সেলিম রেজা নিউটন
অপরাধী মাত্রই তাকে আর মানুষ নয়, গণ্য করা হয় আত্মাহীন হিংসাত্মক প্রাণীতে, যাকে বন্দী না করলে সমাজ সহিংসা আক্রান্ত হবে! আর তাই কারাগার-বন্দিশালা-কয়েদখানা হয়ে ওঠে অবিসম্ভাবী। ‘আইন’ ‘বিচার’ ‘দণ্ড’ সমস্তটাই তৈরি হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বর মাধ্যমে। সার্বভৌম ক্ষমতা মাত্রই ত্রাসের মনোপলি। সাধারণ সংকল্পর নামে বিশেষাধিকার প্রাপ্তদের সংকল্প এবং সংঘবদ্ধ প্রতিহিংসা হলো এই সার্বভৌমত্ব— রাষ্ট্রক্ষমতার আত্মা! তাই যাবতীয় আইন, যাবতীয় বিচার, যাবতীয় দণ্ড বিশেষাধিকারের স্বার্থে।
আদতে বিশেষাধিকার টিকে থাকে ‘ভয়ে’। দণ্ড সেই ভয়। কারাগার সেই ভয়। কারাগার প্রথমেই ছিনিয়ে নেই আপনার আব্রু। আপনার শরীরের একান্তকে। শনাক্ত করা হয় আপনার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সুরাতহালের পরই সমস্ত আপনীয়তা ও তার বোধকে নিশ্চিহ্ন করে আপনার উপরে আরোপ হয় নজরদারি। আপনি হয়ে ওঠেন পাপপরায়ণ একটি বস্তু! এমন বস্তু যাকে পরিণত করতে হবে দণ্ডনীতির অনুসরণকারী যন্ত্রমানবে। আপনাকে হতে হবে সংঘবদ্ধ প্রতিহিংসার দাস! দাসত্ব একটি নিয়মিত কারা- শৃঙ্খলা।
২০০৭ সালে সেনা-কর্তৃত্বের জরুরি জমানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হওয়ার দায়ে সেলিম রেজা নিউটন কারাবন্দী হন। মুক্তির পর কারাগার নিয়ে তিনি একগুচ্ছ প্রবন্ধ রচনা করেন। বিড়ালের জেলখানা তার মধ্যে অন্যতম। রচনাটি ২০০৮ সালের, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা। প্রথম প্রকাশ হয় প্রবাসী বাঙালিদের লন্ডনভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা ইউকেবেঙ্গলি তে। ৪ঠা মে ২০০৮ সালে। পরে রচনাটি লেখকের অচেনা দাগ গ্রন্ত্রে সংকলিত হয়েছে। বর্তমান সংস্করণটি সেখান থেকেই নেয়া। -সম্পাদক
জেলখানার জেনেসিস
মানুষের জন্য প্রথম যখন জেলখানা বানানো হলো, কোনো লোক সেই জেলে যেতে চাইলো না। জেলের কর্তারা তখন পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন, মানুষ আদৌ ঐ জেলের ভেতরে থাকতে পারবে কিনা। কুকুরকে বলা হলো কয়েদখানার ভেতরে যেতে। কুকুর রাজি হয় না। তখন ভেতরে মাংশ, হাড় ইত্যাদি অনেক ভালো ভালো খাবার রেখে আসা হলো। এবার প্রধান ফটক খুলে দেওয়া হলো, আর কুকুরকে আবার অনুরোধ করা হলো। কুকুরেরা ঢুকল। আয়েশ করে খাবার-দাবার খেল, গোটা জেল ঘুরে-ফিরে দেখল, তারপর সোজা গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। রাজি হলো না থাকতে তারা জেলের ভেতরে। কিন্তু হাল ছাড়লেন না কারা-কর্তৃপক্ষ। এবার পাঠানো হলো বিড়ালদেরকে, আর ভেতরে রাখা হলো মাছ, দুধ ইত্যাদি প্রভৃতি। বিড়ালেরা ঢুকল, খাওয়াদাওয়া করল, এবং থেকে গেল জেলেরই ভেতরে। উল্লসিত কয়েদ-কর্তারা: বিড়াল যখন থেকে গেল, মানুষও পারবে।
