অরাজ
শিল্পী: মকবুল ফিদা হুসেন সূত্র: পিনটারেস্ট
প্রচ্ছদ » রবীন্দ্রনাথ এবং রাষ্ট্রতন্ত্র, নেশন ও জাতীয়তাবাদ

রবীন্দ্রনাথ এবং রাষ্ট্রতন্ত্র, নেশন ও জাতীয়তাবাদ

  • আলী রীয়াজ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গান, এমনকি তার উপন্যাসের তুলনায় তাঁর সমাজ ও সভ্যতা বিষয়ক নিবন্ধসমূহ কম আলোচিত হয়ে থাকে। কিন্ত রবীন্দ্রনাথের অন্যসব সৃষ্টির মতোই এখনও সেগুলো প্রাসঙ্গিক এবং সম্ভবত আজকের দিনে তার প্রাসঙ্গিকতা আরো বেশি। রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তার একটি বড় দিক হচ্ছে যে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সভ্যতা বিষয়ক রচনাগুলো।

১৮৭৮-৮০ সালে তার প্রথম বিলেতবাসের সময় রচিত পত্রগুচ্ছ যা ভারতী সাময়িকীতে ‘য়ুরোপ প্রবাসী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ বলে প্রকাশিত হয় এবং যা ১৮৮১ সালে ‘য়ুরোপপ্রবাসীর পত্র’ হিসবে গ্রন্থাকারে ছাপা হয় সেখানেই আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতা বিষয়ে তাঁর প্রথম ধারণা ও প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হই। সেই থেকে ১৯৪১ সালে মৃত্যুর অব্যবহিত আগে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ পর্যন্ত ৬০ বছরে তিনি এই এই বিষয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন। এই সময়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলো যেমন অভ্যন্তরীণভাবে বিকশিত হয়েছে, তেমনি সারা পৃথিবী জুড়ে তাঁদের উপনিবেশিক শাসনের বিস্তার ঘটিয়েছে। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা।

আর্টওয়ার্ক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিল্পী: দেবরাজ জানা
সূত্র পিন্টারেস্ট

রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার ইউরোপ সফরের সূচনায় – ১৮৯০ সালে – যদিও বিনয় করে বলেছিলেন যে, ‘আমার মতো অভাজনের পক্ষে য়ুরোপীয় সভ্যতার পরিণাম অন্বেষণের চেষ্টা অনেকটা আদার ব্যাপারীর জাহাজের তত্ত্ব নেয়ার মতো’ তথাপি এই বিষয়ে তাঁর উপলব্ধি এতটা গভীর, এতটাই কৌতুহলদ্দীপক যে এতদিন পরেও আমাদের তা পাঠ করা দরকার। দীর্ঘ ৬০ বছরে বিভিন্ন সময়ে তিনি যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলেন তাতে আমরা যে বিবর্তন দেখতে পাই তা হচ্ছে প্রবল আশবাদ থেকে হতাশা, গভীর বিশ্বাস থেকে প্রবল অবিশ্বাস।

রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন রাষ্ট্র ও নেশনকে, প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন রাষ্ট্রতন্ত্র, ন্যাশনালইজম এবং ইমপীরিয়ালইজমকে। লক্ষ্যনীয় যে, তিনি এগুলোকে চিহ্নিত করেছিলেন ক্ষতিকারক এবং ভয়াবহ বলে। এখন সারা পৃথিবী জুড়ে যখন উগ্র জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালইজমের বিস্তার ঘটেছে এবং তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা এখন প্রাত্যহিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তখন রবীন্দ্রনাথের চোখে এই প্রবণতাগুলোর যে বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়েছিলো সেই দিকে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি। সম্ভবত তা করা জরুরিও। এতে করে আমরা দেখতে পাবো যে সমসাময়িক কালের এই প্রবণতার উৎস কোথায় এবং তাঁর ভয়াবহতা কতটুকু।

