিকে বন্ড গোপন গোয়েন্দা তথ্যে’র ভিত্তিতে ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন ‘অপরাধ’ আগেই দমন করে ফেলেন। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, দুনিয়ার সর্বত্রই পুলিশের মূল দুইটা কাজ, অতীত ‘অপরাধ তদন্ত’ এবং ভবিষ্যত ‘অপরাধ দমন’, এই দুই ‘সুপার কপ’ আখ্যানেই চিত্রিত আছে। জনমানস এই কল্পনা দিয়েই বাস্তবের পুলিশ নিয়ে ভাবে বা বাসনা সাজায়।

ওয়ার ওলফ

‘সুপার কপ’কে জনমানসের বাসনার অন্তর্গত করে তোলার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নৃবিজ্ঞানী গ্রেয়বার দেখান যে ইউরোপের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে জন-মানসে এই চিন্তনভঙ্গীর একটা সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা আছে। কল্পিত ড্রাকুলা চরিত্র যেমন আছে, তেমনি বাস্তবের চরিত্র এলিয়ট নেস বা ফিলিপ মারলোকে নিয়ে প্রচলিত জনশ্রুতি আছে। ভ্যাম্পায়ার আর ওয়্যার-উলফ, গ্রেয়বার দেখাচ্ছেন, আজকের জন-মানসে ‘সুপার কপ’ বা ‘ডার্ক জাস্টিস’ ধারণারই প্রত্নতাত্ত্বিক রূপ। দুই চরিত্রই দানব, ভ্যাম্পায়াররা ছিলেন ধনী আর অভিজাত, থাকতেন ক্যাসল বা ম্যানশনে। ওয়্যার-উলফরা ছিলেন গরিব ও ভবঘুরে, প্রায়শই জেমস বন্ডের মত ফেরারী, লড়তেন ভ্যাম্পয়ারদের সাথে, দানব হয়ে। শুভ আর অশুভ, দুই শক্তিই তখন দানব, একে অপরের সাথে লড়াই করে প্রতীকি সম্পর্কে আবদ্ধ থাকার কারণেই তারা আবির্ভূত হন জনমানসের কল্পনায়।

মেরিন ড্রাইভের সর্বশেষ খুনে উদ্বেলিত পাঠকের মনে হয়তো ইতিমধ্যেই ‘সুপার কপ=মেজর সিনহা’ এবং ‘মনস্টার-কপ=ওসি প্রদীপ’ ধরনের একটা স্ট্রাকচারাল বিশ্লেষণ পাওয়ার আশা জেঁকে বসেছে। কিন্তু সেই পথ আমি মাড়াবো না। কারণ আমার কারেন্ট হিরো নৃবিজ্ঞানী গ্রেয়বার আরো শিখিয়েছেন, খুনি রাজনৈতিক ক্ষমতা শুধু ‘জেমস বন্ড’ বা ‘নয়ন বন্ডে’র ফিকশনই বানায় না, শাসিত বুদ্ধিজীবিতার জন্য দুইটা সিরিয়াস ওয়ার্নিংও ইস্যু করে। প্রথমটা হচ্ছে, অতীত ঘটনা নিয়ে বেশি জ্ঞান অর্জন করতে গেলে বাটে পড়তে হয় (এই গণপ্রজ্ঞা অর্জনের জন্য ‘দি মামি’ দেখতে পারেন)। দ্বিতীয়টা হচ্ছে ভবিষ্যত নিয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গেলেও বিপদ হয় (উদাহারণ: ফ্রাংকেনস্টাইন চরিত্র)। কাজেই প্রতীকে পরিণত হতে থাকা বাস্তব চরিত্র দিয়ে চলমান খুনাখুনির ভূত-ভবিষ্যত বিশ্লেষণের ঝুঁকি আপাতত এড়িয়েই যাব। তাছাড়া, স্ট্রাকচারাল পদ্ধতিরও একটা পরিসীমা আছে। এটা পরাবাস্তবিক দৃশ্য আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক আনন্দে যতদূর আগায় তারচে বেশি ঠেলতে গেলে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ না হয়ে বৈজ্ঞানিক কুসংস্কারে পর্যবসিত হতে পারে।

