অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ব্লাইন্ডনেস শিল্পী: মোরো সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » কর্নেল তাহের রূপকথার ৩৭ বছর: কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা

কর্নেল তাহের রূপকথার ৩৭ বছর: কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা

  • সেলিম রেজা নিউটন

সম্পাদকীয় নোট: বর্তমান রচনাটি জাসদ-ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কর্তৃক ২২শে জুলাই ২০১১ তারিখে আয়োজিত তাহের-দিবসের আলোচনার পরিমার্জিত ও পুনর্লিখিত অডিও-অনুলিপি। অডিও ইউটিউবে: কর্নেল-তাহের-রূপকথার ৩৭ বছর

অডিও অনুলিপির পরিমার্জনা শেষ হয় ২০১৩ সালে। এরপর দৈনিক বণিক বার্তা: ২৩শে নভেম্বর ২০১৩, ২১শে ডিসেম্বর ২০১৩, ২৮শে ডিসেম্বর ২০১৩, দৈনিক সোনার দেশ: ৭ই নভেম্বর ২০১৩, ২৩শে নভেম্বর ২০১৩, ৭ই ডিসেম্বর ২০১৩, ১৪ই ডিসেম্বর ২০১৩, ২৮শে ডিসেম্বর ২০১৩ রচনাটি প্রকাশিত হয়।

বর্তমান সংস্করণটি লেখকের অচেনা দাগ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।

কর্নেল তাহের
১৯৩৮-১৯৭৬

আজকেও কি আমরা তাহেরের পথে হাঁটতে চাই?

কর্নেল আবু তাহের (বীরোত্তম) এর আত্মদানের দিবসে আজকে আয়োজিত এই সভায় জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির, রাজশাহী জেলা কমিটির, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ, আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের জাসদ এবং ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মীবৃন্দ, সংগঠকবৃন্দ সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এবং যেকোনো প্রকারেই হোক, যত রকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেই হোক, কর্নেল তাহেরের নামটা – তাঁর নিশানা এবং তাঁর লড়াইয়ের চিহ্ন – বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং প্রতি বছর অন্তত তাহের-দিবসে সেটা মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়ার যে কাজ জাসদ, কর্নেল তাহের পরিষদ, ছাত্রলীগ গত ৩৫ বছর ধরে করছেন, তার জন্য তাঁদেরকে লড়াকু অভিনন্দন জানাচ্ছি।

বক্তৃতা করতে আমার রীতিমতো ভয় লাগে। আলোচনা করতে অত্যন্ত সংকোচ বোধ হয়। সেটা এই জন্য যে আমি খুব কুণ্ঠিত থাকি: যাঁদের সামনে কথা বলা হচ্ছে তাঁরা ঠিক এ ধরনের কথাবার্তা শোনার জন্য আদৌ আগ্রহী কিনা। আর সুদীর্ঘ কাল ধরে, বিশেষ করে উপনিবেশিক শাসনামলের জের ধরে আমাদের মধ্যে দাসত্বের একটা ট্র্যাডিশন তৈরি হয়েছে। সেই ট্র্যাডিশনটা যতখানি না সাক্ষাৎ দাসত্বের, তার চেয়ে বেশি চিন্তার দাসত্বের।

আপনি দেখবেন যে ছিয়াত্তরের পর থেকে এই পর্যন্ত কর্নেল তাহেরকে নিয়ে আমরা কথা বলে যাচ্ছি। কর্নেল তাহেরকে নিয়ে সম্প্রতি দুর্দান্ত একটা উপন্যাস সাম্প্রতিক সময়ে লিখিত হয়েছে। ক্রাচের কর্নেল। শাহাদুজ্জামান লিখেছেন। যাঁরা পড়েন নি তাঁদেরকে পারলে এক্ষুণি জোগাড় করে পড়ে ফেলতে হবে। অসাধারণ লেখা। তো, আমি যেটা বলছি তা হলো: ১৯৭৬ থেকে এ পর্যন্ত আমরা তাহেরকে নিয়ে যত কথা বলে যাচ্ছি, তার বেশ একটা তালিকা এই বইটার সঙ্গে আছে। তাহেরকে নিয়ে কী লেখা হয়েছে না হয়েছে, তাঁর নিজের রচনা কী আছে না আছে তার তালিকা। তা ছাড়া বুদ্ধিজীবীদের, এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের তাহের বিষয়ক লেখালেখির তালিকাও ওখানে বড় করে দেওয়া আছে। এগুলো আপনারা প্রতি বছরই দেখে থাকেন।

আমরা গতানুগতিক কিছু কথা বলি। অথচ তাহেরের মতো একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ – ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ – রূপকথার মতো অলৌকিক সমস্ত ঘটনা ঘটেছে। রোমাঞ্চকর, রোমান্টিক, সাহসিকতায় পরিপূর্ণ, স্বপ্নে আচ্ছন্ন ঘটনা। এবং সত্যিই একেবারে অলৌকিক, রূপকথার মতো, ঘটনাপ্রবাহ বয়ে গেছে। তাহেরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। সেই তাহেরের রাজনৈতিক দল জাসদ। তাহের এই রাজনৈতিক দলের সাথে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজেকে যুক্ত করে রেখেছিলেন। নিজে তিনি এই দল গড়ে তোলেন নি বটে, কিন্তু তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, জাসদই তাঁর স্বপ্ন পূরণের সঙ্গে মানানসই রাজনৈতিক দল। সেই রাজনৈতিক দল এবং তাহেরের অনুসারীরা আজকে যাঁরা বাংলাদেশ চালাচ্ছেন সেই মহাজোট-সরকারের অংশ। তার মানে আমরা তাহেরের সাক্ষাৎ কমরেডদেরকে নিয়ে গঠিত একটা সরকারের অধীনে বাংলাদেশে আছি।

আমি জানি না। আমার খুব কৌতূহল হয়। আমার এমনিতে পড়াশোনা খুব কম। কৌতূহল হয়: জাসদের দিক থেকে তাদের পঁচাত্তরের বিপ্লবী কর্মসূচি এবং বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের কোনো পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন কিনা। জাসদের দিক থেকে সামগ্রিক কোনো পার্টিগত মূল্যায়ন আছে কিনা।

আজকের বাংলাদেশে আমরা কি কর্নেল তাহেরের পথ অনুসরণ করে একটা সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে চাই? আজকে? চাই না। আজকের বাংলাদেশ আর সাড়ে তিন দশক, চার দশক আগের বাংলাদেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তাহেরের মতো করে সেনাবাহিনীর ভেতরে নিজেদের রাজনৈতিক-সামরিক সংগঠন গড়ে তোলা, কিংবা বেসামরিক মানুষদের মধ্যে বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পথ অনুসরণ করার দিকে তাহেরের অনুসারীরাও আর নাই। তার মানে কোথাও না কোথাও কিছু একটা আমরা বিবেচনা করে দেখেছি। মূল্যায়ন একটা ঘটেছে। মুখে সেটা বলি না বলি। বুঝেশুনে সেটা লেখা হোক না হোক। মূল্যায়নটা হলো: কর্নেল তাহেরের পথ আমরা বাংলাদেশে আর অনুসরণ করব না।

 রূপকথার মতো সময়

তাই বলে কর্নেল তাহেরকে নিয়ে কথা বলার গুরুত্ব আর থাকে না, তা মোটেই না। ব্যক্তি হিসেবে একটা মানুষ কোন শিখরে পৌঁছাতে পারে – মনুষ্যত্বের – তার একটা নমুনা হচ্ছে তাহের। ব্যক্তি হিসেবে একজন মানুষ কীভাবে তার সময়কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, সময়ের লাগাম নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করতে পারে এবং সে আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখাতে পারে – তার অসাধারণ নমুনা কর্নেল তাহের। একই সঙ্গে, ব্যক্তি-মানুষ উপযুক্ত সামাজিক ভিশনের অভাবে, উপযুক্ত রূপকল্প, উপযুক্ত প্রোগ্রাম, উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে কী করতে পারে না, তার নিজের জীবনকে হাসিমুখে একাধিকবার, সারা জীবন জুড়ে অনেকবার, বাজি ধরার পরেও কী করতে পারে না তারও অসাধারণ একটা নমুনা তাহের, এবং তাহেরের মতো এক ঝাঁক মানুষ। তাহের কিন্তু একা না। খেয়াল করে দেখবেন। তাহেরের ডাইনে দেখবেন। তাহেরের বাঁয়ে দেখবেন। তাহেরের সামনে-পেছনে দেখবেন। তাহেরের পরিবারকে দেখবেন। তাহেরের ভাইদেরকে দেখবেন। অজস্র মানুষ। গোটা মুক্তিযুদ্ধ জুড়ে আপনি দেখবেন, তাহেরের মতো, তাহেরের মাপের অনেক মানুষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে কর্নেল তাহের এবং তাঁর সাথীরা নিজেদের মতো করে কাজ করে গেছেন। আরো অনেক মানুষ। তাঁরা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বিভিন্ন রকমের ঝুঁকিপূর্ণ, টালমাটাল, পরিবেশের মধ্যে নিজেদের গোটা জীবন-সংসার-পরিবার সমস্ত কিছুকে বাজি ধরে কাজ করে গেছেন।

আমার কাছে মনে হয়, কর্নেল তাহেরকে নিয়ে কাজ করার, কথা বলার চাইতে বড় গুরুত্ব আজকে এখানে যে: এ পর্যালোচনা থেকে তাহেরের বিপ্লব ব্যর্থ হলো কেন সে সম্পর্কে একটা পরিষ্কার উপলব্ধি অর্জন করা যায়। এ আলোচনা এ জন্যে নয় যে তাহের একজন ব্যর্থ মানুষ ছিলেন বলে প্রতিপন্ন করা আমাদের লক্ষ্য। তাহেরের মতো মানুষেরা কোনো দিন ব্যর্থ হন না। এবং আমি কিন্তু কখনোই কর্নেল তাহেরকে একা-মানুষ হিসেবে দেখছি না। কর্নেল তাহেরের মাকে দেখবেন। রূপকথার মতো একটা মানুষ। সত্যিই রূপকথার মতো। আপনি তাহেরের ভাইদেরকে দেখবেন। অবিশ্বাস্য। একেবারেই অবিশ্বাস্য। আমি ধরে নিচ্ছি, আপনারা কর্নেল তাহের সম্পর্কে এ ঘটনাগুলো জানেন। শুনেছেন। কোনো না কোনোভাবে কথাগুলোর সাথে আপনারা পরিচিত। তা যদি না ও হয়ে থাকে, তাহলে খুবই দ্রুত, সংক্ষেপে, ক্রাচের কর্নেল পড়ে ফেলবেন। তাহলে ছবির মতো আপনার সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠবে ‌‘কর্নেল তাহের’। বাহারের কথা ধরেন। আপনাদের চেয়ে অল্প বয়েসের একটা ছেলে। জাসদের গণবাহিনীর সেইসময়কার যে বিপ্লবী সুইসাইডাল স্কোয়াড, সেই সুইসাইডাল স্কোয়াডের ছয় জনের এক জন বাহার। তাহেরের ছোট ভাই। তাহেরেরই আরেক ছোট ভাই বেলাল। কর্নেল তাহেরের গ্রেপ্তারের পরে এদের যে অপারেশন সেটা দেখবেন।

আমরা তো রূপকথার মধ্যে ডুবে ছিলাম! আজকে যেটাকে রূপকথা বলে মনে হচ্ছে, আজকে যেটাকে অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে, আজকে যে মানুষগুলোকে ধরাছোঁয়ার বাইরের কাল্পনিক জগতের মানুষ বলে মনে হচ্ছে, সেই ধরনের মানুষ দিয়ে বাংলাদেশ ভরা ছিল। বাঙালি জাতি, বাঙালি কৃষক সম্প্রদায়, এই ভূখণ্ডের মানুষ তাঁদের মুক্তির জন্য নানাভাবে লড়াই করে গেছে, প্রস্তুতি নিয়ে গেছে, সুদীর্ঘকাল ধরে, হাজার খানেক বছর ধরে। এই হাজার খানেক বছরের জাতিগত, সম্প্রদায়গত, দেশগত প্রস্তুতির একটা চূড়ান্ত মুহূর্ত আমরা দেখতে পাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধে আত্মদান করার মতো লোকের কোনো অভাব ছিল না। নতুন দেশ গড়ার জন্য যা প্রয়োজন তা-ই নিয়ে বাজি ধরার মতো লোকের কোনো অভাব ছিল না। অজস্র নাম না জানা লোক ‍– তাহের যাঁদের সাথে লড়াই করেছেন, কামালপুরের মতো যুদ্ধে। তাহের যাঁদেরকে ট্রেনিং দিয়েছেন। অজস্র কৃষক। এঁদের মধ্যে অনেকের জীবন, অনেকের আত্মদান, অনেকের লড়াই, অনেকের আগ্রহ এমনকি তাহেরকে পর্যন্ত মুগ্ধ করেছে। বিস্মিত করেছে। সত্যি আমরা একটা রূপকথার যুগ পার হয়ে এসেছি। একটা গোটা দেশ তার সামগ্রিক জাগরণের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা একাত্তরের নয় মাস ধরে দেখিয়েছে। এত বড় ঘটনা, এত বড় আকারের ঘটনা, এত বড় আয়তনের ঘটনা গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে আপনি খুব কম পাবেন।

আমি আজকে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি আরও একটা কারণে। আমার গর্ব লাগে যে কর্নেল তাহের এই দেশেরই মানুষ। খুব পরিচিত মানুষ। কাছের মানুষ। তাহেরের ভাইবোনেরা, তাহেরের সন্তান, তাহেরের স্ত্রী, তাহেরের আত্মীয়স্বজন, তাহেরের কমরেডরা আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে এখনও। এই বাংলাদেশে। এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। চে গুয়েভারার নাম শুনলে আপনি যেরকমভাবে রোমাঞ্চিত হন, আমার সন্দেহ, তাহেরের নাম শুনলে আপনি সেই মাত্রায় রোমাঞ্চিত হন না। কারণ তাহের আপনার বাড়ির পাশের লোক। কিন্তু কর্নেল তাহের ঐ চে গুয়েভারা বা ফিদেল ক্যাস্ত্রোদের মাপের মানুষ। এবং এই মাপের মানুষদেরকে নিয়েই সেই সময় গঠিত হয়েছিল, গড়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ। সেই মানুষেরা কেউ পদক পান নি। খেতাব পান নি। কিন্তু তাঁরা ছিলেন। তাঁরা ছিলেন বলেই বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশ’ হতে পেরেছিল। প্রত্যেকের রক্ত টগবগ করেছিল। প্রত্যেকে অস্থির হয়ে ছিল। কীভাবে, কী করলে আমার বাংলাদেশ এই হাজার বছরের নিপীড়ণের হাত থেকে, চব্বিশ বছরের পাকিস্তানী নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাবে। আমরা মুক্তি পাব। তার জন্য যা করা প্রয়োজন গোটা একটা জাতি তা-ই করবে বলে নিশ্চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। অলৌকিক একটা সময়। রূপকথার মতো একটা সময়।