রবীন্দ্রনাথ যখন জাতীয়তাবাদের ত্রুটি গুলো চিহ্নিত করেন তখন রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশের সময় এবং সেই ন্যাশনালইজমের ভিত্তিতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো। ইউরোপের দেশে দেশে এখন আবার যে চিন্তা বিকশিত হচ্ছে তা হচ্ছে তার মর্মমূলে যে এক ধরনের জাতীয়তাবাদের চিন্তাই উপস্থিত তা সহজেই চোখে পড়ে। আজকের যুগে কেবল যে রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদেরই পুনর্জীবন ঘটছে তা নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদও। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ। হুমকি কেবল নির্দিষ্ট দেশের সীমানার মধ্যে আটকে নেই, তা বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে। জাতীয়তাবাদের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে এর উদ্ভব হয়েছিলো নিজস্বতাকে অন্যের চেয়ে বড় করে, তুলামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ বলে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষা থেকেই। পশ্চিমের এই ধারণা যখন প্রাচ্যে বিকশিত হয়েছে তখন তা বিবেচিত হয়েছে মুক্তির একটি পথ হিসেবে। ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং মুক্তচিন্তার যে আদর্শ তা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিলো, এই বিষয়ে ১৯০১ সালের আগের রচনাগুলোতে তিনি সেই কথাই বলেছেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী রচনায়ও আমরা দেখতে পাই যে তিনি পশ্চিমা সভ্যতার কিছু দিককে ইতিবাচক বলেই বিবেচনা করেছেন। ‘সফলতার সদুপায়’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন–

ভারতবর্ষে একচ্ছত্র ইংরেজ-রাজত্বের প্রধান কল্যাণই এই যে, তাহা ভারতবর্ষের নানা জাতিকে এক করিয়া তুলিতেছে। ইংরেজ ইচ্ছা না করিলেও এই ঐক্যসাধন-প্রক্রিয়া আপনা-আপনি কাজ করিতে থাকিবে। নদী যদি মনেও করে যে, সে দেশকে বিভক্ত করিবে, তবু সে এক দেশের সহিত আর-এক দেশের যোগসাধন করিয়া দেয়, বাণিজ্য বহন করে, তীরে তীরে হাট-বাজারের সৃষ্টি করে, যাতায়াতের পথ উন্মুক্ত না করিয়া থাকিতে পারে না। ঐক্যহীন দেশে এক বিদেশী রাজার শাসনও সেইরূপ যোগের বন্ধন। বিধাতার এই মঙ্গল অভিপ্রায়ই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে মহিমা অর্পণ করিয়াছে।

একার্থে রবীন্দ্রনাথ কার্ল মার্ক্সের মতোই ইংরেজকে ভারতে উজ্জীবনের শক্তি এবং ইতিহাসের অচেতন শক্তি বলে বিবেচনা করেছেন। শুধু তাই নয়, ১৯১৬ সালে তিনি যখন ন্যাশনালইজম-এর সমালোচনায় মুখর, সেই সময়ে জাপানে দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন–

I must not hesitate to acknowledge where Europe is great, for great she is without doubt. We cannot help loving her with all our heart, and paying her the best homage of our admiration,—the Europe who, in her literature and art, pours out an inexhaustible cascade of beauty and truth fertilizing all countries and all time; the Europe who, with a mind which is titanic in its untiring power, is sweeping the height and the depth of the universe, winning her homage of knowledge from the infinitely great and the infinitely small, applying all the resources of her great intellect and heart in healing the sick and alleviating those miseries of man which up till now we were contented to accept in a spirit of hopeless resignation; the Europe who is making the earth yield more fruit than seemed possible, coaxing and compelling the great forces of nature into man’s service. Such true greatness must have its motive power in spiritual strength.

