অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহিন
ভূমিকা
দুনিয়ার জমিনে কোনো ঘটনা বা দূর্যোগ হঠাৎ করে নাজিল হয় না। এর পেছনে আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রভাবকের পরিপ্রেক্ষিতেই সেই ঘটনার বা দূর্যোগের জমিন নির্মাণ হয়। তাই, গাছের রোগ ধরতে ডালপালার আগে এর গোড়ায় সংঘটিত কার্য-কারণের খোঁজ করা বাঞ্চনীয়। অন্যথায়, বালতির পর বালতি পানি ঢেলেও গাছের কাজে আসবে না। এরকমই এক দূর্যোগের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্ব যাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের এরকম বিশ্রীভাবে প্রাদুর্ভাবের পেছনে নিশ্চিতভাবে কোনো নির্দিষ্ট একটি কারণ জড়িত না। এর পেছনে রয়েছে বিশ্বের আর্থ-সামাজিক-ভৌগোলিক প্রভাবক যেগুলোর পেছনে দায়ী খোদ মানুষই।
ডাক্তার-বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভাইরাসটির সাথে তারা পরিচিত কিন্ত বর্তমানে যে রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে তা মিউটেটেড হওয়া ফল। তো এই মিঊটেশন হওয়া এবং এর মহামারি আকার ধারণ করার কার্য-কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমারিকার ওয়াশিংটনভিত্তিক Time পত্রিকায় জাস্টিন ওরল্যান্ড The Wuhan Coronavirus, Climate Change, and Future Epidemic শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। যেটার ভাষান্তর বর্তমান রূপটি।
প্রবন্ধটিতে ওরল্যান্ড বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া রোগ-মহামারির পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভূমিকা আছে তা দেখান। তিনি দেখান কীভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে রোগ ছড়াতে দিন দিন সক্ষমতা দান করছে আর অন্যদিকে মানুষ সেটার শিকার হচ্ছে। লেখাটিতে পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিশ্বায়ন প্রকল্পের ফলে প্রাণিকুলের, বিশেষ করে মানুষের অন্তিম বিপর্যয়ের এবং এমনকি গভীরভাবে চিন্তা করলে, অস্তিত্ব সংকটের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে, বিস্তারিতভাবে এখানে তেমন কিছু বলা না হলেও ওরল্যান্ড ইশারায় বর্তমানে অসহায় হয়ে থাকা পৃথিবীর মানুষদের তাদের নিজেদের দ্বারা তৈরি বিষাক্ত জলবায়ুর ও তৎসংশ্লিষ্ট কয়েকটা বিষয়ে পাঠককে ভাবার খোরাক দেন।
মূল প্রবন্ধ
গত কয়েক সপ্তাহ যাবত এক আচানক কিসিমের করোনা-ভাইরাস খবরের কাগজের মূল শিরোনামগুলো দখল করে রেখেছে। একই সাথে এর দ্রুত প্রাদুর্ভাবপ্রবণ ও বেয়াড়া চরিত্র জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাদের বেশ নড়েচড়েই বসতে বাধ্য করছে। কিন্তু সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক বিজ্ঞানীদের কাছে এটা আদৌ নতুন কিছু না, অন্যান্য ব্যাধি-সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলোর মত এটিও একটা, যা দূর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরির সক্ষমতা রাখে।
এটা দাবি করার মত কোনো দলিল আমার কাছে নেই যে, ঠিক এই সময়েই এই বিশেষ ভাইরাসটি জন্তুর শরীর থেকে মানব শরীরে সংক্রমিত হওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা রয়েছে অথবা এটাও দেখাতে পারব না যে, পৃথিবীর উষ্ণতা এই সংক্রমণ বাড়তে সহায়তা করছে। সামগ্রিকভাবে দেখলে এটা যথেষ্ট পরিষ্কার যে, আগামীতে ভাইরাস বা অন্যান্য ব্যাধি-সৃষ্টিকারী জীবাণুর কারণে ছড়ানো মহামারিতে জলবায়ু-পরিবর্তন একপ্রকার আগুনে ঘি ঢালার কাজ করবে। যুগ-যুগ ধরেই বিজ্ঞানীগণ অনুধাবন করে আসছেন যে, জলবায়ু-পরিবর্তন রোগ ছড়ানোর ধরন/প্রণালী বদলে দিবে। কিন্তু এদিকে পৃথিবী যত উষ্ণতর হচ্ছে সেই হাইপোথিসিগুলো পরীক্ষিত