মুক্তিযুদ্ধের মহাজাগরণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো

এই রকম রূপকথার মতো একটা গণজাগরণ, মহাজাগরণ, (অনেক কিছু অর্জন করেও) ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আজকে পেছন ফিরে তাকালে, দেখলে, অসম্ভব মনে হয়, কেমন করে এই মহাগণজাগরণ রাষ্ট্র-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেও বেপথু হলো। (আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই সীমাবদ্ধতার নিয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য সেলিম রেজা নিউটন, ২০১২।)

শিল্পে সাহিত্যে কবিতায় সামরিকতায় শিক্ষাদীক্ষায় – সমস্ত দিক থেকে সমস্ত রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করা একটা গোটা জনগোষ্ঠী অকল্পনীয় এক বিপর্যয়ের মধ্যে পথ হেঁটেছে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর কালপর্বে। গভীর অন্ধকারের মধ্যে। কী হচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না। কোন দিকে যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না। খোদ জাসদের ‘গণবাহিনী’র নিচের দিকের অংশ, ‘জাসদ’ নামের রাজনৈতিক দলটার সারা দেশের অংশ, অন্যান্য পলিটিক্যাল পার্টি, সেনাবাহিনী, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, তাঁদের সকলের মধ্যকার নানান রকমের মতের লোক, নানা রকমের পথের লোক সবাই একটা অসম্ভব কনফিউশনের মধ্যে। অসম্ভব বিভ্রান্তির মধ্যে। অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞার মধ্যে দিয়েই একটা অন্ধকার পথ আমরা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫-৭৬ পর্যন্ত পাড়ি দিয়ে আসলাম। আজকে এত বছর পরেও যখন পেছন ফিরে তাকাই, গোটা ইতিহাসটা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। এখনও অনেক অস্পষ্টতা। অনেক গোপন নেটওয়ার্ক। অনেক গোপন লেনদেন। পরাশক্তিদের নানান ধরনের গুপ্ত তৎপরতা। আমাদের এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর নানান রকমের দোদুল্যমানতা। তাদের কারো রাশিয়ার দিকে দৌড়ানো। তাদের কারো আমেরিকার দিকে দৌড়ানো। তাদের কারো ভারতের দিকে দৌড়ানো। তাদের কারো চীনের দিকে দৌড়ানো। তাদের কারো মাথার মধ্যে আলবেনিয়া। তাদের কারো মাথার মধ্যে কিউবা। অসম্ভব অস্পষ্ট-এলোমেলো একটা পরিস্থিতি।

শিল্পী : মিতা মেহেদী
সূত্র: ফেসবুক

মুক্তিযুদ্ধের মতো মহাপ্লাবনিক গণজাগরণ যে প্রকৃত লক্ষ্যের চূড়া দেখে যেতে পারল না, কিংবা কর্নেল তাহেরকে কেন্দ্র করে পরিচালিত রূপকথাময় বৈপ্লবিক সংগ্রাম যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো, তার পেছনে আছে সমাজ-পরিবর্তন বিষয়ক বলশেভিক রূপকল্পের সীমাবদ্ধতা আর ব্যর্থতার প্রশ্ন। এ ব্যর্থতা শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয়, কর্নেল তাহেরের নয়, বলশেভিক রাশিয়ার তথাকথিত সমাজতন্ত্রের পর্যুদস্ত হওয়ার মধ্যেও তা প্রকাশিত – প্রকটিত।

আমি খুব অল্প কথার মধ্যে দিয়ে বলার চেষ্টা করব। আমি এমনিতে বাচাল টাইপের লোক। সাঈদী টাইপের লোক। বেশি বকবক করা ছাড়া উপায়ও থাকে না। আমাদের এখানটা ধারণাগত জঞ্জাল-আবর্জনায় সয়লাব হয় আছে। স্বাধীনতা নিয়ে বা সমাজতন্ত্র নিয়ে এখানে মুক্তচিন্তার সামান্য কোনো বিকাশ-প্রকাশের চিহ্নমাত্র নাই বলতে গেল। যা আছে তা পাখিপড়া প্রশিক্ষণ, মুখস্ত-অধঃপতিত বৈষ্ণব-গোঁসাইদের মন্ত্রপড়া দীক্ষাপাঠ। সুতরাং রিকশার স্পোক নিয়ে কথা বলতে গেলেও এখানে জেনারেল মটরসের আলাপ তোলা ছাড়া পথ থাকে না। কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখেছি, বাচালতা করে করে দেখেছি, হুট করে একটা লম্বা আলাপ তুললেই হয় না। বাচালতার জন্যে আসলে সদাপ্রস্তুত থাকেন না সবাই। তাই আমি অল্প কথায় বলব। অনেক কথা বাকি থেকে যাবে। খচখচ করতে থাকবে পাঠকের মনে প্রশ্নের কাঁটা। পরিশ্রমী মুক্তমনারা সময় নিয়ে অধ্যয়ন করবেন নিশ্চয়ই। আমার-আমাদের অন্যসব রচনা-আলোচনা জোগাড় করে দেখবেন হয়ত। হুট করে গালি দেওয়ার মানসিকতা যে সবার নয় সে বিশ্বাসের পাল নামিয়ে নিলে তো চলে না।

যাক গে এসব কথা। এখন আমার এবং আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষদের জীবনের ছোট্ট একটা পর্বের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে দেখানোর চেষ্টা করব বলশেভিক রূপকল্পের দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতা কীভাবে আমাদের প্রতিদিনের রাজনৈতিক কাজকর্মের দিশাকে পরিসীমিত করে ফেলে। ঘটনা হলো: সাম্প্রতিক কালে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুশীল-সামরিক জরুরি জমানার তখনও অনাগত ‘ওয়ান-ইলেভেন’কে আমরা মোকাবেলা করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। তো, সেই ওয়ান-ইলেভেন আসার আগেই আমরা তাকে মোকাবেলার প্রস্তুতির রূপকল্প প্রণয়নের চর্চা শুরু করি। এখানে উপস্থিত তুষার থেকে আরম্ভ করে, মুকুট থেকে আরম্ভ করে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঝাঁক অসাধারণ ছাত্রছাত্রী সেই প্রতিরোধ-যজ্ঞের সংগঠক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভেবে দেখুন: ওয়ান-ইলেভেনকে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে কেন? নিউটন কিংবা তুষার বা মুকুট অথবা বাধন টিটো, পার্থ ওরা এমন কে যে ওয়ান-ইলেভেনকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত ওদেরকেই নিতে হবে? এখানেই আসে দৃষ্টিভঙ্গি বা রূপকল্পের প্রশ্নে উদ্দেশ্য-উপায়গত স্বচ্ছতার প্রশ্ন।

আমাদের কাছে একদম ঝকঝকে পরিষ্কার ছিল: কোনো পলিটিক্যাল পার্টি বা রাজনৈতিক ছাত্র-সংগঠন অন্তত ওয়ান-ইলেভেনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য চট করে দাঁড়াবে না। রাষ্ট্র যখন তার যাবতীয় নিপীড়ন-যন্ত্র নিয়ে হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপরে নামে, প্রথম সারির নেতারা সব শ্রীঘরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন, তখন কোনো হুকুমতান্ত্রিক পলিটক্যাল পার্টির কর্মীবাহিনীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এটাই নিয়ম। যাঁরা চিরকাল হুকুমের দাস হয়ে কাজ করেন, ওপরের নির্দেশ ছাড়া তাঁরা এক পা-ও ফেলতে পারেন না। যে শিশু ‘আন্ডার ইন্সট্রাকশান’ বেড়ে ওঠে, সে বড় হয়ে প্রবলেম সল্ভ‌্‌ করতে শেখে না, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে হিমশিম খায়। এঁরা মূলত অনুসরণকারী। অনুকরণকারী। পছন্দের মানুষের পেছনে দাঁড়াতে এঁরা ভালোবাসেন। পছন্দের মানুষকে চোখের পলকে নেতা-হুজুর-বস্ বানিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে থাকেন। দরকার হলে ঝুঁকিও নেন। ফলত, দেখলেন আপনারা, ওয়ান-ইলেভেনের মতো  এই রকম একটাঘটনা – সে ঘটনাকে রুখে দাঁড়ালো না কেউ। পরের দিনই চ্যালেঞ্জ করল না কেউ। তবুও, আমরা জানতাম, একবার কেউ দাঁড়িয়ে গেলে অনেক মানুষকে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই ‘কেউ’টা রাজনৈতিক দলের কেউ হলে কাজ হবে না। কারণ বাংলাদেশে রাজনীতি মানেই ক্ষমতার রাজনীতি (‘প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স’ বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি[১] বিষয়ক সামান্য ধারণাটুকু পর্যন্ত নেই এখানে), এবং সেই ক্ষমতার রাজনীতি তার ব্যর্থতার সীমা অতিক্রম করেছে। তাঁদের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা আর ছিল না তখন। সুতরাং আমরা ঠিক করেছিলাম মহাকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রশক্তিকে, তা সে যে চেহারা নিয়েই আত্মপ্রকাশ করুক না কেন, প্রতিরোধ করার, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তোলার পথে যাব আমরা কোনো না কোনোভাবে।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অরাজপন্থী প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্সের সচেতন ও প্রত্যক্ষ অনুশীলন শুরু করার বিকল্প ছিল না আমাদের সামনে। এবং আমরা প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ শুরু করেছিলাম। নিজেদের মতো করে আমাদের সে কাজ কয়েক বছর ধরেই চলছিল। আড্ডায়, স্টাডি-সার্কেলে, গানের আসরে, ফর্মাল ও ইনফর্মাল আলোচনা-সভাগুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরে এবং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাজতন্ত্রের  প্রাথমিক ইতিহাসকে ধরে পর্যালোচনা করছিলাম আমরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চার দশকের ইতিহাস, ১৯২১ সালে রাশিয়ায় গিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা এবং তার পরের ইতিহাস – এই সমস্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করছিলাম আমরা। পর্যালোচনা করছিলাম আমরা বাঙালি জাতির এক হাজার বছরের, কম পক্ষে এক হাজার বছরের, তিল তিল করে এগুনোর ইতিহাস। অচ্ছুৎ একটা জাতি – যার কোনো চাষা-সদস্যের ছায়াটুকু গায়ে পড়লে পরে নোংরা হয়ে যেতেন শাসক শ্রেণীর লোকেরা। এই ধরনের একটা জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করছিলাম আমরা। এবং আমরা একটা উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলাম। উপলব্ধিটা হচ্ছে, সমাজতন্ত্র আমরা সবাই চেয়েছি। এখনও চাই। কিন্তু সমাজতন্ত্রের নামে আমরা যার চর্চা করেছি, তার সঙ্গে সমাজতন্ত্রের খুব কমই যোগাযোগ আছে। এরকম একটা মৌলিক উপলব্ধিতে আমরা পৌঁছেছিলাম।[২]

আমরা গোটা বলশেভিক ঐতিহ্যটাকে কমবেশি নাড়াচাড়া করে দেখছিলাম। সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ের প্রকৃত ইতিহাসটাকে বুঝে নিচ্ছিলাম। সাহায্য করছিল ইন্টারনেটের মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডার। আমরা সার্বিকভাবে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট ঐতিহ্যটা পর্যালোচনা করছিলাম। ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে আমার নিজের কথা বললে, কাজটা শুরু হয়েছিল আরো আগে থেকে। আলোচ্য প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আমাকে প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা-অনুসন্ধিৎসা-অনুসন্ধানে নিমজ্জিত থাকতে হয়েছিল সেই ৮৯-৯০ থেকে। আত্মরক্ষার দায়ে। আত্মা রক্ষার দায়ে। আত্ম-উপলব্ধির দায়ে। সেটা শুরু হয়েছিল সেই রুশ বলশেভিক রাশিয়ার মহাডিগবাজি খাওয়ার করুণ কালপর্ব থেকে। আমার নিজের ক্ষেত্রে এটা ছিল জন্মসূত্রে-পরিবারসূত্রে পাওয়া নিজের বলশেভিক-দীক্ষায়িত জীবনটাকে তার যাবতীয় উল্লম্ফন ও সরণ-প্রতিসরণ সহকারে বুঝে নেওয়ার তাড়না। এবং এসব পর্যালোচনা-সমালোচনা-সমীক্ষাজাত উপলব্ধির  ফলেই আসলে বিশেষ অর্থে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে। বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা, ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি আইনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিশেষত রাশিয়ায় ১৯২০-এর দশকে, স্পেনে ১৯৩০-এর দশকে এবং জার্মানিতে ১৯৪০-এর দশকে, সর্বাত্মক-স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব এবং তাকে আটকানোর ইতিহাস থেকে আমাদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে ওয়ান-ইলেভেনকে যদি ইমিডিয়েটলি চ্যালেঞ্জ করা না যায়, তাহলে আমরা নিশ্চিন্তে আগামী দশ বছর বা কুড়ি বছরের জন্য মার্কোসের মতো বা এরশাদের মতো সামরিক আইনের পাল্লায় পড়ে যাব – সেটা যে নামেই জারি থাক না কেন। ভাত-কাপড়-থাকা-খাওয়ার কষ্ট তো ছিলই, আছেই, উপরন্তু মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলাদেশের মানুষের সংগঠন-সমাবেশ-চলাচলের এবং চিন্তা করা ও কথা বলার স্বাধীনতা। ব্যক্তিগতভাবে ভুগব আমরা।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো

আমাদের ইতিহাস-অনুশীলন থেকে আমরা এ-ও জানতাম, ‘এক-এগারো’ টাইপের সামরিক শাসনের মূল শক্তি গণবিচ্ছিন্ন সৈন্যবাহিনী, কিন্তু সৈন্যবাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের মতো অসহায় লোক পৃথিবীতে কমই থাকে। এদের মতো ভীতু, ‘কাপুরুষ’, বন্দুকনির্ভর মানুষ কমই পাওয়া যায়। বন্দুকধারী ব্যক্তি নিরস্ত্র মানুষের তুলনায় কম নিরাপদ। শুধু গায়ের জোরে, বন্ধুকের জোরে শাসন করা যায় না। শাসন করতে জনসম্মতিও লাগে। আর স্রেফ মিডিয়া-নির্মিত জনসম্মতি বেশি দিন টেকে না। আমরা জানতাম যে একবার রুখে দাঁড়ালে এরা থমকে দাঁড়াবে এবং গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে নিজেদেরকে। আমাদের জানা ছিল, বাংলাদেশের মানুষ এটা অবশ্যই রুখে দাঁড়াবে। ঘোরতর অন্ধকারে ‘টিমটিম করে জ্বলা একটি লণ্ঠনের’ (বিপ্রতীপ, ২০০৯) আয়োজন-সাধনা করে চলেছি আমরা তখন সকলের অগোচরে প্রায়। বারবার আমরা ‘জরুরি আইন’ লঙ্ঘন করেছি সেই সময়। রুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই বটে। অন্তত তিন বার আমাদেরকে ঐ সময় জরুরি আইন  লঙ্ঘন করতে হয়েছে। একেবারে আইনত। প্রকাশ্যে। প্রথমবার জরুরি আইনকে চ্যালেঞ্জ করি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মহাজরুরি আইন জারি করার এক মাসের মাথায়। ২০০৭ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে। প্রকাশ্য ধর্মঘট, মিছিল এবং ছাত্রসভায় অংশগ্রহণ করে, বক্তৃতা দিয়ে। সে সময় প্রকাশিত একটা খবরের বিববরণ দেওয়া যেতে পারে, এই এত দিন পরে:

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে বির্তর্কিত সান্ধ্য-কোর্স বাতিলের দাবীতে [ সেদিন ] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত [ হয় ]। … মোটা ফীর বিনিময়ে সান্ধ্য-কোর্স চালুর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করে আসছিল শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবী উপেক্ষা করে সান্ধ্য-কোর্সের ফরম বিক্রি শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ধর্মঘটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ক্লাশ-ইনকোর্স-মিডটার্ম পরীক্ষা হয়নি। সকাল থেকেই প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীরা জড়ো হন কলাভবনে। কলাভবনের সব ক’টি গেইট বন্ধ করে দেন এবং ভবনের মূল গেইটে অবস্থান নিয়ে ক্লাশ করতে আসা শিক্ষার্থীদেরকে কলাভবনে ঢুকতে বাধা দেন। … আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কলাভবনের মূল গেইট থেকে মিছিল বের করেন। মিছিলটি উপাচার্যের কার্যালয়সহ পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এসে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। বিক্ষোভ সমাবেশে এক পর্যায়ে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন। (আজিজুল হক রাসেল, ২০০৭)

সেবারই আমি গ্রেপ্তার হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম ঢাকায়। যেকোনো কারণেই হোক সেটা তখন ঘটে নি। এর পরের দফায় আমরা জরুরি আইন লঙ্ঘন করি ‘এক-এগারো’ নামে সমধিক পরিচিত জরুরি অবস্থার মাত্র চার মাসের মাথায়, ২০০৭ সালের মে মাসের ২০ তারিখে। মেলা দিন হয়ে গেছে। এখন একটু ভেঙেই বলে রাখা দরকার এসব কথা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তখন সুশীল-সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নানান ধরনের কর্মকাণ্ড চলছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সাইজ করার  পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিলেন তাঁরা। আর আমরা সেইটাকে ধরেই দাঁড়াচ্ছিলাম। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কী চেঞ্জ আমরা চাই, এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে বাংলাদেশে কেমন ধরনের সমাজ আমরা চাই, ওয়ান-ইলেভেন আমরা কেন চাই না, এগুলো পরিষ্কার বাংলা ভাষায়, এক পাল সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দার উপস্থিতিতে আমরা তুলে ধরেছিলাম একটা সেমিনারে। জরুরি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারে হাত দেবেন, ছাতার আইন ওরফে আমব্রেলা অ্যাক্ট জারি হবে ইত্যাকার গুজবের প্রেক্ষাপটে আমাদের ‘মানুষ নেটওয়ার্ক’ ঐ বিশেষ আলোচনাসভা আয়োজন করেছিল। সভার আগে, একেবারে ঢোল পিটিয়ে, কয়েক হাজার হ্যান্ডবিল বিলি করে, সবাইকে জানানো হয়েছিল। এমনিতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গোয়েন্দা-অধ্যুষিত এলাকা। হ্যান্ডবিল বিলি করতে গিয়ে আমাদের শিক্ষার্থী-বন্ধুরা নিয়েছিলেন গ্রেপ্তার-নির্যাতনের ঝুঁকি। কেননা সভাটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালীন সেনাসরকারের অনুগত রাবি-কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে। জরুরি আইনের সভাসমাবেশ-প্রচার সম্পর্কিত বিধিনিষেধ স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে।

আমার মনে আছে: অডিয়েন্সের একটা পাশ জুড়ে ছিলেন নানা কিসিমের সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দারা। আরেকটা পাশ জুড়ে ছিলেন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এবং মাত্র কয়েক জন শিক্ষক। ‘জরুরি বিঘোষিত রাষ্ট্রযন্ত্রের তখন রীতিমতো নওজোয়ান তেজ। অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ। বাঘ আর হরিণেরা এক ঘাটে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। বাচ্চারা গোয়েন্দা সংস্থার নাম মুখস্ত করছে। আতঙ্কে অজগর সাপ গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তায়। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া কুমির আত্মপ্রকাশ করছে ডোবায়।’ (দ্রষ্টব্য: সেলিম রেজা নিউটন, ২০১১: ৬৩। দুই নম্বর অন্ত্যটীকা।) সেবারও ছিল গ্রেপ্তারের আতঙ্ক। সহকর্মীরা তো আসতেই চাচ্ছিলেন না সেখানে। সব মিলিয়ে ৪/৫ জনকে হাজির করা গিয়েছিল অনেক কায়দা-কানুন, অনুরোধ-উপরোধ করে। সাহসের সাথে হাজির ছিলেন বেশ কিছু শিক্ষার্থী অ্যাক্টিভিস্ট। তাঁরাই ছিলেন সভার হ্যান্ডবিল বিতরণকারী, সভার আয়োজক। তাঁদের অনেককেই আজকে এখানে দেখতে পাচ্ছি। ভালো লাগছে। তো সেই সভার একমাত্র আলোচক হিসেবে আমাকে সেদিন রীতিমতো বেপরোয়াভাবেই, উপস্থিত গোয়েন্দাদেরকে ইঙ্গিত করে বলতে হয়েছিল:

অন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ  যদি [এখানে থেকে] থাকেন, তাঁদের কাছেও অনুরোধ যে আমাদের এই আলোচনাকে রেফার করার জন্য দরকার যদি পড়ে, যেকোনোরকমভাবে আমাদের আলোচনার বরাত দিয়ে যদি কিছু বলা লাগে, তো দয়া করে আমাদের কাছে চাইবেন। আমরা আমাদের গোটা আলোচনার সিডি দিয়ে দিব। গোটাটাই উন্মুক্ত। এখানে লুকানোর কিছু নাই এবং আড়াল করার কিছু নাই। যে-কারও যেকোনো প্রয়োজনে যদি আজকের আলোচনার প্রয়োজন পড়ে, এর বরাত দিয়ে কিছু বলার, কিছু লেখার, কোথাও কোনো প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দরকার যদি পড়ে, তাহলে আমাদের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ সিডিটা নেবেন। দয়া করে আমাদের নাম দিয়ে নিজেদের মতো করে কোনো রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবেন না। (দ্রষ্টব্য: সেলিম রেজা নিউটন, ২০১১; ‘আলোচনার পদ্ধতি’ অংশ।)

আসলে পরিস্থিতি ছিল সত্যি খারাপ। ‘আলোচনার পরদিন তো [সভায় উপস্থিত গোয়েন্দাদের] একজন আমাকে স্বতঃস্ফূর্ত গলায় ফোন করে জানিয়েছিলেন, তিনি আমার আলোচনা থেকে উপকৃত হয়েছেন। এটা ছিল গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ, প্রশংসা, জিজ্ঞাসাবাদ, অত্যাচার, কৃতজ্ঞতা জানানো এবং দুঃখপ্রকাশ করার কাল।’ (দ্রষ্টব্য: সেলিম রেজা নিউটন, ২০১১: ৬৩। তিন নম্বর অন্ত্যটীকা।)

যাই হোক, তৃতীয় বার আমরা আর পার পাই নি। না ঢাকায়; না রাজশাহীতে। প্রথম বার জরুরি আইন ভেঙে ঢাবি-তে সভা-সমাবেশ-ধর্মঘট করার সময় ঢাকার সাংবাদিকতা বিভাগ এবং অন্যান্য নানা বিভাগের যেসব শিক্ষার্থী-সংগঠকের সাথে আমাদের  যোগাযোগ দাঁড়িয়েছিল, তাঁদের অনেকেই ছিলেন ক-মাস পরের ‘আগস্ট বিদ্রোহ’ নামের বিপুল ক্যাম্পাস-আন্দোলনের আদি কারিগর। এঁদেরই মূল একজন সংগঠক ছিলেন ঐ বিভাগের শিক্ষার্থী খোমেনী ইহসান। তো সে বছর ২০শে আগস্টে ঢাবি-র খেলার মাঠে সেনা-সদস্যদের অসদাচরণের প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে সূচিত ঐ আগস্ট বিদ্রোহের ঠিক আগে, ১৮ই আগস্ট ২০০৭, খোমেনী আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাংবাদিকতা-সূত্রে। তাঁর সাথে আমার কথা হয় বিদ্যমান সুশীল-সামরিক জরুরি জমানাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উপায়-পদ্ধতি নিয়ে। এসব নিয়ে পরে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন আমার ব্লগ ডট কমে। পরে দেখেছি আমাদের সেদিনের কথাগুলো তিনি টুকে রেখেছেন তাঁর সেই লেখায়, যাতে ধরা পড়েছে আমাদের সেই সময়কার প্রস্তুতি-স্পিরিট:

ঘুটঘুটে অন্ধকারে মানুষকে পথ দেখানোর জন্য পুরো জঙ্গল আলোকিত করার দরকার নাই। এটি পারাও যায় না। এ সময় দরকার হয় টিমটিম করে জ্বলা একটি লণ্ঠনের। যার ক্ষীণ আলোর রেখা দেখে মানুষ বুঝতে পারবে পথটি কোন দিকে। অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়ানো মানুষ এতটুকু পেলেই নিজের নিজের কাজটি করে নিতে পারে। (বিপ্রতীপ, ২০০৯)

সবাই মিলে আমরা সেই লণ্ঠন জ্বেলেছিলাম। ঢাবি-তে ২০শে আগস্ট যখন শিক্ষার্থী-বিদ্রোহ আর সেনানিপীড়ন চলছে তখনও কথা হয়েছে আমার তাঁদের সাথে। একটু পর পর। এসবেরই পরিণাম রাবি-তে ২১শে আগস্ট। তা নিয়ে কথা আরেক দিন। এ নিয়ে বাচালতা আপাতত বন্ধ। কিন্তু নিজেকে নিয়ে, নিজেদেরকে নিয়ে এই বাচালতা করা হলো কেন এতক্ষণ? সেটা হলো: যে-ইতিহাস-উপলব্ধি থেকে জরুরি আইনকে আমরা বারবার বুড়ো আঙুল দেখিয়েছি, কারাবরণের ঝুঁকি নিয়েছি, অজস্র শিক্ষার্থী মিছিলে নেমেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, পঙ্গু হয়ে গেছেন, সেই উপলব্ধির সঙ্গেই জড়িত তাহেরকে নিয়ে আমাদের পর্যালোচনা, আমাদের আজকের উপলব্ধি। সে আলাপ তুলতেই আমাদের মতো পোকামাকড়ের কেচ্ছা নিয়ে এত বাচালতা।

ভেবে দেখুন: যখন আমাদের মতো কীটতূল্য মানুষেরা আসন্ন একটা রাষ্ট্রীয় বিভীষিকাকে মোকাবেলা করার জন্য ঐতিহাসিক-সমাজতান্ত্রিক  পর্যালোচনাভিত্তিক প্রস্তুতি নিতে পারে, তখন ঐ ২০০৬ সালে ২০০৭ সালে বুর্জোয়া-বলশেভিক ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলো কেন নিঃসঙ্কোচে গা-ঢাকা দিয়ে উধাও হয়ে যায়?

প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি: রাজনীতির অরাজপন্থা

আমাদের সেই ইতিহাস-উপলব্ধি-পর্যালোচনার সূত্রপাত খোদ কার্ল মার্কস এবং ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ বিষয়ক অভিজ্ঞতা থেকেই বটে – অরাজপন্থায় বা অ্যানার্কিতে যা ‘প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স’ বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি ও ‘প্রত্যক্ষ তৎপরতা’র[৩] ধারণা ও চর্চার সাথে সংশ্লিষ্ট। কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বতন্ত্র, রাষ্ট্রশক্তি এবং স্বাধীনতার ধারণা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গীর মার্কসীয় বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতার ক্ষেত্রে নিয়ামক হয় দাঁড়িয়েছে বারবার: একাত্তর থেকে এক-এগারো পর্যন্ত। আজকের দিনেও। আজকেও আমরা ঘুরেফিরে আরেকটা এক-এগারো মার্কা পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছি।

আর্টওয়ার্ক: রাইট টু প্রটেস্ট
শিল্পী: ভ্লাদিমির খাখানভ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

আমাদের উপলব্ধি যদি এই হয় যে রাষ্ট্রক্ষমতার সিংহাসনে আরোহন করে রাজশক্তির সবল প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্র বা কিছু-একটা শুভবস্তুর উদয় ঘটাবো, তাহলে আমাদের পথ হবে এক রকম। সেই পথের ফরাসী বিপ্লব যুগের জ্যাকোবিনদের পথ। বন্দুক-বলপ্রয়োগ-বঞ্চনার পথ। এঁরা সবাই সামরিক রাষ্ট্র-শক্তির বৈধতায় বিশ্বাসী। জেলজুলম-হিংসায় বিশ্বাসী। কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বে বিশ্বাসী। কর্তা হুজুর গুরু ফাদার পুরুত মাতব্বর জেনারেল এক্সপার্টে বিশ্বাসী। লেনিন-লাদেন-লিবারালপন্থা এখানে একই অন্ধকারে উদ্ভাসিত। জামাত জেএমবি জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগ বিএনপি কমিউনিস্ট পার্টি এখানে একই বস্তুর পূজারী। সেই বস্তুর নাম কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রশক্তি। এ ধারার মোদ্দা কথাটা হলো: ‘আমরা শক্তি, আমরা বল – আমরা হুকুম-কল’। এঁদের তর্কটা শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতার মালিকানা নিয়ে। বাকিটা একই। নেতৃত্বতন্ত্র কর্তৃত্বতন্ত্র হুকুম করবেন, এক পাল পাবলিক-কর্মী-কর্মচারী পিপড়ার মতো লাইন ধরে সেটা মেনে চলবেন। নেতা-কর্তা ভালো হলেই দেশের মঙ্গল, দশের মঙ্গল। নেতা-কর্তা খারাপ হলে দেশের-দশের সর্বনাশ। আদেশ পালন করা ছাড়া ব্যক্তি-মানুষ এবং জনসাধারণের জীবনধারণের তেমন কোনো তাৎপর্য এখানে নাই। কর্তৃত্ব-হুকুম-(অ)মঙ্গল এখানে একই ধারণাসূত্রে গাঁথা। যুদ্ধই এখানে শান্তি। দাসত্বই এখানে স্বাধীনতা। হিংসাই এখানে বন্ধুত্ব। অন্ধত্বই এখানে সত্যদৃষ্টি। অরওয়েলীয় দ্বৈতচিন্তা/দ্বৈতস্বরই এখানে বাকস্বাধীনতার সীমা (দ্রষ্টব্য: সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৩-ঘ)।