কয়েদির হাসি ও হেঁয়ালি
আশ্বিনের আকাশ-ভর্তি উজ্জ্বল আলোর মতো হাসিভরা মুখ নিয়ে এই গল্প আমাদেরকে বলল আলমগীর। আলমগীর ওরফে জাহাঙ্গীর, পিতা: জাকির হোসেন, কয়েদি নম্বর: ৯৩১৯, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি কয়েদির হাসি। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি কয়েদির টুপিতে জ্বলজ্বলে লাল-নীল সুতা দিয়ে ফুল-তোলার মতো করে আঁকানো চারটা সংখ্যা ৯৩১৯, আলমগীরের নিজের হাতে করা কারুকাজ, যে হাত দিয়ে এলজি বহন করার দায়ে আজ ১২ বছর হলো সে কারাগারের রাক্ষসপুরীতে ঘানি টানছে, টানতে হবে আরও কয়েক বছর। কৌতূহল আর জিজ্ঞাসার সিরিয়াস একটা দ্রবণে আমার চেহারা ভিজিয়ে আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, বিড়াল পারলে মানুষও পারবে, এর মানে কী আলমগীর? আলমগীর হাসে। হেঁয়ালি-ভরা, আকাশ-ভরা হাসি। ওর কাছে, ওর অভিজ্ঞতার কাছে, ওর গল্প-সত্তার কাছে নিজেকে আমার নিছক একটা খেলনা বলে মনে হলো। পরে অনেক জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু সেই নিরুত্তর হাসি।
নিজে আমি ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি। পোষ-মানা বিড়াল হচ্ছে সেই প্রাণী, যাকে আপনি যতই মারেন যতই ধরেন সে আপনার বাসায় আবার ফিরে আসবে। শারীরিক নিগ্রহ সহ্য করার ক্ষেত্রে বিড়ালের তুলনা মেলা কঠিন। পাঁচ-তলার ছাদ থেকে মাটিতে ফেলে দেন, উঠে একটু গা-ঝাড়া দিয়ে হেঁটে চলে যাবে। অতিশয় শক্ত জান বিড়ালের। আবার, গল্পটা হয়ত এ-কথাও বলতে চাইছে যে জেলখানা নামক ধারণাটার আড়ালে আছে এই মনোভাব যে: মানুষ হচ্ছে কুকুর-বিড়ালের মতোই আরেকটা জন্তু মাত্র। গল্পটার মধ্যে কি এই আভাসও আছে যে জেলের বন্দিত্ব আর নিগ্রহ সহ্য করতে গেলে বিড়ালের মতো ‘অমানবিক’ জীবনের অধিকারী হতে হবে? নাকি ইশারাটা এই যে, জেলে পুরে রাখতে পারলে মানুষ পরিণত হবে বিড়ালে? আমি থৈ পাই না।
বিড়ালের স্বাধীনতা, মানুষের দাসত্ব
কারণ যা-ই হোক, কারাগারে কুকুর দেখি নি। একটাও না। কিন্তু বিড়াল আছে, ছানাপোনা সংসার-সহকারে আছে। বিশাল জানালার লোহার গরাদে গাল রেখে ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি বিড়ালের মা তার সন্তানকে শেখাচ্ছে কেমন করে লাফ দিয়ে আক্রমণ করতে হয়, কেমন করে আত্মরক্ষা করতে হয়, কেমন ক্ষিপ্রতার সাথে থাবা আর দাঁতের ব্যবহার করতে হয়। দেখেছি মধ্যরাতে সন্তানের জন্য খাবার খুঁজতে লক-আপের লোহার ফাঁক গলে আমাদের ওয়ার্ডে ঢুকছে বিড়ালের মা। দেহধারণের জন্য ক্ষুধা-নিবারণ, আর নিজের সিদ্ধান্তে চলার জন্য আত্মরক্ষা-আক্রমণ: বিড়াল তাঁর প্রকৃত প্রজাতি-সত্তা এতটুকু বিসর্জন দেয় নি।