হচ্ছে এবং তাঁরা সেইসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার মাধ্যমে হাতে কলমে শিক্ষা নিচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও সংক্রামক রোগ-বালাইয়ের মধ্যে অনেক ধরনের যোগসূত্র বিদ্যমান। কিন্তু কীভাবে পৃথিবীর বাড়ন্ত তাপমাত্রা আমাদের শরীরের স্বাভাবিক ইমিয়্যুন সিস্টেমের কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে, বিশেষভাবে, দেখার সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং একই সাথে এই সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপর আমি এখন আলোকপাত করতে যাচ্ছি।
আমাদের মানব শরীর এক আজব কিসিমের রোগ-প্রতিরোধকারী মেশিন। একবার অভিযোজিত হয়ে গেলে তা অনেকদিন পর্যন্ত রোগ-জীবাণু ঠেকিয়ে রাখতে পারে। আমাদের শরীরের উষ্ণ তাপমাত্রা রোগ-জীবাণুর সর্বপ্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণ আপনাআপনিই ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম। যখন কোনো রোগ-জীবাণু আমাদের দেহে প্রবেশ করে, তখন প্রায়ই আমরা জ্বর অনুভব করি, রোগের সাথে লড়াই করতে আমাদের শরীর বরং তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। জ্বর শরীরের ইমিয়্যুন সিস্টেমকে চাঙ্গা করে দেয় এবং আদর্শগতভাবে সেই তাপমাত্রা শরীরে এমন একধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে বেঁচে থাকা রোগ-জীবাণুর জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু, প্রাকৃতিক পরিবেশে যেহেতু রোগ-জীবাণু ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসছে, সেগুলো মানব শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় টিকে থাকাতে সামর্থ্যবান হয়ে যায়। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিয়্যুনোলজির অধ্যাপক আর্ট্রুটো ক্যাসাডিভাল সতর্ক করেন, “যতবার আমরা অত্যাধিক গরম সময় পার করি, ততোবারই আমাদের শরীরে ‘বাছাই প্রক্রিয়া’ (selection event) সম্পাদিত হয়”। যে রোগ-জীবাণুগুলো বেঁচে যায় এবং বংশবৃদ্ধি ঘটায় সেগুলো, একইসাথে আমাদের শরীরের ভেতর থাকা জীবাণুগুলো, উচ্চ তাপমাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। এবং এরই সাথে সাথে আমাদের শরীরের প্রাথমিক রোগ প্রতিরোধের মেকানিজম তার সক্রিয়তা হারায়।
এটা কোনো তাত্ত্বিক আলাপ নয় বরং ভাববার বিষয়। গতবছর ক্যাসাডিভাল ও তাঁর সহকর্মীরা mBio নামক জার্নালে দেখান যে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কীভাবে Candida auris (একধরনের ছত্রাক যা রক্তের মিশে গিয়ে নির্দিষ্ট ধরনের কিছু রোগ সৃষ্টি করে) একইসাথে দক্ষিণ এশিয়া, ভেনিজুয়েলা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মত তিন ভিন্ন ভিন্ন জায়গার রোগীদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল। আমাদের এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায় যারা উড়োজাহাজে চড়ে একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করেন তাদের মাধ্যমে প্রায়ই রোগ-বালাই ছড়ায় [বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ এর জ্বলন্ত উদাহরণ ]। কিন্তু এটার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, এই প্রত্যেক জায়গাতে প্রায় একই রকমের পরিবর্তনশীল জলবায়ুগত অবস্থার কারণে ছত্রাকটি একইভাবে বিবর্তিত ও বিকশিত হয়েছে। ক্যাসাডিভাল হুশিয়ারি দেন, এই প্রভাব কতটা বিস্তৃত হবে সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এই বিস্তার শুধুমাত্র Candida auris এর মত ছত্রাকেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