আর আমাদের উপলব্ধি যদি এই হয় যে মানুষ নিজেরা নিজেদেরকে পরিচালনা করতে সক্ষম এবং সেটাই কাঙ্ক্ষিত, তাহলে আর হুজুর-পুরুত-পাণ্ডা লাগে না। রাষ্ট্রশক্তির দাঁত নখ পেশী থাবা ছেঁটে ফেলাটাই তখন আসল কাজ। যে যেভাবে যতটা পারে সে সেভাবে ততখানি সেই কাজ করাটাই তখন আসল কথা। তথাকথিত বিপ্লব করতে গিয়ে সারাদেশ আত্মঘাতী দাবানল ছড়িয়ে দেওয়াটা তখন আর কাঙ্ক্ষিত নয়, বরং ঘুটঘুটে অন্ধকারে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো ছড়ানোই তখন জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জরুরি কর্মপদ্ধতি। এ পথে জ্ঞানই মুক্তির চাবিকাঠি। এ উপলব্ধি মোতাবেক স্বাধীনতার অর্জনের একমাত্র পথ স্বাধীনতা খোদ। স্বাধীনতা মানে ভুল করার এবং শুধরে নেওয়ার স্বাধীনতাও বটে।

প্রথম উপলব্ধি মোতাবেক উদ্দেশ্যটাই আসল। যেকোনো উপায়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আরোহন করাটাই মূল ঘটনা। যেকোনো পন্থাই বৈধ পন্থা। কেননা আমার বিশ্বাস, আমার মতাদর্শই একমাত্র খাঁটি বিশ্বাস, খাঁটি মতাদর্শ তাতে তো কোনো সন্দেহই নাই। আর দ্বিতীয় উপলব্ধি অনুসারে উপায়টাই আসল। যে উপায়ে আমি কাজ করি তা যদি আমার উদ্দেশ্যের সাথে মানানসই না হয়, তাহলে সে উপায় বৈধ নয়, কাঙ্ক্ষিত নয়। অহিংসায় পৌঁছানোর একমাত্র পথ এখানে অহিংসা স্বয়ং। সাম্য-সমাজে পৌঁছানোর একমাত্র পথ সাম্য-প্রণালীতে পরিচালিত আত্মসংগঠনতন্ত্র। (দ্রষ্টব্য: সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৩-গ।) একেই বলে ‘প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স’ বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি (দ্রষ্টব্য: ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-ক; ডেভিড গ্রেইবার, ২০১২-ক)।

প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি বলতে বোঝায়: যা আমি চাই তা এখনই পরিস্ফূট হয়ে উঠবে আমার এই মুহূর্তের কর্মপ্রণালীর মধ্য দিয়ে। এটা পরিস্ফূট হয়ে ওঠে সাংগঠনিক কর্মপ্রণালীর ভেতর দিয়ে। আজকের রাজনৈতিক সংগঠনই আগামী দিনের কাঙ্ক্ষিত সমাজ-সংগঠনের ক্ষুদ্র-কিন্তু-বাস্তব রূপ ফুটিয়ে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘সকল শ্রমিকের সংগঠন’ শ্রমিক-পরিচালিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড একেই বলে ‘পুরনো সমাজের খোলসের মধ্যে নতুন সমাজের বীজ অঙ্কুরিত করা’ (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, ২০১৩: ৩)। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ বৈঠক বন্ধ করে দেওয়া কিংবদন্তীর সিয়াটল-আন্দোলন (১৯৯৯) ছিল এই প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্সের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত – দেখিয়েছেন ডেভিড গ্রেইবার (২০০৪) তাঁর ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ অ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপোলজি’ বইয়ে।

সাম্প্রতিক ইউরোপ-আমেরিকা জোড়া অকুপাই আন্দোলনও এই ধরনের রাজনীতির অত্যুজ্জ্বল নজির (দ্রষ্টব্য: ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-ক; ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-খ; ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-গ)। ভয়ে ভয়ে পোকামাকড়ের ইতিহাসও বলি: আগস্ট বিদ্রোহে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষকদের মুক্তির দাবিতে এবং ‘মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন’ অর্জনের লক্ষ্যে রাবি-তে গড়ে ওঠা ‘কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে পরিচালিত ছাত্র-আন্দোলনও এই প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্সের অঙ্কুর হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে (দ্রষ্টব্য: আরিফ রেজা মাহমুদ টিটো, ২০০৮; আরিফ রেজা মাহমুদ টিটো ও পার্থ প্রতীম দাস, ২০০৮; পার্থ প্রতীম দাস, ২০০৮; রেজাউর রহমান প্রমুখ, ২০০৮; সেলিম রেজা নিউটন, ২০০৮-খ)।

প্রথম আন্তর্জাতিক: প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বনাম রাষ্ট্রপন্থা

যে ‘প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স’ বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতির কথা আমরা বলছিলাম, সে দিক থেকে দেখলে বিপ্লবীদের একটা মুখ্য বিবেচনা হওয়ার কথা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধনে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতার ভূমিকা কী হবে সে বিবেচনা। কর্নেল তাহের এবং তাঁর সাথী-অনুসারীরা তাঁদের নিজেদের ভাবধারা মোতাবেক যখন একটা বিপ্লবের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তখনও কিন্তু এই বিবেচনাটাই গোটা সেই বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের নির্ধারক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। তাঁদের পদ্ধতি-প্রণালী ও ভিশনের তাৎপর্য ভালো করে বোঝার দায় থেকে বিশেষত প্রথম আন্তর্জাতিকের ভেতরকার মার্কসবাদী রাষ্ট্রপন্থা এবং নৈরাজ্যবাদী মুক্তিপন্থার নিরিখে জন্য রাষ্ট্র-প্রশ্নটাকে একটু আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখে নিতে চেষ্টা করব।

আর্ট্ওয়ার্ক: দ্য পা্ওয়ার অব ট্রুথ সিরিজ
সূত্র: চাইনা ডেইলি

ইউরোপে শিল্পবিপ্লব-কালপর্বের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল ‘শ্রমজীবী মানুষদের আন্তর্জাতিক সমিতি’ ওরফে ‘প্রথম ইন্টারন্যাশনাল’। লন্ডনের সেইন্ট মার্টিন হলে ১৮৬৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এক গণশ্রমিক-সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয় এই প্রতিষ্ঠান। সেই সময়কার বৃটেন এবং ফ্রান্সের সবচেয়ে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। ঐ গণশ্রমিক-সভা আয়োজন করার ক্ষেত্রে কার্ল মার্কসের কোনো অংশগ্রহণ না থাকলেও প্রথম ইন্টারন্যাশনালের অস্থায়ী জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবং অচিরেই এর নেতৃত্বে আসীন হন। (দ্রষ্টব্য: ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ, ২০১৩।)

এই সমিতি গড়ে ওঠার পেছনে আছে সুদীর্ঘ আর্থ-সামাজিক-ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রীয় পটভূমি। অত কথা এখানে নয়। তারপরও অল্প কিছু কথা এখানে না বললেই নয়। কারণ এখনকার বাংলাদেশে বলশেভিক ধারার (বিশেষত তরুণ) বামপন্থীরা এই ইতিহাস নিয়ে তেমন চর্চা করেন না। এ নিয়ে যেটুকু কথাবার্তা তাঁরা নেতাদের মুখ থেকে শোনেন তাও এক প্রকার মুখস্ত ‘মার্কসবাদী’ ঘরানার একপেশে কেচ্ছা। তাই এ নিয়ে সামান্য দু-একটা কথা এখানে বলে রাখতে চাই। বলতে চাই আপাতত কমিউনিস্ট ইতিহাসপ্রণেতা জি. এম. স্টেক্লফের লেখা ‘প্রথম আন্তর্জাতিকের ইতিহাস’ বইটার তৃতীয় অধ্যায়টুকু অনুসরণ করে (জি. এম. স্টেক্লফ, ১৯২৮)।

সংক্ষেপে বললে, গোটা ইউরোপের শ্রমিকরা একটা আন্তর্জাতিক সমিতির প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। সব দেশেই তাঁদের আর্থিক দুরবস্থা ছিল মূলত একই ধারার। সব দেশেই তাঁরা একই ধরনের শোষণ-পীড়নের শিকার হচ্ছিলেন। তার মধ্যে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মতো অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোয় শ্রমজীবীদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা অনেক বেশি কঠোর হয়ে পড়েছিল মালিকপক্ষের নিষ্পেষণ ও নানা রকমের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে। এরই মধ্যে, আমরা বলছি ১৮৬০-এর দশকের কথা, পোলিশ জাগরণ এবং ইতালির জনসাধারণের মুক্তি-সংগ্রাম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী জনতারর মধ্যে সংহতিসূচক উদ্দীপনা তৈরি করেছিল, বিশেষত ফরাসী ও বৃটিশ শ্রমিকদের মধ্যে।

এ সময়, ১৮৬২ সালে, লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় কারখানা, প্রযুক্তি ও শিল্পকলা বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী। ৩৬টা দেশের ২৮০০০ মানুষ এই প্রদর্শনীতে অংশ নেয়। এই মেলায় আকৃষ্ট হয়েছিল ৬০ লক্ষ দর্শক। এই প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে গোটা ইউরোপ মহাদেশের শ্রমিকদের সাথে বৃটিশ শ্রমিকদের দেখাসাক্ষাতের উসিলা তৈরি হয়। ফ্রান্সের শ্রমিকরা, বিশেষ করে প্যারিস আর লিয়ন্সের শ্রমিকরা, তহবিল সংগ্রহ করতে শুরু করেন যেন ফরাসী শ্রমিকদের প্রতিনিধিদল এই মেলায় যেতে পারে। জার্মানি থেকেও শ্রমিক-প্রতিনিধিদল এই মেলায় আসেন। ১৮৬২ সালের ৫ই আগস্ট ফরাসী শ্রমিকদের ৭০ জনের প্রতিনিধিদলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান বৃটিশ শ্রমিক-কমরেডরা। এই অনুষ্ঠানে বেশি বেশি করে উচ্চারিত হয় শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক একটা সমিতি গঠনের প্রয়োজনের কথা। এ সময় লন্ডনে অনেক ফরাসী শ্রমিক-উদ্বাস্তু বসবাস করতেন। উপরন্তু, ঐ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে আসা ফরাসী শ্রমিকদের কেউ কেউ বৃটেনে থেকে যান স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য। এঁদের মাধ্যমে দুই দেশের শ্রমিকদের মধ্যে যোগাযোগটা অক্ষুণ্ণ থেকে যায়। অন্য দিকে, মার্কসকে কেন্দ্র করে একদল জার্মান শ্রমিক বৃটিশ শ্রমিক আন্দোলনের নেতাদের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ গড়ে তোলেন। তাঁরাও তুলে ধরতে থাকেন গোটা ইউরোপের শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার গুরুত্বের কথা।

এ দিকে রুশ সাম্রাজ্যের অধীশ্বররা যখন পোলিশ গণজাগরণকে রক্তগঙ্গায় ডুবিয়ে দেন, তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়েন বৃটেন ও ফ্রান্সের শ্রমিকরা। তাঁদের মধ্যকার যোগাযোগ নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকে। ১৮৬৩ সালের ২২ জুলাই ফরাসী শ্রমিকদের একদল প্রতিনিধি আবার আসেন বৃটেনে। তাঁরা আসেন তাঁদের কাছে বৃটিশ শ্রমিকদের পাঠানো পত্রের উত্তর নিয়ে। ঐ একই সন্ধ্যায় লন্ডনের সেইন্ট জেমস হলে পোল্যান্ডের মানুষদের সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফরাসী শ্রমিকরা। এইসব সভায় এবং আরো অন্যসব সভায় এই দুই দেশের শ্রমিকদের আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক একটা সমিতি গঠনের ব্যাপারে।

১৮৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যাণ্ড প্রশ্নে নতুন একটা সভা আয়োজনের উদ্যোগ যখন চলছিল, বেশ কিছু ফরাসী শ্রমিক-প্রতিনিধি তখন লন্ডনে আসেন। এবার তাঁরা আসেন সকল দেশের শ্রমিকদের মধ্যে তথ্য-যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়ার মতো বিশেষ একটা কমিটি গঠনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে। এই ফরাসী শ্রমিকদের স্বাগত-সম্বর্ধনা উপলক্ষে বৃটিশ শ্রমিক-সংগঠনগুলো আয়োজন করে বিরাট এক আন্তর্জাতিক সভা – ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে।

সভাটা অনুষ্ঠিত হয় সেইন্ট মার্টিন হলে। সভায় সভাপতিত্ব করেন দৃষ্টবাদী চিন্তক ও ইতিহাসের প্রফেসর এডওয়ার্ড স্পেন্সার বিজলি (কার্ল মার্কস ছিলেন এঁর বন্ধু)। শুরুতে বক্তৃতা করেন প্রফেসর বিজলি। তারপর বৃটিশ শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ফরাসী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ পড়ে শোনান শ্রমিকনেতা ওডগার। এরপর ফরাসী শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেন ফরাসী শ্রমিকনেতা তোলাইন। বক্তৃতা-টক্তৃতা হয়ে যাওয়ার পর সর্বসম্মতিক্রমে এই সভা একটা প্রস্তাব গ্রহণ করে শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক একটা সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে। ঠিক হয় যে এর কেন্দ্রীয় অফিস হবে লন্ডনে। ২১ সদস্যের একটা কমিটি নির্বাচিত হয়। কমিটির দায়িত্ব হয় সংগঠনের নিয়মকানুন ও গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা।

কমিটির বৃটিশ সদস্যরা ছিলেন ওডগার, হাওয়েল, অসবোর্ন, ল্যুক্রাফ্ট প্রমুখ খ্যাতনামা ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন ‘ওয়েনাইট’ (তথাকথিত ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রী দার্শনিক রবার্ট ওয়েনের অনুসারী), কেউ কেউ ছিলেন ‘চার্টিস্ট’। (চার্টিজম হচ্ছে ঊনবিংশ শতকের বৃটেনের প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কার-আন্দোলন। ১৮৩৮ সালের ‘পিপলস চার্টার’ এর নাম অনুসারে এঁদের নাম হয় চার্টিস্ট।) কমিটির ফরাসী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দুনুয়ালা, লু লুবেয, বুস্কে প্রমুখ। কমিটিতে ইতালির প্রতিনিধি ছিলেন ফোন্তানা। অন্য সদস্যরা ছিলেন মেজর এল. উল্ফ (ইনি ছিলেন ইতালির ঐক্য আন্দোলনের অবিসম্বাদিত নেতা জুযেপি মাৎজিনির সেক্রেটারি), ইকারিউস, প্রমুখ। কমিটির তালিকার একেবারে নিচে ছিল ‘ড. মার্কস’-এর নাম। শ্রমিক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর সুনাম, লন্ডনে তাঁর অবস্থান, এবং সম্ভবত প্রফেসর বিজলির সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব তাঁকে এই কমিটিতে স্থান পেতে সাহায্য করেছিল। অচিরেই, আপন গুণাবলীর সুবাদে মূল নেতৃত্বে আসীন হন তিনি প্রথম ইন্টারন্যাশনালের।