সামান্য বিড়ালকেও তার স্বাধীন স্বভাব থেকে বশীভূত করতে পারে না জেলখানা। অথচ কয়েদ আছে মানুষকে পরাভূত-বশীভূত করার খায়েশে। আল্লাহ – চাইলে আপনি মা-প্রকৃতিও বলতে পারেন – মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জন্মসূত্রে স্বাধীন সত্তা হিসেবে। আর সেই কবে থেকে সমস্ত মানুষকে অল্প কিছু মানুষের দাস বানানোর জন্য শারীরিক ও মানসিক বলপ্রয়োগের একগাদা সশস্ত্র প্রতিষ্ঠান খুলে বসে আছে কতিপয় লোক। নিজেদেরকে এরা বলে কর্তৃপক্ষ, আমি বলি ইবলিস। কর্তৃত্ব-কর্তৃপক্ষ-ইবলিস চায় মানুষ তার গোলামি করবে। আল্লাহ চান মানুষ স্বাধীনভাবে মোমিন মানুষ হয়ে উঠবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তাই মোমিনের ঈমানের অঙ্গ। অস্ত্র আর শাস্ত্রের জোরে মানুষকে ইবলিসের দাসে পরিণত করার প্রচেষ্টার ইতিহাস হচ্ছে কারাগারের ইতিহাস।
প্রত্যেক কারাগারই আদিতম কারাগার
বিড়ালের গল্পটার উৎপত্তি চট্টগ্রাম জেলে। চট্টগ্রামের জেলখানাটা বানানোর সময়ই ঐ কুকুর-বিড়াল পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়েছিল বলে গল্পে প্রকাশ। গল্পের পেটের মধ্যে এই ইঙ্গিতও আছে বলে আমার বিশ্বাস। সেটা হলো, তুমি যে জেলখানায় বন্দি ঐটাই পৃথিবীর আদিতম এবং একমাত্র জেল। এর আগে অতীতে কোনো জেলখানা ছিল কিনা, কিংবা বর্তমানে আর-কোথাও কোনো জেলখানা আছে কিনা তাতে তোমার কী আসে-যায়? বন্দির বিবেচ্য হচ্ছে বন্দিত্ব। বন্দির বিবেচ্য হচ্ছে স্বাধীনতা। তো, আলমগীর পৃথিবীর ঐ প্রথম জেলখানার লোক – চট্টগ্রামেরই ছেলে। পাহাড়ে সুড়সুড়ি খেয়ে নামতে নামতে, আর সমুদ্রে সুতা-বাঁধা বয়া ধরে দূর নীলে ভাসতে ভাসতে শৈশব পার করেছে সে। তারপর কৈশোর ঠিক মতো পেরিয়েছে কি পেরোয় নি, অভাবের ধাওয়া খেয়ে জেলে ঢুকেছিল নব-তরুণ। সাত সমুদ্র তের জেল ঘুরেফিরে চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই এখন সে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেল বিষয়ে তাঁর মতো বিশেষজ্ঞ কমই আছে।
নির্যাতনের জাদুঘর
আলমগীরই প্রথম জানালো, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার আদতে বৃটিশের তৈরি করা ‘সাঁওতাল পানিশমেন্ট জেল’। আস্তে-ধীরে বিভিন্ন কয়েদি এবং ‘বাবু’র কাছ থেকে জানা গেল আরও নানা তথ্য। (সবচেয়ে কম বেতনভোগী গরিব কারাকর্মচারী ও কারারক্ষীদেরকে কয়েদিরা বলেন ‘বাবু’।) সাঁওতালদের বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষত তাঁদেরই শায়েস্তা করার জন্য ১৮৪০ সালে এই কারাগারের পত্তন ঘটায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুরা।