কিন্ত রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের এই শক্তিকে রাষ্ট্রতন্ত্র বা ন্যাশনালইজমের মধ্যে নয়, দেখেছেন তাঁর আত্মার শক্তির ভেতরে। ‘সমাজভেদ’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতা বিষয়ে তাঁর ধারণাগুলো আরো সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য সভ্যতার পার্থক্য চিহ্নিত করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে বিষয়ের ওপরে জোর দিয়েছেন তা হচ্ছে রাষ্ট্র প্রসঙ্গ। তিনি লিখেছেন যে, ‘রাষ্ট্রতন্ত্রই য়ুরোপীয় সভ্যতার কলেবর; এই কলেবরটিকে আঘাত হইতে রক্ষা না করিলে তাহার প্রাণ বাঁচে না। … পূর্বদেশে তাহার বিপরীত। প্রাচ্যসভ্যতার কলেবর ধর্ম। ধর্ম বলিতে রিলিজন নহে, সামাজিক কর্তব্যতন্ত্র; তাহার মধ্যে যথাযোগ্যভাবে রিলিজন পলিটিক্স সমস্তই আছে।” তাঁর এই ধারণাটি তিনি আরো বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন ‘প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য সভ্যতা’ প্রবন্ধে। ফরাসী মনীষী গিজর মত অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সভ্যতার ‘মূল প্রকৃতি ও শ্রেষ্ঠত্ব’ হিসবে যাকে চিহ্নিত করেন তা হচ্ছে ‘স্বাধীনতা’। আর প্রাসঙ্গিকভাবে এ কথাও তিনি উল্লেখ করেন যে ভারতে ইংরেজের আগমনে ‘জ্ঞানের বন্ধনমুক্তি’ ঘটেছে। তিন মহাদেশ ব্যাপৃত যে সভ্যতা তাঁকে তিনি বলেছেন ‘মহাসভ্যতা’ “পৃথিবীতে এমন আশ্চর্য বৃহদ্‌ব্যাপার ইতিপূর্বে আর ঘটে নাই।” কিন্ত এই অভূতপূর্ব মহাসভ্যতার ঐক্যসূত্রটি হলো – রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থ’। “ইংলন্ডে বল, ফ্রান্সে বল, আর সকল বিষয়েই জনসাধারণের মধ্যে মতবিশ্বাসের প্রভেদ থাকিতে পারে, কিন্তু স্ব স্ব রাষ্ট্রীয় স্বার্থ প্রাণপণে রক্ষা ও পোষণ করিতে হইবে এ সম্বন্ধে মতভেদ নাই। সেইখানে তাহারা একাগ্র, তাহারা প্রবল, তাহারা নিষ্ঠুর, সেইখানে আঘাত লাগিলেই সমস্ত দেশ একমূর্তি ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান হয়। জাতিরক্ষা আমাদের যেমন একটা গভীর সংস্কারের মতো হইয়া গেছে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষা য়ুরোপের সর্বসাধরণের তেমনি একটি অন্তর্নিহিত সংস্কার”। আর এই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, রবীন্দ্রনাথ অনুমান করলেন, ‘তাহার অপেক্ষা উচ্চতর ভাবকে হনন’ করতে উদ্যত হয়েছে। সেই উচ্চতর ভাবটি হচ্ছে মানবধর্ম – “রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে য়ুরোপীয় সভ্যতা এতই আত্যন্তিক প্রাধান্য দিতেছে যে, সে ক্রমশই স্পর্ধিত হইয়া ধ্রুবধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করিতে উদ্যত হইয়াছে।” রবীন্দ্রনাথ আশংকা প্রকাশ করলেন যে, “য়ুরোপীয় সভ্যতার মূলভিত্তি রাষ্ট্রীয় স্বার্থ যদি এত অধিক স্ফীতিলাভ করে যে, ধর্মের সীমাকে অতিক্রম করিতে থাকে, তবে বিনাশের ছিদ্র দেখা দিবে এবং সেই পথে শনি প্রবেশ করিবে।”

এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সভ্যতার আরেকটি মৌলিক ধারণা বিষয়ে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন, তা হচ্ছে ‘নেশন’। রবীন্দ্রনাথ নেশন শব্দটির কোনো বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করেননি, ইচ্ছে করেই। কেননা ‘নেশন’-এর ধারণাটি পাশ্চাত্য থেকে আহরিত; রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “‘নেশন’ শব্দ আমাদের ভাষায় নাই, আমাদের দেশে ছিল না। সম্প্রতি য়ুরোপীয় শিক্ষাগুণে ন্যাশনাল মহত্বকে আমরা অত্যাধিক আদর দিতে শিখিয়াছি। অথচ তাহার আদর্শ আমাদের অন্তঃকরণের মধ্যে নাই। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ, আমাদের গৃহ, কিছুই নেশন-গঠনের প্রাধান্য স্বীকার করে না”। শুধু তাই নয় রবীন্দ্রনাথ নেশন-এর চেতনার মধ্যে আবিষ্কার করলেন এক ধরনের নিষ্ঠুরতা – “পনেরো-ষোলো শতাব্দী খুব দীর্ঘকাল নহে। নেশনই যে সভ্যতার অভিব্যক্তি তাহার চরম পরীক্ষা হয় নাই। কিন্তু ইহা দেখিতেছি, তাহার চারিত্র-আদর্শ উচ্চতম নহে। তাহা অন্যায় অবিচার ও মিথ্যার দ্বারা আকীর্ণ এবং তাহার মজ্জার মধ্যে একটি ভীষণ নিষ্ঠুরতা আছে”।

নেশন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ধারণার আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমরা পাই তাঁর ‘নেশন কী’ প্রবন্ধে। যদিও ফরাসী ভাবুক আর্নেস্ট রেনা’র আদর্শে লেখা এই প্রবন্ধ ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ ব্যাখ্যার ভূমিকা মাত্র, তথাপি সেখানে রবীন্দ্রনাথ নেশনকে যে ভাবে সংজ্ঞায়িত করেন সেখানে আমরা পশ্চিমা সভ্যতার এই উপাদান বিষয়ে তাঁর অবস্থান বুঝতে সক্ষম হই। রবীন্দ্রনাথ দেখালেন যে, “জাতি ভাষা বৈষয়িক স্বার্থ ধর্মের ঐক্য ও ভৌগোলিক সংস্থান নেশন-নামক মানস পদার্থ সৃজনের মূল উপাদান নহে”। তাঁর মতে এই মানস-পদার্থের উপাদান দুটি – “অতীতে সকলে মিলিয়া ত্যাগ দুঃখ-স্বীকার এবং পুনর্বার সেইজন্য সকলে মিলিয়া প্রস্তুত থাকিবার ভাব হইতে জনসাধারণকে যে একটি একীভূত নিবিড় অভিব্যক্তি দান করে তাহাই নেশন”। নেশন বিষয়ে তাঁর এই ধারণার আলোকেই তিনি ভারতের সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে তিনি দেখিয়েছেন যে, পাশ্চাত্যে নেশনতন্ত্র কি করে এক ভয়াবহ উদগ্র রূপ লাভ করছে। ‘বিরোধমূলক আদর্শ’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন পাশ্চাত্যে এই নেশনতন্ত্র তৈরি করেছে অন্ধত্ব, অবিচার ও নিষ্ঠুরতা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–