যা হোক, নৃজ্ঞৈানিক বিচার বিশ্লেষণের জন্য ‘জনমানস’ খুব অদ্ভূত একটা পরিসর কারণ তা সর্বদা এরকম অদ্ভূত সব বৈপরীত্যে ঠাসা থাকে। সমাজের মূলধারার চিন্তা-স্রোত, ক্লিফোর্ড গিয়ার্টয (১৯৭৩) দেখিয়েছেন, মতাদর্শ বা আইনের মত এক-রৈখিক বা একমাত্রিক না। এখানে বহুমাত্রিক ও বিরোধাত্মক বহু ধারণাই একই সাথে একই মনে ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন এই পরিসরে ব্যক্তি মানুষ একই সাথে ধার্মিক এবং সেকুলার বা লিবারেল হতে পারেন এবং তাতে তার সমাজ জীবনে বিশেষ কোন বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না। কিন্তু মতাদর্শিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কল্পনায় বৈপরীত্য বা বহুমাত্রিক সম্ভবনা বা সত্যের জায়গা নেই। এজন্যই ক্ষমতা, খুন, মতাদর্শ, বা ধর্মের মত সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা বোঝার জন্য জনজীবন ও মানসের বহুমাত্রিক বৈপরীত্যকে প্রতীকি ব্যবস্থার ‘থিক ডেসক্রিপশন’ তৈরি করে ব্যাখ্যা করবার প্রেস্ক্রিপশন দেন আমার আরেক একাডেমিক হিরো, ‘ব্যাখ্যানমূলক নৃবিদ্যা’র অগ্রদূত ক্লিফোর্ড গিয়ার্টয। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপবাসীদের মোরগ লড়াইয়ে প্রতীকাবদ্ধ রাজনৈতিক মনের গড়ন ব্যাখ্যা করে নিজের পদ্ধতি তিনি হাতে কলমে দেখিয়েছেন।

ডেভিড গ্রেয়বর

এসব প্রেসক্রিপশন বা পদ্ধতি দিয়ে পাবলিক ডিসকোর্সে ক্রিয়াশীল অযুত-নিযুত সব প্রতীকের মাঝে এরকম শত-সহস্র জোড়-বিপ্রতীপ সম্পর্ক আবিষ্কার করে, তাদের সম্পর্ক সূত্র বিশ্লেষণ করে জনমানসে ‘সুপারকপ’ বা ‘ডার্ক-জাস্টিসে’র বাসনাকে যেমন ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনি ব্যাখ্যা করা যায় রাষ্ট্রীয় প্রযোজনায় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’ এর মত একক-উর্ধ্ব-কমা-বন্দী শব্দের প্রতীকে প্রতিভাত চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে। ব্যাখ্যা করা যায় মেট্রোপলিটান হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ক্রমশ নেক্রোপলিটান হতে থাকা রাষ্ট্রের গুপ্ত ও প্রকাশ্য খুনাখুনির প্রবৃত্তিকে। শাসন-প্রণালীর অঙ্গীভূত চর্চা হিসেবে খুনাখুনিকে বুঝতে হলে, রাজনৈতিক ক্ষমতার এই খুনে প্রবৃত্তির কায়-কারবার ব্যাখ্যা করতে গেলে, নৃবিজ্ঞানের কাছে এই পদ্ধতির বিকল্প নাই।

রাষ্ট্রের হাতে একেকটা খুনের পরে কি কি দেখা গেল, কি কি জানা গেল, কি কি বলা/লেখা/ভাবা গেল, সেটা খুনের ঘটনার মতই তীব্র বাস্তবতা কারণ এসবের মধ্য দিয়েই পরের খুনের প্লট তৈরী হয়। এই ছিল আমার ২০১১ সালে লেখা নৃবৈজ্ঞানিক উপলব্ধি। এখন আরো স্পষ্ট হচ্ছে যে রাষ্ট্রীয় খুন প্রশ্নে জনমানসে বিরাজমান যে সম্মতি বা স্ববিরোধ, তার মূলে আছে সরল ও ‘নির্বোধ’ এক রাষ্ট্র-কল্পনা, যার ম্যানুফ্যাকচার আর ডিসট্রিবিউশন আধুনিক রাষ্ট্র নিজেই তদারকি করে, খুনাখুনিকেই ‘স্বাভাবিক’ শাসন দশা হিসেবে চালানোর মতলবে।