এই সুসভ্য প্রভুরা বন্দিদেরকে নির্যাতনের জন্য বানায় ভয়ঙ্কর সব সেল আর অন্য-সব ব্যবস্থা। যেমন অন্ধকার নির্জন কবর-সেল: তাতে কোনো মতে শ্বাস নেওয়ার জন্যে সামান্য একটি বাঁকানো পাইপের আউটলেট, যেন বন্দিকে বোঝানো যায় কবরের আজাব বলে কাকে। এখনও আছে এই সেল, প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে। অব্যবহৃত। ঢোকার দরজা মাটি দিয়ে ভরাট করে বন্ধ করে-দেওয়া। ছিল জোঁক-সেল, তাতে কখনো জোঁক কখনো শিং মাছ রাখা হতো কয়েদিদেরকে বিশেষ শিক্ষা দেওয়ার জন্য। ছিল ঘনকের আকৃতিসম্পন্ন কিউবিক্যাল সেল: এত ছোট, ঘাড় তুলে যেন কেউ দাঁড়াতে না পারে। এখনও আছে কণ্টক-সেল: মাথার ওপরে আর ডানে-বাঁয়ের দেয়ালে শত শত লোহার কাঁটা, পেরেক বা গজালের মতো, তারই মধ্যে এক চিলতে জায়গা, কোনো মতে শোয়া যায়, সামান্য নড়া-চড়া করতে গেলেও গা রক্তাক্ত হবে। এই কাঁটা-সেলগুলো এমডি’র ভেতরে (ম্যানুফ্যাকচারিং ডিপার্টমেন্ট), অব্যবহৃত, দরজাগুলো সিল করে দেওয়া। ছিল যিশু খ্রিষ্টের ক্রসের মতো করে হাত দুই দিকে ছড়িয়ে বেঁধে মনের সুখ মিটিয়ে চাবুক মারার জন্য হুইপ স্ট্যান্ড। সেই স্ট্যান্ড এখনও আছে, এখন আর চাবুক মারা হয় না। দেড়শো বছর আগের সবচাইতে ‘সভ্য’দের এই ছিল বন্দির প্রতি আচরণ। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার এ-রকম ‘ঐতিহ্য’বাহী কারাগার: নির্যাতনের জীবন্ত জাদুঘর।
নির্যাতন এখনও আছে। মাত্রা সংকুচিত হয়েছে, ধারা বদলেছে। কিন্তু নির্যাতন আছে। আছে শীতের কামড়। বাঘ-পালানো মাঘের শীতেও, জেলের দরজা আর দরজার সমান জানালাগুলো থাকে খোলা। সারা সারা রাত ধরে। বিশাল একেকটা ওয়ার্ড। চার দেয়ালের কোনোটাতেই দরজা-জানালার অভাব নাই। হু হু করে হিম ঢুকছে। এদিক দিয়ে ঢুকছে, ওদিক দিয়ে বেরুচ্ছে। জমে যাচ্ছে মানুষের বাচ্চারা। গায়ে শুধু একটা কম্বল: পাতলা, ছেঁড়াখোঁড়া, পুরানা, ধ্যাড়ধ্যাড়া। এসব বন্দির অনেকে শিশু, অনেকে বৃদ্ধ। গরমের দিনে এই অবস্থাটাই বিপরীত আকার ধারণ করে: পদ্মার চর পেরুনো গরম লু হাওয়ার হাহাকার ঢোকে বিরাট উদোম জানলা-দরজা দিয়ে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুমাতে বাধ্য হওয়া কয়েদিদেরকে নিয়ে একেকটা ওয়ার্ড পরিণত হয় গরম গ্যাসচেম্বারে।