অন্ধতা নেশনতন্ত্রেরই মূলগত ব্যাধি। মিথ্যা দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক, নিজেদের কাছে নিজেকে বড়ো করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা প্যাট্রিয়টিজ্‌মের প্রধান অবলম্বন। গায়ের জোর, ঠেলাঠেলি, অন্যায় ও সর্বপ্রকার মিথ্যাচারের হাত হইতে নেশনতন্ত্রকে উপরে তুলিতে পারে, এমন সভ্যতার নিদর্শন তো আমরা এখনো য়ুরোপে দেখিতে পাই না।পরস্পরকে যথার্থরূপ জানাশুনা কেমন করিয়া সম্ভব হইবে। নেশনের মেরুদণ্ডই যে স্বার্থ। স্বার্থের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী, এবং স্বার্থের সংঘাতে মানুষকে অন্ধ করিবেই। ইংরাজ যদি সুদূর এশিয়ায় কোনোপ্রকার সুযোগ ঘটাইতে পারে ফ্রান্স্ তখনই সচকিত হইয়া ভাবিতে থাকিবে, ইংরাজের বলবৃদ্ধি হইতেছে। প্রত্যক্ষ সংঘাত না হইলেও পরস্পরের সমৃদ্ধিতেও পরস্পরের চিত্তকে বিষাক্ত করে। এক নেশনের প্রবলত্ব অন্য নেশনের পক্ষে সর্বদাই আশঙ্কাজনক। এ স্থলে বিরোধ, বিদ্বেষ, অন্ধতা, মিথ্যাপবাদ, সত্যগোপন, এ-সমস্ত না ঘটিয়া থাকিতে পারে না।

বিংশ শতাব্দীর সূচনায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন যে, ইউরোপকে “তাহার ন্যাশনালত্বের ব্যাধি, অতিমেদস্ফীতির স্থায় তাহার হৃদয়কে, তাহার মর্মস্থানকে, তাহার ধর্মনীতিকে আক্রমণ করিতেছে”।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কাছে এই বিষয় মোটেই অস্পষ্ট ছিলো না যে তার সূচনা হয়েছে পাশ্চাত্যের নেশন তন্ত্র বা ন্যাশনালইজম থেকে। ভয়াবহ যুদ্ধের বিভীষিকার এই সময়েই তিনি এই কথাটি বলতে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে। ১৯১৬ সালে জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে তিনি যে সব বক্তৃতা দেন তা প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে Nationalism শিরোনামের গ্রন্থে। এই সব বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিলো একটাই– ন্যাশনালইজমের যে একটি ভয়াবহ রূপ আছে তা তুলে ধরা, এর ভেতরেই যে সভ্যতার অবমাননার, ধ্বংসের বীজ আছে সেই বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করাই ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য। এই গ্রন্থে আছে তিনটি নিবন্ধ– Nationalism in the West, Nationalism in Japan, Nationalism in India। তৃতীয় লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করার সময়েই লেখা।

এই শতকের শুরু থেকে নেশনতন্ত্র বিষয়ে তিনি যে সব হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর সমন্বিত রূপ হচ্ছে তাঁর এই নিবন্ধগুলো। তাঁর এই সব লেখায় তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিবাচক দিক বা অবদানকে অস্বীকার করলেন না, কিন্ত সুস্পষ্টভাবেই বললেন যে ইউরোপের মহত্ব যেমন আছে তেমনি আছে তাঁর ক্ষুদ্রতা – ‘Europe is supremely good in her beneficence where her face is turned to all humanity; and Europe is supremely evil in her malefic aspect where her face is turned only upon her own interest, using all her power of greatness for ends which are against the infinite and the eternal in Man.’

কিন্ত তাঁর প্রধান বক্তব্যই হল ন্যাশনালইজমের বিরুদ্ধে। তিনি বললেন, “The Nation, with all its paraphernalia of power and prosperity, its flags and pious hymns, its blasphemous prayers, in the churches and its literary mock thunders of its patriotic bragging, cannot hide the fact the Nation is the greatest evil of the Nation, that all of its precautions are against it… its one wish is to trade on the feebleness of the rest of the world.” যুদ্ধের দিকে অঙ্গুলি সংকটে করে তাঁর বক্তব্য ছিলো –This European war of Nations is the war of retribution. Man, the person, must protest for his very life against the heaping up of things where there should be the heart, and systems and policies where there should flow living human relationship. The time has come when, for the sake of the whole outraged world, Europe should fully know in her own person the terrible absurdity of the thing called the Nation. … The Nation has thriven long upon mutilated humanity.”