করোনা-ভাইরাস এখন যেই রূপে ছড়াচ্ছে তা নানান কারণে Candida থেকে ভিন্ন কিন্তু এটির বাহকও প্রাণি–বাদুড়। সংক্রামক রোগ ছড়ানোর সাথে তাপমাত্রার কি সম্পর্ক তা বুঝার জন্য বাদুড় একটা কৌতূহলোদ্দীক উদাহরণ হতে পারে। মানুষের মত বাদুড়ও স্তন্যপায়ী প্রাণি, যারা রোগ প্রতিরোধের জন্য শরীরের উষ্ণ তাপমাত্রা বজায় রাখে। কিন্তু যেখানে আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকে ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং অসুস্থ হলে যা মাত্র কয়েক ডিগ্রি বাড়ে, সেখানে বাদুড়ের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থাতেই ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত যেতে পারে। তার মানে এটা দাঁড়ায় যে, তারা নিজেরা আক্রান্ত না হয়েও অনায়াসে বিপুল সংখ্যক রোগ-জীবাণু বয়ে বেড়াতে পারে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে অদূর ভবিষ্যতে বাদুড় তাদের শরীরের তাপমাত্রার বদৌলতে সুরক্ষিত থেকে যাবে, অন্যদিকে তাদেরই বহন করা রোগ-জীবাণু আমাদের আক্রমণ করতে আরও বেশি সক্ষম হবে।
যুগ যুগ ধরেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে আসছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন গণস্বাস্থ্যের উপর ভালোরকমই প্রভাব ফেলবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৯২ সালে ন্যাশনাল একাডেমি অফ সাইন্সেস থেকে প্রকাশিত এক রিপোর্ট বেশ কিছু পথ বাতলে দেয় যেগুলোর মাধ্যমে জলবায়ু-পরিবর্তন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবকে উস্কে দিবে এবং একইসাথে রিপোর্টটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্সের অভাবকে “উদ্বেগজনক” (disturbing) হিসেবে দেখায়। ৪ বছর পর জার্নাল অফ আমারিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের বহুল পঠিত ও উদাহৃত (a widely-cited-paper) একটি গবেষণাপত্রে সতর্ক করে বলা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তন অপুষ্টি থেকে ম্যালেরিয়া সবধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি ঘটাতে পারে এবং এটা ঠেকাতে ডাক্তার, জলবায়ু গবেষক এবং সমাজ বিজ্ঞানীদের সমন্বিত গবেষণাকার্যের জন্য আহ্বান করা হয়। একই বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একই বিষয়ের উপর ৩০০ পৃষ্ঠার এক ঢাউস রচনা বের করে, যেখানে জলবায়ু ও স্বাস্থ্যের মধ্যে ওতোপ্রোত সম্পর্কের উপর দৃষ্টিপাত করা হয়; এবং একইসাথে এই সম্পর্ককে ‘জটিল ও বহু-প্রভাবকে প্রভাবান্বিত’ (complex and multifactorial) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বর্তমান যুগে জানাশোনায় আমরা অতীতের থেকে এগিয়ে আছি, তবুও অনেক কিছুই আমাদের অজানা রয়ে গেছে। যখন আর্কটিকের জমে থাকা বরফ গলতে থাকবে, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলো পরিবেশে মুক্ত হয়ে মিশে যাবে। সেগুলোর সাথে লড়াই করার সামর্থ্য কি আমাদের আছে? পুরো মানবজাতি, দেশগুলো এবং জীবন প্রবাহের উপর প্রকৃতির খড়গ হস্ত মানুষের মনস্তত্বে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে? বর্তমানে ট্রপিক্সগুলোতে (the tropics)/ক্রান্তিবলয়ে অন্তরীণ হয়ে থাকা রোগবাহী মশাগুলো তাদের সক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে কদ্দুর পর্যন্ত ঘুরাফিরা করবে?
এসব প্রশ্নের সাথে আরও অনেক তথ্য, যা আমরা জানি যে জানি না (known unknown) সেগুলো তালাশ করতে বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে আছেন। কিন্তু একইসাথে সন্দেহাতীতভাবে অনেককিছুই আমরা জানিই না যে অজানা (unkhown unknowns) রয়ে গেছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে এই বিষয়টিই আমার কাছে সবচেয়ে ভীতিকর ঠেকে।