আছে পিঁপড়ার কামড়। প্রায় তিন-তলা দালানের সমান উঁচু এত্তো বড় বকুলগাছের গোড়ার দিককার মূল কাণ্ডে লোহার কড়া পোঁতা আছে। তাতে হাত বেঁধে বিষ পিঁপড়ার কামড় খাওয়ানো হয় এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা তিন ঘণ্টা। গাছের গোড়ায় মাটিতে অনেক পিঁপড়ার বাসা। কয়েদির গায়ে মেখে দেওয়া হয়েছে গুড়। খুঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে বাসা। লাইন ধরে পিঁপড়া বেরুচ্ছে। শত শত পিঁপড়া। উঠে যাচ্ছে কয়েদির গায়ে, কামড়াচ্ছে। প্রসিদ্ধ ঐ বকুলতলার বকুল ছাড়াও গাছ আরও আছে। আছে মাথার ওপর গাছের ডালের সাথে উঁচু করে হাত বেঁধে একদিন দুই দিন তিন দিন দাঁড় করিয়ে রেখে দেওয়া, ঐ অবস্থায় পেটানো। এগুলো খুব বিরল না। (কোর্টে এক নাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে থেকে সামান্য আন্দাজ পেয়েছিলাম দাঁড়িয়ে থাকার সুখ।) আছে দিনের পর দিন লোহার ডাণ্ডাবেড়ি: নানান ভঙ্গিতে, যেন ঠিকমতো হাঁটতে না পারে, যেন দরকারেও নিচু হতে না পারে, সারাক্ষণ পিঠ বাঁকা করে থাকতে হয়, সোজা হতে না পারে, ইয়ত্তা নাই।
আর ‘কেস টেবিলে’ লাঠিপেটা তো আছেই। একজন কয়েদিকে কয়েকজন ‘দাঙ্গা’ মিলে রীতিমতো লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, তবু সে কয়েদি জেল-কর্তাদেরকে চোখে চোখ রেখে ব্যঙ্গ করে হিন্দি গান গেয়ে নেচে চলেছেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে। ‘বি-ক্লাস’ কয়েদি এঁরা, দ্বিতীয় শ্রেণীর কয়েদি। প্রকৃতপক্ষে, এঁরাই মানবপ্রজাতির স্বাধীন আত্মা-পরম্পরার সবচাইতে উৎকৃষ্ট প্রতিনিধি। নিরীহ ও ভদ্রভাবে বন্দিত্বকে মেনে নেন না এঁরা। কিছুতেই বশ মানানো যায় না এঁদের। স্বাধীন মানুষকে সকলেই সমীহ করতে বাধ্য হয়। জেল-কর্তৃপক্ষও সমীহ করেন এঁদেরকে, সহজে ঘাঁটান না। আমাদের আলমগীর এঁদেরই এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি।
স্বাধীনতার দিন গণনা, নিরন্তর পাপচক্র
নির্যাতনের এসব ঘটনা প্রত্যেক দিন ঘটে না। ঢালাওভাবে ঘটে না। সেই বৃটিশ আমল আর নাই। তবু এখনও ঘটে নির্যাতন। কম ঘটে, কিন্তু প্রায়শই ঘটে। কোনো কয়েদি বা বাবু-জমাদার অন্য কোনো কয়েদির নামে ‘রিপোর্ট’ দিলে, মানে অভিযোগ দাখিল করলে, কেস টেবিলে তাৎক্ষণিক-বিচারসভা বসে। জেল-কর্তারা সেখানে সাক্ষী-সাবুদ দেখে রায় দেন। অভিযুক্তরা সুবিচারও পান বটে, তবে প্রায়-সমস্ত ক্ষেত্রেই পান শাস্তি। শাস্তি মানে এই সব শারীরিক নির্যাতনমূলক ব্যবস্থাগুলোর কোনো একটা। আবার, শাস্তি বলতে হতে পারে ‘রেমিশন’ বা ‘রেয়াত’ কাটা যাওয়া। প্রায় সকলেরই তো সশ্রম কারাদণ্ড। কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকের শ্রম বা কাজ ঠিক করে দেন, ‘কাজ-পাশ’ করে দেন। সেই কাজের প্রকৃতি অনুসারে কয়েদিরা প্রতি তিন মাস কারাদণ্ড থেকে নির্দিষ্ট হারে – ২০ দিন ২১ দিন ২২ দিন ইত্যাদি – রেয়াত পান, ফলে তার মোট সাজা কমে আসে।