আর্টওয়ার্ক: ওরেগন লাইভ
শিল্পী: আলেন ব্রেটম্যান
সূত্র: পিনটারেস্ট

এই পুরো প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের আওতায় নিয়ে আসা গেলে ‘ভাল ক্রসফায়ার বনাম খারাপ ক্রসফায়ার’ ধরনের নির্বুদ্ধিতা কেন ও কীভাবে জনমানসে দানা বেঁধে অবস্থান করে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিগঠনে নির্বুদ্ধিতার ভূমিকা, এমনকি এই নির্বুদ্ধিতা উৎপাদন প্রণালীকেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব এই পদ্ধতি অবলম্বনে। ‘ডার্ক’ বা ‘ডাইরেক্ট’ জাস্টিসের বাসনা, কিংবা সুপার বা মনস্টার কপের আখ্যান কীভাবে ন্যায়হীন বন্দোবস্ত আর খুনাখুনির রাজনৈতিক বাস্তবে বোকামিকে সম্বল করে বাঁচতে শেখায় নাগরিককে, তার রাজনৈতিক বাসনার বিন্যাসকে কীভাবে বদলে দেয়, আর এসবের মধ্য দিয়ে তার মুক্তির স্পৃহা, তার সামাজিক সত্তা, কীভাবে প্রতিদিন খুন হয় সেই বিবরণ ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। হাইপার রিয়াল সময়ে ফ্যাক্ট আর ফিকশনের প্যারালাল ইউনিভার্সে আটকা পড়া বিহব্বল নাগরিক মন, কিম্বা ‘ফরেস্ট গাম্পে’র মত হুদাই দৌড়াইতে থাকা নাগরিক মনের অন্তর্লীন আদল আরো স্পষ্ট হতে থাকে।

খুব বোরিং না আসলে নৃবিজ্ঞান।

উল্লেখিত পূর্বসূত্র

আহমেদ, বখতিয়ার ২০১৪ (ক), ‘গুম-খুন-আতঙ্ক : শাসন প্রণালী ও হত্যার কথকতা’, বাধন অধিকারী সম্পাদিত বাংলাদেশ পরিস্থিতি: নয়া উদারবাদী যুগে শাসনপ্রণালী ও কথকতা।

আহমেদ, বখতিয়ার ২০১৪ (খ), ‘ভাষা, সংস্কৃতি ও মানবসত্তা: একটা নৃবৈজ্ঞানিক আলাপচারিতা’, আলী আফজাল খান (সম্পাদিত), ভিন্নচোখ, ভাষা সংখ্যা ২০১৪, ঢাকা।

খান, সলিমুল্লাহ ২০১১, ‘লেবিস্ত্রোসের আবিষ্কার’, তাঁর স্বাধীনতা ব্যবসায়, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ১৪৫-১৫৭।

মজহার, ফরহাদ ১৯৭৭, প্রস্তাব, বুক সোসাইটি, ঢাকা।

Geertz, Clifford 1973, The Interpretation of Cultures, Basic Books Inc., New York.

Graeber, David 2015, ‘Dead Zones of the Imagination: An Essay on Structural Stupidity’ in his The Utopia of Rules: On Technology, Stupidity, and the Secret Joys of Bureaucracy, Melville House, London.

বখতিয়ার আহমেদ

বখতিয়ার আহমেদ নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক। অধ্যাপনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। উচ্চতর গবেষণা ও অধ্যাপনা করেছেন অস্ট্রেরিয়ার ওলোংগং বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৯০’র দশকের শেষভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়াশোনাকালে যুক্ত ছিলেন শিক্ষার্থী আন্দোলনে। ক্ষমতা, সমাজ, ভাষা, নব্য উদারবাদ, জাতীয়তাবাদ, বিবর্তনবাদ বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রচনা রয়েছে, বিদ্যায়তনের শাস্ত্রীয় অচলায়তন ভাঙতে যা গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগ: bokhtiar_ahmed@yahoo.com