ভারতে ন্যাশনালইজমের প্রসঙ্গ আলোচনায় তিনি একে ভয়াবহ বলেই চিহ্নিত করলেন – “Nationalism is a great menace, it is the particular thing which for years has been at the bottom of India’s troubles. And in as much as we have been ruled and dominated by a nation that is strictly political in its attitude, we have tried to develop within ourselves, despite our inheritance from the past, a belief in our eventual political destiny.” রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে তাঁর এই বক্তব্য কোনো বিশেষ জাতির বিরুদ্ধে নয়, বরঞ্চ জাতির ধারণার বিরুদ্ধেই – “I am not against one nation in particular, but against the general idea of all nations.”

রবীন্দ্রনাথ নেশন এবং ন্যাশনালইজম বা জাতীয়তাবাদের যে অন্ধত্বের কথা বলেন সেখানে এই সব ধারণা এবং আদর্শ একটি দেশের ভেতরেই কীভাবে বিভক্তি এবং অসহিষ্ণুতার জন্ম দিতে পারে তার ইঙ্গিত থাকলেও তা বিস্তারিত ভাবে আলোচিত নয়। কিন্ত যদি নেশন এবং জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের মর্মবাণী আমরা উপলব্ধি করতে পারি তবে সেটা বুঝতে অপারগ হবারও কোনো কারণ নেই।

আজকের দিনে, সারা বিশ্বেই যখন উগ্র জাতীয়তাবাদের লেলিহান শিখার বিস্তার দেখতে পাই, যখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে – ভারতে, বাংলাদেশে, শ্রীলংকায় – আমরা দেখতে পাই নেশনের নামে, জাতীয়তাবাদের নামে এমন সব শক্তির উত্থান ঘটছে যা মানবিক মর্যাদাকে পদদলিত করছে সেই সময়ে আমাদের এই বিষয়ে কেবল উপলব্ধি করাই যথেষ্ট নয়। আমাদের করণীয় কী তাও রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই জানতে পারি ‘for the sake of humanity we must stand up and give warning to all, that this nationalism is a cruel epidemic of evil that is sweeping over the human world of the present age, eating into its moral vitality.’

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, এক শতাব্দী পরে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে তা আমাদের স্মরণ করা দরকার, আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা সেইখানেই।

সম্পাদকীয় নোট: হৃদবাংলা: বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ ২০১৯ স্মারক সংকলনে প্রথমে প্রকাশিত।

আলী রীয়াজ

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুয়িশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক সেন্টারের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো। ২০১৩ সালে তিনি উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস-এ পাবলিক পলিসি স্কলার হিসেবে কাজ করেছেন। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্টিতে যোগ দেবার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটেনের লিংকন বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাফলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন (১৯৯৫-২০০০)। অধ্যাপক রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি (১৯৯৩)। আলী রীয়াজের জন্ম ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় তিনি একাধিকবার ডাকসু’র সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশনা হচ্ছে– ‘ইলেকশন ইন এ হাইব্রিড রেজিম: এক্সপ্লেইনিং দ্য ২০১৮ বাংলাদেশি ইলেকশন’ (২০১৯)। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো– লিভড ইসলাম অ্যান্ড ইসলামইজম ইন বাংলাদেশ (২০১৭); বাংলাদেশ: এ পলিটক্যাল হিস্ট্রি সিন্স ইন্ডিপেন্ডেন্স (২০১৬); হাও ডিড উই অ্যারাইভ হেয়ার (২০১৫), ইসলাম অ্যান্ড আইডেনটিটি পলিটিক্স অ্যামং ব্রিটিশ বাংলাদেশিজ : আ লিপ অব ফেইথ (২০১৩); ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ অ্যাবাউট বাংলাদেশি পলিটিক্স (২০১২); ফেইথফুল এডুকেশন: মাদ্রাসাজ ইন সাউথ এশিয়া (২০০৮); গড উইলিং: দ্য পলিটিক্স অব ইসলামিজম ইন বাংলাদেশ (২০০৪)। ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০১৪) এবং বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর সংকট (১৯৯৩) বই দুটি বিপুল সমাদৃত।