অত্যন্ত বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া এর চেয়ে বড় শাস্তি কয়েদির কাছে আর কিছু নাই। ধরেন, এক বছর জেল খেটে আপনি তিন মাস ‘রেয়াত’ অর্জন করেছেন, এখন শাস্তি হলো তার থেকে এক মাস ‘রেয়াত’ ছেঁটে দেওয়া, এ খুব হৃদয়বিদারক শাস্তি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক শাস্তির চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর। তিল তিল করে দেওয়া তাঁর অমানুষিক শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত রেয়াত বাদ গেল। এখন তাঁকে আরও বেশি জেল খাটতে হবে, আরও বেশি শ্রম দিতে হবে।
একটা দিন বেশি জেল খাটা আর একটা দিন কম জেল খাটার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে যে: স্বাধীন মানুষের সাথে বন্দির যে তফাৎ। ‘রেয়াত’ কাটা যাওয়াটাকেই তাই কয়েদিদের ভয় বেশি। সেটা কর্তৃপক্ষও জানেন, ফলে তাঁরা শারীরিক শাস্তির চেয়ে রেয়াত কাটার সিদ্ধান্ত নিতেই পছন্দ করেন বেশি। যে কর্তা ব্যক্তিগতভাবে বদ তিনি শারীরিক নিগ্রহে আনন্দ পান। আর যিনি বিচক্ষণ-দয়ালু তিনি রেয়াত কাটেন। আবার মতান্তরে, যে কর্তা রেয়াত কাটেন তিনিই নিষ্ঠুর বেশি। শাস্তির বৈচিত্র্য আর মাত্রার হেরফেরের আর মানুষের দয়ার আর নিষ্ঠুরতার প্রকারভেদের এ-এক নিরন্তর পাপচক্র।
বন্দিত্ব প্রাকৃতিক নয়, দাসপ্রথা ঐশ্বরিক নয়
স্বেচ্ছায় ঢুকেছিল বিড়াল কারাগারের পাপচক্রে, শুধু একটু খাওয়ার তাগিদে, বাঁচার আশায়। অথচ প্রকৃতিতে জেলখানা নাই। বিড়াল অথবা বাঘের জন্য কোনো বন্দিশালা নাই বনানীতে। ক্যাঙ্গারুর জন্য কোনো কারাগার কুঞ্জবনে নাই। পাখিদের জন্য প্রিজন নাই। গরুদের জন্য নাই গরাদের বন্দোবস্ত। কুকুরের জন্য কোনো কয়েদের কারবার নাই। ক্ষুধা লাগলে একটা প্রাণী অন্য প্রাণীকে শিকার করে খায় ঠিকই, কিন্তু বন্দি করে রাখে না। খাঁচায়, খোঁয়াড়ে কিংবা চিড়িয়াখানায় অন্য প্রাণীকে বন্দি করে রাখার ব্যবস্থা প্রাকৃতিক নয়। আদিতে মানুষের জন্যেও কোনো জেলখানা ছিল না। মানুষের জন্য খোদা বানিয়েছেন পাহাড়, নদী আর আকাশ। মানুষের জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, সৃজনশীলতা এবং স্বাধীনতা। সৃজন করেছেন মানুষকে তিনি জন্মসূত্রে স্বাধীন হিসেবে। মানুষের জন্য তিনি সৃষ্টি করেন নি কারাগার। মানুষের জন্য তিনি সৃষ্টি করেন নি দাসপ্রথা।