কমিটি বৈঠকে বসে ৫ই অক্টোবর। আরো নানা দেশের শ্রমিকনেতাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। গঠিত হয় ৩২ সদস্যের অস্থায়ী সাধারণ পরিষদ বা ‘জেনারেল কাউন্সিল’। কমিটির প্রথম কাজ ছিল ‘প্রথম ইন্টারন্যাশনাল’-এর কর্মসূচির রূপরেখা ঠিক করা এবং নিয়মকানুন ও গঠনতন্ত্রের খসড়া করা। একটা খসড়া উপস্থাপন করেন মেজর এল. উল্ফ। এটা ছিল ‘ইতালীয় শ্রমজীবীদের সমিতি’র নিয়মকানুন-গঠনতন্ত্রের অনুবাদ। দ্বিতীয় খসড়া পেশ করেন বিশিষ্ট চার্টিস্ট নেতা ওয়েস্টন। তৃতীয়টা পেশ করেন লু লুবেয। চতুর্থ খসড়াটা প্রণয়ন করেন কার্ল মার্কস। দীর্ঘ, প্রাণবন্ত আলোচনার পর গৃহীত হয় মার্কসের খসড়া। প্রথম ইন্টারন্যাশনালের আদি এই খসড়া আমাদেরকে রাষ্ট্র-প্রশ্নটাকে বিবেচনার সুযোগ করে দেয়। এবং এক্ষেত্রে তৈরি হয় পরস্পরবিরোধী দুই ধরনের বিবেচনাবোধ। একটা হচ্ছে রাষ্ট্র-রাজনৈতিক বিবেচনা, অপরটা আর্থ-সামাজিক বিবেচনা।

খসড়াটার প্রথম অংশ হচ্ছে ‘ঘোষণা’; পরের অংশ ‘অস্থায়ী নিয়মকানুন’। ঘোষণা-অংশে বলা হয়: ‘শ্রমজীবী শ্রেণীর মহান কর্তব্য হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা জয় করা’। পরবর্তী সময়ে লেনিনবাদী ধারার বলশেভিক পার্টিকে আমরা এই চিন্তাধারা মোতাবেক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার ওপর প্রাথমিকতম গুরুত্ব আরোপ করতে দেখেছি। এই চিন্তাধারা শ্রমিকশ্রেণীসমূহের ‘ভ্যানগার্ড পার্টি’ হিসেবে একটা লেনিনবাদী গঠনের সুযোগও তৈরি করে।

কিন্তু কমিটির বৈঠকে মার্কসের খসড়ার নিয়মকানুন অংশের শুরুতে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় একটা ‘প্রস্তাবনা’। এতে বলা হয়: ‘শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহের মুক্তি অর্জন করতে হবে অবশ্য-অবশ্যই খোদ শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহের দ্বারাই’। বিশেষ লক্ষণীয়: এতে করে শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে কোনো রাজনৈতিক পার্টি গঠনের অবকাশ থাকে না। কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয়ে ‘রাজনৈতিক’ সংগ্রাম করাটা শ্রমজীবীদের জন্য অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি কেবল শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব – এই নৈরাজ্যমুখিন চিন্তার বীজ আমরা দেখতে পাই এই চিন্তাধারার মধ্যে।

উপরন্তু এই ‘প্রস্তাবনা’য় বলা হয়: ‘সুতরাং শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহের অর্থনৈতিক মুক্তি হচ্ছে সেই মহান লক্ষ্য, প্রত্যেকটা রাজনৈতিক আন্দোলনকে একেকটি উপায় আকারে যে লক্ষ্যের অধীনস্ত থাকা উচিত হবে’। ‘প্রস্তাবনা’য় আরো বলা হয়, ‘শ্রমের মুক্তি’ একটা ‘সামাজিক সমস্যা’। তার মানে এটা কোনো রাজনৈতিক রূপান্তরের মামুলি প্রশ্ন নয়, এটা আসলে সমাজ-রূপান্তরের প্রশ্ন। পরবর্তী সময়ের গোটা আন্তর্জাতিক শ্রমিক-আন্দোলনের সমস্ত ধারাকেই আমরা দেখেছি ‘বিপ্লব’ বলতে ‘সামাজিক বিপ্লব’ বোঝাতে – রাজনৈতিক বিপ্লব নয়।

একটা জিনিস এখানে বিশেষভাবে খেয়াল করা দরকার। সূচনাপর্বে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল মোটেও কোনো মার্কসবাদী সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠে নি। এটা ছিল নানা দেশের নানা মতের নানা পথের শ্রমিক-আন্দোলন ও শ্রমিক-সংগঠনসমূহের একটা সাধারণ সমবায়। শুরু থেকেই এতে ছিলেন মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক সমাজ-তন্ত্রীরা, প্রুধোঁপন্থী মিউচুয়ালিস্টরা, ব্ল্যাঙ্কুইবাদী জঙ্গীপন্থীরা, এবং বাকুনিনপন্থী কর্তৃত্বতন্ত্রবিরোধী নৈরাজ্যবাদীরা। আরো ছিলেন জার্মানির লাসালপন্থীরা, বৃটেনের ওয়েনপন্থীরা ও চার্টিস্টরা, ইতালির মাৎজিনি-অনুসারী ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদীরা ইত্যাদি প্রভৃতি নানান মতপথের শ্রমজীবীরা।

বেশি দিন টেকে নি প্রথম ইন্টারন্যাশনাল। এর মতো বহুমত বহুপথের একটা সংস্থাকে পরিচালনার জন্য যে ধরনের উদার মনোভাব এবং স্বাধীনতা-স্বশাসনপন্থা অনুসরণ করার দরকার ছিল, কার্ল মার্কসের আত্ম-অভিমানী প্রকৃতি তার উপযোগী ছিল বলে মনে হয় না। উপরন্তু তাঁর কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বভিত্তিক সংগঠনচিন্তা ইন্টারন্যাশনালকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়। ১৮৭৬ সালে, প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মাথায়, বিলুপ্ত হয়ে যায় এই বহু আকাঙ্ক্ষিত এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এই এক যুগ কালপর্ব ছিল অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক এই শ্রমিক-সংগঠন গোটা ইউরোপের এবং আমেরিকার ক্রমবিকাশমান পুুঁজিবাদকে প্রতিদিন চ্যালেঞ্জ করছিল। একেবারে মোক্ষমভাবে। এই প্রথম ইন্টারন্যাশনালই শ্রমিকদের সামনে প্রথম পরিষ্কারভাবে হাজির করতে পারে: শ্রমিকরা, যদি চায়, তাহলে পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারে।

প্রথম ইন্ট্যারন্যাশনালের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে যায়। আমাদের আপাত-আলোচ্য প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্সের প্রসঙ্গে এবং সামাজিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কীভাবে বিবেচনা করব সেই প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটা হলো: শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নিতে যদি পারে, তার পরে সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণ হবে কেমন করে। তখন মার্কস-এঙ্গেলসদের ধারা শক্তিশালী ছিল প্রধানত ইংল্যান্ড এবং জার্মানির শ্রমিক-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। বলতে গেলে এই দুইটা দেশের শ্রমিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই মার্কস এবং এঙ্গেলসের জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারা গড়ে ওঠে। এই ধারা মনে করত, আমরা – কমিউনিস্টরা, শ্রমিকরা – রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করব, এবং রাষ্ট্রক্ষমতার নিপীড়ন করার যে ক্ষমতা আছে (সেনাবাহিনী আছে, পুলিশ আছে, বলপ্রয়োগ করার নানান অ্যাপারেটাস আছে, যন্ত্রপাতি আছে) – সেই যন্ত্রপাতিগুলো আমরা আমাদের কব্জায় নেব। এবং আমরা এই যন্ত্রপাতিগুলোকে আমাদের মতো করে প্রয়োগ করব পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে – তাঁদের এতকালের অর্জিত শক্তি-কাঠামোকে একদম চিরতরে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

অন্য দিকে প্রথম ইন্টারন্যাশনালের একটা বিরাট অংশ – স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড (নেদারল্যান্ড), বেলজিয়াম – এই দেশগুলো থেকে আসা শ্রমিক-আন্দোলন এবং তাদের সংগঠনের প্রতিনিধিরা একটা বিকল্প ধারা বা ধারণা দাঁড় করান। সেই ধারণাটা হচ্ছে: একবার আপনি যদি লঙ্কায় যান তাহলে আপনি রাবণে পরিণত হবেন। আপনি যত মহান ব্যক্তিই হন এবং আপনার উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক, একবার যদি আপনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন এবং রাষ্ট্রের এই বলপ্রয়োগ করার মেশিনগুলোকে প্রথম সুযোগেই ধ্বংস করে না দিয়ে নিজের হাতে নেন, তাহলে আগামীকাল আপনি (এক বছরের মধ্যে, বা ছয় মাসের মধ্যে) স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হবেন; জারের চাইতে বড় জারে পরিণত হবেন। এই ধারার অন্যতম বড় গলা ছিলেন রুশ বিপ্লবী মিখাইল বাকুনিন।

মিখাইল বাকুনিন
(১৯১৪-১৮৭৬)

তো, বাকুনিনরা বলতেন: বিদ্যমান রাষ্ট্র – তার সেনাবাহিনী, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র, মন্ত্রীসভা, সংসদ – তার যত রকমের বলপ্রয়োগ করার মেশিন আছে, প্রথম সুযোগেই সেই যাবতীয় মেশিনপত্রকে ধ্বংস করে দিতে হবে। এবং এর জায়গাতে এর বিকল্প হিসেবে কোনো বৈপ্লবিক সংসদ, কোনো বৈপ্লবিক সেনাবাহিনী, কিংবা কোনো বৈপ্লবিক পুলিশবাহিনী আমরা গঠন করব না। একবার যদি রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের দিকে শ্রমিক-আন্দোলন যায়, তাহলে গত পাঁচ হাজার বছরের বলপ্রয়োগের যে রাজনীতি (রাজনীতি মানেই বলপ্রয়োগের রাজনীতি), পাঁচ হাজার বছরের যে কর্তৃত্বতন্ত্র সেগুলোই সমাজে নব উদ্যমে ফিরে আসবে। এই ধারার রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিথ্যা। অনেক পরের বলশেভিক ‘সমাজতন্ত্র’ বাকুনিনদের এই দাবিকে নির্মমভাবে সত্য প্রমাণ করেছিল ৭০ বছর ধরে – আমরা দেখেছি।

সামাজিক বিপ্লবকে এই মুক্তপরায়ণ সমাজতন্ত্রীরা আগামীকালের ঘটনা মনে করতেন না। এঁরা মনে করতেন আমি যে বৈপ্লবিক রূপান্তর চাই সমাজের, তা আমার বর্তমান চাওয়াচাওয়ির কর্মপ্রণালীর মধ্যেই প্রতিফলিত হতে হবে। আগামীকাল যে শুভ-সুন্দর-ন্যায়পরায়ণ সমাজ আমি চাই আমার আজকের সংগঠন-প্রণালীই তার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে যদি না তোলে তাহলে আমাদের পক্ষে অন্তত ঐ রকমের একটা সমাজগঠনের চিন্তা স্রেফ মুখের বুলি হয়েই থাকবে। এই বুলি হবে আর সব ভাঁওতাবাজির বুলির মতোই যার লক্ষ্য ভালো ভালো কথা বলে রাষ্ট্র-রাজনৈতিক ক্ষমতাটাকে কুক্ষীগত করা। তারপর আমি যা করব সেটাই হবে ‘সমাজতন্ত্র’।

সুতরাং, ‘প্রথম ইন্টারন্যাশনাল’-এর মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রীরা এই প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্সের প্রশ্নটাকে বড় করে সামনে এনেছিল। ইন্টারন্যাশনালের মুক্তিপরায়ণ সেকশনগুলো ১৮৭১ সালে সুইজারল্যান্ডের সনভেলিয়ায় কংগ্রেসে মিলিত হয়। ইন্টারন্যাশনালের নয়টা সেকশনের ষোলো জন প্রতিনিধির এই ‘সনভেলিয়া কংগ্রেস’ একটা সার্কুলার পাঠায় ইন্টারন্যাশনালের অন্তর্ভুক্ত সকল ফেডারেশনের কাছে। (দ্রষ্টব্য: মার্কস-এঙ্গেলস, ১৮৭২)। ‘সার্কুলার অফ দ্য সিক্সটিন’ বা ‘ষোল জনের সার্কুলার’ নামে পরিচিত এই দলিলে বলা হয়:

ইন্টারন্যাশনাল তার নিজের জন্য যে গঠনবিন্যাসটা তৈরি করেছে, ভবিষ্যতের সমাজ হবে – আবশ্যিকভাবে – সেটারই সর্বজনীন চেহারা। এ ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। তাহলে অবশ্যই আমাদের এই সংগঠনকে এমন যত্নের সাথে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে তা আমাদের আদর্শের যতটা সম্ভব কাছাকাছি যায়। কর্তৃত্বতান্ত্রিক একটা সংগঠনবিন্যাস থেকে সমতাপরায়ণ ও মুক্ত একটা সমাজ বেরিয়ে আসবে – এমনটা কেউ চাইতে পারেন কেমন করে? এটা অসম্ভব। ইন্টারন্যাশনাল যেহেতু ভবিবষ্যতের মানবসমাজের ভ্রুণ, এখন থেকেই একে তাই হয়ে উঠতে হবে আমাদের স্বাধীনতা-নীতি আর ফেডারেশন-নীতির বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি। এবং একে তাই প্রত্যাখ্যান করতে হবে এমন যেকোনো নীতিকে যা হয়ে উঠতে পারে কর্তৃত্ব-প্রবণ বা স্বৈরতন্ত্র-প্রবণ। (কে. জে. কেনাফিক, ১৯৪৮: ২৬২-২৬৩)

এরও আগে, ১৮৬৯ সালে, মিখাইল বাকুনিন লিখেছিলেন,

ইন্টারন্যাশনালের গঠনবিন্যাস রাষ্ট্রের গঠনবিন্যাস থেকে পুরোপুরি আলাদা হবে। কারণ, এর লক্ষ্য নতুন নতুন রাষ্ট্র তৈরি করা নয়, বরং সকল বিদ্যমান সরকার-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। রাষ্ট্রের ক্ষমতা যত কৃত্রিম, নিষ্ঠুর আর কর্তৃত্বপরায়ণ হবে, রাষ্ট্র যত বেশি উদাসীন ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে জনসাধারণের স্বাভাবিক বিকাশধারা, স্বার্থ আর আকাঙ্ক্ষার প্রতি – তত বেশি করে স্বাধীন আর স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক হয়ে উঠতে হবে ইন্টারন্যাশনালের গঠনবিন্যাসকে। তত বেশি করে একে ধারণ করতে জনসাধারণের স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে আর আদর্শসমূহকে। (মিখাইল বাকুনিন, ১৮৬৯)

এভাবে, ইন্টারন্যাশনালের গঠনবিন্যাসের প্রশ্নে, ইন্টারন্যাশনাল পরিচালনার পদ্ধতির প্রশ্নে, এবং সমাজতন্ত্রের সাথে স্বাধীনতা ওতপ্রোত সম্পর্ক বিচারের প্রশ্নে বাকুনিনদের সাথে মার্কসদের মৌলিক মতপার্থক্য তৈরি হয়। এরই পরিণামে হেগে অনুষ্ঠিত ১৮৭২ সালে মার্কসদের ‘কেন্দ্রায়িত সমাজতন্ত্র’ আর বাকুনিনদের নৈরাজ্যবাদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভেঙে যায় প্রথম ইন্টারন্যাশনাল (ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ, ২০১৩)। ইন্টারন্যাশনাল থেকে বহিষ্কার করা হয় বাকুনিনদেরকে – স্পেন সুইজারল্যান্ড ফ্রান্স ডেনমার্ক নেদারল্যান্ডসের মার্কসবাদ-বিরোধী পুরো ধারাটাকে।

