- কল্পনা চাকমা
কল্পনা চাকমার ‘রণাঙ্গনের সারিতে আমরা হবো সৈনিক’ লেখাটি প্রথমে ১৯৯৭ সালের ২০ আগস্ট ‘স্বাধিকার’ এর সাত নম্বর বুলেটিনে এবং পরে হিল ইউমেন্স ফেডারেশনের সম্পাদনায় ২০০১ সালের ১২ জুন ‘কল্পনা চাকমার ডায়রি’তে প্রকাশিত হয়।
পশ্চাৎপদ দেশে, এমন কি অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশেও নারী-পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে বাস্তবতা অনেক বৈষম্য আরো অনেক বেশী। বিশ্বের নারী সমাজ সুদীর্ঘকাল ধরে যে পুরুষ কর্তৃক অনেক নির্যাতীত হয়ে আসছে, বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হয়ে আসছে, সে সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বজুড়ে পশ্চাৎপদ দেশেও সমাজে নারীদের পারিবারিক নিপীড়ন একই রকম। কিন্তু আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীরা বেশী নির্যাতীত। কেননা দীর্ঘকাল ধরে চলছে পাহাড়িদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
এই পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ শ্যামল পাহাড়ের অন্তরালে রয়েছে বুকফাটা আর্তনাদ, গগণবিদারী আর্তচিৎকার। একদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ১০ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠির জাতীয় অস্তিত্ব সংরণের জন্য গণসংগ্রাম এবং অন্যদিকে সেই সংগ্রামকে দমন করার জন্য সামরিক প্রচেষ্টা, যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিনত করেছে এক অগ্নিগর্ভ রণক্ষেত্রে। এখানে উগ্র বারুদ-অত্যাচারে জনজীবন হয়েছে দুর্বিসহ। দীর্ঘ অত্যাচার, নির্যাতন আর যন্ত্রনায় ত-বিত পার্বত্য জনতার আজ বেদনার্ত উচ্চারণ: জীবন আমাদের নয়।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের অপরাপর নারী সমাজের চাইতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের অবস্থা করুণ। এ রূপ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নারীর ভূমিক পালন অত্যন্ত কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। তারপরেও আমাদের অগ্নি পরীক্ষার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। রণাঙ্গনের সারিতে, মুক্তির মিছিলে সামিল হতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নারীরা একদিকে সরকারি, সেনা বাহিনী ও স্থানীয় বেআইনী অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, শ্লীলতাহানী ও চরম লাঞ্চনার শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে তাদেরকে সামাজিক বৈষম্য, গণ্ডিবদ্ধ জীবন যাপন ও পুরনো ধ্যান – ধারণায় নিমজ্জিত করে রাখা হয়েছে।
আসলে পাহাড়িদের আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যতীত পৃথকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের মুক্তি হতে পারে না। কাজেই নারীকে শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু নারী মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। এ মুক্তি পুরুষ ও নারী জাতির একে অপরের মুক্তির সাথে সম্পর্কিত।
তাই নারী ও পুরুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে আতœনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সে জন্য প্রত্যেক জুম্ম (পাহাড়ি) নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে প্রকৃত নারী মুক্তি আন্দোলনে, তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে, অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে স্বাধিকার আন্দোলনে সংগ্রামরত বিভিন্ন সংগঠনের সাড়া দিয়ে পাহাড়ি নারী সমাজ কিছুটা হলেও ঐক্যবদ্ধ। যেহেতু চূড়ান্ত বিজয় এখনো অর্জিত হয়নি, সেহেতু বিজয়ের জন্য আরো বেশী ঐক্যবদ্ধ হওয়া বর্তমান অবস্থায় জরুরী।
আমরা এখনো সামাজিকভাবে, ধর্মীয়ভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত। এ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বৃহত্তর অংশকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। আমরা চাই এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। এক শ্রেণীর মানুষ অন্য শ্রেণীর মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। এক জাতি অন্য জাতির উপর শোষণ – নির্যাতন চালাতে পারবে না। সব মানুষই মানবিক গুনাবলীতে সমৃদ্ধ হবে এবং জীবন – জীবিকাসহ সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। এ ধরণের বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একমাত্র পরিপূর্ণ নারী মুক্তি সম্ভব।
আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, নারীরা সচেতন হবার চেষ্টা করলে অনেক আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শৃংখল ভেঙ্গে আসার চেষ্টা করলে অনেকে তাকে উচ্ছৃঙ্খলতা হিসাবে আখ্যায়িত করেন। আন্দোলনে সামিল হলে তাকে চরিত্রহীন বলে মনে করা হয়। কিন্তু এসব কুপমণ্ডকতায় আমরা বিচলিত নই। বেগম রোকেয়া যেভাবে ঘুণে ধরা সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা যেমনি কাঁধে অস্ত্র তুলে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, সেভাবে জুম্ম নারী সমাজকে জাগাতে হবে। স্বাধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
নারী অধিকার এমনি এমনি আসবে না। অধিকার কারোর দয়ার সামগ্রী নয়, অনুদানের বিষয় নয়। এ অধিকার অর্জন করতে হয়, ছিনিয়ে আনতে হয়। অধিকার বঞ্চিত পাহাড়িরা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বতন্ত্র নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় যা একমাত্র স্বায়ত্তশাসন কায়েমের মাধ্যমেই সম্ভব।
” পুরুষ অবরুদ্ধ আপন দেশে নারী অবরুদ্ধ নিজ নিবাসে” এ অবস্থা আর কত দিন চলবে? আর আমাদের জুম্ম নারীদের অবস্থার বর্ণনা করার জন্য আমরা আর কতদিন বলব-
সচল হয়েও অচল সে
যে বস্তার চেয়েও ভারী
মানুষ হয়েও সঙ-এর পুতুল
পার্বত্য কোলের নারী।