বহিষ্কার করা হয় তহবিল তসরুপের নাম দিয়ে, গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ তুলে, উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি করার দোষারোপ করার মাধ্যমে। এই ধারাট ছিল অনেক শক্তিশালী। মার্কসের চিন্তাধারা দ্বারা অধিকতর মাত্রায় প্রভাবিত ইংল্যান্ড এবং জার্মানির শ্রমিক আন্দোলনের থেকে পরিমাণে-সংখ্যায়-
আয়তনে-লিটারেচারে অনেক বড় একটা ধারা। এবং এই ধারাকে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল থেকে যখন বহিষ্কার করে দেওয়া হলো, তার তিন-চার বছরের মধ্যেই প্রথম ইন্টারন্যাশনাল শক্তিশূন্য হয়ে পড়ে। উপরন্তু, বাকুনিনরা পাছে এই প্রথম ইন্টারন্যাশনালে নতুন করে প্রভাব বিস্তার করে ফেলে, তাই এর প্রধান কার্যালয় লন্ডন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় নিউ ইয়র্কে – মার্কসের উদ্যোগে (ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ, ২০১৩)। পরের ক-বছর ধরে কোনো রকমে টিকে থাকার পর শেষে ১৮৭৬ সালে ফিলাফেলডিয়া সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করা হয় প্রথম ইন্টারন্যাশনালকে। নৈরাজ্যপন্থীদেরকে বহিষ্কার করা, প্রধান কার্যালয় লন্ডন থেকে সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি কারণ তো ছিলই – প্রথম ইন্টারন্যাশনাল বিলুপ্ত করে দেওয়ার আরো একটা কারণ ছিলেন মার্কস নিজেও। এসময় তিনি ইন্টারন্যাশনালের কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন, আর বেশি করে মন দিচ্ছিলেন পুঁজি সংক্রান্ত গবেষণা-অধ্যয়নে (অ্যানার্কোপিডিয়া, ২০০৮)।

প্রথম ইন্টারন্যাশনাল যতদিন ছিল, তার মধ্যে দ্ইুটা ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কথা সত্য যে তাত্ত্বিক হিসেবে, পুঁজি গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে, ইউরোপের শ্রমিকদের মহান সংগঠক হিসেবে গোটা ইন্টারন্যাশনালের কাছে, সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন কার্ল মার্কস। উপরোক্ত তর্কগুলো যখন চলছিল প্রথম ইন্টারন্যাশনালে, যখন বাকুনিনদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখনও বাকুনিন নিজে কাল মার্কসের ক্যাপিটাল প্রথম বারের মতো রুশ ভাষায় অনুবাদ করছেন, এবং লিখছেন যে ক্যাপিটাল প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য অবশ্যপাঠ্য। (মার্কসের এবং এঙ্গেলসের রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহারের প্রথম রুশ অনুবাদ করেছিলেন বাকুনিন ১৮৮২ সালে।) তার মানে তাত্ত্বিক হিসেবে ও গুরু হিসেবে এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে একটা মোটামুটি ‘বিজ্ঞান-সম্মত’ পাটাতনের ওপর দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে মার্কসের ভূমিকা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু মার্কস-কথিত ‘জনগণের রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করার তত্ত্বের সঙ্গে যাঁরা একমত ছিলেন না, তাঁদের দিক থেকে স্পষ্ট একটা ধারণা গড়ে ওঠে এই মর্মে যে: সমাজতন্ত্র নামে যে শ্রমিক-আন্দোলন ইউরোপ-
আমেরিকাতে আছে তার মধ্যে আছে আসলে দুইটা পরিষ্কার ধারা। একটা হচ্ছে ‘কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্র’। অন্যটা ‘মুক্তিপরায়ণ সমাজতান্ত্রিক’ ধারা। কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্র বিদ্যমান রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রুলিং ক্লাসকে উচ্ছেদ করে দিয়ে নিজেরাই রাষ্ট্রটাকে কব্জা করে নিজেদের মতো করে পরিচালনা করার কথা ভাবতো। প্রকারান্তরে এঁরা বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র নিরপেক্ষ একটা মেশিন। মেশিনটা যাঁরা পরিচালনা করবেন, সেই অনুসারে তা পরিচালিত হবে এবং সেরকম চরিত্র ধারণ করবে। পরিচালকরা যা চান, রাষ্ট্র তাই করবে, সেরকমই হবে। মুক্তিপরায়ণ সমাজ-
তন্ত্র মনে করত রাষ্ট্রের নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। এর প্রধান চরিত্র বলপ্রয়োগ করা, প্রতিপক্ষকে দমন করা। শুধু শ্রেণীগত প্রতিপক্ষই নয়, রাষ্ট্রের যেকোনো প্রতিপক্ষকেই। এমনকি সেই প্রতিপক্ষ যদি রাষ্ট্র-পরিচালক তথা রাষ্ট্র-ম্যানেজারদের নিজ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তও হয়ে থাকেন। সুতরাং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তার সাহায্যে সমাজপরিবর্তন করতে যাওয়াটা আত্মঘাতী একটা পদ্ধতি।

তো, এই কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রের ধারাটাই আমাদের মতো দেশগুলোর আজকের দিনের বলশেভিক-রাজনীতির বীজ। আজকে আমরা যাকে বলশেভিক-বামপন্থা বলি আর কি। ১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়াতে বলশেভিক পার্টির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের বিপ্লবের পর থেকে সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র মানেই হচ্ছে এই লেনিনবাদী, কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্র। কর্নেল তাহেরও এই মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট ধারা থেকেই গড়ে ওঠা, বিকশিত হয়ে ওঠা, এই রকমের একটা পরিবারের মধ্য থেকেই বেড়ে ওঠা মানুষ। পরবর্তী সময়ে এই ধারার কমরেডদের সঙ্গেই যোগাযোগ করে তিনি তার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সূচনা ঘটান।

শাস্ত্র, সায়েন্স এবং স্বাধীনতা

কর্নেল তাহের এর আগে, পঁচাত্তরের অনেক আগে, সিরাজ শিকদারের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেছিলেন। সিরাজ শিকদার পলিটিক্যাল ক্লাস নিতেন, কর্নেল তাহের মিলিটারি ট্রেনিং দিতেন। (মিলিটারির সাথে পলিটিক্সের এই সংমিশ্রণই পরবর্তী বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ইতিহাস রচনা করেছে।) এভাবে তাঁরা কাজ করছিলেন। এক পর্যায়ে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে তাঁদের বনিবনা হয় না। সিরাজ শিকদারই বলতে গেলে কর্নেল তাহেরের কাছ থেকে দূরে সরে যান। সিরাজ শিকদার অভিযোগ তোলেন যে কর্নেল তাহের একজন মিলিটারি অফিসার। এবং একজন পেটিবুর্জোয়া মিলিটারি অফিসারের পক্ষে বিপ্লবী হওয়া সম্ভব না। তাঁকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। কিন্তু, তাহেরকে আমরা যারা চিনি তাঁরা জানি যে, তাহের সেই ছোটবেলা থেকে একটা সামরিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তাহের বিভিন্ন স্কুলে পড়েছেন। তাঁর বাবা ছিলেন রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার। সেই কারণে আজকে এখানে কালকে ওখানে বদলি হয়ে হয়ে যেতে হয়েছে তাঁদেরকে। চট্টগ্রামে তাহের তখন পড়ছেন, যখন তিনি মেট্রিক পাশ করেন নি, তাঁর স্কুলের টিচার (মাস্টারদা সূর্যসেনের একজন প্রত্যক্ষ সহকর্মী তাহেরদের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন) ক্লাসরুমে ঐ ‘কোমলমতি’ ছেলেমেয়েদেরকে, তের-চোদ্দ-পনের বছরের বাচ্চাদেরকে, শেখাতেন যে তোমাদের মতো বয়েসেই আমরা বৃটিশ সাম্রাজ্যকে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি বলতেন, আমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্র ছিলাম। তাহেরকে বলতেন, তোমাদের বয়েসী আমরা ছিলাম তখন। তাহের ছিলেন সেই গল্পের প্রতি সেই ইতিহাসের প্রতি অনেক উৎসুক। এবং তাঁর ঔৎসুক্য দেখে সূর্যসেনের সেই কমরেড, জালালাবাদ পাহাড়ের বিপ্লবের অন্যতম প্রত্যক্ষ, সম্মুখযোদ্ধা, তাহেরকে নিয়ে, ঐ ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে যান। দেখাতে থাকেন: জালালাবাদ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে কোথায় সূর্যসেন যুদ্ধ করেছেন, কোথায় কোথায় দাঁড়িয়ে তাঁরা পজিশন নিয়েছেন, কীভাবে কীভাবে তাঁরা পরাজিত হয়েছেন, কীভাবে কীভাবে তাঁরা জিতেছিলেন, কীভাবে তাঁরা তাঁদের জয় রক্ষা করতে পারেন নি। স্বপ্নের বীজ তাহেরের মাথার মধ্যে বুনে দেন তিনি।

তার আগে থেকেই মায়ের সূত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মন্ত্র পেয়েছিলেন তাহের। খুব অল্প বয়েসে, চট্টগ্রামের এ ঘটনারও আগে, তাহেরকে আমরা দেখেছি, একটা ডাকাত ডাকাতি করে ফিরে যাচ্ছে, কর্নেল তাহের একা, ছোট বাচ্চা, খালি হাতে সেই ডাকাতের সামনে গিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছেন, চ্যালেঞ্জ করছেন। মারামারি করছেন (অন্য একটা ঘটনায়)। তো, এই তাহেরকে আমরা দেখি, একেবারে ছোট বেলা থেকে উনি একটা যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছেন। এবং এই যুদ্ধ করার জন্যই, যুদ্ধ শেখার জন্য তাহের সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। সামরিক বাহিনীতে যাব, যুদ্ধ কেমন করে শিখব, সব ভালো মতো শিখে সামরিক বাহিনী ছেড়ে বাইরে আসব, জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে আমার দেশকে আমি পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্ত করব। আর, সিরাজ শিকদার মনে করছেন, তাহের হচ্ছেন পেটি বুর্জোয়া আর্মি অফিসার।

সিরাজ সিকদার
১৯৪৪-১৯৭৫

খেয়াল করে দেখবেন: সিরাজ শিকদারকে খাটো করে দেখারও কিন্তু এক চুল জায়গা নাই। সিরাজ শিকদার আমাদের আরেক রূপকথার নায়কদের একজন। এরকম অজস্র রূপকথার নায়কদেরকে নিয়ে, আমি বলেছি, আমরা রূপকথার যুগ পার হয়ে এসেছি। সত্যিকারের রূপকথার যুগ। এটা আসলে রূপকথা ছিল না, বাস্তব ছিল। সিরাজ শিকদারের মাথায় ছিল একটা বলশেভিক থিওরি। শাসক ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রের মতো। ব্রাহ্মণদেরকে যেমন করে তাঁদের শাস্ত্র, তাঁদের মনুসংহিতা গাইড করেছে তেমনই। মনুসংহিতায় যা লেখা আছে তার বাইরে ব্রাহ্মণেরা যাবেন না। মনুসংহিতায় যা লেখা আছে, তার মানে ব্রাহ্মণেরা বোঝেন অথবা না বোঝেন সেটাই মেনে চলবেন। তাঁরা প্রধানত না বুঝেই হাজার পাঁচেক বছর ধরে ঘাড়ে করে মনুসংহিতা বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন। মনে করেছেন: জীবনের চাইতে শাস্ত্র বড়। জীবনের চাইতে সায়েন্স বড়। জীবনের চাইতে ‘সত্য’ বড়। যে ‘সত্য’ আমি চিনেছি। আমার যেটা শাস্ত্র, আমার যেটা ডগমাটিজম, আমার যেটা অন্ধত্ব – সেটাই হলো ‘আমার সত্য’; ‘আমার সায়েন্স’। এই সায়েন্সের বাইরে ব্রাহ্মণরা (সারা পৃথিবীর সর্বপ্রকার ব্রাহ্মণ) এক চুলও সরেন নি। সাধারণ মানুষকে রাস্তা দিয়ে শুধু হেঁটে যাওয়ার অধিকার অর্জন করার জন্য, সাধারণ মানুষ যেন তার নিজের ছায়া নিয়ে সংকুচিত না থাকে তার জন্য লড়াই করতে হয়েছে তাদেরকে। নিজের ছায়াটুকুর স্বীকৃতি অর্জন করার জন্য! (এই ছায়া ব্রাহ্মণের গায়ে পড়ে গেলে তো  সর্বনাশ! প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, হয়ত মেরে ফেলা হবে, হয়ত গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, হয়ত একঘরে করে ফেলা হবে।) বলশেভিকরাও শ্রেণীসংগ্রামের জগতে নিজেদেরেক এরকম উন্নত, নেতৃস্থানীয়, ভ্যানগার্ড ব্রাহ্মণই ভাবতেন বটে।

এই শাস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই-ই তো মানবজাতির মুক্তির লড়াই। মানবজাতির যেটাকে আমরা আমরা সভ্যতা বলি, যেটাকে আমরা সংস্কৃতি বলি, যেটাকে আমরা আমাদের স্বপ্ন বলি, স্বাধীনতা বলি, মুক্ত যে জীবনের কথা বলি, সেটা অর্জন করার জন্য মানবজাতিকে বারো হাজার বছর ধরে কোনো না কোনোভাবে শাস্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে।

সিরাজ শিকদারের মাথায় ছিল শাস্ত্র। বলশেভিক শাস্ত্র। সেই শাস্ত্র বলে দিচ্ছে যে কর্নেল তাহের একটা পেটিবুর্জোয়া আমি অফিসার। পাকিস্তানী আর্মির মতো নিপীড়ক আর্মির অফিসার। এই শাস্ত্রকে সিরাজ শিকদার শাস্ত্র হিসেবে চেনেন নি। তিনি তাকে মনে করেছেন সমাজবদলের সায়েন্স। মজার কথা হচ্ছে, সেই সায়েন্স মতে, কর্নেল তাহের বিপ্লবী না, পেটিবুর্জোয়া লোক। তাহলে আমরা, এক কথায়, দেখতে পাচ্ছি, তাহেরের জীবন থেকে আমি এক নম্বর এইটা শিখলাম যে শাস্ত্রের চাইতে প্রকৃত ব্যক্তি এবং তার কর্মকাণ্ড অনেক বেশি জরুরি।

কিন্তু আনফর্চুনেটলি কর্নেল তাহের সেই চে গুয়েভারার সমর্থকই ছিলেন, যে চে গুয়েভারা কিউবাতে বিপ্লব হবার পরে প্রথম ফায়ারিং স্কোয়াডগুলোতে নিজে হাতে গুলি করে মানুষকে মেরেছেন; যে চে গুয়েভারা কিউবাতে প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলি দাঁড় করান, রাশিয়ার মতো। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো ছিল দাসদের ক্যাম্প, যেখানে সমস্ত লোককে, যাকেই মনে হচ্ছে বিপ্লবের বিরুদ্ধে, যাকেই মনে হচ্ছে আমার পক্ষে না, তাকেই বন্দি করে রাখা হতো। মানুষ বড় ছিল না। বড় ছিল: আমার প্রতি অনুগত কে, অনুগত কে না। যে আমার প্রতি অনুগত না, সে-ই বিপ্লবের শত্রু। তাকে নিয়ে আমি কী করব? তাকে নিয়ে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আমি ঢোকাবো। সারা জীবন জেল খাটবে সে। পরিশ্রম করবে। তাতে করে উৎপাদন হবে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উৎপাদন দাঁড়াবে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশন দাঁড়াবে এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দাসদের, দাস-শ্রমিকদের, সাধারণ শ্রমিকদের শ্রমে – যার জন্য বিপ্লব, যাদের মুক্তির জন্য বিপ্লব।

যে জেলখানা ভেঙে ফেলার জন্য বিপ্লব, সেই জেলখানা নিয়েই বলশেভিক সমাজতন্ত্র দাঁড়িয়েছে। আপনারা জানেন। আমি বাড়াচ্ছি না আর। রাশিয়া ছিল সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় জেল সিস্টেম। কিউবা ছিল ল্যাটিন আমেরিকার সব চেয়ে বড় প্রিজন ক্যাম্পগুলোর একটা, প্রিজন সিস্টেমগুলোর একটা। আমাদেরকে – আমি শুধু এক কথায় বলি – আমাদেরকে এই গোটা বলশেভিক ধারা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আমাদের কোনো ভুল ছিল না। আমরা যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, আমাদের পূর্বসূরীরা (তাহেরকে আমার ব্যক্তিগতভাবে বড় ভাই মনে হয়, বা এরকম অনেক মানুষকে) যাঁরা আমাদের মাত্র এক প্রজন্ম আগের মানুষ, তাঁদের কোনো ভুল ছিল না। তাঁদের পুরো যুগটা দেখবেন। ভিয়েতনামে হোচিমিন। এগারো-বারো-তেরো বছর ধরে স্বাধীনতা-যুদ্ধ চলছে। স্বাধীনতা-যুদ্ধ আস্তে আস্তে সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতৃত্বে একটা র‌্যাডিক্যাল লড়াইয়ে পরিণত হচ্ছে। এই কিউবা, ভিয়েতনাম, চীন, রাশিয়া, আলবেনিয়া – এদেরকে দেখে দেখে তাহেররা বড় হয়েছেন। আমরা এদের কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। আমাদের গোটা যুগটাই তো বলশেভিকদের যুগ। ১৯১৭ সালের পরে আমরা অন্ধ ঈমান এনেছিলাম: আমাদের ‘নবী’ আছে, আমাদের ‘রসুল’ আছে, আমাদের ‘ধর্মগ্রন্থ’ আছে, আমাদের ‘মক্কা’ আছে, ‘বেহেশত’ পৃথিবীতে আমরা তৈরি করেছি সোভিয়েত ইউনিয়নে। সুতরাং আমাদের এখানে কাজ হচ্ছে: ‘জাস্ট টু ফলো’। শুধু অনুসরণ করে যাও। তাহলে পরেই তুমি মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাবে। কিন্তু, এই অন্ধ অনুসরণ – এটা যে আমাদেরকে অন্ধত্বের পথে নিয়ে যাবে এইটা আমরা ভাবিই নি।

সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে খোদ কার্ল মার্কসকে যে ধরনের মতামতগুলো মোকাবেলা করে করে দাঁড়াতে হচ্ছিল, সেই মুক্তিমুখিন সমাজতন্ত্রের বিপুল ইতিহাসকে আমাদের সামনে আনতে পারে নি এই অন্ধ অনুসরণ। ১৯১৭ সালের পরে আমরা পৃথিবীতে পেয়েছি দুইটা সাম্রাজ্য। একটা মার্কিন সাম্রাজ্য। একটা হচ্ছে সোভিয়েত সাম্রাজ্য। দুই সাম্রাজ্য একইরকম পদ্ধতিতে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছে: গুপ্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিশাল প্রিজন সিস্টেম, দাসপ্রথা, লেবার ক্যাম্প, এগুলোর ভিত্তিতে। এইটা জেল-সমাজতন্ত্র। রাশিয়াতে গড়ে উঠেছে। চীনে গড়ে উঠেছে। এ ধারার প্রত্যেকটা ‘কমিউনিস্ট’ দেশে গড়ে উঠেছে।

আমার নিজেরও কিন্তু জন্ম হয়েছে একটা বলশেভিক পরিবারে। জন্মের পর মানুষ, বাচ্চারা, যে খেলনা নাড়াচাড়া করে … আমি বিশিষ্ট্য প্যাকেটমোড়ানো লেনিনগ্রন্থ নিয়ে খেলতে খেলতে বড় হয়েছি। বইয়ের শুরুতে তাঁর ছবির ওপরে পাতলা ফিনফিনের কাগজের ঈষৎ-অস্বচ্ছ পর্দা থাকত। পবিত্র একটা অনুভূতি হতো। আমরা এই বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ এই বলশেভিক ধারার সমাজতন্ত্রের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে, কোনো না কোনো দিন, কোনো না কোনো নামে, কোনো না কোনো চিহ্ন নিয়ে, কোনো না কোনো নেতার অধীনে লড়াই করেছি। আমরা সবাই জীবন দান করার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলাম।

কর্নেল তাহেরকে দেখেছি, তার গণবাহিনীর লোকদেরকে দেখেছি, এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেখেছি, শুধু কী করতে হবে বলে দেন। তার জন্য আমি মারা যেতে উদগ্রীব। বাচ্চার কী হবে, বউয়ের কী হবে, আমার পরিবারের কী হবে, কিচ্ছু ভাবেন নি এঁরা। মানুষ বড় হয়ে গিয়েছিল। মনুষ্যত্ব তার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু সেই মনুষ্যত্বকে নিয়ে আমরা আমাদের স্বপ্নের একেবারে দারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েও ব্যক্তি ও সমাজের প্রকৃত স্বাধীনতার জায়গাটাকে ধরতে পারি নি।

কেন নিতে পারি নি? সেটা দেখার জন্য যদি পেছনে তাকাই, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই মার্কসিজম-লেনিনজম নিয়ে আরেকবার ভাবতে হবে। কার্ল মার্কসের নিন্দা করা মানে আমার নিজেকে নিন্দা করা। বলশেভিজমকে অন্ধ বলা মানে আমাকে অন্ধ বলা। আমরা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজকের অন্যতম আলোচক (নাজমুল হক) প্রধান ভাইদের সঙ্গে এক সঙ্গে রাস্তায় হাত ধরাধরি করে আমরা দশটা বছর পার করে দিয়েছি। আমাদের গোটা স্টুডেন্ট লাইফ। আমরা মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি বা দেব দেব করছি, এরশাদ সাহেব ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন। আমরা মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তার আগে আমরা এরশাদ সাহেবকে বিদায় করেছি। আমাদের জেনারেশনের গোটা জীবনটাই গেছে রাস্তায়। কেডস পরে। এক ধরনের একটা যুদ্ধের মধ্যে। পিকেটিঙের মধ্যে। লড়াইয়ের মধ্যে। আমাদের বন্ধুরা মারা গিয়েছেন। জাসদের, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের। মানুষরা লড়াই করেছে। মারা গেছে। আমার ঘনিষ্ট বন্ধুরা, প্রধান ভাইয়ের ঘনিষ্ট বন্ধুরা, আমরা লড়াই করেছি, মারা গেছি, নানাভাবে পঙ্গু হয়েছি, আহত হয়েছি, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। আমি আমার নিজের সমালোচনা করছি। আমি তাহেরের সমালোচনা করছি না।

তাহেরের কাছ থেকে কী শিখতে পারি আমরা?

তাহেরের কাছ থেকে আমাদের যা শেখার, সেটা শিখে নিতে হবে। কী শিখতে পারি আমরা? ব্যক্তি কী হতে পারে তার মাপ পেতে পারি আমরা। মনুষ্যত্ব নামের বিরাট একটা ধারণা মানুষকে কত বড় করে ফেলতে পারে – তাহেরকে দেখে তা শিখতে পারি। আরো অনেককে দেখে শিখতে পারি। এই গোটা জেনারেশনটাকে দেখে আমরা শিখতে পারি। তাহেরকে দেখে শিখতে পারি আমরা যা অনুসরণ করছিলাম তা একটা অন্ধ শাস্ত্র। তাকেই আমরা মনে করেছি সমাজ বদলের সায়েন্স। অকাট্য বিজ্ঞান মনে করেছি। এবং সেই বিজ্ঞান আমাদের পকেটে আছে আমরা তাই মনে করেছিলাম। আমরা শুধু হুজুর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। তাহের নিজে পর্যন্ত একটা উপযুক্ত পলিটিক্যাল লিডার খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তাহের শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন যে কে পলিটিক্যালি গাইড করতে পারে। সিরাজুল আলম খানের কাছে তিনি গিয়েছেন। জাসদের কাছে তিনি গিয়েছেন।

কর্নেল তাহেরের আত্মত্যাগ, তার সাহসিকতা – এগুলো খুব স্বাভাবিক মনুষ্য-গুণাবলী। এগুলোকে আমি ব্যতিক্রমী গুণাবলী হিসেবে দেখি না। মানুষের সহজাত তথা জন্মসূত্রে পাওয়া এই গুণাবলী তাহের আত্মস্থ করেছিলেন। আমরা অনেকইে জন্মসূত্রে অর্জন করার পরেও সেটা বহন করতে পারি না। বহন করতে পারি না কেন? আমাদের সমাজকাঠামো, স্কুল-কলেজ থেকে আরম্ভ করে, আমাদের পরিবার থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রকাঠামো, আমাদেরকে এমন ট্রেনিং দেয় যে, আমরা শুধু অনুসরণ করতে চাই। নিজের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি না। মানুষের মধ্যে ভগবান থাকেন। মানুষের মধ্যে স্বয়ং গড থাকেন। নেচার, গোটা ইউনিভার্স, তার সর্বোচ্চ-সুন্দর গুণাবলী দিয়ে মানুষ নামের একটা প্রজাতি সুষ্টি করেছে। এই প্রজাতির গুণাবলীর প্রতি আমাদের একটু সম্মান করা দরকার, নিজেদের প্রতি আমাদের সম্মান করা দরকার। আমরা কী পারি, আমরা কী পারি না, তা নিয়ে একবার ভাবা দরকার।

মাথার মধ্যে লম্বা ওয়াজ। সব কথা তোলারও উপায় নাই এখানে। সামরিকতা নিয়ে তাহেরের ধারণা সংক্রান্ত আলাপ আছে। সামরিকতা নিয়ে খোদ আমাদের সামরিক বাহিনীর ধারণা নিয়ে কথা বলার আছে। জাসদের গণবাহিনীর গঠনকাঠামো নিয়ে, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সংগঠনগত কাঠামো নিয়ে আমাদের এক্সপেরিমন্টগুলো নিয়ে কথা আছে। মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরে, পরে স্বাধীন দেশের কুমিল্লা ব্রিগেডে কর্নেল তাহের যখন ব্রিগেড-এর দায়িত্বে ছিলেন, সেইখানে উনি নতুন সেনাবাহিনীর গড়ার এক্সপেরিমেন্টগুলো চালাচ্ছিলেন সেইগুলো নিয়ে বলার আছে। সব মিলিয়ে খোদ সামরিকতা জিনিসটার জায়গা সমাজে কোথায়? সমাজতন্ত্রের সাথে সামরিকতার সম্পর্ক কী? সময়কে পাল্টে দেওয়ার জন্য ব্যক্তি-মানুষ কী করতে পারে? কত দূর করতে পারে? পরিবার কী করতে পারে? ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে একটা সমাজ কী করতে পারে? এসব নিয়ে প্রচুর কথা তোলার, বলার, অবকাশ থেকে গেছে আমাদের।

আর্টওয়ার্ক: রোড টু কমিউনিজম
শিল্পী: ভ্লাদেমির কাজানেভস্কি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

একটা জিনিস খেয়াল করা দরকার বিশেষ করে। এ দিকটা বলে কথা শেষ করব। সেটা হলো: রাষ্ট্র এবং সমাজ পরস্পরের শত্রু। রাষ্ট্র চায় গোটা সমাজ তার গোলাম হবে। আমলারা যা বলবেন, রাষ্ট্র-আইন যা বলবে, কেবল জন্ম নেওয়া বাচ্চা থেকে আরম্ভ করে মৃত্যুপথযাত্রী পর্যন্ত তা মেনে চলবে। রাষ্ট্র এই গোলামি চায়। আর সমাজ কী চায়? সমাজ স্বাধীনতা চায়। সমাজ চায় রাষ্ট্রের নামে হোক, রাজনৈতিক দলের নামে হোক, ধর্মের নামে হোক, মতাদর্শের নামে হোক, সামরিক বাহিনীর নামে হোক সমাজের ওপরে যেন গোলামি চাপানো না হয়। রাষ্ট্রের সাথে সমাজের এই যে মুখোমুখি সম্পর্ক – এ সম্পর্কটাকে খেয়াল করেন নি তাহের। লেনিন থেকে আরম্ভ করে কার্ল মার্কস থেকে আরম্ভ করে গোটা বলশেভিক ট্রাডিশন এটা খেয়াল করে নি।

কার্ল মার্কসের কাছ থেকে, গোটা বলশেভিক ট্রাডিশনের কাছ থেকে, লেনিনের কাছ থেকে আমাদের শেখার মতো অজস্র বিষয় আছে। সবচাইতে বেশি করে শিখতে হবে: আমাদের স্বপ্নসৌধ সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ঝুরঝুর করে হাওয়া হয়ে গেল একটা গুলি পর্যন্ত না ফুটিয়ে। বিনা লড়াইয়ে। বিনা প্রতিরোধে। বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলাদেশের সমান একজন নেতা যখন সপরিবারে খুন হয়ে যাচ্ছেন, কেন তখন তার বিশাল ছাত্রলীগ, তার বিশাল আওয়ামী লীগ, তার বিশাল রক্ষীবাহিনী, তার বিশাল সেনাবাহিনী চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে? সামান্যতম প্রতিরোধও দাাঁড়াচ্ছে না কেন? প্রতিরোধ কোত্থেকে আসে? স্বাধীনতা কোত্থেকে আসে? অন্ধ অনুসরণ কোত্থেকে আসে? এবং শুধুমাত্র জানবাজি ধরলেই বিপ্লব করা যায় না। শুধু লোক জড়ো করে বিপ্লব হয় না। এই সামগ্রিক জিনিসগুলো নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, একটা একটা করে, বিস্তারিতভাবে, দীর্ঘ দিন ধরে আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে সেটা বিশেষ কাজের হবে। এ ছাড়া আমাদের পথ নেই।

এখনকার কর্তব্য নির্ধারণের প্রশ্ন

আমি জানি তাহেরের আগুন বুকে নিয়ে এইখানে অনেকে উপস্থিত। আমি জানি তাহেরের আগুন বুকে বাংলাদেশে অনেক তরুণ কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশকে সার্ভ করার জন্য পথ খুঁজছে। কিন্তু ছাত্রদের রাজনীতিবিমুখতা নিয়ে এখানে শিপন অথবা তুষার যে শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন – প্রিয়ভাজন জামি আর আমার বন্ধু শিবলী আরেকটু বলেছেন যেটা নিয়ে – আমি সেটাকে সেরকমভাবে দেখি না। ওঁদের কথা এক দিক থেকে ঠিকই। কিন্তু আরেক দিক থেকে দেখলে দেখবেন: বাংলাদেশের তরুণরা খোদ ছাত্র-রাজনীতি জিনিসটাকে প্রত্যখ্যান করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ খোদ রাজনীতি জিনিসটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে আমার মনে হয়।

মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রীরা স্পেনে দুই বছরের রক্ষক্ষয়ী লড়াইয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়নের লড়াইয়ে, কিউবাতে লড়াইয়ে আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রপন্থার মারাত্মক কিপদের কথা। (প্রসঙ্গত কিউবাতে কিন্তু সমাজতন্ত্রের ধ্যানধারণা প্রথম ঢোকে স্পেন হয়ে। ফ্রান্স হয়ে। মুক্তিপরায়ণ সমাজতান্ত্রিক ধারা হয়ে। বাকুনিন হয়ে। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন হয়ে না।) গোটা পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের এই মুক্তিপরায়ণ ধারাটা কিন্তু আমাদেরকে বার বার করে বলেছে যে খোদ রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রয়োজনীয়তার কথা। রাজনীতি মানেই হচ্ছে রাষ্ট্র। রাজনীতি মানেই হলো সেনাবাহিনী। উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনীই বলেন আর যে সেনাবাহিনীই বলেন, সেনাবাহিনী সেনাবাহিনীই।

আর্টোয়ার্ক: মুক্ত কর ভয়
শিল্পী: মিতা মেহেদী
সূত্র: ফেসবুক

তাহেরের আলো নিয়ে, তাহেরের আগুন নিয়ে, তাহেরের স্বপ্ন নিয়ে, এবং ঐরকম আরো অজস্র মানুষের স্বপ্ন-আগুন-আলো নিয়ে আমরা লড়াই করে যাচ্ছি। এই আগুনকে বুকে রেখে আমরা যদি আরেকটু আলো জ্বালতে পারি, এবং সেই জ্বালা আলোতে তাহেরের, জাসদের, সিরাজ শিকদারের, হক-তোয়াহাদের, আরো সব বামপন্থী ধারার লড়াইগুলোকে, এমনকি মস্কোপন্থী পার্টিগুলির (যে পার্টিগুলির নানান ধরনের সীমাবদ্ধতা আমার দেখেছি, একাত্তরে, বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরে অদ্ভুতভাবে তারা আওয়ামী লীগের সাথে মিশে গিয়েছিল, তাদের নিজস্ব কোনো সত্তা ছিল না) কার্যক্রমকে আমরা যদি পর্যালোচনা করতে পারি তাহলে সেটা কাজের হবে। আমরা যদি বুঝি যে: রাজনীতি মানেই হচ্ছে রাষ্ট্র, বলপ্রয়োগ, সৈন্যবাহিনী, গুপ্তসংস্থা তাহলে আমরা আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারব।

যেমন ধরুন বেলাল এবং বাহার। এঁদেরকে দেখলে সেই কর্তব্য সম্পর্কে আন্দাজ পাওয়া যায়। জাসদের সেন্ট্রাল কমিটির হুকুম ছাড়াই, সিরাজুল আলম খানের সাথে যোগাযোগ করা ছাড়াই, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার হুকুম ছাড়াই ভারতীয় হাইকমিশনারকে জিম্মি করার একটা জীবন-মরণ-স্বপ্নের মতো একটা অপারেশন তাঁরা চালিয়েছিলেন। কোন বিবেচনা থেকে চালিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই এই বিবেচনা থেকে যে এখন আর হুকুম দেওয়ার কেউ নাই। এখন আর পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির মিটিং বসার মতো সময় নাই, এখন যা করার আমাকেই করতে হবে।

ছোট্ট বাচ্চা বাহার, বেলাল, ওদের বন্ধুরা – তারা আমাদেরকে পথ দেখাবে যেন আমরা কোনো রকম কেন্দ্রীভূত পার্টি, কোনো কেন্দ্রীভূত কমিটি, কোনো রকম কেন্দ্রীভূত কমান্ডের বাইরে নিজের উদ্যোগে, নিজের পাড়ায়, নিজের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে, নিজের ডিপার্টমেন্টে, নিজের পরিবারে (তাহেরের মতো), এবং সর্বত্র ওঁদের মতো স্বপরিচালিত স্কোয়াড বানাতে পারি। এইসব স্কোয়াড গোটা বাংলাদেশ কোথায় গেল তাকিয়ে দেখবে না। নিজের বিবেচনামতো কাজ করবে। এই স্কোয়াডগুলো পারস্পরিক নেটওয়ার্ক তৈরি করার মাধ্যমে, পারস্পরিক ফেডারেশন তৈরি করার মাধ্যমে একেকটা স্বাধীন-স্বতন্ত্র নিউক্লিয়াস হিসেবে সবাই মিলে কাজ করবে। স্পেনের লিবার্টারিয়ান কমিউনিস্টদের মতো। ফ্রান্সের শ্রমিকদের সিন্ডিকেটের মতো। রাশিয়ার অ্যানার্কিস্টদের মতো। তখন একজন কেন্দ্রীয় নেতা অ্যারেস্টেড হয়ে গেলেই একটা বিপ্লব হারিয়ে যাবে না। একটা কেন্দ্রীয় কম্যান্ডের সবাইকে অ্যারেস্ট করে ফেললেই একটা বিপ্লব দুই দিনের মধ্যে রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যাবে না।

কাঙ্ক্ষিত সেই বিপ্লব আমাদের সামনে আসছে। সেই বিপ্লবকে আমরা কত তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে আসতে পারি সেটাই এখন প্রশ্ন। আমাদের সাথে করমর্দনের জন্য অপেক্ষা করছে সময়। আমাদের সাথে করমর্দনের জন্য অপেক্ষা করছে রূপকথা – আরেকটা অলৌকিক ইতিহাসের পর্ব। আমরা তাকে ডেকে আনতে পারি আমাদের জীবন-কর্ম দিয়ে। খুব সামান্য ঘটনা এইটা। সাধারণ কাজ এইটা। এর জন্য আপনাকে ‘নবুয়ত’ নিয়ে আসতে হবে না। এর জন্য আপনাকে অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে আসতে হবে না। অলৌকিক ক্ষমতা আল্লাহ বলেন, প্রকৃতি বলেন, নেচার বলেন আপনার মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। একবার সেই ক্ষমতাকে ঘষা দেন: আগুন জ্বলুক, এবং সেই আগুনের আলোতে আমরা আরেকবার তাহেরকে চিনে নেই, আরেকবার ভবিষ্যতকে বানাই। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

পাদটীকা:

[১] প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি কী বস্তু তা নিয়ে কথা আছে খানিক পরে।

[২] আমাদের সেই পর্যালোচনার আংশিক বিবরণী ‘বাংলাদেশ: কর্তৃত্ব রাষ্ট্র স্বাধীনতা’ নামের একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি হিসেবে প্রণীত-প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়টুকু ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে। সেটা এই ‘অচেনা দাগ’-এ ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রের প্রচ্ছন্ন রূপকল্প’ নামে সংকলিত হয়েছে।

[৩] প্রত্যক্ষ তৎপরতা বিষয়ক ধারণা ও চর্চার জন্য দ্রষ্টব্য ডেভিড গ্রেইবার, ২০০৯; উইকিপিডিয়া, ২০১৩; ভল্টারিন ডি ক্লিরা, ১৯১২; মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ১৯৬৩।

তথ্যপঞ্জি
সেলিম রেজা নিউটন, ২০১২। ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজতন্ত্রের প্রচ্ছন্ন রূপকল্প’। দেশলাই। ২য় সংখ্যা: শ্রাবণ ১৪১৯ আগস্ট ২০১২।

আজিজুল হক রাসেল, ২০০৭। বিতর্কিত সান্ধ্য-কোর্স বাতিলের দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট। ইউকেবেঙ্গলি। http://www.ukbengali.com/NewsMain/ArchiveNewsMain/MNews.htm।

সেলিম রেজা নিউটন, ২০১১। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার: প্রসঙ্গ শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি। যোগাযোগ। সংখ্যা ১০, জানুয়ারি ২০১১।
পৃষ্ঠা ৯-৬৪।

সেলিম রেজা নিউটন, ২০১১। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার: প্রসঙ্গ শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি। যোগাযোগ। সংখ্যা ১০, জানুয়ারি ২০১১।
পৃষ্ঠা ৯-৬৪।

বিপ্রতীপ, ২০০৯। ‘অন্ধকারে লণ্ঠনের আলো’। আমার ব্লগ। ১০ই আগস্ট। https://www.amarblog.com/index.php?q=biproteep/posts/.

সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৩-ঘ। ‘জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪: তোমার দ্বেষ আমার দ্বেষ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। প্রাইম খবর, ৬ই মার্চ ২০১৩।

সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৩-গ। ‘বাংলা-বসন্ত: উদ্দেশ্য ও উপায়’। দৈনিক ইত্তেফাক, দৃষ্টিকোন পাতা, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৩।

ডেভিড গ্রেইবার, ২০১২-ক। David Graeber, “The New Anarchists”, New Left Review , Jan.-Feb. newleftreview.org/II//david-graeber-the-new-anarchists.

ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-ক। David Graeber, “Origins of Occupy Wall Street and Prefigurative Politics”, The Daily Kos, Oct , http://www.dailykos.Com/story/////-Origins-of-Occupy-Wall-Street-and-Prefigurative-Politics#.

ডেভিড গ্রেইবার, ২০০৪। David Graeber. Fragments of an anarchist anthropology (nd pr. ed.). Chicago: Prickly Paradigm Press.

ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-খ। David Graeber, ‘Occupy Wall Street’s Anarchist Roots’, Al Jazeera, ‘Opinion’ section,  Nov.

ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-গ। Dabid Graeber, ‘Situating Occupy’, Adbusters,  Dec.

ডেভিড গ্রেইবার, ২০১২-ক। David Graeber, “The New Anarchists”, New Left Review , Jan.-Feb. newleftreview.org/II//david-graeber-the-new-anarchists.

ডেভিড গ্রেইবার, ২০১২-খ। David Graeber, “The ‘Cancer’ In Occupy? An Anarchist Reponds”, The Occupied Wall Street Journal,  June.

ডেভিড গ্রেইবার, ২০১৩। The Democracy Project: A History, A Crisis, A Movement. New York: Spiegel & Grau.

ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ, ২০১৩। Encyclopaedia Britannica. First International. Retreived on the th December of . http://www.britannica.com/Ebchecked/topic//First-International.

আরিফ রেজা মাহমুদ টিটো ও পার্থ প্রতীম দাস, ২০০৮। ‘মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন: জরুরী পর্বের একটি জরুরী পাঠ ও বিবেচনা’ (আরিফ রেজা মাহমুদ টিটো ও পার্থ প্রতীম দাসের মধ্যে সওয়াল-জবাব); ওঙ্কার: ক্ষমতা, মিডিয়া ও সক্রিয়তা বিষয়ক চিন্তা-অনুশীলন প্রচেষ্টা (মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন: জরুরি পর্ব সংখ্যা); রেজাউর রহমান, সারোয়ার হোসেন সুমন, মেহেদী হাসান প্রান্ত, মোহাম্মদ আলী রুবেল, রেজাউল পারভেজ, গোলাম রাব্বানী, আরিফ রেজা মাহমুদ, এবং রীমা পারভিন কর্তৃক সম্পাদিত; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, বৈশাখ ১৪১৫ এপ্রিল ২০০৮।

আরিফ রেজা মাহমুদ টিটো, ২০০৮। ‘আন্দোলনের কর্তৃত্ব-বিরোধী ধারা: ইশতেহারের মূল প্রস্তাবনা’; ওঙ্কার: ক্ষমতা, মিডিয়া ও সক্রিয়তা বিষয়ক চিন্তা-অনুশীলন প্রচেষ্টা (মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন: জরুরি পর্ব সংখ্যা); রেজাউর রহমান, সারোয়ার হোসেন সুমন, মেহেদী হাসান প্রান্ত, মোহাম্মদ আলী রুবেল, রেজাউল পারভেজ, গোলাম রাব্বানী, আরিফ রেজা মাহমুদ, এবং রীমা পারভিন কর্তৃক সম্পাদিত; রাবি; ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, বৈশাখ ১৪১৫ এপ্রিল ২০০৮।

সেলিম রেজা নিউটন, ২০০৮-খ। ‘আইনের শাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ’, ওঙ্কার: ক্ষমতা, মিডিয়া ও সক্রিয়তা বিষয়ক চিন্তা-অনুশীলন প্রচেষ্টা (মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন: জরুরি পর্ব সংখ্যা); রেজাউর রহমান, সারোয়ার হোসেন সুমন, মেহেদী হাসান প্রান্ত, মোহাম্মদ আলী রুবেল, রেজাউল পারভেজ, গোলাম রাব্বানী, আরিফ রেজা মাহমুদ, এবং রীমা পারভিন কর্তৃক সম্পাদিত; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, বৈশাখ ১৪১৫ এপ্রিল ২০০৮।

জি. এম. স্টেক্লফ, ১৯২৮। G. M. Stekloff. History of The First International. First published: in England . Published: London, Martin Lawrence Limited. Translated: from the rd Russian edition, with notes from the th edition, by Eden and Cedar Paul. Printed: and made in England by the Dorrit Press, Ltd, London S.E.. Transcribed: by Andy Blunden. Proofed: and corrected by Chris Clayton. Marxist Internet Archive. http://www.marxists.org/archive/steklov/history-firs t-international/.

মার্কস-এঙ্গেলস, ১৮৭২। Marx and Engels (). “Fictitious Splits in the International”. Written by Marx and Engels between January and March , . Adopted by the General Council of the International Workingmen’s Association as a private circular. Published in Geneva . Progress Publisher translation.  http://www.marxists.org/archive/marx/works///fictitious-splits.htm#p.

কে. জে. কেনাফিক, ১৯৪৮। Kenneth Joseph Kenafick. Michael Bakunin and Karl Marx. Printed by A. Maller, Melbourne, Australia. [ Freedom Press, . ]

মিখাইল বাকুনিন, ১৮৬৯। Mikhail Bakunin. “The Organization of the International”. Marxist Internet Archive, http://www.marxists.org/reference/archive/bakunin/works/writings/ch.htm.

অ্যানার্কোপিডিয়া, ২০০৮। Anarchopedia. International Workingmen’s Asso-ciation. www.en.anarchopedia.org/International_Workingmen’s_Association. This page was last modified on  November , at :.

সেলিম রেজা নিউটন

লেখক